কোজাগর – ৭

হলুক্ পাহাড়টা রীতিমতো উঁচু। সমুদ্র সমতা থেকে কতো উঁচু হবে জানি না, কিন্তু এই পাহাড়ী জনপদ থেকেও হাজার দুয়েক ফিট উঁচু। শীতের জ্যোৎস্না-রাতে চাঁদ ঝুলে থাকে এর মাথার ওপরে ফানুসের মতো। পায়ের কাছে কুয়াশার আঁচল জমে মাঝ রাতে, নীল হয়ে। আর সেই কুয়াশার ওপরে শিশির-ভেজা চাঁদের আলো পড়ে সমস্ত বিশ্ব চরাচর কেমন এক অপার্থিব মোহময় সৌন্দর্যে ভরে ওঠে। তখন মনে হয় পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোনো গ্রহেই বুঝি এসে পড়েছি।

এমন রাতে একা একা ঘুরে বেড়াই বনের পথে। শীতের রাতে অদৃশ্য সাপ ও বিছের ভয় নেই বললেই চলে। আর যারা আছে, তাদের পায়ের শব্দ শুনতে না পেলেও অন্য, জানোয়ার ও নিশাচর পাখিদের স্বরে, শুকনো পাতার মচ্‌মচানিতে, কী ডাল ভাঙার আওয়াজে তাদের আনাগোনার খোঁজ পেয়ে যাই আগে ভাগেই। এতো বছর জঙ্গলে থেকে চোখ ও কানের সদ্ব্যবহার করতে শিখেছি।

প্রথম প্রথম খুব শীত লাগে। কিন্তু একটু হাঁটার পরই গা গরম হয়ে যায়। বেরোবার সময় বেশি করে কালাপাত্তি জর্দা দিয়ে দু-খিলি পান মুখে পুরে নিই। গা-গরম করার ওষুধ।

চলতে চলতে থামি। কোথাও বসি। উঁচু এবং ঋজু বড় শিমুলের সমকোণে ছড়ানো ডালের ওপর লেজ ঝুলিয়ে ময়ূর-ময়ূরী বসে থাকে। তাদের পাখা শিশিরে ভিজে যায়। তার ওপর চাঁদের আলো পড়ে বড় ভূতুড়ে দেখায় তখন। কখনও হাততালি দিয়ে উড়িয়ে দিই তাদের মজা দেখার জন্যে। ন্যাপেতে ভারী শরীরে লম্বা লেজে ও বড় বড় ডানায় সপ্ সপ্ শব্দ করে জ্যোৎস্না-স্নাত শিশির-ভেজা গা-ছম্-ছম্ উপত্যকার ওপরে উড়ে গিয়ে ওরা অন্য গাছে বসে। ময়ূর নেহাত দায়ে না-ঠেকলে একসঙ্গে বেশি ওড়ে না। অতবড় শরীর আর লেজ নিয়ে একবারে বেশিদূর উড়তে বোধহয় কষ্ট হয় ওদের।

বছর কয়েক আগে কাড়ুয়া একবার ময়ুরের মাংস খাইয়েছিল। খেতে চমৎকার। মানে এতোই ভালো যে, বলার নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো হোয়াইট মিট। কিন্তু কী করে মানুষে ময়ূর মারে তা ভাবতেও আমার কষ্ট হয়। কী করে মারতে পারে?

টাইগার প্রোজেক হয়ে যাওয়ার পর সমস্ত শিকারির ওপরই কড়া নজর বন বিভাগের। ওয়ালেবস্-এর টাওয়ার বসেছে বেলাতে। আর্ম-গার্ড রাইফেল নিয়ে থাকে সেখানে। কোথাও চোরা-শিকারের খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে জিপ নিয়ে চলে যায় তারা। কাড়ুয়া চোরা-শিকারি। কাড়ুয়ার একটা মুঙ্গেরী দো-নলা গাদা বন্দুক আছে। সেটা এখন আর বাড়িতে রাখে না ও। পাহাড়ের মধ্যের এক গুহায় লুকিয়ে রাখে। সন্ধে হয়ে গেলে ছায়ামূর্তির মতো বেরিয়ে পড়ে বন্দুকটাকে ওখান থেকে নিয়ে। শুরু হয় তার রাতের টহল।

গরমের দিনে শিমুল ফুল খেতে আসে কোটরা হরিণ। তখন পাথরের আড়ালে ওঁত পেতে কাড়ুয়া। শিমুল ফুল আমিও খেয়ে দেখেছি। ফুলের গোড়াটা কষা কষা লাগে। গরমের দিনে জঙ্গলের গভীরে কোনো জলের জায়গায় এসেও বসে থাকে কাড়ুয়া। শুয়োর আর হরিণের ওপরই লোভ বেশি ওর। বাঘকে ও কখনও ভয় পায়নি। কিন্তু জানাজানি হয়ে যাওয়ার ভয়ে নিজের দায়িত্বে বেশি বাঘ আগেও মারেনি। এখন সব চোরা-শিকারিরই বাঘের ভয়ের চেয়েও, বন বিভাগের ভয়টাই বেশি। বাঘ মারার কথা ভাবে না এখন কেউই।

গরমের সময় জঙ্গল ফাঁকা হয়ে যায়। তাই কাড়ুয়াকে তখন যেতে হয় পাঁচ-দশ মাইল দূরের গভীরতর ছায়াচ্ছন্ন জঙ্গলে। যেখান থেকে বন্দুকের শব্দ কারোই শোনার কথা নয়। কাড়ুয়া জানে, ধরা পড়লে শুধু বেদম মার খাবে যে তাই-ই নয়, তার জেলও হবে। এই জঙ্গল-পাহাড়, জঙ্গল-পাহাড়ের তাবৎ জানোয়ার এবং চিড়িয়ার রাহান্ সাহান্ এ-অঞ্চলে ওর মতো ভালো কেউই জানে না। টাইগার প্রোজেকট্ এবং স্যাংচুয়ারী হওয়ার আগে বনবিভাগের বড়কর্তাদের এবং শিকার-কোম্পানিদের শিকার খেলিয়ে তার আমদানি ভালোই হতো। ও কিন্তু এইসব জানোয়ার এবং পাখিদের অন্য অনেকের চেয়েই বেশি ভালোবাসে। কারণ ও তাদের জানে। মায়া ওরও কম নেই কারো প্রতি। কিন্তু পেট বড় বেইমানি করে। ও নিরুপায় হয়েই তাই এতো ঝুঁকি নিয়ে এখনও লুকিয়ে শিকার করে। চাষবাসের, কী কাঠ কাটার কাজ সে কখনও শেখেনি। গোলামী করেনি কারুর। ও স্বাধীন।

যখন বন্দুকটা ওর ঘরে থাকতো, এক বর্ষার দিনে, ওর সঙ্গে কথা বলেছিল বন্দুকটা। ঝারিতালাওয়ের পাশের কচুক্ষেতে তার এক শিকারি বন্ধুকে বড়কা দাঁতাল শুয়োরে ফেড়েছিল। তার নাম ছিল রামধানীয়া। সে-রাতে বৃষ্টি পড়ছিল টিপ্‌টিপ্ করে সন্ধে থেকে। কাড়ুয়া তার মাটির ঘরে চাটাই পেতে ঘুমিয়ে ছিল। এমন সময় ওর মনে হলো হঠাৎ ফিফিস্ করে রহস্যময় স্বরে কে যেন ওকে ডাকল। ধড়ফড় করে ঘুম ভেঙে উঠেই কাড়ুয়া দেখল, কাছে-পিঠে কেউই নেই। বন্দুকটা যেন ওকে ফিফিস্ করে বলল, শটি খেতোয়ামে বড়ুকা শুয়ার আও।

রামধানীয়ার কথা মনে পড়ে গেল। পেটটা চিরে দিয়েছিল শুয়োরটা। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে এসেছিল তার। নিদিয়া নদীর পাশের শ্মশানে বসে কাড়ুয়া তার জিগরী দোস্তের খুনের বদলা নেবে বলে শপথ করেছিল মড়া ছুঁয়ে।

সেই টিপ্‌টিপে বৃষ্টিতে গাদা-বন্দুকে তিন-অংগলী বারুদ গেদে সামনে একটা মরচে ধরা লোহার গুলি ঠেসে বনদেওতার নাম করে বেরিয়ে পড়েছিল কাড়ুয়া। ঝারিতালাও-এর কাছে আসতেই শুয়োরের কচু গাছ উপড়ানো শব্দ পেয়েছিল ও। তারপর প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে কাদার মধ্যে এগিয়ে গিয়ে হুম্মকে দেগে দিয়েছিল তার বন্দুকোয়া। হড়হড়িয়ে পা পিছলে গুচ্ছের কাদা ও শটি গাছ ছিটিয়ে-মিটিয়ে উল্টে পড়েছিল বড়কা এক্রা দাঁতাল শুয়োরটা।

বন্ধুর মৃত্যুর বদলা নিয়েছিল কাড়ুয়া।

মাঝে মাঝে এমন রাতে একা টহলে বেরিয়ে পালসা-খেলা কাড়ুয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে যেতো আমার। অন্ধকারে ছায়ার মতো, সাবধানী নিশাচরে শিকারি জানোয়ারের মতো নিঃশব্দে মাংসল পায়ে ও চলাফেরা করতো। কখনও মুখোমুখি হলে আমাকে হঠাৎ দেখা ভূতের মতো হাত তুলে বলতো, পরর্‌নাম বাবু।

বলতাম, পরর্‌নাম।

তারপরই বলতাম, পেলে কিছু?

নেহী! কুচ্ছু না মিললই।

বুঝতাম, দূরের জঙ্গলের মধ্যে কোনো জানোয়ার মেরে গাছের ডাল চাপা দিয়ে রেখে এসেছে সে। দিনের বেলায় বিশ্বস্ত একজন অনুচরকে নিয়ে সেখানে ফিরে যাবে কাল।

কাড়ুয়া আমাকে বিশ্বাস করে না। ওদের বিশ্বাস ছোটবেলা থেকে এতলোক ভেঙেছে নির্দয়ভাবে যে, কাউকেই আর বিশ্বাস করে না ওরা।

হুলুক্ পাহাড়ের দারুণ ঘন জঙ্গলের মধ্যে গভীর ছায়াচ্ছন্ন স্যাঁতসেঁতে জায়গা আছে একটা। বড় গাছ-গাছালির পাতার চন্দ্রাতপের ফাঁক-ফোক দিয়ে রোদ এসে পড়ে তাদের ওপরে। জারির মতো প্যাটার্ন হয় ঘন সবুজ জঙ্গলে হলদে-সাদা রোদের সেই আলো-অন্ধকারের কাটাকুটির আড়ালে বাঘ তার সাদা-কালো ডোরা শরীর নিয়ে বাঘিনীর সঙ্গে মিলিত হয় নানা ফুলের সুগন্ধে সুরভিত নিভৃতে। বাঘিনী বাচ্চা দেয় মাঝে মাঝে ঐখানে। তারপর পাশের বিরাট গুহায় বাচ্চা নিয়ে আশ্রয় নেয়। গড়ে তিন-বছরে একবার করে ব্যাঘ্র-শিশুমঙ্গলের জায়গা হয়ে ওঠে গুহাটা। ঐ জায়গাটা বাঘের বড় প্রিয় জায়গা বলে লোকজন ঐ দিকটা এড়িয়ে চলে। পথও বড় দুর্গম এবং দূরের। একদিন রথীদা আর আমি খুব সকালে সঙ্গে হ্যাভারস্যাকে খাবার ও জল নিয়ে ঐ গুহা দেখতে গেছিলাম। ট্রাকে করে যতোটা যাওয়া যায় গিয়ে, বাকিটা হেঁটে গেছিলাম। কে জানে, কতোদিন আগে খাঁরওয়ার বা চেরোরা এই গুহাতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল? কতো হাজার বছর ধরে কতো আদিম উপজাতির আনাগোনা ছিল এইখানে তার খবর কে রাখে? গুহার মধ্যে যেসব কারুকার্য আছে উপজাতিদের আঁকা, তা দেখলে বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়। কী দিয়ে তারা কালো পাথরের ওপর এঁকেছিল; বেশিই জন্তু-জানোয়ারের ও শিকারির ছবি, তা নিরূপণ করবার মতো জ্ঞান আমার ছিল না। কতো হাজার বছর আগে যে ঐসব ছবি আঁকা হয়েছিল, তাও অনুমান করা অসম্ভব ছিল আমার মতো সাধারণ লোকের পক্ষে।

স্থানীয় একটা জনশ্রুতি আছে, মুলেন সাহেবের শ্বশুর জনস্টন সাহেব ঘোড়ায় চড়ে কাঁধে ভারী রাইফেল ঝুলিয়ে ঐদিকে যেতেন। সঙ্গে অনেক গাছ-গাছালি নিয়ে। আজকে আমরা যে গাছ-গাছালি দেখি এই ভয়াবহ জঙ্গলের গভীরে তা এক বিদেশি সাদা চামড়ার মানুষের অবদান। ওরা আমাদের রক্ত চুষতে এসেও এই দেশকে যেভাবে ভালোবেসেছিল, যেভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে এ-দেশীয় বন-পাহাড় নখদর্পণে রেখেছিল, যে পরিশ্রম ও অসুবিধে স্বীকার করে বিভিন্ন জেলার গেজেটিয়ায় আশ্চর্যভাবে লিখে গেছিল সেই নিষ্ঠা আমরা স্বাধীনতার এতো বছর পরেও দেখাতে পারলাম কই!

এসব দেখে মনে হয়, যে ভালোবাসে, ভালোবাসতে জানে, যার জ্ঞানের স্পৃহা আছে, আবিষ্কারের তাগাদা আছে, সে মালিকানার কথা হয়তো সবসময় ভাবে না। আপন পর জ্ঞানও করে না। ভালোবাসার আনন্দেই তেমন মানুষ ভালোবাসে।

এই জায়গাটাতে কতোরকম যে গাছ-গাছালি, মনে হয় কোনো হর্টিকালচারাল গার্ডেনে ঢুকে পড়েছি বুঝি। এক এক দিকে, পাথরে,জমিতে, পাহাড়ের গায়ে গায়ে এক এক রকম প্ল্যান্টে ভরে আছে। তাকালে, চোখ ফেরানো যায় না। ‘ডিফিওন্-বিচিয়া’, ‘জেব্রা প্ল্যান্ট’, ‘বেবী’জ টিয়ারস্’ আরো কত কী প্ল্যান্ট! জেব্রা প্ল্যান্টরা ব্রাজিলের নেটিভ্।

লজ্জাবতীরও কতোরকম বাহার। ‘বেবী’জ টিয়ারস্’ বা ‘মাইন্ড ইওর ওওন বিজনেস’ প্ল্যান্টের পাতাগুলো সবুজের ওপর সাদা ডোরা। জেব্রার গায়ের ডোরার মতো। বড় উজ্জ্বল হলুদ ফুল ফুটে ছিল তাতে। এখানে ফার্নও-বা কতোরকম। ‘হেয়ারস্ ফুট ফার্ন’ ‘মেইডেনহেয়ার’, আমার ভারি ভালো লাগে। হালকা ছোট ছোট গোল পাতাগুলো এই ফার্নের। ব্রোমেলিয়াসও ছিল এক রকম। ক্রিপ্‌টান্‌থাস্ জোনাটাস্। সবুজের ওপরে হালকা হলুদ আর সাদার ডোরা। বড় বড় পাতা।

আর অর্কিডের তো শেষ নেই। এতো কম উচ্চতায় এতোরকম অর্কিড দেখে রথীদা তো অবাক! সুন্দর অর্কিডগুলোর কটমটে সব নাম বলেছিলেন : “ক্রিস্টোফার লিন’, ‘মিল্‌টোনিয়া ভেক্সিলারিয়া’—অবাক বিস্ময়ে পর পর নাম বলে যাচ্ছিলেন রথীদা।

অর্কিড আমি চিনি না। অন্য প্ল্যান্ট-ট্যান্টও অতো চিনি না। চিনতে চেয়েছি চিরদিন। কিন্তু সুযোগ-সুবিধা হয়নি তেমন। রথীদার কাছ থেকে জেনে নিই। চিনে নিই। পালামৌর বন পাহাড়ে অর্কিড বিশেষ দেখিনি, এক নেতারহাট অঞ্চল ছাড়া। এই জায়গাটা একটা আশ্চর্য ব্যতিক্রম।

আমরা যখন গুহার কাছে পৌঁছেছিলাম, তখন দুপুর হয়ে গেছে। কতো রকমের যে প্রজাপতি ফুলে পাতায় উড়ে বসছে। মনে হচ্ছিল, কোনো স্বর্গরাজ্যে যেন এসে পড়েছি।

নিস্তব্ধ, গহন অরণ্যের বুকের কোরকে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা দু-জন মুগ্ধ বিস্ময়ে।

গুহায় ঢোকার আগে গুহার সামনের নরম মাটি ভালো করে পরীক্ষা করে নিলাম। রথীদা গাছ, ফুল, তারা চেনে। জানোয়ার বা পাখি সম্বন্ধেও ওঁর ঔৎসুক্য কম দেখলাম না। বাঘের পায়ের দাগ আছে। কিন্তু পুরনো।

রথীদাকে বললাম, চলুন এগোই। ঝরনার জল-চোয়ানো নরম মাটিতে পায়ের দাগ না-ফেলে এই গুহাতে ঢোকা বা বেরুনো কোনো জানোয়ারের পক্ষেই সম্ভব নয়। সেইটাই বাঁচোয়া।

গুহাটার মুখটা প্রকাণ্ড বড়। ভিতরে গিয়ে আস্তে আস্তে সরু হয়ে এসেছে। সাবধানে টর্চ জ্বেলে এগোচ্ছিলাম আমরা। কথা বললে গগম্ করে উঠছিল। নিজেদের গলার স্বরে নিজেরাই চমকে যাচ্ছিলাম। দুর্গন্ধি চামচিকে টর্চের আলোয় ও আমাদের শব্দে বিরক্ত হয়ে এদিকে-ওদিকে উড়ে বেড়াচ্ছিল। বাঘের গায়ের গন্ধ এবং হিসির গন্ধেও গুহাটা ভরে ছিল।

কিছুটা এগিয়েই আলো দেখতে পেলাম। কাছে যেতেই দেখি, গুহাটা আরও চওড়া ও উঁচু হয়ে গেছে। এবং আলো আসছে ওপরের স্কাইলাইটের মতো পাথরের ফাঁক-ফোক দিয়ে। সেই ফাঁক-ফোকরগুলো এমন, আলোই আসতে পারে শুধু। বৃষ্টির জল নয়।

আরও এগিয়েই দেওয়ালের সেই আশ্চর্য ছবিগুলো চোখে পড়লো। একজন আদিবাসী শিকারিকে একটি বুনো মোষ তাড়া করেছে। বিরাট-বিরাট বন্য বরাহ—মুখ ব্যাদান করে দাঁত বাগিয়ে ছুটে যাচ্ছে। তির-ধনুক নিয়ে বাঘ শিকার করছে আদিবাসী শিকারিরা। শিকার-করা বাঘ পড়ে আছে তাদের পায়ের কাছে

মোহাবিষ্টর মতো অনেকক্ষণ আমরা গুহার মধ্যেই রইলাম।

বাইরে বেরিয়ে, ঐ ছায়াচ্ছন্ন জায়গা ছেড়ে এসে অপেক্ষাকৃত আলোকিত জায়গায় আসন্ গাছের নিচে, পরিষ্কার একটা বড়ো কালো পাথরের ওপর খাবারদাবার সামনে নিয়ে সতরঞ্জি বিছিয়ে বসা গেল।

রথীদা বলছিলেন, বুঝলি সায়ন, বড়ো অদ্ভুত ব্যাপার। এই গুহার ছবিগুলোর কথা এ-অঞ্চলের কেউই জানে না। বহু বছর হয়ে গেল কেউ আসেও না এদিকে। জানি না, আগে লোকে এর খোঁজ জানতো কি-না। স্থানীয় লোকে জানতো নিশ্চয়ই।

তারপর আত্মমগ্ন হয়ে বললেন, আমরা কী ভাগ্যবান। ইতিহাসের সঙ্গে দেখা হলো আমাদের। ইতিহাসও নয়। বলা উচিত, প্রাক্ ইতিহাসের সঙ্গে।

খেতে খেতে রথীদা নানা কথা বলছিলেন। বলছিলেন আজকে সভ্য মানুষ শিকারকে একটা অমানবিক ব্যাপার বলে মনে করে। শিকার ব্যাপারটাই এখন ন্যক্কারজনক। হয়তো যথার্থভাবেই। কিন্তু আর্টের ইতিহাসের স্ফূরণ বা আর্টের প্রথম বিকাশ কিন্তু এই প্রাগৈতিহাসিক প্রস্তরযুগের শিকারিদের হাতেই। এমন সব গুহায় গুহায় পৃথিবীর কোণায় কোণায় সেইসব শিকারিরা যা এঁকে রেখেছিল, যা খোদাই করে গেছিল; তাই-ই পৃথিবীর আর্টের উৎস। আমাদের পূর্বসূরি, সব শিল্পীর পূর্বসূরিরাই শিকারি ছিলেন। ভাবা যায় না! তাই না?

প্যালেওলিথিক বা প্রাথমিক প্রস্তর যুগ বলতে যা বুঝি আমরা, তাতেও কিন্তু শিকারিরাই ছিল মুখ্য। সেটা ছিল শিকারিদেরই যুগ। কারণ মানুষের আদিমতম পূর্বপুরুষরা শিকার করেই বেঁচে থাকতো। তার অনেক পরে চাষ-বাস করা শিখেছিল মানুষ। তারও অনেক পর আগুন আবিষ্কার করেছিল। ক্রুড আর্টিফ্যাকটস্ থেকে আমাদের পূর্বপুরুষরা আস্তে আস্তে অসীম সৌন্দর্যসম্পন্ন শিল্পে পৌঁছান

একটা রুটি আর আলুর দম মুখে পুরে রথীদা বললেন, স্পেনে কতো সব বিখ্যাত গুহা আছে। তার মধ্যে আল্টা-মিরা একটা। এই হুলুক পাহাড়ের গুহাটা দেখে যে কতো কথাই মনে হচ্ছে! আমরা যে হোমো-ফ্যাবার থেকে হোমো স্যাপিয়েনে উন্নীত হলাম, ভাবতে শিখলাম, ভাবনাকে ভাষান্তরিত করতে, আর্টের মাধ্যমে রূপান্তরিত করতে শিখলাম—এই প্রক্রিয়ার গোড়ায় শিকারিরাই। যদিও একথা বলছি বলে, তুই আমার ওপর হয়তো চটে যাবি। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই চটেছিস ইতিমধ্যেই।

আমি বললাম, চটবো কেন? সত্যেরে লও সহজে…।

এটা আমার আর রথীদার মধ্যে একটা স্ট্যান্ডিং জোক্। রথীদা রথীন্দ্রনাথের কণিকার সব কবিতা চমৎকার আবৃত্তি করেন। শুধু আবৃত্তিই যে করেন, তাই-ই নয়। বলেন, “দিস্ ইজ্ মাই ম্যানুয়াল অফ রাইট সিভিলিজেশান।”

“ভালোমন্দ যাহাই ঘটুক সত্যেরে লও সহজে”–এ-পংক্তিটি রথীদার মুখে সব সময়ই ঘোরে। সুযোগ পেলাম, আমিও রথীদাকে বলে দিলাম।

রথীদা হেসে উঠলেন। বললেন, স্পেনের আল্টা-মিরার গুহায় যেসব ছবি আছে জানোয়ারের শিকারের, সে-সব ছবি আমি একটু আগে যা বললাম, তাই-ই প্রমাণ করে। এসব আমার কথা নয়। গুণী-জ্ঞানীদেরই কথা। আমার মতো করে তোকে বলছি। আমাদের দেশেও এরকম অনেক সব গুহা-চিত্র আছে, যেমন মধ্যপ্রদেশের ভীমবৈকায়।

রথীদাকে বলেছিলাম, পরে একদিন আপনার কাছে ভালো করে এসব শুনব। এখন খাওয়া সারা যাক। ট্রাক থেকে নেমেও আমাদের দুঘণ্টা লেগেছিল গুহা পৌঁছতে পায়ে হেঁটে। তারপর ট্রাকেও লাগবে আধঘণ্টা ভালুমারে ফিরতে।

ঠিক বলেছিস। বলেই, খাওয়াতে মন দিয়েছিলেন রথীদা।

আসলে, আমি এসব দেখেশুনে এতো উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম যে, তোকে বোধহয় খুব জ্ঞান দিয়ে দিলাম একচোট। বোরড় হয়ে গেলি?

কী যে বলেন? কতো কী শিখলাম! কতো নতুন গাছ চিনলাম, পাতা চিনলাম কতো অর্কিড। আপনার সঙ্গে না-এসে একা এলে এসব দেখতাম ঠিকই। কিন্তু কী দেখলাম তার তাৎপর্যই বুঝতাম না।

হুলুক্ পাহাড়ের গুহামুখে বসে সেদিন আর্টের জন্ম আর তার বিকাশ নিয়ে আর কিছু শোনার সুযোগ হয় নি রথীদার কাছ থেকে। তবে বেশ কয়েক মাস পরে, এক কৃষ্ণপক্ষের গরমের হাতে রথীদার বাংলোর সামনে হাতায় বসে যখন আমরা গল্প করছিলাম আর দুজনে মিলে একসঙ্গে তারা দেখছিলাম, চিনছিলাম; তখন ঐ পাহাড়ের দিকে চোখ পড়ায় উনি নিজের থেকেই আবার ওই প্রসঙ্গ তুলেছিলেন।

সেদিন বলেছিলেন যে, প্রস্তর যুগের দ্বিতীয় অধ্যায়, সেটাকে শিকারি যুগই বলা চলে। সেই অধ্যায়ের সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে আর্টের আবিষ্কার। আবিষ্কারও না বলে, উদ্ভাবন বলাটাই ঠিক। এই আশ্চর্য উদ্ভাবন প্রাগৈতিহাসিক মানুষের বিবর্তনধারায় এক ল্যাণ্ডমার্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুস্তেরীয় যুগের (Mousterian ) গুহাগুলোতে কিন্তু কোনো শিল্পকর্মের নিদর্শন পাওয়া যায় নি। প্রথম এর সূচনা দেখা গেছিল অরিগ্‌নিসিয়ান—পেরিগর্ডিয়ান সময় থেকে

রথীদাকে থামিয়ে দিয়ে বলছিলাম, কী সব যে বলছেন, জার্মান ল্যাটিন এই অশিক্ষিত লোককে। আমি মানেই বুঝতে পারছি না। সোজা করে, আমার মতো সাধারণ বুদ্ধির মানুষের বোঝার মতো করে বলুন।

রথীদা হেসে ফেলে বলেছিলেন সরি। না বুঝলেও চলে যাবে। সকলকে সব যে বুঝতে হবেই এমন কোনো কথা নেই। মোটা কথাটা বুঝলেই হলো। বুঝলি, অরিগ্‌নিসিয়ান— পেরিগডিয়ান যুগ থেকেই হঠাৎ যেন শিকারি যুগের লোকেরা রাতারাতি কোনো দৈবশক্তিতে ভর করে আর্টিস্ট হয়ে গেল। তার অব্যবহিত আগের যুগেও কিন্তু আর্টের এমন উৎকর্ষতার অঙ্কুর যে কিছুমাত্রও ছিল, তেমন কোনো প্ৰমাণ নেই। এইটেই বিস্ময়ের।

তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ সিগার খেয়ে, যেন নিজের মনেই বলছেন, এমনভাবে বলেছিলেন, প্রস্তরযুগের দ্বিতীয় পর্বের প্রথম থেকে শেষ পর্যায়ের পুরো সময়েই ভাস্কর্যের সঙ্গে আমরা পরিচিত। তখন ভাস্কর্য বলতে প্রধানত নারীমূর্তি। পৃথুলা নিতম্বিনীই ছিল সব ভাস্কর্যের নারী।

আমাদের দেশের ভাস্কর্যের নারীরাও তো পৃথুলা; নিতম্বে তো বটেই। ঠিক। রথীদা বললেন।

তারপর আলোচনার গম্ভীর বিষয়কে হালকা করতে বললেন কিনা জানি না, বললেন, জানিস তো, দক্ষিণ আমেরিকার বুশ-কান্ট্রির মেয়েদের ওটা একটা বিশেষত্ব। নিতম্বে অস্বাভাবিক মেদ জমে ওদের। যাকে বলে স্ট্রিপ্টোপিগিয়া।

আপনি যে নিতম্বের ওপর এমন অথরিটি তা তো আগে জানতাম না।

রথীদা হাসলেন। বললেন, শুধু নিতম্ব কেন হে ছোকরা? অনেক কিছুর ওপরেই।

রথীদা আবার শুরু করলেন। কিছু কিছু জায়গার গুহাতে যেসব ভাস্কর্য ছিল, তার বেশির ভাগই অন্তঃসত্ত্বা নারীদের। অথবা ভেবে দ্যাখ, ঘোড়াদের মিলনের। হোয়াট আ কন্‌ট্রাসট্। তবে ঐরকম সব বিষয়ের প্রবণতা দেখে পণ্ডিতেরা অনুমান করেন যে, নারীর সন্তান-ধারণের ক্ষমতাকে, মানে উর্বরতাকে, তখন বিশেষ তাৎপর্য দেওয়া হতো। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার কন্দর গুহার অন্ধকারতম কোণগুলিতে পণ্ডিতেরা নানারকম জানোয়ার, ম্যমথস্, জংলি ঘোড়া বল্গা হরিণ, বুনো শুয়োর, জংলি ষাঁড় আর মেয়েদের ছবির ভাস্কর্য দেখতে পেয়েছেন। স্পেনের আল্টা-মিরা গুহার কথাও তো তোকে আগেই বলেছি।

স্বগতোক্তির মতো বললাম, জংলি জানোয়ারের ছবিই আর্টের গোড়ার আর্ট? আশ্চর্য! কিন্তু জানোয়ারের ছবি কেন আঁকতো প্রথম হোমো স্যাপিয়েনরা? এর কি কোনো তাৎপর্য ছিল? ছবিতেও কল্পনারই প্রাধান্য থাকা উচিত ছিল। জানোয়ার শিকার তো করতোই তারা। সেই বাস্তব জানোয়ারের ছবি নিয়ে অত বাড়াবাড়ি কী?

মুশকিলে ফেললি আমাকে। অত কী জানি? তবে মনে হয়, মস্তিষ্কের প্রথম বিকাশের সময় হোমো স্যাপিয়েনদের কল্পনার ক্ষমতা তখনও ফোটে নি তেমন তাছাড়া পণ্ডিতেরা এও বলেন, যে জন্তু-জানোয়ার আঁকার আসল তাৎপর্য ছিল জাদু। বশীকরণ। ধর্, বুকে তির-বেঁধা একটা বিরাট দাঁতাল শুয়োর এঁকে দিল। অন্ধকার গুহার গায়ে এই ছবি আঁকা মানে জীবন্ত বন্য-বরাহকে জাদু করা। হয়তো ওই ছবি দেখতে দেখতে আগেকার দিনের সামান্য হাতিয়ার-সম্বল মানুষগুলোর আত্মবিশ্বাসও বাড়তো। ওরা হয়ত ভাবতো, সাংঘাতিক বলশালী ও হিংস্র জন্তুদের সামান্য হাতিয়ার নিয়েও বাস্তবে মারা খুব সহজ হবে, জাদুর ঘোরে!

বাঃ!

যেসব জানোয়র ওরা খেতো, পাথরের ওপর সেগুলোর ছবি এঁকে, বা তাদেরই হাড়ে তাদের চেহারা খোদাই করে ওরা প্রার্থনা করতো যেন সেই জন্তু-জানোয়ারদের ধরা বা মারা তাদের পক্ষে সহজতর হয়। তখন জীবন বড় সংগ্রামের ছিলো তো।

আমি বললাম, আহা! যেন এখনও সংগ্রামের নয়।

তা নয়, তবে বুঝে দ্যাখ, ঘোড়া পর্যন্ত বশ মানে কি তখনো। মানুষের প্রধান খাদ্যই ছিল তখন ঐসব জন্তু-জানোয়ার। একমাত্র জীবিকাই ছিল শিকার।

তাহলে কাড়ুয়া বেচারীর আর দোষ কী।

রথীদা হাসলেন। বললেন, কোনোই দোষ নেই। আসলে কাড়ুয়া যখন অনন্ত-ঘুম ঘুমোচ্ছিল তখন হোমো স্যাপিয়েনরা এক দারুণ ফাস্ট ট্রেনে চড়ে আজকে আমি-তুই যেখানে পৌঁছেছি, সেখানে পৌঁছে গেছে। কাড়ুয়া হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে দেখে সেই প্রস্তর যুগেই প্রায় রয়ে গেছে ও। কোন স্টেশনে, কোন্ ট্রেনে তার ওঠার কথা ছিল, ও জানে নি। উন্নতির মধ্যে, পাথরের টুকরো বা তির-ধনুকের বদলে ওর হাতে মুঙ্গেরী গাদা-বন্দুক। আমরা যে-স্টেশনে, যে-ট্রেনে পৌঁছেছি কাড়ুয়ার সেখানে আর পৌঁছুনো হয় নি। হলো না।

আমি বললাম, আমরাও কি ঠিক ট্রেনে চেপেছিলাম রথীদা? আমি? আপনি? সংখ্যায় আমরা যারা গরিষ্ঠ, তারা যে-ট্রেনে চড়ে দ্রুতগতিতে কোটি কোটি বছর পেরিয়ে এসে আধুনিক নগরভিত্তিক সভ্যতানামক গোলমেলে স্টেশনে পৌঁছেছি এবং পৌঁছতে পেরে গর্বে বেঁকে রয়েছি বর্তমান মুহূর্তে, সেই গন্তব্যটাই কি হোমো- স্যাপিয়েদের সঠিক গন্তব্য ছিল? আমরা সকলেই কি নিশ্চিত সে বিষয়ে?

রথীদা নড়ে চড়ে বসলেন।

সিগার থেকে প্রচুর ধুঁয়ো ছাড়লেন।

অনেকক্ষণ তারা-ভরা আকাশের দিকে চেয়ে গভীর গলায় বললেন, বড় দামি কথা বলেছিস রে একটা। কথাটা ভাববার মতো। হয়তো অনেকেই পৃথিবীর নানা কোণে বসে এই মুহূর্তে এই কথাটাই ভাবছে। কে জানে? হয়তো কাড়ুয়াই আমাদের সকলের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান্। আমরাই সকলে হয়তো ভুল ট্রেনে চড়েছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *