৮
সেদিন সন্ধ্যা নাগাদ অবিনাশ এসে উপস্থিত। ঘটনাচক্রে তখন লছমী বাড়িতে একা। অন্ধ বৃদ্ধ অবশ্য আছেন দ্বিতলের ঘরে। ও ঘরে লছমীর প্রবেশ নিষেধ। লছমীকে দুটি আদেশ জারি করে রেখেছিল শিবনাথ— সে যেন বুড়োর ঘরে না ঢোকে; আর রাত দশটার পরে সে যেন বাগানে না নামে। ডেভিল আজ পনেরো দিনেও তাকে সহ্য করতে পারছে না। দূর থেকে ওকে দেখলেই গর্জন করতে থাকে। চেন ছিঁড়ে ফেলতে চায়। অবিনাশ যখন এলেন তখন অবশ্য ডেভিল চেন দিয়ে বাঁধা। লছমী দরজা খুলে দিয়ে বললে, আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল—
অবিনাশ ওকে হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিলেন। কথার জবাব দিলেন না। গট গট করে উঠে গেলেন দ্বিতলে। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বলেন, আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন?
—কে অবিনাশ? কিন্তু আজ সন্ধ্যায় তো নয়। কাল সকালে আসতে বলেছিলাম।
না হয় ক-ঘণ্টা আগেই এসেছি। এখন বলুন কেন ডেকেছেন?
বৃদ্ধ একটু ভেবে নিয়ে বলেন, দেখো অবিনাশ, তুমি বয়সে ছোট, সম্পর্কেও। তাই ক্ষমা আমি চাইব না, তুমি লজ্জা পাবে। আমি তোমাকে মিথ্যা সন্দেহ করেছিলাম বলে অনুতপ্ত, এই কথাটাই জানাতে ডেকে পাঠিয়েছি।
অবিনাশ উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। বলেন, যাক। একটা পাষাণভার নামল আমার বুক থেকে। তাহলে লছমী যে মিনতি এটা মেনে নিচ্ছেন আপনি? কিন্তু কেমন করে বুঝলেন সে কথা?
—তোমার কাছে একটা কথা গোপন করেছিলাম। রঞ্জন আর মিনতির মধ্যে অনেক দিন আগেই একটা অনুরাগ সঞ্চারিত হয়েছিল। আমরা তখন শাঁখারিপাড়ার বাসায় থাকতাম। রঞ্জনই আমার সন্দেহ দূর করেছে। বুঝতেই পারছ তুমি—কিশোর-কিশোরী কী জাতের ছেলেমানুষি করে থাকে। লছমী সে-সব কথা রঞ্জনের কাছে বলতে পেরেছে। রঞ্জন নিঃসন্দেহ —লছমী আর কেউ নয়, মিনতিই!
অবিনাশ আকাশ থেকে পড়লেন। তবে তিনি অভিজ্ঞ মানুষ; তৎক্ষণাৎ বুঝলেন রঞ্জনের পরিকল্পনা। ছেলেটি দুর্লভ সুযোগ পেয়ে ‘নেপোর’ ভূমিকায় দধিভক্ষণ-মানসে অবিনাশের আষাঢ়ে গল্পে রং চড়াচ্ছে। একটা ঢোক গিলে বললেন, রঞ্জন কি মিনতিকে বিয়ে করতে চায়?
—সে কথা বলাই বাহুল্য। ওদের বিবাহটা চুকে গেলে আমি নিশ্চিন্ত! তখন আর এ যক্ষের ধন আমাকে পাহারা দিতে হবে না।
বৃদ্ধ অন্ধ না হলে দেখতে পেতেন অবিনাশের চোখ দুটো জ্বলছে। ডেভিলের চোখের মতো। তবু কণ্ঠে মোলায়েম স্বর এনে অবিনাশ বলেন, যক্ষের ধন মানে? এ বসতবাড়ি ছাড়া আপনার তো আর বিশেষ কিছুই নেই?
—তুমি তা কেমন করে জানলে অবিনাশ! তুমি তো আর আমার কাগজপত্র হাতড়ে দেখনি?
অবিনাশ দাঁতে দাঁত চেপে বলেন, সোনা কিনে পুঁতে রেখেছেন?
হো-হো করে হেসে ওঠেন বৃদ্ধ। বলেন, না অত বোকা আমি নই। যাক ও কথা। কাল সকালে এসো। আমি সর্বসমক্ষে উইল করব। তোমাকে সাক্ষী রাখতে চাই।
অবিনাশ নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে বললেন, উইল করে কাকে কী দিচ্ছেন জানবার কৌতূহল আমার নেই। তবে উইল করার আগে আপনাকে একটা সংবাদ জানাতে চাই। কথাটা জরুরি। বস্তুত সেজন্যই অমি ছুটে এসেছি। শুনুন— আমি নিঃসংশয়ে জানতে পেরেছি, লছমী আপনার অপহৃতা নাতনি মিনতি নয়।
—তাই নাকি! তাহলে তো উইলের বয়ানটা বদলাতে হয়। সে-ক্ষেত্রে উইলে আমার ওয়ারিশকে নাতনি বলে উল্লেখ করাটা তো আইনত ঠিক হবে না।
অবিনাশ স্তম্ভিত হয়ে যান। বলেন, মানে? তা সত্ত্বেও আপনি এ প্রবঞ্চক মেয়েটিকে…
হ্যাঁ অবিনাশ। প্রবঞ্চনা তো সে করেনি। বেচারি ছিল অপরের হাতের পুতুল। আর তাছাড়া তুমি যে-কথাটা আমাকে বলতে এসেছ সেটাও আমার জানা আছে।
—কী কথা জানাতে এসেছি আমি? আপনি কী জানেন?
—জানি যে, লছমীর মায়ের নাম ফুলেশ্বরী। তার জন্ম পাটনার রেল হাসপাতালে। দোসরা ফেব্রুয়ারি—1948। আর ও হ্যাঁ, জন্ম সময়ে তার ওজন ছিল সাত পাউন্ড।
অবিনাশ ইতিপূর্বে স্তম্ভিত হয়েছেন। এবার বজ্রাহত হয়ে গেলেন।
—কী হল? কথা বলছ না কেন অবিনাশ? ঐ কথাই তো জানাতে এসেছ? আমতা-আমতা করে অবিনাশ বলেন, আপনি কেমন করে জানলেন?
—ভগবান যাকে অন্ধ করেন, তাকে একটা ‘সিক্সথ সেন্স’ দিয়ে থাকেন। শোনোনি? বৃদ্ধ উৎসাহে উঠে বসেছেন। অবিনাশ মরিয়া হয়ে ওঁর বালিশের তলায় হাতটা চালিয়ে দেন। যা আশা করেছিলেন। চাবির থোকা! এর মধ্যেই আছে দুর্লভ নিকেতনের সেই লোহার আলমারির চাবি! হঠাৎ খেয়াল হয়েছে ওঁর—কী মূর্খ উনি! সব হাতড়ে দেখেছেন —দেখেননি, ঐ আলমারিটা, যাতে মাসে মাসে কীটনাশক স্প্রে করা হয়!
—কী হল? চুপ করে গেলে যে?
অবিনাশ উঠে দাঁড়িয়েছেন। বলেন, তার মানে সব জেনে বুঝেও— শুধুমাত্র আমাকে বঞ্চিত করার জন্যই আপনি ঐ লছমীটাকে আপনার সবকিছু দিয়ে যাবেন?
—আবার ‘লছমী’ কেন অবিনাশ? মিনতিকে! অন্ধ বুড়ো মানুষ শেষ জীবনে একটা ভুলকে আঁকড়ে ধরে সান্ত্বনা খুঁজছে কেন তাতে বাধা দিচ্ছ তুমি?
অবিনাশ ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেলেন। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। তা হোক অবিনাশের হাতে টর্চ ছিল। দ্রুতপায়ে উনি বাগানটা পার হয়ে চাবি হাতে এগিয়ে গেলেন ঐ দুর্লভ নিকেতনের দিকে। ডেভিল চেন-বাঁধা পড়ে আছে তার কেনেলে। একবার মুখ তুলে দেখল। অবিনাশকে দেখে ল্যাজটা নাড়ল। সিংহশাবকের মতো প্রকাণ্ড জন্তুটা তারপর নিশ্চিন্তে দুটি থাবায় মাথা রেখে চোখ বুজল।
লছমী ছিল তার একতলার ঘরে। অবিনাশকে বাগান পার হয়ে দুর্লভ নিকেতনের দিকে যেতে দেখল। পরমুহূর্তেই তার কানে গেল বৃদ্ধের চিৎকার—শিবু! শিবনাথ! গিরিন! দুর্গা!
ওঁর কণ্ঠস্বর চমকে উঠল লছমী। এমন পাগলের মতো ডাকছেন কেন উনি? দ্রুতপদে সে উঠে এল দ্বিতলে। দ্বারের বাইরে থেকে বললে কী হয়েছে? শিবুদা নেই। বাড়িতে কেউ নেই!
—লছমী! তুমি …. তুমি খুঁজে দেখ তো। বালিশের নীচে আমার চাবির থোকাটা ছিল।
লছমী বিছানা হাতড়ে বললে, নেই তো! এখানে ছিল?
—অবিনাশ কোথায়? চলে গেছে?
—না উনি বাগানে নেমে গেলেন। ঐ স্মৃতিমন্দিরের দিকে!
দাঁতে দাঁত চেপে বৃদ্ধ গর্জন করে ওঠে, শয়তান! এত বড় শয়তান!
—কেন কী হয়েছে দাদু?
—ঐখানেই যে লুকোনো আছে আমার বুকের পাঁজর কখানা—বৃদ্ধ ঘর ছেড়ে হাতড়াতে হাতড়াতে বেরিয়ে আসেন বারান্দায়।
বলেন, নেই? কেউ নেই? গিরিন, দুর্গা, শিবু?
লছমী এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। বৃদ্ধ বারান্দার রেলিং ধরে ধরে এগিয়ে আসেন। চিৎকার করে ডাকলেন ডেভিল লিস্! লিস্!
বাঘের মতো লাফিয়ে উঠল ডেভিল। এ ডাক বহুদিন শোনেনি সে! গর্জন করে উঠল প্রভুভক্ত গ্রেট-ডেন। অবিনাশ একবার চোখ তুলে দেখল। না! ডেভিলের গলায় শক্ত করে চেন বাঁধা। দ্রুতহাতে সে আলমারি খুলে ফেলে। তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকে কাগজপত্রের ভেতরে।
বৃদ্ধ বলেন, লছমী তুই আমাকে হাত ধরে ঐ কেনেলটা পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারিস না?
লছমী জবাব দিল না। মাথার মধ্যে ঘুরে উঠল তার। অবিনাশের প্রতি পুঞ্জীভূত ঘৃণায় সে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারাল। কোনো জবাব না দিয়ে সে একছুটে নেমে গেল বাগানে। রান্নাঘরের পাশে পড়েছিল একটা কয়লাভাঙার হাতুড়ি। বজ্রমুষ্টিতে বাগিয়ে ধরল সেটা। তারপর উন্মাদিনীর মতো সে ছুটে চলল দুর্লভ নিকেতনের দিকে।
দেখতে পেল অবিনাশ। তৎক্ষণাৎ বার হয়ে এল সে ঘর থেকে। পৈশাচিক হাসল। বললে, আয়! এইটাই চাইছিলাম! আগে তোকে শেষ না করলে আমার তৃপ্তি হবে না!
লছমী বাগানের আধা-আধি পাড়ি দেবার আগেই অবিনাশ ঢুকে গেল কেনেলে। ডেভিল তখন উন্মাদ হয়ে গেছে। প্রভুর ডাক সে শুনেছে। চেন ছিঁড়বার জন্য সে প্রচণ্ড দাপাদাপি জুড়ে দিয়েছে। অবিনাশ এ সুযোগ ছাড়ল না। ছুটে এসে খুলে দিল চেনটা লছমীর দিকে তর্জনী নির্দেশ করে আদেশ দিল, ডেভিল! লিস্! লিস্!
বাঘের মতো গর্জন করে নক্ষত্রবেগে ছুটে আসছে দানবটা! লছমী ভয়ে আৰ্তনাদ করে উঠল। ছুটে পালানো অসম্ভব। দুহাতে মুখ ঢেকে সে বসে পড়ল মাটিতে। পরক্ষণেই একটা প্রচণ্ড আঘাতে সে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। ডেভিল ওকে পেড়ে ফেলেছে!
পৈশাচিক উল্লাসে অবিনাশ দৃশ্যটা উপভোগ করছে।
দ্বিতলের বারান্দা থেকে ভেসে আসছে একটা আর্তনাদ—কী হল লছমী! ডেভিল!
অন্ধ চক্ষুষ্মান হলে দেখতে পেতেন একটা অদ্ভুত দৃশ্য। ধুলো কাদায় লছমী আর ডেভিল লুটোপুটি খাচ্ছে। দুজনে জড়াজড়ি করে পড়ে আছে মাটিতে। ডেভিল তার বাঘের মতো মাথাটা ওর বুকে তলপেটে, পায়ের ওপর রগড়াচ্ছে। আজ পনেরো দিনের নিরুদ্ধ বাসনাটা সে চরিতার্থ করছে। ওরা এতদিন চেন বেঁধে তাকে সরিয়ে রেখেছিল! তার তীব্র প্রতিবাদে কেউ কান দেয়নি। না, এমনকি মিন্টিও নয়! আজ তাই সে চুটিয়ে শোধ নিচ্ছে!
মানুষ ভুলতে পারে—গ্রেট ডেন আর ম্যাস্টিফের রক্ত বইছে যার ধমনিতে সে যে কিছুতেই ভুলতে পারে না। আজ থেকে এক দশক কাল যে এ গন্ধ লেগে আছে ওর নাকে। ও কি ভুলতে পারে ফ্রকপরা সেই ছোট্ট মিন্টিকে?
পাঁচ মিনিট পরে লছমী উঠে দাঁড়াল। ধুলো কাদা গা থেকে ঝাড়বার চেষ্টা করল না। ডেভিলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললে, নো, ডেভিল নো! স্টে! লক্ষ্মী! আর নয়! হল তো আদর! আর কত?
শান্ত হল সিংহশাবক। সিংহবাহিনীর মতোই এবার মিনতি ফিরে দাঁড়ালো মহিষাসুরের মুখোমুখি! গেটের দিকে তর্জনীটা নির্দেশ করে বলল— বেরিয়ে যান! না হলে ডেভিলকে লেলিয়ে দেব কিন্তু! দাঁড়ান! ঐ চাবির থোকাটা রেখে যান। হ্যাঁ! এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝেছেন এ বাড়িতে থেকে আপনাকে তাড়িয়ে দেবার অধিকার আমার আছে!