কুলের কাঁটা – ৭

সাতদিনের মাথায় রাজগির থেকে ফিরে এসে রঞ্জন উপস্থিত হল দুর্লভ নিকেতনে। এবার দরজা খুলে দিল লছমী। রঞ্জনকে দেখে বিচিত্র হাসল। বললে, আসুন। আপনাকে রোজই আশা করছি।

রঞ্জন ভিতরে বললে, তাই নাকি? কেউ আমার পথ চেয়ে অপেক্ষা করছে জানা থাকলে আগে আসতাম। সে কথা নয়, কিন্তু তুমি এখানে কেন এসেছিলে ‘লছমী’?

—লছমী! সিংহবাহিনী নয় তাহলে?

—না মিন্টি নয়।

মেয়েটি চমকে ওঠে। রঞ্জন এক নিঃশ্বাসে বলে যায় ভুল ভুলই, –তোমাকে মিনতি মনে করে অনেক প্রভতা আমি করেছি। সে জন্য আজ লজ্জা হচ্ছে। তোমার হচ্ছে কি না জানি না। সে যাক, তুমি এখন কী করবে?

লছমী নয়ন নত করল। অনেকক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবল। তারপর যখন মুখ তুলল, তখন দেখা গেল ওর চোখের কোনায় জল টলটল করছে। বললে, আমি এখন কী করব তা বলছি; কিন্তু তার আগে আর একটা প্রশ্নের জবাব দেবেন? সত্যি করে জবাব দেবেন?

—বলো কী জানতে চাও?

—ধরুন, আমি যদি সেই মিনতিই হতাম এবং দাদুর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতাম, তাহলে আপনি কী করতেন?

রঞ্জন বলে, ও অবান্তর প্রশ্নের কী জবাব দেব? তুমি তো সেই মিনতি নও?

—নাই হই! তবু…..তবু আমার প্রশ্নের জবাবটা দেবেন?

—তোমার এ প্রশ্নের জবাব তো আমি সেদিনই দিয়েছি, লছমী। মিনতিকে যেদিন আমি ভালবেসেছিলাম, সেদিন আমরা কিশোর কিশোরী—সব কথা বুঝতাম না। কিন্তু সেদিন মিনতি বড়লোকের নাতনি ছিল না। তারপরে ঘটনা তো দেখতেই পাচ্ছ। তাকে ভুলতে পারলে এতদিনে আমি নিশ্চয় সংসার শুরু করতাম।

লছমীর চোখ দুটো জ্বলে ওঠে। ঝুঁকে পড়ে বলে, তাহলে আর একটা কথাও বলে যান বাবুজি। ধরুন আমি লছমীই, প্রবঞ্চক, ঠগ— এসেছি সম্পত্তির লোভে। আমার কথা থাক। কিন্তু আপনি হঠাৎ আপনার সেই হারিয়ে যাওয়া সিংহবাহিনীর প্রতিমাটিকে আবিষ্কার করলেন একটা পচা নর্দমায়! একটা ঘৃণিত পরিবেশে! তার জরির সাজ খুলে গেছে। সে শুধু উলঙ্গই নয়, তার দেহ গলে গেছে, খড়-মাটি বেরিয়ে পড়েছে। তখন আপনি কী করতেন?

রঞ্জন উঠে দাঁড়ায়। বলে, তোমার সঙ্গে প্রলাপ বকতে আমি আসি না লছমী। আমি এসেছি অধ্যাপক গোকুলচন্দ্রকে তোমার সত্য পরিচয়টা জানিয়ে যেতে। ইতিমধ্যে আমি রাজগির ঘুরে এসেছি। তোমার সব ছলনার অবসান ঘটেছে। সরো, পথ ছাড়ো।

হঠাৎ শিউরে ওঠে লছমী। বলে, কী জেনে এসেছেন আপনি?

—তোমার সব কথা! হাসপাতাল রেজিস্টারে তোমার জন্ম ইতিহাস! তোমার মায়ের নাম…

থর থর করে কেঁপে ওঠে লছমী। একেবারে ভেঙে পড়ে। বসে পড়ে রঞ্জনের পায়ের ওপর। অশ্রু আর্দ্র কণ্ঠে বলে, সব মিছে কথা রঞ্জন! সব মিথ্যা! আমি আমি সেই মিন্টিই!

রঞ্জন ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ভিতরে চলে যায়।

সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে অধ্যাপক গোকুলচন্দ্র বললেন, আমি এমনটিই আন্দাজ করেছিলাম। আমি যে জানি, অবিনাশ একটা প্রবঞ্চক। ঠগ। তোমরা সবাই ভুল করলেও ডেভিল ভুল করেনি। লছমীকে দেখলেই সে তারস্বরে ডাকতে থাকে। চেন ছিঁড়ে ফেলতে চায়।

রঞ্জন বলে, এখন কী করবেন স্যার? মানে, ঐ মেয়েটাকে….

—তুমি কী পরামর্শ দাও?

—ওকে তার বাপের কাছে পাঠিয়ে দিন। মেয়েটাও ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছিল! বৃদ্ধ অনেকক্ষণ কী যেন ভাবেন। তারপর বলেন, একটা কথা তোমাকে বলি -তোমার বয়স কম, রক্ত গরম। কিন্তু আমি তো দুনিয়াদারী শেষ করে এসেছি। তুমি ঐ মেয়েটার ওপর যতটা রাগ করেছ, আমি ততটা করতে পারছি না। ভেবে দেখ –এ দুনিয়ায় মানুষের কাছে, সংসারের কাছে, সমাজের কাছে ও কী পেয়েছে? মানুষ হয়েছে ঐ শনিচরীর শনিদৃষ্টিতে— দুবেলা দুমুঠো খেতেও হয়তো পায়নি। বিয়ে হল, অথচ স্বামী নিল না। বাপ তার রক্ত জল করা টাকায় গহনা বানিয়ে দিল—সেগুলো ছিনিয়ে নিয়ে গেল ওর শ্বশুর। বিনিময়ে ওর মাথায় চাপিয়ে গেল কলঙ্কের বোঝা। এভাবেই পূর্ণ যুবতী হল সে –তারপর ওদের সংসারে এল অবিনাশ। লোভ দেখালো মেয়েটাকে। জীবনের পঁচিশটা বছর যে মেয়েটা স্নেহ পায়নি, ভালবাসা পায়নি, শখ-আহ্লাদের জিনিস তো দূরের কথা, ভরপেট খেতেই পায়নি—তার সামনে অবিনাশ মেলে ধরল বিরাট প্রলোভন। কলকাতা শহর একটি বিহারী যুবতীর কাছে স্বর্গরাজ্য। সেই স্বর্গরাজ্যের এক ধনীর নাতনী হবার লোভ দেখাল অবিনাশ। নিত্য নতুন শাড়ি, গহনা, মোটরগাড়ি; সিনেমা থিয়েটার নাচগান! মাথা ঘুরে গেল মেয়েটার। কিন্তু রঞ্জন, সেজন্য সবটুকু শাস্তি কী ঐ হতভাগীরই পাওনা?

রঞ্জন স্থির হয়ে বসে রইল কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর নিচু হয়ে প্রণাম করল বৃদ্ধকে! বললে এজন্যে শাস্ত্রে গুরুর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। আমি এভাবে ভেবে দেখিনি। –না, মেয়েটাকে আমি খালি হাতে বিদায় দেব না। আফটার অল, হতভাগীটাকে দেখতে সোনামণির মতো!— গলাটা ধরে এল বৃদ্ধের

—বেশ তো। দেবেন তাকে কিছু টাকা।

—না! ‘কিছু’ টাকা নয়, ‘বেশ কিছু’ টাকা! সোনামণি আর ফিরে আসবে না। আমি বেশ বুঝতে পারছি। তাহলে কার জন্যে এ কুবেরের ধন রেখে যাব আমি? তুমি এক কাজ করো। টেবিলের ড্রয়ারে আমার অ্যাড্রেস বইটা আছে। নিয়ে এসো, দেখো ওতে ‘বাসু প্রসন্নকুমার, বার অ্যাট-ল-র’ ঠিকানা আছে। তাঁকে খবর দাও। আমাকে তিনি চেনেন। বলো, কাল সকালে নয়টার সময় তিনি যেন অবশ্য অবশ্য আসেন। আমি একটি উইল করব। আমি অন্ধ, সই যাতে ‘ভ্যালিড’হয় তার ব্যবস্থা তিনি করবেন। হয়তো টিপছাপ দিতে হবে। তুমিও এসো। অবিনাশকে কাল বেলা দশটার সময় আসতে বলো। সর্বসমক্ষেই আমি উইলটা করতে চাই।

রঞ্জন ঠিকানাটা টুকে নিয়ে বিদায় হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *