অধ্যায় ১০
সন্ধ্যার একটু পর ফোনটা এলো। রোজি তখনও পার্লারে।
“জিনিসটা কি হাতে পাইছো?” পাভেল ফোনে জানতে চাইলো।
“একটু আগে দিয়া গেছে।”
“কও কী!” ফোনের ওপাশে পাভেলের খুশিটা টের পাওয়া গেল। “তাইলে সব কিছু প্ল্যানমতোই হইতাছে!”
“হ। সবই ঠিক আছে। আমি তোমার লগে দেখা করুম সতটার দিকে। হীরাটা তোমারে দিয়া চইলা যামু বায়ারের কাছে। তারে ফোন দিয়া জানায়া দিছি, জিনিস এখন আমার হাতে আছে, সে যে ট্যাকাগুলা রেডি রাখে।”
“ওকে। আমি রেস্টুরেন্টেই থাকুম, তুমি আসো।” একটু থেমে আবার বলল, “সাবধানে আইসো…লগে তো ডায়মন্ডটা আছে।”
“একদম চিন্তা কইরো না।”
কথা শেষে ফোনটা আবার সাইলেন্ট মোডে রেখে দিলো। ঘরের মধ্যে পায়চারি করার সময় আশেক টের পেল তার ভেতরের অস্থিরতাটা আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
“আশেক?” পাশের ঘর থেকে দুর্বল কণ্ঠে ডাকলেন আর্জুমান্দ। “বেটা আমার?”
“কী হইছে, আর্জুমান্দ?” পাশের ঘরে যেতে যেতে বলল সে।
বিছানায় বসে আছেন তিনি। আশেক তার পাশে বসে পড়লো। কপালে হাত রেখে দেখলো জ্বরটা বেড়েছে কি না।
“এই বিমার ঠিক হইবে না, বেটা,” মলিন হাসি দিলেন শতবর্ষী বৃদ্ধা। “আর কতো!”
“এইসব একদম কইবা না,” অভিমানের সুরে বলল মির্জা।
“এক শ হয়ে গেছে,” আশেকের একটা হাত ধরে বললেন। “তোর জন্যই তো ইতনা সাল বাঁইচে ছিলাম। রোজি মাইয়াটা অনেক কষ্ট করছে, তুই ওরে দেইখে রাখিস।”
“কী হইছে তোমার? শরীর বেশি খারাপ? ডাক্তার ডাকুম?” ভড়কে গিয়ে বলল আশেক।
“বেচাইন হইস না। সারা দিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াস…ঠিকমতো বাতচিতও হয় না। এখন একটু মন দিয়া শোন, বেটা।“
“আচ্ছা কও, কিন্তু মইরা-টইরা যাওনের কথা কইবা না, ঠিক আছে?”
মলিন হাসি দিলেন আর্জুমান্দ। “ছোটা বেটারে সব সময় নিজের ভাই মনে করবি। এই দুনিয়াতে ওর আর কেউ নাই।“
আর্জুমান্দ বানু চার্লিকে ছোটা বেটা বলে ডাকে। এটা ছাড়াও ‘মির্জা শায়ক’-এর মতো সুন্দর একটা নামও দিয়েছিলেন, যদিও কেউ তাকে ঐ নামে ডাকে না। পিচ্চিকালে বেশি ভাড়ামো করতো বলে আশেক তাকে চার্লি নামে ডাকতে শুরু করে—ওটাই তার নাম হয়ে গেছে।
“ওর বয়স হয়েছে, ওরে একটা শাদি করাইতে হইবো।”
“তুমি আর রোজি একটা মাইয়া দেইখা ওর বিয়া করায়া দিও।”
“আমার ওয়াক্ত নাইরে, বেটা,” বিষন্ন মুখে বললেন আর্জুমান্দ।
“তোমারে না কইলাম- “
আশেকের মুখের উপর হাত রাখলেন আর্জুমান্দ বানু। “আমার কথা শোন। এই মাকানটা…জমিনটা নওয়াবসাব আমারে ওয়াক্ফ আল-আওলাদ করে দিয়া গেছেন।“
আর্জুমান্দ বানু যে নওয়াবসাবের কথা বলছেন, তার পরিচয় তিনি কখনও কারো কাছে প্রকাশ করেননি প্রয়াত স্বামীর সম্মান রক্ষার্থে। বহু কাল আগে, তার বয়স যখন সতেরো কি আঠারো, উত্তর ভারতের কোনো এক অঞ্চল থেকে ঢাকার নবাবদের শাহবাগের ইশরাত মঞ্জিল আর দিলকুশার বাগানবাড়িতে মুজরো করতে এসেছিলেন। নবাব পরিবারের কোনো এক যুবকের সঙ্গে প্রণয় হয়ে যায় তার। এই প্রণয় এতটাই তীব্র ছিল যে, দলের বাকিরা ঢাকা ছেড়ে গেলেও তিনি রয়ে যান। ‘নওয়াবসাব’ তার জন্য একটা কুঠি বানিয়ে দেন, পরিবারের অগোচরে বিয়েও করে ফেলেন। কিন্তু কলেরার মহামারীতে অল্প বয়সেই মারা যান তিনি। ততদিনে দেশভাগ হয়ে গেলেও স্বামীর স্মৃতি আকড়ে পড়ে থাকেন আর্জুমান্দ বানু
“এই জমিনটা তুই কখনও বেচবার পারবি না, বেটা। ওয়াকফ জমিন কখনও বেচা যায় না,” একটু থেমে আবার বললেন, “আমি তোকে মোতওয়াল্লি বানিয়ে দিবো…তুই এইখানে একটা মাকান বানাবি, ছোটা বেটারে একটা ঘর দিবি। বাকিটা তুই আর রোজি…” দম ফুরিয়ে গেল আর্জুমান্দের।
পরম মমতায় আর্জুমান্দের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আশেক।
“আরেকটা কথা,” চোখদুটো বন্ধ করে ফেললেন বৃদ্ধা। “দুদুরে মাফ কইরে দিস।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো আশেক, অমনি তার মনে পড়ে গেল বইটার কথা। “তোমারে একটা জিনিস দেখাই…” ঘর থেকে বের
হয়ে ফিরে এলো দুদুর লেখা বইটা নিয়ে। আর্জুমান্দের দিকে বাড়িয়ে দিলো সেটা।
“এইটা কী, বেটা?”
“দুদু তোমারে নিয়া বই লেখছে।”
“আমারে নিয়া?!” অবাক হলেন বৃদ্ধা।
“হ। নাম দিছে ‘হাসনাহেনার কাব্যগাঁথা’ …মানে,হাসনাহেনার শায়েরী।”
বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলেন এক সময়কার নর্তকী। বইটার প্রচ্ছদ রাজকীয় পোশাকের এক অনিন্দ্য সুন্দরির পেইন্টিং-আভিজাত্য আরোপ করতে সেই সুন্দরির মাথায় ঘোমটা টানা। নিশ্চিতভাবেই এটা আর্জুমান্দের ছবি নয়—তবে তাকেই চিত্রিত করেছে।
আশেক প্রথমে উৎসর্গটা পড়ে শোনালো। কথাগুলো শুনে চোখ বন্ধ করে ফেললেন আর্জুমান্দ।
এরপর মূল লেখা যেখান থেকে শুরু সেটা পড়বে কি না দ্বিধায় ভুগলো কয়েক মুহূর্ত। গভীর করে শ্বাস নিয়ে অবশেষে পড়ে শোনালো আর্জুমান্দকে :
হাসনাহেনার কথা কী আর বলবো!
লাল টকটকে লিচুর মত দেখতে তার মুখ। সেই গোলাকার মুখের থুতনিটা বেশ তীক্ষ্ণ, কমলার কোয়ার মতো ফোলা ফোলা দুটি ঠোঁট। নাকের ছোট্ট পাটা দুটো প্রতিটি নিশ্বাসের সাথে ফুলে ফুলে ওঠে। জীবন্ত করে তোলে তার আপাত অভিব্যক্তিহীন মুখটাকেও! দেহবল্লরী যেন রেশমি কাপড়ে মোড়ানো—মসৃণ আর পেলব। পরিপক্ক লেবুর গায়ে যদি হাল্কা গোলাপি আভা যোগ করা হয় তবে তার গায়ের রঙটা পাওয়া যাবে। নীলচে কালো গভীর অন্তর্ভেদী চোখদুটো যেন আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘ।
হাঁটলে তার শরীর জলভর্তি কলসির মতো টলোমলো করে ওঠে। সুন্দর, সাবলীল আর বেপরোয়া! যেন নিঃশব্দ সঙ্গিতের তালে তালে পা ফেলে সে। তার এই ভঙ্গিমা যেকোন ঝাণু নর্তকীকেও ঈর্ষাকাতর করে তোলে।
সব শব্দের অর্থ বুঝতে না পারলেও অশ্রুরত আর্জুমান্দের মুখে এক ধরণের প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল। দুদু যে তার যৌবন কালের রূপের বর্ণনা করেছে সেটা বুঝতে পেরেছেন।
বইটা আর্জুমান্দের জীবনের গল্পের আদলে লেখা একটি উপন্যাস। সেই গল্পের নায়িকা হাসনাহেনা বাঈ নামের অনিন্দ্য সুন্দরি এক নতর্কী।
চোখ বন্ধ করে ফেললেন আর্জমান্দ বানু। “কিতনা সাল বাদ নামটা শুনলাম!”
ভুরু কুঁচকে ফেলল মির্জা। “তোমার নাম হাসনাহেনা বাঈ?!” কিন্তু আর্জুমান্দ কিছু বলার আগেই আশেক টের পেল, তার পকেটের ফোনটা ভাইব্রেট করছে।