কোজাগর – ২৬

২৬

চিপাদোহরে পৌঁছতেই হৈ হৈ পড়ে গেল। নান্টুবাবু আর গজেনবাবু কোনো গোপন কারণে বনদেবতার কাছে পাঁঠা মানত করেছিলেন। কারণটা কী তা জানবার জন্যে আমি আর বিশেষ ঔৎসুক্য দেখালাম না। পাঁঠার স্বাদ খুবই ভালো ছিল। ডালটনগঞ্জের পাঁঠাদের খুব নামডাক আছে। বুদ্ধিমানদেরও নিশ্চয়ই আছে। তবে, তাঁদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। শহরের চারধারেই জঙ্গল। তাই পাঁঠাদের বিচরণ ক্ষেত্রের অভাব নেই এবং সে কারণেই এখান থেকে ট্রাক ট্রাক পাঁঠা কলকাতায় চালান যায়। কলকাতার ইন্টেলিজেন্ট বাবুরা খোঁজও রাখেন না যে, যে-পাঁঠাদের রেলিশ করে তাঁরা খান তাদের একটি বড় ভাগ কোথা থেকে আসে। কিন্তু এই ছাগল-পাঁঠার মতো শত্রু একোলজির আর কিছুই নেই। কিছুদিন আগেই ইউনেস্কোর একটি সমীক্ষা হাতে এসেছিল। যা পড়লাম, তাতে তাবৎ ছাগজাতি সম্বন্ধে এমন একটা বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে যে, পাঁঠা দেখলেও ঘেন্না হয়! ছাগল দেখলেও হয়। কারণ ছাগলের দুধ-খাওয়া স্বাধীনতা পেয়েছিলাম বলেই বোধহয় আমাদের স্বাধীনতায় এত রকম ভেজাল বেরুলো।

সাইপ্রাস, ভেনেজুয়েলা এবং নিউজিল্যান্ড তো ছাগজাতের বিরুদ্ধে রীতিমতো জেহাদই ঘোষণা করেছে। উর্বর জমি ও বনজঙ্গলকে পাঠাদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে ঐসব দেশ স্লোগান নিয়েছে, “Even one single goat at large is a danger to the nation.” এই ছাগলরাই আফ্রিকার সাহারা এবং সাভানা তৃণভূমির আয়তন বাড়াতে সাহায্য করেছে। প্রতিবছর সাভানাভূমির এক মাইল করে মরুভূমির পেটে চলে যাচ্ছে এদেরই দৌরাত্ম্যে। গত কয়েক শতাব্দীতে মূলত এদের জন্যেই মরুভূমি তিনশ কিলোমিটার উর্বর জমি জবরদখল করে নিয়েছে। আমি ঐ রিপোর্ট পড়ার আগে নিজেও জানতাম না যে, পাঁঠারা ঘাস এবং গাছের গোড়া উপড়ে নির্মূল করে খায়। মাটিরতলায় শিকড় সুদ্ধু সাফ হয়ে যাওয়াতে, রোদ বৃষ্টি এবং হাওয়ার কাছে ধরিত্রীকে অসহায় করে তোলে। মাটি ধুয়ে যায়, উড়ে যায় এবং তার সঙ্গে চলে যায় মাটির উর্বরতা। আমাদের দেশেও ছাগল-পাঁঠা কেউ বেড়া দেওয়া জায়গায় রাখে না। বেওয়ারিশ জমিতে অথবা পড়শির খেতে এবং টাড়ে-জঙ্গলে, ঝোপে-ঝাড়ে পাঁঠারা আপন মনে চরে বেড়ায় এবং সর্বনাশ করে। প্রত্যেক দেশেই এদের এই উন্মুক্ত বিচরণ: বন্ধ করার জন্যে আইন হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে কী হবে? যেখানে মানুষদের নিয়েই ভাবার মতো মানুষ বেশি নেই, সেখানে ছাগল-পাঁঠার ব্যাপারে কেউ বিশেষ মাথা গলাবেন? মাথা আমরা সব ব্যাপারেই গলাই; কিন্তু বড় দেরি করে। এখন বাঘ গেল, বাঘ গেল করে, প্রায় চোখ গেল, চোখ গেল রব উঠছে তামাম দেশ জুড়ে, অথচ আমাদেরই উর্বর মস্তিষ্ক থেকেই এই আইডিয়া বেরিয়েছিল যে, বিদেশিদের দিয়ে বাঘ মারিয়ে বিদেশি মুদ্রা অর্জন করে রাতারাতি বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো হোক। প্রতি রাজ্যে রাজ্যে প্রাক্তন রাজন্যবর্গ ও বড়লোক শিকারিদের আনুকূল্যে নানারকম শিকার কোম্পানি রাতারাতি ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছিল। তাদের কারও টার্মস ছিল “টু প্রডিউস্ আ টাইগার উইদিন শুটেবল ডিস্ট্যান্স”। কারও বা ছিল, বাঘ মারিয়েই দেওয়ার। বদলে বাঘ-প্রত্যাশী আগন্তুকরা দিতেন নানা অঙ্কের ডলার বা মার্কস্। খানা-পিনা ফালানা ঢামকানা অল ইনক্লুডেড। তা, আমেরিকান জার্মান ট্যুরিস্টরা কম টাকার শ্রাদ্ধ করে যান নি, সেই অল্প ক’বছরে। কম বাঘের চামড়া সঙ্গে করে নিয়েও যায়নি। প্রতি রাজ্যের প্রতিটি ভালো শিকারের ব্লকে যে কতগুলি করে বাঘা মারা পড়েছিল উনিশ শ’ সাতচল্লিশ থেকে উনিশ শ’ সাতষট্টির মধ্যে তার হিসেব নিলেই মোট সংখ্যা যে আতঙ্কের কারণ তা বোঝা যাবে। এর আগে চোরা শিকার যে হতো না তা নয়। কিন্তু চোরাশিকারিরা সাধারণত বাঘকে এড়িয়ে যেতেন। তাঁরা সাধারণত বাবুরাম সাপুড়েদের পথ অনুসরণ করে নিরাপদ শিকারই বেশি করতেন। বাঘ নির্মূল হতে বসেছিল বড়কর্তাদের বিদেশি মুদ্রা অর্জনের এই ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়ার দরুন। বাঘ যখন প্রায় নিঃশেষ হয়ে এল, তখন আরম্ভ হল টাইগার প্রোজেকট। ওয়ার্লড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের দাক্ষিণ্যে। টাকাও কম পাওয়া গেল না। এখন মানুষ মেরে বাঘ বাড়াবার প্রচণ্ড চেষ্টা চলছে। এই চেষ্টা কতদূর ফলপ্রসূ হবে তা আমরা, যারা জঙ্গলে থাকি তারাই একমাত্র বলতে পারব। খাতাপত্তরের হিসেবে যাই-ই বলুক—আগের থেকে বাঘের সংখ্যা যে বেড়েছে এ পর্যন্ত, তা আপাতদৃষ্টিতে একেবারেই মনে হয় না। বড় বাঘ আজকাল তো খুব একটা চোখেই পড়ে না। আগে আক্‌ছায় দেখা যেত। ট্রাক থামিয়ে, জিপ থামিয়ে রাস্তা কখন ছেড়ে যাবে সেই অপেক্ষায় বসে থাকতে হতো, বিশেষ করে বর্ষার এবং প্রচণ্ড শীতের রাতে। শীতের রাতে বাঘ বনের বড়ো রাস্তা দিয়ে যাতায়াতই পছন্দ করে। কারণ, বিড়ালের সমগোত্রীয় বলে, চামড়াতে জল পড়ুক তা তাদের একেবারেই পছন্দ নয়। শীতের রাতে শিশিরে ভেজা বন থেকে বৃষ্টির জলের মতোই প্রায় জল ঝরে।

অনেকদিন পর লালটু পাণ্ডের সঙ্গে দেখা। মুখে সেই অমায়িক হাসি, পবিত্র, অপাপবিদ্ধ। এখন দুপুরবেলা, তাই সিদ্ধির সরবৎ পেটে পড়ে নি বলে, লালটু এখন হান্ড্রেড পার্সেন্ট সোবায়। আমি ওকে অনুরোধ করলাম ক’টি শায়ের শোনাতে। লালটু ডান হাত দিয়ে পেল্লায় হাতা ধরে তার মধ্যে ঘি ঢেলে তা খেসারীর ডালের হাঁড়িতে

নাড়তে নাড়তে বাঁ হাত তুলে আঙুল নাড়িয়ে বলল :

“পীরতম্, বসে পাহাড় পর্
ম্যায় কোয়েল নদীকে তীর
তুমসে কব্ মিলন হোগা
পাঁও পড়ি জঞ্জীর।”

সঙ্গে সঙ্গে সকলেই ক্যা বাত্‌ ক্যা বাত্ করে উঠলেন। বললাম, আর একটা হোক। লালটু আমার পাতে ভাতের পাহাড়, ডালের নদী বইয়ে দিয়ে বলল :

“বাসি ভাতমে ভাপ্ নেহী
পরদেশকি পিয়াকে আশ নেহী।”

গজেনবাবু বললেন, কিছু বুঝলেন বাঁশবাবু? এটা লালটুর বউ এর কথা।

তা বুঝেছি।

নান্টুবাবু বললেন, ঐটা শোনা লালটু, যেটা গত মাসে পূর্ণিমার রাতে লিখেছিস।

আমার দিকে ফিরে বললেন, শুনুন, স্বামীর সওয়াল আর স্ত্রীর জবাব।

লালটু গর্বিত মুখে হাত নাড়িয়ে শুরু করল :

“লিখতা হুঁ খাতে খুন্‌সে, সিয়াহী না সমঝ না।
মরতা হুঁ তৈরি ইয়ামে, জিন্দা না সমঝ না।”

অর্থাৎ রক্ত দিয়েই চিঠি লিখছি। কালি দিয়ে লিখছি না। তোমার কথা ভেবে ভেবেই তো মরতে বসলাম; আমাকে আর জীবন্ত ভেব না।

লালটুর স্ত্রী লিখল :

“কেয়া, সিয়াহী নেহী থা? যো খুসে লিখতে?
কেয়া ঔর কোহি নেহি থী, যো হাম্‌পর মরেথে?

মানে হল, আ মরণ! তোমার কি কালি ছিল না যে রক্ত দিয়ে লিখতে গেলে চিঠি? আর অন্য কেউই কি ছিল না তোমার যে, আমারই জন্যে মরতে এলে।

এরপরে গজেনবাবুর পীড়াপীড়িতে আরও দুটি শায়ের শোনাল লালটু, কিন্তু সে দুটি এতই অশ্লীল যে লেখা যাবে না। লালটু কিন্তু সরল মনেই সেই শায়ের রচনা করেছিল। যা সহজ সরল ছিল, গজেনবাবুর উপক্রমণিকাতে তাইই কদর্য ও অশ্লীল হয়ে উঠল।

খেতে খেতে ভাবছিলাম যে, শ্লীলতা বা অশ্লীলতা বোধহয় রচনাতে থাকে না প্রায়শই; তা থাকে পাঠক শ্রোতার মনে। এবং তার দৃষ্টিভঙ্গিতেও। সুন্দরকে কদর্যতা দেবার এক ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল গজেনবাবুর

লালটু পাণ্ডে চিপুয়া মাছের ঝোল রেঁধেছিল। দারুণ স্বাদ এই মাছগুলোর। ঔরঙ্গা নদীর মাছ। প্রায় সারাবছরই পাওয়া যায়। ডালটনগঞ্জ থেকে নান্টুবাবু আমার অনারে সকালে পাঁঠার মাংসের সঙ্গে এই মাছও নিয়ে এসেছিলেন। এত সুস্বাদু মাছ খুবই কম খেয়েছি। রোশনলালবাবুর একজন অতিথির কাছে শুনেছিলাম যে আসামের গারো পাহাড়ের নিচে বয়ে-যাওয়া কুমিরে ভরা জিঞ্জিরাম নদীতে, একরকমের মাছ পাওয়া যায়, তার নাম ভাঙনি। সেই মাছের স্বাদ নাকি অনেকটা ঔরঙ্গার এই চিপুয়া মাছেরই মতো। খেয়ে দেয়ে উঠে সারাদুপুর গেল বাঁশ, কাঠ, ট্রাক, কুলী ও রেজার হিসেব নিয়ে। সন্ধ্যার সময় রোশনবাবু এলেন। যথারীতি হিসেব-নিকেশ চলল কিছুক্ষণ। আমরা সব চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

রোশনলালবাবু যখন কথা বলেন তখন আমরা কেউ কথা বলি না। বলার নিয়ম নেই। রোশনলালবাবুর গাড়িটা দাঁড়িয়েছিল। কালো রঙের অ্যাম্বাসাডার গাড়ি চতুর্দিকে নানান্ রকমারি ঝকে জিনিস। রকম-বেরকমের লাল-নীল আলো। এখানের রইস্ আদমিদের রুচিই এরকম। এখানে বড়লোকদের দামি পোশাক পরে দামি আংটি পরে শুধু দামি গাড়িই নয়, সেই গাড়িকে নানারকম উদ্ভট সাজে না সাজিয়ে রাখলে লোকে বড়লোক বলে মানতেই চায় না। বড়ই বিপদ। এবং হয়তো এই কারণেই চরম দারিদ্র্য আর প্রচণ্ড আড়ম্বরের পার্থক্যটা এখানে এত বেশি করে চোখে পড়ে।

কুলিরা জটলা করে দূরে দাঁড়িয়েছিল। আজ ওদের পে—ডে। বাবু সঙ্গে করে টাকা নিয়ে এসেছেন। কিন্তু আসতে আসতে আজ রাত হয়ে গেছে। এবং বাবু থাকাকালীনও পেমেন্ট পাবে না ওরা। কারণ গোলমাল উনি একেবারেই বরদাস্ত করতে পারেন না। বাবু চলে গেলে তারপর। বেচারিরা! এদিকে চিপাদোহরের হাট ভেঙে গেছে অনেকক্ষণ। ওদের কুকুর-কুণ্ডলি পাকানো জমায়েত থেকে চাপা বিরক্তিমাখা গুঞ্জরন শোনা যাচ্ছে। টাকাটা তাড়াতাড়ি পেলে খুশি হতো ওরা, কিন্তু একথা এসে বাবুকে বলে, এমন সাহস কারোরই নেই ওদের। আমাদেরও কারো নেই। আমরা যে বাবুর মাইনে করা চাকর। রক্ষিতারই মতো। আমাদের মধ্যে মাথা উঁচু করে কথা বলার মতো সাহস ক’জনের আছে? তাছাড়া, আমরা তো বহাল তবিয়তেই আছি। আমাদের মাইনে একদিনও দেরি হয় না। ও ব্যাটা কুলিদের জন্যে আমরা অপ্রিয় হতে যাই কেন মালিকের কাছে? যাদের গরজ তারাই বলুক। চাকরিটা চলে গেলে যে বুড়ো মা-বাবা অথবা অল্পবয়সি ভাই-বোন না খেয়ে থাকবে। নিজেরাও হয়তো থাকবো অথবা যে-জীবনযাত্রার মান-এ মালিক আমাদের অভ্যস্ত করে দিয়েছেন তা থেকে আমাদের নেমে আসতে হবে। সে বড় কঠিন কাজ। না-খেয়ে থাকার চেয়েও কঠিন। কারণ মাঝে মাঝে না খেয়ে-থাকা লোকদের মধ্যেও সত্যি কথা বলার সাহস দেখতে পাই, কিন্তু আমাদের মতো ইংরিজি জানা রক্ষিতবাবুদের মধ্যে সেই সাহস তো একেবারেই দেখি না।

মানুষের আত্মসম্মান, স্বাধীনতাবোধ, ব্যক্তিত্ব সব কেড়ে নেবার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে তার মুখে টাকা ছুঁড়ে দেওয়া, তাকে এমন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত করে দেওয়া যা থেকে কোনোমতেই নেমে যেন আসতে না পারে। পৃথিবীর সব প্রান্তরে মালিকরাই এ খবরটা রাখেন। আর রাখেন বলেই এই গভীর গহন জঙ্গলের মধ্যেও আমাদের মতো রক্ষিত মানুষদের তাদের উদ্দেশ্য সাধন করতে দেখতে পাওয়া যায়।

রোশনলালবাবু অবশ্য এক্ষুণি উঠে যাবেন। সঙ্গে তার দুই মোসাহেব। এঁদের আগে কখনও দেখিনি। একজন কালো মোটা মোষের মতো দেখতে। সৰ্বক্ষণ পান খেয়ে খেয়ে মুখের দুটি পাশ চিরে গেছে। তার পরনে পায়জামা আর পাঞ্জাবি। পেটে বোমা মারলেও বোধহয় অ, আ, ক, খ বেরবে না; অন্যজন বেঁটেখাটো—গাঁট্টাগোঁট্টা নর-পাঁঠার মতো দেখতে। চেহারা দেখে মনে হয় গাঁজা-গুলি খায়; খুন-খারাপি করে। তাদের রকম দেখে মনে হল যে, মালিক যদি এই রাতের বেলাতেও বলেন যে, সূর্য উঠেছে ঐ দুজন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠবেন, আলব্বাৎ মালিক নেহি ত ক্যা? মালিক এদের ছাড়া নাকি নড়েনই না আজকাল। এদের চোখ দিয়েই পৃথিবী দেখেন।

ব্যাপার দেখে মনে হল মালিকের ভীমরতি হয়েছে।

কুলিদের মধ্যে একটি অল্পবয়সি ছেলে এগিয়ে এসে রোশনলালবাবুর গাড়ির সামনের দুই বাম্পারে লাগানো ঝকঝকে আয়না দুটিকে দেখছিল। তারপর হঠাৎ তার কি খেয়াল হল, তার কোঁচড়ের মধ্যে থেকে একটি কাঠের কাকই বের করে সে চুল আঁচড়াবে বলে ঠিক করল, আগুনের আভা-পড়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। আয়না দুটি এমনভাবে লাগানো যে, নড়ানো যায় না। কিন্তু ও অত না বুঝে ডানদিকের মাদ্‌গাডে বসানো আয়নাটি ধরে শক্ত হাতে এক হ্যাঁচকা টান দিতেই আয়নাটি খুলে এল মাডগার্ড থেকে।

আর যায় কোথায়? এক নম্বর মোসাহেব চেযার ছেড়ে দৌড়ে গিয়েই ছেলেটির পেটে এক লাথি মারল, বেহেনচোত্ বলে গাল দিয়ে! পরক্ষণেই দু’নম্বর মোসাহেবও ভিড়ে গেল। কী হয়েছে, তা বোঝার আগেই ছেলেটি মাটিতে শুয়ে পড়ল মারের চোটে। মালিক একবার মুখ ঘুরিয়ে দেখে বললেন, অনেক হয়েছে, ছেড়ে দে। জানে মারিস না। এস.পি.-র সঙ্গে আমার একটু খটাখটি চলছে। অসময়ে তোদের যত ঝামেলা। সমবেত কুলিয়া এবং বাবুরা কিছু বোঝার আগেই ঘটনা ঘটে গেল। পাঁড়েজি বলে উঠলেন, এসব দামি জিনিস। ছোঁওড়াপুত্তান। দরকার কি তোর হাত দেবার। সারাজীবন খেটেও এইরকম একটা আয়না কিনতে পারবি? শালার কুপ্-কাটা কুলির আবার টেরি, তার আবার আঁচড়ানো! শখ কত!

কিছুক্ষণ পর বাবু চলে গেলেন মোসাহেবদের নিয়ে ধুলো উড়িয়ে। বাবুরা চলে গেলে, কুলিরা পেমেন্টের জন্যে এগিয়ে এল সেরেস্তার সিঁড়ির সামনে। অদ্ভুত কায়দায় বসল, দুটো হাঁটু দুদিকে দিয়ে ত্রিভঙ্গ হয়ে। ওরা এমনি করেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে পারে, নড়া-চড়া না করে। মাঝে মাঝে শুধু মাটিতে থুথু ফেলে এদিক ওদিক পিচিক পিচিক্ করে।

গণেশ মাস্টার এসে পৌঁছল। তাকে আগেই খবর দেওয়া হয়েছিল যে আমি এসেছি বাবুরা চলে যাওয়ার পর বাবুর বাবুরা বসলাম, বাবুদের ফেলে যাওয়া চেয়ারে। একটা চেয়ার তখনও বাবুর পশ্চাৎ দেশের গরমে গরম হয়ে ছিল। জাজমেন্ট সিট অব বিক্রমাদিত্যের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। তাই আমি ঐ চেয়ারটি এড়িয়ে গেলাম। গণেশ মাস্টার ঘটনা শুনে বলল, রোশনলালবাবু অনেক বদলে গেছেন। তাই না সায়নদা? নান্টুবাবু বললেন, কিছু লোক থাকে, পয়সাই যাদের একমাত্র পরিচয়। পয়সায় কোনোরকমে টান পড়লে, বা রোজগারে ভাঁটা পড়লে সেই মানুষগুলো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মনে করে সব গেল, সব গেল। তখন তাদের অমানুষ হয়ে উঠতে সময় লাগে না। তবে কী জানেন, সকলেই বদলায়। মানুষ হচ্ছে নদীর মতো! চলতে চলতে আমরা অনবরত নিজেদের বদলাচ্ছি। চর পড়ছে একদিকে, পাড় ভাঙছে অন্যদিকে। আমরাও কি একই আছি?

গণেশ বলল, বাবা! নান্টু তোর হলটা কী? সাহিত্যিকের মতো কথা বলছিস?

তোমাদের কথা আলাদা। তোমরা ওঁর চাকরি কর—তোমাদের মালিককে তোমরা হয়তো অনেক ভালো করে চেন। আমি বাইরের লোক—তবুও, আমার সঙ্গেও ওঁর ব্যবহার ছিল চিরদিনই চমৎকার। ইদানীং, লক্ষ করি, উনি যেন দেখেও দেখেন না; চিনেও চেনেন না আমাকে। সত্যি কথা বলতে কি, উনি থাকলে আমার এখানে আসতেও লজ্জা করে। বছরে কিছু টাকা যে আমি পাই না তোমাদের কোম্পানি থেকে তা নয়। উপরি সেটা। ঘুষও বলতে পার। কিন্তু এখানে এটাই রেওয়াজ। নইলে আমার মতো রেলবাবুর চলত না। এতো প্রথম থেকেই চলে আসছে। কিন্তু আজকাল ওঁর হাবভাবে মনে হয় যেন, আমি ওঁর দয়ার ভিখিরি! তোমরা হতে পার; আমি নই। আপনি কী বলেন? সায়নদা?

গজেনবাবু বললেন, আস্তে আস্তে, মাস্টার! কে শুনে ফেলবে! দেওয়ালেরও কান আছে।

শুনতে পেলে পাবে। আমি তো রেল কোম্পানির চাকর। তোমার বাবুর চাকর তো নই। আমাকে তোমার বাবু আর করবে টা কি? উপরি বন্ধ হলে, আমিও বাড়কাকানা থেকে রেক্ আটকে দেব। বরাবরের মতো হয়তো পারব না। গোমোতে বেশি খরচ করলে অথবা বাড়কাকানাতে—রেক্ তোমরা পাবেই। কিন্তু কিছুদিনের মতো তো টাইট্ করে দেব। তাছাড়া তোমার বাবুর একার ভরসায় তো আর আমি এখানে পড়ে নেই। এখানে আরো অনেক অনেক বড়াসে—বড়া ঠিকাদার আছে। পয়সাওয়ালা লোকও আছে। তোমার মালিক একাই লক্ষ্মী ঠাকুরের ঠিকা নিয়েছে নাকি? বলে, আমার দিকে চেয়ে, আপনি কী বলেন?

ব্যাপারটা আমি বুঝছিলাম না। আজকের হাওয়া যেন ভীষণ অন্যরকম।

নান্টু বলল খামোখা চটাচটি করার কোনো মানে নেই। ভাবলাম, কোথায় নতুন গান-টান শোনাবি, বাঁশবাবু এয়েছেন, না তুই বাবুর পিণ্ডি দিতে বসলি।

না রেঃ, এইসব ছোটো ছোটো কথা, ছোটো ছোটো উপেক্ষা, অপমান, মনে বড় লাগে। সেদিন তোদের বাবু আমাকে কী বলেছে জানিস? আমি আমার টাকার অঙ্কটা একটু বাড়াতে বলেছিলাম, বলেছিলাম, টাকার দাম তো বাঁশপাতার সমান হয়ে গেল; যদি-না একটু কনসিডার করেন….

বাবু কী বললেন জানিস?

কী? নান্টু শুধোল।

হেসে বললেন, আমার বউ থাকলে বলতাম রোজ সকালে টাকার বান্ডিল বিয়োতে। বউ তো নেই, কী করি।

শালা পাঞ্জাব থেকে রিফিউজি হয়ে এসে হঠাৎ এত টাকার মালিক হয়ে কাকে কী বলতে হয় তা ভুলে গেছে। বল্, এরকম ভাষায় কেউ কথা বলে?

নান্টু হেসে ফেলল।

বলল, তুইও শালা! ঘুষও নিবি, আবার সতীগিরিও করবি। ঘুষ দিলে লোকে সুযোগ পেলে একটু বলবে না?

গণেশ চটে উঠে বলল, ঘুষ যেন আমি এদেশে একাই নিচ্ছি! শালার মিনিস্টারেরা, এম-পি, এম-এল-এরা সব ধোওয়া তুলসীপাতা! দেশে ইলেকশান্ চলছে কীসের টাকায় রে? বেশি পেঁয়াজি করবি না। শালাদের বগলের তলা দিয়ে সব হাতি চলে যাচ্ছে, সেদিকে চোখ পড়ে না।

নিতাইবাবু হঠাৎ গেয়ে উঠলেন, “থা–ম্ তোরা থাম্! নিশি বয়ে যায় রে, তন্ন তন্ন করি অরণ্য আন্ বরা আন রে; এই বেলা; যা রে!”

এইসব কথার মধ্যে হঠাৎ বাল্মীকি-প্রতিভার কথা আমদানি করাতে আমি চমকে উঠলাম। কথাই বলব। কারণ, কবিতারই মতো। সুরের কোনো বালাই ছিল না।

আজকে এসে পর্যন্ত, সকাল থেকেই শুনছি যে, নিতাইবাবুর কচি শুয়োরের কাবাব খাওয়ার শখ হয়েছে। শিকার টিকার তো একদম বারণ। চারধারের পুরো এলাকাই হচ্ছে স্যাংচুয়ারীর এলাকা—তাই শিকারের প্রশ্নই ওঠে না। বস্তিতে লোক পাঠিয়েছেন সারা দিনে তিনবার। নিজেও গেছেন দু’বার। কিন্তু মনোমতো শুয়োরের ছানা মেলেনি।

নান্টুবাবু বললেন, আসল ব্যাপারের খোঁজ রাখেন বাঁশবাবু? চামারটোলীতে একজন মেয়ে আছে সে দেখতে একেবারে হেমা মালিনী। শুয়োর ছানার খোঁজে হলে ও শালা নিজে যেতে না। আসলে ও অন্য কোনোরকম ছানা খাওয়ার মতলবে আছে। বলেই নিতাইবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, কীরে নিতে?

শাট্-আপ্। বলে উঠলেন নিতাইবাবু।

বলেই, সেরেস্তাতে নিজের ছোট্ট ঘরে চলে গেলেন।

কেন জানি না, আজ এরা সকলেই খুব পেন্ট্-আপ্ হয়ে আছেন। প্রচণ্ড টেন্স। আমি জানি, নিতাইবাবু এখন কী করবেন ঘরে বসে। ওল্ড-মংক রাম্-এর বাদামি-রঙা পেটমোটা বোতল থেকে একটু রাম্ ঢালবেন। তাতে জল মেশাবেন। তারপর গেলাসটা নিয়ে চৌপাই-এর ওপরে গুটিয়ে রাখা তোশকে হেলান দিয়ে বসে দেওয়ালে ক্যারুকোম্পানির বিজ্ঞাপনের অর্ধনগ্না মেয়েটির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে একটু একটু করে রাম্-এ চুমুক দেবেন। যোগভ্যাস নানারকমের হয়। মনকে কেন্দ্রীভূত নানা প্রক্রিয়াতে করা যায়। নিতাইবাবু এই প্রক্রিয়াই বেছে নিয়েছেন।

ফুটফাট করে আগুন জ্বলছে। আগুন কত কী যে স্বগতোক্তি করে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে! এখন কৃষ্ণপক্ষ। লাল আগুনের কম্পিত আভায় ছায়াগুলো সব কাঁপাকাঁপি করছে, চারিদিকে। আমাদের গল্প চলে নানারকম, চারপাশে গোল হয়ে বসে। এ কথার থেকে সে কথা।

উল্টো-পাল্টা কথা হওয়াতে মাঝে মাঝে তুমুল ঝগড়াও হয়। পরে আবার মিটমাটও হয়ে যায়। অন্তত এতবছর তাই-ই হয়েছে। আজই আবহাওয়াটা একটু অন্যরকম দেখছি। খুবই অন্যরকম। আমিই এদের কাছ থেকে দূরে থাকি এবং একাও। কিন্তু একে অন্যের সঙ্গে এদের সম্পর্কটা অনেকটা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতো। সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর না হলে ক্ষণে ক্ষণে ঝগড়া করাও যায় না; আবার ভাব করাও যায় না। চিপাদোহরে এসে, এদের দেখে আমার প্রায়ই মনে পড়ে যায়, আমার মাসিমার মৃত্যুর পর আমার মেসোমশাই সকলকেই বলতেন : আমার ঝগড়া করার লোক চলে গেছে। মেসোমশাইয়ের বলার ধরন দেখেই বুঝতে পারতাম যে, তাঁদের সম্পর্কটা কতখানি গভীর ছিল। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হয়তো সাধারণত এমনই গভীর হয়। ব্যাচেলর আমি। অনুমান ছাড়া আর কিছু করার নেই আমার। গণেশ মাস্টার এতক্ষণ নান্টুবাবু আর গজেনবাবুর সঙ্গে মহুয়া খাচ্ছিল। একটু একটু মৌতাত এর মধ্যেই হয়েছে বলে মনে হল। সঙ্গে পাঁঠার কজে ভাজা। লালটু পাড়ে সমানে জোগান দিয়ে যাচ্ছে। গণেশ মাস্টারের যেন আজ কী হয়েছে! বারে বারেই একই কথাতে ফিরে আসছে। নেশা হয়ে গেলে অনেককেই এরকম করতে দেখেছি। কিন্তু গণেশকে এর আগে বহুবার নেশা করতে দেখেছি; কিন্তু কখনও ঠিক এরকম মুডে দেখিনি। গণেশ বলল দড়াম্ করে, যাদের পয়সা আছে, অনেক পয়সা; তারা বোধহয় মনে করে পয়সা দিয়েই জীবনে সব পাওয়া যায়। আপনি কী বলেন সায়নদা?

আজ ও আমাকে নিয়ে যে কেন পড়েছে বুঝলাম না।

হঠাৎ? এ কথা?

উত্তর না দিয়ে ও আবারও বলল, অশিক্ষিত লোক যখন অনেক পয়সার মালিক হয়ে পড়ে তখন ধরাকে সরা জ্ঞান করে তাই না?

তুমি হঠাৎ এত চটে উঠলে কেন? রোশনলালবাবু তো তোমার সঙ্গে বেশ ভালো ব্যবহারই করতেন! কিছু কী ঘটেছে? আমাদের সঙ্গেও তো কখনও খারাপ ব্যবহার করেননি। এমন নিমকহারামি করছ কেন হঠাৎ?

আপনি তো ওঁর দালাল।

দালাল কথাটা আজকাল খুব চালু হয়েছে। তুমি যদি বলে সুখ পাও তো বলো।

একজন খারাপ মানুষ আমার একার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলেই সকলের কাছে বা সকলের জন্যে সে ভালো হয়ে যেতে পারে না।

হলোটা কী?

যেটুকু আগে শুনলেন, সেটুকু কিছুই নয়। হয়েছে নিশ্চয়ই কিছু। তবে এখন থাক্। সময় হলে আপনি নিজেই জানতে পারবেন।

তারপর বলল, কিন্তু আপনি এ সম্বন্ধে কী বলেন?

বললাম, আমি কী বলব? তাছাড়া বলব কী সম্বন্ধে? আমার কিছু বলার নেই, তার চেয়ে বরং অন্য কথা হোক্

বুঝলম, আজ গণেশের প্রচণ্ড নেশা হয়ে গেছে। বোধহয়, খালি পেটে ছিল।

গজেনবাবু হাত দিয়ে গণেশকে থামিয়ে দিয়ে, হঠাৎ আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বললেন, আপনার তিতলির কী খবর?

‘আপনার’ কথাটার তাৎপর্য এড়িয়ে গিয়ে গজেনবাবুর দিকে ফিরে, একটু ভেবে বললাম, ভালোই। ও ছুটিতে আছে।

কীসের ছুটি? ম্যাটার্নিটি লিভ্ নাকি?

কথাটা শুনেই আমার সারা গা জ্বালা করে উঠল। হঠাৎ আমার মনে হল, কী কুক্ষণে এই চাকরিতে এত বছর এইসব জায়গাতে, এইরকম সব লোকেদের সঙ্গে পড়ে আছি? এরা এত নোংরা প্রকৃতির, এত ইতর, এতই ছোটো এদের জগৎ, এদের চেনাজানা ও পড়াশোনার গণ্ডি এত সীমিত যে এখানে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসে। অথচ এরাই আমার কাছের লোক–বন্ধুর মতো। বিপদে এরাই দৌড়ে আসে। এদের কাছেও দৌড়ে যাই আমি। কিন্তু লেখাপড়া না শিখলেই যে মানুষ খারাপ হয় একথা আমি কখনও বিশ্বাস করিনি। বরং উল্টোটাই করেছি। গজেনবাবু সম্বন্ধেও আমার ধারণা অন্যরকম ছিল। তিনিই এমন একটা কথা বললেন, বলতে পারলেন আমাকে, যতই নেশাগ্রস্ত হোন না কেন তবুও? আমার মনে পড়ে গেল হাজারিবাগের চাত্রার জঙ্গলের একজন মুনশি আমাকে উপদেশ দিয়েছিল : “মালিক, পিনেওয়ালা আদমি ওর কানে-ওয়ালা জানোয়ার সে হামেশাকে লিয়ে দূর মে রহিয়েগা।”

গজেনবাবু আবার বললেন, কী হল? চুপ করে রইলেন যে!

মুখ তুলেই বুঝতে পারলাম যে, আজ রাতে গজেনবাবু একা নন। নান্টুবাবু ও গণেশও যেন চোখে চোখে হাসাহাসি করছেন। আমাকে নিরুত্তর দেখে গণেশ আবার বলল, সায়নদা, আপনাকে একটা কথা বলব? আপনি যতখানি মহত্ত্ব বইতে পারেন ততটুকুই বইবেন, তার চেয়ে বেশি মহৎ হবার চেষ্টা করবেন না।

আমি তখনও চুপ করেই ছিলাম!

নান্টুবাবু বললেন, নানকুর সঙ্গে আপনার খুব বন্ধুত্ব না? নানকুকে কি আপনি মদত দিচ্ছেন?

আমি? মদত দিচ্ছি? কীসের মদত?

অবাক হয়ে বললাম আমি।

এবারে গজেনবাবু বললেন, আজ রোশনলালবাবুর বডিগার্ডরা হঠাৎ কুলিটাকে ধরে এমন পেটাল কেন? কিছু কি বুঝতে পারলেন?

আরও অবাক হয়ে বললাম, না তো!

নান্টু বললেন, এই নানকু এখানকার সব আদিবাসীদের এবং অন্যান্য জংলিদের নতুন সব মন্ত্র শেখাচ্ছে। ওদের খারাপ করে দিচ্ছে।

মন্ত্র যদি শেখায় তাহলে সুমন্ত্রই শেখাবে, কুমন্ত্র নয়। নানকু করলে, ওদের ভালোই করবে বলে আমার বিশ্বাস।

আপনার যে এই বিশ্বাস, তা আমরাও জানি। এবং জানি বলেই এত কথা!

আচ্ছা বাঁশবাবু, আপনি তিতলিকে খুব ভালোবাসেন? কীরকম ভালোবাসেন?

এ প্রসঙ্গ থাক্ না।

কেন থাকবে? বলে গজেনবাবু ফুঁসিয়ে উঠলেন।

থাকবে, কারণ অপ্রাসঙ্গিক, তাই। অশোভনও বটে।

না। আপনাকে বলতেই হবে, তিতলিকে কি আপনি পোষা কুকুর-বিড়ালের মতো ভালোবাসেন, না মানুষেরই মতো ভালোবাসেন?

তার মানে? আমি এবারে রেগে বললাম।

তিতলিকে আপনি এতই ভালোবাসেন তো’ বিয়ে করলেই পারেন। ওকে বিয়ে করে দেখাতে পারেন যে, আদিবাসীদের, জঙ্গলের এদের আপনি সত্যিই ভালোবাসেন। কিন্তু আমি এবং আমরা সকলেই জানি যে, আপনি তিতলিকে বিয়ে কখনওই করবে না! হয়তো ওর সঙ্গে শোবেন। হয়তো শুচ্ছেনও আপনি নিয়মিত। আপনি ওকে ভোগে লাগাবেন। যেমন চিরদিন তাদের ভোগে লাগানো হয়েছে। আপনার সঙ্গে আমাদের কোনোই তফাত নেই বাঁশবাবু। আমার, আপনার এবং আমাদের সকলেরই উদ্দেশ্য এবং লাভ-ক্ষতি একই। তিতলির মতো লাজোয়ন্তী সুন্দরী মেয়েকে দাসি এবং রাখন্তি বানিয়ে, নানকু ও তার দলবলকে মদত দিয়ে, নিজে যা নন তাই-ই হবার চেষ্টা করেছেন। একদিন আপনার অবস্থা ময়ূরপুচ্ছ-পরা কাকের মতো হবে। আপনি সাবধানে থাকবেন।

আমি সত্যিই বড় বিপদে পড়েছি মনে হল। এরা কী বলছেন, কেন বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না। এমনকী গণেশও।

এমন সময় নিতাইবাবু সেরেস্তার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আগুনের কাছে এলেন। তিনি নিজেকে বারবারই একটু আলাদা মনে করেন। আমাদের মধ্যে কৌলীন্যে তিনি সবচেয়ে উঁচু। ব্রাহ্মণের সেরা ব্রাহ্মণ। তাই দশজন সাধারণের সঙ্গে নেশা-ভাঙ তিনি করেন না কখনও। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পা’টা সামান্য একটু টলল। নিতাইবাবু চেয়ারে ধপ করে বসে পড়েই বললেন, তোদের একটা শ্রীধর পাঠকের গান শোনাই—বলেই, রাতের বেলা ভৈরবীর সুর ভেঁজে তার নিজস্ব সুরে ও স্কেলে গান আরম্ভ করতেই অন্য সকলে থাক্ থাক্ এখন গান শোনার মুড নেই বলে থামিয়ে দিলেন।

গণেশ মাস্টার বলল, অ্যাই যে, নিতাইদা, আমরা সায়নদাকে অনুরোধ করছি তিতলিকে বিয়ে করতে।

নিতাইবাবুর যেন নেশা কেটে গেল।

বললেন, তিতলি? কে তিতলি? কোন্ তিতলি?

নান্টুবাবু ও গজেনবাবু সমস্বরে বললেন, তিতলি গো তিতলি। বাঁশবাবুর মেইডসারভেন্ট।

নিতাইবাবু চেয়ারের হাতলে সবে ধরতে যাওয়া গানের মুখটা তলার বোলে বাজিয়ে বললেন, বলিস কী রে? বিয়ে? কাহারের মেয়েকে? বামুনের ছেলে হয়ে ছ্যাঃ ছ্যাঃ।

তারপর একটু থেমে, যেন বমি পেয়েছে এমন ওয়াক্ ওযাক্ শব্দ তুলে বললেন, ছ্যাঃ ছ্যঃ হ্যাঃ….

আমার সব যেন কেমন গোলমাল লাগতে লাগল।

আমি কি কোনো ষড়যন্ত্রের মধ্যে এসে পড়েছি? এরা সকলেই কি আমাকে নিয়ে এক দারুণ ঠাট্টার খেলায় মেতেছে আজ? পূর্ব-পরিকল্পিত ঠাট্টায়? এরা সকলেই তো আমার খুবই কাছের মানুষ ছিল। সুখের ও দুঃখের ভাগীদার, শীতে গ্রীষ্মে বর্ষায়? কিন্তু —

কোথায় যেন এ ক’দিনে কিছু ঘটে গেছে। কোনো দুর্ঘটনা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *