কোজাগর – ১১

১১

সেদিন বোধহয় শুক্রবার, হাটবার ছিল। হুলুক পাহাড় থেকে ট্রাকে করে ভালুমারে ফিরতেই দেখি, আমার ডেরার বাইরে কোম্পানির একটি ডিজেলের জিপ দাঁড়িয়ে। সিং ড্রাইভার খৈনী মারছিল দু হাতের তেলোয়, জিপে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। ডেরার উঠোনের কাঠের বেড়াতে তিনটি রঙিন শাড়ি মেলা ছিল। প্রায় শুকিয়ে এসেছে শাড়িগুলো। এক্ষুণি তুলে না নিলে হিমে ভিজে যাবে।

ঘাবড়ে গিয়ে, সিংকে শুধোলাম, কী ব্যাপার? সিং বলল, আপ্‌কি মেহমান্ লোগ ডালটনগঞ্জ আয়ে থে।

কাঁহাসে? অবাক হয়ে শুধোলাম আমি।

রাঁচি হোকে আয়েথে, সায়েদ কলকাত্তাসে। হুঁইয়েসে মালিক জিপোয়া দেকর্ উন্‌লোগোঁকো হিয়া ভেজিন্। মালিক বলিন্ কী, জিপোয়া যবতক মেহমানলোগ রহেঙ্গে; তবতক্ উনলোগোকা ঘুমান-ফিরানাকে লিয়ে আহিকা পাস্ রাখনেকে লিয়ে। চার রোজ বাদ ইসি জিপোয়াসে উনলোগোঁকো রাঁচি ছোড়কর আয়েঙ্গা।

উঠোনে ঢুকতেই দেখি ছোটমামা ও ছোটমামি মোড়া পেতে বসে চা খাচ্ছেন আর তিতলির সঙ্গে গল্প করছেন। একজন ভদ্রলোক ওদের পাশে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বসে কাগজ পড়ছেন। ইংরিজি খবরের কাগজ। বোধহয় রাঁচি থেকে নিয়ে এসেছিলেন।

ছোটমামা বললেন, আয়, আয় দ্যাখ্ কেমন জাঁকিয়ে বসেছি আমরা।

ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করলেন আমাকে। আমারই সমবয়সি হবেন উনি। তবে অনেক কেতাদুরস্ত। চেহারাও সুন্দর। আন্দাজে বুঝলাম, ইনিই আমার হবু-স্ত্রীর দাদা।

ছোটমামা আলাপ করিয়ে দিলেন, এই যে রণদেব চ্যাটার্জি।

আমি প্রতি নমস্কার করলাম।

আমার ঘর থেকে এক ভদ্রমহিলা বেরোলেন বোধহয় ঘুমোচ্ছিলেন। চোখ ফোলা ফোলা, চুল উস্কো-খুস্কো। সিঁথিতে সিঁদুর ছিল না। আজকাল মেয়েরা বিবাহিতা কিনা সিঁথি দেখে তা বোঝার উপায় নেই। একটা হলুদ-লাল ছাপা শাড়ি পরে ছিলেন।

উনি হাত তুলে নমস্কার করে বললেন, আমার নাম বাণী

রণদেব আলাপ করিয়ে দিলেন। বললেন, আমার স্ত্রী।

আবার নমস্কার করলাম আমি। তারপর বোকার মতো বললাম, আগে খবর দিয়ে এলেন না? কত না অসুবিধে হল আপনাদের।

কীসের অসুবিধে? কী দারুণ জায়গায় থাকেন আপনি। আমার তো ইচ্ছে করছে এখানেই থেকে যাই সারাজীবন।

রণদেব বললেন।

কলকাতা থেকে দু-একদিনের জন্যে এসে সকলেই এমন বলেন। সত্যি সত্যিই সারাজীবন থাকলে হয়তো নির্বাসন বলে মনে হবে।

রণদেববাবু আমার মোটা কাপড়ের পায়জামা, দেহাতি সবুজ-রঙা খদ্দরের ইস্ত্রিবিহীন পাঞ্জাবি এবং ধূলিধূসরিত চটি এবং হয়তো আমার চেহারা দেখেও মনে হল, একটু শক্ড হলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সামলেও নিলেন।

বাণী ঘরের ভিতরে অদৃশ্য কাউকে উদ্দেশ করে ডাকলেন, এই জিন্ বাইরে আয়। ভিতর থেকে রিন-রিনে স্বরে একজন নারীকণ্ঠে উত্তর দিলেন, আর একটু ঘুমুতে দে বৌদি! এতখানি পথ জিপে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে এসে হাড়গোড় সব ভেঙে গেছে। এই জঙ্গলে তো আর পালাতে পারব না কোথাওই। আসছি একটু পরে।

কথা শুনে আমি লজ্জিত হলাম। আমার বাসস্থান, পথ এবং হয়তো আমারও কারণে ভীতও হলাম। ভদ্রমহিলা কী খুবই চটে রয়েছেন আমার সঙ্গে বিয়ের কথা হওয়ায়?

মেয়েটির গলার স্বর খুবই ভালো লাগল। গলার স্বর শুনেই আমি মোটামুটি বুঝতে পারি কে কেমন দেখতে, কার কেমন স্বভাব। অন্তত এতোদিন ভাবতাম যে, পারি।

এই ভগ্নকুটিরে কলকাতার মহিলাদের পদার্পণ এই-ই প্রথম। লজ্জা, আনন্দ এবং ভয় মিলে-মিশে আমি কেমন বোকা বোকা হয়ে গেলাম। আয়নাটা কাছে থাকলে একবার নিজের মুখটা দেখে নিতাম, কেমন দেখাচ্ছে। কিন্তু আয়না যে ঘরে, সেই ঘরেই যে-আমার আয়না হবে; সে শুয়ে আছে। যে—ঘরে একজন অনাত্মীয়া এবং অপরিচিতা মহিলা শায়িতা অবস্থায় আছেন সেই ঘরে এখন ঢোকা যায় না। যদি সে ভবিষ্যতে পরমাত্মীয়া হয়েও ওঠে, তবেও না।

ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতে।

তিতলি আমাকে চা এনে-দিল। ওর মুখ দেখে মনে হল, ও আজ দুপুরে খাওয়ার সময় পর্যন্ত পায় নি, ওকেও কেমন বোকা বোকা দেখাচ্ছিল। আমি চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে উঠোনের এক কোণায় তিতলিকে ডাকলাম। ফিফিস্ করে বললাম, কী কী সওদা করতে হবে বল। এক্ষুণি বেরোব আমি। ও বলল, ডালটনগঞ্জ থেকে ওঁরা বারোটা মুরগি, ছোটো এক ঝুড়ি ডিম্, কিছু আলু পেঁয়াজ, অন্যান্য আনাজ এবং তিন কেজি মতো পাঁঠার মাংস জিপেই নিয়ে এসেছেন। যেমন ঠান্ডা আছে এখন, তাতে রান্নাঘরের জাল-লাগানো জানালার সামনে জিনিসপত্র রেখে দিলেই হবে। বেশ ক’দিন স্বচ্ছন্দে রাখা চলবে।

রণদেববাবু বাণীকে বললে, তুমি বলছিলে হাঁটতে যাবে। চল একটু হেঁটে আসি। জিন্‌কেও ডেকে নাও। একি? গৃহস্বামী এলেন, এখনও বিছানা ছেড়েই উঠল না?

বাণী বললেন, তুমি কি এই ভাবেই যাবে?

এখানে আর কে দেখবে? দেখছ না সায়নবাবু কী রকম ননশালান্টলি শ্যাবী পোশাকে রয়েছেন। এই একটা মস্ত আনন্দ এখানে।

আমার দিকে ফিরে বললেন, কী বলুন সায়নবাবু? সমাজ নেই, সংস্কার নেই, এখানে যা ইচ্ছে তাই-ই করা যায়।

মনে হল, কথাটা বলতে বলতে আমার পাশে দাঁড়ানো তিতলির দিকে তাকালেন উনি এক বিশেষ চোখে।

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হাসলাম। বললাম, যা বলেছেন।

একটু পরে জিন্ নামক, ফোটোতে দেখা মহিলাটি ঘর থেকে বেরোলেন। দেখলাম উনি তাঁর নিজের ফোটোর চেয়েও সুন্দরী। ঘর থেকে বেরোবার আগে চুল ঠিক করেছেন, হালকা পাউডারের প্রলেপ বুলিয়েছেন মুখে, চোখে কাজল দিয়েছেন। ফিকে সবুজ তাঁতের শাড়ি, গাঢ় সবুজ ব্লাউজ, পিঠময় খোলা চুল। বেশ বুদ্ধিমতী, রুচিমতী চেহারা। প্রথম দেখাতেই ভালো লাগল খুউব। ফোটোটাতে প্রাণ ছিল না। জিন্ সশরীরে এসে তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন।

মন বলে উঠল, এখনই গায়ে হলুদের সানাই বাজা উচিত।

উনি হাত তুলে নমস্কার করলেন। বললেন, আমার নাম জিন্। ভালো নাম দময়ন্তী। আপনাকে কেমন জ্বালাতে এলাম আমরা। সত্যি সত্যিই যে আসব, তা নিশ্চয়ই ভাবতে পারেন নি।

কী বলব ভেবে পেলাম না। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, আমার সৌভাগ্য!

বাণী কথাটা শুনে ঠাট্টা করে বললেন, শুনলি। তুই তাহলে সৌভাগ্যও বয়ে আনতে পারিস কারো কারো জন্যে। এতোটা জানতাম না।

আরও লজ্জিত হলাম। বাঁশবাবুর সর্বাঙ্গে লজ্জার ফুল ফুটল। এবার মরণ!

জিন্ আমাকে উদ্দেশ করেই বললেন, আপনি বরং ফ্রেশ হয়ে নিন, আমরা একটু হেঁটে আসছি। রাস্তা ভুলে যাবো না তো?

জিনের কথার পিঠে বাণী বললেন, এখানে, এতদূরেই যখন পথ চিনে আসতে পারলি তখন এই বাড়ির বাইরে গিয়েই যে রাস্তা ভুলবি এমন সম্ভাবনা আছে বলে তো মনে হয় না।

বলেই, জিনের দিকে চোখ ঠেরে বললেন, চল্‌ এগোই!

ওঁরা তিনজন এগোলেন।

রণদেব থেমে দাঁড়িয়ে, তিতলিকে বললেন, একঠো লাঠি-টাঠি হ্যায়?

তিতলি না বুঝে, বোকার মতো তাকিয়ে রইল।

আমি ঘর থেকে একটি বাঁশের ছোট-লাঠি নিয়ে এলাম।

লাঠি কী করবেন?

যদি সাপ-টাপ—

শীতকালে সাপের ভয় নেই।

খারাপ লোক-টোক।

জঙ্গলে খারাপ লোকও নেই। তারা সবাই শহরে থাকে।

তা ঠিক, আপনার মালিককে দেখে, আপনাকে দেখে, এবং তিতলিকে দেখেও এ কথাটা এতক্ষণে বোঝা উচিত ছিল। তাহলেও এটা নিয়েই যাই, সাহস দেবে। শহরের লোক তো, জঙ্গলে এলেই ভয়ে হাত-পা কেমন ঠান্ডা মেরে যায়।

ওঁরা চলে যেতেই ছোটোমামিমা বললেন, কিরে খোকা? কেমন দেখলি?

বললাম, তোমরা দেখেছো, তার ওপর আমি আর কী দেখবো? ফোটো তো আগেই দেখেছি। আমার এই ভাঙাচোরা ঘর, জংলি চেহারা ও পরিবেশ এসব ওঁরই এবং ওঁদেরই দেখার। এমন শহুরে সফিস্টিকেটেড মেয়ের কী আমাকে পছন্দ হবে?

মামিমা রেগে বললেন, তার দাদা-বৌদির ও তার তোকে যদি পছন্দই না হবে, তাহলে কি আর তোর বাড়ি দেখতে আসে? এতদূর কি এগোতে পারে কেউ? তা-ছাড়া…বলেই থেমে গেলেন। আমি বলি কি, এখন তোরা একটু মেলামেশা করে নে। দু-জনেরই বয়স হয়ে গেছে। শেষে বাবা, বলিস না যে, মা-বাপ মরা ছেলেকে মামা-মামি জোর করে খারাপ মেয়ে গছালো। জিনটাকে তো ছোটবেলা থেকেই দেখছি। একটু পাগলি-পাগলি এই যা দোষ। আমার দূরসম্পর্কের খুড়তুতো দাদার মেয়ে। গোখ্‌লেতে পড়ত। দক্ষিণীর ডিপ্লোমা আছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে। ওর বাবা-মাকে আমি জানি! জীরুদা নেই এখন। থাকলে মেয়ের বিয়েতে খুবই ঘটা করতেন। জিন্ যখন স্কুলে পড়ে, তখনই মারা যান উনি ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াতে। সঞ্চয় যা ছিল সবই গেছে। তবে রণ বড়ো ভালো ছেলে। ও-ই সব দায়িত্ব নিয়েছে এবং নেবে যতটুকু পাববে, নিশ্চয়ই করবে বোনের বিয়েতে।

একটু পরে বললেন, ও শোন্ খোকা, ভুলেই গেছিলাম। আমি কিন্তু বলেছি, তোকে একটা মোটর সাইকেল দিতে হবে। বনে-বাদাড়ে হেঁটে হেঁটে বেড়াস।

আমি স্তম্ভিত হলাম বললাম, সে কী? পণ চেয়েছ তুমি-তোমার খুড়তুতো ভাইপোর কাছ থেকে ভাগ্নের জন্যে! ছিঃ ছিঃ ওসব কিছু লাগবে না। ভারি অন্যায়। ছিঃ! ওঁরা কী ভাবলেন আমাকে। ভদ্রলোকে পণ নেয় নাকি?

ছোটমামা প্রচণ্ড কবি প্রকৃতির মানুষ। ছেলেবেলায় গিরিডিতে থাকাকালীন একটা কবিতা লিখেছিলেন : ―

“ঐ যে ঐ নীল পাহাড়টার গায়
এক সারি বক চলছে ভেসে,
যেন কুন্দফুলের মালা….” ইত্যাদি ইত্যাদি

মায়ের মুখে শুনেছিলাম সেই কবিতার কথা

ছোটমামা বললেন, বাঃ সামনের ঐ পাহাড়টার নাম কী রে? কী উঁচুরে পাহাড়টা!

ওর নাম হুলুক! নিয়ে যাব তোমাদের একদিন।

বাঃ বাঃ। কী সুন্দর নাম।

বুঝলাম শহরে-থাকা ছোট মামার এই রকম জায়গায় পৌঁছেই ইঁট-চাপা কবিত্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। পাহাড় দেখেও যে বাঙালির কবিত্ব জাগে না মনে, তাঁর বাঙালিত্ব সম্বন্ধে অবশ্যই সন্দেহের কারণ থাকে।

কাল সকালে আমি হেঁটেই চলে যাব। কতদূরেই আর হবে, আধ মাইলটাক? সে আর কী। কী বল্?

ছোটমামা উত্তেজনার সঙ্গে বললেন।

সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পালামৌ পড়োনি বুঝি? পাহাড়ের দূরত্ব অমনি মনে হয়। ঐ পাহাড় দশ মাইল দূরে। আর একা যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ওখানে নানারকম হিংস্র জানোয়ার আছে। বড়ো বাঘের জায়গা ওটা।

ইন্টারেস্টিং। তোর মা থাকতে তাকে এখানে একবারও আনলি না। বুবুকে নিয়ে এলে বড়ো খুশি হতো। জানিস, আমাদের গিরিডির খাণ্ডুলী পাহাড়টা…..আর উশ্রী নদী…।

ছোটমামিমা বললেন, তুমি চুপ করবে, আবার গিরিডিতে পেল। তারপরই আমার দিকে ফিরে বললেন, তোর মামা-মাসিদের এই গিরিডি দুর্বলতা একটা রোগ বিশেষ। পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু ভালো; সবই গিরিডির মতন। দেখছিস খোকা?

হাসলাম আমি।

ছোটমামা বললেন, যাক গে। তুমি যখন এসে গেছো, তখন খোকাকে এ-ক’দিন একটু ভালো-মন্দ রেঁধে খাওয়াও। বুবু যেমন রাঁধত তেমন ভুনি খিচুড়ি, কড়াইশুঁটির চপ্। এখানে খাঁটি গাওয়া-ঘি নিশ্চয়ই পাওয়া যায়। ভালো করে কিশমিশ দিয়ে মোহন-ভোগ। পাটিসাপ্‌টা ক্ষীরের পুলি, চুষি, সমস্ত। বেচারি ফাঁকে পড়ে আছে। কিছুই খেতে পায় না।

ছোটমামিমা বললেন, আরম্ভ হল খাওয়ার বিবরণ। তোমাদের মতো পেটুক আর খাদ্যবিলাসী পরিবার আমি আর দেখিনি বাবা!

ছোটমামা হঠাৎ চটে গিয়ে বললেন, দ্যাখো নি তো দ্যাখো। তোমরা বাঙালরা তো কোয়ান্টিটিতে বিশ্বাস কর; কোয়ালিটির তোমরা কী বুঝবে? দুজনের দিকে দুহাত তুলে বললাম, ব্যস্, ব্যস্ আর নয়।

তুই যা, মুখ হাত ধুয়ে তৈরি হয়ে নে খোকা। লজ্জা তো যত তোরই দেখছি বেশি। আমার ভাইঝি তো তুবড়ির মতো কথা বলে হৈ হৈ করে বেড়াতে চলে গেল।

লজ্জা তো আমার হবারই কথা। আমাকেই তো দেখতে এসেছেন ওঁরা। আজকাল নিয়ম-কানুন সব পাল্টে গেছে। বুঝেছো ছোটমামি।

বুঝেছি। এবারে যা তুই। জামাকাপড় ছাড়।

ছোটমামা বললেন, তোদের কোম্পানির মালিক লোকটি বড় ভালো রে। এত বড় কাজ সামলাচ্ছেন। দেখেও আনন্দ হয়। আমার কাছে যেই শুনেছেন যে, তোর বিয়ের ব্যাপারে আমরা এসেছি, অমনি কী উৎসাহ! জানিস, আরও একটা কথা বললেন, আমাকে আলাদা ডেকে। বললেন, আমাকে বরযাত্রীর নেমন্তন্ন করবেন তো? আর বৌ-ভাত কিন্তু ডালটনগঞ্জেই হবে। যতজন খুশি কনের বাড়ির লোক নেমন্তন্ন করবেন। থাকা, খাওয়া, জঙ্গল দেখানোর সব ভার আমার। মুখার্জিবাবুর বড়ই কষ্ট হয় একা থাকতে এই জঙ্গলে। বউ না থাকলে মানুষ কি একা একা থাকতে পারে? লাগান, লাগান, বিয়েটা লাগান। আমি একপায়ে খাড়া আছি মদত দেবার জন্যে।

ঘরে গিয়ে দেখলাম, বেডকভারের আড়াল থেকে বালিশ দুটো টেন বার করা। ননদ আর বৌদি বোধহয় পাশাপাশি শুয়ে ছিলেন। বিছানাটাতে শুয়ে থাকার চিহ্ন স্পষ্ট। কুঁড়ে-মুড়ে আছে বেডকভারটা। ডানদিকের বালিশে একগুচ্ছ বড়ো কালো চুল চোখে পড়ল লণ্ঠনের আলোতে। নিশ্চয়ই জিনের চুল। চুলটা নাকের সামনে তুলে ধরলাম। কী সুন্দর গন্ধ। কী তেল? খুব চেনা-চেনা গন্ধ—মনে পড়েছে? কেয়োকার্পিন। দে’জ মেডিকেলের তৈরি। মা মাখতেন এই তেল। বালিশটা তুলে নাকে গন্ধ নিলাম। সমস্ত বালিশটা গন্ধে ম ম করছে। বালিশটাকে ধরে মনে হল জিন্ নামক একজন অনাত্মীয়া-অপরিচিতা-কুমারী মেয়ের সঙ্গে আমার সহবাসই বুঝি সম্পূর্ণ হল। গা শিউরে উঠল ভালোলাগায়। এক নিষিদ্ধ না-হওয়া সম্পর্কে। চুলটিকে সযত্নে আমি আমার পার্সের ভিতরের খোপে ভরে রাখলাম। আমার প্রতীক্ষার সহচরী। সময় বাকি নেই বেশি।

আলমারি খুলে বিছানার চাদর ও বালিশ বের করলাম। কম্বল ও কিছু বালিশ ওঁরা নিয়ে এসেছেন। সামান্য বিছানাও। তাড়াতাড়ি টর্চ হাতে জিপে করে বেরিয়ে পড়লাম চৌপাই-এর খোঁজে। রথীদার বাড়ি যেতে হবে।

আগামিকাল পূর্ণিমা। সন্ধে হতে না হতেই ফুটফুট্ করবে জ্যোৎস্না আজকে। মানিয়ার বাড়িও একবার ঘুরে আসতে হবে। কাল থেকে চারদিন অনেক বেশি দুধ দিতে বলতে হবে ওকে। আনাজ-টানাজও যদি কিছু পাওয়া যায়। গাড়ুর রেঞ্জার সাহেবের কাছে পাঠাতে হবে সিংকে, লেবু ও আমলকীর আচারের জন্যে। মানিয়ার ক্ষেতে ভাল কড়াইশুঁটি হয়। বেশি করে পাঠিয়ে দিতে বলব, যাতে ছোটমামার কড়াই-শুঁটি-ছাড়ানো খিচুড়ি আর কড়াইশুঁটির চপ্-এর অভাব না ঘটে।

রথীদার বাড়ির দিকে সিং-এর পাশে জিপের সামনের সিটে বসে যেতে যেতে আমার মন খুশিতে ভরে উঠল। আমি যে এত কল্পনাপ্রবণ, এমন ছেলেমানুষ তা জিন্ আমার এখানে না এলে বুঝতে পারতাম না। জন্ম-রোম্যান্টিক আমি। মামাবাড়ির রক্ত বইছে আমার শরীরে। আমি যে এমন প্রেমিক তা-ও আমি জানতাম না; নইলে একটি চুল আর একটি চুলের গন্ধমাখা বালিশ নিয়ে একটু আগেই যা করলাম, তা কেউ যে এক বয়সে পৌঁছেও করতে পারে তা বিশ্বাস পর্যন্ত হত না।

আমি কি পার্ভার্ট?

নিজেই নিজেকে শুধোলাম।

তারপর নিজেই আবার নির্জন বনপথে নিজেকে আশ্বস্ত করে বললাম, নিজের ভাবী-স্ত্রীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাটা কি পার্ভার্সান? হতেই পারে না।

রথীদা তো খবর শুনে লাফালাফি শুরু করে দিলেন। তাঁর লোকটিকে জোর করে পাঠালেন। একসময় এক সাহেবের কাছে বাবুর্চি-কাম-বেয়ারার কাজ করত সে। চাকর আর মালীর মাথায় চারটে চারপাইও। বললেন, যে ক’দিন ওঁরা আছেন আমিই না হয় তোর ওখানে গিয়ে খাব। শহরের লোক, তার ওপরে তোর পরমাত্মীয়। তোর মামা-মামিও এসেছেন, ওঁদের খাতির না করতে পারলে তো আমাদেরই বে-ইজ্জত। পুরো ভালুমার বস্তির যে-ইজ্জত।

রথীদা কোনো কথাই শুনলেন না! আমার সব প্রতিবাদ উড়িয়ে দিয়ে বললেন, আর একটাও কথা বলবি তো মার খাবি আমার কাছে।

মামিমা আর রথীদার রাঁধুনি রান্নাঘরে। তিতলি জোগান দিচ্ছে। আমি আর ছোটমামা বাইরের বারান্দায় ছাদের নিচে ইজিচেয়ারে ভালো করে র‍্যাপার মুড়ে বসে আছি। ছোটমামাকে আমার বাঁদুরে টুপিটা পরতে দিয়েছি। বয়স হয়েছে প্রায় ষাট। হঠাৎ ঠাণ্ডা লাগলে মুশকিল হবে এখানে। রথীদার চাকর, মালী এবং তিতলি মিলে হাতে হাতে সব ঘরে ঘরে বিছানা-টিছানা করে দিয়েছি। ঠিক হয়েছে, আমি রথীদার কাছে গিয়ে শোব। আমার এতটুকু বাড়িতে এত লোকের জায়গা হবে না।

টেটরা এসব কিছুই জানত না। ও এসেছিল সন্ধের পর পরই তিতলিকে নিতে। আমি বলে দিয়েছি তিতলি এ-ক’দিন আমার এখানেই থাকবে। ওকে পার্স বের করে কুড়িটা টাকাও ধরে দিয়েছি এ-ক’দিন ওদের খাওয়া-দাওয়ার জন্যে। তিতলি তো আর এ-ক’দিন খাওয়া নিয়ে যাবে না বাড়িতে।

আমি যে এমন বড়লোক ছিলাম বা হয়েছি তা আগে আমার নিজেরই জানা ছিল না। শুধু ধনে বড়লোকই নই, মনেও। চমৎকার লাগছে। বাইরে একটা লক্ষ্মীপেঁচা উড়ে উড়ে ডাকছে। চাঁদের আলোয় তার হিমভেজা সাদা ডানা দুটিকে স্বপ্নময় দেখাচ্ছে। ডাকবেই। লক্ষ্মীছাড়ার বাড়িতে লক্ষ্মী এসেছে যে, তা লক্ষ্মীপেঁচাটার অগোচর থাকবার কথা নয়। আফটার অল,, ও তো আমাদের ভালুমারেরই একজন। ছোটমামা, রথীদার পাঠানো একটা সিগার ধরিয়েছেন। আমরা তিতলির বানানো গিরিডি-স্পেশাল চা খেয়ে কাপ দুটি নিচে নামিয়ে রেখেছি এমন সময় শীতের স্তব্ধ, হিমঝরা, ঝিঁঝি ডাকা ভালুমারের রাতকে মথিত করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কলি ভেসে এল বাইরে থেকে। ওঁরা বাড়ির দিকে আসছেন।

কে যেন গাইছেন,…”হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলির। হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে, ঘিরে ঘিরে।” আরও কাছে এসেছেন ওঁরা। “দেবতারা আজ আছে চেয়ে, জাগো ধরার ছেলে মেয়ে, আলোয় জাগাও যামিনীরে

ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো “দীপালিকায় জ্বালাও আলো, জ্বালাও আলো, আপন আলো;জয় করো এই তামসীরে…।”

আমার কল্পনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। তামসীকে দূর করতেই তো তুমি এসেছো জিন্, এতদূরে; আমি তা জানি। আমি সবই জানি। তোমার কাছে কৃতজ্ঞতার আমার শেষ নেই।

ছোটমামা বললেন, জিন্ গাইছে, গলা চিনতে পারছিস?

মনে মনে বললাম, তোমার খুড়তুতো শালার মেয়ে সে হতে পারে বটে, কিন্তু আমারও কিছু পর নয় জিন্। বুঝলে, ছোট মামা।

মুখে কিছুই বললাম না।

আরো চেয়ার আনালাম বারান্দায়। একটা ফাঁকা চৌপাইও। চৌপাইতে আমিই বসব। যদি ছারপোকা থাকে? তাহলে আমার ভাবী-স্ত্রীর সুন্দর নরম শরীর জ্বলতে থাকবে ছারপোকার কামড়ে। আমি বেঁচে থাকতে এমনটি হতে দিতে পারি না। আমি বন-বাদাড়ের বাঁশবাবু। আমার শিভারি আর কী? ঐটুকুই! এইটুকুই করি নিজের কাজে নিজেকে বড় করার জন্যে।

বাণী উঠোনে ঢুকেই বললেন, কই সায়নবাবু ঠাণ্ডায় যে জমে গেলাম! এতো ঠান্ডা, আগে বলবেন তো? জিন তো নেহাত গা-গরম করবার জন্যেই প্রাণের দায়ে চেঁচিয়ে গান জুড়ে দিল। আপনাদের এই ভালুমারের কুকুরগুলোর বোধহয় রবীন্দ্রসঙ্গীতে অ্যালার্জি। এমন সমস্বরে চেঁচাতে লাগল না যে, কী বলব!

রণ বললেন, উ-হু-হু আমার নাকটাকে আর আমার নাক বলে মনে হচ্ছে না।

আমরা হেসে উঠলাম। ওরা ঢুকতে না ঢুকতেই তিতলি হাতে হাতে গরম চায়ের গ্লাস ধরিয়ে দিল। আমার এখানে বেশি কাপ নেই। ওরা দু-হাতের তেলো দিয়ে গরম চায়ের গ্লাস জড়িয়ে ধরে গরম হতে চাইলো।

বললাম, শিগগিরি ভালো করে গরম জামা পরে নিন, ঠান্ডা লাগলে মুশকিল হবে। একশ মাইলের মধ্যে ডাক্তার নেই কিন্তু।

জিন্ বলল, শুধু ডাক্তার কেন? অন্য অনেক কিছুই নেই। সিনেমা নেই, শাড়ির দোকান নেই, ভেলপুরী বা ফুচকার দোকান নেই, কোয়ালিটির আইসক্রিম নেই। এখানের লোকেরা যা রোজগার করেন, সবই বোধহয় জমাতে পারেন। খরচ বলতে তো কিছুই নেই।

তা ঠিক। তবে এখানের লোকদের যা রোজগার তাতে জমাবার মতো কিছু হাতে থাকে না।

আপনাদেরও না?

রণদেববাবু জিগগেস করলেন।

আমি, আমার ইন্টারভ্যু খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা আছে জেনেও বলে ফেললাম, আমাদেরও না। কী-ই বা রোজগার!

বাণী বললেন, আর এই যে পরিবেশ! এটা বুঝি কিছু নয়। এই পারকুইজিটের দাম বুঝি টাকা দিয়ে দেওয়া যায়?

তারপর, যেন জিকে শোনাবার জন্যেই বললেন, সাধ্যটা কখনওই বড় কথা নয়; সাধটাই বড়ো কথা। আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, যে মানুষ এমন জায়গায় এতোবছর একটানা থাকতে পারেন, তার মধ্যে শ্রদ্ধা করার মতো অনেক কিছুই দেখি আমি। টাকা দিয়ে কী হয়? কতটুকু হয়? বেশি টাকা দিয়েই বা কী হয়!

তারপর চায়ে একটা হঠাৎ-চুমুক দিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, আসল ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে জীবনে কে কী চায়? কেউ আপনার মতো এমন উদার উন্মুক্ত প্রকৃতি চায়, কেউ টাকা চায়, শহরের মধ্যের মাপা জীবন, মাপা হাসি, মেকি সংস্কৃতি চায়। এটা অ্যাটিচুডের ব্যাপার। আমার কিন্তু আপনার সঙ্গে ভীষণ মিল। এখানে না এলে যে কী হারাতাম, তা আমিই জানি।

এই হঠাৎ বাগ্মিতার কারণ বুঝতে না পেরে চুপ করেই রইলাম।

বাণী চেঁচিয়ে বললেন, জেঠিমা, আমরা চা’টা খেয়েই যাচ্ছি রান্নাঘরে আপনাকে হেল্প করার জন্য। জিন্ কিন্তু কিছুই বলল না।

মামিমা বাইরে এসে বললেন, তোমাদের কাউকেই দরকার নেই। খোকা বাবুর্চি পর্যন্ত এনে ফেলেছে, লোকজনও। এতক্ষণ নিজে হাতে তোমাদের জন্যে বিছানা-টিছানা করে ফেলেছে। তোমরা হলে গিয়ে মহামান্য অতিথি। আমি রান্নাঘরে গেছিলাম খোকার ফেভারিট্ রান্না করব বলে। রাতে ভুনি-খিচুড়ি আর মুরগি ভাজা এবং আলু ভাজা হচ্ছে। তোমাদের মুখে রুচবে তো?

বাণী বললেন, আমরা তো রোজই পোলাউ-কালিয়া খাচ্ছি। মুখে এতো সাধারণ খাওয়া রোচা শক্ত।

তুই বড়ো খারাপ বৌদি। আমার দাদা তো তোকে রানির মতোই রাখে। তাতেও তোর অভিযোগ গেল না। জিন্ বলল।

মনে মনে বললাম, তোমাকেও রানির মতো করেই রাখব জিন্। বাঁশবনের শেয়াল-রাজা বাঁশবাবু যতখানি পারে। কষ্ট দেব না কোনোই।

এমন সময় রথীদা এলেন। সিংকে পাঠিয়েছিলেন ওঁকে আনতে। রথীদা আসতেই সকলে তাঁর দারুণ ব্যক্তিত্ব ও মিশুকে স্বভাবে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনিই হয়ে গেলেন সেন্টার অফ অ্যাট্রাকশান। কেউই আমার দিকে আর একবার চেয়ে পর্যন্ত দেখছিলেন না।

রথীদার কাছে যাওয়াটাই ভুল হয়ে গেছে! কখনও নিজের চেয়ে বেশি ভালো লোককে আপারহ্যান্ড দিতে নেই। দিলেই, সমূহ বিপদ।

রথীদা অবশ্য আমার খুব প্রশংসা করছিলেন। কথায় কথায় সায়ন এই, সায়ন সেই। আমার নিজেকে খুব ছোট লাগছিলো। আমি যেন খারাপ ছাত্র। গ্রেস দিয়ে আমাকে কোনোক্রমে পাস করাবার চেষ্টা করছেন রথীদা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *