প্রথম অধ্যায়
“খুন! সবাই এটাই কেন জিজ্ঞেস করে বলুন তো আগে?” শশাঙ্ক পালিত দাঁতের ফাঁকে হাসল। তারপর মিনমিন করে নিতান্ত অদরকারি কথার মতো বলল, “যে মৃত্যুগুলো হয়েছে সেগুলোর সবকটাই বলা যায় ন্যাচারাল ডেথ। আনইউজুয়াল সেরকম কিছু নেই!”
নীলাদ্রি এতক্ষণ সিঁড়ির নিচের খসে পড়া প্লাস্টারের তাপ্পি দেওয়া কড়িকাঠের দিকেই তাকিয়েছিল। এবার মাথা নামিয়ে বলল, “ডেথ ব্যাপারটাই ন্যাচারাল নয় শশাঙ্কবাবু, সে বিছানায় শুয়ে হোক কিংবা পাহাড় থেকে পড়ে।” শশাঙ্ক আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিল সুনন্দা। তুলির ঘুমন্ত মুখটা নিজের এক কাঁধ থেকে অন্য কাঁধে বদলে নিয়ে বলল, “ডেথটা আমাদের কনসার্ন নয়; বাড়ির যা অবস্থা দেখেছি তাতে যে কোনো সময় ছাদ খসে পড়তে পারে। বিশেষ করে বর্ষাকালটা…”
“অমন দেখে মনে হয় দিদিভাই, এ কি আর আজকের নরম গাঁথনির বাড়ি? খাস জমিদারবাবুর নিজের তদারকিতেই তৈরি…”
“জমিদারবাবু আর বেঁচে নেই।” নীলাদ্রি বলে ওঠে, “তাই ছাদ ভাঙলে সেটা তার ঘাড়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই। আমাদেরই প্রাণটা খোয়া যেতে পারে।” একটু থেমে আবার বলল, “শুনেছি সাউথের বিল্ডিংটা একটু পাকাপোক্ত আছে। ওদিকটায় তো দিতে পারতেন? “
শশাঙ্কর মুখ দেখে মনে হল সে ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হয়েছে কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে চাইছে না। জোর করে আগের হাসিটা হেসে বলল, “ওদিকে এখনও পাইপের জলের ব্যবস্থাটা হয়নি, আপনারা যদি কুয়ো থেকে জল নিয়ে কাজ চালাতে পারেন তাহলে আমাদের অসুবিধা নেই।”
নীলাদ্রি আর কিছু বলল না। সুনন্দাও মুখ নামিয়ে নিয়েছে। থাকার জায়গা নিয়ে খুব বেশি বিলাসিতা করার মতো ক্ষমতা থাকলে কলকাতা ছেড়ে এই গঞ্জে পুরানো জমিদারবাড়িতে ঠাঁই নিতে হত না। একমাস হল নীলাদ্রির মার্চেন্ট অফিসের চাকরিটা চলে গেছে। সুনন্দা বাড়িতে টিউশনি করত বেশ কয়েকটা। তাছাড়া জমানো টাকাও খানিকটা ছিল। কিন্তু তাতে আর যাই হোক মাসে মাসে বাড়িভাড়া গুনলে চলে না। ফলে বাধ্য হয়ে প্রস্তাবটা গ্রহন করতে হয়েছে। প্রস্তাবটাও ভারি অদ্ভুত। সুনন্দাই এক ছাত্রের মায়ের মুখে প্রথম জানতে পারে খবরটা। এক ধনী দম্পতি সপ্তাখানেকের জন্যে জরুরি দরকারে বিদেশ যাচ্ছেন। তাদের একটি বছর দশেকের মেয়ে আছে। ঘটনাচক্রে সেই মেয়েটিকে এক্ষুনি তারা নিয়ে যেতে চাইছেন না। ফলে সাতদিনের জন্যে এমন কাউকে তাদের দরকার যারা মেয়েটির দেখাশোনা করতে পারে।
তবে নিজের বাড়িতে মেয়েটিকে আনা যাবে না। হুগলী সদর থেকে বেশ খানিক ভিতরে জামালপুর থানার অধীনে একটা ছোট জনপদ আছে— চকদীঘি সেখানে একটা পুরনো জমিদারবাড়ি সরকারি তত্ত্বাবধানে লিজ নিয়েছেন এনারা। এই একটা সপ্তাহ মেয়েটিকে নিয়ে সেইখানেই থাকতে হবে। মেয়েটির ঠিক মতো দেখাশোনা হচ্ছে কিনা সেটা দেখার জন্যে কয়েকজন লোককে বাড়িতেই রাখা হবে। বাদ বাকি সমস্ত দায়িত্ব তাদের নিজেদের।
প্রস্তাবটা শুনে প্রথমে কিছুতেই রাজি হতে চায়নি নীলাদ্রি। গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলেছিল, “উঁহু, এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন দু’নম্বরি ব্যাপার আছে। নিজের মেয়েকে কেউ অন্যের কাছে রেখে যায় নাকি? তাও আবার আজকের সময়…”
“অন্যের কাছে কোথায় রাখছে? বাড়ি ভর্তি ওদের লোকজন থাকবে। আমাদের খালি কয়েকদিনের জন্যে মা-বাবার মতো দেখাশোনা করতে হবে। ইটস টু ইজি…”
তাও গাঁইগুই করেছিল নীলাদ্রি, “তারপর মেয়েটার কিছু গণ্ডগোল হলে? সব দোষ কিন্তু তোমার-আমার ঘাড়ে চাপবে।”
“ওইটুকু মেয়ের কী হবে? আর আমরা দুটো এতবড় মানুষ একটা দশ বছরের মেয়েকে সামলাতে পারব না!”
শেষপর্যন্ত কিন্তু যুক্তিতর্ক ধোপে টেকেনি। পকেটে টাকাপয়সা না থাকলে ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলে আলাদা করে কিছু থাকে না। নীলাদ্রিও রাজি হয়েছে শেষ অবধি। সুনন্দা পা বাড়িয়েই ছিল। তুলিকে দেখার পর থেকে দু’জনের যেটুকু কিন্তু-কিন্তু ভাব ছিল সেটাও কেটে গেছিল।
যোগেন্দ্র নাথ আর অরুণিমা নাথ নিজেরা থাকেন কলকাতার ভবানিপুরে। নিজস্ব তিনতলা বাহুল্যে ভরা বাড়ি। সেখানে গিয়ে ডাইনিঙে বসতে প্রথমে একটু ভয়-ভয় লাগছিল সুনন্দার। এত সাজানো গোছানো বড়লোকের বাড়িতে সে আগে পা রাখেনি কোনোদিন। বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল দোতলাটার দিকে। সেখানে বারান্দার গ্রিলের গা ঘেঁষে উঁকি দিচ্ছে বেগুনি বোগেনভিলিয়ার ঝাঁক।
মজার কথা হল প্রস্তাবটায় নীলাদ্রি রাজি হওয়ার পর থেকেই সুনন্দার নিজের উৎসাহে ভাঁটা পড়েছে। উলটে একটা অজানা আশঙ্কা এসে চেপে ধরেছে তাকে। মেয়েটা যদি রাজি না হয়?
এমনিতে সুনন্দা সবার সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি মিশে যেতে পারে। ফলে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাচ্চামানুষের খেয়াল কেই বা বলতে পারে? আচমকা যদি বেঁকে বসে তাহলে এক ধাক্কায় সব বানচাল হয়ে যাবে।
নাথ-দম্পতী কিন্তু সে আশঙ্কা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “তুলির সঙ্গে একবার মিশে দেখুন না, আপনি ওকে নয়, ওই আপনাকে শাসন করবে।”
“ওকে নিয়ে যাচ্ছেন না কেন?” নীলাদ্রি করেছিল প্রশ্নটা।
“আসলে ওখানে গিয়ে ওকে দেখাশোনার সময় পাব না আমরা।”
“সে হলেও, ওখানে তো পয়সা দিয়ে বেবিসিটার রাখা যায়।”
“তা যায়, কিন্তু নতুন জায়গায় নতুন লোকের হাতে ওইটুকু মেয়েকে তুলে দিতে ভরসা হয় না।”
“এখানেও তো তাই দিচ্ছেন।” হাসতে হাসতেই কথাটা বলেছিল নীলাদ্রি।
ব্যঙ্গটা গায়ে মাখেননি যোগেন্দ্র নাথ। হাসির রেশ ধরে বলেছিলেন, “আপনারা যা ভাবছেন তা নয়, মেয়ের উপর চব্বিশঘণ্টা নজর রাখার লোকের ও বাড়িতে অভাব নেই। গেলেই বুঝতে পারবেন। কিন্তু আমরা চাইছিলাম মা-বাবার ফিগারটা ও যেন মিস না করে। বিশেষ করে আপনাদের…” আচমকাই থেমে যান যোগেনবাবু।
খানিকক্ষণ নীরবতা, তার পর সুনন্দা প্রশ্ন করেছিল, “ওর কোনো মেডিক্যাল কন্ডিশন…”
বিমর্ষ মাথা নেড়েছিলেন দম্পতী, “আজ্ঞে হ্যাঁ, ওর একটু শ্বাসকষ্ট আছে। মানে একটু উত্তেজিত হয়ে পড়লে সেটা শুরু হয়। ইনহেলার রাখবেন সঙ্গে তবে সেটা যত কম ব্যবহার হয় ততই ভালো, বুঝতেই পারছেন এইটুকু মেয়ে…
সুনন্দা মাথা নেড়েছিল। মনে মনে একটা বিচ্ছিরী খেয়াল এসে চেপে ধরেছিল ওকে। মন বলছিল মেয়েটা ওদের দেখে রাজি না হলেই হয়তো ভালো হবে। এক্ষুনি দু’জনে মিলে বাড়ি ফিরে যাবে। আর একটু চেষ্টা করলে একটা চাকরি ঠিক জোগাড় করে নিতে পারবে নীলাদ্রি। কি দরকার খামোখা একটা অচেনা অজানা মেয়ের ভার নিয়ে? শেষে যদি মেয়েটার কোনো ক্ষতি হয় সব দোষ ওদের উপরে এসে পড়বে।
ভাবনাটা এতটা বেড়ে উঠেছিল যে কথাটা নিজে থেকেই বলত সুনন্দা। কিন্তু মুখের কথা আটকে যায় তুলিকে দেখে। দশ বছরের তুলনায় বেশখানিকটা ছোট দেখায় তাকে। নরম, গোলগাল চেহারা। গায়ের রঙটা কেমন যেন ফ্যাকাসে ধরনের। ঠোঁটের দুটো কোণ এতটাই গভীর শে সারাক্ষণই মনে হয় হাসছে।
সোফায় ওদের উলটোদিকে বসে প্রথমে বেশি কথা বলতে চায়নি তুলি। হয়তো সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসে বসেছিল বলেই। কিন্তু সে পুরনো বাড়িতে গিয়ে বাবা-মাকে ছাড়া থাকতে পারবে কিনা জিজ্ঞেস করতে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ জানিয়েছিল। তারপর উঠে এসে বসেছিল সুনন্দার পাশে। মেয়েটার নরম হাতের উপর হাত রেখেছিল সুনন্দা। একবারের জন্যে নিজের বুকের ভিতরটা কেমন মুচড়ে উঠেছিল তার। রিন্টির কথা মনে পড়েছিল না চাইতেই….
.
শশাঙ্ক পালিত উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করছিল। ভাঙা কড়িকাঠের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নীলাদ্রি বলল, “না না! বাচ্চামেয়ে আছে সঙ্গে, কুয়ো-টুয়ো রিস্ক হয়ে যাবে, আপনি এদিকটাতেই ব্যবস্থা করুন।”
“দুটো ঘর রেডি করা আছে। আপনারা চাইলে এক্ষুনি খুলে দেব।” শশাঙ্ক পিছনের সিঁড়ির দিকে একবার হাত দেখিয়ে বলল কথাটা।
“দুটো ঘর একটু বাড়াবাড়ি, আমি আর থাকবই কতক্ষণ, ওদের দু’জনের জন্যেই….”
সুনন্দার চোখের ইশারায় থেমে গেল নীলাদ্রি। তারপর একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “আপনি বরঞ্চ ওকে ঘরটা দেখিয়ে আনুন, আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসছি।”
“এখন আবার কোথায় যাবে, জামাকাপড় ছেড়ে যেও না হয়।”
“নাঃ, জাস্ট সারাউন্ডিংটা দেখে আসব একটু। এখান থেকে তো কালনা বেশিদূর নয়, শশাঙ্কবাবু? “
“না না। সামনেই তারকেশ্বর-বর্ধমান রোড পাবেন।”
“ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফিরছি। তুমি ভালো করে বুঝে নিও।” কথাটা বলে আর সেখানে দাঁড়াল না নীলাদ্রি।
সুনন্দা একবার তুলির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল সে তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে আবার মাথাটা কাঁধে ফেলে শশাঙ্কর দিকে তাকিয়ে বলল, “চলুন, যাওয়া যাক।”
জমিদারবাড়ির পুরনো সিঁড়ি। প্রতিটা ধাপের কোণে ভরাট শ্যাওলা জমেছে। সিঁড়ির ঠিক মধ্যিখানে বেশ কয়েকটা ধাপে সিমেন্টের চাঙড় উঠে গেছে। দেখে পা ফেলতে হয়। শুধু ভাঙা বলেই নয়, খসে যাওয়া সিমেন্টের ধুলো আলগা হয়ে পড়ে আছে। তার উপরে একবার পা পিছলে গেলেই মাথা উলটে নিচে পড়তে হবে। সুনন্দা সাবধানে উঠতে লাগল।
বাড়ির এইদিকটা মোটামুটি খালি। ফলে পায়ের আওয়াজ দোতলা অবধি গিয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে। সিঁড়ির ল্যান্ডিয়ে একটা প্রায় মানুষের সমান লম্বা জানালা আছে। রঙিন স্কাইলাইট লাগানো। সেই নকশা ভেদ করে আসা রামধনু রঙের আলো পড়েছে ধুলোঢাকা মেঝের উপরে।
শশাঙ্ক ল্যান্ডিয়ে এসে একবার পিছন ফিরে বলল, “দিন, ওকে আমি ধরছি।”
“না, থাক, এইটুকুই তো।”
“তাতে কি। প্রথমবার উঠছেন। দিন না।”
মাথা নাড়ল সুনন্দা, প্রসঙ্গটা ঘোরানোর জন্যে বলল, “আচ্ছা, শুনেছি একজন নাকি এই সিঁড়ি থেকে পড়েই মারা গেছিলেন।”
দাঁতের নিচে একটু হাসল শশাঙ্ক, তারপর বলল, “সেখান থেকেই তো সুনাম রটল।”
“হঠাৎ সিঁড়ি থেকে পড়ে গেলেন কী করে?”
“সিঁড়ির অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন। রাতবিরেতে আলো ছাড়া চলাফেরা করলে পড়ে যে যাবে তাতে আর আশ্চর্য কি? তার উপরে তখন আবার ছিল বর্ষাকাল, এমনিতেই মেঝে সব পিছল হয়ে ছিল।”
“হুম….” প্রতিধ্বনির আওয়াজটা মন দিয়ে শুনছিল সুনন্দা। নিশ্চয়ই লোকটা যখন পড়ে যাচ্ছিল তখন তার আর্ত চিৎকারটাও এভাবে গোটা সিঁড়ি জুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। দোতলায় এসে পড়েছিল দু’জনেই। সুনন্দা আর কথা বাড়াল না।
দোতলায় এলে বোঝা যায় বাড়িটা ঠিক কতটা বড়। চৌকো ঘেরা বারান্দা তার এক-একটা দিক অন্তত বিশ মিটারের কম নয়। প্রতিটা দিকে তিনটে করে ঘর। তার সবকটার দরজা এখন বন্ধ। দেওয়ালের হলদে রং জায়গায় জায়গায় চটে গেছে। কোথাও চুন-সুরকি বেরিয়ে পড়েছে। উপরের দিকটা ফাঁকা। বোঝা যায় বর্ষার সময় জল এসে বারান্দাটাকে থৈথৈ করে দেয়।
শশাঙ্ক সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বাঁদিকে একটা ঘরের দিকে এগোতে এগোতে বলল, “এই দুটো ঘর নিলেই আপনাদের সুবিধা হবে, বাকিগুলোতে বড্ড ধুলো পড়ে গেছে।”
“আপনারা থাকেন কোথায়?”
আবার সেই আগের বিনীত হাসিটা ফিরিয়ে আনল শশাঙ্ক, চাবিটা দিল সুনন্দার হাতে।
“আমরা একরকম এ বাড়ির কেয়ারটেকার, যখন জমিদার আমল ছিল তখন এই দিকটা ছিল জমিদার বংশের সদস্যদের থাকার জায়গা। আর আমরা যে মহলটায় থাকি সেটা ছিল গেস্ট আর সাহায্যপ্রার্থীদের। ছাদে আসুন, দেখাব আমরা কোথায় থাকি।”
বাঁদিকে আরও কিছুদূর গিয়ে দ্বিতীয় ঘর। দরজাটা খোলা ছিল। সেটা হাত দিয়ে ঠেলে ভিতরটা দেখাল শশাঙ্ক। তারপর আর একটা চাবি তার দিকে বাড়িয়ে দিল। একহাতে চাবিটা নিয়ে ভিতরে ঢুকে এল সুনন্দা
ভিতরটা সদ্য গোছানো হয়েছে বোঝা যায়। দেওয়ালেও নতুন রং করা হয়েছে। বাইরে থেকে মহলটাকে যতটা ভাঙাচোরা মনে হয় ভিতর দিকটা ততটা নয়।
ঘরের দু’দিকে দুটো জানলা। আর একটা দিকে জামাকাপড় রাখার মতো ছোট আলনা। মাঝখান জুড়ে একটা দু’জনের শোয়ার মতো বিছানা। তার উপরে পরিপাটি করে চাদর পাতা আছে। চাদরটা নতুন নয়। সম্ভবত এতদিন অন্য কোথাও পাতা ছিল সেটা। সুনন্দারা এখানে আসায় নিয়ে এসে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মাথার উপরে তাকিয়ে একটা নতুন পাখা চোখে পড়ল। সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে সেটা চালিয়ে দিল শশাঙ্ক। সুনন্দা ততক্ষণে তুলিকে কোল থেকে নামিয়ে বিছানার উপরে শুইয়ে দিয়েছে। এগিয়ে গিয়ে জানলাটা খুলে দিল সে।
বাইরে তাকালেই এ প্রাসাদের অন্দরমহলটা চোখে পড়ে। এতদূর থেকে দেখে বড়সড় মনে হয় সেটাকে। এদিককার প্রাসাদের প্রায় অর্ধেক। অনেকটা জুড়ে ছড়ানো। বাইরে বেশ কিছু কাঁটাঝোপ গজিয়েছে। ঢোকার রাস্তার ঠিক মুখে একটা বেশ বড়সড় কাঠগোলাপের গাছ। এত বড় কাঠগোলাপ আগে দেখেনি সুনন্দা। সে সেদিকে একটা আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, “গাছটা কে লাগিয়েছে বলুন তো?”
“সনাতনদা। আরও লাগিয়েছিল। আগের বছরের ঝড়ে সব উপড়ে গেছে। তাছাড়া জায়গাটায় সাপখোপ আছে। খুব একটা যায় না কেউ।”
“সনাতনদা? উনিও এ বাড়িতেই থাকেন?”
“হেডকুক বলতে পারেন। এ বাড়িতে ঠিক বলা যায় না, দক্ষিণ মহলে থাকেন। সেদিকের অন্দরমহলটা অবশ্য এতটা ভেঙ্গে পড়েনি। ছাদে আসুন, দেখিয়ে দিচ্ছি সব।”
তুলির দিয়ে তাকায় সুনন্দা। গালের উপর একটা হাত রাখে। সে একটু উশখুশ করে পাশ ফিরে শোয়। তার গোলাপি ফ্রক এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে বিছানার উপরে। সেটা হাত দিয়ে ঠিক করে দেয় সুনন্দা। এখনও গভীর ঘুমে আছন্ন হয়ে আছে মেয়েটা। কাল রাতটা ট্রেনে ভালো করে ঘুম হয়নি। আজ সকাল থেকে একবারও চোখ খোলেনি।
ঘরের দরজাটা টেনে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল দু’জনে।
শশাঙ্ক পালিতের বয়স বছর চল্লিশেকের একটু বেশি আন্দাজ করা যায়। গালে চাপ দাড়ি, গায়ের রং বেশ ফর্সা। সমস্ত মুখের মধ্যে খাড়া নাকটা আলাদা করে চোখে পড়ে। কপালের কাছে একটা বড়সড় জড়ুল আছে! থেকে থেকে কবজির উলটো দিকটা দিয়ে নাকের ডগাটা ঘষে সে। এ বাড়ির বাকি সদস্যরা এখনও আসেনি এদিকে। শশাঙ্কই গিয়ে হুগলী স্টেশান থেকে নিয়ে এসেছে ওদের।
আরও গোটা কুড়ি সিঁড়ি পেরোলে ছাদ। ছাদে ওঠার মোট দুটো সিঁড়ি আছে। একটা সিমেন্টের, সোজা। আর একটা লোহার পেঁচানো সিঁড়ি। দ্বিতীয় ছাদে ওঠার আগেই দু’জায়গায় ভেঙে গিয়ে ফাঁক হয়ে আছে। সেখানটা একটু লাফিয়ে উঠতে হয়।
সিমেন্টের সিঁড়ির নিচের দিকে লম্বা ঝুলের সার নেমেছে। তার ফাঁকে কিছু পুরানো জিনিসপত্র রাখা আছে। সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে চলে এল সুনন্দা।
চকদীঘির দত্ত জমিদারবাড়ি সতেরশো শতকের মাঝামাঝি তৈরি। তখন বড়সড় বাড়ির বেশিরভাগ অংশেই শ্বেতপাথরের মেঝের চল ছিল। কিন্তু এতক্ষণে অন্তত এ মহলে শ্বেতপাথর চোখে পড়েনি সুনন্দার। বাইরে মূল প্রাসাদে ঢোকার মুখে যে সদরের সিঁড়ি আছে সেটা প্রস্থে অন্তত মিটার দশেক চওড়া। তবে কোণার দিকে কয়েক জায়গায় ভেঙে গেছে।
ছাদে উঠে মনটা হালকা হয়ে গেল সুনন্দার। চারপাশে সিমেন্টের ভারি রেলিং দেওয়া ছাদ। সেই সিমেন্টের গাঁথনির মধ্যে মধ্যে সময়ের কালো ছোপ পড়েছে। রেলিঙের ঠিক উপরেই নানারকম মূর্তি বসানো আছে। বেশিরভাগই সিংহ, কোথাও খাপখোলা তলোয়ার, কোথাও বা ঘোড়া। কয়েকটা জায়গায় মূর্তি খসে গিয়ে রেলিঙের খাম্বা বেরিয়ে পড়েছে।
ছাদের মেঝেতে বড় বড় খোপ কাটা। কয়েকটা খোপ হেঁটে পার হয়ে ছাদের একপ্রান্তে এসে দাঁড়াল সুনন্দা। কিনারায় এসে না দাঁড়ালে আশপাশের অন্য কোনো বাড়ি চোখে পড়ে না। শুধু দক্ষিণের প্রাসাদটা চোখে পড়ে। সেদিকে দেখিয়ে শশাঙ্ক বলল, “মোট দুটো প্রাসাদ। একটা উত্তরের, একটা দক্ষিণের। জমিদারবাড়ির নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেকটা প্রাসাদের পিছনের দিকে সেই প্রাসাদের অন্দরমহল। আপনারা থাকবেন উত্তরের প্রাসাদে। আর আমরা থাকব দক্ষিণের অন্দরমহলে। দেখে আসবেন একবার?”
“না, আজ আর ভালো লাগছে না। তাছাড়া মেয়েটা জেগে গেলে খুঁজবে।”
“খোঁজার কিছু নেই। ও আগেও এসেছে আমাদের এখানে। বেশ চৌকশ মেয়ে। আমাদের সবাইকেই প্রায় চেনে।”
এতক্ষণ মন দিয়ে উত্তরের ভাঙাচোরা অন্দরমহলের ভিতরের জমাট অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিল সুনন্দা। এবার শশাঙ্কের দিকে ফিরে বলল, “মেয়েটাকে নিয়ে ভয় লাগছে, জানেন?”
“ভয়ের কী আছে? সাতটা দিনের তো ব্যাপার।”
“গণ্ডগোল কিছু হওয়ার থাকলে সাতদিনই যথেষ্ট। বিশেষ করে এইটুকু বাচ্চা…”
“আপনাদের নিজেদের ছেলে মেয়ে…”
কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল শশাঙ্ক। অর্ধেক বলেই বুঝতে পেরেছে একটু বেশি ব্যক্তিগত হয়ে গেছে প্রশ্নটা।
তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নরম করে হাসল সুনন্দা। তারপর মাথা দুলিয়ে বলল, “ছিল…”
শশাঙ্কের অস্বস্ত্বিটা আর একটু বেড়ে উঠল। সে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। প্রসঙ্গটা বদলাতে বলল, “দাদা বলে দিয়েছেন সনাতনদা আর মধুবাবু মাঝে মাঝেই দেখে যাবেন আপনাদের। আমিও আসব যাব ইচ্ছা হলে।”
“আপনিও তো এখানেই থাকতে পারতেন।”
হাতের উলটোদিক দিয়ে কপালের ঘাম মুছল শশাঙ্ক, “আমার আসলে দোকান বাজারের দায়িত্ব। তাছাড়া রান্নবান্নাটাও দেখাশোনা করতে হয়। বাইরে থেকে লোকজন জমিদারবাড়ি দেখতে আসে। তাদের সামলানোটাও একটা হ্যাপা।”
“আপনাকে থাকতে বললাম তার একটা কারণ আছে জানেন।”
“কী কারণ?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে শশাঙ্ক।
“এখানে আসার পর থেকে জমিদারবাড়ির ইতিহাসটা জানতে ইচ্ছা করছে আমার। অন্তত কোনো বই-টই যদি পাওয়া যেত, মানে জমিদারবাড়ির তো কিছু না কিছু হিস্ট্রি থাকে …”
মিহি একটা হাসি খেলে যায় শশাঙ্কের মুখে, “যত ইতিহাস আপনি বইতে পাবেন তার থেকে ঢের বেশি পাবেন মধুবাবুর মুখে। তবে ইতিহাস বলতে তেমন কিছু নেই।
জমিদার ভূপতি দত্ত ব্রিটিশদের প্যাট্রন ছিলেন। ফলে সেকালেও জমিদারিটা টিকিয়ে রেখেছিলেন। এই বাড়িটাও। তারপরের জেনারেশান থেকে একটু একটু করে শেষ হয়ে যায় জমিদার বংশ। লোকে বলে…”
“কী বলে?” কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে সুনন্দা।
“একটি, মাথায় কালো কাপড়ে ঢাকা ছায়ামূর্তিকে নাকি কয়েক শতাব্দী ধরে দেখা যায় এখানে। কিসব যেন অভিশাপ আছে।” খোলা হাসির একটা দাগ ফোটে শশাঙ্কের দাড়ির আড়ালে, “ওসব গল্প পরে মধুবাবু শুনিয়ে দেবেন। আপাতত জেনে রাখুন বছর পঞ্চাশেক আগেই তার বংশের শাখাপ্রশাখা প্রায় গুটিয়ে গেছে। দাপট যা ছিল তাও শেষ হয়ে গেছে অনেক আগে। শেষে নাথ ইন্ডাস্ট্রি সরকারের নির্দেশে এটা দেখাশোনা আর এলটমেন্টের দায়িত্ব পায়।”
“আর খুনগুলো কবে হয়?”
আবার হাসির ঝাপটা ছড়িয়ে পড়ে শশাঙ্কের মুখে, “খুনের ব্যাপারটা আপনার মাথাতেও ঘুরছে তার মানে।”
সুনন্দা একটু লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে বলে, “আসলে যে বাড়িতে এতগুলো মানুষ আচমকা মারা গেছেন সেখানে থাকতে একটু একটু গা ছমছম করবে বৈকি। বিশেষ করে প্রাচীন জমিদারবাড়ি যখন, তাও ব্যাপারটা যদি ভালো করে জানা থাকে তাহলে আর অতটা ভয় করবে না।”
মাথা নাড়ায় শশাঙ্ক, তারপর দূরের দিকে তাকিয়ে বলে, “খুন বলুন আর মৃত্যু, সেগুলো ঠিক কবে থেকে শুরু হয় তা কেউ বলতে পারে না। মানে ধরুন ইংরেজ আমলেও যদি হয়ে থাকে তার সাক্ষী দেওয়ার জন্যে কেউ নেই আর। চাকর-বাকরের মধ্যে কেউ যদি মরে থাকে তাহলে কেউ তার অত হিসেব রেখে যায় না। আমি যদ্দুর জানি সরকার থেকে এর হেরিটেজশিপের নেওয়ার পর মোট চারজন এ বাড়িতে থাকতে থাকতে মারা গেছেন। তবে তার কোনোটাই খুন বলা যায় না। লোকে গুজব রটাতে পারে বড়জোর। সেটা কোনো নতুন কথা নয়।”
“প্রথমটা সিঁড়ি থেকে পড়ে?”
“আজ্ঞে, যে সিঁড়ি দিয়ে এলাম আমরা। নাইন্টীন সিক্সটিফোরে।”
“তারপর?”
“প্রথমটার বারো বছর পর অর্থাৎ সেভেন্টিস-এর মাঝামাঝি দ্বিতীয়টা। দীঘির জলে বড়ি ভেসে ওঠে। এর নাম আমি শুনেছিলাম একবার, মহীতোষ বসু। ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এসেছিল। কোনোভাবে হয়তো রাতে জলের কাছাকাছি গিয়েছিল। দীঘিতে বড়ি ভেসে ওঠে।”
“কোন্ দীঘি?” প্রশ্ন করে সুনন্দা।
আঙুল দিয়ে অন্দরমহলের মাথার পিছনটা দেখিয়ে দেয় শশাঙ্ক। ঝোপঝাড়ে ঢেকে আছে সেখানটা। তবে ভালো করে লক্ষ করলে সেই গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটুখানি জলের রেখা চোখে পড়ে।
“ওখানে একটা পুকুর আছে মনে হচ্ছে।”
“ওটাই দীঘি, এ বাড়ির সামনে আর পিছনে দু’দিকেই জল আছে। আসার সময় সামনে পুকুরপাড় দেখলেন তো?”
সুনন্দা মাথা নাড়ে। চারদিক খোলা থাকায় বেশ জোরে একটা হাওয়া দিচ্ছে। তাতে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে মুখের উপরে। এই হাওয়াটা যেন তার বহুদিনকার চেনা।
সুনন্দার চেহারাটা বেশ মার্জিত। রোগা বা মোটা কোনোটাই বলা যায় না। গায়ের রং ফর্সার দিকে। চোখে একটা রিমলেস চশমা পরে সে। তাকে একবার দেখেই হাইস্কুলের নতুন বহাল হওয়া অংকের দিদিমণি গোছের একটা চেহারার কথা মাথায় আসে। ফিনফিনে গলার আওয়াজ। কথাও বলে থেমে থেমে।
বাইরে কম্পাউন্ডের উপরে আরও কিছু ফুলের গাছ লাগানো আছে। তার পাশ দিয়ে মাঝে মধ্যেই জমিদারবাড়ির অন্যদিকের বাসিন্দা কিছু লোকজন এদিক থেকে ওদিক চলে যাচ্ছে। কারও কাঁধে গামছা, কারও পরনে। কেউ কেউ দীঘির দিকে যাচ্ছে স্নান করতে। গুনগুন আওয়াজে ভরে আছে জায়গাটা
আচমকাই সুনন্দার চোখ চলে গেল উত্তরের অন্দরমহলের দিকে। ভারী আশ্চর্য গঠন মহলটার। ঠিক যেন একটা ছোটোখাটো মন্দির। উপরের দিকটা জুড়ে ছড়ানো একটা গম্বুজ। তার চূড়ায় একখণ্ড লাল তেকোণা কাপড় পতাকার মতো এসে পড়েছে। পাশে গজিয়ে ওঠা ঝাঁকড়া খেজুর গাছের পাতা এলিয়ে পড়েছে সেই গম্বুজের উপরে। সামনের দিকে মহলের দরজা। সেই দরজার গায়ে চক দিয়ে কেউ নাম লিখে গেছে। দরজাটা অর্ধেক খোলা থাকায় ভিতরের দিকের ঘন অন্ধকার চোখে পড়ে। সম্ভবত ভিতরে কোনো জানলা বা দরজা খোলা নেই। সামনের ঘাসের জায়গাটার উপরে পায়ে চলা রাস্তা নেই। সত্যি জায়গাটা পরিত্যক্ত।
সিঁড়ির কাছ থেকে পায়ের আওয়াজ পেয়ে এগিয়ে এল দু’জনে। নীলাদ্রি এসে ঢুকল ছাদে। তারপর সুনন্দার দিকে তাকিয়ে বলল, “কি ঘুম ঘুমাচ্ছে গো! ওঠার নাম নেই।
“ক্লান্ত আছে খুব, রাতে তো জেগেই ছিল।”
“সে তো বুঝলাম, কিন্তু এভাবে একা রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলে?”
“বেশ, এবার থেকে নিয়েই আসব।”
পকেট থেকে সিগারেট বের করে শশাঙ্কের দিকে এগিয়ে দিল নীলাদ্রি। তারপর আবার সুনন্দার দিকে ফিরে বলল, “সব বুঝে-টুঝে নিয়েছ তো? দরকার পড়লেই লোক থাকবে। ভয়ের কিছু নেই।”
“আপনি থাকবেন না?” জিজ্ঞেস করল শশাঙ্ক।
“আমার দিন তিনেকের কাজ আছে কলকাতাতে। তাছাড়া কিছু জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে আসতে হবে। ল্যাপটপটা তো রেখেই এসেছি। কিগো, তোমার ভয় করবে নাকি?”
ভুরু কুঁচকে মুখ বাঁকাল সুনন্দা, “কে যে ভিতু আমার জানা আছে।”
“না না ইয়ার্কি নয়” নীলাদ্রি মুখে মেকি ভয় আনার চেষ্টা করে, “এ বাড়িতে চার-চারটে মানুষ চার-চারটে দশকে অস্বাভাবিকভাবে মারা গেছে। তার মধ্যে একটা আবার সুইসাইড।”
“তাই নাকি! সুইসাইডও আছে?” অবাক চোখে শশাঙ্কের দিকে তাকাল সুনন্দা।
“হ্যাঁ, এটাই লেটেস্ট। বছর দশেক আগে। দড়ি থেকে ঝুলছিল। আপনাদের যে রুমটায় আছেন তার উলটো দিকেরটায় ছিলেন। নলিনী… কি যেন নাম, ঠিক মনে পড়ছে না…”
“এনাদের কোনো জ্ঞাতির কেউ?”
“একেবারেই না। সরকার বাহাদুরের লোক, হ্যাঁ, মনে পড়েছে— নলিনী ঘোষ। মজার কথা হল এই যে চারজন মারা গেছেন তাদের কেউই এদের বংশের সঙ্গে যুক্ত নয়। হয় বাইরে থেকে আসা অতিথি না হলে ঠিকাদার, ইঞ্জিনিয়ার, এইসব।”
“বেশ, তিনজনের কথা জানলাম। ফার্স্ট, সেকেন্ড আর ফোরথ, বাকি একজন?”
শশাঙ্ক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। নীলাদ্রি বাধা দিল তাকে। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “মরা লোকেদের কথা পরে জানবে না হয়। আপাতত নিচে একজন জীবিত বসে আছেন। তার সঙ্গে দেখা করে আসা দরকার।”
“কে?”
“জানি না। নাম বলল সনাতন।”
সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল শশাঙ্ক, “সনাতনদা এসেছেন। আপনারা নিচে আসুন। আলাপ করিয়ে দি। বাকি সব ওঁর থেকেই জানতে পারবেন। ভারী কর্মঠ লোক। তবে মাথাটা ইদানীং বুঝি একটু খারাপ হয়েছে।”
দোতলার বাইরের বেঞ্চে বসেছিল সনাতন। লোকটাকে দেখে প্রথম দর্শনে বাঙালি বলে মনেই হয় না। মাথা আর গাল ভর্তি সাদা দাড়ি। মোটাসোটা শক্ত গড়ন। হাতে রোঁয়া ওঠা লাল তাগা বাঁধা। পরনে একটা পাট করে পড়া খাটো ধুতি আর ফতুয়া। এটুকু বাদ দিলে শৌখিনতার তেমন কোনো চিহ্ন নেই শরীরে। খানিকটা ঝুঁকে থাকেন সবসময়। সুনন্দার মনে হল লোকটার সঙ্গে ছবি বিশ্বাসের মিল আছে কোথাও।
নীলাদ্রিদের দেখেই দুটো হাত জড়ো করে তুলে ধরল সনাতন। তারপর সেরকম গম্ভীর মুখে একবার সুনন্দার দিকে তাকিয়ে আবার চোখে ফিরিয়ে নিল। বোঝা গেল বেশি কথাবার্তার লোক নয় সনাতন।
“আপনাদের নন-ভেজে আপত্তি নেই তো?” নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল শশাঙ্ক।
“উঁহু, সেটাই প্রেফার করি বরঞ্চ।”
“বেশ, তাহলে সনাতনদাকে নিয়ে অভিযোগ থাকবে না। শুধু ঝালটা একটু বেশি হয়। সেটা সহ্য করে নিতে হবে। অনুরোধ করে লাভ হবে না। ওল্ড হ্যাবিটস… হেঁ হেঁ…”
“আপনারা যা বলবেন তেমনই করে দেব।” ঘরঘরে গলায় কথাগুলো বলে জামার হাতায় ঘাম মুছল সনাতন।
“আজ রাতে যা খাবেন এখনই বলে দিন। বিকেলের চা-টা আমি আলাদা করে পাঠিয়ে দেব।” শশাঙ্ক বলল।
“না না, আজ রাতে আমরা একটু বাইরে বেরিয়ে খাব ঠিক করেছি। কাল সকালে তো ও চলে যাবে।” সুনন্দা সনাতনের দিকে তাকাল।
“চকদিঘীতে বাইরে খাবার মতো কিছু পেলে হয়। ঠিক শহর তো আর নয়। যাই হোক, কাল থেকেই শুরু হবে না হয়। আর মধুদা… মধুদা মহলে নেই সনাতনদা?”
“ছিল তো আসবে একটু পরে।” আগের মতোই কাটাকাটা উচ্চারণে কথাগুলো বলে সনাতন। তারপর আবার বসে পড়ে বেঞ্চের উপরে। লোকটার চোখের মণি দুটো কি আশ্চর্য রকম স্থির! মনে হয় বুকের ভিতরে রক্তের বদলে খানিকটা বরফ জমাট বেঁধে আছে।
“যাই, আমি আবার একটু দেখে আসি তেনাকে পাওয়া যায় কিনা। আপনারা জিরিয়ে নিন।” কথাগুলো বলতে বলতে বাইরের দিকে পা বাড়ায় শশাঙ্ক।
সনাতনের পাশে বসে পড়ে নীলাদ্রি। খোশগল্প করতে থাকে।
বারান্দার উপরে খোলা ছাদ দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সনাতন। প্রশ্ন করলে মাঝে মাঝে মুখ খুলে উত্তর দিয়ে আবার চুপ করে যাচ্ছে। সুনন্দা একবার তাকে আপাদমস্তক দেখে ভিতরের দিকে ঢুকে আসে। ওপাশের ঘরটার চাবি রেখে গেছে শশাঙ্ক। কিন্তু খুলে দিয়ে যায়নি। সেটা একবার খুলতে হবে। টেবিলের উপর থেকে চাবিটা নিতে গিয়েই থমকে যায় সুনন্দা। এতক্ষণে বিছানার উপরে উঠে বসেছে তুলি। খোলা জানলা দিয়ে উত্তরের অন্দরমহলের দিকে চেয়ে কি যেন দেখছে।
“তুমি উঠে পড়েছ?” নরম গলায় প্রশ্ন করল সুনন্দা। তারপর এগিয়ে গেল বিছানার দিকে।
তুলি একবার মুখ ফিরিয়েই আবার জানালার দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। কোনো কারণে একটু চমকে গেছে যেন সে।
নিচু অস্পষ্ট স্বরে প্রশ্ন করল, “তোমরা আমাকে ডাকছিলে?”
“আমরা? নাতো।” অবাক হয়ে যায় সুনন্দা, “আমি তো উপরে ছিলাম। অবশ্য নীলাদ্রি যদি এ ঘরে এসে…
“এ ঘর থেকে না।” কথা শেষ হবার আগেই বলে ওঠে তুলি।
“তাহলে কোথা থেকে?”
ডানহাতটা তুলে জানলা দিয়ে দূরের ঝোপে ঢাকা পুরনো অন্দরমহলটা দেখিয়ে দেয় তুলি, “কাছে যেতে বলছিল, ওখান থেকে।”
দু-এক পা এগিয়ে জানালার কাছে সরে আসে সুনন্দা। একটা ঠান্ডা স্রোত তার বুকের মাঝে পুরানো ভয়টা আবার ফিরিয়ে আনে।
কাঠগোলাপ গাছটার ফাঁক দিয়ে শতাব্দী প্রাচীন অন্দরমহল মাকড়সার ঝুলে ঢেকে একবুক নিশ্ছিদ্র অন্ধকার নিয়ে পড়ে আছে। তার সামনেটা এখন ফাঁকা….