কোজাগর – ৪১

৪১ 

বর্ষা এসে গেছে। 

মহাসমারোহে। প্রথম প্রবেশেই সে তার দীর্ঘ অনুপস্থিতি পুষিয়ে দিয়েছে। সারারাত ধরে বৃষ্টি হয়েছে পরশু। কাল এবং আজও হয়েছে, তবে কম। গাছে গাছে নতুন পাতা গজিয়েছে। অসংখ্য। রাতারাতি। প্রকৃতি, ধুলোর মধ্যে, রুক্ষতার মধ্যে, জ্বালার মধ্যে, এত প্রাণ কী করে যে লুকিয়ে রাখেন, তা প্রকৃতিই জানেন। গ্রীষ্মশেষে বর্ষা আসার প্রথম দিনটাতে যদি কেউ জঙ্গলের বুকের কোরকে না থেকে থাকেন কখনও, তাহলে এই অনুভূতির সত্য ও যথার্থ তাঁকে লিখে বোঝানো যাবে না। এ ফুলশয্যার রাতের পরের সকাল যেন। ঝরা-ফুল, ঝরা-পাতা, খোয়াইয়ে প্রকৃতির কোলে বছরের প্রথম কর্ষণ, ঘর্ষণ এবং বর্ষণের জল বয়ে যাওয়ার চিহ্ন, এ সবই যেন তার কুমারী জীবন পিছনে ফেলে আসার মিষ্টি কষ্টর সাক্ষী হয়ে রয়েছে! রাতারাতি কত কীই-ই না বদলে গেছে! আমাদের ডেরার পেয়ারা গাছের প্রতি ডালে ডালে কচি-কলাপাতা সবুজ রঙা পাতার অঙ্কুর এসেছে। গাছে গাছে পাখিরা আনন্দে ওড়াউড়ি করছে। এখন রোদ পড়ে এসেছে। কচিকলাপাতা সবুজ রঙা পাতার অংকুর এসেছে গাছে গাছে সবে। কিশলয়ও নয়, কিশলয়ের আভাসমাত্র যেন। 

পরশু রাতে হুলুক্ পাহাড়ের নিচের গভীরে জঙ্গলাকীর্ণ অন্ধকার খাদে শম্বরের দল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঘাক্ ঘাক্ আওয়াজে, ডাকাডাকি করে তাদের বর্ষাবরণের আন্দাজ জানান দিয়েছে দিকে দিকে। তৃষিত, সোঁদামাটির গন্ধ, ওদের গায়ের গন্ধের সঙ্গে মিশে বৃষ্টির ছাঁটের সঙ্গে চারিদিকে ছিটিয়ে গেছে। জলের সঙ্গে, গন্ধও ভিজেছে বন বনান্তরে। গুড়ু গুড়ু গুড়ু বাজের শব্দ মাদল বাজিয়ে বর্ষার আগমন ঘোষণা করেছে আর ঘন ঘন বিদ্যুৎ পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। 

কোটরা হরিণ ডাকছে। ভয়-পাওয়া ডাক নয় এ। আনন্দের ডাক। একবার করে ডাকছে, আবার বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দৌড়ে যাচ্ছে। তাদের ব্বাক্ বাক্ আওয়াজ প্রথম জল-পাওয়া পাহাড়ের প্রতিধ্বনিত হয়ে প্রজাপতি আর পাখিদের জল-ভেজা মসৃণ ডানায় পিছলে গিয়ে সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে চারিয়ে যাচ্ছে আজ বিকেলে। দীর্ঘ তপস্যার পর কুমারী প্রকৃতি বর্ষাপুরুষের সহস্র অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জলসিক্ত আদরে গর্বিতা, গর্ভিণী হয়ে গেছে রাতারাতি, ভালুমারের মানুষদের স্বস্তির নিঃশ্বাস বইছে ঠান্ডা, স্নিগ্ধ হাওয়ায়। 

তিতলি একটা মস্ত হাই তুলল। শেষে বিকেলে বারান্দায় বসে চায়ের পেয়ালা হাতে আমি ওকে দেখছিলাম। তিতলিকে কাছে ডাকলাম। রঙ্গনের ডালে পুরুষ বুলবুলি তার সঙ্গিনীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিফিস্ করে কত কী বলছে। কথা, তার আর শেষ হচ্ছে না। 

বনবাংলোতে হেল্থ ডিপার্টমেন্টের ভ্যান এসেছে কাল সকালে। সঙ্গে ডাক্তার কমপাউন্ডারও এসেছেন। ভ্যাসেক্‌টমি ও টিউবোমি করবেন বলে। যারাই করাতে চায়, তাদেরই অপারেশন করবেন। টাকাও দেবেন। তবু কেউই করাতে চাইছে না। কুসংস্কার, অজ্ঞতা, আর যা কিছুই নতুন তাঁর প্রতি এক গভীর অনীহা আর অসূয়া এদের মজ্জার গভীরে প্রোথিত হয়ে রয়েছে। 

কাল প্রথমে বিকেলে বেড়াতে বেড়াতে আমি গিয়ে পড়েছিলাম বাংলার দিকে। সেখানে পৌঁছে এক কৌতুকাবহ অথচ শোকাবহ ঘটনার সম্মুখীন হলাম। দেখি টিহুল কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড তোড়ে ডাক্তারবাবুকে গালাগালি করছে। চারপাশে কিছু নিষ্কর্মা লোকও জমে গেছে। টিহুল দারুণই উত্তেজিত। সুন্দরী বউকে তাড়িয়ে দেবার পর গাড়ুর মেয়েটির সঙ্গে নতুন করে ঘর পাতে ও তখন নাকি মেয়েটি শর্ত করিয়ে নিয়েছিল যে, টিহুল অপারেশন করিয়ে নেবে, যাতে ওদের আর ছেলেমেয়ে না হয়। আগের পক্ষের দুটিই যথেষ্ট। বাধ্য ছেলের মতো, চিপাদোহরে মাস ছয়েক আগে তখন গিয়ে অপারেশন করিয়েও আসে ও। কিন্তু টিহুলের নতুন স্ত্রী নাকি মাস দুই হল অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। টিহুল ডাক্তারবাবুর মুণ্ডপাত করে বলছে, যো নেহি কাটায়া উওভি পস্তায়া, ঔর যো কাটোয়া লিয়া উওভি। ঈ ক্যা বাত। 

ডাক্তারবাবু, দেখলাম অনেকই বোঝাবার চেষ্টা করছেন। 

ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে। টিহুলের বর্তমান স্ত্রীর নাম সহেলী। বেশ ভালো দেখতে সে। মনে হয়, সব সুন্দরী মেয়েরা টিহুলের জন্যেই এ জন্মে নির্দিষ্ট ছিল। প্রথম ডানা-কাটা বউকে না হয় সম্বন্ধ করেই বিয়ে করেছিল, কিন্তু এ মেয়েটি তো স্বেচ্ছায়ই টিহুলকে বিয়ে করেছে। জানি না সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতীরা টিহুলের মতো বোকা-সোকা ভালোমানুষকেই বোধহয় পছন্দ করে স্বামী হিসেবে। সহেলী ভালো দড়ি বানায়। জঙ্গল থেকে ঘাস ও মোরব্বা কেটে এনে তা থেকেই বানায় দড়ি। বড় ছেলেটির বয়স বছর সাতেক। সেও মাকে সাহায্য করে। সেই দড়ি নিয়ে গিয়ে বেচে হাটে। লাটাখাম্বার সঙ্গে বেঁধে কুয়ো থেকে বাল্টি করে জল তোলার জন্যে, কেউ কেউ কেনে গরু মোষ বাঁধার জন্যে। অন্য প্রয়োজনেও কেনে। ভালোই রোজগার। টিহুলও একটা চাকরি পেয়েছে কাছের হুরদু ফরেস্ট বাংলোতে। রোজ ভোরে কাজে যায় পাঁচ মাইল হেঁটে জঙ্গলের পাকদণ্ডী দিয়ে, সঙ্গে খাবার নিয়ে। আবার ফিরে আসে বেলা পড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গেই। বেশি সন্তান মানেই যে দুঃখ তা টিহুল এবং তার নতুন বৌ বোঝে বলেই নিজের ঔরসজাত একটি সন্তান না থাকলেও টিহুল ওই বন্দোবস্তে বোধহয় রাজি হয়ে গেছিল। দুজনে মিলে যা রোজগার করে তাতে বেশ ভালো মতোই দিন কেটে যাচ্ছিল ওদের। হঠাৎ এই উটকো বিপত্তি।। 

টিহুলের চেঁচামেচি ও গালিগালাজে ভালুমারের লোকেরা উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। ডাক্তারবাবু রীতিমতো নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন। আমাকে ভিড়ের মধ্যে দেখে, ছোটলোকদের মধ্যে একমাত্র ভদ্রলোককে পেয়ে অকূলে যেন কূল পেলেন। ভদ্রলোকদের মতো গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ বোধহয় কমই হয়। এক কোণায় ডেকে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন, কী করি এখন বলুন তো মশায়! অপারেশন ঠিকই করেছিলাম, এখন ব্যাটাচ্ছেলের বউ যদি অন্য কারো সঙ্গে শুয়ে প্রেগন্যান্ট হয় তাহলে আমি কী করতে পারি? একথা লোকটাকে বলতেও পারছি না অথচ যা নয় তা বলে গালাগালি করছে আমাকে। অন্য লোকদের খেপাচ্ছে। ডালটনগঞ্জ থেকে সিভিল সার্জন-এর খপ্পরে পড়ার ভয় সত্ত্বেও ভালো করতে এলাম, এখন দেখুন তো কী ঝামেলা! এ গ্রামে নাকি নানারকম পোলিটিক্যাল ডিসটার্বেন্স হচ্ছে। তাই পাটনা থেকে নির্দেশ এসেছে ভালুমারকে প্রায়রিটি বেসিস-এ দেখার সমস্ত ব্যাপার। আর প্রায়রিটি! এখন দেখছি মার খেতে হবে। বউরা যদি অন্য মরদের সঙ্গে শুয়ে বেড়ায় তাহলে খামোখা কাটাকাটি করে লাভই বা কী বলুন? 

হঠাৎই ভিড়ের মধ্যে গোদা শেঠকে দেখতে পেলাম। অনেকদিন পর। চেহারা তার আরও তেল-চুকচুকে হয়েছে। চোখে মুখে কৌতুক। একবার টিহুলের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার ডাক্তারের দিকে। আর মাঝে মাঝে মুখে বলছে, তাজ্জব কী বাহ্। বড়া তাজ্জব কী বাহ্। 

টিহুলের দিকে তাকিয়ে খুব কষ্ট হল আমার। ও এমনই সরল, ভালোমানুষ প্রকৃতির লোক এবং প্রথম বউয়ের ব্যাপারে ও এমনই দুঃখিত ও মর্মাহত হয়ে আছে এখনও যে, ওকে আসল ঘটনাটা বলতে আমারও মন সরল না। তাছাড়া, ব্যাপারটা এতই ডেলিকেট্ যে বলব কী করে তাও ভেবে পেলাম না। ইগনোরন্স ইজ ব্লিস্‌’ কথাটা যে কত দামি তা আমার নতুন করে মনে হয়েছিল কাল। টিহুলকে আমি আড়ালে ডেকে বললাম, তোর বউ কোথায়? 

বাড়িতে। 

তাকে একটু আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবি? কালকে? 

এর মধ্যে বউ-এর কী করার আছে? ডাক্তার কি ছেলেখেলা পেয়েছে? 

চোখের কোণে দেখলাম, গোদা শেঠ নিঃশব্দে পরিহাসের হাসি হাসছে আমার আর টিহুলের দিকে চেয়ে। 

আমি গলা-খাঁকরে বললাম, ব্যাপারটা হচ্ছে টিহুল… 

কোনোই ব্যাপার নেই। এই সব বুজরুগি এখানে চলতে দেব না আমরা।

ডাক্তারবাবু আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। বিরক্ত মুখে বললেন, ঠিক আছে,  ঠিক আছে। আমরা কালই এখান থেকে চলে যাব! মহুয়াডারে। দরকার নেই আমাদের। 

টিহুল রেগে বলল, আমাদেরও দরকার নেই আপানদের। মানে মানে সরে পড়ুন। টিহুলের মতো শান্ত, নির্বিরোধী, অসহায় অত্যাচারিত মানুষ যে এমন ফুঁসে গর্জে কথা বলতে পারে এ আমার জানা ছিল না। টিহুলের রাগা দরকার ছিল। কিন্তু যদি বা ঘুম ভেঙে জাগলোও তো ভুল কারণে, ভুল কোপে, ভুল লোকের ওপর মারমুখী হল। 

ভিড়ের মধ্যে এবার বনবাংলোর নতুন চৌকিদারকেও চোখে পড়ল। লোকটা আগের চৌকিদারের মতোই শয়তান। এই বাংলোটার যেন বিশেষ গুণ আছে। কিন্তু শয়তানদের শয়তানি যাদের ওপর, তারাই শয়তানদের ভগবান বানিয়ে রেখেছে। এদের বাঁচাবে কে? 

আমি ফিরে এলাম। গোদা শেঠের ভয়ে নয়, চৌকিদারের ইতরামির জন্যেও নয়, অথবা ডাক্তারের অসহায়তায় তার সহায় হতে পারলাম না বলেও নয়; শুধু টিহুলেরই মুখ চেয়ে। একজন সর্বস্বান্ত মানুষ এক মারাত্মক মিথ্যাকে সত্যি বলে বিশ্বাস করে আঁকড়ে ধরে, বেঁচে থাকতে চাইছে। যেন-তেন প্রকারেণ তার মনের শান্তি, তার নীড় যাতে না ভাঙে তার চেষ্টা করছে। যা ঘটে গেছে, তার প্রতিকার আমার হাতে নেই। টিহুলের ক্ষতিপূরণ করার ক্ষমতাও আমার নেই। তা-ই। 

ডাক্তারবাবুকে হয়তো বোঝানো যাবে না যে, আমি গ্রামের বাসিন্দা হয়েও ওঁর চেয়েও বেশি অসহায়। শুধু এই ব্যাপারেই নয়, অনেকই ব্যাপার। 

মুঞ্জুরীর ব্যাপারটাও আমাকে একেবারে গোড়াসুদ্ধু উপরে ফেলার উপক্রম করলে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই এ ধারণা আমার বদ্ধমূল হচ্ছে যে, মেয়েদের আমি আদৌ বুঝি না। অবশ্য যখন কথাই আছে দেবাঃ ন জানন্তি, কুতো মনুষ্যাঃ তখন আমি আর বিশেষ কী! 

মুঞ্জরী তখন সেদিন ফিরে যায়নি মাহাতোর সঙ্গে। তবে, শুনছি, ফিরে যাবে। ওর পুরনো সংসারের হিসেব নিকেশ বিলি বন্দোবস্ত করে, তবে যাবে। সময় চেয়েছে এক মাসের মাহাতোর কাছে। মাহাতোর সঙ্গে যে এক রাত দিব্যি থেকে এল তার জন্যে মাহাতোকে কারো কাছেই জবাবদিহি করতে হয়নি। যব মিঞা বিবি রাজি, তবু কেয়া করে কাজি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *