কুলের কাঁটা – ১২

১২

মাসখানেক পরের কথা।

প্রবীণ এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্যারিস্টার এ. কে. রে-র বৈঠকখানায় বসেছে মামলার প্রথম অধিবেশন। সালিশি মামলার একটা মস্ত সুবিধা এই যে, মধ্যস্থকে চার মাসের মধ্যে রায় দিতে হয়। ফলে দেওয়ানি

মামলার মতো বছরের পর বছর আদালতে মামলা ঝুলে থাকার আশঙ্কা নেই। বাদী তাঁর অভিযোগ বিস্তারিতভাবে লিখে পেশ করেন। প্রতিবাদী তাঁর প্রত্যুত্তরও পেশ করেন। অতঃপর শুনানি হয়। দুপক্ষ ইচ্ছে করলে নিজ নিজ আইনজ্ঞ পেশ করতে পারেন। আর্বিট্রেটর ইচ্ছা করলে সাক্ষীর শপথ গ্রহণ করতে পারেন, আদালতের বিচারকের মতো। যদিও সচরাচর তা করা হয় না। সাক্ষী, প্রমাণ, সওয়াল-জবাব আদালতের মতো হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। শুধু বিবদমান উভয়পক্ষ সমান সুযোগ পাচ্ছেন কিনা এটা আর্বিট্রেটরকে দেখে নিতে হয়। রায়ে তাঁকে যুক্তি দেখাতে হয় না। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ মাত্র এক লাইনের রায় দেওয়া হয়েছে, এমন নজিরও আছে।

বাদীর প্রতিবেদন এবং প্রতিবাদীর প্রত্যুত্তর পেশ করা হয়েছে। এবার রে-সাহেব বসেছেন বিচার করতে। ওঁর টেবিলের একদিকে বসেছেন বাতগ্রস্তা আরাধনা, অবিনাশ এবং তাঁর অ্যাডভোকেট বিজন দত্ত। অপর দিকে লছমী, রঞ্জন, মমতা এবং বাসু সাহেব। একজন শ্রুতি-লিখনকারী নোটবই পেনসিল বাগিয়ে বসে আছে এক পাশে। সাক্ষীরা পাশের ঘরে। ডাক পড়লেই আসবেন।

রে-সাহেবের নির্দেশে বিজন দত্ত তাঁর প্রারম্ভিক ভাষণে বললেন, মি লর্ড! আমার মক্কেল তাঁর বক্তব্য লিখিতভাবেই বলেছেন। আমরা চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করব, প্রতিবাদিনী শ্রীমতী লছমী শর্মা একজন প্রবঞ্চক। শ্রীরামপ্রসাদ শর্মা তাঁর পালক-পিতা নন, জনক-পিতা। লছমী দেবীর জন্ম পাটনা রেলওয়ে হাসপাতালে। জন্ম-তারিখ দোসরা ফেব্রুয়ারি 1948। তাঁর গর্ভধারিণীর নাম ফুলেশ্বরী। অপরপক্ষে গোকুলচন্দ্রের নাতনির জন্ম 7ই সেপ্টেম্বর 1949। প্রমাণ স্বরূপ আমরা পাটনা হাসপাতালের রেজিস্টারের একটি ফটোস্ট্যাট কপি দাখিল করছি। এটি আমাদের এক নম্বর এক্সিবিট।

বাসু বললেন, ওটি নথিভুক্ত করায় আমাদের কোনো আপত্তি নেই, মি লর্ড। বরং আদালতের সময় সংক্ষেপ করার জন্য আমরা আরও স্বীকার করছি যে ঐ ফটোস্ট্যাট্ কপিখানা মূল হাসপাতাল রেজিস্টার থেকেই গ্রহণ করা। যাচাই করার দরকার নেই।

রে-সাহেব বলেন থ্যাঙ্কু কাউন্সেল! …ইয়েস য়ু মে প্রসিড প্লিজ!

বিজনবাবু বলেন, রামপ্রসাদ শর্মার সাক্ষ্যে আমরা প্রমাণ করব যে, তিনি 1963 সালের মে মাস পর্যন্ত পূর্ব রেলওয়েতে চাকরি করেন, এবং পাটনার রেল-কোয়ার্টার্সে বাস করতেন। লছমীও তাঁর সঙ্গে সেখানে থাকত এবং স্কুলে পড়ত। তার এগারো বছর বয়সের সময় ছাপড়া জেলার বিশৌলী গ্রামের জোতদার চাষি মহাদেব প্রসাদ দেও-এর সঙ্গে তার বিবাহ হয়। বিবাহের দু-বছর পর 24.3.63 তারিখে পুত্রবধূকে স্বগৃহে নিয়ে যাবার জন্য মহাবীর রাম প্রসাদের গৃহে আসে। সেই রাত্রেই লছমীর অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা ওঠে। তাকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয় এবং সার্জেন ডক্টর শঙ্করীপ্রসাদ তার পেটে অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন করেন। সেই অপারেশন সম্বন্ধে হাসপাতাল রেজিস্টারে যে তথ্য লেখা আছে এটিই তার ফটোস্ট্যাট্ কপি। আমাদের দু-নম্বর এক্সিবিট্। সুতরাং প্রতিবাদী পক্ষের মনগড়া কাহিনি কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। আদালত অনুমতি করলে এবার আমরা একে একে আমাদের সাক্ষীদের ডাকতে পারি।

রে-সাহেব বললেন, না। তার পূর্বে আমি প্রতিবাদীর প্রারম্ভিক ভাষণটা শুনতে চাই।

বাসু বললেন, মি লর্ড! প্রতিবাদীর বক্তব্য সংক্ষিপ্ত, যাঁকে এই মামলায় প্রতিবাদী করা হয়েছে, অর্থাৎ রামপ্রসাদের পালিতা কন্যা লছমী দেবী, তিনিই প্রকৃত প্রস্তাবে গোকুলচন্দ্রের পৌত্রী মিনতি রায়চৌধুরী। কেন আমার মক্কেল এই সত্যটা এতদিন গোপন করে রেখেছিলেন সে-কথা তিনি আমাকে জানিয়েছেন; কিন্তু প্রকাশ্য আদালতে সেটি তিনি জানাতে অনিচ্ছুক। এটুকুই এ মামলার জটিলতা সে-কথা যদি প্রকাশ করে বলবার অধিকার আমার থাকত তাহলে এ মামলার মীমাংসা পাঁচ-মিনিটের মধ্যে হয়ে যেত—

বিজন হঠাৎ বলে বসেন, অর্থাৎ সহযোগী প্রকৃত সত্য গোপন করে মামলা জিততে চাইছেন?

বাসু বলেন, না। ডাকাতে ধরে নিয়ে যাওয়া একটি অসহায়া নারী যদি তার সমস্ত অভিজ্ঞতা প্রকাশ্য আদালতে পেশ করতে না চায় তবে তাকে সত্য গোপনের অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায় না। এ মামলায় আমাদের দায় প্রমাণ করা-রামপ্রসাদের স্ত্রী ফুলেশ্বরীর গর্ভজাতা কন্যা এবং এই প্রতিবাদিনী এক ব্যক্তি নয়; আমাদের দায় প্রমাণ করা—প্রতিবাদিনী গোকুলচন্দ্রের পৌত্রী মিনতি দেবী-তার বেশি নয়। তাই করব আমরা। এর বেশি আর আমার কিছু বলার নেই আপাতত।

বিজনবাবুর তরফে প্রথম সাক্ষী রামপ্রসাদ শর্মা তার নাম, ধাম, পরিচয় দিয়ে অবিনাশের সঙ্গে তার যা কথাবার্তা হয়েছিল তা জানাল। একশ টাকা মাস-মাহিনায় সে লছমীকে অবিনাশের সঙ্গে কলকাতায় পাঠিয়েছিল – অবিনাশের কথা অনুযায়ী সে বিশ্বাস করেছিল অবিনাশের উদ্দেশ্য একটি মরণোন্মুখ অন্ধ বৃদ্ধের শেষের দিনগুলিকে একটা মিথ্যার প্রহেলিকায় ভরিয়ে দেওয়া। বিজনবাবুর প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন, শনিচরীকে বিবাহ করার পূর্বে তিনি ফুলেশ্বরীকে বিবাহ করেন। ফুলেশ্বরীর একটি মাত্র কন্যা সন্তান হয় লছমী। হ্যাঁ, সে পাটনা স্কুলে পড়ত। এগারো বছর বয়সে বিবাহ হয়, ইত্যাদি ইত্যদি। দীর্ঘ সওয়াল অন্তে বিজনবাবু বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বলেন, য়ু মে ক্রস হিম নাউ।

বাসু বলেন, পাণ্ডাজি, আপনি আধঘণ্টা ধরে অনেক অবান্তর কথা বলেছেন। অবশ্য দোষ আপনার নয়, যেভাবে প্রশ্ন হয়েছে সে ভাবেই জবাব দিয়েছেন আপনি। এবার আমার একটি সোজা কথার সরল উত্তর দিন—ঐ মেয়েটি, অর্থাৎ এ মামলার প্রতিবাদিনী কি আপনার স্বর্গগতা স্ত্রী ফুলেশ্বরীর গর্ভজাত কন্যা?

—না!

—ঐ মেয়েটির সঙ্গে ছাপড়া জেলার মহাদেব প্রসাদ দেও-এর পুত্রের বিবাহ হয়েছিল?

—না!

—অবিনাশচন্দ্র যখন ঐ মেয়েটিকে গোকুলচন্দ্রের নাতনি হিসাবে কলকাতায় নিয়ে আসতে চাইলেন, তখন কি আপনি অনুমান করেছিলেন যে, হয়তো আপনার পালিতা কন্যা তার পিতামহের কাছেই যাচ্ছে?

বিজনবাবু আপত্তি করেন—মি লর্ড! সাক্ষীর অনুমান কোনও এভিডেন্স নয়

এ. কে. রে বলেন, অবজেকশন ওভাররুলড! এটা আদালত নয়। সাক্ষী কেন তাঁর কন্যাকে অবিনাশবাবুর সঙ্গে পাঠান তা আমি জানতে চাই। বলুন?

—না। সেটা আমি নিশ্চিতভাবে জানতাম না। বেটি কোনোদিনই তার প্রকৃত পিতৃ-পরিচয় আমাকে জানায়নি। আমি জানতাম, সেটা ওর দুঃখের ইতিহাস। তাই জানতে চাইনি। তবে আমি অনুমান করেছিলাম, হয়তো আমার পালিতা কন্যা তার পিতৃগৃহেই যাচ্ছে।

—বিদায় দেওয়ার সময় সে-কথা কি আপনার পালিতা কন্যাকে বলেছিলেন?

—বলেছিলাম। আমি বেটিকে বলেছিলাম-—দ্যাখ, তোর ভাগ্য তোকে কোথায় নিয়ে যায়। যদি দেখিস ঠিক বন্দরে পৌঁছাতে পারিসনি, তাহলে ফিরে আসিস। আমার বাড়ির দরজা চিরকাল তোর জন্য খোলা থাকবে।

—আর একটা কথা পাণ্ডাজি! এই মেয়েটি—মানে কবে আপনার পালিতাকন্যা আপনার সংসারে আসে? কী ভাবে আসে, তা আপনি জজ সাহেবকে জানাবেন কি?

—জানাব হুজুর। আমার কন্যা লছমী আত্মহত্যা করেছিল। ঐ পাটনা শহরেই। ওর নামে যে মিথ্যা কলঙ্ক রটেছিল তা ও সহ্য করতে পারেনি। ফুলেশ্বরী একেবারে পাগলের মতো হয়ে যায়। ঐ সময় ঘটনাচক্রে আমি এই মেয়েটিকে উদ্ধার করি, পাটনায় — গঙ্গার ঘাটে। এও আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল। আমি তাকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসি। কেন ও আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল তা ও আমাকে জানায়। আমি তাকে আমার কন্যা লছমীর কথা বলি। তাকে বোঝাই—এটাই মেয়েদের নিয়তি! লাঞ্ছনা সইতেই মেয়েরা দুনিয়ায় পয়দা হয়। তবু আত্মহত্যা মহাপাপ! ওকে আমার সংসারে আশ্রয় দিই। ঐ সময়েই রিটায়ার করে আমি রাজগিরে চলে আসি। মেয়েটিকে আমি আমার মৃতকন্যার স্থলভুক্ত করে নিই। নিজের সংসারে হতভাগী কেন ফিরে যেতে পারেনি, সে-কথা আমি বলব না বাবুজি। বেটি যদি নিজে সে কথা বলে তো স্বতন্ত্র কথা। আমি তাকে জবান দিয়েছিলাম—তার দুঃখের কথা দুনিয়াকে জানাব না। আমি আমার সত্য রক্ষা করেছি। ফুলেশ্বরীও করেছিল। আমার বর্তমান স্ত্রী শনিচরী পর্যন্ত জানে না ও তার সতীনের গর্ভজাত নয়। এর বেশি আমি কিছু বলব না বাবুজি!

—দ্যাটস্ অল মি লর্ড।

পাণ্ডাজি তাঁর পালিতা কন্যার দিকে তাকিয়ে দেখেন, তার দুই চোখে জল।

বিজন বিচারকের অনুমতি নিয়ে পাণ্ডাজিকে পুনরায় জেরা শুরু করলেন, তাহলে আপনি অবিনাশবাবুকে কেন জানালেন না—এ মেয়েটি আপনার কন্যা নয়?

—এ প্রশ্নের জবাব আমি দেব না বাবুজি!

বিজন উত্তেজিত হয়ে বলেন, মি লর্ড! সাক্ষী হোস্টাইল। আপনি তাকে বাধ্য করুন।

এ কে রে বলেন, সাক্ষী প্রতিবাদী পক্ষের নয়! আপনার। উনি যদি আপনার সঙ্গে সহযোগিতা না করেন আমি নাচার।

কিন্তু উনি যে ইতিমধ্যে ও-পক্ষের কাছে ঘুষ খেয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছেন না, তার প্ৰমাণ কী?

—দিচ্ছেন, সেটা আপনি প্রমাণ করুন। আপনার প্রশ্নের জবাবে ওঁকে এমন কোনো কথা বলতে হবে, যা গোপন রাখার জন্য তিনি তাঁর অ্যালেড পালিতা কন্যার কাছে প্রতিশ্রুত। আমি তাঁকে বাধ্য করতে পারি না। আই রিপিট -সাক্ষী বাদীপক্ষের।

বিজন হতাশ হয়ে বলেন, দ্যাটস্ অল মি লর্ড

দ্বিতীয় সাক্ষী অবিনাশচন্দ্র। বিজনবাবুর প্রশ্নে তিনি তাঁর উকিলের প্রারম্ভিক ভাষণের কথাই স্বীকার করে নিলেন। বাসু জেরায় তাঁকে প্রশ্ন করেন, রাজগির থেকে সোজা কলকাতায় না এসে আপনি হঠাৎ কাশী গিয়েছিলেন কেন?

—তীর্থদর্শনে। বেড়াতে।

—কিন্তু কাশীতে পৌঁছে ধুলো-পায়ে আপনি দুর্গাবাড়ি অঞ্চলের সেই বাড়িটিতে প্রথম গিয়েছিলেন—যেখানে গোকুলচন্দ্রের পুত্র খুন হন; তাই নয়?

অবিনাশ চুপ করে থাকেন। কী যেন ভাবছেন তিনি।

বাসু বলেন, যদি স্মরণ না হয় তবে তাই বলুন। আমি বরং পরবর্তী সিটিং-এ কাশীর লেকচারার অশোক মেহতাকে সাক্ষ্য দিতে ডাকি!

তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে অবিনাশের। স্বীকার করলেন তিনি।

—এবার হুজুরকে বুঝিয়ে বলুন, আপনি যখন নিজে নিঃসন্দেহ ছিলেন যে, লছমী আসলে মিনতি নয়, তখন সর্বপ্রথমে বিশ্বনাথের মন্দিরে বা গঙ্গাস্নানে না গিয়ে তাকে ঐ বাড়ি দেখাতে নিয়ে গেলেন কেন?

আবার চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন অবিনাশ। ভেবে নিয়ে বলেন, আমি জানি না।

—জানেন! স্বীকার করছেন না! আপনি ভগ্নিপতিকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে মেয়েটিকে সংগ্রহ করেননি। আপনি চেয়েছিলেন ঐ জাল-মিনতির সাহায্যে জেনে নিতে গোকুলচন্দ্ৰ কোথায় তাঁর গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছেন। স্বীকার করুন।

—না! না! এ কথা সত্য নয়!

নয়? তাহলে কলকাতায় এসে প্রথমেই কেন ‘দুর্লভনিকেতনে’ যাননি? কেন তাকে শাঁখারিপাড়ার বাড়িটা চিনিয়ে দিতে গিয়েছিলেন? সে যে জাল, এ-কথা কেন সকলের কাছে গোপন রেখেছিলেন?

অবিনাশ রুখে ওঠে, আপনি কী বলতে চাইছেন? জাল মিনতি সম্পত্তি পেলে আমার কী?

—আপনার সব! কারণ আপনি একা জানতেন—সে জাল। তার মৃত্যুবাণ পকেটে নিয়ে আপনি তাকে খেলাচ্ছিলেন। জাল-মিনতি যদি গুপ্তধনের সন্ধান পায়, সম্পত্তি পায়–তখনই আপনি দুনিয়াকে জানাতেন যে, সে জাল। সব কিছু আপনাতে বর্তাতো!

—আপনার এ অভিযোগ মিথ্যা!

—এবার বলুন, গোকুলবাবুর মৃত্যুর পূর্বদিন সন্ধ্যায় কি আপনি তাঁর পোষা কুকুর ডেভিলকে ঐ মেয়েটির দিকে লেলিয়ে দেননি?

—না। এ-অভিযোগও সর্বৈব মিথ্যা।

এ. কে. রে বলেন, কুকুরটার ব্যাপার আমরা এখনও জানি না। কাউন্সেল যদি তার ব্যাকগ্রাউন্ডটা একটু বুঝিয়ে বলেন সুবিধা হয়

বাসু বলেন, মি লর্ড। গোকুলচন্দ্রের একটি কুকুর আছে, নাম ডেভিল। গ্রেট-ডেন আর জার্মান-ম্যাস্টিক-এর ক্রসব্রিড। প্রকাণ্ড বাঘের মতো, খানদানী কুকুর। লছমী এ বাড়িতে আসার পর থেকে সে প্রচণ্ডভাবে ডাকতে থাকে। লছমীকে বলা হয়, সে যেন ঐ কুকুরটার ধারেকাছে না যায়। তাহলে ডেভিল তাকে ছিঁড়ে ফেলবে।

বাসু অতঃপর বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করেন—কীভাবে অবিনাশ ঐ কুকুরটাকে লছমীর দিকে লেলিয়ে দেন এবং কীভাবে বোকা হন।

এ. কে. রে বলেন, স্ট্রেঞ্জ স্টোরি!

বিজন দত্ত ফোড়ন কাটেন, স্টোরিজ আর য়ুজুয়ালি স্ট্রেঞ্জ মি লর্ড! আষাঢ়ে গল্পটা শুনতে আমাদেরও বেশ ভাল লাগছিল। তবে গল্প গল্পই। তার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই।

বাসু অবিনাশের দিকে ফিরে বলেন, আপনি এ-ঘটনা সম্পূর্ণ অস্বীকার করছেন? – আদ্যন্ত।

বাসু বলেন, দ্যাটস্ অল মি লর্ড।

বাদী পক্ষের আর কোন সাক্ষী না থাকায় এবার প্রতিবাদী তরফের প্রথম সাক্ষী তাঁর সাক্ষ্য দিতে এলেন। ডক্টর পি উপাধ্যায় এম. ডি; এফ. আর. সি. এস.।

বাসু-সাহেব তাঁকে প্রশ্ন করেন, গত পরশুদিন, প্রতিবাদিনী ঐ মেয়েটিকে আমি আপনার চেম্বারে নিয়ে গিয়েছিলাম এবং আপনি তাকে পরীক্ষা করেছিলেন, একথা সত্য?

—আপনার উভয় প্রশ্নের উত্তরই—হ্যাঁ, সত্য।

—ডাক্তারী পরীক্ষায় আপনি কী দেখেছেন?

—আপনার অনুরোধমত আমি পরীক্ষা করে দেখেছিলাম—ঐ মেয়েটির অ্যাপেনডিক্স যথাস্থানে আছে। অর্থাৎ অ্যাপেনন্ডিসাইটিস্ রোগে ওঁর কোনোদিন অপারেশন হয়নি।

ডক্টর উপাধ্যায়, এবার আপনি বলুন-অ্যাপেনডিক্স কি মানবদেহের এমন একটি প্রত্যঙ্গ যা কেটে বাদ দিলে আবার গজাতে পারে? দাড়ি-গোঁফ, মাথার চুল, হাত পায়ের নখ যে ভাবে গজায়?

—না। অ্যাপেনডিক্স কেটে বাদ দিলে তা পুনরায় গজাতে পারে না।

—এবার আপনি এ মামলার এক্সিবিট্ নম্বর 2 পরীক্ষা করে দেখুন। ও থেকে জানা যাচ্ছে পাটনা হাসপাতালের ডাক্তার শঙ্করীপ্রসাদজি রামপ্রসাদ পাণ্ডার কন্যা লছমীর অ্যাপেন্ডিসাইটিস্ অপারেশন করেছিলেন। এখন আপনার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নির্ভর সিদ্ধান্ত কি সন্দেহাতীতরূপে বলতে পারে যে, গত পরশু যে পেসেন্টটিকে আপনি পরীক্ষা করেছিলেন, অর্থাৎ প্রতিবাদিনী ঐ মেয়েটি এক্সিবিট 2 বর্ণিত পেসেন্ট নয়?

—হ্যাঁ পারি। এই ভদ্রমহিলাকে ডাঃ শঙ্করীপ্রসাদ অপারেশন করেননি!

—যার অর্থ-রামপ্রসাদ শর্মার কন্যা লছমী, যাকে অপারেশন করা হয়েছিল সেই মেয়েটি এবং প্রতিবাদিনী পৃথক ব্যক্তি?

—নিঃসন্দেহে।

—দ্যাস্ অল মি লর্ড!

বাসু বলেন, মি লর্ড! আমার আর কোনো সাক্ষী নেই। রঞ্জন সরকারকে আমি সাক্ষী হিসাবে ডাকতে পারতাম, যেহেতু সে কিশোর বয়সে মিনতি রায়চৌধুরীকে ঘনিষ্ঠভাবে জানত। তাদের সেই কিশোর বয়সের রোমান্স এ মামলায় নথিভুক্ত হ’ক এটা আমি চাই না। তিনটি কারণে। প্রথমত, সে গোপন-জীবনের কোনো তৃতীয় সাক্ষী নেই। দ্বিতীয়ত, রঞ্জনবাবু মিনতিকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক, ফলে তাঁর সাক্ষ্যের ততটা মূল্য হবে না। তৃতীয়ত, ইতিপূর্বেই সহযোগী এমন ইঙ্গিত করেছেন যে, রামপ্রসাদ শর্মা স্বার্থপ্রণোদিত হয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাই আমি এমন একটি সাক্ষীকে অতঃপর হাজির করতে চাই, যার বিরুদ্ধে আমার সহযোগী অন্তত উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ জানাতে পারবেন না। এ. কে. রে বলেন, আপনি এই যে বললেন আপনার আর কোনো সাক্ষী নেই?

—আজ এখানে নেই মি লর্ড! আগামী অধিবেশনে তাকে পাবেন। আমার প্রস্তাব, আপনি এ মামলার পরবর্তী অধিবেশন অকুস্থলে করুন—অর্থাৎ ঐ ‘দুর্লভ নিকেতনের দ্বিতলের বারান্দায়। ডেভিল অবিনাশবাবুকে দীর্ঘদিন ধরে চেনে তাঁর এভিডেন্স—মোতাবেক সে লছমীকে চেনে না–আমরা ওঁদের দুজনকে বাগানে পাঠিয়ে দিয়ে দেখতে পারি ডেভিল কী সাক্ষ্য দেয়!

এ. কে. রে বলেন, পরিকল্পনাটা অদ্ভুত! কিন্তু আপনি কী প্রমাণ করতে চাইছেন বলুন তো?

—আমি আশা রাখিঐ তথাকথিত প্রবঞ্চক মেয়েটির অঙ্গুলি নির্দেশে ডেভিল তার অতি পরিচিত অবিনাশচন্দ্রকে ছিঁড়ে ফেলবে! অ্যান্ড আই থ্রো দিস্ প্রপোজাল অ্যাজ এ চ্যালেঞ্জ!

অবিনাশ মুখ কালো করে বসে থাকেন।

তড়াক করে উঠে দাঁড়ান বিজন দত্ত—মি লর্ড! কী বলব?… সহযোগীর প্রস্তাব… সিমপ্লি হরিবল! আমার মক্কেল একজন গ্ল্যাডিয়েটর নন! আর…মানে…উনি কী করে আশা করেছেন, মাননীয় বিচারক একটা কুকুরের সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন?

এ. কে. রে হেসে বলেন, বেগ টু ডিফার উইথ দ্য কাউন্সেল। আমার নিজের একটি অ্যালসেশিয়ান আছে। কুকুর-চরিত্র আমার ভালমত জানা। আমি ঐ ডেভিলের সাক্ষ্যকে রীতিমত গুরুত্ব দিতে চাই। যদি অবশ্য মিস্টার বাসু আমাকে নিশ্চিন্ত করেন যে, ডেভিল ওঁদের কাউকে কামড়ে দেবে না।

বাসু চট করে উঠে দাঁড়ান। বলেন, মি লর্ড! আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিচ্ছি— রামপ্রসাদের পালিতা কন্যাকে সে কিছু বলবে না। কিন্তু ডেভিল যাঁকে আজীবন ও-বাড়িতে যাতায়াত করতে দেখেছে তাঁর সম্বন্ধে আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি না; বরং আমার আশঙ্কা…ওয়েল, আশঙ্কার কথা থাক….

এ. কে. রে অবিনাশের দিকে ফিরে বলেন, এ বিষয়ে আপনি কী বলেন?

অবিনাশ জবাব দিলেন না। তাঁর হয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানালেন বিজন দত্ত—মি লর্ড! ইন্ডিয়ান আর্বিট্রেশন অ্যাক্টে কুকুরের সাক্ষ্য নেওয়ার কোনো নজির নেই।

এ. কে. রে হেসে বলেন—থ্যাঙ্কু অল! লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন!

আরও মাসখানেক পরের কথা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *