কুলের কাঁটা – ৫

টুকটুক করে হার্ডল রেসের সব কয়টা বেড়াই অবিনাশ নির্বিঘ্নে ডিঙিয়ে আসছিলেন, হোঁচট খেলেন একেবারে শেষ লেংথে। সবাই মেনে নিল লছমীকে –মিনতি হিসাবে, কেউ কেউ দর্শন মাত্রেই। নিল না মাত্র দু-জন। এবং মোক্ষম দু-জন। স্বয়ং গোকুলচন্দ্র এবং তাঁর পেডিগ্রিড কুকুর-ডেভিল।

ডেভিল নিশাচর। দিনের বেলা মোটা চেন দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা হয়। বাগানে তার নির্দিষ্ট ঘরে। দুর্লভ স্মৃতিমন্দিরের’ মুখোমুখি। ঐ স্মৃতিমন্দিরটার কথা বলা হয়নি। বাগানের একান্তে গোকুল একটি ঘর তুলেছিলেন। সেটাই ওঁর গবেষণাগার। সেখানে বই, বই আর বই। কাঠের আলমারির মাঝখানে একটা মজবুত গোদরেজের আলমারি। তাতে রাখা ছিল ওঁর গবেষণার মূল দলিলপত্র। ‘পেস্ট-কনট্রোল সার্ভিস’ থেকে প্রতিমাসে তাতে কীটনাশক ‘স্প্রে’ করে যায়। ঐ ঘরের পাশেই ছাতিমতলায় সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো চত্বর। সেখানে বংশের আদিপুরুষ গোকুলের প্রপিতামহ দুর্লভচন্দ্রের নামে একটি শ্বেতপাথরের স্মৃতি-ফলক। সেটি পাঠ করলে জানা যায়—দুর্লভচন্দ্রের জন্ম 1825 সালে এবং তিরোধান 1869 সালে। ঐ স্মৃতিমন্দিরের পাশেই ডেভিল-এর কেনেল।

অবিনাশ ও আরাধনাকে ডেভিল ভালমতোই চেনে, কিন্তু ওদের সঙ্গে লছমীকে ঢুকতে দেখে সে যে তারস্বরে গর্জন শুরু করল তা আর থামতেই চায় না। অবিনাশের মনে হল, মানুষের চোখে ধুলো দিলেও ঐ জানোয়ারটার চোখে তিনি ধুলো ছড়াতে পারবেন না কোনোদিনই। শিবনাথ-দুর্গামণি ওকে কিন্তু মেনে নিল। দুর্গামণি তো ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল লছমীকে—এতদিনে আমাদের কথা মনে পড়ল হতভাগী!

গোকুল কিন্তু সংবাদটা শুনে গুম মেরে গেলেন। না হাসি, না কান্না। না আবাহন, না বিসর্জন! ঘরের প্রবেশপথে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে ওরা—শিবনাথ, দুর্গামণি, অবিনাশ, আরাধনা, গিরিনবাবু। লছমী যা অভিনয় করল তাতে মুগ্ধ হয়ে গেলেন অবিনাশ। সে ছুটে এসে লুটিয়ে পড়ল বৃদ্ধের পাঁজর-সর্বস্ব বুকে। তারপর তার কী ফুলে ফুলে কান্না। স্তম্ভিত হয়ে গেলেন অবিনাশ। এমন বুকফাটা কান্না কেমন করে কাঁদছে মেয়েটা। হয়তো অন্ধ বৃদ্ধের কাছে ঐ কান্নার নৈবেদে সে বলতে চাইছে— তুমি আমাকে ক্ষমা করো। বিশ্বাস করো, তোমার সম্পত্তির লোভে আমি আসিনি। তোমার ঐ পাঁজর সর্বস্ব বুকে আশ্রয় নিতেই এসেছি শুধু। আম প্রবঞ্চক নই— আমি এক হতভাগিনী।

বৃদ্ধ যেন পাষাণ হয়ে গেছেন। হাতখানাও রাখলেন না ওর মাথায়।

অবিনাশ কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, মিন্টু ফিরে এসেছে চৌধুরী মশাই। আপনি ওকে আশীর্বাদ করুন।

বৃদ্ধ না রাম, না গঙ্গা।

আরাধনা ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে এসে ধরে তুললেন লছমীকে। বললেন, উনি একেবারে অভিভূত হয়ে পড়েছেন। ওঁকে একটু সামলাতে দে মিন্টু। আয় উঠে যায়।

লছমী কিন্তু সে কথায় কর্ণপাতও করল না। নাট্যসম্রাজ্ঞীর মতো আর্তনাদ করে ওঠে—দাদু, তুমি বিশ্বাস করছ না? আমি মিন্টু মিন্টু তোমার সোনামণি

ওরা ধরাধরি করে ওকে সরিয়ে নিয়ে গেল। একতলার বাগানে তখনও ডেভিল তীব্র স্বরে প্রতিবাদ করে চলেছে—তোমরা বিশ্বাস কোরো না। ও প্রবঞ্চক! ও ঠগ্‌!

ঘণ্টাখানেক পরের কথা। এ ঘরে তখন জমাটি আড্ডা। অবিনাশ সবাইকে সবিস্তার শোনাচ্ছেন—কেমন করে তিনি হারানো মেয়ে খুঁজে পেলেন। হঠাৎ শিবু এসে বলল, আপনাদের দুজনকে বুড়োকত্তা ডাকতিছেন!

গল্পে ছেদ পড়ল। বুড়ো কর্তার তাহলে এতক্ষণে ‘সান’ হয়েছে। দুজনে উঠে এলেন এ ঘরে। গোকুল বললেন, বোসো তোমরা দুজন। দরজাটা বন্ধ করে দাও।

রুদ্ধদ্বার কক্ষে গোকুল বললেন, এবার বলো কোথায় জোগাড় করলে ওকে?

—আপনি বিশ্বাস করছেন, না— ঐ আমাদের মিণ্টি?

—বিশ্বাস যাতে করতে পারি তাই তো তোমার গল্পটা শুনতে চাইছি। এমন একটা গল্প শোনাও যা অতি নাটকীয় না মনে হয়, আবার আষাঢ়ে বলেও না মনে হয়। নাও শুরু কর।

অবিনাশ পনেরো দিন ধরে মনে মনে যা মহড়া দিয়ে রেখেছেন তাই গড় গড় করে বলে গেলেন। দীর্ঘ কাহিনি শেষ হলে গোকুল শুধু বললেন সুন্দর গল্পটা। তবে যাবার সময় মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে যেও, না হলে ডেভিল আমাকে ঘুমোতে দেবে না।

অবিনাশের হাতে বন্দুক থাকলে হয়তো ডেভিলকে গুলি করে মারতেন। ঢোক গিলে বলেন, চৌধুরী মশাই, বলা সহজ, কিন্তু কোথায় ওকে নিয়ে যাব বলুন? আমার বাড়িতে? নাকি রাজগিরে তার পালক-পিতার আশ্রয়ে?

—সে তোমার মাথাব্যথা!

হঠাৎ দ্বারের কাছ থেকে শিবনাথ বলে ওঠে, তাহলে ঐ সঙ্গে আমাদের দুজনকেও বিদায় দ্যান কর্তা। আপনে অন্য লোক দেখুন।

বৃদ্ধ ধমকে ওঠেন, তোকে কে কথা বলতে ডেকেছে?

—কেউ ডাকে নাই কর্তা! আমি চাকর, আপনে মনিব! তবু আমি মনিষ্যি তো বটে! আপনে চোখে দেখেন না, আমরা যে জলজ্যান্ত দেখছি মিন্টি-মাকে।

বৃদ্ধ এক মুহূর্ত নীরব থেকে বলেন, ঠিক আছে। কী নাম মেয়েটার?

—মিনতি, মিন্টি!

—আহ! সে-কথা বলছি না। ওর বাপ, সেই পাণ্ডা ওকে কী নামে ডাকে?

— আজ্ঞে লছমী।

—ঠিক আছে। লছমী এ বাড়িতেই থাকবে।

ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল অবিনাশের।

সন্ধ্যার পর শিবনাথ আর দুর্গামণি আবার এল দরবার করতে। শিবু বলে, আপনি তো চোখে দেখেন না, গায়েও হাত বুলালেন না। তাহলে কেমন করে জানলেন…

গোকুল বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, আমি চোখে দেখি না ঠিকই–সেজন্যে তিন তিনটে কেষ্টর জীব পুষেছি। একটা ষাঁড়, একটা গরু আর একটা কুকুর। তিনটের মধ্যে ঘ্রাণশক্তি আর বুদ্ধি আছে ঐ কুকুরটারই। সে আমাকে বলে দিয়েছে।

দুর্গামণি বলে, কিন্তু ওর মুখখানা দেখলে…

—জানি। মুখখানা একরকম না হলে অবিনাশ এতবড় দুঃসাহস দেখাত না!

বস্তুত ওরা দুজন জানে না গোকুল এ ঘটনার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। পূর্বদিন সন্ধ্যায় রঞ্জন এসেছিল ‘দুর্লভ নিকেতনে’। গোকুল সব কথা তার কাছ থেকে শুনেছেন। আজ সকালে লছমীকে নিয়ে যে অবিনাশ আসছে তাও জানতেন। গোকুল বলেছিলেন, আশ্চর্য! সে তোমাকে চিনতেই পারল না?

—না স্যার। ওর সব পূর্বস্মৃতি নাকি হারিয়ে গেছে।

বৃদ্ধ বলেছিলেন, কিন্তু তোমার নিশ্চয় মনে আছে রঞ্জন— আজ থেকে চোদ্দো-পনেরো বছর আগে আমি একদিন তোমাকে ডেকে প্রচণ্ড ধমক দিয়েছিলাম?

রঞ্জন চুপ করে বসে থাকে। জবাব দেয় না।

একটা হাত বাড়িয়ে ওর হাতখানা টেনে নিয়ে অন্ধ বলেন, ভুল বুঝো না আমাকে। একটা বিশেষ কারণে ও-কথা বললাম। মেয়েরা জীবনে সব কিছু ভোলে, ভুলতে পারে না একটি জিনিস—তার জীবনের প্রথম প্রেমকে। তোমাদের দুজনকে হাতে-নাতে ধরে ফেলেছিলাম আমি সিঁড়ির মধ্যে। সে ঘটনার কথা এ দুনিয়ায় জানে শুধু তিনজন—তুমি, আমি আর সেই হতভাগী! অথচ দেখে নিও, কাল সকালে এসে সে এ বাড়ির সবাইকে চিনতে পারবে। তার কারণটা কী জানো? এদের সকলের ফটো আছে অবিনাশের অ্যালবামে। তোমার ফটো নেই। তোমার সঙ্গে সোনামণির যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার কথা অবিনাশ জানে না!

বৃদ্ধ জানতে পারেননি—তাঁর শ্রোতা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল শুনে। তাহলে কি মেয়েটা সেই সিংহবাহিনী নয়! প্ৰবঞ্চক!

কাল কি সেই জন্যই মেয়েটা তার রঞ্জনদাকে চিনতে পারেনি! কিন্তু ওর মুখটা, ওর চাহনিটা, সেই নিচেকার ঠোঁট কামড়ানো ভঙ্গিটা — আশ্চর্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *