কোজাগর – ৩৪

৩৪

গোলমালটা বাধল বন্দুকটা নিয়েই। কাড়ুয়া আর সেই অনামা ছেলেটির লাশের কাছে যখন হীরুর বন্দুকটি পাওয়া গেল—তখন ফরেস্টের গার্ডরা আর পুলিশের সেপাইরা সেটিকে নিয়ে এল সটান সাহেবদের কাছে।

সোনা-দানা টাকা পয়সা হারিয়ে গেলে, যার গেল তার আর্থিক ক্ষতিই হয়, কিন্তু বন্দুক হারালে, যে বন্দুকের মালিক, তাকে নিয়ে পুলিশ এমন টানাটানি শুরু করে যে, সে আর বলার নয়। এবং ব্যাপারটা ঘটল তখনই, যখন হীরু বাংলোয় ছিল না, তার মা-বাবা ভাই বোনের সঙ্গে দেখা করতে গেছিল জিপে চড়ে।

ঝক্‌ঝকে পালিশ তোলা জিপটা থেমেছিল এসে জুগনু ওরাওঁ-এর জীর্ণ বাড়ির বেড়ার সামনে। সিপাহিরা ফটাফট্ স্যালুট মেরেছিল, হীরু জিপ থেকে নামতেই। ড্রাইভার সিপাহি সকলের সামনে হীরু ছেঁড়া-চৌপাইতে-বসা, খালি-গা, ছেঁড়া-ধুতি পরা তার বাপকে হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাত বাড়িয়ে দু’পা ছুঁয়ে নমস্কার করেছিল।

জল গড়িয়েছিল তখন জুর চোখ বেয়ে।

জুগনু ওরাওঁ হীরুর চিঠি আগেই পেয়েছিল। নিজে পড়তে পারে না জুগ তাই টুসিকে দিয়ে পড়িয়েছিলো। টুসির নামেও আলাদা চিঠি এসেছিল একটা। হীরু যখন বাবাকে প্রণাম করছিল তখন উঠোনে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে হীরুর মা, টুসি আর লগন নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।

হীরু বাবাকে ছেড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণ পর টুসিকে আড়ালে ডেকে নিয়ে কীসব বলল। টুসি মাথা নাড়ল, কিন্তু মুখে কিছু বলল না। ঠোঁট কামড়াল। আবার মাথা নাড়ল।

হীরুর বাপ বলল, কী ব্যাপার? তোমরা সব চুপচাপ কেন? হীরুকে আর সিপাহি ড্রাইভারদের সকলকে কিছু খেতে দাও। প্রত্যেককে দাও। যা আছে তাই-ই দাও।

ড্রাইভার সিপাহিদের মুখে এক দারুণ খুশির ভাব ফুটে উঠল। তারা সেই মুহূর্তে বড় একাত্ম বোধ করল হঠাৎই তাদের সাহেবের সঙ্গে। সাহেবকে ওরা যা ভেবেছিল, আসলে সাহব তা নন্। সাহেবও একজন রক্ত-মাংসের মানুষ। একেবারে তাদেরই মতো। তাদেরও বাবা-মা এমনই কোনো জায়গায়, এমনই দুঃখ-দুর্দশার মধ্যেই থাকেন। সাহেব যে তাঁদেরই একজন, হীরু যে আকাশ থেকে পুষ্পকরথ বা হেলিকপ্‌টার থেকে হঠাৎ পড়ে তাদের সাহেব হয়ে যায়নি—তারও যে শিকড় আছে দেহাতেই, এই পাহাড় জঙ্গল ঘেরা বস্তির ভিতরে, একথা জেনে বড় ভালো লাগল ওদের সকলের। হীরু এ ক’বছর ওদের সঙ্গে নৈর্ব্যক্তিক এবং রূঢ় ব্যবহার করে, ওদের ওপর বসিং করে যা ওদের কাছ থেকে কখনও পায়নি, আজ এক মুহূর্তেই সেই স্বতঃস্ফূর্ত বশ্যতা পেয়ে গেল ওদের প্রত্যেকেরই কাছ থেকে। সরল সত্য দিয়ে যা ছোঁওয়া যায় এবং পাওয়া যায়, ভণ্ডামি আর চালাকি দিয়ে তা কখনওই পাওয়া হয়ে ওঠে না। বড় দেরি করে এ কথাটা জানল বোধহয় হীরু।

টুসি চোখের জল মুছল আড়ালে, আঁচল দিয়ে। হীরুর চোখ এড়াল না তা। সিপাহি ড্রাইভারের জল-টল খাওয়ার পর হীরু বলল, চললাম। শিগগিরি ছুটি নিয়ে এসে একমাস থাকব বস্তিতে, তোমাদের সঙ্গে, এই বাড়িতেই। বাড়িটা নতুন করে করব। এবারে বিয়েও করব মা। আমার জন্যে একটা ভালো মেয়ে দেখো, তোমার মনোমতো।

টুসি, লগন আর টুসির মা, অবিশ্বাসভরা বিস্ময়ে চলে-যাওয়া হীরুর দিকে চেয়ে রইল।

হীরু বাংলোতে ফিরে এসেই কাড়ুয়ার লাশ দেখে আঁৎকে উঠল।

কাড়ুয়া চাচাও হার মানল। কাড়ুয়া চাচাকেও মারতে পারে এমন কোনো বাঘ আছে নাকি দুনিয়াতে? পরক্ষণেই, তার বন্ধু যখন বন্দুকটা হীরুকে দেখিয়ে ওকে যা বলার বলল, হীরু চমকে উঠে মুখ ফসকে বলে ফেলল, আরে এ যে আমারই বন্দুক!

না বলে উপায়ও ছিল না হীরুর। কারণ সব বন্দুকেই নাম্বার, ম্যানুফ্যাকচারের নাম সব লেখা থাকে—এবং সব লাইসেন্সও থাকে। বন্দুক হারালে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ডায়েরি করতে হয়।

তোমার বন্দুক?

কুটিল চোখে তাকালো হীরুর বন্ধু তার দিকে।

তারপর বলল, আজীব বাহ্। খোদ পুলিশ সাহাবকে বন্দুক খো গ্যয়া ঔর উন্‌হিকা নেহী মালুম থা!

শোওয়ার ঘরের আলমারিতেই রাখা ছিল। কতদিন বন্দুক বের করি না। কবে, কখন, কে চুরি করেছে, তা পাটনা ফিরে না গেলে কিছু বোঝাই যাবে না। চুরি নিশ্চয়ই কেউ করেছে, নইলে এ বন্দুক এখানে এলো কোথা থেকে? আর চুরি করে থাকলে…..

এতটুকু বলেই, থেমে গেল ও। তারপর লাশ দুটোর দিকে চেয়ে বলল, চুরি করে থাকলে, এই দু হারামির এক হারামিই করেছে। বন্দুকটা সিপাহিরা পেয়েছিল ছেলেটার লাশের কাছে। এই গ্রামের চোরা-শিকারি কাড়ুয়ার কাছে নয়।

বল কী! বিপ্লবী ছেলে বন্দুক চুরি করল তোমার, আর তুমিই খোঁজ পেলে না। খুবই গোলমেলে ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে।

হীরুর বন্ধু হীরুর চোখে চোখ রেখে বলল।

হীরু হেসে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল ব্যাপারটা। কিন্তু ওর বন্ধু টেবল্ থেকে প্যাড টেনে নিয়ে একটা মেসেজ লিখল—গান ক্লেইমড্ বাই এইচ্ সিং, এস. পি. অন ডিউটি। স্টেটেড টু হ্যাভ বিন স্টোলেন ফ্রম হিজ রেসিডেন্স ইন্‌ পাটনা—। থেফট্ নট রিপোর্টেড। প্লিজ সেন্ড অর্ডার বাই ওয়্যারলেস্—।

মেসেজট লিখে হীরুর দিকে এগিয়ে দিল হীরুর বন্ধু।

হীরু পড়ল। পড়ে, তার বন্ধুর চোখে তাকাল।

গলা নামিয়ে বন্ধু বলল, এই মেসেজ এক্ষুণি পাটনাতে আই জি’র কাছে পাঠাতে হবে। বেলা থেকে টাইগার প্রোজেটের ওয়্যারলেসের থ্রতে ওয়্যারলেস করে দেব। ব্যাপারটা খুবই সিরিয়াস্। এস. পি. সাহেবের বন্দুক নিয়ে বিপ্লব হচ্ছে; কথাটা আই. জি. সাহেবের এক্ষুনি তো জানা উচিত।

হীরু তবুও চুপ করেই রইল।

বন্ধু গলার স্বর পাল্টে কী যেন ভেবে হীরুকে বলল, দেখ ইয়ার, ম্যায় কুছ দেখা নেহি; শুনা ভি নেহি। তেরা বন্দুকোয়া তু লে-লে ওয়াপস্। মগর এক শর্ত পর্।

কা?

বলে, হীরু বোকার মতো চেয়ে থাকল বন্ধুর দিকে।

বন্ধু গলা আরো নামিয়ে বলল, ইন্তেজাম করনে হোগা ওহি চিঁড়িয়াকা লিয়ে।

কওন্‌ সী চিঁড়িয়া?

ওর বন্ধু ফিফিস্ করে কী যেন বলল হীরুকে। বলল, টুসি। খুশবুওয়ালি টুসি। ব্যস্ ইন্নাহি মুঝকো ইয়াদ হ্যায়। পুরা নাম্-হি ঔর পত্তা ম্যায় বতানে শক্তাথা, তর্ ত উ বানিয়াই উস্কো উঠাকে লেকর্ আতেথে

হীরুর কানের লতিদুটো দপদপ্ করতে লাগল। ও ঘোরের মধ্যে বলল, হোগা। ডী? ওর বন্ধু বলল। উজ্জ্বল চোখে।

ডীল। বলল হীরু। তারপর বলল কখন কোথায়?

সাত বাজিমে। সাম্।

হীরু বলল, শোনচিতোয়া আভিতক্ নেহী না পিটা গ্যয়া। রাতমে ঘর ছোড়কে কোন্ আইবে করে গা? ইত্‌না হিম্মত কেরো নেহী হো!

তো?

হীরুর বন্ধু ভাবল একটু। তারপর বলল, কেয়া কিয়া যায়?

পরক্ষণে নিজেই বলল, এক কাম কিয়া যায়। হাম জিপ ঔর রাইফেল লে কর, এক্কেল পঁহুছেগা ঠিক্ জাগে পর্। তু, জাগে বাতাদে মুঝকো। উস্কো বাদ ম্যায় খুই সমঝ লেঙ্গে।

হীরু চিন্তিত মুখে বলল, কওনসী জাগ?

ওর বন্ধু বলল, সুরজ বুড়নেকে পইলে, ঝারি-তালাওকে পশ্রা কিনারে পর্ যো ইম্‌লিকা বড়কা প্যের হ্যায়, উস্সীকে নীচে রহুংগা ম্যায়। তু শালে বন্দোবস্ত কর্ দে। নেহী ত তুঝকো ফাঁসায়াগা ইয়ার। তু হাসে দো-পজিশনকে সিনিয়র হো, সালে, ব কাঁহাকা—এক পজিশন্ তো কমসে কম্ ক্লিয়ার হো জায়গা প্রোমোশন কা হিসাবমে, মেরে লিয়ে।

হীরু হঠাৎ মুখ তুলে তাকালো ওর বন্ধুর দিকে। প্রাণের বন্ধু! খান্দানি, রইস্ আমি কখনও আদিবাসীর বন্ধুর বন্ধু যে হতে চায় না, একথা হীরু এতদিন বুঝেও বোঝে নি। মেনেও মানে নি। অথচ হীরু একটা সময় পর্যন্ত আপ্রাণ চেয়েছিল, ওদেরই একজন হতে, নিজের আপনজনদের ফেলে দিয়ে।

হীরু বলল, ঠিক্কে হ্যায়। ইন্তেজাম্ হো যায়গা। তু বেফিককর্ রহ্।

হীরুর বন্ধু সিপাহিদের ডেকে বলল যে–বিকেল-বিকেল সে নিজে একা জিপ্, রাইফেল, আর আলো নিয়ে জঙ্গলের পথে ঘুরে বেড়াবে। শোনচিতোয়ার সঙ্গে দেখা হলে তো মারাই পড়বে শোনচিতোয়া, আর যে ছেলেগুলো এ জঙ্গলে আস্তানা গেড়েছে তাদের সঙ্গেও মোকাবিলা হতে পারে। ভিড় করে শিকার হয় না, সে শোন্‌চিতোয়াই হোক, কী বিপ্লবীই হোক।

গোদা শেঠের মোটর ভট্‌ভট্ করে লাল ধুলো উড়িয়ে বাংলোয় এসে থামল। পিছনে মাহাতো বসে। বাংলোর বারান্দায় হীরুর বন্ধু ইজিচেয়ারে বসে রিভলবার পরিষ্কার করছিল তখন। তাড়াতাড়ি মোটর সাইকেলটা দাঁড় করিয়েই দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল তারা দু’জনে। বলল, সেলাম হুজৌর।

সেলাম।

খবর আছে হুজৌর। বলল গোদা। তারপর হীরুর বন্ধুকে ইশারায় ঘরের ভিতরে আসতে বলল। খবরটা, নির্জনে দিতে চায়।

ঘরে এল ওরা তিনজনেই। গোদা ফিফিস্ করে বলল, নানকু আর দু-তিনটি ছেলেকে দেখা গেছে গাড়ুর ব্রিজের কাছে কোয়েল নদীর পাশে। ওদের কাছে রাইফেল, বন্দুক আছে। আপনার ফেরার সময় আপনাদের উপর হামলা করবার মতলব্ করছে ওরা।

জানলে কী করে?

হীরুর বন্ধু নির্লিপ্ত গলায় বলল, রিভলবার পরিষ্কার করতে করতে।

গাড়ুর হাট ছিল কালকে। হাটে নান্‌কু এসেছিল সওদা করতে। অনেক কিছু সওদা করল। তার একার সাইকেলের ক্যারিয়ার, বড়ো আর হ্যান্ডেলে সে-সওদার থলিয়া সব আঁটানো মুশকিল ছিল। আমাদের চর ছিল হাটে। তারা দু’জন জঙ্গলে জঙ্গলে পিছা করে। গাড়ুর ব্রিজ পেরিয়ে পথটা যেই বাঁয়ে ঘুরেছে মুণ্ডু আর বেতলার দিকে, সেই রাস্তায় কিছু দূর কোয়েলের পাশে পাশে এসেই ঠিক বাঁদিকে নদীর পারে জঙ্গল-ভরা একটি ভাঙা পোড়া বাড়ি আছে পাহাড়ের উপর। রাস্তা থেকে ভালো দেখা যায় না। জঙ্গল আর আগাছায় ভরে গেছে চারপাশ। বাঘও আস্তানা গাড়ে সময় সময় সেখানে। অনেকদিন আগে এক সাহেবের আস্তানা ছিল। সেইখানেই আড্ডা গেড়েছে ওরা। আমাদের চর নিজ চোখে দেখে এসেছে। আজই সন্ধেতে যদি ফোর্স নিয়ে যান তাহলে ওদের ঘিরে ফেলতে পারেন। চারদিক ঘিরে ফেললে পালাবার পথ পাবে না।

হীরুর বন্ধু কী ভাবল একটু। তারপর বলল, আজ আমাদের অন্য প্ল্যান আছে। তোমরা চর লাগিয়ে রাখো, কাছাকাছি গাছের উপর থেকে তারা নজর রাখুক। কাল আমরা যা করার করব।

বহত্ মেহেরবানি হুজৌর।

ওরা সবিনয়ে বলল।

মেহেরবানির কী আছে। এ তো আমাদের ডিউটি।

তারপরই বলল, আমার কী করলে?

হুজৌর, বস্তিতে মেয়ে তো কতই আছে। আপনি বললে আমরা লাইন লাগিয়ে দেব। সবই তো আমাদেরই সম্পত্তি। কিছু নাম পাত্তা না বলতে পারলে সেই বিশেষ মেয়েটিকে কী করে খুঁজে বের করি?

হীরুর রহিস্ বন্ধু মাহাতো আর গোদা শেঠের পশ্চাৎদেশের প্রতি কিছু অ-রহিস্-সুলভ মন্তব্য করে ওদের চলে যেতে বলল। হীরুই যখন জিম্মা নিয়েছে, তখন ওদের জড়াতে চাইল না। শুধু বলল, ওয়ার্থলেস্।

ইংরিজি না-জানতে ঐ শেষ গালাগালিটাই গোদা আর মাহাতো সবচেয়ে খারাপ গালাগাল ভেবে মন-মরা হয়ে মোটর সাইকেল ভটভটিয়ে চলে গেল।

হীরু ফিরে এল। ফিরতেই ওর বন্ধু গোদা শেঠ আর মাহাতোদের কথা বলল হীরুকে। হীরুর মাথার মধ্যে ঝমঝম্ করতে লাগল। কোথায় পৌঁছেছে এই মাহাতো আর গোদা? হারামজাদারা। সারা বস্তির মেয়েদের ইজ্জৎ এখন ওদের হাতে!

হীরু মুখ নামিয়ে সংযত গলায় বলল, তোমার ইন্তেজাম পাকা করে এসেছি।

হীরুর বন্ধু বলল, যা প্রোগ্রাম আছে তাইই থাকবে? ঝারি তালাও-এর পশ্চিম পাড়ের বড়কা ইম্‌লি গাছের নীচে?

হ্যাঁ। তবে মেয়েটি কিন্তু একা দাঁড়িয়ে থাকবে। দেরি করো না। শোনচিতোয়া মেয়েটিকে নিয়ে গেলে তার মা-বাবা আমাকে পুঁতে ফেলবে। হীরু বলল।

খরচ কত হবে?—হীরুর বন্ধু বলল।

হীরু বলল, যা তুমি দেবে খুশি হয়ে।

বন্ধু আগ্রহাতিশষ্যে বলল, এই একশো টাকা এখনই রেখে দাও। রাণ্ডিকা বাচ্চি একশো টাকার নোট কি কখনও চোখে দেখেছে? খুশি হবে নিশ্চয়!

হীরুর চোখ দুটো জ্বলে উঠল। গম্ভীর মুখে বলল হওয়া তো উচিত!

তারপর বলল, তুমি কিন্তু মেয়েটিকে পৌঁছে দেবে, ফেরার সময় তার বাড়ির কাছাকাছি রাস্তাতেই সে নেবে যাবে। জ্যোৎস্না থাকবে আজ। আজ তাকে পৌঁছে দিয়েই আমার ছুটি। আমি শোনচিতোয়াটার জন্যে ভালুমায়ের দিকে যাব—যদি পথের উপর হঠাৎ পেয়ে যাই শটগানটা নিয়ে যাব। কাছ থেকে শটগানের মারই ভালো। তুমি ঠিক সাতটাতেই পৌঁছবে। একেবারে একা আসবে। আজকাল সন্ধে হয় ঠিক সাতটায় এখানে। মেয়েটিকে যেন চিতায় না খায় দায়িত্ব সব তোমার। মেয়েটিকে অন্য কেউ দেখে ফেললে, বস্তিতে সে এজন্মে আর মুখ দেখাতে পারবে না।

তারপর আবার বলল, একা এসো কিন্তু। আর দেরি কোরো না।

তাকে বাঘে খাবে।

হাসতে হাসতে হীরুর বন্ধু বলল, বাঘে খেলে, আমি খাব কী করে? আজীব বাহ্। গরমের দিন। খাওয়ার পর দরজা-জানালা বন্ধ করে দুটো নাগাদ একটু শুয়ে নিল ওরা দুজনেই। সন্ধের ঘণ্টাখানেক আগে হীরু উঠে বলল, এবার আমি যাই।

ঠিক আছে।

হীরু চলে গেল, বারান্দার ইজিচেয়ারে পা-ছড়িয়ে বসে আরাম করে চা খেল হীরুর বন্ধু। তারপর ঘটা করে চান করতে গেল। খান্দানি ঘরের ছেলে, পাছে জংলি মেয়ের সঙ্গে মিলিত হয়ে গায়ে জঙ্গলের গন্ধ মাখামাখি হয়ে যায়, তাই তার নিজের শরীরে এক অতিরিক্ত সুগন্ধের প্রলেপের প্রয়োজনও আছে আজ সন্ধেতে।

হীরু একদম একা, জিপ চালিয়ে তাদের বাড়িতে গেল। টুসিকে ডাকল, আলাদা করে। ফিফিস্ করে কী বলল। তারপরই চলে গেল। লগন আর তার মা-বাবা কিছু বলার আগেই।

টুসি তার মাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গিয়ে ফিফিস্ করে বলল মা, নানকুর খুব বিপদ। আমাকে এক্ষুণি একবার বেরোতে হবে। আর কিছু জিগগেস কোরো না। দাদার পক্ষে এ খবর জানানো খুবই অসুবিধে ছিল। তবু জানিয়েছে। এ কথাটা বাবাকে জানিয়ে রেখো। লগনকেও বোলো। কিন্তু অন্য কিছু বোলো না।

টুসি বেরিয়ে পড়ল পনেরো মিনিটের মধ্যে। আজকাল শরীর খুবই ক্লান্ত লাগে। শরীরে নানারকম অসুবিধে। মনটাও সবসময় খারাপ থাকে। তার পেটে সেই মানুষটার বাচ্চা। যে, রিভলবার দেখিয়ে তাকে নাঙ্গা করেছিল। আর সেই বাচ্চার বাপ হবে নানকু। ছিঃ ছিঃ।

ছেলে অথবা মেয়ে কী হবে ভগবানই জানেন। যাই-ই হোক, হয়তো সে খুব সুন্দর হবে। কিন্তু শরীরের সৌন্দর্যই কি সব? টিহুলদাদার বৌ তো কত সুন্দরী। কিন্তু তার কি ইজ্জত আছে? সেই লোকটা, তাকে এমন অসহায় অপমানের মধ্যে রাখল। শুধু আজই নয়; যতদিন তার এই পেটের সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর বেঁচে থাকবে ততদিনই রাখবে। এটা যে কী করল নানকু, কেন করতে গেল; কিছুতেই ভেবে পায় না টুসি।

এদিকটাতে বহুদিন আসেনি টুসি। আজকাল এমনিতেই কেউ আসে না ঝারিতালাওর দিকে শোনচিতোয়ার ভয়ে। অন্যান্য বস্তি ছাড়াও শুধু ভালুমার বস্তিতেই এ পর্যন্ত পাঁচজন মানুষ গেছে চিতাটার পেটে গত তিনমাস-এ। টুসি নানকুর কাছ থেকে শুনেছে যে, বাঘটাকে ম্যান-ইটার্ ডিক্লেয়ার করবার চেষ্টা হচ্ছে খুব। হলে, ভালো শিকারিরা এসে মেরে দিতে পারবে বাঘটাকে। নানকুর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর থেকে ও কত কী জেনেছে, শুনেছে, ওর জগৎ যে কত বড় হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, তা ওই-ই জানে। দশ-দিনে, পনেরো দিনে নানকু একবার এলে, থাকলে রাতে; কী করে তাকে আদর করবে ভেবে পায় না টুসি। টুসিকে অনাবৃত করে তার তলপেটে কান ছুঁইয়ে নানকু বলে, দেখি দেখি; রহিস্ আমির ব্যাটার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই কি না!

এত লজ্জা করে টুসির!

নানকু বলে, কেন ভাবিস এত? মনে করবি, আমরা একে কুড়িয়ে পেয়েছি। আমরা ওকে যেমন করে মানুষ করব ও তেমনই হবে—আমাদেরই একজন হয়ে উঠবে। ওর রক্ত কিছু ভালো জিনিসও বয়ে নিয়ে আসবে-যা আমার মধ্যে নেই; তোর মধ্যে নেই। তোর বুকের দুধ খাবে, আমার সঙ্গে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবে বড় হয়ে। ও দেখবি একেবারে আমাদেরই মতো হয়ে যাবে। নানকু ওরাওঁ-এর ব্যাটা….।

তারপর বলে, নাঃ। মন এখন দেবো না। ব্যাটার চেহারা দেখে তারপর দেব।

টুসি হাসে। কিন্তু বড়ো লজ্জা করে! বড়োই লজ্জা করে টুসির। গর্ভাধান, প্রেমেই হোক কী ঘৃণাতেই হোক; যেসব বিবাহিত মেয়ে পরপুরুষের ঔরসজাত সন্তান গর্ভে বয়ে বেড়ায় একমাত্র তারাই জানে যে, স্বামীর মুখের দিকে চাইতে তাদের কতখানি লজ্জা করে! কতখানি কষ্ট হয় বেচারী স্বামীর জন্যে। সে স্বামী যতই নির্গুণ, নিরূপ হোক না কেন!

এই পথে কেউই হাঁটে না আজকাল। আগাছা গজিয়ে গেছে পথের মধ্যে। গরমের দিনে সাপেরও ভয়। খুব ভয়ে ভয়ে হাঁটছে টুসি।

একটু এগিয়েই জিপটা দেখতে পেল। ভাইয়া বসে আছে। ভাইয়ার হাতে দোনলা বন্দুক। কোমরে রিভলবার। যে-রকম রিভলবার দেখিয়ে সেই মানুষটা তাকে লুটেছিল।

দীর্ঘশ্বাস পড়ল টুসির। মানুষটার কথা মনে পড়ল! বড় সুন্দর মানুষটা। সে যদি ভয় দেখিয়ে, গায়ের জোরে তাকে না পেত! মেয়েরা তো এমন নয় যে, প্রিয় ছাড়া, স্বামী ছাড়া, তারা আর দ্বিতীয়জনকে ভালোবেসে কিছু দেয় না কখনও। ভালোবেসে মেয়েদের কাছ থেকে সবই পাওয়া যায়। কিন্তু ঐ লোকটা—প্রথম অভিজ্ঞতাতেই লোকটা সমস্ত পুরুষজাত সম্বন্ধে টুসির মনে বড় ঘেন্না ধরিয়ে দিয়েছিল।

হীরু ওকে জিপে উঠে আসতে বলল।

টুসি জিপে উঠে বসলে, হীরু বলল, বাড়িতে কী বলেছিস?

তুমি যা বলতে বলেছিলে।

বেশ করেছিস!

তারপর বলল, তোর সঙ্গে শেষ দেখা করে ক্ষমা চায় আমার বন্ধু। ও জেনেছে যে, তুই আমাকে সব বলেছিস। সব শুনে ও বলেছে যে নানকুর কোনো ক্ষতি ওর দ্বারা হবে না। সেকথাও ও আমাকে দিয়েছে। তুই যে আমার বোন ও তা জানতো না।

টুসি বলল না, জানলেই বা! কেউ কি এমন করে করতে পারে? জোর করে?

হীরু চুপ করে রইল। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল ওর।

জিপ চলতে লাগল। কিছুটা গিয়েই ঝারিতালাও-এ এসে পড়ল ওরা। ঝারিতালাও পেরিয়ে গিয়ে জিপটাকে লুকিয়ে রাখল হীরু পথের বাঁদিকে। তারপর জিপ থেকে নেমে বলল, চল্।

তখন সাড়ে ছ’টা বেজেছে; চারধারে সাবধানে তাকাতে তাকাতে চলতে লাগল হীরু! পুলিশ সাহেবের দামি পোশাকে টুপিতে বেল্টে, জুতোতে আর ভাইয়াকে দেখে গর্বিত হচ্ছিল টুসি। ভাইয়ার কেবল একটাই খুঁৎ। সে লম্বা নয়।

পশ্চিম পাড়ের তেঁতুল গাছতলাতে এসে হীরু বলল, তুই এই ইম্‌লি গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকবি। ও আসবে ওর জিপ নিয়ে। জিপেই কথাবার্তা বলবে। তারপর চলে যাবে। এখানে আমার থাকার কথা নয়। কিন্তু শোনচিতোয়াটার জন্যে তোকে আমি একা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দিতে পারি না। আমি পাশের কেলাউন্দা ঝোপগুলোর আড়ালে বন্দুক নিয়ে তোকে পাহারা দেব। ও এলে, এই বলবি না যে আমি আছি। ভুলেও না।

টুসি এবারে একটু ভয় পেল। বলল, ক্ষমা চাইতে তোমার সঙ্গে ওতো বাড়িতেও আসতে পারত। এত কাণ্ডর কী ছিল? নানকু জানলে আমার উপর খুব রাগ করবে। এখনকার নানকুকে চেনো না দাদা। সে আর আগের লোক নেই।

হীরু একটুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, নানকু রাগ করলে বলিস, প্রথমত আমার কথাতেই তুই এরকম করেছিস, দ্বিতীয়ত নানকুর ভালোর জন্যেই করেছিস।

টুসি অধৈর্য গলায় বলল, ও কখনওই শান্তি কিনতে চায় না পেছনের দরজা দিয়ে। ও সেই ধাতের মানুষই নয়। ও শুনলে বড় রাগ করবে দাদা। আমি জানি না, কী হবে। ওকে বলতে আমার হবেই।

হীরু তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়ে বলল, আমার বন্ধু এক্ষুণি এসে পড়বে। আমি লুকোই।

আমার বন্ধু, কথাটা হীরু কী করে বলল, তা কথাটা বলে ফেলেই হীরু ভাবছিল।

টুসি বলল, আবারও যদি আমার সঙ্গে অসভ্যতা করে?

যাতে না করে তাই-ই তো আমি এলাম। তুই নিশ্চিত থাক। হীরু ওরাওঁ-এর শরীরে ওরাওঁ-এর রক্তই বইছে। ইজ্জৎ, সে নিজের ইজ্জৎ, বোনের ইজ্জৎ, গুষ্টির ইজ্জৎ, জাতের ইজ্জৎ, সবই সে বাঁচাতে জানে! তোর ভাইয়া আর সিং নেইরে। আবার ওরাওঁ হয়ে গেছে।

মিনিট দশেকের মধ্যেই পেট্রোল জিপের ইঞ্জিনের মিষ্টি ঘুমপাড়ানি শব্দ একটি রানি ভোম্রার ডানার শব্দর মতো জঙ্গলের মধ্যে ক্রমশ জোর হতে হতে এগিয়ে আসতে লাগল। তারপর একসময় পথের বাঁকে জিপটাকে দেখা গেল। জিপটা এগিয়ে আসতে লাগল সোজা এদিকে। জিপটা যখন একেবারে কাছে এসে গেছে, তখন হঠাৎই হীরু আবিষ্কার করল যে বাংলোর চৌকিদার সামনের সিটে বসে আছে; তার বন্ধুর পাশে।

হঠাৎ হীরু ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। ক্ষিপ্ত ও একটুও হতে চায়নি। ও ভেবেছিল খুব ঠাণ্ডা মাথায়, নিষ্কম্প হাতে, জিপ থেকে নামলেই বন্দুকে তুলে গুলি করবে তার রহিস, উঁচু জাতের বন্ধুর বুক লক্ষ্য করে। তাই ওকে বারবার বলেছিল হীরু একা একা আসতে।

এই চৌকিদারটা ভারি পাজি। এইই টিহুলের বৌকে খারাপ করেছে, করেছে বস্তির আরও অনেক মেয়েদের। আর এখন সেই চৌকিদারকেই সঙ্গে নিয়ে এসে হাজির হল রহিস আদমি। এতবার একা আসতে বলা সত্ত্বেও! হীরু দাঁতে দাঁত চেপে নিরুচ্চারে বলল, যাঃ শালা! চৌকিদার তোরও মওত্ ছিল। তাই এলি। আমার হাতে মরতে এলি। বনদেওতার মনে এইই ছিল, কে জানত!

হীরু তো আর সিং নেই। হীরু যে আবার ওরাওঁ হয়ে গেছে।

জিপে, সেই মানুষটাকে দেখে টুসি অবাক হয়ে গেলো। যে মানুষের সন্তান বইছে সে অনুক্ষণ, যার পরশ তার স্তনবৃত্তে, তার জরায়ুতে, তার নাভিমূলে, তাকে ভুলবে কী করে? মানুষটা সত্যিই বড় ভালো দেখতে। সৌন্দর্যর একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। সবকিছুকে, ভালো মন্দ, অতীত ভবিষ্যৎ সব কিছুকেই ভুলিয়ে দেয় এমন চোখ-ধাঁধানো সৌন্দর্য।

মুহূর্তের জন্য টুসি সর্বনাশী, নানকুর প্রতিও বুঝি এক পরম অকৃতজ্ঞতায় তার ধর্ষণকারীর প্রতি এক নতুন অবিশ্বাস্য ভালোলাগায় ভরে উঠল! মেয়েরা বড় বিচিত্র। নারীর চরিত্র-রহস্য বিধাতারও অজানা। কিন্তু পরক্ষণেই ঘৃণাটা, চকিতে পোষা পাখির মতো, ওর বুকে ফিরে এলো; গর্ভধারণের পর তার বমির মতো, তার বিরক্তির মতো, তার মাথাব্যথার মতো, তার অরুচিরই মতো। টুসির ইচ্ছা হল মানুষটাকে দু হাত দিয়ে গলা টিপে মারে।

মানুষটা জিপের ড্রাইভিং সিট থেকে নামল। খুব লম্বা, সুপুরুষ ভাইয়ার মতোই পোশাক পরা। দারুণ মানিয়েছে পোশাকটা। তার আগুনরঙা মুখে, দিনের শেষে রোদের ছটা পড়ে আরও লাল দেখাচ্ছে।

মানুষটা হাসল, হেসে টুসির দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

ঠিক সেই সময়ই বন্দুকের আওয়াজটা হল। টুসির থেকে সাত-আট হাত দূরে দাঁড়ানো মানুষটার মুখ, মাথা, কান সব ঝাঁঝরা হয়ে ধড় থেকে আলাদাই হয়ে গেল বলে যেন মনে হল। ধপ করে মানুষটা পড়ে গেল টাঙ্গির বাড়ি-খাওয়া পলাশ গাছের মতো। পড়তে পড়তে অবচেতনে তার ডান হাতটা রিভলবারে খাপের দিকে এগিয়ে গিয়েই থেমে গেল।

ব্যাপারটা কী ঘটল, তা টুসি বোঝবার আগেই চৌকিদার জিপ থেকে নেমে উল্টোদিকে দৌড় লাগালো। ততক্ষণে হীরু উঠে দাঁড়িয়েছে কেলাউন্দা ঝোপের আড়াল ছেড়ে। উঠে দাঁড়িয়ে, বন্দুক তুলে ভাল করে নিশানা নিয়েই আবার গুলি করল। দৌড়তে থাকা চৌকিদার যেন একাট ধাক্কা খেল। সামান্য একটু লাফিয়ে উঠল; সামনে এগিয়ে আরও দু’পা দৌড়ে গিয়েই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল কতকগুলো তেতোগন্ধ পুটুসের ঝাড়ে। শরীরটা ডুবে গেল ঝোপের মধ্যে। তার একটা নাগাপরা পা উঁচু হয়ে থরথর্ করে কাঁপল কিছুক্ষণ।

আতঙ্কে বিস্ফারিত চোখে টুসি একবার তার ভাইয়ার দিকে আর একবার ঐ রহিস্ মানুষটি আর চৌকিদারের দিকে তাকাতে লাগল। ঘাড় এপাশ ওপাশ করতে করতে তার ঘাড় ব্যথা করছিল। ঘটনার আকস্মিকতাতে ও একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছিল।

ততক্ষণে প্রায় অন্ধকারও হয়ে এসেছে। টুসির মাথাটা একেবারে ভারশূন্য হয়ে গেছে। কোনো কিছু বোঝা বা ভাবার ক্ষমতা আর ওর নেই। টুসি ডাকল, ভাইয়া, ভাইয়া!

হীরু ওকে ইশারায় চুপ করতে বলে, বন্দুকে আরও গুলি ভরে এগিয়ে গিয়ে পড়ে থাকা লাশ দুটোর মাথা লক্ষ্য করে আরও দুটি গুলি চালালো। তারপর রহিস বন্ধুর রিভলবারের হোলস্টার খুলে রিভলবারটি এবং জিপ থেকে রাইফেলটি তুলে নিয়ে টুসিকে বলল, অব্ চলা যায়।

ভূতগ্রস্ত, দার্হাতে-পাওয়া, অন্তঃসত্ত্বা টুসি অদৃশ্য মানুষখেকো শোনচিতোয়ার আতঙ্কভরা অন্ধকার জঙ্গলের দিকে একবার, আর তার খুনি ভাইয়ার দিকে আরেকবার চাইতে চাইতে জিপের সামনের সিটে এসে বসল হীরুর পাশে।

হীরু জিপটা স্টার্ট করল। হেডলাইট জ্বালালো। তারপর সোজা হুলুক্ পাহাড়ের দিকে চলতে লাগল।

টুসি বলল, ভাইয়া, এ কী করলে তুমি! দু দুটো খুন করলে! আমার ভয় করছে। শিগগির আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও। শরীর খারাপ লাগছে আমার ভীষণ।

হীরু চুপ করে থাকল।

একটুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে, অথচ যেন অনেক দূর থেকে বলছে এমন ভাবে বলল, একটু পরে আর ভয় করবে না। ভালো লাগবে। দেখিস্।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে টুসি বলল, ভয়ার্ত গলায়, কোথায় চললে? বাড়ির উল্টোদিকে?

এক্ষুনি ফিরলে, লোকে আমাকে যে সন্দেহ করবে, বাংলোতে সিপাহি কনস্টেবল্ তো কম নেই। দারোগাও আছে একজন।

ওঃ। টুসি বলল। ঈস্…।

হুলুক্ পাহাড়ের খাড়া উঁচু ঘাঁটির পথটা অনেকখানি খাড়া উঠে যেখানে বাঁক নিয়েছে, তার নীচেই ঘন জঙ্গলে ভরা গভীর খাদ। নীচ দিয়ে একটা ঝরনা বয়ে গেছে। জঙ্গলাকীর্ণ এখন। মিশেছে গিয়ে মীরচাইয়াতে। অনেকখানি চড়াইয়ে উঠে আসার পর জিপ থামালো হীরু।

টুসি বলল, থামলে কেন?

এখানে থেকে আমাদের বস্তিটা খুব সুন্দর দেখায়। মনে হয়, নেতারহাটে এসেছি। আজ কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে, দ্যাখ্ টুসি। ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না। নীচের জঙ্গল, টাঁড়, আর ভালুমার বস্তি কী দারুণ দেখাচ্ছে দূরে! আয়, নেমে দ্যাখ।

তারপর বলল, কতদিন পর এলাম বস্তিতে। তোর সঙ্গে কতদিন পর…।

টুসি ভয় পাওয়া গলায় বলল, ভাইয়া, শোনচিতোয়া আছে না? এখানে নামা কী ঠিক হবে?

টুসির শরীরটা বড়ই খারাপ লাগছিল। পেটের ভিতরে যে প্রাণটা নড়ে চড়ে বলে মনে হয় আজকাল; সে যেন একটু আগেই জেনে গেছে যে, যে-তার জনক; সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। যেন বুঝতে পেরেছে তার বীভৎস মৃত্যুর কথা। সমস্ত শরীরটা গুলিয়ে উঠেছে টুসির। তবুও ভাইয়ার কথাতে ও নেমেই দাঁড়াল। সন্ধের বনের স্নিগ্ধতা ভালো লাগলো। এত উঁচুতে বেশ একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব আছে।

আবার মনে পড়ল—ঈস্—স্-স্।

হীরু বোনের কোমর জড়িয়ে ধরে ছোটবেলার মতো আদরে, বড় উষ্ণতার সঙ্গে, কিন্তু যেন অনেক দূর থেকে বলল, তোর জন্যে আমার বড় কষ্ট হয় রে টুসি

তুমি কী করবে বল? সবই আমার কপাল!

চন্দ্রালোকিত উপত্যকার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে টুসির দু-চোখ জলে ভরে এল।

হীরু টুসির একটু পিছনে দাঁড়িয়ে তার রিভলবারটা বোতাম খুলে-রাখা হোলস্টার থেকে বের করল আস্তে। বের করে, নিঃশব্দে হাতে নিল। তারপর টুসির ঘাড়ের পিছনে নলটা নিয়ে ট্রিগার টানল। একটুও কাঁপলো না হাত। কোনো আওয়াজ না করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল টুসি। চুল ছড়িয়ে, দু হাত দুদিকে মেলে দিয়ে, একটা পাথরের উপর এমনভাবে পড়ল যে, আর একটু হলেই খাদে চলে যেত ও। প্রায় দু’হাজার ফিট নীচে। রিভলবারের গুলির আওয়াজ, দৌড়ে গড়িয়ে গেল জ্যোৎস্নালোকিত খাদের দিকেই। পরক্ষণেই ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল পাহাড়ের দিক থেকে অনেকগুলো আওয়াজ হয়ে।

হীরু, টুসির পিঠের বাঁদিকে, যেখানে তার একমাত্র আদরের বোনের ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত, বড় ক্লান্ত হৃদয়, ঠিক সেইখানে আরেকবার গুলি করল খুব কাছ থেকে। ঝটিতে ওকে চিৎ করে, টর্চ জ্বেলে, একবার ছোটবোনের মুখটা দেখে নিল শেষবারের মতো। তারপর গলগল করে গরম তাজা রক্ত বেরোনো শরীরটাকে পা দিয়ে জোরে ঠেলে ফেলে দিল নীচের খাদে।

অত নীচে পড়ায়, কোনো আওয়াজ শোনা গেল না। একটা কালো উড়ন্ত পিন্ডর মতো তালগোল পাকিয়ে হাত, পা চুল বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে তার সুন্দরী বোন টুসি অদৃশ্য হয়ে গেলো খাদের অন্ধকারে। আচমকা কতকগুলো টি-টি পাখি চারপাশ থেকে ডেকে উঠল একসঙ্গে। তারপর হীরুর মাথার ঠিক ওপরে, চক্রাকারে ঘুরে বেড়াতে লাগল।

জঙ্গলের পাখিদের চোখেও কিছু অদেখা থাকে না। গাছেরই মতো।

হীরু তার বন্ধুর রাইফেলটা আর রিভলবারটা ছুড়ে ফেলে দিল নীচের খাদে। চটাং চটাং শব্দ করতে করতে, পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে; লাফাতে লাফাতে ওগুলোও গিয়ে পড়ল নীচে।

তারপর জিপ ঘুরিয়ে আস্তে আস্তে ঘাঁটিতে নামতে লাগল হীরু। কিছুটা নামতেই, একটা বড় রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে দেখা হল। রাস্তার একেবারে মাঝখানে। বাঘটা, চড়াইটায় উঠে আসছিল। সরু রাস্তা। জিপ ও বাঘ দু’জনের যাওয়ার পথ নেই। কিন্তু বড় বাঘ কখনও রাস্তা ছাড়ে না কাউকে। হীরু একটু ব্যাক করে, যেখানে রাস্তাটা দু-ভাগ হয়েছে, সেখানে এসে দাঁড়াল। বাঘটা সোজা উঠে এসে একলাফে ডান দিকের পথে নেমে চলে যেতেই, হীরু জিপটাকে সেকেন্ড গিয়ারে দিয়ে আবার নামতে লাগল।

হীরু ওরাওঁ ভাবছিল, এ সংসারে বিদ্যা, শিক্ষা, অর্থ, জাতের কৌলিন্য এসবই ফাল্গু। সবচেয়ে যা বড়; তা হচ্ছে ইজ্জৎ। হীরু ওরাওঁ-এর বোন সেই ইজ্জৎ দিয়ে দিয়েছিল তার বন্ধুকে। স্বেচ্ছায় হোক, কি অনিচ্ছায় হোক।

আরও ভাবছিল যে, নানকু হারামজাদা খুব বড়ো। বড়ো বেশি বড়ো। কিন্তু কী করে পরের ছেলে পেটে নিয়ে টুসি তাকে বিয়ে করল? নানকু যদি এত বড় হতে পারল, তবে তার বোনও কেন একটু বড়ো হতে পারল না? ভালুমার বস্তিতে কি গাছ ছিল না গলায় দড়ি দেওয়ার?

হীরু যদি হীরু সিং থাকত, তবে হয়তো অনেক কিছুই মেনে নিতে পারত। লক্ষ লক্ষ নিজ নিজ স্বার্থ বাঁচানো শহরের-সুখ-সর্বস্ব বড় জাতের বাবু অনেক কিছুই মেনে নেয়। বামন, কায়েত, ভূমিহার, ক্ষত্রিয়দের বিবেক হচ্ছে কন্‌ভিনিয়েন্সের বিবেক। কিন্তু ওরাওঁ-এর বিবেক তা নয়। ওরা ওদের পুরোনো মূল্যবোধ নিয়েই বাঁচতে চায়।

কে জানে? হয়তো হীরু ভুল। হয়তো, ও প্রাকৃত। প্রাকৃত তো হবেই; ও যে আদিবাসী। অপাংক্তেয়, হরিজনদেরই মতো। ওদের সংস্কৃতি অনেকই পুরোনো। অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে এসেছে ওদের এই মূল্যবোধ। শিক্ষিত হয়ে, ভারত সরকারের বড় অসর হয়েছে বলেই হীরু তার রক্তের কথা ভুলতে পারে না। হীরুর মতো একজন আদিবাসী মানুষের কাছে কী মূল্যবান; তা কেবল সেইই জানে। এবং সেই মূল্যবোধের মূল্য কী করে দিতে হয়; তাও।

গভীর বনের মধ্যে একা জিপ চালাতে চালাতে হীরু ভাবছিল যে, ওদের যদি কেউ সত্যি সত্যিই ভালোবাসত, যদি ওদের সঙ্গে অন্তরের একাত্মতা বোধ করত, তবে তেমন কেউই শুধু কেবল বুঝতে পারত এই মুহূর্তে হীরু ওরাওঁ-এর আনন্দ এবং দুঃখের গভীরতার স্বরূপ। যুক্তি বা তর্ক দিয়ে নয়; শুধু চোখের জলেই এই মুহূর্তে হীরু ওরাওঁ-এর প্রকৃত মানসিকতা প্রতিবিম্বিত হত। শুধু মাত্র, চোখেরই জলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *