কুলের কাঁটা – ১৩

১৩

রঞ্জন আর মিনতি এসেছে বাসু-সাহেবকে নিমন্ত্রণ করতে সাতদিন পরে রেজিস্ট্রি মতে ওদের বিবাহ। বাসু বলেন, মামলা তো জিতলে, সম্পত্তির দখলও পেলে, কিন্তু ভাঁড়ে ভবানী কতটা ছিল?

রঞ্জন বলে, সে আর এক রহস্য। সমস্ত বাড়িটা আমরা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছি। গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারিনি। এই সঙ্গে একটা কথা বলি–মাস্টারমশাই আমাকে বারে বারে বলেছিলেন, তাঁর গুপ্তধনের চাবিকাঠি লুকানো আছে ঐ দুর্লভ স্মৃতিমন্দিরে। তার চারপাশে আমরা খুঁড়ে দেখেছি। কিছু পাইনি! ঐ আলমারিতে আছে কিছু প্রাচীন দলিলপত্র…

বাসু পাইপটা ধরিয়ে বলেন, ভেরি ইন্টারেস্টিং। সংক্ষেপে বলো তো, কী কী প্রাচীন দলিল-পত্র আছে?

রঞ্জন নিজেও ইতিহাসের ছাত্র। আজ একমাস ধরে সে ডুবে আছে ঐ নিয়ে। একটা বিস্তারিত বর্ণনা দিল সে। প্রাচীন দলিলের মূলস্তম্ভ একটি দিনপঞ্জিকা। 1842 থেকে 1868 পর্যন্ত। লেখক-বংশের আদি পুরুষ দুর্লভচন্দ্র রায়। হাতে তৈরি তুলট কাগজে খাগের কলমে লেখা। হস্তাক্ষর স্পষ্ট। প্রতিদিন পাশে তারিখ দিয়ে লেখা। দুর্লভচন্দ্র ছিলেন ব্রিটিশ পল্টনে। তাঁর রচনায় তদানীন্তন ভারতবর্ষের একটি ছবি পাওয়া যায়; বিশেষ করে সিপাহী বিদ্রোহের। দিনপঞ্জিকায় পৃষ্ঠা-সংখ্যা না থাকলেও প্রতি পৃষ্ঠার মাথায় তারিখ দেওয়া আছে। তাই কাগজগুলি বাঁধানো না হলেও ঠিকমতো সাজানো যায়। এছাড়া আছে দুর্লভচন্দ্রের পৌত্র অর্থাৎ গোকুলের পিতার খান আষ্টেক ডায়েরি। কিছু বিক্রি কোবালার দলিল। খান দশেক পোস্টকার্ড ও খাম। খামের ভিতর চিঠি। সেগুলিতে পোস্টাপিসের ছাপ 1868 থেকে 1894 পর্যন্ত। অধিকাংশের প্রাপক দুর্লভচন্দ্রের পুত্র বৃন্দাবনচন্দ্র রায়চৌধুরী। খান পাঁচেক খামের উপর আছে অদ্ভুত কিছু সাঙ্কেতিক চিহ্ন, যার অর্থ-গ্রহণ হয় না।

বাসু সাহেব নিশ্চুপ শুনে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ সোজা হয়ে উঠে বসেন। বলেন, ও তোমার ঐতিহাসিকের কম্মো নয়। আমাকে সমস্ত ব্যাপারটা দেখতে দাও তো। সাঙ্কেতিক চিহ্ন মানে কী রকম চিহ্ন?

—এক সার পুতুল। সংখ্যায় তারা পাঁচজন। অঙ্গ-ভঙ্গি করে নাচছে। আর আছে একটা জন্তু-কুকুর, বেড়াল অথবা খরগোশ।

—স্ট্রেঞ্জ! ভেরি স্ট্রেঞ্জ! সার অর্থারের একটা ডিটেকটিভ গল্পের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আমার। ‘ডান্সিং ডল’ বা ঐ জাতীয় কি নাম। চলো তো দেখি।

 বাসু-সাহেবকে ঠেকানো গেল না। তখনই তিনি হাজির হলেন দুর্লভ নিকেতনে। তারপর তিনদিন তিনরাত্রি তিনি ডুবে রইলেন ঐ নথিপত্রে। যে পাঁচখানি খামের উপর ঐ পুতুলের ছবি পেলেন, প্রথমেই তার ফটো তুলে নিলেন। সবগুলি খামই 1868 থেকে 1869-এর ভিতর ব্যবহৃত। যে কয়টির পোস্টাল ছাপ পড়া যায় তার তারিখ এবং চিঠির ভিতরের তারিখ মিলিয়ে বোঝা যায় -খামের চিঠির কোনো অদল-বদল হয়নি। পাঁচখানি পত্রের প্রাপকই হচ্ছেন—দুর্লভচন্দ্রের পুত্র বৃন্দাবনচন্দ্র। সবগুলি খামের ছবি তো ছাপানো যায় না। খান-দুয়েকের ছবি এখানে দেওয়া গেল, যাতে পুতুল নাচের গোপন রহস্য বোঝা যায় কিনা তা আপনারাও চেষ্টা করে দেখতে পারেন। পাঁচটি খামেই আছে পাঁচটি করে পুতুল। আর সব শেষে একটি কুকুর। যেন মহাপ্রস্থানের পথে দ্রৌপদীর পতনের পর হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলেছেন পঞ্চপাণ্ডব। না, তাও নয়, ওরা সকলেই যে পুরুষ, তা নয়! কখনও তিনটি পুরুষ দুটি মহিলা, কখনও দুটি পুরুষ তিনটি মহিলা। একটি আবার স্ত্রীভূমিকাবর্জিত নাটক।

পাঁচখানি পত্রের প্রেরক বিভিন্ন ব্যক্তি-তাহলে ঐ পুতুলের ছবি কে এঁকেছেন? বৃন্দাবনচন্দ্র? কেন? ওরা কী কথা বলতে চায়? তৃতীয় দিনে রঞ্জন এসে প্রশ্ন করে, কিছু পেলেন স্যার?

