কুলের কাঁটা – ৬

রঞ্জন স্থির থাকতে পারেনি। পরদিনই আবার এসে উপস্থিত হল দুর্লভ নিকেতনে। শিবনাথ ওকে বৈঠকখানায় বসিয়ে বললে, বুড়ো কর্তাকে—

—না। মিনতিকে বরং বলো, তার রঞ্জুদা এসেছে।

মিনিট পাঁচেক পরে লছমী এসে দাঁড়াল দরজার কাছে।

—এসো মিনতি। বসো। তোমাকে আমি ‘তুমিই’ বলতাম।

মেয়েটি চোখ তুলে একবার তাকায়। বলে না মনে কিছু করিনি। বলুন-

—কিন্তু তুমি দাঁড়িয়ে থাকলে কেমন করে গল্প করব? বোসো।

লছমী মেঝের উপরেই বসে পড়ে। রঞ্জন বলে, ও কী। মাটিতে কেন? সোফায় বোসো।

লছমী নতনেত্রে বলে, সে অধিকার আমি পাইনি। আমি আশ্রিত মাত্র। দ্বিতীয় কথা, এ বাড়িতে আমার পরিচয় আমি ‘লছমী’। আমাকে সেই নামেই ডাকবেন।

রঞ্জনের বুকের মধ্যে মুচড়ে উঠল। ঐ মেয়েটিকে—না, ঐ রকম দেখতে একটি মেয়েকে সে জীবনে প্রথম ভালবেসেছিল। গোকুলচন্দ্রের ভাষায় ‘কাফ্ ল্যভ’! তা হোক্ কিন্তু আজও তো সে ঐ মুখখানা ভুলতে পারেনি। রঞ্জন বলে, আর সকলে তোমাকে ‘লছমী’ বলে ডাকলেও তুমি অন্তত আমার কাছে—মিনতি। মিন্টি। সিংহবাহিনী।

মেয়েটি আবার চোখ তুলে তাকায়। বলে, সিংহবাহিনী! তার মানে? আপনার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?

—তুমি ভুলে গেছ, তাই তোমাকে মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে। তেরো বছরের সেই মিনতির সঙ্গে এককালে আমার গভীর ও নিকট সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

—কিন্তু আমার তো সে কথা মনে পড়ে না?

—কিন্তু আমিও যে সে কথা ভুলতে পারছি না?

লছমী হঠাৎ হেসে উঠল। বলল, একটা কথা বলব বাবুজি?

—বাবুজি!…. আচ্ছা, বেশ বলো।

—অবিনাশবাবু যে প্রয়োজনে আমাকে এখানে এনে ফেলেছেন, আপনিও কি সেই প্রয়োজনে আপনার সিংহবাহিনীর সঙ্গে পাতানো সম্পর্কটা লছমীর সঙ্গে ঝালিয়ে নিতে চাইছেন?

রঞ্জন গম্ভীর হয়ে বললে, বুঝলাম না!

—না বোঝার কী আছে? বুড়োর অনেক টাকা, কিন্তু আপনি ভুল করছেন বাবুজি! বুড়োবাবু লছমীকে তাঁর যক্ষের ধন দিয়ে যাবেন না। তিনি সোনামণির পথ চেয়ে বসে আছেন!

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে দাঁড়ায় রঞ্জন। বলে, একটা কথা তাহলে তোমাকে বলে যাই লছমী। তুমি যেই হও, আমার গোপন কথাটা যখন শুনে ফেলেছ তখন সবটাই শুনে যাও মিনতিকে যখন আমি ভালবেসেছিলাম সে তখন বড়লোকের নাতনি ছিল না। আর তুমি যদি সেই মিনতি না হও তাহলে আর কোনোদিন আমার সামনে এসে দাঁড়িও না! বুঝলে?

—আর আমি যদি সেই মিনতিই হই?

রঞ্জন জবাব দিতে পারে না। একদৃষ্টে সে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। কে ও? লছমী না মিনতি? লছমী বলে, বলুন বাবুজি। আমি যদি সেই মিনতিই হই, অথচ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হই, তখন কি আপনার সামনে এসে দাঁড়াব?

রঞ্জন ওর হাতখানা তুলে নেয়। বলে সত্য করে বলো— তুমি কে?

লছমী খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। বলে, এটা তো আমার প্রশ্নের জবাব নয় বাবুজি!

শিবনাথ এসে বলে, বুড়ো কর্তা আপনারে ডাকতেছেন।

বৃদ্ধের ঘরে ঢুকতেই গোকুল বলেন, দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে কাছে এসে বস। রঞ্জন আদেশ পালন করলে বৃদ্ধ বললেন, তুমি ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখতে পারবে রঞ্জন? মেয়েটাকে আমি ঘরে ঢুকতে দিই না, কিন্তু সে আর সকলেরই হৃদয় জয় করে নিয়েছে। তুমি রাজগিরে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে আসতে পার?

রঞ্জন বললেন, সেই কথা বলতেই এসেছিলাম আজ। আমি তদন্ত করে দেখতে চাই। বৃদ্ধ অনেকক্ষণ কী ভাবলেন। তারপর বলেন, আর একটি কথা। মেয়েটি যদি মিনতি হয়, তাহলে …. মানে পূর্বকথা স্মরণ করে প্রশ্ন করছি, তুমি কি আমার কাছে কোনো বিবাহ-প্রস্তাব পেশ করবে?

অন্ধের কাছে চক্ষুলজ্জার বালাই নেই। রঞ্জন বললে, স্যার, ঠিক জানি না— ও যদি মিনতি নাও হয়, তবু হয়তো আমি ওকে বিবাহ করতে চাইব।

গোকুল স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। একটু ভেবে নিয়ে বলেন, এতবড় কথাটা যখন তুমি বলতে পারলে রঞ্জন তখন রাহা-খরচের কথা তুলব না। তুমি রাজগিরে গিয়ে সব কিছু খুঁটিয়ে খোঁজ নিয়ে এসো। তুমি বুদ্ধিমান— এ কথা বলা বাহুল্য যে, রামপ্রসাদ শর্মা অবিনাশের স্টেটমেন্ট ‘করোবরেট’ করবে। সেটুকু ব্যবস্থা অবিনাশ নিশ্চয় করেছে।

রঞ্জন মাথা নেড়ে সায় দেয়। খেয়াল করে না, বৃদ্ধ ওর মাথা নাড়া দেখতে পাচ্ছেন না। গোকুল আবার বলেন, আরও একটা কথা। তোমাকে এর আগে একদিন বলেছিলাম, আমি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস—ঐ যাকে ভুল করে বলা হয়, ‘সিপাহী বিদ্রোহ’—তার ওপর গবেষণা করছিলাম। কাজটা শেষ হয়নি। মূল দলিলপত্র সব রাখা আছে দুর্লভ নিকেতনের লোহার আলমারিতে। তুমি ইতিহাসের ছাত্র, আমাকে কথা দাও— আমার মৃত্যুর পর ঐ কাজটা তুমি শেষ করবে।

রঞ্জন শুধু বললে, এ তো অনুরোধ নয় স্যার, আশীর্বাদ। আমার সৌভাগ্য।

বৃদ্ধ একটু ভেবে নিয়ে বলেন; সব কথা তোমাকে এখনই বলতে পারছি না; কিন্তু আর এ-কথাটা কখনও ভুলো না। ঐ কীটদষ্ট নথিপত্রের মধ্যেই আছে আমার গুপ্তধনের চাবিকাঠি। তুমি খুঁজে নিও। বুঝলে!

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে রঞ্জন দেখে লছমী দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে।

আপাদমস্তক আর একবার দেখে নিয়ে রঞ্জন বললে, কলকাতায় কী কী দেখলে?

—কিছুই দেখিনি, বাবুজি। কে আমাকে কী দেখাচ্ছে বলুন?

তা বটে। যতদিন না ওর পরিচয়টা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কেই বা ওকে নিয়ে ঘুরবে? প্রসঙ্গান্তরে যাবার জন্যে বললে, কলকাতায় পৌঁছে রাজগিরে চিঠি দিয়েছ?

—না।

—কেন? তোমার সেই বাবা ব্যস্ত হয়ে আছে নিশ্চয়। একটা পৌঁছানো সংবাদ দেওয়া উচিত ছিল।

—উচিত তো অনেক কিছুই ছিল। কিন্তু খাম-পোস্টকার্ড না থাকলে কী করে চিঠি লেখা যায় সে কথা তো আমাকে কেউ বলে দেয়নি।

—তোমার …. তোমার হাত-খরচার পয়সা কিছু নেই?

কে দেবে? বুড়োবাবু আমাকে মানতেই চান না। কার কাছে চাইব।

রঞ্জন বিনা বাক্যব্যয়ে পাঞ্জাবির পাশ পকেটে হাত চালিয়ে দিল। এক টাকার খান কয়েক নোট আর এক মুঠো খুচরো ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বললে, নাও ধরো।

—আপনি কেন দেবেন?

—সেটা পরে ভেবে দেখা যাবে! ধরো।

—কত আছে ওতে?

—দেখলেই তো, আমি গুনে দেখিনি।

লছমী একদৃষ্টে কয়েকটা মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল। তারপর হেসে বলল, না গুনে কাউকে টাকা-পয়সা দিতে নেই, আপনি জানেন না?

রঞ্জন সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললে, না জানি না। কেন বলো তো?

—সেইটেই নিয়ম!

কথার পিঠে কথা। অবাক হবার কী আছে? রঞ্জন কিন্তু স্তম্ভিত হয়ে যায়।

লছমী একটু হেসে বললেন কী হল? আপনি তো কিছু বললেন না, বাবুজি

রঞ্জন সম্বিত ফিরে পায়। বলে, কী বলব?

—অন্তত একটা ধমকও তো দিতে পারতেন আমাকে। বলতে পারতেন—’তুমি ইতর’।

রঞ্জন বজ্রাহত!

লছমী কিন্তু আর দাঁড়াল না। ওর অবশ হাত থেকে একমুঠো খুচরো অসঙ্কোচে গ্রহণ করে চলে গেল অন্দরমহলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *