গান্ধার রাজ সুবলের দুহিতা ও ধৃতরাষ্ট্রের ধর্মশীলা স্ত্রী। মাতৃকাগণের মতিদেবী গান্ধারী রূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। স্বামী জন্মান্ধ ছিলেন জেনে গান্ধারীও পট্টবস্ত্র দিয়ে চক্ষু আবৃত করে রাখতেন। মহাদেবের কাছে গান্ধারী শত পুত্র প্রাপ্তির বর পেয়েছিলেন। মহর্ষি ব্যসদেবের কাছেও তিনি সেই একই বর ভিক্ষা করে পেয়েছিলেন। কুন্তির পুত্র হয়েছে, অথচ দুই বৎসর সন্তান-সম্ভবা হওয়া সত্বেও ওঁর পুত্র হল না – সেই দুঃখে তিনি উদরে আঘাত করে একটি মাংসপিণ্ড প্রসব করলেন। ব্যসদেবের নির্দেশে সেই মাংসপিণ্ড বিভক্ত করে ভিন্ন-ভিন্ন কুণ্ডে অংশগুলিকে রাখা হল। সেই কুণ্ডগুলি থেকেই তাঁর একশো পুত্র ও একটি কন্যার জন্ম হয়। পুত্রস্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে গান্ধারী বহুবার পুত্রগণের অশিষ্টতা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ধৃতরাষ্ট্রকে বার বার সতর্ক করেছেন যে, দুর্যোধনকে ত্যাগ না করলে কুরুকুল ক্ষয় বন্ধ করা যাবে না। পুত্রকেও তিনি কঠোর বাক্যে পাপকর্ম থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, পাণ্ডবদের অর্ধরাজ্য ফিরিয়ে দেবার নির্দেশ দিয়েছেন। অবশ্যই তাতে কোনও ফল হয় নি। পুত্রকে আস্কারা দেবার জন্য ধৃতরাষ্ট্রকেও তিনি ভর্ৎসনা করেছেন। যুদ্ধের শেষে পুত্রহারা গান্ধারী যখন দুঃখ শোকে কাতর হয়ে আছেন। তখন ্কৃষ্ণ গান্ধারীকে এসে বলেছেন যে, গান্ধারী যেন পাণ্ডবদের চক্ষু দিয়ে দগ্ধ না করেন। গান্ধারীর তপোবলের কথা কৃষ্ণের অজানা ছিল না। ব্যাসদেবও গান্ধারীকে শান্ত করার জন্য এসেছিলেন। গান্ধারী জানতেন যে, যুদ্ধের জন্য পাণ্ডবরা দায়ী নন, কিন্তু দুর্যোধনের উরুভঙ্গ এবং দুঃশাসনের রক্তপান – ভীমের এই দুই ক্রুর কর্মের জন্য ভীমের তিনি অত্যন্ত কুপীত হয়েছিলেন। ভীম যখন আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করছেন, তখন গান্ধারী বললেন যে, শত পুত্রকে বিনাশ না করে, অল্প-অপরাধী একটি পুত্রকে কি ভীম বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন না? (বিকর্ণের মত ধার্মিক পুত্রকেও ভীম বধ করেছিলেন!)। যুধিষ্ঠির এগিয়ে এসে যখন গান্ধারীকে প্রণাম করছেন তখন শোকসন্তপ্ত গান্ধারের দৃষ্টি পট্টবস্ত্রের ফাঁক দিয়ে যুধিষ্ঠিরের নখের ওপর পড়তেই, সেগুলি পুড়ে কালো হয়ে গেল। কিন্তু তার পরেই গান্ধারী নিজেকে সংযত করলেন। পুত্রশোকাতুরা দ্রৌপদী যখন গান্ধারীর কাছে এলেন তখন তাঁকে গান্ধারী সস্নেহে সান্ত্বনা দিয়েছেন। মহাযুদ্ধের আগে দুর্যোধন যখন যুদ্ধজয়ের জন্য মায়ের কাছে আশীর্বাদ চেয়েছিলেন, তখন গান্ধারী বলেছিলেন, ধর্ম যেখানে, জয় সেইখানে। পুত্রস্নেহ সত্বেও ধর্ম থেকে গান্ধারী বিচ্যূত হতে পারেন নি। কিন্তু কৃষ্ণ ও ব্যাসদেবের কাছ থেকে দিব্যনেত্র লাভ করে যখন কুরুক্ষেত্রে পুত্রদের রুধিরাক্ত দেহাবশেষ দেখছেন, তখন তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারেন নি। অমিত শক্তিধর কৃষ্ণ ইচ্ছা করলেই এই বিনাশ বন্ধ করতে পারতেন, কিন্তু তাও করেন নি – এই চিন্তায় তিনি কৃষ্ণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, পঁয়ত্রিশ বছর পর কৃষ্ণদের যদু বংশও এইভাবে হানাহানি করে নিজেদের বিনষ্ট করবে। কৃষ্ণ নিজে জ্ঞাতি-পুত্র হারিয়ে একাকি অরণ্যে গিয়ে নিহত হবেন। যুধিষ্ঠিরের রাজ্যলাভের পনেরো বৎসর পর ধৃতরাষ্ট্র প্রব্রজ্যা গ্রহণের সংকল্প করলেন। কুন্তি, সঞ্জয় ও বিদুর সহ গান্ধারীও ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গ নিলেন। এর কিছুকাল পরে অরণ্যে দাবাগ্নির মধ্যে যোগযুক্ত হয়ে গান্ধারী, ধৃতরাষ্ট্র, কুন্তির সঙ্গে দেহত্যাগ করেন।