বাসু বলেন, একটা বিরাট অসঙ্গতি আমার নজরে পড়েছে।

—কী বলুন তো? কোথায়?

—শেষ তিনটি পৃষ্ঠায়। পয়লা জুন থেকে তেসরা জুন পড়ে যাও—রঞ্জন দিনপঞ্জিকার শেষ তিনটি পৃষ্ঠা পড়তে থাকে :

বুধবার, 1লা জুন, 1868 : অতঃপর একদা দুর্গের পতন হইল। পরিখা অতিক্রম করত ফেরঙ্গ সৈন্য পিপীলিকা শ্রেণীবৎ দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিল। নবাব সম্মুখ যুদ্ধে নিহত হইলেন। নবাবজাদাকে আমরা বন্দী করিলাম। মন্দভাগিনী নবাবজাদী এবং হারেম অভ্যন্তরস্থ মুসলমান মহিলাদিগের ভাগ্যে কী ঘটিল তত্ত্বত্তান্ত লিপিবদ্ধ করা বাহুল্যমাত্র। মেজর ম্যাকফার্লন অতঃপর দুর্গাধীপের পদ অধিকার করতঃ আদেশ করিলেন, সিপাহীগণ দুর্গের প্রতিটি প্রকোষ্ঠ ও প্রত্যন্তভাগ তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হউক। তাহাই হইল! পরন্তু নবাব-ছাহেবের অতুল হীরা-মুক্তা-মাণিক্যের সন্ধান কেহই পাইল না। অবশেষে দুর্গাধীপ বৃথা অন্বেষণে ক্ষান্ত হইলেন, পরন্তু আমার হৃদয় ঝটিকাবিক্ষুব্ধ অর্ণবের ন্যায় অশান্তই রহিয়া গেল। আমি নিরন্তর চিন্তা করিতে লাগিলাম—ইহা কিপ্রকারে সম্ভব? নবাবকে দুর্গ মধ্যে আমরা তিনদিক হইতে বেষ্টন করিয়াছিলাম। চতুর্থ দিকে খরস্রোতা যমুনা নদী। ফলে নবাব ঐ রত্নরাজি কোথায় লুক্কায়িত করিতে পারেন? ঐ সময়ে আমার লক্ষ্য হইল, নবাব ছাহেবের দিনপঞ্জিকাটি সর্বসাধারণের চক্ষুর সম্মুখে অনাদৃত অবস্থায় নিরন্তর বিরাজমান। আমার সন্দেহ জন্মিল – হয়তো নবাব ছাহেব তাঁহার দিনলিপিতে কোন ইঙ্গিত রাখিয়া গিয়াছেন। ঐ গ্রন্থটি আদ্যন্ত বিশুদ্ধ উর্দুতে লিখিত। সে দিনলিপি পাঠে অনুধাবন করা যায়— নবাব—ছাহেব সাতিশয় পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। ফার্সি, আরবি ও সংস্কৃতের ভুরিভুরি উদ্ধৃতিতে তাঁহার পাণ্ডিত্যের স্বাক্ষর বিরাজমান। লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম, দিন পঞ্জিকার আদ্যন্ত সহজ, সরল ও অর্থবহ। শুধুমাত্র শেষ পৃষ্ঠাটি যেন বাতুলের রচনা।

উক্ত শেষ পৃষ্ঠার প্রথমেই নবাব ছাহেব একটি ফার্সি উদ্ধৃতি দিয়াছেন— দীবান হাফিজের একটি বয়েৎ। তৎপরে একটি সংস্কৃত শ্লোক। পরন্তু তাহার পরের অংশ সম্পূর্ণ কুজ্‌ঝটিকাবৃত। আমি অতঃপর নবাব ছাহেবের দিন পঞ্জিকার শেষ পৃষ্ঠাটি হুবহু নকল করিয়া দিতেছি :

‘রহজনে দ্‌হর্ ন খুফতস্ত, ম-শও অয়মন্ অজ-ও
অগর্ ইমরোজ ন বর্দন্ত, কে ফর্দা বে-বরদ্।।

—দীবান্ হাফিজ 256/8

‘অর্থাৎ সংসারে তস্কর নিদ্রাগত হয় নাই, তাহা হইতে নিৰ্ভয় থাকিও না। আজ যদি সে তোমাকে অপহরণ না করে, কল্য তা সে করিবেই।।

‘দীবান্ হাফিজ এর এ সাবধানবাণী বিস্মৃত হইয়াছিলাম। তস্কর এতদিন আসে নাই, তাই নিশ্চিন্ত ছিলাম। অদ্য সে আমাকে অপহরণ করিতে আসিয়াছে। অদ্য প্রাতে পণ্ডিতজী কুমারসম্ভব পাঠ আরম্ভ করিলেন। প্রথম শ্লোকটি উচ্চারণ করিয়াছেন মাত্র, অর্থাৎ ‘অস্ত্যত্তরস্যাং দিশি হিমালয়ঃ নাম নগাধিরাজঃ’ তখনই ভগ্নদূত আসিয়া সংবাদ দিল সফদরজং বার্তা পাঠাইয়াছেন—ফেরঙ্গ সৈন্য ইসলামপুরের দুর্গ দখল করিয়া এই দিকে অগ্রসর হইতেছে। তৎক্ষণাৎ সভাভঙ্গ হইল। আত্মরক্ষায় সচেষ্ট হইলাম। আমি মুসলমান। ইসলামের জন্য যুদ্ধে প্রাণ দিব, ইহাতে ভীত নহি। কিন্তু বেগমদিগের কী ব্যবস্থা করিব? একজন বিশ্বস্ত কর্মচারীকে আদেশ করিলাম বেগমদিগকে সন্নিকটস্থ ‘রদনখুম’ গ্রামে পঁহুছাইয়া দিতে। খোদা সহায় হইলে তাহারা ঐ পথে অযোধ্যায় চলিয়া যাইবে। অযোধ্যার নবাব তাহাদিগকে আশ্রয় দিবেন। পরন্তু আমার এই অতুল ঐশ্বর্য্যরাশির কী ব্যবস্থা করিব? তৎক্ষণাৎ তাহাও লুক্কাইত করিলাম। একমাত্র নবাবজাদা শাহ্ মেহ্বুব তাহার সন্ধান জানিল। পরন্তু দুর্গরক্ষার সময় প্রাণাধিক পুত্র মেহবুবও নিহত হইতে পারে। সেজন্য আমার ভবিষ্যদ্-বংশীয়দিগের উদ্দেশ্যে এই বজ্রকূট সাবধান বাণী লিপিবদ্ধ করিয়া যাইতেছি। অবধান কর :

‘শত্রুদলে যদি ম্লেচ্ছ সিপাহী দেখিতে পাও তখন শুধু প্রথম পাঁচটি সৈন্যকে আক্রমণ করিবে। তাহাদের শিরচ্ছেদ করতঃ ছিন্নমুণ্ড সংগ্রহ করিবে। অপরপক্ষে যদি শুধুমাত্র কাফের সৈন্য আক্রমণ করে তখন শ্রেণীবদ্ধ সৈন্যদলের প্রথম চারিজন সৈন্যকে অতিক্রম করতঃ পঞ্চম সৈন্যকে অতিক্রম করিবে। পরন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় কাফের সৈনিকদিগকেও সম্পূর্ণ অবহেলা করিবেক না।’

এই আমার নির্দ্দেশ।

‘খোদা হাফেজ।’

নবাব ছাহেবের ঐ শেষ পৃষ্ঠাটি আমাকে উন্মাদ করিয়া দিল। আদ্যন্ত সহজ সরল উর্দুতে নিজ জীবনকাহিনী বিবৃত করিয়া একেবারে শেষপৃষ্ঠায়-—

—বৃহস্পতিবার, 2রা জুন 1868 : তিনি এরূপ প্রলাপোত্তি করিলেন কেন? নিশ্চয় উহার অভ্যন্তরে কোনও গুপ্ত সঙ্কেত আছে। তাহা কী?

চিন্তা করিতে করিতে বিদ্যুচ্চমকের ন্যায় আমার নিকট ঐ গূঢ় সংকেতের অর্থ নিশাবসানে সূর্যোদয়ের মত প্রতীয়মান হইল। কী মূর্খ আমি! নবাব-ছাহেব আদৌ প্রলাপোক্তি করেন নাই। অতি সুকৌশলে তিনি তাঁহার ভবিষ্যদ্বংশীয়দিগের হিত্যর্থে গুপ্তধনের নির্দেশ ঐ উপদেশে গোপনে লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। ম্লেচ্ছ-সিপাহী ও কাফের-সিপাহী শব্দদ্বয় তির্য্যকঅর্থে গ্রহণযোগ্য। ম্লেচ্ছ-সিপাহী অর্থে দীবান হাফিজের ঐ বয়েৎ, যাহার প্রথম পাঁচটি শব্দ হইতেছে— ‘রহজনে দহর ন খুফতস্ত ম-শত্ত’। তাহাদের শিরচ্ছেদ করতঃ -অর্থাৎ প্রথম অক্ষরগুলি গ্রহণ করতঃ যে শব্দ পাই তাহা ‘র-দ-ন-খু-ম’। কিমাশ্চর্যম্! সেটি পার্শ্ববর্তী গ্রাম—যে-গ্রামে বেগম ছাহেবাগণ পলায়ন করিয়াছেন! অতঃপর কাফের সৈন্যদলের, অর্থাৎ সংস্কৃত শ্লোকটির প্রথম চারিটি শব্দ অতিক্রম করতঃ পঞ্চম শব্দটি হইতেছে : ‘নগাধিরাজঃ’। অহো ভাগ্য! ঐ রদনখুম গ্রামে একটি শিবমন্দির বিরাজমান; বিগ্রহের নাম ‘নগাধিরাজ’। কূটচক্র ভেদ করিয়া আমার সৰ্ব্বাবয়বে রোমাঞ্চ হইল। অতঃপর মেজর ম্যাকফার্লন ছাহেবের নিকট দিবসত্রয়ের নিমিত্ত অনুপস্থিতির আর্জি পেশ করিলাম—বলিলাম, নিকটেই আমার একজন আত্মীয় আছেন। তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহি। ছুটি মঞ্জুর হইল। আমি একাকী ঐ রদনখুম গ্রামে উপনীত হইলাম। নগাধিরাজ মন্দিরের চতুর্দিকে দুই দিবস বৃথা অন্বেষণ করিলাম। কোনও সঙ্কেত দৃষ্টিগোচর হইল না। ঐ সময় নিরন্তর চিন্তা করিতে করিতে বিদ্যুচ্চমকের ন্যায় স্মরণ হইল—–নবাব ছাহেবের আরও একটি নির্দেশ ছিল, যাহা এযাবৎকাল আমি গ্রাহ্য করি নাই। তিনি বলিয়াছিলেন— ‘প্রথম ও দ্বিতীয় কাফের সৈন্যদ্বয়কেও সম্পূর্ণ অবহেলা করিও না। সেই দুইটি শব্দ হইতেছে ‘অস্ত্যত্তরস্যাং দিশি’ অর্থাৎ ‘উত্তর দিকে আছে’! আমি নগাধিরাজ মন্দির হইতে উত্তরাভিমুখে চলিতে শুরু করিলাম। লক্ষ্য হইল, সে দিকে গ্রাম্য পথ নাই-বিজন অরণ্য! তাহা হউক। আমি সেই অরণ্যে প্রবিষ্ট হইলাম। এক্ষণে দেখিলাম—ঘন পত্রগুল্ম কণ্টকাকীর্ণ সেই অরণ্যের অভ্যন্তরে সম্প্রতি মনুষ্যগমনের চিহ্ন রহিয়াছে। দুই-একটি বৃক্ষশাখা কিছু দিন পূর্বেই কেহ ছেদন করিয়া অরণ্যে প্রবেশ করিয়াছিল। ঐ সঙ্কেত চিহ্ন লক্ষ্য করিতে করিতে প্রায় অৰ্দ্ধক্রোশ অতিক্রম করতঃ একটি উন্মুক্ত স্থান দৃষ্টিগোচর হইল। এই স্থান বাহির হইতে কিছুতেই লক্ষ্য হইবে না। দেখিলাম, প্রায় চারিহস্ত পরিমিত বর্গক্ষেত্রে লতাগুল্মাদি পরিষ্কৃত। সে স্থলে সম্প্রতি কে বা কাহারা একটি গর্ত মৃত্তিকাদ্বারা বন্ধ করিয়াছে। আমার রোমাঞ্চ হইল। বুঝিলাম, গন্তব্যস্থলে উপনীত হইয়াছি। দিবাভাগে খনন করিতে সাহসী হইলাম না। স্থানটি অন্তরে চিহ্নিত করিয়া অরণ্য হইতে নির্গত হইলাম। গ্রামে গিয়া একটি খনিত্র সংগ্রহ করিয়া নগাধিরাজ মন্দিরে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। ক্রমে সন্ধ্যা হইল। জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রি। প্রথম প্রহরে শিবাকুলের সঙ্কেত পাইয়া নগাধিরাজ মন্দিরে আগমনপূর্বক আমি খনিত্রসহ অকুস্থলে পুনরাবির্ভূত হইলাম। তিন দণ্ডকাল নিরন্তর কায়িক পরিশ্রমে মনুষ্যদেহ পরিমাণ গর্ত খনন করিতে অস্মদ্দেহে শ্রমজল নির্গত হইল। তদনন্তর কোনও কঠিন ধাতব পদার্থে আমার খনিত্র প্রতিহত হইল। একটি মঞ্জুষা পাইলাম। তাহা উন্মোচন করিতেই ক্ষীণ জ্যোৎস্নালোকে নবাব ছাহেবের অতুল ঐশ্বর্য্যরাশি ঝলমল করিয়া উঠিল। আমি বজ্রাহত হইয়া গেলাম।

আমি অতুলবৈভবের অধিকারী হইয়াছি। এক্ষণে আমার সমস্যা এই অতুল ঐশ্বৰ্য—

—শুক্রবার, 3রা জুন 1968 : সমভিব্যাহারে কী প্রকারে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করিব? কী প্রকারে ঐ হীরামুক্তামাণিক্য মোহর ও তঙ্কায় রূপান্তরিত করিব? যদ্যপি তাহা সঙ্গোপনে করিতে সক্ষম হই তাহা হইলে শুধু আমি নহি, অস্মদ্বংশীয় অধঃস্তন সপ্তপুরুষ শতাধিক বৎসরকাল বিনা আয়াসে স্বচ্ছন্দে কালাতিপাত করিতে পারিবে। নবাব ছায়েব আমাকে যে শিক্ষা প্রদান করিয়াছেন তাহা আমি কদাচ বিস্মৃত হইব না। আমিও চৌর-তস্কর হস্তলাঘবদিগের এবং স্বার্থলোলুপ আত্মীয় পরিজনের লোলুপ দৃষ্টি হইতে আমার এ গুপ্তধন একই প্রকারে কৌশলে লুক্কাইত রাখিব। আমি উর্দু-ফার্সি-সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করিয়াছিলাম বলিয়াই ঐ বজ্রকূট সমস্যা ভেদ করিতে সফলকাম হইয়াছি। ইহা জননী সরস্বতীদেবীর আশীর্ব্বাদ। এ সম্পত্তি আমিও অস্মদ্বংশীয় পুত্র পৌত্র-প্রপৌত্রের উদ্দেশ্যে রাখিয়া যাইব। এই দিনপঞ্জিকাতেই রাখিব আমার নির্দেশ। বজ্রকূট সমস্যা সমাকীর্ণ। আমার মৃত্যুর পরে এই দিনপঞ্জিকাও সর্বসমক্ষে বিরাজমান থাকিবে, যেমন ছিল নবাব ছায়েবের দিনলিপি। কেহ দৃকপাত করিবে না; পরন্তু যদি কেহ যত্নবান হইয়া যথোচিত অনুসন্ধান করে, যদি তাহার পাণ্ডিত্যে যথেষ্ট অধিকার থাকে, তবে সেও অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিকারী হইবে, নচেৎ নহে। এক্ষেণে আমি অস্মদংশীয়দিগের উদ্দেশ্যে এই অন্তিম নির্দেশ রাখিয়া যাইতেছি। অবধান কর :

RUBAIYAT E OMARKHAYYAM

‘Ghiyashuddin Abulfath Omar Bin Ibrahim Al-Khayyamic,
‘KUZA NAMA’
‘Shapes of all sorts and sizes, great and small,
That stood along the floor and by the wall;
And some loquacious Vessels were; and some
Listen’d perhaps but never talk’d at all.
Said one among them–Surely not in vain
My substance of the common Earth was ta’en—
অলমিতি। শিবশম্ভু।’

রঞ্জন থামতেই বাসু-সাহেব বলেন, এবার বল ঐতিহাসিক অসঙ্গতিটা কী?

রঞ্জন মাথা নেড়ে বললে, না! অসঙ্গতি কিছু নেই; একটিমাত্র বর্ণাশুদ্ধি আমার নজরে পড়েছে। দুর্লভচন্দ্র ‘৪’ লিখতে এক জায়গায় ‘9’ লিখেছেন। উনি 1868 লিখতে ভুলে 1968 লিখেছেন—

—দেয়ার লাইস্ দ্য ক্লু। লেখক ভুল লেখেননি। সালটা ঠিকই আছে। নির্ভুল!

—কী বলছেন স্যার! ঠিক আছে মানে? দুর্লভচন্দ্র তো একশ বছর আগেকার যুগের মানুষ। 1968 সালটা ভুল নয়?

—না, নয়। কারণ শেষ পৃষ্ঠার লেখক দুর্লভচন্দ্র নন-তোমার হবু দাদাশ্বশুর গোকুলচন্দ্ৰ—ওটা মাত্র আট বছর আগেকার লেখা। বুঝলে?

রঞ্জন হেসে ওঠে। বলে, এটা কী বললেন বাসু-সাহেব? দেখছেন না—কাগজ এক, হাতের লেখা এক, কালি এক, ভাষা এক, এমনকি পূর্বপৃষ্ঠা থেকে পারস্পর্যটুকু পর্যন্ত বজায় আছে? ‘৪’ লিখতে ভুলে ‘9’ লেখা হয়েছে বলে—

বাসু ঘন ঘন মাথা নাড়েন-ভুল নয় মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড—এটা ইচ্ছা করে করা কারচুপি। সবটাই গোকুলচন্দ্রের কীর্তি! তিনি একই রকম কাগজ জোগাড় করেছেন, একই কালিতে, একই ভাষায়, একই হাতের লেখায় ঐ শেষ পৃষ্ঠাটি লিখেছেন! এমনভাবে মূল পাণ্ডুলিপিতে সাজিয়ে রেখেছেন যে, বোঝাই যায় না—ওটা প্রক্ষিপ্ত।

—এমন মনে করার হেতু?

—গোকুলচন্দ্র বলতে চেয়েছেন— খামের উপর আঁকা ঐ নৃত্যরত পুতুলের সারি loquacious —অর্থাৎ বাঙ্ময়। সোজা কথায়—ওরাই নির্দেশ দেবে, কোথায় তিনি তাঁর সম্পত্তি লুকিয়ে রেখে গেলেন! গোকুল বলছেন সৃষ্টিকর্তা কুম্ভকার ঐ পুতুলগুলি নিরর্থক সৃষ্টি করেননি— Surely not in vain।

রঞ্জন বাধা দিয়ে বলে, আমি সে-কথা বলছি না। আমি জানতে চাইছি, আপনি কী কারণে অনুমান করছেন–—

—অনুমান নয় রঞ্জন-এ আমার স্থির সিদ্ধান্ত। একাধিক কারণে ধরা পড়ে গেছেন গোকুলচন্দ্র। না ভুল বললাম। তিনি স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন, কারণ তাঁর সেটাই ছিল উদ্দেশ্য—তাঁর ভাষায় ‘যাহার পাণ্ডিত্যে প্রকৃত গভীরতা আছে, সে যেন বুঝিতে পারে’। নাউ লুক হিয়ার–প্রথম দুটি পৃষ্ঠার সঙ্গে শেষ পৃষ্ঠার একটা প্রকাণ্ড পার্থক্য আ েস্থানানে। প্রথম পৃষ্ঠায় বানান আছে ‘সর্ব্বসাধারণ, কৰ্ম্মচারী, নির্দ্দেশ, তির্যক, ঐশ্বর্য্য, প্রত্যাবৰ্ত্তন’ ইত্যাদি। অথচ শেষ পৃষ্ঠায় বানান আছে—’আশীর্বাদ, নির্দেশ, ঐশ্বর্য, সর্বসমক্ষে’! অর্থাৎ শেষ পৃষ্ঠার লেখক ‘রেফ’-এর পর দ্বিত্ব বর্জন করেছেন। এটা বর্তমান শতাব্দীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত আইন অনুসারে। এখন আমাকে বুঝিয়ে দাও দেখি-1868 সালের লেখক ঐ বানানে শেষ পৃষ্ঠাটা কেমন করে লিখেছেন? তিনি কেমন করে জানলেন পরের শতাব্দীতে বিশ্ববিদ্যালয় ‘রেফ’-এর পর দ্বিত্ব বর্জন করবেন? এতবার বানান ভুল করার মানুষ তো তিনি নন?

রঞ্জন বলে, আশ্চর্য! এটা তো খেয়াল হয়নি। এ থেকে প্রমাণ হয়, আপনি যথার্থ পণ্ডিত। আমি পণ্ডিতম্মন্য!

