কোজাগর – ৩৮

৩৮

রথীদার সঙ্গে কাল হঠাৎ একবার দেখা হয়েছিল পথে। আমাকে দেখেই, মুখ ঘুরিয়ে নিলেন অথচ আমি কথা বলব বলেই ওঁর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।

এমন যে হবে, হতে পারে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবি নি। রথীদা এর আগে ভালুমারের কয়েকজনকে এবং গজেনবাবুকেও বলেছেন, আর কী হবে? তোদের বাঁশবাবুকে আত্মীয় বলে মনে করতাম, সে এমন একটা কাণ্ড করে বসল যে, কোথাও দেখা হলে, গাঁয়ের বিয়েচুড়ো এবং অন্য জমায়েতেও মুখ ঘুরিয়ে নিতে হবে।

মানুষ রাগের মাথায় অনেক কথাই বলে। তবে, রথীদার মতো একজন মানুষ, যাঁকে হৃদয়ের সব শ্রদ্ধা, সব সম্মান উজাড় করে দিয়ে ভালোবেসেছিলাম, তিনি এমন যে সত্যি সত্যি করতে পারেন, তা আমার ভাবনারও বাইরে ছিল। ব্যাপারটাকে সহজে স্বীকার করে নিতে পারিনি। তাই আমার ডেরাতে ফিরেই কাগজ কলম নিয়ে বসেছিলাম। তিতলি আমাকে গম্ভীর দেখে শুধিয়েছিল, শরীর খারাপ হয়েছে কি না? জবাব না দিয়েই রথীদাকে চিঠি লিখতে আরম্ভ করলাম। কিন্তু শ্রদ্ধাভাজনীয়েষু লেখার পর শ্রদ্ধাভাজনীয়েষু কথাটা কেটে দিয়ে চুপ করে বসে রইলাম অনেকক্ষণ।

যাকে আর মন থেকে শ্রদ্ধা করতে পারি না, তাকে শ্রদ্ধাভাজনীয়েষু বলে সম্বোধন করার মধ্যে এক ধরনের ভণ্ডামি আছে বলে মনে হল আমার। মন থেকে যা আসে না তা নিজের পরম প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকলেও আসে না। লিখলাম :

রথীদা,

আজ সকালে বাস স্ট্যান্ডের সামনে যখন আপনার সঙ্গে দেখা হল তখন আপনি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন আমাকে দেখে। বড়ো কষ্ট হল আমার। আমার নিজের কারণে নয়। আপনারই কারণে। আপনার বাখ্-বীটোভেন-মোৎজার্ট, আপনার দেশি-বিদেশি সাহিত্য ও দর্শনের ওপর দখল, আপনার অগাধ পাণ্ডিত্যর আর কোনো দাম অন্তত আমার কাছে রইল না। আমি আপনার তুলনায় নিতান্তই অশিক্ষিত। সত্যিই সত্যিই বাঁশবাবু। কিন্তু আমার মনে হয় মানুষকে সবচেয়ে আগে মনুষ্যত্বর পরীক্ষাতে কৃতকার্য হতে হয়। হওয়া উচিত অন্তত। সে পরীক্ষায় ফেল যদি কেউ করেন, তাহলে তাঁর কত পাণ্ডিত্য কত জ্ঞান তা নিয়ে আমার অন্তত মাথাব্যথা নেই কোনো।

মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকলেই সব মানুষ মানুষ হয় না। আমি এমন রূঢ় কথা আপনাকে কখনও বলতে পারব বলে ভাবিনি। কিন্তু আজকে আপনার ব্যবহার দেখে আমার মনে হল যে, আপনাদের মতো তথাকথিত শিক্ষিত মানুষরা এই মস্ত দেশটার নেতা ও নিয়ন্তা হয়ে রয়েছেন বলেই আজও এই দেশের এমন দুর্দৈব। আপনাদের অন্তরের গভীরে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত ভণ্ডামির জোরেই আপনারা নানকুর মতো ছেলেকে বাইরে থেকে বাহবা দেন, বাড়িতে ডেকে হুইস্কি খাইয়ে তার কাছে ভগবান সাজতে চান, আমাদের মতো স্বজাত ও স্বসমাজের মানুষকে পিঠ চাপড়ে বলেন, ‘সাবাস হে ছোকরা, এই ছোটলোকগুলোকে টেনে তোলা, জ্ঞানের আলো দেখাও। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। মিশনারি সাহেবদের অধিকাংশর মতো আপনিও তেমনই ভালো করতে চান এই তিতলিদের। বাইরের ভালো শুধুই দেখানো ভালো। অ্যানিম্যাল লাভার্স সোসাইটির সভ্যরা পশুদের ভালোবাসেন। তাঁদের মতোই আপনারাও বিলিতি কুকুরদের যতখানি ভালোবাসেন তাদের যত সোহাগ করে ফোমের গদির ওপর সযত্নে পাতা বিছানাতে শোয়ান তার একশ ভাগের একভাগ ভালোবাসা ও সোহাগ ও আপনাদের বুকের কোণায় জমিয়ে তোলেননি এই মানুষগুলোর জন্যে। আপনি এবং হয়তো আমিও যাদের মধ্যে যৌবন ও জীবন প্রায় কাটিয়ে দিলাম,—সেই হতভাগা মানুষগুলোর জন্যে কিছুমাত্র বোধই বোধহয় রাখি না আর। তিতলি যদি মানুষী না হয়ে উঁচু পেডিগ্রীর বিলিতি কুক্কুরী হত, তাহলে আপনার কাছে ওর সম্মান হয়তো অনেকই বেশি হত। বিলিতি ডগ্‌ সোপ দিয়ে ওকে চান করাতেন, ক্যালেন্ডার দেখে ওকে ডি-ওর্মিং করতে নিয়ে যেতেন ভেট্ এর কাছে। সে ঋতুমতী হলে, কোন পাড়ায়, কার কাছে, তার জাতের যোগ্য পেডিগ্রীর কুকুর কাছে তার খোঁজ করে সেই কুকুর দিয়ে নিজের সাধের কুকুরীকে রমণ করাতেন, যাতে পরের প্রজন্মে আবারও তেমনি সুন্দর উঁচু জাতের সোনু-মনু কুকুরবাচ্চা পান। কিন্তু রথীদা, তিতলি যে মানুষ! আমি যে তার মধ্যে আপনার চোখ দিয়ে পেডিগ্রী খুঁজে নি। একজন সাধারণ মানুষের চোখ দিয়ে একজন মানুষীকে খুঁজেছি। একজন পুরোপুরি ভারতীয় মানুষকে। যে জাতে বামুন নয়, যে বাঙালি নয়, যে এনিড ব্লাইটন বা মিলস এন্ড বুন্ পড়েনি কখনও, আপনার মতো প্রুস্ট, ডস্টয়ভয়স্কি, এবং বাখ্ বেটোভেন মোৎজার্ট এর নাম পর্যন্ত শোনেনি যে। যে শুধু এই সুন্দর মস্ত দেশের রামায়ণ মহাভারতের শিক্ষায় শিক্ষিত আনকালচারড্ আনইন্টেলেক্‌চুয়াল একজন মাটির গন্ধ গায়ের ভারতীয়।

আপনাকে বলতে পারতাম আরও অনেক কথা, সরি, লিখতে পারতাম। আমার মনে পড়ে না আজ অবধি এত ক্রুদ্ধ আমি কখনও হয়েছি। আমি জানি না কী করে নিজেকে সামলাব; নিজেকে বোঝাব, মানব যে, আপনাকে শ্রদ্ধা করার মতো এত বড় ভুল…….।

ইতি
সায়ন মুখার্জি

চিঠিটা খাম-বন্ধ করে তিতলিকে বললাম, মানিয়া বা বুলকি কী পরেশনাথ এলে তাদের কারো হাত দিয়ে এ চিঠিটি রথীদার কাছে পাঠিয়ে দিতে। তিতলি অনেকক্ষণ আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। বলল, পাঠাবে? পাগলা সাহেবকে? তারপর কিছু বলতে গিয়েও বলল না। মুখ নামিয়ে বলল, আচ্ছা।

রামধানীয়া চাচার বাড়ি যেতে যেতে অনেক কথাই ভাবছিলাম। জঙ্গলের পথে একা হাঁটলেই আমাকে ভাবনাতে পায়। আসলে, রথীদার এই আশ্চর্য ব্যবহারে আমি পাগলের মতো হয়ে গেছি কয়েকদিন হল। আমার মাথার কিছুই ঠিক নেই। যে মানুষকে মনে মনে এত বড়ো করে দেখে এসেছি, শৈশবে মাতৃপিতৃহীন হয়ে আমি যাকে মা-বাবা-গুরু সকলের স্থানে বসিয়েছি, এত বছর ধরে যাকে নিজের আদর্শ বলে জেনেছি, সেই মানুষটি এক মুহূর্তে এত নীচে নামিয়ে ফেললেন নিজেকে। ধুঁয়োর মেঘে চোখ জ্বালা করেছে বলে তার নীচে আগুন আদৌ আছে কি নেই, সে কথা এক-বারও মনে হয়নি। মানুষ এমন ভুলও করে? আর এই মানুষটিকেই ভালুমার ও আশপাশের বস্তির মানুষরা দেবতা জেনে তার পায়ে পুজো চড়িয়ে এসেছে এতদিন।

আসলে, আমরা প্রত্যেকেই কী দারুণ স্বার্থপর! তিতলিকে বিয়ে না করলে, আমার ব্যক্তিস্বার্থ, পারিবারিক স্বার্থ, আমার বিবাহিত স্ত্রীর অপমান না ঘটলে, আমি কি এত উত্তেজিত হতে পারতাম? শুধুই আমার নোক্রানি তিতলির জন্য? হয়তো পারতাম না। এবং পারতাম না বলেই ‘মানুষ’ এই পরিচয়ের সম্মানে নিজেকে সম্মানিত ও করতে পারতাম না।

হাটবার আজ। হাটে যাব। তিতলি বলছিল, কী কী আনতে হবে। আমি কাগজের ফালিতে লিস্ট বানিয়ে নিচ্ছিলাম। পরেশনাথের জন্যে একটি প্যান্ট ও জামা আর বুলকির জন্যে একটি শাড়ির কথা বলেছিল ও।

বেরোবার সময় শুধোলাম, বুলকি তার পরেশনাথের মাপ তো আমার কাছে নেই। তিতলি হাসল। বলল, ও শাড়ি পরা আরম্ভ করেছে। ওর জন্যে একটা ডুরে শাড়ি এনো, যত সস্তাতে পাও। পারলে, একটা সায়া আর জামাও। মেয়েটা বড় হচ্ছে।

মেয়েটা বড় হচ্ছে।

এমন বিপদ আর নেই। বুদ্ধদেব বসুর একটি কবিতা পড়েছিলাম ‘যৌবন করে না ক্ষমা’। বিত্তশালিনী কন্যাদের কাছে যৌবন আসে আশীর্বাদের মতো। আর বুলকির মতো হতভাগিনীদের কাছে যৌবন বড়োই অভিশাপ হয়ে আসে।

হাটবারে জঙ্গলের পথে পথে রঙের মেলা বসে যেন। মেয়েরা সকলেই যার যার ভালো রঙিন শাড়ি পরে, ভালো করে নিম বা করৌঞ্জ বা সরগুজা বা কাড়ুয়া যা হাতের কাছে জোটে সেই তেল দিয়ে জাব্‌জবে করে চুল আঁচড়ায়। কেউ বা কাঠের কাঁকুই গোঁজে মাথায়। ফুল গোঁজে প্রায় সকলেই। কেউ হাটে চলে বিকোতে। কেউ চাল কিনতে। কেউ বা দুয়েরই জন্যে। ছেলেরাও তালিমারা জামা-কাপড়ের মধ্যে যা সবচেয়ে ভালো সেইটেই বের করে পরে। যার ছাতা আছে সে-যতই বিবর্ণ হোক না কেন, সে স্ট্যাটাস্ সিম্বল হিসেবে সেটাকেও হাতে নেয় গরমে এবং বর্ষায়। পথ চলতে চলতে কথা কয়। বাঁকের মুখে অদৃশ্য হয়ে যায় রঙের চমক। তেল, সিন্দুর, খৈনীর গন্ধ মিশে যায় পুটুসের গন্ধের সঙ্গে। পথটা যতই হাটের কাছাকাছি পৌঁছতে থাকে ততই নানারকম গন্ধ এসে নাক ভরে দিতে থাকে। বয়েল গাড়ির বয়েলদের গায়ের গন্ধ, খড়ের গন্ধ, খোলের গন্ধ, তেলের গন্ধ, বাজে-তেলে পকৌড়া আর বড়া ভাজার গন্ধ। চিনির সিরাতে ফেলা গজার মজা গন্ধ। ছাগল, মুরগির গায়ের গন্ধ, হাঁস-মুরগির ডিমের আলাদা আলাদা গন্ধ। আর সমবেত বনপাহাড়ের মেয়েপুরুষদের ঘামের গন্ধে ম-ম করে হাটের আকাশ-বাতাস।

হাটই হচ্ছে আমাদের এখানের ক্লাব। শহুরে বাবুদের বড়ো বড়ো ক্লাবের মতন। সেসব ক্লাবে শুনতে পাই এখনও গলায় রঙিন দড়ি ঝুলিয়ে, টেইল্কে ট না পরে গেলে দেশ স্বাধীন হওয়ার চল্লিশ বছর পরও কোনো কোনো ঘরে বা খানাঘরে ঢোকা মানা। তবে ওসব তফাত ছাড়া আর সবই এক। পরনিন্দা, পরচর্চা, একে অন্যের বউ ভাগিয়ে নেওয়া, ছেলেমেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ, নতুন বানানো গয়না দেখানো, এসব মানসিকতায় সব ভারতবাসীই এক। শুধু তাদের ভাষা আলাদা, চাল-চলন আলাদা, অর্থনৈতিক অবস্থা আলাদা এইই যা।

ধীরে সুস্থে কেনা-কাটা করে, বৈদ্যর কাছ থেকে রামধানীয়া চাচার জন্যে একটু দাওয়াই নিলাম।

মানিয়ার সঙ্গে দেখা হল। ও চা খাবে কিনা জিজ্ঞেস করলাম। তাতেও বিশেষ উৎসাহ দেখালো না। সপ্তাহে একদিন হাটে এসে চা জিনিসটাও বিশেষ পছন্দ করে না। নান্ ধারে-কাছে না থাকলেই হাটের দিনে মানিয়া কয়েকপাত্র চড়াবেই। শাল পাতার দোনায়। এই-ই-তো আনন্দ। শুধু এইটুকুই।

ফরেস্ট গার্ডদের কাছে মানিয়ার কেসের খোঁজ নিলাম। ওরা মানিয়ার কাছ থেকেই খৈনী চেয়ে নিয়ে হাত ডলতে ডলতে ঠোঁটের তলায় চালান করে দিয়ে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে বলল, “শালেকো পাঁচ-সাকো দামাদ বানাকে ছোড়েগা। অ্যাইসেহি ছোড়েগা থোরী!”

মানি ইতিমধ্যেই কিঞ্চিৎ টেনেছিল ভাটিখানা থেকে। মুঞ্জরীও ধারে কাছে নেই। সুতরাং ভারত স্বাধীন। গার্ডদের দিকে চেয়ে দার্শনিকদের মতো ও নির্লিপ্ত হাসি হাসল। বলল, আইনে যদি তাইই হয় তবে তাইই যাব। আইন আমি অমান্য করি না।

তবে কাঠ কাটলি কেন? এতই যদি তোর জ্ঞান? ধমকে উঠল একজন গার্ড! মানি হঠাৎ তড়পে উঠে বলল, জঙ্গলের কাঠ কি শালা তোর বাবার! জঙ্গলের লোক আমরা। বনদেওতা কোনোদিন অভিশাপ দিল না, জঙ্গলের কাঠের মালিক হয়ে গিলি আজ তোরা। ফুঃ। আম চারা গাছা গাছ কাটালে দোষ। আর তোরা যে টাকা খেয়ে ট্রাককে ট্রাক গাছ পাচার করে দিচ্ছিস এই সব কোর-এরিয়ার ভিতর থেকেই; তখন কি বাঘিনীকে পেয়ার করা বাঘ বাঘিনীর ঘাড় থেকে বিরক্তিতে নেমে পড়ছে না? বাঘের বংশবৃদ্ধি করছিস শালার আমাদের বংশনাশ করে। তাও সত্যি সত্যি বাঘ বাড়লেও কথা ছিল। যত বাতেল্লা। যত রাগ, কি এই গরিব মানিরই ওপর? আমাকে কুড়ুল হাতে জঙ্গলে দেখতে পেলেই কি তাদের বংশবৃদ্ধি করার ইচ্ছে উবে যাচ্ছে?

কথাটা অবশ্য যেমন ভদ্রভাষায় লিখলাম, মানি আদৌ সে ভাষায় বলল না। তার ভাষা লেখার যোগ্য নয় বলেই মোলায়েম করে লিখছি।

গার্ড মানির দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, তুই ভেবেছিসটা কী? দেশের আইন বলে কি কিছুই নেই? চল্ শালা! তোকে পাঁচবছর কেন, দশবছরের জন্যে দামাদ করব। গাঁড়পর দো-দো হান্টার লাগালে ভালুমার বস্তির লোকেরা তোর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবার জন্যে লাইন লাগিয়ে দেবে। আইন তো তামাশা হ্যায়! যিকা পাস্ পাইসা, উনহিকা জেবমে কানুন। জয় বজরঙ্গবলীকা জয়।

দূর থেকে রথীদাকে দেখলাম। লাল হলুদ ডোরাকাটা টেরিকটের হাওয়াই শার্ট আর সাদা টেরিকটের ট্রাউজার পরনে। মাথার ওপর লাল-নীল-সবুজ হলুদ ছাতা। পেছনে বেয়ারা, থলে হাতে।

আশ্চর্য! এত বছর রথীদাকে এমনভাবেই দেখে আসছি। হাট সুদ্ধু লোক গড় হয়ে প্রণাম করছে পাগলা সাহেবকে। কিন্তু এর আগে একবারও আমার মনে হয়নি যে, রথীদা যদি আমারই মতো, রোশনলালবাবুর একজন অতি নগণ্য কর্মচারী হতেন এবং ছ্যাঁচা বাঁশ ও খড়ের ডেরায় থাকতেন, রথীদার যদি এত পয়সা না থাকত, জমি-জমা না থাকত তাহলে কি এত খাতির-প্রতিপত্তি হত তাঁর।

কথাটা ভেবে নিজেকেই ছোটো লাগল। আমার মনটাই কি নোংরা? ছোট? আজ রথীদার সঙ্গে আমার গভীর মতবিরোধ হয়েছে বলেই কি আমার এ কথা মনে হচ্ছে? না, এই কথাটি সত্যি এতদিন আমারই চোখে পড়েনি এই সত্যর স্বরূপ।

তিতলির প্রণাম গ্রহণ না-করা, তিতলির কারণে আমাকে সুদ্ধু অস্বীকার করায়, যারা তিতলির আপনজন, আমার চেয়েও অনেক বেশি আপনজন, তাদের মধ্যে খুব কম লোকের মনেই রথীদা সম্বন্ধে কোনো দ্বিধা দেখলাম। অবাক বিস্ময়ে আমি মানুষগুলোর দিকে চেয়ে রইলাম। এই আসল ভারতবর্ষ। এর মুক্তি নেই। ভবিষ্যৎ নেই। এখানে রথীদার মতো ভণ্ড মানুষরা, গোদা শেঠ, মহাতোর মতো খল ধূর্ত অত্যাচারীরা আর রোশনলালবাবুর মতো টাকার কুমিররাই চিরদিন রাজত্ব করে যাবে। যারা নিজেরা না জানতে চায়, কুম্ভকর্ণের প্রেত যাদের মানসিকতাকে অসাড় করে রেখেছে যুগযুগান্ত ধরে, তাদের বাঁচাবে কে? এ অজগর চিরদিন কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়েই থাকবে, ঘুম ভেঙে সমস্ত দেশের শরীরের আনাচ-কানাচের অসাড়তা ভেঙে, এ নিজের গতিতে কি কখনও গতিমান হবে? হয়তো হবে না। আমার জীবদ্দশায় হয়তো হবে না।

রথীদা যেমন সকালে করেছিলেন, তেমনই এখনও আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।

আমার কেনা কাটা শেষ হয়ে এসেছিল। এক কাপ চা ও দুখিলি পান খেয়ে উঠলাম। একটা লাঠি নিয়ে এসেছিলাম, তাতে, থলে-টলে ঝুলিয়ে ডেরার দিকে পা বাড়ালাম। তিতলিকে বিয়ে করার পর থেকে এবং রোশনলালবাবুর চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে আমি আচারে ব্যবহারে মানি-মঞ্জুরীদের মতোই হয়ে গেছি। হয়ে যাচ্ছি ক্রমশ। আমার নামের পেছনে যে বাবু লেজটি ছিল তার থেকে মুক্ত হতে চাইছি অনবধানে। দু পাতা ইংরিজি পড়লে বা শহুরে বামন কায়েত ভূমিহার হলেই যে হাটে গেলে, পেছনে মাল বইবার জন্যে কাউকে নিয়ে যেতে হয়, না-নিয়ে গেলে দেহাতের লোক সম্মান করে না, এ কথা আর মানি না। মানার মতো মানসিক অবস্থাও নেই। এরা যদি আমাকে তাদের একজন বলে ভালোবাসে তাহলেই খুশি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাসবে কি?

ব্যাপারটা বড়ো হঠাৎ ঘটে গেল। একেবারে অভাবনীয় ভাবে। হাটের এলাকার মাঝামাঝি পৌঁছে গেছি। চোখ তুলেই দেখলাম, সামনে মাহাতো দাঁড়িয়ে আছে। ও বোধহয় মাংসের দোকানে দাঁড়িয়ে দুজন অনুচর নিয়ে মাংস কিনছিলো। হঠাৎ দৌড়ে এল আমার দিকে। চমকে উঠলাম আমি ব্যাপারটার অভাবনীয়তায়। মারবে না কি আমাকে? কিন্তু কেন? রোশনলালবাবুর প্ররোচনায়? কিন্তু ও কাছে আসতেই বুঝলাম ওর লক্ষ্য আমি নই। আমার হাত দুয়েক পিছনে পিছনে হেঁটে আসা মুঞ্জরী। মুঞ্জরীকে একেবারেই লক্ষ করিনি।

মুঞ্জরীর পরনে একটা শাড়ি। শুধুমাত্র শাড়িই। শায়া নেই। জামা নেই। পেঁচিয়ে, আঁটসাঁট করে পরেছে। মুঞ্জরীর বয়স এখন হবে পঁয়ত্রিশ। দারিদ্র্য আর অত্যাচারে অনেক বড় দেখায় ওকে। কিন্তু নারী সে তো নারীই। নারীর লজ্জাবোধ, সম্ভ্রম শুধু চিতাতেই ছাই হয়। মাহাতোকে দেখেই, বাজকে দেখে বটের তিতির যেমন আড়াল খোঁজে তেমনই আমার পেছনে জড়সড় হয়ে দাঁড়াল ও। শাড়িটাকে যতখানি পারে টেনে-টুনে ঠিক করে নিল। তবু শাড়ির ওপরে অনেকখানি জায়গা অনাবৃত রইল। ওর উজ্জ্বল তামা-রঙা শরীরের আভাসে মহাতোর দু’চোখ লুব্ধ হয়ে উঠল। মাহাতোরা সৌন্দর্য জানে না। মাংস চেনে।

মাহাতো বলল, তোকে আগেই বলেছিলাম। আগে টাকা দিবি কি না বল। না দিলে যা করব বলেছিলাম, আজ তাই-ই করব।

মানিয়া তো এসেছে হাটে। মুঞ্জরী মিনমিন করে ভয়ে কাঠ হওয়া গলায় বলল। তা তো এসেছে, কিন্তু বসে গেছে, শুঁড়িখানায়। তোর কীরকম মরদ?

মুঞ্জরী অসহায়ের মতো বলল, টাকা তো আমাদেরই পাওনা তোমার কাছে। বয়েল ভাড়ার সব টাকা তো শোধ হয়নি এখনও।

হবে। এক্ষুনি হবে। আমি যা বলি, তাইই করি। আজ তোকে দেখাব। তোর মরদকে দেখাব, আর দেখাব তোর সব পেয়ারের লোককে, মাহাতো কী করতে পারে, আর না পারে।

মুঞ্জরী হঠাৎ বাঁশবাবু-উ-উ-উ বলে এক চিৎকার দিয়ে দৌড়ে সামনে—হাটের মালভূমি ছেড়ে ঝোপঝাড় জঙ্গলের দিকে, যেদিকে ওদের বাড়ি ফেরার পথ। লোহার নাল-লাগানো নাগড়া পায়ে মাহাতোও ওকে ধাওয়া করে গেল। মুঞ্জরীর হাতে একটি ছোট্ট থলি, রসদ তাতে সামান্যই ছিল, সে অনেক জোরে দৌড়াচ্ছিল। আর মহাতোর পেছনে আমি। কিছুই না ভেবে। যন্ত্রচালিতর মতো! চোখের কোণে দেখলাম, ছাতা মাথায় রথীদা সিগার ফুঁকতে ফুঁকতে পাঁঠার পেছনের রাং থেকে মাংস নেবেন, না সামনের রাং থেকে, তাতেই মনোনিবেশ করলেন, মাহাতো আর মুঞ্জুরীর দিকে চকিতে একবার তাকিয়ে নিলেন। 

রাতারাতি এমন বদলে যেতে পারে কোনো মানুষ। আশ্চর্য! বেশিদূর যেতে হল না। হাটের কেন্দ্রবিন্দু পার হয়ে, ঝোপঝাড়ের মধ্যে পৌঁছতেই মাহাতোর অনুচররা মুঞ্জুীকে ধরে ফেলল। ভয়ে প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠল মুঞ্জী। হাট-ভরতি লোক একমুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে গেল। পরক্ষণেই মাহাতো, গোদা শেঠ এবং মাহাতোর অনুচরদের দিকে তাকিয়ে আবার কেনা-বেচায় মন দিল। ততক্ষণে আমিও পৌঁছে গেছি মুঞ্জীর কাছে। আমার আগেই পৌঁছেছে মাহাতো। মাহাতো মুঞ্জরীর শাড়ির আঁচলটা ধরে জোরে টান লাগলো। দু’পা জোড়া করে বুকের কাছে দু’হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে ছিল মুঞ্জুরী। কিন্তু প্রচণ্ড বলশালী মহাতোর হাতের এক ঝটকায় মুঞ্জীর শাড়িটা খুলে গেল। সম্পূর্ণ বিবস্ত্রা হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল ও। প্রথমে হাতদুটো বুকের কাছে জড়ো করা ছিল। এখন বুক নিবারণ করে হাত দুটোকে জড়ো করে ঊরুসন্ধিতে এনে রেখে হাউ-হাউ করে উঠল ও। 

আজ সকাল থেকে আমার রাগ ঈশানকোণের মেঘের মতো জমা হচ্ছিল। রথীদার মতো তথাকথিত শিক্ষিতদের ভণ্ডামি, হাট-সুদ্ধ এই অশিক্ষিত মানুষগুলোর নপুংসকতা আমার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল। আমার বোধ তাৎক্ষণিক ভগ্নমুহূর্তে মাথার মধ্যে অ্যাম্পলিফায়ারের মতো গগমিয়ে বলল, আজ মাহাতো, মুঞ্জরীর বেইজ্জত করছে হাটের মাঝে, কাল তিতলিকেও করবে। সব কিছুরই একটা কোথাও শেষ হওয়া উচিত, থাকা উচিত সমস্ত জাগতিক অসীমতারই। কী করলাম, তা জানবার আগেই, আমার কাঁধের লাঠি থেকে সমস্ত মালপত্র ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মাথার ওপর লাঠিটা তুলে নিয়ে সজোরে এক বাড়ি লাগালাম মাহাতোর মাথায়। বিকট একটা শব্দ হল। মাইরে-এ-এ বলে চিৎকার করে মাহাতো মাটিতে ধপাস্ করে পড়ে গেল কাটা কলাগাছের মতো। 

মরে গেল না কি? গেল তো গেল। 

মুঞ্জরী মুহূর্তের মধ্যে মাটিতে পড়ে থাকা শাড়িটাকে তুলে নিয়ে জড়িয়ে নিল আবার গায়ে। এতক্ষণ পর মানিয়া দৌড়তে দৌড়তে কাঁদতে কাঁদতে এসে মুঞ্জীর পা জড়িয়ে ধরে হাউ-হাউ করে কেঁদে উঠল। মুঞ্জী সঙ্গে সঙ্গে ঘৃণায় লাথি মারল ওর মুখে। মানিয়া বসানো ঘটের মতো উল্টে পড়ে গিয়ে পেছনে উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়েই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। 

ততক্ষণে মাহাতোর অনুচরেরা আমাকে ঘিরে ফেলেছে। পাঁচ-ছ’ জন হবে। কারো হাতে লাঠি, কারো হাতে বর্শা, তারা আমাকে টেনে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। দু তিনজন মাহাতোর পরিচর্যায় লাগল। আমা-হেন নির্বিরোধী গাঁ-বাচালে বাবু শ্রেণীর লোক ছোটোলোকদের মধ্যে পড়ে যে মাহাতোকে লাঠি মেরে ধরাশায়ী করতে পারে এ কথাটা হাটের একটা লোকেরও বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু শ্লথবুদ্ধি লোকেরা যখন কোনো বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে, দেব অথবা ভূতের বিশ্বাসেরই মতো, তখন মরে গেলেও তা আর ছাড়তে চায় না। চেনা-অচেনা লোকগুলো হঠাৎ ছায়ামূর্তির মতো এক-এক করে এগিয়ে আসতে লাগল। দোকানিরা দোকান ছেড়ে এল। যাদের হাট শেষ হয়ে গেছে, তারা রসদ মাটিতে নামিয়ে। পাকৌড়ির দোকানে উনুনের ওপর কড়াইতে চিড়বিড় করে তেল পুড়ে যেতে লাগল। 

আমাকে ওরা আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। লোহার মতো ওদের হাতের বাঁধন। আমি যে ডাইরি-লেখা, মনে মনে কবিতা-লেখা মানুষ। আমি যে ছবি আঁকতে ভালোবাসি, আমি যে গান গাই। শরীরচর্চা তো করিনি কখনও। আমার মতো কেরানি, কলমপেষা, কবিতা-লেখা শিক্ষিত বাবুরা যে চিরদিন শরীরচর্চাকে ছোটলোকী বলেই মনে করে এসেছি। শরীরে বল থাকা ভদ্রজনোচিত ব্যাপার বলে কখনও মানিনি। কিন্তু সেই মুহূর্তে বুঝতে পারলাম যে শরীরচর্চা নিশ্চয়ই করা উচিত ছিল। শরীরটাও হেলাফেলার নয়। কারণ পৃথিবীতে শরীরসর্বস্ব লোকই সংখ্যায় বেশি। তাদের কাছে শারীরিক ভাষাটাই একমাত্র ভাষা, কলমের ভাষা নয়, তুলির ভাষা নয়, গলার সুর নয়। 

আশ্চর্য! হাটের সেই সমস্ত মানুষ পায়ে পায়ে আসছিল। কিন্তু হাত পনেরো-কুড়ি ব্যবধান রেখে। মাহাতোর লোকদের মধ্যে দু’জন হুংকার ছাড়তেই ওরা হুড়মুড় করে পাঁচ-পা পেছিয়ে গেল। কিন্তু আবারও এগিয়ে আসতে লাগল। ক্রমে ক্রমে ব্যবধান কমিয়ে ফেলতে লাগল। আমার খুব লাগছিল। একজন মাথার চুলের মুঠি জোরে ধরে ছিল। মাথাটা পেছনদিকে টেনে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসা হাটের অগণিত মানুষগুলির দিকে চেয়ে আমার মনে হচ্ছিল যে আমার চতুর্দিকে স্তূপের পর স্তূপ বারুদ। বারুদের বলয় আমাকে ঘিরে রয়েছে। যে বারুদে আগুন লাগলে একটি প্রকাণ্ড দুর্গ পর্যন্ত উড়ে যাবে, মাহাতোর ক’জন অনুচর তো ছার। কিন্তু কারো কাছেই আগুন নেই। স্ফুলিঙ্গ নেই একটিও। একটা মানুষ চাই। মাত্র একটা মানুষ! মানুষের মতো মানুষ। মশাল হাতে একটা মানুষ যে শুধু আগুন লাগাতেই নয়, পথ দেখাতেও পারে। পথিকৃৎ নেই। তেমন মানুষ নেই। শুধু ভালুমারেই নয়, এই গাড়ুভালুর হাটেই নয়, বোধ হয় সারা দেশেই নেই। 

একটা মোটা পিয়াশাল গাছের গোড়াতে নিয়ে গিয়ে মাহাতোর অনুচরদের মধ্যে থেকে একজন কোমর থেকে একটা লম্বা ধারালো ছুরি বের করল। কসাইয়ের ছুরির মতন। তিতলির মুখটা মনে পড়ল আমার। বুলকি আর পরেশনাথের মুখও। ওদের জন্য নতুন শাড়ি জামা কিনেছিলাম। বড়ো খুশি হত ওরা দেখতে পেলে। আর পরমুহূর্তেই মনে পড়ল আমার মৃতা মায়ের মুখখানি। আর মায়ের মুখের কথা, অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে। 

ঠিক সেই মুহূর্তেই ওই পিয়াশাল গাছের চারপাশের জঙ্গল থেকেই চারজন অল্পবয়সি ছেলে হঠাৎ ডালটনগঞ্জে দেখা হিন্দি ছবির চরিত্রের মতোই যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হল। তাদের প্রত্যেকের হাতে ঝকঝকে দোনলা বন্দুক। তারা মুখে কিছু বলল না, বন্দুকের নলগুলো শুধু মাহাতোর লোকেদের দিকে তাক করে থাকল। 

ঠিক সেই মুহূর্তে হাট-ভর্তি নারী-পুরুষ-শিশু একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল। মারো উস্‌লোঁগোকো জানসে মার দেও। মারো মাহাতো শালেকো। মা-বহিনকো ইজ্জত ভি ছোড়তা নেহি ঈ জানোয়ার লোঁগ। 

বলেই তারা কিন্তু আর বন্দুকওয়ালাদের অপেক্ষাতে বা সাহায্যে রইল না। যে জোর যে একতার দৃঢ়বদ্ধ গভীর অসীমশক্তিসম্পন্ন জোর তাদের মধ্যে নিবদ্ধ ছিল, এতদিন, এত বছর, তার অদৃশ্য উৎস মুখ খুলে যেতেই তারা হৈ-হৈ করে এসে পড়ল মহাতোর লোকেদের ওপর। ধরাশায়ী হল মাহাতোর লোকজন। হাটের কোনো দোকানি যেন মুঞ্জুরীকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে তাকে নতুন শাড়ি সায়া জামাতে সেজে নিতে বলল জঙ্গলের আড়ালে গিয়ে। 

কিছুক্ষণ হাটের লোকদের স্বাধীনতা থাকলে মাহাতো অথবা তার দলবদলের একজনও, সেদিন প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারত না। জনতা যে মরা ব্যাঙের মতো ঠান্ডা অথচ ডিনামাইটের মতোই শক্তিধর সেই কথা প্রথম উপলব্ধি করলাম আমি সেদিন। শুধু ডিটোনেটর চাই। 

কিছুক্ষণ কিল চড়-লাথি, লাঠি টাঙ্গির উল্টোদিকের ঘা মারবার পরই সকলে হঠাৎ একসঙ্গেই থেমে গেল। আমি ঘটনা পরম্পরার অভাবনীয়তাতে অবশ হয়ে সেই বড়ো পিয়াশালের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে ছিলাম। বুঝলাম কাউকে অথবা কয়েকজনকে আসতে দেখে সবাই চুপ করে গেছে। সকলেই পশ্চিমদিকে চেয়ে ছিল। কারা আসছে? 

পুলিশ? না তো! কোনো আওয়াজ নেই। 

হ্যাঁ। এবার কানে এল, দূর থেকে টায়ারসোলের ছেঁড়া চটি ফটাস্ ফটাস্ করে দুলা-পালা একটামাত্র লোক আসছে। তার ধুতি ও দেহাতি খদ্দরের পাঞ্জাবির অনেকখানি ছিঁড়ে গেছে, দাড়ি কামায়নি, শীর্ণ চেহারা। কাছে আসতেই গুঞ্জন উঠল নানকু। নান্ক। নানকুয়া হো! 

ছেলেগুলো যে নানকুকে চেনে এমনও মনে হলো না। কিন্তু নানকু আসার সঙ্গে সঙ্গেই তারা ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেল। নানকু, মাহাতোর চেলাদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মাহাতোর কাছে গেল। কাকে যেন বলল, পানি পিলাও উস্‌কো। সে জল খেয়ে একটু সুস্থ হলে তাকে বলল, তোরা ওয়াক্ত আজ খতম্ মাহাতো। ম্যায় আজ তুহর্ জান দেলি। তোরা জাকা বদলা কওন্ চিজ্‌ দেবি? বহত শওচ্ সঝকে বল্।… 

যো মাঙ্গিস্ তু নানকুয়া। 

কোনোরকম উঠে বসে মাহাতো বলল, পাঞ্জাবির হাতায় মুখের জল ও রক্ত মুছতে মুছতে। 

জান্ ত’ বড়া মেহঙ্গাই হোতা হ্যায়। বলে, নানকু হাসতে লাগল। দারুণ সেই হাসি। মনে হল, এই নানকুকে আমি চিনি না। নানকু বলল, আজসে তু হামলোগোঁকা, ঈয়ে ভুখে-হুঁয়ে ভোলে-ভালা ঝুণ্ডকা এক টুকরা বন্যা মাহাতো। কৈচ্‌কী মে কোয়েল য্যাইসা ঔরঙ্গামে মিলি, ঐসেহি হামলোগোঁকো সাথ মিল্ যা। জি খোলকে তু ক্যা হামলোগোঁকো পায়ের সে দাব্ কর্ বাঁচনে শেকোগী? নেহী, কভি নেহী। নেহী ত, পেয়্যারসে যো-কুছ্ তোরা হ্যায়, সব মিজুলকে বাঁট বাঁটকে খা আসে মাহাতো। তোরা একহেহিকা তোদ্‌মে কিনা গেন্দুনী ঔর গেঁহু? সব্‌সে মিল্কর, বাঁটকে খা, খাকে দেখ্‌, খানা কিত্‌না মিঠা লাগতা। কিনা জদি পতা। আঃ। উঠ। 

মাহাতো কাঁদতে কাঁদতে উঠল। আমার লাঠি খেয়ে ওর মাথার পেছন-ফেটে রক্ত বেরুচ্ছিল। 

নানকু আমার দিকে ফিরে বলল, আমি চললাম। আমাকে আর তোমাদের দরকার নেই। 

প্রত্যেকটি মানুষ নির্বাক, নিস্পন্দ হয়ে রইল। 

আমার কাছে এসে একটু বসল নানকু। আমার মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে কৌতুকময় চোখে বলল, কামাল কর দিয়া! বাঁশবাবু। 

তারপর ফিফিস্ করে বলল, এরা এতদিনে এদের আবিষ্কার করেছে। অল্পবয়সি ছেলেগুলোকে, যারা দেখা দিয়েই লুকোলো, তাদের এখন বোঝাতে হবে যে, আসল জোর বন্দুকের নলে নেই। বন্দুক তো মানুষের চাকর মাত্র। বোমাও তাই। যে মানুষ বন্দুক হাতে পেয়ে নিজেদের বড়ো মনে করে তাদের মনের বয়স হয়নি এখনও। মানুষের মনের জোর আবার যেদিন মানুষ পুনরাবিষ্কার করবে সেদিন বোধ হয় অল্পকটা খারাপ লোক, অগণ্য ভালো লোকের ওপর খবরদারি করতে পারবে না। বাঁশবাবু আমাদের সকলের জীবনকাঠি মরণকাঠি এখন আমাদেরই হাতে। একমাত্র আমাদেরই হাতে। এই ভালুমার একটি ছোট্ট উদাহরণ। আমরা নিজেদের অনেক বছর বড় অসম্মান করেছি। এখন সময় এসেছে বাঁশবাবু, নিজেদের ফিরে পাবার। ভালুমারে সকলে সত্যিই বোধ হয় এতদিনে নিজেদের জোরের কথা বুঝতে শিখেছে। সবে শিখেছে। বড়ই আনন্দের কথা। আর ভয় নেই। 

রথীদা একা এগিয়ে এলেন। এতক্ষণ মাংসের দোকানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। ফিল্মের ফ্রিজ শটের মতো। নানকুর দিকে চেয়ে বললেন, কী রে? তোর পাগলা সাহেবকে চিনতে পর্যন্ত পারছিস না দেখছি। এত বড় নেতা হয়ে গেছিস? 

নানকু পাগলা সাহেবের দিকে তাকাল একবার। তারপর, রহস্যজনক হাসি হেসে বলল, কে আপনি? সত্যিই কিন্তু আপনাকে চিনতে পারলাম না। 

রথীদা হাটসুদ্ধ লোকের সামনে অপমানিত হয়ে চলে যাওয়া নানকুর দিকে চেয়ে হঠাৎ শব্দ করে….হঠাৎই থুথু ফেললেন ওর দিকেই। 

হাটসুদ্ধু লোক দম বন্ধ করে রইল। নানকু ঘুরে দাঁড়াল। যেখানে হাটের লাল ধুলোয় থুথুটা পড়েছিল, সেই অবধি ফিরে এল। তারপর থুথুটা মাটিতে পড়ে থাকা একটি শালপাতার দোনায় করে দু’হাতে নিয়ে রথীদার কাছে ফিরে এল। 

আমার ভীষণ ভয় করতে লাগল, এবার কী করবে নানকু তা ভেবে। ভাবলাম, রথীদার থুথু রথীদাকে দিয়েই হয়তো গেলাবে। নানকু ছেলেটা গত অল্প ক’দিনে অনেকটাই বদলে গেছে। নিকট আত্মীয় কেউ পাগল হয়ে গেলে অন্য নিকট আত্মীয় চোখে তাকে দেখে যেমন ভাব হয়, রথীদার চোখেও তেমন ভাব ফুটে উঠল। 

তবু রথীদা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, নিমকহারাম। 

নানকু হাসল। সে কথার কোনো জবাব দিল না। 

বলল, হাত পাতুন। 

রথীদা দু’হাত ভিক্ষা চাওয়ার মতো করে সামনে মেলে ধরলেন। নানকু সেই প্রসারিত হাতে দোনা ভরা থুথু তুলে দিয়ে ফিরে গেল। দু’পা দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, থুকিয়ে মত্ পাগ্‌লা সাহাব। থুক্‌নেওয়াঁলেকা স্রিফ্ থুক্ই মিলতা আখির মে। অপনা ইজ্জৎ সাহালকে অপনা জেব্ মে রাখিয়ে। 

বলেই, আর একবারও পিছনে না তাকিয়ে নানকু মিলিয়ে গেল গামছা আর চুড়ির দোকানগুলোর পাশ দিয়ে, থোকা থোকা ফুল ভরা পলাশ গাছগুলোর নিচ দিয়ে, গড়ানো পথ বেয়ে জঙ্গলের ধূলিধূসরিত গভীরে, শেষ বিকেলের কমলা আলোয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *