দরিয়া-ই-নুর – ৬

অধ্যায় ৬

“ছাপান্ন ছুরি? এইটা আবার কিমুন নাম?”

চার্লির প্রশ্নের হেসে ফেললেন আর্জুমান্দ। দুয়ারে পাতা চেয়ারটায় বসে আছেন তিনি, পেছনে দাঁড়িয়ে শতবর্ষী আর্জুমান্দের রূপালী রঙের চুলগুলোতে নারকেল তেল মাখিয়ে দিচ্ছে ছেলেটা।

“আসল নাম ছিল জানকী বাঈ। এখানকার মাইয়া ছিল না, এলাহাবাদের মাইয়া ছিল।”

“এলাহাবাদ? এইটা কুন জায়গায়?”

“অনেক দূরে…হিন্দুস্তানে, বেটা।’

“ও,” চার্লি গল্প শুনতে আগ্রহী হলেও তাকে দেখলে মনে হবে সে বুঝি চুলে তেল মাখাতেই বেশি মনোযোগী।

“মুজরা করতে ঢাকায় আইসেছিল…আর যায় নাই। একদিন মুজরা করতে দেড় হাজার টাকা নিতো!”

“মাত্র দেড় হাজার ট্যাকা?” অঙ্কটা চার্লিকে মোটেও মুগ্ধ করলো না।

স্মিত হেসে ফেললেন আর্জুমান্দ। তার অভিজাত অবয়বে এমন হাসি আরো বেশি আভিজাত্য আরোপ করে। “একশো বছর আগের কথা, তখন দেড় হাজার মানে, এখন কয়েক লাখ হবে।”

চার্লির ভুরু কপালে উঠে গেল। “ও, তাইলে ঠিক আছে।”

“এক নওয়াবসাহেব জানকীর প্রেমে পড়ে গেলেন, কেউ যেন তার কাছ থেকে জানকীকে কেড়ে নিতে না পারে সেজন্যে কী করলেন, জানিস?”

“একটা ঘরে তারে আটকায়া রাখলো?”

মাথা দোলালেন আর্জুমান্দ। মুখে এখনও হাসি লেগে আছে। “আরো কঠিন কিছু করেছিলেন।”

“কী করছিল?”

“জানকীর সারা জিসমে ছাপ্পান্ন ছুরি মেরেছিলেন নওয়াবসাহেব।”

“কী!?” অবাক হলো চার্লি। “এতগুলান ছুরি মারলো তারে মারার জন্য?”

“নারে, বেটা…মারার জন্য মারেনি। আর কোনো পুরুষ যেন ওর রূপে দিওয়ানা না হয় তাই…”

“হায় আল্লাহ! এই তার পেরেম?”

এবার শব্দ করে হেসে ফেললেন আর্জুমান্দ। “তুই এসব বুঝবি না।”

“আমার বুঝনের দরকার নাই,” একটু রেগেমেগেই বলল চার্লি।

“নওয়াবসাহেব তারে বহুত মহব্বত করতেন, একটা বাড়ি করে দিয়াছিলেন…মাসোহারাও দিতেন। “

“মাসোহারা?” এই শব্দটার সাথে চার্লি পরিচিত না।

“মাসে মাসে টাকা দিতেন।”

“ও…বেতন দিতো।”

হেসে ফেললেন আর্জুমান্দ। “হুম…বেতন দিতো।”

“বেতন যে পাইতো, হের কামটা কি আছিল?”

চোখ বন্ধ করে ফেললেন আর্জুমান্দ, একটু রুষ্ট হলেন মনে হলো। “ভালো করে তেল দে, এত কিস্সা শুনতে হবে না!”

চার্লি কিছু বলতে যাবে অমনি রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলো রোজি। “সাল্লে মিয়ার দোকান থেইকা আধাকেজি মসুরের ডাইল নিয়া আয়,” চার্লির দিকে একশ’ টাকার নোট বাড়িয়ে দিলো সে।

বিরক্ত হলো ছেলেটা। “সব কাম একবারে দিতে পারো না? সকালে যে গেলাম তহন ডাইলের কথা কইলা না ক্যান?”

“মনে আছিল না,” রোজি স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল।

“খাড়াও, হাত ধুইয়া আহি। হাতে দুনিয়ার ত্যাল…” বাথরুমের দিকে চলে গেল চার্লি।

“আশেক কই, বেটি?” আর্জুমান্দ জানতে চাইলেন।

“বিকালে বাইর হয়া গেছে।”

“এত দিন পর বাইর হইলো, কয়েকটা দিন বাড়িতে থাকবো না? এখন তার কী কাজ?”

ঠোঁট ওল্টালো রোজি। আজকে পার্লারে বৈদ্যুতিক লাইনে সমস্যার কারনে তাড়াতাড়ি এসে পড়েছে। “সারাদিন কি ঘরে বইসা থাকবো? গেছে হয়তো পুরানা ইয়ার-দোস্তগো লগে দেখা করতে।“

“হ, ইয়ার-দোস্তের লগেই দেহা করতে গেছে,” একটা গামছায় হাত মুছতে মুছতে বাইরে এসে বলল চার্লি। “পাভেল মিয়ার লগে মোলাকাত করতে গেছে।”

কথাটা শোনামাত্র রোজির ভুরু কুঁচকে গেল। “পাভেলের লগে দেখা করতে গেছে?!”

“হ।” দুয়ারে একটা টানা দড়ির উপরে গামছাটা রেখে হাত বাড়ালো চার্লি, “ট্যাকা দাও?”

“ওর লগে ক্যান দেখা করতে গেছে? ওর লগে কী কাম?” রীতিমতো রেগেমেগে জানতে চাইলো।

“আমি কেমনে কমু,” টাকাটা নিয়ে বের হয়ে গেল চার্লি।

দুশ্চিন্তায় কপালের ভাঁজ আরো ঘন হলো রোজির।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *