৪৫
আজ স্কুল থেকে যাবার সময় পরেশনাথ গলায় খুশির ঝলক তুলে বলল, আজ বাবা আসবে।
বাবা? অবাক হয়ে আমি শুধোলাম।
হ্যাঁ। মাহাতো বাবা। সুজির হালুয়া আর প্যাড়া নিয়ে আসবে। আমাদের জন্যে।
বলেই, ছুট লাগালো ভেজা মাঠ পেরিয়ে
কতকগুলো কেঁচো স্তূপীকৃত হয়ে ছিল নরম মাটির ওপরে। ব্যাঙাচি দৌড়ে গেল ছোটো একটি গর্তের জমা জলে। কত পোকা-মাকড়, কত রঙ তাদের। রাতের বেলা ঘরের মধ্যে আলো জ্বেলে জানালা খুলে রাখা যায় না আজকাল। তীব্র গতিতে নানা আকৃতির নানারঙা বনজ পোকা-মাকড় আছড়ে এসে পড়ে লণ্ঠনের ওপর। সারাদিন ঝিঁঝি ডাকে ঝাঁ-ঝাঁ করে। মীচাইয়াতে এখন সফেন জলরাশি প্রচণ্ড বেগে বয়ে চলেছে সহস্র ধারায়। গ্রীষ্মের তাপদগ্ধ কালো চ্যাটালে পাথরগুলো কোথায় হারিয়ে গেছে এখন। মাঝে মাঝে শুধু তাদের উঁচু কানাগুলো চোখে পড়ে, সেখানে জল ছাপিয়ে উঁচু হয়ে আছে ওরা। গ্রীষ্মের ধূসর ধূলিমলিন তাপক্লিষ্ট রুক্ষ বনের মধ্যে যে এত উচ্ছল প্রাণ লুকিয়ে ছিল নিঃশব্দে, তা কে বিশ্বাস করবে!
সব পোড়োরা চলে গেলে, তিতলি চা নিয়ে এল। তিতলিকে বলেছিলাম, ওকে ডালটনগঞ্জের হাসপাতালে সময় মতো ভর্তি করাব। ও ভীষণ আপত্তি করেছে। কোনো পুরুষ ডাক্তারের সামনে সে নগ্ন হতে পারবে না। তার নগ্নতার প্রথম ও শেষ সাক্ষী হবো আমিই। ওর জীবনের একমাত্র পুরুষ। আশ্চর্য ওর লজ্জাবোধ। মনের গভীরে প্রাচীন কোনো জটাজুট-সম্বলিত মেল শভিনিস্ট বাস করে বলেই হয়তো ওর এই সমর্পণী কথাতে মনের মধ্যে এক রকম মূর্খজনোচিত শ্লাঘা বোধ করি। বুঝতে পারি, আমি ভীষণ স্বার্থপর। নইলে জোর করতাম, করা উচিতও ছিল ওর নিরাপত্তার কারণেই। ও বলে, বিপাতিয়া আর শনিচারিয়াই যা করার তা করবে। যেমন করে তার ঠাকুমা এবং মা-এর প্রসব হয়েছে এই গ্রামেই, ওরও তেমন করেই হবে। অত খরচের ও কায়দার দরকার নেই। সে যেমন ছিল, তেমনিই থাকতে চায়। বড়লোক বাঁশবাবুকে বিয়ে করেছে বলেই সে বড়লোকি করতে রাজি নয়।
হাসি পায় আমার ওর কথা শুনে।
বড়লোকই বটে! বাঁশবাবুর মতো বড়লোক কে আর আছে? কী জানি? বড়লোকি বোধহয় টাকার অঙ্কের ওপর নির্ভরশীল নয়। তা থাকে কারো কারো মনে। তিতলির মতো এই রকম বোধসম্পন্ন মানুষরাই বোধহয় সত্যিকারের বড়লোক।
চা দিয়েই ফিরে না গিয়ে, আজ বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়া পরেশনাথের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকল তিতলি। কেমন উদাস হয়ে গেল ওর চোখের দৃষ্টি। আমি ভাবলাম, ওর যখন ছেলে হবে, সেও পরেশনাথের মতোই টালমাটাল পায়ে এই পর্বত প্রান্তরে কেমন করে ছুটে যাবে, তাইই ভাবছে বোধহয় ও।
কী ভাবছিস?
উঁ?
ভাবছিস কী তুই?
ও আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ভাবছি, ছেলেমেয়ের দরকার কী ছিল?
হঠাৎ এই কথা?
না, আমি ভাবছি; মানি আর মঞ্জুরী চাচা-চাচির কথা। কত কষ্ট করে পেটে ধরেছিল চাচি, পরেশনাথকে। কত কষ্ট করে নিজেদের সব আরামের থেকে বঞ্চিত করেই না, বড়ো করে তুলেছিল ওকে চাচা-চাচি! আজ সুজির হালুয়া আর প্যাড়ার লোভ পরেশনাথকে সবই ভুলিয়ে দিল! অজীব্ বাত! ওরা যদি এতই নিমকহারাম হয়, তবে ছেলে-মেয়ে হওয়ার দরকার কী আদৌ!
পরেশনাথের কী দোষ? ও তো শিশু। মুঞ্জরীই যদি একটু ভালো খাওয়া, ভালো থাকা একটু সোহাগের জন্যে এতদিনের ঘর ভাঙতে পারে, তবে ছেলেমানুষ পরেশনাথের দোষ দিই কী করে? তুই যদি আজ দশ-পনেরো বছর পরে আমাকেও এমনি করে ছেড়ে চলে যাস, তোকে আমার চেয়ে যে অনেক বেশি ভালো করে রাখবে, আমার চেয়েও যে অনেক আরাম দিতে পারবে সব রকমের, এমন লোকের কাছে; তখন তোর মা-ন্যাওটা ছেলের তোর সঙ্গে গেলে তাকে আমি অন্তত দোষ দিতে পারব না।
তিতলি ভীষণ রেগে উঠল। নাকের পাটা ফুলে উঠল ওর। বলল, সব মেয়েই মুঞ্জরী-চাচি নয়। সব মেয়েই নিমকহারাম, নির্লজ্জ নয়। অমন কথা তুমি বোলো না। কখনও বলবে না।
বোকার মতো কথা বলছিস তুই। মানুষের একটাই জীবন। আমি যদি তোকে খেতে না দিতে পারি, তোর ছেলেমেয়েকে ভরণপোষণ না করতে পারি, অন্য লোকের হাতে রোজ রোজ অপমানিত হই কিন্তু তবুও রোজই মদ খাই, মাতাল হয়ে ফিরি হাট থেকে সেদিনকার তুই কী করবি না করবি তা আজ বলা সহজ নয়। আমাদের জীবন নদীরই মতো। তাতে কখন কোথায় চর পড়ে আর পাড় ভাঙে, কখন কোন দিকে ছুটে চলে জল তা কি আগে থাকতে বোঝা যায়? পাগলি! কারো ভবিষ্যৎই কেউ জানে না। ভগবান মানুষকে সবই জানতে দিয়েছেন, শুধু পরক্ষণে তার নিজের জীবনে কী ঘটবে তা জানতে দেননি।
তিতলি আবারও রেগে বলল, ও সব কথা আমি জানি না। আমি, আমি। সবাই এক রকম নয়। চাচি কখনওই ভালো কাজ করছে না। বনদেওতা তাকে কখনও ক্ষমা করবে না, তুমি দেখে নিও।