কুলের কাঁটা – ২

অবিনাশের অবচেতনে প্রবেশ করতে হলে প্রথমেই জানতে হবে তাঁর ভগ্নিপতি অধ্যাপক গোকুলচন্দ্রের কথা। শুধু তাঁর নয়, তাঁর পিতৃপুরুষদের কথাও কিছুটা।

গোকুলচন্দ্র রায়চৌধুরী মৈমনসিং এর এক বিখ্যাত জমিদার বাড়ির সন্তান। বর্তমানে তাঁর বয়স ছিয়াত্তর। বেশ বড় জমিদারি ছিল, লাখ-দশেক টাকার আদায়। বিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়েছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষেরা। তবু গোকুলচন্দ্র যখন জন্মগ্রহণ করেন তখনও বাড়িতে তিন তিনটে হাতি ছিল। বংশের আদিপুরুষ দুর্লভচন্দ্র রায়— তিনিই প্রথম রায়-চৌধুরী খেতাব পান— ছিলেন প্রগাঢ় পণ্ডিত। চার-পাঁচটি ভাষা জানতেন তিনি। কিন্তু তারপর আর কেউ ও বংশে সরস্বতীর বন্দনা করেনি। চতুর্থ পুরুষ গোকুলচন্দ্র হলেন দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। কৃতিত্বের সঙ্গে পর পর দুবার এম. এ পাশ করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দর্শনে ও ইতিহাসে। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের স্নেহধন্য হয়ে তরুণ গোকুলচন্দ্র এলেন কলকাতায়। পিতা নিবারণচন্দ্রের আপত্তি ছিল—ওঁদের জমিদার বংশে চারপুরুষে কেউ চাকরি করেনি, শুধু খরচ করেছে। গোকুল গ্রাহ্য করেননি। এ নিয়েই পিতাপুত্রের হল মতান্তর। মতান্তর থেকে মনান্তর। শেষে গোকুলচন্দ্র এমন একটি কাজ করে বসলেন যে, পিতৃদেব তাঁর মুখদর্শন করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করলেন। ব্যাপারটা গুরুতর। পিতার অজ্ঞাতে গোকুলচন্দ্র একটি শিক্ষিতা ব্রাহ্ম মহিলার পাণিগ্রহণ করেছিলেন। এ থেকেই পিতাপুত্রে ছাড়াছড়ি। গোকুলের একটি মাত্র পুত্রসন্তান হয়েছিল। সে পুত্রের বিবাহেও নিবারণচন্দ্র উপস্থিত হননি। তারপর বাংলা বিভাগ হয়েছে। উদ্বাস্তু হিসাবে নিবারণ চলে এলেন কলকাতায়। গোকুল তখন শাঁখারিপাড়ায় বাসা ভাড়া করে আছেন। ছুটে গেলেন। নিবারণ তবু দেখা করেননি।

কেটে গেল আরও দশ-বারো বছর। তারপর একদিন অশীতিপর নিবারণচন্দ্র এসে দাঁড়ালেন পুত্রের বাড়িতে। নতমস্তকে। গোকুলচন্দ্রের চরমতম দুর্দিনে। ইতিমধ্যে গোকুলের স্ত্রী গত হয়েছেন। সবালক পুত্র স্ত্রী-কন্যাসহ কাশীতে চলে গেছে চাকরি নিয়ে। গোকুল তখন একাই থাকতেন তাঁর দীর্ঘদিনের পুরাতন ভৃত্য শিবনাথের তত্ত্বাবধানে। হঠাৎ এল মর্মান্তিক দুঃসংবাদ। কাশীতে ওঁর পুত্রের গৃহে ডাকাতি হয়েছে। ওঁর পুত্রকে ডাকাতেরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, সর্বস্ব লুঠে নিয়ে গেছে—এমনকি তাঁর তেরো বছরের নাতনি মিনতিকেও তারা অপহরণ করে নিয়ে গেছে। সংবাদ শুনে পাড়ার একটি ছেলেকে নিয়ে তখনই ছুটে গিয়েছিলেন কাশীতে—কিন্তু পুত্রবধূর সাক্ষাৎ পাননি। তিনি উপস্থিত হবার পূর্বেই সে হতভাগিনী আত্মহত্যা করেছিল।

গোকুলচন্দ্র ফিরে এলেন কলকাতায় –একেবারে পাষাণ হয়ে।

সেই দুর্দিনেই তাঁর দ্বারে এসে দাঁড়িয়েছিলেন চুরাশি বছরের বৃদ্ধ নিবারণচন্দ্র। তাঁর মৃত্যুর পূর্ববৎসর। বৃদ্ধ পাঁজর সর্বস্ব বুকে গোকুলকে জড়িয়ে ধরে শুধু বলেছিলেন, বিশ্বাস কর বড়খোকা। এতবড় অভিসম্পাত কিন্তু আমি তোকে কোনোদিন দিইনি।

দিন কারও জন্য বসে থাকে না। পাষাণ হয়ে যাওয়া গোকুল আবার একদিন উঠে বসলেন। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর সম্পত্তির অধিকারীও হলেন। সেটা 1961 সাল। গোকুলের বয়সও তখন একষট্টি। অবসর নিয়েছেন কর্মজীবন থেকে। অধ্যাপনা ত্যাগ করলেও ঐতিহাসিক গবেষণার মধ্যেই তিনি ডুবে থাকতেন। পিতা দেশবিভাগের পুর্বেই কিছু সম্পত্তি এদেশে এনেছিলেন। আর এনেছিলেন এক তোরঙ্গ বোঝাই কাগজপত্র ওদের মহাফেজখানায় সযত্নে রাখা ছিল সেইসব প্রাচীন দলিল। নিবারণচন্দ্র তাঁর পণ্ডিত পুত্রের হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেইসব কীটদষ্ট পুরাতন নথিপত্র। গোকুল নাকি তার ভিতরে আবিষ্কার করেছেন কিছু অতি মূল্যবান ঐতিহাসিক তথ্য। কেউ বলে তিনি ওদের পারিবারিক ইতিহাস লিখেছেন, কেউ বলে—না, উনি লিখেছেন ওঁর প্রপিতামহের জীবনী, আবার কেউ বলে উনি নাকি সিপাহী বিদ্রোহের উপর একটি প্রামাণিক গবেষণা করছেন। এমন অনুমান করার কারণ হচ্ছে এই যে, বংশের আদিপুরুষ নিবারণচন্দ্রের পিতামহ দুর্লভচন্দ্র রায়—হ্যাঁ, তখনও ওঁরা রায়চৌধুরী খেতাব পাননি –সিপাহী বিদ্রোহে প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছিলেন। মঙ্গল পাণ্ডের যখন ব্যারাকপুরে ফাঁসি হয়, তখন দুর্লভচন্দ্রও ছিলেন ঐ ব্যারাকপুর ছাউনিতে। সেই দুর্লভচন্দ্রের একটি দুর্লভ দিনপঞ্জিকা নাকি পাওয়া গেছে জমিদারী মহাফেজখানা থেকে। গোকুলচন্দ্রের মতে প্রপিতামহের ঐ দিনপঞ্জিকাটির দাম লাখ টাকা!

সরশুনা ছাড়িয়ে ডায়মন্ডহারবার যাওয়ার পথে বড় রাস্তার উপর একটি প্রকাণ্ড বাগানওয়ালা বাড়ি বানিয়েছিলেন নিবারণচন্দ্র। সেখানেই এসে উঠলেন গোকুল। একেবারে একা। না একা নন—তাঁর পুরাতন ভৃত্য শিবনাথ এবং তার স্ত্রী দুর্গামণিও এল সঙ্গে। আর এল তাঁর ডগ শো জেতা কুকুর ‘ডেভিল’। গোকুলচন্দ্রের যদি বংশগৌরব থাকে তবে ডেভিলেরও তা আছে। ডেভিলের বাবা ছিল হ্যারিস কোম্পানির বড় সাহেবের একটি খানদানি ‘গ্রেট ডেন’ এবং গর্ভধারিণী লাহাদের বাড়ির প্রাইজ পাওয়া ‘জার্মান ম্যাস্টিফ্’। তখন তার বয়স মাত্র তিন বছর, তবু প্রায় একটা প্রকাণ্ড বাছুরের মতো হয়ে উঠেছে ডেভিল!

অতবড় হাতাওয়ালা বাড়িতে তিনটি মানুষ ও একটি কুকুর নিশ্চয়ই নিঃসঙ্গতা অনুভব করত—করল না, কারণ আত্মীয়-স্বজনেরা গুটি গুটি এসে জুটলেন। প্রথমেই এলেন, গোকুলের শ্যালক অবিনাশচন্দ্র সস্ত্রীক এবং স্ত্রীর ভাইকে নিয়ে। এলেন গিরিনবাবু—তিনি নাকি সম্পর্কে গোকুলের বোন-পো। আও দু-চারজন এলেন— রক্তের সম্পর্কের টানে; যদিচ ‘রায়চৌধুরী’ পরিবারের পারিবারিক ইতিহাস যিনি রচনা করেছেন তিনি বুঝে উঠতে পারেননি সম্পর্কটা ঠিক কী জাতের। পুরাতন ভৃত্য শিবনাথ বলত, বুড়োকর্তা আপনি অ্যাত বড় পণ্ডিত হয়েও এমন সোজা কথাটা বুঝলেন না আজ্ঞে? সম্পর্কটা ট্যাকার! অনেক ট্যাকা যে আপনে হুস করি পায়ে গেলেন। ওয়ারিশ নাই। তাই ওঁয়ারা একে একে এসে জুটেছেন।

সংসার অনভিজ্ঞ পণ্ডিত মানুষটি কথাটা প্রথমে মেনে নেননি। ক্রমে বুঝলেন। তাঁর ঢাক ঢাক গুড় গুড় নেই। একদিন সবাইকে ডেকে বললেন, শোনো বাপু। তোমরা এখানে থাকতে চাও তো থাকো। আমি যা খাই তোমরাও তা খাবে। তবে আমার মৃত্যুর পর তোমরা কেউ কিছু পাবে না। আমার হারানো নাতনী যদি কোনোদিন ফিরে আসে তবে সেই আমার যাবতীয় সম্পত্তি পাবে! বুঝলে?

সাফ কথা। ভিড় ক্রমে পাতলা হয়ে গেল। ‘দুর্লভ নিকেতনে’ তাই বৃদ্ধ এখন ঐ ভৃত্যসম্বল হয়ে প্রায় একাই থাকেন। আত্মীয়-স্বজনেরা বললে, ছেলে যে-ভাবে মরেছে, বাপও একদিন ঐ ভাবে খতম হবে। ডাকাতের হাতে।

তা কিন্তু হয়নি। দুটি কারণে। এক নম্বর সকলেই জানত মিতব্যয়ী গোকুলের না আছে সোনাদানা না আছে নগদ টাকা। দ্বিতীয়ত, সন্ধ্যার পর থেকেই চেন ছাড়া ডেভিল বাড়ির দায়িত্ব নিত। লোহার গেটে ঝোলানো আছে প্রকাণ্ড সাবধানবাণী। প্রয়োজন ছিল না। দুর্লভ-নিকেতনকে কেন্দ্রবিন্দু করে আধ মাইলের ব্যসার্ধ নিয়ে একটি ভৌগোলিক বৃত্ত যদি টানা যায়, তাহলে সেই বৃত্তবাসীরা নিঃসন্দেহে শুনেছে ডেভিলের নৈশ গর্জন। ও-পাড়ায় ডেভিলের নাম ‘হাউন্ড অফ দ্য বাস্কারভিল!

তারপর আরও একযুগ কেটে গেছে। মাত্র গত বৎসর গোকুল তাঁর শ্যালক অবিনাশকে জরুরি পত্র লিখে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আজ বড় বিপদে পড়ে তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি অবিনাশ। কিছু দিন চোখে ব্যথা হচ্ছিল। ডাক্তার দেখিয়েছি। ওঁরা বলছেন, আমার চোখের শিরা-উপশিরা নাক সব শুকিয়ে যাচ্ছে। মাস তিনেকের ভিতরেই আমি নাকি সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যাব।

অবিনাশ বলেছিলেন সে কী। তা হতেই পারে না। আপনার তো পয়সার অভাব নেই চৌধুরী মশাই। আপনি বিলেত চলে যান—রাশিয়ায়, আমেরিকায় কিম্বা ভিয়েনায়

গোকুল তাতে রাজি হননি, বলেছিলেন –কদিনই বা বাঁচব? দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেও লাভ নেই। আমার শরীর ভেঙে পড়েছে বুঝতে পারছি। আর বড়জোর এক বছর। তোমাকে যেজন্য ডেকেছি তাই বরং বলি। আমার মন বলছে –একদিন না একদিন মিনতি ফিরে আসবে। এখন বলো, অন্ধ হয়ে যাবার আগে আমার সম্পত্তি আমি কীভাবে তার জন্য রেখে যাবার ব্যবস্থা করব? কাকে আমার অছি করে যাব?

অবিনাশ বহু ইতস্তত করেও বুকের কথাটা মুখে আনতে পারলেন না। বললেন, আপনি কি চান, এ অবস্থায় আমার দুজন আপনার এখানে এসে থাকি?

—নিশ্চয়ই চাই। বরাবরই তাই চেয়েছি।

এরপর ভাঁটার পর জোয়ারের মত আবার গুটি গুটি এসে জুটলেন, সবাই! অবিনাশ, আরাধনা, গিরিনবাবু এবং আরো সব আত্মীয়স্বজন। আহা। উনি অন্ধ হয়ে যেতে বসেছেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *