দরিয়া-ই-নুর – ১

অধ্যায় ১

‘রসিয়া তোরি আঁখিয়ারে,
জিয়া লাল চায়…’

বয়স তার সব কিছু গ্রাস করে ফেলেছে, বাকি ছিল কণ্ঠটা, এখন সেটাও পর্যুদস্ত। এক সময় সাবলীলভাবে, অনায়াসে যে সুর তুলতে পারতেন, সেটা করতে গেলে এখন প্রচণ্ড শক্তির প্রয়োজন হয়, গলায় এবং বুকে চাপ অনুভব করেন তিনি। এই যেমন এখন হচ্ছে। সাধারণ একটা ঠুমরী, এ জীবনে কতো শতবার গেয়েছেন, কিন্তু এখন গলায় তুলতেই পারছেন না। হাল ছেড়ে দিলেন, দম ফুরিয়ে গেছে এরই মধ্যে। গলা ছেড়ে, প্রাণ খুলে গান গাইতে না পারার যে কী কষ্ট সেটা অন্য কেউ বুঝবে না।

রোদ পোহাবেন বলে ঘরের সামনে এক চিলতে খালি জায়গায় পুরনো একটা চেয়ার পেতে বসে আছেন আর্জুমান্দ বানু। কিন্তু দু-দিন ধরে কুয়াশা পড়ছে সাদা চাদরের মতো, শীতের তেজও বেড়ে গেছে অনেক, রোদের দেখাই মিলছে না।

ভারি কুয়াশা তার ছানি পড়া চোখের দৃষ্টি আরো বেশি ঘোলাটে করে তুলেছে। সেই ঘোলা চোখে ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে বসে আছেন তিনি। এখন শুধু স্মৃতিটাই তার সম্বল। বুজর্গরা বলে, সময় ফুরিয়ে এলে মানুষ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। তিনিও জানেন তার সময় শেষ হয়ে এসেছে।

আজকাল মাঝেমধ্যেই কানে শুনতে পান তবলার বোল, এসরাজের মোলায়েম সুর, তানপুরার অবিরাম সা-পা ধ্বণি। ইচ্ছে করে দৌড়ে ছুটে যাবেন সামনের খোলা দুয়ারে, হাতে মুদ্রা ধরে, তাল মিলিয়ে নাচবেন। কিন্তু সে সাধ্য তার নেই। চলৎশক্তি প্ৰায় হারিয়ে ফেলেছেন। দিনের বেশিরভাগ সময় এই চেয়ারেই বসে থাকেন এখন।

চোখ বন্ধ করে আর্জুমান্দ বানু ডুব দিলেন স্মৃতির দরিয়ায় : সুরের মূর্ছনায় অবিরাম নেচে যাচ্ছেন। নাচতে নাচতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন তিনি। নতুন উদ্যমে আবারও শুরু করলেন। চারপাশে অসংখ্য মুগ্ধ চোখের মধ্যে একজোড়া চোখ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিয়ে দেখছে তাকে। তার রূপ, কণ্ঠ, সুর আর নৃত্যে মাতোয়ারা সেই দৃষ্টি। একটু ঝুঁকে সেলাম ঠুকে মেহফিল শেষ করলেন, কিন্তু ঐ একজোড়া চোখে সেই মুগ্ধতা যেন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

“আর্জুমান্দ!”

পুরুষ কণ্ঠের ডাকটা শুনে চমকে উঠলেন তিনি, চোখ মেলে তাকালেন বাস্তব দুনিয়ায়।

“আমার আর্জুমান্দ!”

প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে পুরুষ কণ্ঠটা ডাকছে। এই কণ্ঠ তার অনেক দিনের চেনা। ঘোলা চোখে দেখলেন একটি পুরুষ অবয়ব এগিয়ে আসছে তার দিকে। দিবাস্বপ্ন দেখছেন না তো? কিন্তু তাকে বিস্মিত করে অবয়বটি কাছে এসে তার দিকে ঝুঁকলো, পরম মমতায় দু-হাতে তুলে নিলো তার মুখটা।

“কেমন আছো তুমি?”

দেখতে পেলেন, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মির্জা আশেক। খুশির ঝলকে চপলা কিশোরির মতো চেয়ার ছেড়ে উঠতে চাইলেন, সঙ্গে সঙ্গে আশেক তাকে জড়িয়ে ধরলো, বসিয়ে দিলো চেয়ারে।

“বেটা আমার!” অস্ফুটস্বরে বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলেন আর্জুমান্দ। উজার করে কাঁদলেন তিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *