অধ্যায় ১৫
জেলজীবনের শুরুর দিকে আশেক এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে, আত্মহত্যা করার কথাও ভেবেছিল। জেলের চারদেয়ালে বন্দি হয়ে বিশ-বাইশটা বছর থাকতে হবে ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসতো তার।
কিন্তু সময় সব কিছু সারিয়ে তোলে। ধীরে ধীরে জেলজীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে আশেক। তার মতোই যাবজ্জবীন সাজা পাওয়া অনেক কয়েদী ছিল। তারা বলতো, শুরুর দিকে সবারই এ রকম লাগে। মনটাকে শক্ত করলেই মানিয়ে নেয়া যায়। তাই করেছিল সে, তবে নিজের জন্য নয়-আর্জুমান্দ আর রোজির জন্য।
নিয়মিত দেখা করতে আসতো রোজি আর চার্লি। শুরুর দিকে খুব কান্নাকাটি করতো মেয়েটা। আশেক তাকে বোঝাতো এভাবে জীবনটা নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। সে যেন ভালো একটা ছেলে দেখে বিয়ে করে ফেলে। যতো বার এ কথা বলেছে, ততো বারই রোজি মাসের পর মাস জেলে না এসে কঠিন শাস্তি দিয়েছে তাকে। চার্লিকে দিয়ে অবশ্য জামা-কাপড় আর খাবার পাঠাতো। এই অভিমান ভাঙাতে মাফ চেয়ে ছোট্ট একটা চিরকুট গুঁজে দিতে হতো চার্লির কাছে।
জেলে এক নতুন জগত আবিষ্কার করে আশেক। ওখানকার প্রায় সবাই নিজেদেরকে সব সময় নিষ্পাপ দাবি করে-কথাটা মোটেও সত্যি নয়। অনেকেই অকপটে স্বীকার করে নিজেদের কৃতকর্মের কথা, অনুশোচনায় দগ্ধও হয়।
তবে বিনা অপরাধেও অনেকে জেল খাটে। তারা হয়তো কপালের দোষ দেয়, নয়তো মনে করে ষড়যন্ত্র করে তাদেরকে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে। আশেকের ব্যাপারটা সেদিক থেকে একটু ভিন্ন। সে বিনা অপরাধে জেলে আসেনি, আবার এটাও ঠিক, তাকে ষড়যন্ত্র করেই ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে!
জেলে তার সঙ্গে পরিচয় হয় বেশ কিছু মানুষের, তারা বিশ্বাস করেছিল তার গল্পটা। সেই সব মানুষগুলোই হয়ে উঠেছিল তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন।
জেলজীবনের সপ্তম বছরে ঘটে অদ্ভুত একটি ঘটনা। ততদিনে আশেক কাঠমিস্ত্রির কাজ শিখে ফেলেছে। নতুন জেলার কীভাবে যেন জেনে গেছিলেন তার এই দক্ষতার কথা। তাকে দিয়ে নিজের ঘরের একটা আসবাব বানিয়ে নেন তিনি। আশেকের কাজে দারুণ খুশি হয়েছিলেন জেলার। প্রায়শই নিজের অফিসে ডেকে নিয়ে চা খাওয়াতেন, গল্প করতেন তার সঙ্গে। স্বাভাবিকভাবেই আশেকের গল্পটা শুনতে আগ্রহি হন এক সময়।
কোনো কিছুই লুকায়নি সে, সত্যিটাই বলেছিল। আর সব শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য থ বনে যান জেলার। তারপর যা বলেন, সেটা শুনে আশেকই বিমূঢ় হয়ে পড়ে
দুদুমাস্টারকে জেলার চেনেন! তারা ছেলেবেলার বন্ধু!
সর্বহারাদের দল থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসার পর এই জেলারই দুদুকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নিজের হলে কিছুদিন থাকার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি দুয়েকটা টিউশনিও জোগাড় করে দিয়েছিলেন তাকে। দুদু লাপাত্তা হবার সময় জেলার সদ্য বিসিএস ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ পেয়ে ট্রেনিংয়ে ছিলেন।
এ ঘটনার পর থেকে মির্জা আশেকের সঙ্গে জেলারের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
জেল থেকে মুক্তি পাবার তিন বছর আগে ঘটে আরেকটি ঘটনা। এটাও কম আশ্চর্যের ছিল না। দুদুর পরিণতি নিয়ে জেলার আর আশেকের মনে যে প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছিল দীর্ঘদিন থেকে, তার জবাব এক লহমায় পেয়ে যায় মতি নামের এক কয়েদীর কাছ থেকে। জেলের ভেতরে আশেকদের যে ঘনিষ্ঠ চক্রটি ছিল, সেখানে খুব অল্প সময়েই জায়গা করে নেয় মতি। তার দাবি, সে নির্দোষ। মতি নামের আরেকজন খুনির জায়গায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। আর এটা হয়েছে তার অন্য একটি পাপের কারনে! স্বভাবতই ঘনিষ্ঠ কয়েদীরা জানতে চেয়েছিল, কী এমন পাপ করেছিল সে? মতি তখন তার গল্পটা বলে।
প্রায় এক যুগ আগে সে ছিল ঢাকা শহরের এক নেতার খুবই বিশ্বস্ত একজন মানুষ। একদিন ঐ নেতা মতিকে সঙ্গে নিয়ে পরীবাগ থেকে এক লোককে তুলে আনে তাদের গোপন আস্তানায়। লোকটাকে নির্যাতন করে তারা জানতে চায়, বিপুল পরিমাণের টাকা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে সে। কিন্তু প্রচুর মারধর করলেও লোকটা কিছুই বলেনি। কঠিন প্রকৃতির লোক ছিল।
“হাত-পা-মুখ বাইন্ধ্যা মারছি দুইজনে মিইল্যা,” বলেছিল মতি। “কিন্তু মানুষটার কইলজা আছিল…একটুও ডরায় নাই। শেষের দিকে মাইর খায়া হাসতো আর কইতো, ট্যাকাগুলার খোঁজ দিলেও সে মরবো, না দিলেও মরবো।”
সারা রাত নির্যাতন করার পর ভোরের দিকে লোকটা মারা যায়। মৃত্যুর আগে একটু পানি খেতে চেয়েছিল কিন্তু মতির ঐ নেতা পানি না দিয়ে লোকটার বুকের উপর চেপে বসে, টাকাগুলো কোথায় আছে জানতে চায় আরেক বার। লোকটা মারা যাবার পর ঐ নেতা মতিকে বাধ্য করে লাশটা টুকরো টুকরো করে একটা বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দিতে।
মতির গল্প শেষ হবার পর পাথরের মতো জমে যায় মির্জা আশেক। দুদুমাস্টারের এমন পরিণতি হয়েছে, ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি।
তার বাল্যবন্ধু পাভেল টাকার জন্য এমন কাজ করতে পারলো? কোটি টাকারও বেশি ভাগ পেয়েছিল সে, তারপরও আরো বেশি পাবার লোভে এতটা অমানুষে পরিণত হয়ে গেল!
ঐ দিন আশেক কাউকে কিছু বলেনি। কয়েকটা দিন থম মেরে ছিল। তারপর এক বিকেলে সেলের বাইরে, মাঠের এককোণে মতিকে ডেকে নিয়ে জানিয়েছিল সবটা। সব শুনে হতভম্ব হয়ে পড়ে মতি, কাঁদতে শুরু করে সে।
আশেক কঠিন প্রতীজ্ঞা করে, যতো বয়সকালেই জেল থেকে বের হোক না কেন পাভেলকে সে ছেড়ে দেবে না। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি তার সাজা সাত বছর কমে যাবে। তিন মাস আগে জেলার যখন তাকে জানায়, আগামী ডিসেম্বরে মুক্তি পাবে সে, তখন থেকেই পরিকল্পনা করতে শুরু করে দেয়।
মূল্যবান অ্যান্টিক পাচারের দায়ে জেলে ছিল মনু জায়গীরদার নামের এক ডায়মন্ড ব্যবসায়ী, আর জাল টাকা বানাতে গিয়ে ধরা পড়েছিল ইদ্রিস আকন্দ। আশেকের সঙ্গে তাদের দু-জনেরই ছিল দারুণ সখ্যতা। আশেকের মতো তারাও বাকি সাজা মওকুফ হয়ে জেল থেকে মুক্তি পাবে ডিসেম্বরে। পুরো পরিকল্পনাটা করতে সাহায্য করে এ দু-জন।
মনু জায়গীরদার একদিন গল্প করতে করতে জানিয়েছিল, নব্বইর দশকে স্বৈরাচার হিসেবে কুখ্যাত লোকটা ব্যাঙ্ক থেকে দরিয়া-ই-নুর সরিয়ে সেখানে একটা রেপ্লিকা রেখে দিয়েছে। আর সেই রেপ্লিকাটা সরবরাহ করেছে সে নিজেই।
গল্পটা আশেককে আকৃষ্ট করে। এই দরিয়া-ই-নুরের কথা আর্জুমান্দের কাছ থেকেও শুনেছে।
এদিকে ইদ্রিস আকন্দ ধরা পড়ার পর বেশি সাজার ভয়ে পুলিশের কাছে স্বীকার করেনি, তার বাড়ির গোপন এক জায়গায় দশ কোটি জাল টাকা এবং টাকা ছাপানোর সরঞ্জাম লুকিয়ে রেখেছে। ঠিক করেছিল, বের হবার পর লুকিয়ে রাখা জাল টাকাগুলোসহ সব সরঞ্জাম ধ্বংস করে ফেলবে।
কিন্তু মুক্তি পাবার আগে আশেক তাকে বলেছিল, ওগুলো ধ্বংস না করে তাকে দিয়ে দিতে। সে ওগুলো ব্যবহার করে পাভেলকে ফাঁসাবে। সব শুনে ইদ্রিস আকন্দ কেবল রাজীই হয়নি, নিজে জহুরি সেজে অংশও নেয়।
মুক্তি পাবার আগে দিয়ে আশেককে জেলার ডেকে নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, জেল থেকে বের হয়ে সে দুদু হত্যার প্রতিশোধ নেবার পরিকল্পনা করছে কি না। আশেকের জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারেননি জেলার। তাকে এসব না করে নতুন করে জীবনটা শুরু করার কথা বলেন তিনি। কোনোভাবেই যেন খুনখারাবি করার কথা না ভাবে সে। আশেক তখন জেলারকে আশ্বস্ত করে জানায়, এরকম কিছুই করবে না।
“তাহলে কী করবে, তুমি?” জেলার জানতে চান তখন। “কিছু একটা যে করবে সে ব্যাপারে আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর!”
দ্বিধা থাকলেও এক পর্যায়ে আশেক তার পরিকল্পনার কথা বলে দেয় জেলারকে। সব শুনে চুপ মেরে যান ভদ্রলোক। অবশেষে বলেন, সে যে পরিকল্পনা করেছে সেটা করলে নির্ঘাত ধরা খাবে, আবারো তাকে ফিরে আসতে হবে জেলে। কিন্তু সেটা যেন না হয়, তার ব্যবস্থা তিনি করবেন!
এ কথা শুনে চমকে যায় আশেক।
জেলার তার পিঠে হাত রেখে আস্তে করে বলেন, কাগজে- কলমে তাকে মুক্তি দেয়া হবে ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে, কিন্তু জেল থেকে সে বের হয়ে যাবে ১৫ তারিখ দুপুরে! ৩১ তারিখের আগেই তাকে কাজটা করতে হবে। জেলার আরো জানান, তার ছোটভাই এখন ডিবিতে আছে, পাভেলকে গ্রেফতারের কাজটা তাকে দিয়ে অনায়াসে করানো যাবে।
জেলার আরো বলেন, পাভেল একবার জেলে ঢুকলে দুদুর বন্ধু হিসেবে তিনি কিছু একটা করবেন!
সব শুনে আশেক দারুণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।
মনু জায়গীরদার জেল থেকে বের হয় ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে, আশেককে দরিয়া-ই-নুরের রেপ্লিকাটা দিয়ে চিরতরের জন্য দেশ ছাড়ে সে, চলে যায় তার মায়ের দেশ ফ্রান্সে। আর ইদ্রিস আকন্দ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গোপন জায়গা থেকে জাল টাকা আর সরঞ্জামগুলো বের করে আশেককে দিয়ে দেয় এ কাজে ব্যবহার করার জন্য।