—না রঞ্জন। আমি অপরাধ বিজ্ঞান নিয়ে আছি, তাই ওসব বিষয়ে আমার নজরটা তীক্ষ্ণ। দ্বিতীয়ত, দেখ, যে উদ্ধৃতিটা দেওয়া হয়েছে সেটা ওমর খৈয়ামের ফিটজেরাল্ড কৃত অনুবাদ। ওটা 1868 সালে লেখা অসম্ভব।

—কেন অসম্ভব? এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ডের কবিতাগুচ্ছ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল 1860 সালে।

—ঠিক কথা। কিন্তু প্রথম কয়েক বছর দুনিয়া তার খবর জানত না। পর বৎসর কবি রসেটি এবং কবি সুইনবার্ন ঐ কবিতাগুচ্ছ পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। তবু তার যথেষ্ট প্রচার হয়নি। গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ হয়েছিল আট বছর পরে। তখন দুনিয়া সে খবর পায়—

—মানলাম। কিন্তু এমনও হতে পারে যে, প্রথম সংস্করণের একটি কপি কোনও ইংরাজের মাধ্যমে ভারতবর্ষে এসেছিল 1868 সালের আগেই। হয়তো দুর্লভচন্দ্র তখনই সে কাব্যগ্রন্থ পড়েছিলেন। তিনি ছিলেন প্রগাঢ় পণ্ডিত-আরবি, ফার্সি, উর্দু, সংস্কৃত, ইংরাজি, বাংলা-ছয়-ছয়টি ভাষার অধিকার ছিল তাঁর।

বাসু-সাহেব বলেন, মাই ডিয়ার ঐতিহাসিক, ও রাজ্যটা আমার এক্তিয়ারে। আমি ইংরাজি-সাহিত্যের ছাত্র। এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ডের যে উদ্ধৃতি ওখানে দেওয়া হয়েছে সেটা তাঁর কাব্যগ্রন্থের পঞ্চম ও শেষ সংস্করণ থেকে হুবহু নকল করা এবং তার প্রকাশকাল 1868 সালের পরে।

রঞ্জন বলে, তার মানে ঐ পুতুলগুলো সবাক? ওরা কিছু বলতে চায়?

—ঠিক তাই রঞ্জন। ঐ পুতুলগুলি চায় এ যুগের ‘রদনখুম’ গ্রাম আছে কোন পথের বাঁকে, সেখানকার ‘নগাধিরাজ’ মন্দিরের আধুনিক নামটা কী! খোঁজ, খোঁজ রঞ্জন, খোঁজ। হীরা-মুক্তা-পান্না-জহরতের পশরা সাজিয়ে ঐ পুতুলগুলো আনন্দে নাচছে। কান পেতে শোন—ওরা কী বলতে চায়! কুম্ভকার বৃথাই ওদের ওভাবে সাজায়নি— ‘Surely not in vain’!

রঞ্জন বললে, ঠিক পারব! নিশ্চিত শুনতে পাব, ওরা কী বলতে চায়।

.

এরপর কদিন ধরে রঞ্জনের চোখে ঘুম নেই। সব সময়েই তার চোখের সামনে একসার বিলাতি পুতুল নাচছে। তারা মোটা-সরু, বেঁটে-ঢ্যাঙা; কেউ ছড়ি হাতে বেড়াতে যাচ্ছে, কেউ বা তরোয়াল হাতে লড়াই করতে চলেছে। সংখ্যায় ওরা পাঁচজন—কখনও চারটি ছেলে, একটি মেয়ে; কখনও তিনটি ছেলে দুটি মেয়ে। ওরা পাঁচজনে কী এমন কথা বলতে পারে? ধরা যাক, ওরা পাঁচটি সংখ্যা বলছে— ‘1.7…3…5…82; কিম্বা পাঁচটা অক্ষর—’প…ক…………ধ’। তা থেকে কেমন করে বোঝা যাবে গোকুলচন্দ্র কোথায় তাঁর গুপ্তধন রেখে গেছেন? কী ভাবে রেখেছেন? মোহরের থলি? এক কৌটা হীরা-মুক্তা? এক তাড়া কোম্পানির কাগজ? কোথায় সেটা পুঁতে রেখেছেন? স্মৃতিমন্দিরের উত্তরে, না দক্ষিণে দশ হাত দূরে, না পঞ্চাশ হাত দূরে? কত গভীরে? অসম্ভব!

কিন্তু না! নবাবসাহেব তো মাত্র তিনটি শব্দে বাঙ্ময় হতে পেরেছিলেন। দিয়েছিলেন পূর্ণ নির্দেশ; তিনটি মাত্র শব্দে—’রদনখুম,’ ‘নগাধিরাজ,’ আর ‘উত্তরস্যাং দিশি’। গোকুল তিনের পরিবর্তে পাঁচটি শব্দ ব্যবহার করেছেন, তাহলে কেন পারবেন না? শব্দ? ওরা পাঁচজন পাঁচটি শব্দই তো? নাকি অক্ষর? অথবা সংখ্যা? সব গুলিয়ে যায় আবার।

পুতুলগুলোর একটা সাদৃশ্য ওর নজরে পড়েছে অবশ্য। শেষ দু’জন, অর্থাৎ চতুর্থ ও পঞ্চম পুতুল দুটি পরস্পরের দিকে হাত বাড়িয়ে যেন করমর্দন করতে চাইছে। কিন্তু ওদের হাতে হাতে ঠেকেনি। তার মানে কি? আরও সাদৃশ্য আছে-দ্বিতীয় পুতুলটি প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মহিলা এবং প্রথমটি পুরুষ; আর মনে হচ্ছে দ্বিতীয় পুতুল প্রথমটির কাঁধে খোঁচা মেরে কিছু একটা বলতে চায়। কী বলতে চায় সে?

রঞ্জন প্রায় পাগল হতে বসেছে।

আরও তিনদিন পরের কথা।

বাসু-সাহেবের গাড়িটা এসে দাঁড়ালো দুর্লভ নিকেতনের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে বাসু-সাহেব হাঁক পাড়লেন, ওহে বাবা শিবনাথ, গাড়িতে একটা ফ্লুরির কেক আর ফুলের তোড়া আছে, নামিয়ে নিয়ে এস তো হে

মিনতি ছুটতে ছুটতে নেমে আসে দ্বিতল থেকে। পিছন পিছন নেমে আসে ডেভিল। মিনতি বলে, হায় ভগবান! আপনি এখানে? আর আপনার শাগরেদ গেছে আপনার বাড়িতে।

—কে? রঞ্জন? কেন? আমি তো রোজই সকালে এখানে আসি।

—ইতিমধ্যে যে একটা দারুণ ব্যাপার হয়েছে। ও সমস্যাটার সমাধান করে ফেলেছে। ও নাকি বুঝতে পেরেছে পুতুলনাচের ভাষা।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন বাসু। বলেন, সে কী! কখন?

—এই তো আধঘণ্টা আগে। স্মৃতি-মন্দির থেকে ছুটতে ছুটতে এল ইউরেকা—ইউরেকা’ বলে চিল্লাতে চিল্লাতে। তারপরেই পাঞ্জাবিটা গায়ে চড়িয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল আপনার বাড়ির দিকে। একটা ট্যাক্সি নিয়ে-—

—সে কী বুঝতে পেরেছে, তা বলেনি?

—আমাকে পাত্তাই দিল না। শুধু বললে ‘ইউরেকা! ‘

—ছেলেটা ভোগাবে দেখছি! তাকে যে এখনি দরকার!

—ভয় নেই। এখনই আসবে সে। ওই ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে যাবার পর দেখি মানিব্যাগ নিয়ে যায়নি। অগত্যা ও ট্যাক্সিতেই তাকে বাড়িতে ফিরতে হবে—ভাড়া মেটাতে। অহেতুক অনেকগুলো টাকা অর্থদণ্ড হবে তার।

বাসু বিচিত্র হেসে বলেন, অনেকগুলো টাকা! তুমি জান, তোমরা আজ কত টাকার মালিক?

—না, কেন? আপনিও কি ইউরেকা’ শোনাবেন নাকি?

—তাই শোনাব মিনতি! তোমাদের হীরা-মুক্তার কিছু সন্ধান পেয়েছি। ইতিমধ্যে বাজারে তা যাচাইও করেছি। যে কয়টির সন্ধান পেয়েছি, তার বর্তমান বাজার দর এক লক্ষ সতের হাজার টাকা!

মিনতি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়—কী বলছেন? কীসের দাম? কী পেয়েছেন?

বাসু সাহেব জবাবে কিছু বলার আগেই গেটে একটি ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায়। রঞ্জন ছুটতে ছুটতে এসে বলে, এই যে আপনি! পেয়েছি স্যার! পুতুলগুলো কী বলতে চায় তা বুঝতে পেরেছি।

বাসু বলেন, আশ্চর্য! তুমি তো তাহলে আমাকে হারিয়ে দিলে রঞ্জন! আমি যে সে রহস্য এখনও ভেদ করতে পারিনি! কী বলছে পুতুলগুলো?

মিনতি বলে, সে কি? তাহলে কেমন করে বুঝলেন ওর দাম 1, 17,000 টাকা?

রঞ্জন জানতে চায়, কীসের দাম?

—কীসের, তা বলছি। আগে তুমি বলো দেখি—পুতুলগুলো কী বলছে?

—পুতুলগুলো বারে বারে একই কথা বলছে। তার কী অর্থ তা আমি জানি না। ওরা বলছে ‘সিলমোহর’।

সিলমোহর? হতেই পারে না। সিলমোহর?

—হ্যাঁ, সিলমোহর—STAMP!

লাফিয়ে ওঠেন বাসু – কারেক্ট! STAMP! সিলমোহর নয় রঞ্জন! তার বঙ্গানুবাদ——ডাকটিকিট’!

—ডাকটিকিট! তার অর্থ?

বলছি। কিন্তু তুমি কেমন করে বুঝলে ওরা সবাই বলছে— STAMP?

রঞ্জন বুঝিয়ে বলে, লক্ষ্য করে দেখুন—ওদের টুপিগুলি বিভিন্ন ধরনের, কারও হাতে ছাতা, কারও তলোয়ার, কারও বা লাঠি। ওরা মোটা সরু, ছেলে-মেয়ে, কখনও ডাইনে-ফেরা, কখনও বাঁয়ে! ওদের আকার, আকৃতি, লিঙ্গ, পায়ের মুদ্রা, পোশাকে কোথাও কোনও সাদৃশ্য নেই সামঞ্জস্য নেই। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখুন—প্রতিটি পুতুলের স্থান মাহাত্ম্যে হাতের মুদ্রা অভিন্ন। অর্থাৎ প্রথম খামের 1,2,3, 4 এবং 5 নম্বর পুতুলের মুদ্রা দ্বিতীয় খামের ঐ ঐ পুতুলের হাতের মুদ্রার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। তাই নয়?

—কিন্তু তাতে কী হল?

—হল এই যে, ওরা ‘সিমাফোর সিগন্যালিং কোডে পাঁচটি অক্ষর জানাচ্ছে। আমি ছেলেবেলায় স্কাউটে ছিলাম, তাই সিগন্যালিং শিখে ছিলাম—সব স্কাউটকেই শিখতে হয়। সিমাফোর আইন অনুসারে ওদের অবশ্য সামনে ফিরে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর কথা; কিন্তু তাহলে ওরা সহজে ধরা পড়ে যায়। তাই গোকুলচন্দ্র ওদের ঐভাবে নাচিয়েছেন—

বাসু বলেন, শুধু পুতুলদের নয়, আমাদেরও; কিন্তু ওরা পাঁচজনে কী বলছে?

বলছে পাঁচটি অক্ষর S… T… A…M… P; আমি ভেবেছিলাম তার অর্থ সিলমোহর। আপনি বলছেন না, ডাকটিকিট। কিন্তু কেন? ডাকটিকিট কেন?

বাসু বলেন, ইয়ংম্যান, এতদিনে তুমি প্রফেসর গোকুলচন্দ্রের নাতজামাই হবার যোগ্যতা অর্জন করেছ। আর ঘণ্টা কতক চেষ্টা করলেই তুমি চূড়ান্ত সমাধানে পৌঁছাতে। আমি পুতুলের ভাষাটা ধরতে পারিনি। আমি সমাধানে পৌঁছেছি অন্যভাবে। আমার প্রথম সন্দেহ জাগে গোকুলচন্দ্রের নোট বইতে একটি ঠিকানা দেখে— Stanley Gibbons Ltd. Romans House, 399 Strand, London W.C.2; খোঁজ নিয়ে জানলাম ঐ প্রতিষ্ঠান সুদুর্লভ ডাকটিকিট কেনা-বেচা করে। তখনই দুটি জিনিস খেয়াল হল একনম্বর, ডাকটিকিটের উপর ডাকঘরের ছাপ পড়েনি। এটা কেমন করে সম্ভব? বাবু বৃন্দাবনচন্দ্র ডাকে চিঠি পেলেন, অথচ খামের উপর ডাকঘরের ছাপ নেই কেন? তোমরা জান, অব্যবহৃত ডাক টিকিটের মূল্য বেশি। তারপরেই খেয়াল হল—ডাকটিকিটে রানী ভিক্টোরিয়ার মাথাটা উল্টো করে ছাপা। তারপর দেখি ডাকটিকিটে তিনটি অক্ষর E.I.C.—অর্থাৎ East India Company—তাজ্জব! চিঠির তারিখ 1868 সালের। অর্থাৎ কোম্পানির আমল শেষ হবার দশ বছর পর। সে সময় নিশ্চয় ডাকঘরে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ডাক টিকিট বিক্রি হত না। তখনই খোঁজ নিয়ে দেখলাম, ঐ গোলাকৃতি টিকিট দুটি সর্বপ্রথম ভারতীয় ডাকটিকিট-ওর বর্তমান বাজার দর ষোলো হাজার টাকা। ইংরাজি খামে চৌকো আধ-আনার টিকিটখানির দাম আট হাজার টাকা আর সবচেয়ে দামি হচ্ছে ঐ রানী ভিক্টোরিয়ার উল্টো করে ছাপা চার আনার টিকিটখানা। ঐ একখানা টিকিটের দাম আশি হাজার টাকা!

—আশি হাজার টাকা! কেমন করে জানলেন?

—ন্যাশনাল লাইব্রেরির 383.22085 / G352/নম্বর গ্রন্থের 193নং পৃষ্ঠায়! ভুলে উল্টোভাবে ছাপা এমন টিকিট মাত্র খানকতক আছে পৃথিবীতে। দৃষ্টিশক্তি চিরতরে খোয়াবার নোটিস পেয়ে গোকুলচন্দ্র বিলাত থেকে ঐ দুর্লভ ডাক-টিকিটগুলি সংগ্রহ করেন। সর্বসমক্ষে তা ফেলে রাখেন কুট কৌশলে দিনলিপিতে ঐ নির্দেশ দিয়ে। অবিনাশ হাতে পেলেও তার অর্থ বুঝত না। অদ্ভুত কৌশল করেছিলেন তোমার দাদাশ্বশুর।

ট্যাক্সি ড্রাইভার এসে দাঁড়ায়। জানায় তার ভাড়া উঠেছে— একুশ টাকা।

মিনতি তাকে তিনখানা দশটাকার নোট দিয়ে বলে, তোড়ানি আপ রাখ দিজিয়ে!

সর্দারজির ‘হাঁটা এতবড় যে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলের ভিতর দিয়েও তা দেখা গেল স্পষ্ট। মস্ত সেলাম করে বিদায় হল।

বাসু বলেন, এটা ‘কিম্প্রকার’ ব্যবস্থা মিন্টিদিদি? অবধান কর ট্যাক্সি চালকের ক্ষেত্রে নয় তঙ্কা বকশিস্ এবং অস্মদীয়-ক্ষেত্রে একতঙ্কা ফি?

মিনতি হাসতে হাসতে বলে, আপনাকে আমার সর্বস্ব দিলেও যে ঋণ শোধ হবে না। বলুন কী প্রণামী দেব?

—আপাতত তোমাদের ঐ ওয়েডিং কেক থেকে একটা ম্যাগনাম-সাইজ কর্তৃতাংশ! রঞ্জন লাফিয়ে ওঠে—ওয়েডিং কেক! বাই জোভ! কাল না আমাদের বিয়ে! মিন্টি! তোমার মনে ছিল?

মিনতি বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে মুচকি হেসে বললে, এ জন্যও আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ! এতদিনে ঐতিহাসিক-মশায়ের মনে পড়েছে—আগামীকাল আমাদের জীবনে একটি চিহ্নিত খণ্ডকাল!

শিবনাথ ততক্ষণে প্রকাণ্ড একটা ফুলের তোড়া আর কেক-এর প্লেটটা নামিয়ে রাখছে সেন্টার-টেবল-এ।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *