৯
বিখ্যাত ক্রিমিন্যাল ব্যারিস্টার পি. কে বাসু দুর্লভ নিকেতনের গেটের কাছে গাড়িটা পার্ক করেই লক্ষ্য করেন অদূরে একটা পুলিশের গাড়ি। কী ব্যাপার? ব্যাপারটা বোঝা গেল বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্র। পুলিশ ইন্সপেক্টর সতীশ বর্মনের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি বললেন, সরি, ব্যারিস্টার সাহেব! আপনার কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। আপনার ক্লায়েন্ট মারা গেছেন।
—মারা গেছেন? কে? প্রফেসর রায়চৌধুরী! কেমন করে?
—এ কেস অব পয়েজনিং! বিষ প্রয়োগে হত্যা!
বাসু-সাহেব বারান্দায় উঠে আসেন। সেখানে অনেকেই উপস্থিত। মৃত্যুসংবাদ পেয়ে নয়। এঁদের সকলকেই গোকুলচন্দ্র আজ সকালে আসতে বলেছিলেন। অবিনাশ, আরাধনা রঞ্জন, গিরিনবাবু—ওপাশে ম্লানমুখী লছমী। শিবনাথ উপস্থিত নেই…. সে দুর্গামণিকে সমালাচ্ছে। মৃতদেহ এখনও অপসারিত হয়নি। বর্মন বললেন, এবার আমি একে একে সকলের প্রাথমিক জবানবন্দি নেব। আপনারা সকলে এখানেই অপেক্ষা করুন। আমি ঐ বেঠকখানায় গিয়ে বসছি। একজন একজন করে ডেকে পাঠাব।
একজন পুলিশ ব্যবস্থা করে দিল। বৈঠকখানায় কাগজপত্র সাজিয়ে বর্মন বলেন, আপনি এখন কী করবেন ব্যারিস্টার সাহেব? আপনার ক্লায়েন্টই তো মৃত। ফিরে যাবেন নিশ্চয়? আপনার সময়ের দাম আছে।
বাসু বললেন, তা আছে। তবে নাকি, মক্কেল মারা গেলেই আমার দায়িত্ব শেষ হয় না। তাঁর শেষ ইচ্ছা ঠিকমতো পূর্ণ হচ্ছে কি না সেটা দেখতে হবে আমাকে।
—শেষ ইচ্ছা! সেটা আবার কী?
—তাঁর সম্পত্তি যাতে তাঁর ন্যায্য ওয়ারিশই পায় এটুকুই।
—বটে! তা কে তাঁর ন্যায্য ওয়ারিশ?
—সেটাই তো খুঁজে দেখবার জন্য থেকে যাচ্ছি।
—ও! তা বেশ। খুঁজুন। তা আপনি কোথায় থাকবেন? আমি যেখানে এজাহার নেব সেখানে না বাইরের বারান্দায়?
বাসু বলেন, না এজাহারের ওখানে আমার থাকাটা ঠিক নয়। আমি বাইরেই থাকি।
বর্মন একটু ভেবে নিয়ে বলেন, না মশাই। আপনি নিতান্তই যখন চলে যেতে রাজি নন তখন আমার চোখের সামনেই থাকুন।
এখানে বসে বসে সাক্ষীদের তালিম দিয়ে ভেতরে পাঠাবেন, সে ব্যবস্থায় আমি নেই। আসুন, আপনি ভেতরেই আসুন।
বর্মনের সঙ্গে আদালতে বহুবার বাসু-সাহেবকে লড়তে হয়েছে। হেসে বলেন, বেশ তাই চলুন।
সর্বপ্রথম এজাহার দিতে এল শিবনাথ। মৃতদেহ সে-ই প্রথম আবিষ্কার করেছে। সে নাকি সকালবেলা বৃদ্ধকে ডাকতে এসে দেখে তিনি শক্ত হয়ে আছেন। ডাক্তার ডাকা হয়। ডাক্তার তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। অতঃপর আসে পুলিশ। উনি কখন কী ভাবে মারা গেছেন তা সে জানে না। রাত্রে তিনি দুধ-রুটি খেয়েছিলেন। রোজকার মতো দুর্গামণিই তা তৈরি করেছিল। শিবনাথই এনে দিয়েছিল। আর কিছু সে জানে না।
এরপর এজাহার দিতে এলেন অবিনাশ। প্রথম থেকে তিনি লছমীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করে গেলেন। রাজগিরে মেয়েটিকে দেখে তাঁর নাকি ভুল হয়েছিল। ভুল ভুলই। পরে অনুসন্ধান করে অবিনাশ নাকি জানতে পারেন, লছমী রামপ্রসাদেরই কন্যা তার মৃতা স্ত্রী ফুলেশ্বরীর গর্ভজাতা। খবর পেয়েই তিনি গোকুলকে মাত্র গতকাল সন্ধ্যায় সব কথা খুলে বলেন। বৃদ্ধের ঠিকমতো বিশ্বাস হয় না। তখন অবিনাশ নাকি বলেছিল, “আমি কাল সকালে অকাট্য প্রমাণ এনে দাখিল করব।’ লছমী নিশ্চয় আড়ি পেতে সব কথা শুনেছিল। অবিনাশের ধারণা— আজ সকালে সর্বসমক্ষে অপমানিত হবার আশঙ্কায় লছমী গোকুলের খাদ্যে অথবা পানীয়ে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল।
বর্মন প্রশ্ন করেন, আপনি কি সেই অকাট্য প্রমাণটি সঙ্গে করে এনেছেন? –এনেছি স্যর, কিন্তু সেটা আপনাকে জনান্তিকে দেখাতে চাই। ঐ ওঁর সামনে নয়। বর্মন বলেন, ঠিক আছে। আপনার বাকি এজাহার আমি পরে নেব।
অবিনাশের পর এজাহার দিতে এল লছমী।
—আপনার নাম?
—মিনতি রায়চৌধুরী।
—লছমী শর্মা কার নাম?
—আমারই নাম। আমার পালক-পিতা আমাকে ঐ নামে ডাকতেন।
—আপনি কি বিবাহিত?
—না।
—কাল সন্ধ্যাবেলা যখন অবিনাশবাবু আর গোকুলচন্দ্র গোপনে আলাপ করছিলেন, তখন কি আপনি তা আড়ি পেতে শুনছিলেন?
লছমী জবাব দেবার আগেই বাসু-সাহেব বলে ওঠেন, লছমী, তুমি ইচ্ছে করলে এ প্রশ্নের উত্তর না ও দিতে পার। বলতে পার ‘আমার উকিলের সঙ্গে পরামর্শ না করে
বাধা দিয়ে ওঠেন বর্মন জাস্ট এ মিনিট। আপনি মোড়লি করছেন কেন? লছমী কি আপনার মক্কেল?
—এখনও নয়। পরে হতে পারে!
—তাহলে আপনি ফোড়ন কাটছেন কোন অধিকারে?
—ভারতীয় নাগরিক’ এই অধিকারে। সংবিধানে লছমীকে যে অধিকার দিয়েছে সেটাই তাকে জানিয়ে দিচ্ছে শুধু। আমি লছমীকে জানিয়ে রাখতে চাই— আপনি তার সরলতার সুযোগ নিয়ে তাকে ফাঁদে ফেলতে চাইছেন।
—আমি! হোয়াট ডু য়ু মীন?
—নয়? আপনি কি লছমীকে জানিয়েছেন, সে যা এজাহার দিচ্ছে তা প্রয়োজনবোধে তার বিরুদ্ধেই প্রয়োগ হতে পারে? একথা তাকে জানিয়েছেন যে, এই মুহূর্তে তার একজন সলিসিটার দরকার? এবং উকিলের সঙ্গে পরামর্শ না করে কোনো এজাহার না দেবার সংবিধানগত অধিকার তার আছে?
বর্মন বলেন, আপনি মশাই এবার বরং বাইরে গিয়েই বসুন।
—ধন্যবাদ! —বাসু স্থান ত্যাগ করেন। বাইরের ইজিচেয়ারে এসে বসেছেন কি বসেননি লছমীও বেরিয়ে এল ঘর থেকে। বাসু বলেন, কী হল আবার?
লছমী বললে, এক কথায় শেষ হয়ে গেল। আমি ওঁকে বলেছি, উকিলের সঙ্গে কথা না বলে আমি কোনো জবাব দেব না।
রঞ্জন এগিয়ে এসে বলে, কী হল?
বাসু লছমীকে বলেন, তোমার কাছে একটা টাকা আছে লছমী?
—একটা টাকা? না তো। কেন?
রঞ্জন এক টাকার একখানা নোট বাড়িয়ে ধরে বলে, আমার কাছে আছে স্যার। বাসু বলেন, আমাকে নয়, লছমীকে দাও— তাকে এক টাকা ধার দিচ্ছ তুমি। দ্যাট্স ইট। লছমী এবার আমাকে ঐ টাকাটা দাও।
লছমীর হাত থেকে টাকাটা নিয়ে বাসু পকেটজাত করলেন। বলেন, এস লছমী এখন তুমি আমার মক্কেল। বর্মনের কাছে গিয়ে বাকি জবানবন্দিটা দেবে চলো। যে প্রশ্নের জবাব দিতে বারণ করব, তার জবাব দেবে না।
লছমীকে নিয়ে বাসু-সাহেব আবার বৈঠকখানায় ঢুকলেন, বললেন, আমার মক্কেল তার বাকি জবানবন্দি দিতে এসেছে।
বৰ্মন খাতাপত্র গুছিয়ে উঠছিল। বললে, বুঝেছি। ধন্যবাদ! এজাহার সে থানায় গিয়ে দেবে। বডি ওয়ারেন্ট আগে করিয়ে আনি।
মৃতদেহ অপসারিত করে বর্মন বৃদ্ধের শয়নকক্ষ এবং দুর্লভ স্মৃতিমন্দিরে তালা লাগাল। লছমীকে বললে, আপাতত আপনাকে গ্রেপ্তার করছি না। কিন্তু এ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র যেতে হলে আপনাকে থানা থেকে অনুমতি নিতে হবে।
অবিনাশ বলেন, কিন্তু এ বাড়িতে তাকে থাকতে দিচ্ছে কে? গোকুলচন্দ্রের মৃত্যুতে আমি—ওঁর নিকটতম আত্মীয়, তাকে এ বাড়িতে থাকতে দেব কেন?
বর্মন বললে, দেবেন, যেহেতু খাল কেটে এ কুমিরটিকে আপনিই এখানে এনেছিলেন। শুনুন মশাই, বাড়ির মালিক কে তার ফয়সালা হবে দেওয়ানি মামলায়। ফৌজদারি কেস-এ গৃহকর্তার মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে যে ব্যবস্থা ছিল তাই বহাল থাকবে। শুধু ঐ ঘর দুটি আমি আপাতত তালাবন্ধ করে গেলাম। আদালতের ডিক্রি নিয়ে যখন বাড়ির দখল নিতে আসবেন তখনই কুমিরটিকে উচ্ছেদ করতে পারবেন। তার আগে নয়। আপাতত আপনার স্বখাত সলিলে উনি বর্তমান থাকবেন। বুঝেছেন?
বর্মন জিপ নিয়ে চলে গেল। অবিনাশও লছমীকে শাসিয়ে বিদায় হলেন। বাসু বললেন এবার চলো, নির্জনে কোথাও গিয়ে বসি। ব্যাপারটা শুনি—
লছমী বললে, আমি একটু একা থাকতে চাই। ব্যাপারটা পরে আলোচনা করা যায় না?
—যায়। ঠিক আছে। আমি পরেই আসব।