২৪
দিন দুয়েকের জন্যে আমায় চিপাদোহরে গিয়ে থাকতে হবে। এ ক’দিন তিতলির ছুটি। ডেরা বন্ধ করে ও মা-বাবার কাছে গিয়ে থাকবে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর রথীদা হঠাৎ হাজির হয়ে প্রায় জোর করেই আমাকে পাড়ে নিয়ে চললেন। বললেন, তোকে এতদিন যে কেন নিয়ে যাইনি ঐ জায়গাটাতে তা জানি না।
আমি এখানে আছি বেশ কয়েক বছর অথচ কখনও ভারতেও পারিনি যে, এমন একটা জায়গা আমার ডেরার মাত্র তিন মাইলের মধ্যেই আছে। কী করে জায়গাটা এতদিন আমার চোখে পড়েনি তা ভেবে নিজেও অবাক হলাম। কাড়ুয়ার মুখে বহুবার শুনেছি যে গভীর বনের মধ্যে গা-ছম্ ছম্ সুন্-সান্নাটা জায়গায়, যেখানে দুধুলি আর কাশ ফুল ফোটে বছরের বিভিন্ন সময়ে, জিন-পরীরা হাত ধরাধরি করে খেলতে নামে পূর্ণিমার রাতে। পরেশনাথের সঙ্গে একদিন যে নালাটার উপর দাঁড়িয়েছিলাম বড় বড় আমলকী বনে ছাওয়া পায়ে চলা পথে, যেখানে পরেশনাথ জলে পড়ে গিয়ে লাল তিতলি বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল; সেই নালাটার পাশ দিয়েই মাইল দুয়েক হেঁটে গিয়ে আমরা শেষ বিকেলে একটি বিস্তীর্ণ দোলামতো জায়গায় এসে পৌঁছলাম। বহুদুর অবধি ঘাসে ছাওয়া ছিল সেই দোলা, ঐ শেষ শীতেও। যেখানে মাটি নরম সেখানে অসংখ্য জানোয়ারের পায়ের দাগ। বাইসন, শম্বর, চিতল, হরিণ, বার্কিং ডিয়ার, বুনো মোষ, সজারু শুয়োর, নীল গাই, বড়ো বাঘ এবং চিতারও। পরেশনাথের সেই নালাটিই একটি নদীর মতো হয়ে বয়ে গিয়ে মাঝে একটি বিলের মতো সৃষ্টি করেছে। তারপর বিলের অন্য পাড় দিয়ে আবার বহতা নদী হয়ে চলে গেছে। পশ্চিমদেশীয় এই রুখু মাটিতে কোন্ অদৃশ্য চিত্রকর নরম নীল সবুজের আচমকা তুলি বুলিয়ে কেমন যে এক শান্ত স্নিগ্ধতা দিয়েছেন সমস্ত পারিপার্শ্বিককে তা বুঝিয়ে বলার মতো কলমের জোর আমার নেই! যে সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করা যায় না, যা চোখের সম্পূর্ণ দৃষ্টি মেলে এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়র সামগ্রিকতা দিয়েও পরিপূর্ণভাবে অধিকার করা যায় না। যা আমাদের চেনাজানার পরিচিত অনুভূতির এবং করায়ত্ত জ্ঞানের সমস্ত সীমিত ও চিহ্নিত অভিজ্ঞতাকে পুরোপুরি অতিক্রম করে এক নৈর্ব্যক্তিক ইন্দ্রিয়-অগ্রাহ্য জগতে পৌঁছে দেয়; তাই-ই বোধহয় অমৃত। তাই-ই বোধহয় ঐশ্বরিক সৌন্দর্য!
কী একটা পাখি ডাকছিল জোরে জোরে। রথীদা আমার তাৎক্ষণিক অন্যমনস্কতা ছিঁড়ে দিয়ে আঙুল তুলে বললেন দ্যাখ্ বারবেট্ ডাকছে কেমন। তাকিয়ে দেখলাম বসন্তবৌরি। ইংরিজি নাম নিশ্চয়ই বারবেটই হবে। পাখির নাম তো মানুষের দেওয়া; দেশ ভেদে নাম ভেদ। কোনো বিশেষ নামে নাই-ই ডাকলাম কোনো পাখিকে কারণ পাখি তো আর এই পরিপূর্ণ আদিগন্ত ক্যানভাসে একা নয়, একমাত্রও নয়। এই শেষ বিকেলের কোমল নরম আলোয় উদ্ভাসিত আশ্চর্য এই আকাশ, শীত যাই-যাই গোধূলির বিধুর কমলা রঙে ছাপানো গাছ-গাছালি; এই নীল সবুজে মাখামাখি তিরতিরে নদী ও সেই নদীতে গা-ধুতে আসা প্রকৃতির গায়ের এই মিষ্টি শান্ত স্নিগ্ধ গন্ধ, এই সামগ্রিকতার মধ্যে এই হলুদ পাখিটি একটি আঙ্গিক বইতো নয়! এর নিজস্ব ভূমিকাকে এই সমগ্রর মধ্যে মিলিয়ে দিলেই তো আর তার নাম জানার প্রয়োজন নেই আমার। সে তো আমার চোখে, আমার নাকে, আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে চিরদিন একটি ফ্রিজ-শর্টের মতোই রয়ে গেল; রয়ে যাবে চিরদিন; যতদিন না আমি চিতার ছাই হয়ে যাচ্ছি। মনে হয় এই সহজ সরল চোখ দিয়ে রথীদা বা বিজ্ঞানীরা কোনো কিছুকে দেখতে বা মানতে রাজি নন। আজকের যুগ তাঁদেরই যুগ। সায়ান্টিস্ট্ থেকে কম্যুনিস্ট সকলের কাছেই ঈশ্বরে বা কোনো শক্তিতে বিশ্বাস করাটা একটা প্রাগৈতিহাসিক মূঢ়তা।
কিন্তু আমি যে মুঢ়! মূঢ়ই থাকতে চাই। আবিষ্কারকে কখনও আমি সৃষ্টি বলে মানতে রাজি নই। তাঁকে অস্বীকার করি এমন স্পর্ধা বা বিদ্যা তো আমার নেই। কখনও যেন না-ও হয়। আমি এমনিই থাকতে চাই। রথীদা রথীদাই থাকুন।
কত যে পাখি! যেন পাখির মেলা বসেছে। কতরকম তাদের ডাক। কিছু কিছু ডাক চেনা আর অনেকই অচেনা। জলের পাখি এবং জলভেজা স্নিগ্ধ জঙ্গলের পাখিরা সচরাচর এই পালামৌ অঞ্চলের রুক্ষ, দুর্দম, পৌরুষময় পটভূমি ভালোবাসে না। তারা নরম বাংলার জলজ প্রকৃতিই বুঝি বেশি পছন্দ করে। কিন্তু এতরকম ও এত পাখি যে এতদিন এখানে লুকিয়ে ছিল বনের বুকের কাঁচুলির আড়ালের সুগন্ধী স্নিগ্ধ উষ্ণতায় এ এক বিস্ময়!
রথীদাও পাগলের মতো করতে লাগলেন। বললেন, প্রায় বছর পাঁচেক পরে এলাম এই জায়গাতে বুঝলি। এখানে ইজিলি একটা বার্ড স্যাংচুয়ারি করা যায়। পাখির সংখ্যাও বেড়ে গেছে দেখছি অনেক। আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে রথীদা একটু উঁচুপাথুরে জায়গায় বসলেন। কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন। বললাম, একটু চুপ করবেন রথীদা? এই জায়গাটারও হয়তো কিছু বলার আছে আমাকে, আপনাকে একটু চুপ করে শোনাই যাক। রথীদা বিরক্ত হলেও, মুখে বললেন; বেশ! বেশ! বলেই, সিগারেট ধরালেন একটা। দেশলাই জ্বালানোর ফস আওয়াজের পর সমস্ত জায়গাটি, নদী, ছোটো ছোটো তরঙ্গর বিলটি, গাছের পাতায় ধীরে-সুস্থে বয়ে যাওয়া মন্থর হাওয়াতে মন নিবদ্ধ করে রথীদা যেন চমকে উঠলেন। এদের যে সত্যিই এত কিছু বলার ছিল, বলার থাকতে পারে; তা বোধহয় রথীদাও মানতেন না।
ভাবছিলাম, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যকের সরস্বতী কুণ্ডর কথা। চারদিকে গাছ-গাছালি, মধ্যে জল, স্পাইডার লিলি এবং নানারকম জলজ গাছ আর সেই একান্ত লাগল মানুষটি, কী যেন নাম তার? মনে পড়ছে না, যে কোথা থেকে-না কোথা থেকে কত না গাছ এনে সরস্বতী কুণ্ডে পুঁতেছিল! কত বাংলা ইংরাজি বই-ই তো পড়ি, পড়লাম; কিন্তু আরণ্যকের মতো বই ক’খানা পড়লাম? যা থাকার তা থাকেই। আপাতদৃষ্টিতে কাগজের বড় বড় হরফের বিজ্ঞাপনে; স্তাবক এবং মদের-টেবিলের মোসাহেব সঙ্গীদের উচ্চগ্রাম প্রশংসায়; বা প্রবল ক্ষমতা ও দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন এবং নিজ উদ্দেশ্য সাধনের নিরন্তর চেষ্টায় ব্যাপৃত কোনো সম্পাদকের উচ্চমন্য মতামতে; যা থাকবেই বলে মনে হয়, তা দেখি প্রায়শই থাকে না। উঁচু করে তুলে ধরে তাতে চতুর্দিক থেকে আলো ফেললে শাড়ি জামা বা অন্য যন্ত্রজাত দ্রব্যাদি হয়তো উঁচুমানের বলে পরিগণিত হতে পারে, কিন্তু সাহিত্যকর্ম কোনোক্রমেই হয় না। যাঁর সম্মানে কোনো রিগিং নেই, যে—নির্বাচনে কোনো দলের প্রভাব নেই, কালো-টাকার খেলা নেই, শুধুমাত্র পাঠকের বিবেচনায় যে লেখক নামী লেখকত্ব অর্জন করেন তিনিই প্রকৃত লেখক। নইলে, আজ বিভূতিভূষণের মৃত্যুর এতবছর পরও এই গহন বনের মধ্যে বসে বিভূতিভূষণকে এমন করে মনে পড়ে কেন?
নানারকম পাখি ডাকছে চারধার থেকে। সুরে, গমকে গিট্কিরিতে, আরোহণ-অবরোহণে শুদ্ধ কোমল ও কড়িমার ছোঁয়ায় গগম্ রম্রম্ করছে। সেই সব সুরে কত যে রাগরাগিণীর আলাপ, তান; বিস্তার। নেশা লাগে। আমার বড় নেশা লাগে। প্রকৃতির নেশা, যে কী নেশা, তা যদি মদ, গাঁজা, আফিং, গুলি, মারিজুয়ানা, হাশীস্ ও নানারকম ডোপ্ খাওয়া মানুষেরা একটু জানত। এ নেশায় মানুষ পবিত্র হয়, সিদ্ধ হয়, মুক্ত হয়। ওরা জানে না। কিন্তু আমি জানি। এই নিবিড় নেশার খোঁজ বিলক্ষণ রাখি। একদিন এই শহুরে সভ্য মানুষদের সকলকে, প্রত্যেককে, স্কাইস্ক্র্যাপারের জঙ্গল ছেড়ে ডিজেল আর পেট্রোলের ধুঁয়ো-ভরা পরিবেশ ছেড়ে, নেশার জন্যে নয়, শুধু একটু বেঁচে থাকার জন্যে, একটু সবুজ চোখে দেখার জন্যে, বনের পটভূমিতে একটু পাখির ডাক শোনার জন্যে নিতান্ত অমানুষ হয়ে যাবার পর একদিন শুধুমাত্র তার স্বাভাবিকতা ও মনুষ্যত্ব ফিরে পাবার জন্যেই ভালুমারের মতো জংলি জায়গায় ফিরে ফিরে আসতেই হবে।
আমি অতি নগণ্য একজন মানুষ। কোনো প্রশংসা বা খেতাব বা স্তুতির লোভ আমার নেই। কিন্তু এই আমার ভবিষ্যদ্বাণী। তথাকথিত শিক্ষায় শিক্ষিত শহুরে মানুষরা ভুল স্টেশনে নিয়ে চলেছে নিজেদের দ্রুতগামী আত্মঘাতী পথে। এখনও বোধ হয় সময় আছে আমাদের সকলেরই সামনের কোনো বড়ো জংশনে ট্রেন বদলে কাড়ুয়ার ট্রেনে চড়ে পড়ার
হঠাৎ রথীদা বললেন, ঐ দ্যাখ্ টুনটুনি। বেশ কিছুদিন হল রথীদা পাখি নিয়ে পড়েছেন। আগে পাখি সম্বন্ধে বিশেষ উৎসাহ ছিল না বললেই চলে। আর বোধহয় চুপ করে থাকা সম্ভব হল না রথীদার পক্ষে। আবার বললেন, দেখেছিস্। বিরক্ত গলায় বললাম, টুনটুনি তো ছোটবেলা থেকেই দেখছি। এ তো চেনা পাখি। নতুন পাখি দেখাও। রথীদা উত্তর না দিয়ে নিজের মনেই বললেন, ইংরিজি নাম জানিস? টেইলর বার্ড। চুপ করে থাকলাম। জানতাম, সব টুনটুনিরাই মিথ্যা কথার জাল বোনে আর তারপর নিজের সুবিধামতো ছিঁড়ে ফেলে নতুন কথার ছুঁচসুতো নিয়ে সেই জাল আবার রিপু করে। ঐ যে! ঐ যে! ঐ দ্যাখ্ ঐ কাঠঠোক্রাটা। ওটার নাম জানিস? লিটল স্কালীবেলিড্ গ্রিন উপেকার। আর দ্যাখ্ ঠিক তার উল্টোদিকের গাছে একটা ব্রাউন (রুফার্স) উডপেকার। চুপ করে শুনছিলাম। শুধু মাছরাঙাই কত রকমের দেখেছিস?
নিজেই স্বগতোক্তি করলেন, কী মাছ পায় রে ওরা এখানে?
বিলটাতে বোধহয় অনেক রকম মাছ আছে। রামধানীয়া চাচাকে নিয়ে এলে হতো। ও জলের গন্ধ শুঁকেই মাছের নাম বলতে পারে।
চুপ কর। তুই বড্ড কথা বলছিস-পাখিগুলো উড়ে যাবে। দাঁড়া, তোকে মাছরাঙাগুলো চেনাই। বাঁয়ে আঙুল তুলে, রথীদা জলের পাশে ঝুঁকে পড়া একটা হরজাই গাছের ডালে-বসা বড়ো একটা মাছরাঙাকে দেখিয়ে বললেন, ওটা চিনিস? কিং-ফিশার! আর ঐ দিকে দ্যাখ, ঐ যে রে, ডানদিকের একেবারে কোণে, স্কট্বিল্ড। তার চেয়ে একটু এগিয়ে আয়, ব্রাউন-হেডেড। এবার সোজা তাকা, ঐ যে পাখিটা উড়ে গিয়ে বসল মরা গাছটার কালো ডালে; ওটাকে বলে পাইড কিং-ফিশার? রঙ দেখেছিস—সাদা কালো?
ঐদিকে অবাক হয়ে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন রথীদা। বললেন, আহা! কত রকমই আছে!
একটা ছোটো পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল আমাদের মাথার উপর দিয়ে।
ওটা কী পাখি? আমি চমকে উঠে বললাম।
এক ঝলক দেখে নিয়েই রথীদা বললেন, মিনিভেট্
আমি বললাম, স্কার্লেট মিনিভেট দেখেছি আমি।
বাংলা নাম্, সহেলী। রথীদা বললেন।
সহেলী?
অবাক হলাম নামটি শুনে।
এতেই অবাক! আরও কত সব মিষ্টি নাম আছে পাখিদের। নামগুলো যেন পাখিগুলোর চেয়েও মিষ্টি। যেমন ধর বাটান, সবুজ বাটান, গ্রিন স্যাণ্ডিপাইপার। তারপর টিটি!
টিটি সকলেই চেনে।
তারপর ধর, পাতাসি, হাউস-সুইফট্ বাঁশপাতা, কমোন গ্রিন বিটার, পাতা ফুট্কি, ডাস্কি লিফ্ ওয়ালার ব্ল্যাক রেড স্টার্ট। আরও শুনবি, তো’ শোন। ফুল্কি, ফিরোজা, ভেরিডিটর, ফ্লাইক্যাচার।
একটু চুপ করে থেকে বললেন, রামগাংরা; গ্রে—টিট্।
ধ্যুত্। আমি বললাম। শেষকালে একেবারে অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স। এত সব মিষ্টি মিষ্টি নামের পর রামগাংরা একটা নাম হলো।
কেন? কেন? কাংড়া পেইন্টিং ভালো হতে পারে, ভাংড়া ড্যান্স চমৎকার হতে পারে আর রামগাংরা পাখির বেলায় যত দোষ! সব ঘরানা ভালো করে খুঁজে দেখলে ইনডিয়ান ক্লাসিকাল মিউজিক-এ এই নামেই কোনো দুর্ধর্ষ রাগ-রাগিণীও বেরিয়ে পড়তে পারে। আশ্চর্য কিছুই নয়।
রথীদার কথা শেষ হবার আগেই আমাদের ঠিক উল্টোদিকে, ছোট্ট বিলটার ওপারের জঙ্গলের গভীরে বেশ কাছে থেকেই বড় বাঘ ডাকল। উঁ—আঁউ! অত কাছ থেকে ডাকাতে, মনে হলো জলে যেন ঢেউ খেলে গেল। গাছে, পাতায়, ফুলে, ঘাসে কানাকানি হলো। আমার আর রথীদারও সঙ্গে সঙ্গে চোখাচোখি হলো। জঙ্গলের সব জিনিসের সব জায়গার, নির্দিষ্ট সময় আছে। অধিকার-অনধিকার ভেদ আছে। এই জায়গা এখন বড় বাঘের। এই গোধূলিবেলার পর আবার অন্য প্রাণীদের হবে। পূর্ণিমার মাঝরাতে জিন-পরীদের। আর একটু আগে তো পাখিদেরই ছিল।
বাঘের ডাকের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জায়গাটা উৎকণ্ঠিত, উন্মুখ হয়ে রইল এক স্তব্ধ নীরবতায়। আমি আর রথীদা আস্তে আস্তে ফেরার পথ ধরলাম : বনের রাজাকে সম্মান দেখিয়ে। কিছুটা এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললাম, কেমন শুনলেন বাঘের ডাক?
রথীদা মুখটা আকাশের দিকে তুলে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বললেন, রামগাংরা?
হাসি সামলে, জোর পায়ে আমরা বাঘের এলাকা পেরিয়ে এলাম।
যখন ভালুমারের বড়ো রাস্তায় এসে উঠলাম। তখন রাত নেমে গেছে। রথীদা ডাইনে মোড় নিলেন, আমি বাঁয়ে। বললেন, ওখানেই চল্ সায়ন
না থাক, গোছগাছ করে নেব একটু। কাল একেবারে ভোরে ভোরে বেরিয়ে পড়ব।
কোথায় যাবি?
চিপাদোহর।
ফুঃ! গোছগাছের বহর দেখে মনে হচ্ছে যেন বিলেতেই যাচ্ছিস। তারপর নিজের বাংলোর পথ ধরলেন।
দূর থেকে ডেরার বারান্দায় বাঁশের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হ্যারিকেনটা দেখা যাচ্ছিল। আজকাল বনের বুকের মধ্যে কী যেন সব ঘটনা ঘটছে। ঋতু বদল হবে শিগগির। চারদিকে ফিসফিস করে কারা যেন কথা কয় চুপিসারে। ভালুমারের বন বুঝি ঋতুমতী হবে। শীত কমে এসেছে। দোলের পরই গরম পড়তে শুরু করবে। সরস্বতী পুজোটা কাটবে আমার চিপাদোহরে। বাল্মীকি-প্রতিভার বাল্মীকি বলেছিলেন, “যাও লক্ষ্মী অলকায়, যাও লক্ষ্মী অমরায়, এসো না এসো না এ গহন বনে!” কিন্তু এখানে আমাদের এই জঙ্গলের বাঁশবাবুদের সরস্বতীর সঙ্গে প্রায় সংস্রবই নেই কোনো! লক্ষ্মী আছেন অটুট কমলাসনে, আমার মালিকের ভাণ্ডারে মার্সিডিস ট্রাকে, প্রাইভেট গাড়িতে। যদিও ট্রাকের মাথায় গণেশ মহারাজের ছবি ঝোলে। আসল দেবী কিন্তু লক্ষ্মী! আরও আছেন বিশ্বকর্মা। সরস্বতীর আরাধনা কেউই করে না। নান্টুবাবু আর নিতাইবাবু অবশ্য বাংলা বই পড়েন, নানা জায়গা থেকে জোগাড় করে এনে। কিন্তু ওঁরা এখানে একেবারেই বেমানান।