কোজাগর – ১

তখন গোধূলির আলোয় জঙ্গল-পাহাড়ের অসমান দিগন্তের ওপরের সমস্ত আকাশ এক বিধুর লালিমায় ভরে উঠেছে। চলে-যাওয়া বাসটার পিছনে পিছনে কিছুক্ষণ লাল ধুলোর মেঘ বাসটাকে তাড়া করে গিয়ে, এলোমেলো উড়ে; আলতো হয়ে পথের পাশের গাছ-গাছালিতে, পাথরে, নিঃশব্দে থিতু হল।

বাস থেকে নেমে একটু হাঁটতেই মানিয়ার সঙ্গে দেখা। ও শাল জঙ্গলের ভিতরের সুঁড়িপথ বেয়ে এসে, একবোঝা কাঠ কাঁধে নিয়ে বড় রাস্তায় উঠল। মানিয়া মানে, মানি ওরাওঁ।

বলল, কোথায় গেছিলে বাবু?

ডালটনগঞ্জ।

তোমার জন্যে একটা মুরগি এনেছিলাম সকালে। কিন্তু তিতলি বলল, বাবু মোরগা রাখতে বলে যায়নি। আমি রাখতে পারব না।

ভালোই হয়েছে। ঔরঙ্গাবাদ থেকে আমার যে মেহমানদের আসার কথা ছিল, তাঁরা আসবেন না। ওটা তুই কালকের চিপাদোহরের হাটে বিক্রি করে দিস্। ভালো দাম পাবি। আমাকে তো সস্তাতেই দিতিস!

তোমার কথা আলাদা। ভালোবেসে বলল, মানি।

তারপরই বলল, পা চালাও জোর। অন্ধকার হয়ে’ এলো।

পালামৌর এই জঙ্গল-পাহাড়ের আড়াআড়ি-আসা শীতের সন্ধেকে একটা অশ্রাব্য দেহাতি গাল দিয়ে ও আবার ওর পথে এগোল।

আমিও আমার ডেরার পথ ধরলাম।

সূর্যটা ডুবতে-না-ডুবতেই এখানে শক্ত হাতে শীতটা দু-কান মোচড়াতে থাকে। নাসারন্ধ্রের মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্কের কোষে কোষে শীতের ফুঁ ছড়িয়ে যায়। এই শেষ আশ্বিনেই!

পথের দু-পাশে লিট্‌পিটিয়ার জঙ্গল। ঢেঁাওটা, ঢেঁাটর। মাঝে মাঝে রাহেলাওলার গোল গোল নরম লালচে বেদানার মতো ফুল। তারপরই জঙ্গল গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। কতরকম গাছ-গাছালি! বনজ সন্ধ্যায় গায়ের নিজস্ব গন্ধ উঠেছে চারদিক থেকে। রহসম্যয় এক অচিন গন্ধ। দু-রে….পাহাড়ের নিচে নিচে, যেখানে জঙ্গল খুবই গভীর, সেখান থেকে টিটির্-টি, টিটির্-টি—টিটি টিটি করে একজোড়া টিটি পাখি ডেকে ফিরছে। তাদের গলার আগু-পিছু ক্ষীণ স্বর ভেসে আসছে ভালুমার বস্তির ক্ষেত-খামার, আর জঙ্গলভরা টানা-টাড়ের ওপর দিয়ে। পশ্চিমাকাশে- সন্ধ্যাতারাটা জ্বল জ্বল করছে।

সিম আর লাউয়ের লতা-ছাওয়া বাঁশের বেড়ার দরজা খুলে আমি ভিতরে ঢুকলাম। লালু ভুক্ ভুক্ করে দু-বার ডাকল লেজ নাড়িয়ে। ও এর মধ্যেই খড়ের গাদার ভিতরে সেঁধিয়েছিল। আমার ডেরার বেড়ার পাশেই আগুন জ্বেলেছে রাস্তা মেরামত করা কুলিরা, ওদের ঝুপড়ির লাগোয়া। লালু আমাকে অভ্যর্থনা করেই খড়ের গাদা সেই আগুনের কাছে গিয়ে বসল। দীর্ঘ হিমেল রাতের জন্যে নিজেকে তৈরি করছিল ও।

তিতলি দরজা খুলেই অভিভাবকসুলভ গলায় বলল, এতক্ষণে এলে?

বাস তো এক্ষুনি এলো! শব্দ পাসনি? জানিস না ট্রাক নেই আজকে?

যাওয়ার সময় খুব যে বলে গেলে দুপুরে আসবে। তোমার জন্যে আমারও খাওয়া হল না!

দুপুরেই ফিরব বলে গেছিলাম মনে পড়তেই আমার খুব লজ্জা হল। বললাম, আমার খুব অন্যায় হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দে।

তিতলি ভীষণ লজ্জিত হয়েই, উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলল, ছিঃ, ছিঃ, এ কী! তোমার সঙ্গে কথাই বলব না তুমি এরকম করে কথা বললে!

অন্যায়? তোমার? অবাক গলায় বলল তিতলি।

যেন আমি কখনও কোনো অন্যায় করতেই পারি না।

হাতের জিনিসপত্র রেখে, মুখ-হাত ধুয়ে, জামা-কাপড় বদলাতে গেলাম। ঐ ঘরের পাশে রান্নাঘরে তিতলি আটা মাখছিল, তার শব্দ পাচ্ছিলাম। এ-ঘর থেকেই জিজ্ঞেস করলাম, কী রেঁধেছিস রে আজ?

লাউকির তরকারি আর চানার ডাল।

খুব খিদে পেয়েছে। তাড়াতাড়ি রুটি সেঁকে ফ্যাল্। বেশি করে। দুপুরে তুই খাস নি? কোনো মানে হয়! সত্যিই খাসনি?

সাচ্ না ক্যা ঝুট? উষ্মার সঙ্গে বলল ও।

ওর হাতের বালার সঙ্গে পিতলের থালার ঘষা লাগতে নিক্বণ উঠল।

তারপর নীচু গলায় বলল, আমি তো ভাতই খাব। দুপুরের ভাত কি নষ্ট হবে? হাত-মুখ ধুতে-না-ধুতে মিনিট দশেকের মধ্যে জায়গা করে দিয়ে খাবার নিয়ে এল ও। গরম গরম হাতে-সেঁকা আটার রুটি, লাউয়ের তরকারি, ছোলার ডাল। কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা। মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছি, এমন সময় চুপি চুপি যেন কোনও গোপন কথা বলছে, এমনই গলায় ও বলল, গাড়ুর রেঞ্জার সার্ তোমার জন্যে নিম্বু, আমলকী আর মিরচার আচার পাঠিয়েছেন। দিই একটু?

তাড়া দিয়ে বললুম, দে দে। দিস নি কেন এতক্ষণ? লেবুর আচার তো তুই-ই দু’দিনে শেষ করে দিবি চুরি করে খেয়ে। আমার জন্যে তো কিছুই থাকবে না।

ও গাল ফুলিয়ে বলল, হ্যাঁ। আমি তো হলাম গিয়ে চোর-ডাকাইত্। তোমার সর্বনাশ! তাহলে আমাকে জেনে-শুনে রাখাই বা কেন?

এখানের সব লোকই তো চোর। ভালো লোক পাই না বলেই রাখি। বাধ্য হয়ে। হ্যারিকেনের আলোয় আলোকিত ওর ব্যথিত মুখের ওপর এক ঝঙ্কায় ত্ৰস্ত বাঁ-হাতে আঁচলটা টেনে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, তুমি দেখো তোমার চাকরি সত্যিই ছেড়ে দেবো কাল থেকে। আমরা চোর তো চোর! না খেয়ে থাকব, তাও ভি আচ্ছা। আর একটু ডাল দে। তোকে আমি ছাড়লে তো! তোর ইচ্ছেয় কি চাকরি হয়েছিল যে তোর ইচ্ছেয় যাবে?

ও এবার কপট রাগের সঙ্গে পিতলের হাতা করে গরম ডাল এনে বাটিতে ঢেলে দিয়ে বলল, অনেক পাপ করলে তোমার মতো মনিব পায় লোকে।

এমন সময় বাইরে টেটরার গলা শোনা গেল।

টেটরা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, এসে গেছিরে তিতলি।

তিতলি বলল, কুলিদের ঝুপড়িতে একটু আগুন পোয়াও বাবা। বাবুর খাওয়া হয়নি এখনও।

টেটরাকে ভিতরে এসে বসতে বললাম। ঘরের মধ্যে মাটির মাল্সাতে কাঠকয়লার আগুন রাখাই ছিল। সন্ধে থেকে না-রাখলে ঘর গরম হতে বড় সময় নেয়। টেটরা পাশের ঘরে বসেই আমার সঙ্গে কথা বলতে লাগল। নানা কথা ডালটনগঞ্জে আটার কেজি কত? কাড়ুয়া তেল আর মিট্টি তেলের আমদানি কীরকম! শুখা মহুয়ার দাম কি আরো বেড়েছে এ বছর?

মেঝেতে শালকাঠের পিঁড়িতে আসন করে বসে আমি খাচ্ছিলাম। তিতলি হ্যারিকেনটা একটা কাঠের টুকরোর ওপর রেখে আমার সামনে বসে ছিল।

ঐ ঠোঙায় কী এনেছ আমার জন্যে?

তুই-ই বল।

ওর মুখ খুশিতে ঝল্‌মল্ করে উঠল।

আমি জানি। বলব? বাজি!

খুলে দ্যাখ্।

ও আস্তে আস্তে উঠে আমার ঘর থেকে প্যাকেটটা এনে খুলে ফেলল। খুশিতে ওর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। বলল, ওমাঃ, এত্ত! এত্ত কেন আনলে?

সকলে মিলে ফোটাবি। মজা করবি। তোর জন্যে একটা শাড়িও এনেছি। দেওয়ালির দিনে পরবি। নিয়ে যা। বাজিগুলোও নিয়ে যা।

না, না, এখন কিছুই নেবো না। দেওয়ালির দিন সকালে দিও, তোমাকে প্রণাম করব যখন। দেওয়ালির আর কতদিন বাকি?

ছ’দিন। রাতে অন্ধকার কেমন চাপ বেঁধে থাকে দেখিসনি? চাঁদ ওঠে সেই শেষ রাতে, তাও একটুখানি

ও কিছু না বলে, ঠোঙাটা ঘরে রেখে আসতে গেল।

আমার খাওয়া হয়ে গেলে, তিতলি থালায় ওর খাবার গুছিয়ে নিয়ে বাঁ-হাতে তুলে ধরে বাঁ-কাঁধের ওপর নিল, আর ডান হাতে কেরোসিনের কুপিটা। তারপর এক ঝাঁকিতে বাচ্চা শিমুলের মতো সটান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষারত টেটরাকে ডাক দিয়ে বলল, চল্ বাবা!

এসব জায়গায় সন্ধের পর কেউ ঘর থেকে বেরোয় না বড় একটা। যদি-বা কখনও বেরোতেই হয়, খালি হাতে এবং আলো ছাড়া কখনওই না। টেটরার কাঁধে টাঙ্গি তিতলির হাতে আলো।

খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে আমি দেখলাম, টেটরা আলো হাতে পথ-দেখানো মেয়ের পিছন পিছন বড় বড় পা ফেলে মোড়ের ঝাঁকড়া মহুয়া গাছটার কাছে পৌঁছে পাকদণ্ডীর পথ ধরল বস্তির দিকে।

আমি জানি, তিতলি যেটুকু খাবার নিয়ে যায়, মানে যেটুকু ওকে দিই; ওর মতন, তা তিতলি তার মা-বাবার সঙ্গে ভাগ করেই খায়। হয়তো ওর নিজের পেটও ভরে না। ওরা সারা বছর এ-বেলা ও-বেলা যা খায়, তা না-খাওয়ারই মতো। অথচ আমার এমন সামর্থ্য নেই যে, ওর পরিবারের সমস্ত লোককে আমি খাওয়াই। সে সামর্থ্য থাকলে আমার মতো খুশি কেউই হত না। দু-বেলা খাওয়ার পরই রোজ আমার ওদের কথা মনে হয়। এবং মনে হওয়ায় বেশ অনেকক্ষণ মনটা খারাপ থাকে। নিজে পেট ভরে দু-বেলা ভালো-মন্দ খেতে পাই বলে একটা অপরাধবোধও জাগে মনে।

দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। অন্ধকারে, শীতার্ত তারা-ভরা রাত; বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। খাপ্পার চাল, মাটির দেওয়ালের ঘরে দড়ির চৌপাইতে বসে আমি একটা পান মুখে দিলাম। চৌপাই-এর নিচে মাল্সায় কাঠ-কয়লার আগুনের উষ্ণতা ধীরে ধীরে শরীরকে গরম করে তুলছিল। শীতের রাতে সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গেই এধারের ঘরের বাইরের জীবন স্তব্ধ হয়ে যায়। সবাই খেয়ে-দেয়ে দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ে। শুধু ক্ষেতে ক্ষেতে রাখওয়ার ছেলেদের ক্যানেস্তারা পিটিয়ে শুয়োর হরিণ তাড়ানোর আওয়াজ পাওয়া যায় এদিক-ওদিক থেকে। কুথি আর অড়হর ক্ষেতে শম্বরের দল আসে। যেদিন হাতি আসে, সেদিন আছাড়ী পট্‌কা, মাদল, ক্যানেস্তারার সম্মিলিত শব্দে মাঝ রাতে আচমকা ঘুম ভেঙে যায়। সকলেই যে যার মাটির ঘরে উৎকর্ণ, উৎকণ্ঠিত হয়ে থাকে। একসময় বাইরের রাখওয়ারদের চিৎকার চেঁচামেচি স্তিমিত হয়ে থেমে যায়। তখন পাশ ফিরে সকলে আবার ঘুমোয়।

ঘুমোতে পয়সা লাগে না। একমাত্র ঘুমোতেই! তাই, ওরা খুব ঘুমোয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *