কুলের কাঁটা – ১০

১০

দিন দুয়েক পরে বাসু-সাহেব আবার এসে হাজিরা দিলেন দুর্লভ নিকেতনে। কেউ তাঁকে উকিল হিসাবে নিয়োজিত করেনি—যদিও তিনি ছিলেন স্বর্গত গোকুলচন্দ্রের আইন পরামর্শদাতা। বয়সে গোকুল ছিলেন অনেক বড় বস্তুত বাসু-সাহেবের সিনিয়র এ. কে রে ছিলেন গোকুলের বন্ধু। সেই সূত্রেই গোকুলের সঙ্গে তাঁর আলাপ-তাঁর নামটা লেখা ছিল গোকুলচন্দ্রের অ্যাড্রেস-বুক এ। কিন্তু না, ঠিক বন্ধুকৃত্য করতে তিনি আসেননি, এসেছিলেন ঐ মৃত্যু রহস্যের অমোঘ আকর্ষণে। ঘটনাটা অদ্ভুত রহস্যময়। কে-কেন-কী করে রাতারাতি গোকুলকে হত্যা করল?

বাসু গাড়ি থেকে নেমে বৈঠকখানাতে এসে দেখেন সেখানে আরও দুজন বসে আছেন, মিনতি ছাড়াও। রঞ্জন আর তার মা। গোকুলের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে রঞ্জনের মা এসেছেন ছেলেকে নিয়ে দেখা করতে। রঞ্জনই অভ্যর্থনা করে বাসু-সাহেবকে নিয়ে গিয়ে বসাল—আসুন স্যার! আপনার কথা মা এখনই বলছিলেন। পরিচয় করিয়ে দিই—ইনি আমার মা। মা, ইনি ব্যারিস্টার পি. কে বাসু। যাঁর কথা তোমাকে বলছিলাম।

রঞ্জনের মা যুক্তকরে নমস্কার করে বললেন, ভাববেন না, রঞ্জুর কাছ থেকেই আপনার কথা প্রথম শুনলাম। আপনার অনেক কীর্তি-কাহিনির কথা আমি পড়েছি। এখনই রঞ্জুকে বলছিলাম, আপনাকে খবর দেওয়ার কথা—

—আমাকে? কেন? কী ব্যাপারে?

—এই কেসটা আপনাকে নিতে হবে। প্রফেসর রায়চৌধুরীর কেসটা

বাসু-সাহেব পকেট থেকে পাইপ আর পাউচ বার করে বললেন, হুঁ! কিন্তু কার তরফে? কে আমার মক্কেল?

—আমার পুত্রবধূ!

শুধু বাসু নন, রঞ্জনও চমকে তাকায় বক্তার দিকে। শান্তভাবে রঞ্জনের মা, মিসেস্ মমতা সরকার বললেন, মিনতি রায়চৌধুরী আমার ভাবী পুত্রবধূ। এ হাঙ্গামা মিটে গেলেই—

রঞ্জন আর মিনতি বিহ্বল হয়ে পরস্পরের দিকে তাকায়।

বাসু বলেন, কিন্তু এই মেয়েটি মিনতি রায়চৌধুরী, না লছমী শর্মা তা তো স্থির-সিদ্ধান্ত হয়নি।

—সে জন্যই তো আপনাকে প্রয়োজন। সেটা আপনার কাজ। আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, ঐ মেয়েটিকেই আমার ঘরে পুত্রবধূ করে নিয়ে যাব। এ কথাটাই আজ ওকে জানাতে এসেছিলাম।

মিনতি দুই হাতে মুখ ঢেকে হঠাৎ ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে।

মমতা উঠে এলেন তাঁর সোফা থেকে। মিনতির পিঠে একটি হাত রেখে বললেন, পাশের ঘরে উঠে যা মিন্টি। প্রাণভরে কেঁদে মুখে চোখে জল দিয়ে ফিরে আয়। তোকে সব কথা খুলে বলতে হবে ওঁকে।

মিনতি কী যেন বলতে গেল, পারল না। উদ্গাত অশ্রুর ধমক কোনোক্রমে চেপে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।

বাসু তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে আনলেন রঞ্জন আর তার মায়ের দিকে। বললেন, মিসেস সরকার, কেসটা হাতে নেবার আমারও প্রবল বাসনা। তার কারণ এর চেয়ে জটিলতর কোনো কেস আমি আমার লিগ্যাল-কেরিয়ারে কখনও পাইনি। ইন ফ্যাক্ট, সে জন্যই অনাহুত আমি ছুটে এসেছি। কে-কেন-কীভাবে রাতারাতি প্রফেসর রায়চৌধুরীকে হত্যা করল সেটা আমাকে বুঝে দেখতে হবে। কিন্তু তার আগে এই অবকাশে আপনাকে দু-একটা কথা বলে নিতে চাই। ঐ মেয়েটি যদি মিনতি রায়চৌধুরী না হয়, প্রবঞ্চক লছমী শর্মাই হয়, তাহলেও কি আপনি ওকে পুত্রবধূ করতে চান?

মমতা দেবী সপ্রতিভভাবে জবাবে বললেন, সে প্রশ্নের জবাব আমি দেব না, দেবে রঞ্জন। আমি শুধু চাই আমার ছেলে সংসারী হোক।

বাসু-সাহেব সপ্রশ্ন দৃষ্টি মেলে ধরেন রঞ্জনের দিকে!

রঞ্জনও সপ্রতিভভাবে বললে — প্রশ্নটা অবৈধ, কারণ ও নিঃসন্দেহে মিন্টি! আমি জানি!

বাসু শ্রাগ করলেন। মমতার দিকে ফিরে বললেন, আরও একটা কথা। যদি ও মিনতিই হয়, তাহলে এ-কথা আশঙ্কা করার যথেষ্ট যুক্তি আছে যে, প্রথম যৌবনে—অর্থাৎ ডাকাতের হাতে ও নিগৃহীতা হয়েছিল-ওর জীবনের কয়েকটা বছর…

—আমি জানি! অর্থাৎ আন্দাজ করতে পারি। সে জন্য আমার তরফে কোনও বাধা নেই-মমতা দেবী পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন। বোধ করি বাসু সাহেবকে শিখণ্ডী করে মাতা-পুত্র নিজেদের মনের কথা জানিয়ে দেবার একটা সুযোগই খুঁজছিলেন।

রঞ্জন বললে, আপনি কেন বললেন, এর চেয়ে জটিলতর কোনো কেস আপনি পাননি কখনও?

—বিবেচনা করে দেখো। মোটিভ-এর দিক থেকে দুজন মাত্র সন্দেহজনক ব্যক্তি। শিবনাথ, দুর্গামণি বা গিরিনবাবু সন্দেহের বাইরে। তাঁদের কোনও মোটিভ নেই। সকলেই আজ দশ-বারো বছর আছেন এ পরিবারে। গোকুলের খাদ্যে বিষ মেশানোর প্রচুর সুযোগ তাঁরা পেয়েছেন। কখনও তার প্রয়োজন হয়নি-আজও এমন কিছু ঘটেনি যাতে ওরা অমন একটা কাণ্ড করতে পারে। সন্দেহ ঘনীভূত হয় মাত্র দুটি ব্যক্তির উপর। এক অবিনাশ। তার মোটিভ আছে; কিন্তু স্কোপ নেই। কিছুমাত্র সুযোগ সে পায়নি। সন্ধ্যা নাগাদ সে দুর্লভ নিকেতন’ ত্যাগ করে যায়। তার তিন-চার ঘণ্টা পরে গোকুল নৈশাহার সারেন। ফলে তাঁর খাদ্যে বা পানীয়ে অবিনাশ বা আরাধনা বিষ মেশাতে পারেন না। শিবনাথ বা দুর্গামণি এতই বিশ্বস্ত যে, তাদের দ্বারা ও কাজ করানো অবিনাশের পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব। তাই নয়?

কেউ জবাব দেয় না। বাসু সাহেবকেই তাই বাধ্য হয়ে পুনরায় শুরু করতে হল। দ্বিতীয় সমাধান—যে-কথা অবিনাশবাবু বলেছেন, তাই মেনে নেওয়া। অর্থাৎ ঐ মেয়েটিই…

রঞ্জন বাধা দিয়ে বলে ওঠে—অসম্ভব!

বাসু প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলে ওঠেন-ডোন্ট বি ইমোশনাল! আমরা অ্যাকাডেমিক ডিস্কাশন করছি। যুক্তি-নির্ভর সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি! অবিনাশ যা বললেন, তা যদি সত্যি হয় অর্থাৎ ঐ মেয়েটি যদি সত্যিই মিনতি রায়চৌধুরী না হয়, সে যদি বাস্তবে প্রবঞ্চক লছমী শর্মা হয়, তাহলে সেটাই হচ্ছে এ সমস্যার সমাধান। একমাত্র সমাধান! তাই মাফ করবেন মিসেস সরকার–কেস হিস্ট্রিটা আদ্যন্ত না শুনে আমি কথা দিতে পারছি না।

রঞ্জন কী একটা কথা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই তার মা বলে ওঠেন, তার মানে মিন্টির কাছে সব কিছু শুনে যদি আপনি সিদ্ধান্তে আসেন যে, সে এই জঘন্য আপরাধ করেনি তাহলেই আপনি কেসটা নেবেন?

—একজ্যাক্টলি!

—আর যদি আপনার সিদ্ধান্ত হয়, সেই অপরাধী!

—তাহলে আমার পরামর্শ—সে ‘গিলটি প্লিড’ করুক। অপরাধ স্বীকার করে আইনত সাজা নিক। অবশ্য ইচ্ছা করলে সে অন্য কোনও আইনজ্ঞ ব্যক্তির দ্বারস্থও হতে পারে।

রঞ্জন উঠে দাঁড়ায়। বলে, ওকে ডাকব?

—ডাকো।

একটু পরেই মেয়েটি ফিরে এল। এতক্ষণে সে নিজেকে সামলেছে। কিন্তু এবার সে একা প্রবেশ করল না ঘরে। তার সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ করল সিংহশাবকের মত প্রকাণ্ড একটা গ্রেট ডেন। মেয়েটি বসল একটা সোফায়। ডেভিল এগিয়ে এসে রঞ্জন, তার মা এবং বাসু সাহেবের কাছে গিয়ে ঘ্রাণ নিল। মেয়েটি বললে, স্টে! ডেভিল! চুপ করে বস এখানে।

সিংহবাহিনীর পদপ্রান্তে বসল ডেভিল। ওর পায়ের উপর মাথাটা রেখে গা এলিয়ে দিল। তার দিকে নিষ্পলক নেত্রে তাকিয়ে রইলেন কয়েকটা মুহূর্ত, তারপর মমতার দিকে ফিরে বাসু বললেন-আই উইথড্র, মিসেস্ সরকার! আমি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি! কেসটা আমি নিলাম!

রঞ্জন আর তার মা পরস্পরের দিকে তাকায়।

মিনতি বলে, কীসের কেস?

বাসু বলেন, কিছু নয়। এবার তুমি সব কথা খুলে বলো দিকি? সেদিন যেটুকু শুনেছি ঠিক তারপর থেকে। ডেভিলের ভয়ে অবিনাশ বিদায় হলেন। এইটুকুই সেদিন বলেছিলে। তারপর? তারপর যা যা ঘটল আনুপূর্বিক বলে যাও।

মেয়েটি পরবর্তী ঘটনার বর্ণনা দেয়—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *