এক্স এজেন্ট – ৫

পাঁচ

অ্যান্টোনিন নিকোলভ ও তার মেয়ে উধাও হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে কয়েকটা দিন।

ফ্রান্সের নরম্যাণ্ডিতে রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির নতুন শাখা খুলেছে মাসুদ রানা। এখনও সব গুছিয়ে উঠতে পারেনি। সামনের বড় ঘরে মাঝারি চারটে ডেস্ক ও আরামদায়ক বারোটা চেয়ার। এখনও বিসিআই থেকে হাজির হয়নি জুনিয়র চার এজেন্ট। প্রবেশ পথের পাশে রিসেপশনিস্টের চকচকে কালো কাউন্টার। ববকাট চুলের হাসিখুশি মেয়ে নীলা দত্ত বসেছে ওদিকের চেয়ারে। ভেতরের মাঝারি একটা ঘরে নিজের ডেস্কের পেছনে বসে আছে রানা। একটু আগে ওর সামনে কড়া কালো কফির মগ রেখে আবারও নিজের কাউন্টারে ফিরেছে নীলা। তার আগে বলে গেছে, ফোন করেছিলেন বয়স্ক এক ভদ্রলোক। তিনিই হয়তো হবেন ওদের প্রথম ক্লায়েন্ট। একটু পর পৌঁছেও যাবেন বলেছেন।

এ কথা শোনার পর কফিতে চুমুক দিয়ে গুনগুন করে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় একটা গানের কলি ভাঁজল রানা দু’লাইন। বলা বাহুল্য, সুরটা ওর নিজস্ব- আর-কেউ টের পাবে না কী-গান গাইতে চেষ্টা করছে। ফুরফুর করছে মন। ভুল করেনি এ শহরে শাখা খুলে। তবে একটু পর মৃদু কুঁচকে গেল ওর ভুরু। এইমাত্র মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে রাস্তার ওপাশে সবুজ ঘাসের বিশাল মাঠে নেমেছে এক হেলিকপ্টার। ওটাতে করেই এল নাকি ক্লায়েন্ট? তা হলে ধরে নিতে হবে পয়সাওয়ালা লোক। নিজের পরিচয় দেয়নি ক্লায়েন্ট। দিলে তার নাম ওকে বলত নীলা

তৈরি হয়ে নিল রানা। মনে মনে বলল, এবার দেখাও, বাছা, তুমি কতটা ব্যস্ত। পাশ থেকে কালো কার্ডবোর্ডের ফোল্ডার নিয়ে সামনে রাখল রানা। ওপরের ঢাকনা খুলে গম্ভীর চেহারায় তাকাল ভেতরে। আগেই ওখানে রেখেছে পুরনো কয়েকটা বাংলা খবরের কাগজ।

ধৈর্যের সঙ্গে পার করল পুরো পাঁচ মিনিট, তারপর বলে উঠল রানা, ‘আরে ধূর! একটু উঁকি দিয়ে দেখো তো, নীলা, হেলিকপ্টারওয়ালা বোধহয় আর কোথাও এসেছে অন্য কাজে!’

তখনই দরজার ওপাশ থেকে বলল নীলা, ‘মাসুদ ভাই, এক ভদ্রলোক আর এক ভদ্রমহিলা এসেছেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আমি কি তাঁদেরকে ভেতরে পাঠিয়ে দেব?’

ভারী কণ্ঠে বলল রানা, ‘ঠিক আছে, পাঠিয়ে দাও।’

একমিনিট পর দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল কেউ। ইচ্ছে করেই একটু দেরিতে ফোল্ডার থেকে চোখ তুলল রানা। তখনই টের পেল, মাঠে মারা গেছে ওর সমস্ত অভিনয়। বৃদ্ধকে ভাল করেই চেনে ও। বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের দূর সম্পর্কের বন্ধু তিনি। পাশেই পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়সী এক মহিলা। চোখের জলে ভেসে গেছে গালের মেকআপ। বোঝা গেল সমস্যাটা কার।

পশ্চিম ইউরোপের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রীয়-শক্তি বলা হয় এই বৃদ্ধকে। নাম লুকা ব্রেনেভ। জাতে রাশান। বিলিয়নেয়ার। জন্মেছিলেন জার্মানির রটওয়েইল শহরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চলে আসেন ফ্রান্সে। নব্বুইয়ের দশকে হয়ে ওঠেন পৃথিবীর দশজন বড়লোকের একজন। রানার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল লণ্ডনে বিসিআই চিফের দেয়া এক পার্টিতে। কয়েক বছর পর ব্যবসায়িক এক প্রতিযোগী তাঁকে খুন করাতে চাইলে, তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার জন্যে রানা এজেন্সির সাহায্য নিয়েছিলেন তিনি।

বিসিআই চিফ রাহাত খানের মতই টনটনে রয়েছেন বৃদ্ধ, যেন নিয়মিত শর্ষের তেল মাখানো পাকা বেত। রানা খবরের কাগজে পড়েছে, ফোর্বস লিস্টে তিনি আপাতত আছেন দুনিয়ার চতুর্থ ধনী হিসেবে। বুড়োর পাশের মহিলার চুল ওভাবে চুড়ো করে বাঁধতে গিয়ে অন্তত আট ঘণ্টা নিয়েছে নামকরা বিউটিশিয়ান। মহিলাকে আগে কখনও দেখেনি রানা। মনে মনে বলল, ‘কই, শুনিনি তো আবারও বিয়ে করেছেন ব্রেযনেভ!’

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সামনের দুই চেয়ার হাতের ইশারায় দেখাল ও। ‘আসুন, প্লিয, বসুন।’

বরাবরের মত হ্যাণ্ডশেক করলেন না বিলিয়নেয়ার। ধপ্ করে বসলেন আরামদায়ক চেয়ারে। পাশেই বসল মহিলা। ছোট্ট ব্যাগ থেকে ফেইশাল টিশু নিয়ে মুছল দু’চোখের কোণ। রানা নিজে বসতেই লুকা ব্রেনেভ বললেন, ‘আগেই ফোন করিনি বলে ক্ষমা চাই, রানা। কল করতাম, কিন্তু…’

‘কোনও সমস্যা নেই,’ সহজ সুরে বলল রানা। ‘খুশি হয়েছি আপনি নিজে এসেছেন।’ সরাসরি কাজের কথায় গেল ও, ‘বোধহয় বড় ধরনের কোনও সমস্যা?’

রুক্ষ কংক্রিটের মত কঠোর হলো বৃদ্ধের চেহারা। ‘হ্যাঁ, রানা, খুব বাজে ধরনের সমস্যা।’

ডেস্কের নিচে মেঝেতে আছে ছোট সুইচ, সেটা পা দিয়ে টিপে দিল রানা। মুখে বলল, ‘একটু খুলে বলুন।’ অবাক হয়েছে। সোনালি চুলের মহিলার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেননি বিলিয়নেয়ার। এ ধরনের অভদ্রতা কখনও করেন না তিনি।

‘রানা, ও আমার ভাইঝি তামারা,’ বললেন বৃদ্ধ, ‘বছর দুয়েক আগে এসেছে ফ্রান্সে। ইংরেজি, জার্মান, ডাচ আর রাশান ভাষায় কথা বলতে পারে। তবে মাত্র শিখতে শুরু করেছে ফ্রেঞ্চ। আমি চাই আমাদের আলাপে যোগ দিক। তাই ভাল হয় ইংরেজিতে কথা বললে।’

‘বেশ,’ ইংরেজিতে বলল রানা।

আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে মহিলা। তার সঙ্গে রানার পরিচয় করিয়ে দিলেন লুকা ব্রেনেভ। ম্লান হাসি দিয়ে চুপ করে থাকল মহিলা।

‘হঠাৎ এসে বিরক্ত করছি বলে আবারও ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, রানা,’ বললেন ব্রেনেভ। ‘না এসে উপায় ছিল না। আমি… আমরা… আসলে… পড়েছি মস্তবড় বিপদে। তাই এসেছি সাহায্য পাওয়ার আশায়। ব্যাপারটা এতই জটিল, নিজেই ছুটে না এসে পারিনি।’

রানার মনে পড়ল সর্বক্ষণ আতঙ্কে থাকেন বৃদ্ধ। প্রতিদিন গুবরে পোকা আর হ্যাকিঙের ভয়ে পরীক্ষা করান তাঁর বিশাল বাড়ির প্রতিটি টেলিফোন ও ইন্টারনেট কানেকশন। লে ম্যান্স এলাকায় ওই বাড়িটাকে বলা চলে সত্যিকারের বিশাল দুর্গ। জীবনের ওপর হামলা হওয়ার পর থেকেই বেশিরভাগ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছেন ভদ্রলোক। আজ খুব জরুরি প্রয়োজন না হলে নিজের দুর্গ ছেড়ে বেরোতেন না।

রানা তাঁর কাছে কিছু জানতে চাওয়ার আগেই ট্রে হাতে ঘরে ঢুকল নীলা। দক্ষতার সঙ্গে দুই অতিথির সামনে নামিয়ে দিল এক প্লেট দামি সল্টেড বিস্কুট ও দুই কাপ কফি। নীলা চলে যেতেই বলল রানা, ‘মনে হচ্ছে সমস্যাটা ম্যাডাম তামারার?’

মৃদু মাথা দোলালেন বিলিয়নেয়ার। ‘ও আমার ভাই ওলেগের একমাত্র সন্তান। ভাই মারা গেছে কয়েক বছর আগে। তবে আমার নিজের মেয়ে থাকলে তাকে ওর চেয়ে বেশি ভালবাসতাম না।’ চুপ হয়ে গেলেন বৃদ্ধ।

‘স্বাভাবিক,’ বলল রানা।

ঘোলা চোখে নীরবে ডেস্কের কাঁচের দিকে চেয়ে আছে মহিলা। কয়েক মুহূর্ত পর আবার শুরু করলেন ব্রেযনেভ, ‘ওর পুরো নাম তামারা নিকোলভ। তবে তামারা ব্রেনে ভ নামটাই বেশি পছন্দ করি। অন্য কোনও জাতির পদবি নিলেও আপত্তি তুলতাম না। কিন্তু দুঃখের কথা, মস্ত ভুল করে তামারা বিয়ে করেছিল এক রাশানকে।’ শেষ বাক্যটা যেন তিক্ততা থেকেই বললেন। ‘ওর কপাল ভাল, মাত্র দশ বছর বৈবাহিক জীবন কাটিয়েই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। খুব বাজেভাবে তালাক হয়ে যায়। ওই বিষয়ে বাড়তি কথা বলে তোমাকে বিরক্ত করতে চাই না।’

‘আপনার পরিবারের সমস্যার কথা শুনে খারাপ লাগছে,’ ভদ্রতার সঙ্গে জানাল রানা। বুঝতে পারছে না কোন্ দিকে বইছে আলাপের স্রোত।

মাথা নাড়লেন ব্রেযনেভ। ‘আমারও খুব খারাপ লেগেছে। প্রথম থেকেই বলে এসেছি, ওই লোককে বিয়ে করে ভুল করছে তামারা। অ্যান্টোনিন নিকোলভ সবসময়েই ছিল খুব নিচু মনের একটা পশু। ওর চেয়ে খারাপ কাউকে আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি।’

চুপ করে থাকল রানা।

‘আমার লক্ষ্মী ভাতিজির স্বামী হওয়ার কোনও যোগ্যতাই ছিল না তার,’ বললেন ব্রেনেভ, ‘বা তামারার সন্তান… বা আমার নাতনির বাবা হওয়ার। ওর চেয়ে নীচ, স্বার্থপর, নোংরা পশু এ পৃথিবীতে আগেও ছিল না। মহা হারামি লোক সে।’ রেগে গেছেন বলে বৃদ্ধের ঠোঁটের কোণে জমেছে খানিকটা ফেনা। হাতের চেটো দিয়ে মুখ মুছলেন তিনি। ‘উত্তেজিত হয়ে গিয়েছি, মাফ কোরো, রানা। তালাক হওয়ার দু’বছর পরেও আমাদের জীবনটা দুর্বিষহ করে রেখেছে লোকটা। দশ বছর আমস্টারড্যামে আটকে রেখে অকথ্য মানসিক নির্যাতন করেছে তামারাকে। জানোয়ারটা আমাদেরকে বলেছিল ওখানে চাকরি করে সে। যদিও কোনওদিন জানতে পারিনি কী কাজ করে। আমার তো মনে হতো লোকটা…’ থেমে গেলেন ব্রেযনেভ।

এবার আলাপে যোগ দেয়ার সুযোগ নেবে মহিলা, ভাবল রানা। কিন্তু ওর ধারণা ভুল। নতুন করে শুরু করলেন বিলিয়নেয়ার, ‘বিরাট এক ভুল করল তামারা। ওই নরপশুর সঙ্গে বাস করতে গিয়ে মা হলো। আমি আগেই বলেছিলাম, এত বড় ভুল করতে যাস্ নে। পরে আফসোস করবি। কিন্তু শুনল না ও।’ তিক্ত চেহারা করে ভাতিজিকে দেখলেন তিনি। ‘আমি বলছি না যে বাচ্চা মেয়েটার কোনও মানসিক সমস্যা আছে। হাসিখুশি, লক্ষ্মী মেয়ে। নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসি ওকে। ওর জন্যে মরতেও রাজি হয়ে যাব। আর সেজন্যেই আজ এসেছি তোমার কাছে সাহায্য চাইতে। …যাই হোক, আমার কথা শুনল না তামারা। আর তাই ওই নিরেট গাধাটা পেয়ে বসল ওকে। বছরে অন্তত দু’বার যেন বাচ্চা মেয়েটাকে পাঠানো হয় তার কাছে। আরও খারাপ কথা, খচ্চরটা থাকে মস্কো শহরে।’ ভুরু কুঁচকে ফেললেন ব্রেযনেভ।

এখন পর্যন্ত টু শব্দ করেনি মহিলা। এবার মুখ খুলবে, তেমন সম্ভাবনাও দেখছে না রানা। কাজেই বিলিয়নেয়ারের কাছেই জানতে চাইল, ‘মেয়েটার নাম কী?’

‘ইউনা। ওর বয়স এখন বারো।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ব্রেনেভ। ‘ওর বাবার একপয়সাও দাম নেই আমার কাছে। কিন্তু ইউনার জন্যে নিজের সবকিছু বিসর্জন দিতেও রাজি আছি। ওর খারাপ কিছু হয়ে গেলে…’

বিলিয়নেয়ারের কণ্ঠে অসহায়ত্ব টের পেল রানা। বুঝে গেল, মূল বিষয়ের দিকে যাচ্ছেন তিনি। ‘কোনও ধরনের বিপদ হয়েছে ইউনার?’

ফাঁকা চোখে ডেস্কের কাঁচ দেখছে মহিলা।

আস্তে করে মাথা দোলালেন বিলিয়নেয়ার। ছলছল করছে দুই চোখ। মরিয়া হয়ে উঠেছেন সাহায্য পাওয়ার জন্যে। ‘হ্যাঁ। ভয়ানক বিপদ! হঠাৎ করেই ইউনাকে নিয়ে মস্কো থেকে উধাও হয়ে গেছে ওর বাবা। আমরা ভাল করেই জানি, কেন এমন করেছে সে। টাকার জন্যে নিজের মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে কুত্তাটা।’

ছয়

বেশ ক’বছর ধরে গোটা পৃথিবীতেই বেড়ে গেছে নিরীহ, নিরপরাধ, অসহায় শিশু ও কিশোরদের কিডন্যাপিং। এটা করছে একদল মানবরূপী জঘন্য জানোয়ার। নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত করে এরা। গত তিন বছরে এ ধরনের কয়েকটি কেস হাতে নিয়েছে রানা এজেন্সি। দেশে-বিদেশে পুলিশবাহিনীর এক্স এজেণ্ট চেয়ে অনেক বেশি সাফল্য পেয়েছে বাঙালি ছেলেরা। রানার নির্দেশে প্রয়োজনে কিডন্যাপারদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর হয়েছে ওরা। প্রত্যেকেই জানে, কত ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় বাচ্চারা। একবার কিডন্যাপ হলে বাকি জীবন দেখতে হয় দুঃসহ দুঃস্বপ্ন। লুকা ব্রেযনেভের কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেছে রানা। এমন কেসের কথাও ও জানে, যেখানে প্রাক্তন স্বামী বা স্ত্রী একে অপরের ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে কিডন্যাপারদের দিয়ে নির্যাতন করিয়েছে নিজ সন্তানকে। অনেক সময় আইনের জাল গুটিয়ে আনলে সন্তানকে ভয়ানক ঝুঁকির ভেতর ফেলে অভিভাবক। রানার চোখে চোখ রেখে ব্রেনেভ বললেন, ‘ভুলে যাইনি কী বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিলে তুমি আমাকে। তাই আবারও সাহায্য চাইছি তোমার কাছে, রানা। আমার ব্যক্তিগত স্যাটেলাইট ব্যবহার করে কল দিয়েছিলাম রাহাতকে। কিন্তু সব শুনে বলল, ও নিশ্চিত নয় আমার এই কাজটা তুমি নেবে কি না। এক্ষেত্রে কোনও নির্দেশ দেয়ার অধিকারও ওর নেই।’

‘পুলিশে যোগাযোগ করেছেন?’ জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়লেন ব্রেনেভ। ‘অনেকে বলবে পুলিশের কাছে যাওয়া উচিত। কিন্তু তার ফলে বিরাট কোনও ক্ষতি হতে পারে ইউনার। জানি, অনেক সময়ে পুলিশের ভুলে মারা পড়ে জিম্মি। আর এটা ভেবেই এখনও আইনের সাহায্য চাইনি। আমি যে এখনও বেঁচে আছি, সেজন্যে চিরঋণী তোমার কাছে। মনে করি তুমি আমার রক্তের আত্মীয়র মত। তাই ছুটে এসেছি তোমার কাছে।’

চুপ করে আছে রানা।

‘তুমি যদি ইউনাকে ফিরিয়ে আনার কাজটা নাও, আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারব।’ চেয়ারে ঝুঁকে বসলেন বিধ্বস্ত বিলিয়নেয়ার। ‘প্লিয, বিপদ থেকে সরিয়ে আনো মেয়েটাকে। ওর তো কোনও দোষ নেই। ও কেন এভাবে ভুগবে?’ গলা শুকিয়ে গেছে বৃদ্ধের। কাপ তুলে কফিতে চুমুক দিলেন। ‘প্রতিবার ইউনা মস্কো যাওয়ার সময় বা ফেরার সময় ব্যবহার করে আমার ব্যক্তিগত গাস্ট্রিম জেট। প্রাইভেট টার্মিনাল থেকে ওর বাবা ওকে নিয়ে যায় নিজের অ্যাপার্টমেন্টে। ওটা খুব বাজে এলাকায়। সাধারণত পাঁচ দিন ওখানে থাকে ইউনা। তারপর ফিরে আসে আমাদের কাছে। বেচারি যেন হয়ে গেছে শারাপোভা- সেরেনার টেনিস বলের মত। এতদিন মানসিক কষ্ট পেলেও লোকটার আইনী অধিকারের কথা ভেবে কোনও আপত্তি তুলিনি আমরা।

‘কিন্তু চার দিন আগে ফিরে আসার কথা ইউনার। আমার পাইলট এয়ারপোর্ট থেকে ফোনে জানাল, বিমানে তুলে দেয়ার জন্যে ইউনাকে পৌঁছে দেয়নি নিকোলভ। পরে বাধ্য হয়ে খালি বিমান ফিরিয়ে আনি লে ম্যান্সে। তারপর থেকে পাগলের মত যোগাযোগ করতে চাইছি জানোয়ারটার সঙ্গে।’

‘হয়তো সে ভেবেছে আরও ক’টা দিন ঘুরে যাক ইউনা,’ বলল রানা।

‘আমার তা মনে হয় না,’ নাক দিয়ে ঘোঁৎ আওয়াজ তুললেন ব্রেযনেভ। ‘সে তেমন ধরনের লোকই নয়।’

বাড়তি চার দিন খুব বেশি নয়, মনে মনে বলল রানা। আবার ভয়ানক বাজে কিছু ঘটতে দশ মিনিটও লাগে না।

‘আমি নিজে আয়েশ করে বসে নেই,’ বললেন বিলিয়নেয়ার। ‘খালি বিমান ফেরার পর নতুন করে ভরা হয়েছে ফিউয়েল। তারপর আমার সেরা গার্ডদেরকে ওটাতে করে পাঠিয়ে দিয়েছি মস্কোয়। তাদের একজন ভাল রাশান জানে। দলের সবাইকে নিয়ে চোখ রেখেছে সে নিকোলভের অ্যাপার্টমেন্টের ওপর। ইউনার জন্যে চারপাশে খোঁজও নিচ্ছে।’

‘অ্যাপার্টমেন্টে বোধহয় কেউ ছিল না?’

‘তা তো ছিলই না! প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কয়েক দিন হলো নিকোলভ আর ইউনা আর ফেরেনি ওখানে। এয়ারপোর্টেও যায়নি ওরা। আর সেজন্যেই মনে হচ্ছে টাকার জন্যে নিজের মেয়েকে জিম্মি করেছে নিকোলভ।

প্রথমবারের মত মুখ খুলল তামারা। ইংরেজি উচ্চারণে জার্মান টান। ‘আরও কিছু কথা চাচা বলেননি। ইউনা হারিয়ে যাওয়ার আগে ওর খামখেয়ালির জন্যে আইনী ব্যবস্থা নেব বলে নিকোলভকে ই-মেইল করেছিলাম।’

‘আপনি কি অপমান করেছিলেন নিকোলভকে?’ জিজ্ঞেস না করে পারল না রানা।

‘না, তেমন কিছু করিনি,’ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মহিলার মুখ। ‘ওর গাফিলতিতে তিন-তিনবার দেখা না করেই ইউনাকে ফিরে আসতে হয়েছিল বলে ওকথা বলেছিলাম। মেয়েকে নিতে আসেনি সে এয়ারপোর্টে।’

‘কে জানে এখন কী করছে জানোয়ারটা,’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ব্রেযনেভ। কড়া চোখে দেখলেন ভাতিজিকে। ‘মন খারাপ করে ফিরেছে ইউনা। সেজন্যে দুঃখ প্রকাশও করেনি কুকুরটা। ফলে আমার ভাতিজি রেগে যায়।

মহিলার দিকে তাকাল রানা। ‘আপনি তাকে হুমকি দেন?’

‘তার আগে আলাপ করেছি উকিলের সঙ্গে, বলল তামারা। চোখে অসহায় দৃষ্টি। ‘তারা যখন বলল বাচ্চার প্রতি অবহেলা করেছে বলে নিকোলভের বিরুদ্ধে মামলা করলে আর কখনও আমার মেয়েকে রাশায় পাঠাতে হবে না, তখন তাদের কাছ থেকেই লিখিয়ে নিয়েছি চিঠিটা।’ কাঁদো- কাঁদো হয়ে গেছে সে। চোখের কোণে টলমল করছে অশ্রু। আঙুল দিয়ে ডলতেই কাদাটে মত হয়ে গেল মাসকারা। ‘খুব রেগে গিয়েছিলাম। বুঝতে পারিনি কী করছি। এখন বুঝতে পারছি, সব দোষ আসলে আমার।’

‘তোর কোনও ভুল হয়নি,’ বললেন ব্রেযনেভ, ‘বছরের পর বছর মিথ্যার পর মিথ্যা বলেছে ওই হারামি। একদম ঠিক কাজই করেছিস। তোর মনে নেই, কতবার আমাকে বলেছিস, ওই লোকটার ওপর ভরসা রাখা যায় না? দায়িত্ব পালন করতে শেখেনি সে। দিনের পর দিন ভোদকা গিলে বাড়ি ফিরেছে। সামান্যতম সময় দেয়নি নিজের স্ত্রী আর সন্তানকে। কাজেই নিজের ওপর দোষ চাপিয়ে দিস্ নে।’

আস্তে করে মাথা দোলাল তামারা। ‘হ্যাঁ, এটা ঠিক। শেষ কয়েক বছর বেশিরভাগ সময় মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরত। বারবার বোঝাতে চেয়েছি ইউনাকে। কিন্তু নিজের বাবার দোষ কিছুতেই দেখতে পেত না মেয়ে। তবে সত্যি হচ্ছে, মানসিকভাবে স্থির ছিল না নিকোলভ। তালাক হয়ে যাওয়ার পর আরও অধঃপতন হয়েছে তার।’

‘অসম্ভব মিথ্যুক,’ রাগী গলায় বললেন ব্রেযনেভ। ‘তোরা যখন আমস্টারড্যামে থাকতি, কী কাজ যে করত স্রেফ স্রষ্টাই জানেন। তবে আমার বহুবার মনে হয়েছে, আসলে কোথাও কোনও চাকরি করে না সে। এখনও যে খারাপ কিছুর সঙ্গে জড়িত, সেটাও লিখে দিতে পারি। শুধু যে মিথ্যুক তা নয়, সে আসলে প্রায় দেউলিয়া এক ড্রাগ অ্যাডিক্ট। আমস্টারড্যাম শহরটাই তো ওদের মত পশুতে ভরা।’

ওর কী হলো তা নিয়ে ভাবছি না,’ তিক্ত সুরে বলল তামারা। ‘যা খুশি করে বেড়াক। আমি শুধু ফেরত চাই আমার মেয়েকে।’ রানার চোখে তাকাল সে। ‘আপনি তো বুঝতে পেরেছেন, আমি যদি হুমকি না দিতাম, নিজের মেয়েকে কিডন্যাপ করত না সে। আমার চিঠি পেয়ে ঘাবড়ে যায়। তাই পুরো দোষ আসলে আমার। আর এখন এরপর কী হবে ঈশ্বর জানেন! হয়তো আর কোনও দিন দেখতে পাব না আমার বুকের ধনকে। নতুন করে অশ্রু নামল তার গাল বেয়ে।

ডিভোর্সি স্বামী ও স্ত্রীর ঝগড়ার ভেতর পড়ে কিডন্যাপ হয়েছে বাচ্চা একটা মেয়ে, এখন এমনই মনে হচ্ছে রানার। মুখে বলল না কিছু। ওর মনে হচ্ছে না নিজের মেয়ের ক্ষতি করবে নিকোলভ— বিশেষ করে মেয়ের যখন পূর্ণ আস্থা ও ভালবাসা আছে বাবার প্রতি।

‘প্লিয, রানা,’ কাতর সুরে বললেন ব্রেনেভ, ‘তুমি কি সাহায্য করবে আমাদেরকে?’

চিন্তায় পড়েছে রানা। ফুরিয়ে এল ওর ছুটি। ক’দিন পর দেশে ফিরে যোগ দিতে হবে অফিসে। ওর পক্ষে সম্ভব হবে না রাশায় গিয়ে মেয়েটাকে খুঁজে বের করা। ভেবে বের করতে চাইল, উপযুক্ত কারও কাছে কেসটা দেয়া যায় কি না। চট্ করে মনে পড়ল না কাউকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর জানতে চাইল ও, ‘এখনও কি আপনার লোক ওই অ্যাপার্টমেন্টের ওপর চোখ রাখছে?’

মাথা দোলালেন ব্রেযনেভ। ‘হ্যাঁ। নিকোলভ ওখানে ফিরলে সঙ্গে সঙ্গে জানব। রাশান সরকারের ওপরমহলে হাত আছে আমার। কুকুরটা ওই দেশ থেকে বেরোতে চাইলে ঠেকিয়ে দেবে তারা। তাদের ধারণা, এখনও রাশার ভেতরেই আছে সে।’

‘রাশা বিশাল দেশ,’ বলল রানা। ‘নিকোলভ কোথায় আছে, সে বিষয়ে কোনও পরিষ্কার ধারণা আছে আপনাদের?’

‘না, নেই,’ মাথা নাড়লেন বিলিয়নেয়ার। ‘হয়তো আছে চলার পথে।

‘তা হলে তো বিপদ,’ বলল রানা, ‘শুধু মস্কো শহরেই হাজারো খারাপ জায়গা আছে, যেখানে লুকিয়ে থাকতে পারবে ইউনাকে নিয়ে। আর রাশা তো ষাট লাখ স্কয়্যার মাইলের দেশ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়। ওখানে আছে ডযনখানেক বড় শহর। এ ছাড়া আছে বিশাল জায়গা জুড়ে পাহাড়ি এলাকা। আছে এমন জঙ্গল, যেগুলোর একেকটার আকার ইংল্যাণ্ডের চেয়েও বেশি। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ নদী ওখানে। একদিকে

একদিকে প্রশান্ত মহাসাগর, আরেক দিকে আর্কটিক সাগর। মাসের পর মাস খুঁজেও এভাবে পাবেন না ইউনাকে। তবে রাশান কর্তৃপক্ষের আছে লাখ লাখ পুলিশ ও সেনাবাহিনী। তারা চাইলে কয়েক দিনে খুঁজে বের করতে পারবে অ্যান্টোনিন নিকোলভকে। আমার একার পক্ষে কিছু করা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।

‘টাকার অভাব হবে না। তুমি চাইলে…’

‘টাকা দিয়ে সবসময় সবকিছু পাওয়া যায় না, মিস্টার ব্রেনেভ,’ বলল রানা।

‘আমি খরচ করতে পারব কয়েক বিলিয়ন ডলার।’

‘তা জানি।’

‘দয়া করে আমাদেরকে সাহায্য করো, রানা,’ মুখ নিচু করে বললেন বিলিয়নেয়ার। ‘রাশায় গিয়ে খুঁজে আনো ইউনাকে। আর কাউকে এই দায়িত্ব দিয়ে স্বস্তি পাব না। আমার লোক তোমার তুলনায় একদম আনাড়ি। প্লিয, রানা!’

কাতর চোখে ওর দিকে চেয়ে আছে অসহায় দু’জন মানুষ, কী বলবে ভেবে পেল না রানা। মন বলছে, কিছুই করার নেই ওর। তবুও ইতিবাচক কিছু বলতে হবে। চেয়ারে হেলান দিল রানা। নরম সুরে বলল, ‘পরে আপনাদেরকে জানাব কাজটা নিতে পারব কি না।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন লুকা ব্রেযনেভ। বিড়বিড় করলেন, ‘ঠিক আছে, রানা। আমরা তোমার সিদ্ধান্তের জন্যে অপেক্ষা করব। এবার ফিরব লে ম্যান্সে।’ দামি বিস্কিট যেমন ছিল তেমনি ফেলে ভাতিজির হাত ধরে চেয়ার ছাড়লেন তিনি। রানার মনে হলো মানসিকভাবে ধসে গেছেন দু’জনই। নীরবে ওর অফিস ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন চাচা-ভাতিজি।

থম্ ধরে বসে থাকল রানা। খচ্-খচ্ করছে মনের ভেতর। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই মনে হচ্ছিল, আগেও কোথাও দেখেছে তামারাকে। এবার চট্ করে মনে পড়ল সুন্দরী স্টেনো টাইপিস্ট নাসরীন রেহানার কথা। আলাভোলা, সরল মনের লক্ষ্মী মেয়ে। ওকে খুন করেছিল চরম নিষ্ঠুর এক নরপশু। রেহানার কথা মনে পড়েছে বলেই হঠাৎ নরম হয়ে গেল রানার অন্তরটা। মনে হলো, ওর উচিত তামারাকে সাধ্যমত সাহায্য করা। একটু পর শুনল কপ্টারের টারবাইন ও রোটরের গর্জন। আনমনে ভাবল, অফিস থেকে ছুটি পেলে চেষ্টা করে দেখত ইউনাকে উদ্ধার করতে পারে কি না।

ল্যাণ্ড ফোনের দিকে হাত বাড়াল রানা। তখনই টিং করে মৃদু শব্দ করল মোবাইল ফোন। বাটন টিপে মেসেজ ফোল্ডারে গিয়ে নতুন মেসেজ খুলতেই দেখল, বাংলায় লিখেছেন বিসিআই চিফ: রানা, এখানে খুব জরুরি কাজ নেই, তাই আরও পনেরো দিন বাড়িয়ে দেয়া হলো তোমার ছুটি।

মৃদু হাসল রানা। বুড়োবাঘ মরলেও অনুরোধ করবেন না, তবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, খুশি হবেন তাঁর বন্ধুকে সাহায্য করলে।

ঠাণ্ডা কফি রেখে গোটা চারেক বিস্কিট মুখে পুরে চেয়ার ছাড়ল রানা। ঠিক করেছে, বিকেলেই পৌঁছে যাবে লে ম্যান্সে লুকা ব্রেযনেভের দুর্গে।

সাত

লে ম্যান্সে বিশাল এলাকা জুড়ে বিলিয়নেয়ার লুকা ব্রেযনেভের এস্টেট। প্রকাণ্ড দুর্গটা সতেরো শতকের। আগে ওটার মালিক ছিল রথচাইল্ড পরিবার। এ এলাকায় প্রবেশ করা পেন্টাগনের মতই দুর্গম। তবে রওনা হয়ে ব্রেযনেভের পিএকে ফোন করেছে রানা, জানিয়ে দিয়েছে আসছে দেখা করতে। নইলে পেরোতে পারত না সুরক্ষিত গেট। ভেতরে দু’পাশে বাগান। মাঝের পিচঢালা পথে পুরো বিশ মিনিট এগোবার পর দুর্গের কাছে পৌঁছুল রানা। দু’দিকে ও পেছনে ঢেউ খেলানো সবুজ মাঠে চরছে দেখার মত অপূর্ব সব আরবি ঘোড়া। মাঝে বিশাল জায়গা নিয়ে আঙুরের খেত। একপাশে কাঁচের মত মসৃণ নীল জলের লেক। জেটিতে বিকেলের মৃদু হাওয়ায় দুলছে একটা ঝকঝকে সেইল ক্রুযার।

চারপাশ যেন ছবির মতই সুন্দর।

পার্কিং লটে দামি সব সুপার কারের পাশে নিজের গাড়ি রাখল রানা। নেমে পড়ে দেখল বারোক স্থাপত্যের দুর্গটা। পুরু কলাম ও টারেট উঠেছে বহু ওপরে। বিশাল ফোয়ারার মাঝে শিকারের দেবী ডায়ানার ব্রোঞ্জ মূর্তি। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে কোটি জলবিন্দুর তৈরি রামধনু। পার্কিং লট থেকে দুর্গের দিকে গেছে নুড়িপাথরের পথ। দুর্গের কাছে তুবড়ে যাওয়া পুরনো এক রেনও ফোর গাড়ি। রানা ভাল করেই জানে, ওটা নিজে ব্যবহার করেন লুকা ব্রেযনেভ। কোনটা উচিত আর কোটা অনুচিত, তা নিয়ে তাঁর আছে অদ্ভুত ভাবনা। শোনা যায় খরচ কমাতে প্রিয় স্ত্রীর কবরে বছরে একবার কমদামি প্লাস্টিকের ফুল রাখেন তিনি।

রানা সিঁড়ির কাছে যেতেই হঠাৎ কোথা থেকে হাজির হলো সাদা পোশাকের দু’জন সিকিউরিটি গার্ড। সতর্ক তাদের চোখ। আগে ছিল মিলিটারিতে। ঝামেলা দেখলেই জ্যাকেট থেকে বের করবে অটোমেটিক পিস্তল। দক্ষ, কারণ রানা নিজেই চাকরি দেয়ার আগে বিশেষ ট্রেইনিং দিয়েছে তাদেরকে।

‘আমার আসার কথা ছিল,’ বলল রানা।

ওকে চিনতে পেরে মৃদু হাসল দুই গার্ড। কয়েক সেকেণ্ডে গায়েব হলো দুটো কলামের আড়ালে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই রানা দেখল সদর দরজা খোলা। ওখানে দাঁড়িয়ে আছে এক বাটলার। পরনে কালো ওয়েস্ট কোট, হাতে সাদা গ্লাভ্স্‌। চুলগুলো তেলতেলে। হাতের ইশারায় রানাকে পথ দেখাল সে। সামনেই পড়ল মার্বেলের তৈরি বিশাল হলওয়ে। দু’জনের পদশব্দের প্রতিধ্বনি ফিরছে ছাতের গম্বুজ থেকে। দু’দিকের দেয়ালে সারি সারি গ্রিক মূর্তি, সব আসল। দাম লক্ষ লক্ষ ডলার। বিশাল এক দরজার সামনে থামল বাটলার। ওই কবাট দিয়ে অনায়াসে ঢুকতে পারবে কিংকং। দু’বার টোকা দেয়ার পর দরজা খুলে নীরবে রানাকে ভেতরে যেতে ইশারা করল বাটলার।

প্রশস্ত জানালার সামনে পায়চারি করছেন ব্রেযনেভ। জানালার ওদিকে ফুলের ঢেউখেলানো অপূর্ব সুন্দর রঙিন বাগান। ব্রেযনেভের চেহারা দেখে রানার মনে হলো, কয়েক ঘণ্টায় অন্তত বিশ বছর বেড়ে গেছে বয়স। কপাল ও গালে চিন্তার ভাঁজ। ওকে দেখে ছুটে এলেন তিনি। খপ্ করে হাতটা ধরে হ্যাণ্ডশেক করলেন। খুবই খুশি যে দায়িত্ব নেবে রানা। নাতনি কী বিপদে আছে ভাবতে গিয়ে দুই চোখে চলে এসেছে অশ্রু।

‘ভেবেছিলাম হয়তো আসবে না,’ বললেন ব্রেযনেভ, এসেছ, সেজন্যে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, রানা। ‘

‘নতুন কিছু ঘটেছে?’ সরাসরি কাজের কথায় এল রানা।

গম্ভীর চেহারায় মাথা নাড়লেন বিলিয়নেয়ার। ‘না। সব আগের মতই। কোনও খোঁজ পাইনি ইউনার। প্রতি মুহূর্তে হয়তো দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে জানোয়ারটা ওকে নিয়ে।

ঝটকা দিয়ে খুলে গেছে প্রকাণ্ড ঘরের দরজা। ভেতরে ঢুকল তামারা। এখন পরনে নতুন পোশাক। কাঁধে একই রঙের ছোট্ট হ্যাণ্ডব্যাগ। একটু আগেও কাঁদছিল মহিলা। চাচার সঙ্গে ঘরে কে দেখে প্রায় ছুটে এল। খুশিতে জড়িয়ে ধরল রানাকে। আরেকটু হলে তার কপালের গুঁতো খেয়ে খাড়া নাকটা যেত রানার। তামারা যেভাবে অ্যানাকোণ্ডার মত জড়িয়ে ধরেছে, তাতে হাঁফ লেগে গেল ওর। ‘বাটলার বলল অতিথি এসেছেন। তবে আপনি সত্যিই আসবেন তা বিশ্বাস করতে পারিনি। ধন্যবাদ, অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনি এসেছেন বলে।’

মহিলার শক্ত আঙুলগুলো ভেঙে নিজেকে রক্ষা করবে কি না ভাবতে ভাবতে বলল রানা, ‘জী, এসেছি।’ নিজেকে ছাড়িয়ে নিল কঠিন মৃত্যু-আলিঙ্গন থেকে।

‘এবার আর চিন্তা নেই, তামারা,’ বললেন লুকা ব্রেনেভ। ‘তবে প্রথম কথা টাকা। রানা, তোমার ফি দিয়েই শুরু করা যাক আলোচনা।’

‘গতবার আমাকে কত দিয়েছিলেন মনে আছে?’

‘তুমি তো কিছুই নাওনি!’

এবারও নেব না। আমাকে চারআনা পয়সাও দিতে হবে না,’ পরিষ্কার জানিয়ে দিল রানা। ‘আমি এসেছি আমার বসের সম্মান রক্ষার জন্যে।’

‘তা ঠিক, আমি জানি সোনার টুকরো ক’টা ছেলে পেয়েছে রাহাত,’ বললেন ব্রেযনেভ। ‘তবে টাকা সবসময়ই কাজে আসে। ওটা তেলের মত। সঙ্গে থাকলে ঠিকভাবে চলে মেশিন। যদি ইউনাকে উদ্ধার করতে গিয়ে কয়েক কোটি টাকাও লাগে, আমার কোনও দ্বিধা নেই তা খরচ করতে। যে-কোনও পরিমাণের টাকা তুমি ব্যয় করতে পারো।’ জ্যাকেটের পকেট থেকে পুরনো কোঁচকানো ওয়ালেট বের করলেন ব্রেনেভ। ওটা থেকে নিলেন নতুন একটা ক্রেডিট কার্ড। ওটার ওপর ব্রেযনেভ কর্পোরেশনের লোগো।

‘খরচ মেটাবে এটা থেকে। দুনিয়ার যে-কোনও দেশের যে-কোনও ধরনের টাকা তুলতে পারবে। লিমিট সেট করা আছে সপ্তাহে পাঁচ মিলিয়ন ইউরো। তবে দরকার হলে জাস্ট একবার শুধু ফোন দেবে আমাকে। দ্বিগুণ করে দেব এক্সপেন্স অ্যাকাউন্ট। খরচ করতে দ্বিধা করবে না। এ ছাড়া, রাশায় যাওয়ার সময় খরচের জন্যে সঙ্গে নেবে বাড়তি কিছু রুবল।’

কার্ডটা নিল রানা। ওটার গুণে ব্যয় করতে পারবে প্রতি সপ্তাহে পাঁচ মিলিয়ন ইউরো। একটু অবাকই লাগল ওর।

‘আরেকটা ব্যাপার। তুমি আপত্তি না তুললে তোমাকে রাশায় সাহায্য করবে ওখানকার একজন দক্ষ গোয়েন্দা। তোমার প্রতিটি কথা মেনে চলবে সে।’

‘আপনার কর্পোরেশনের কোনও গোয়েন্দা?’ জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়লেন ব্রেযনেভ। ‘তা নয়। তবে শুনেছি খুব দক্ষ সে। মস্কো শহরের সবই চেনে। ওই শহরের সেরা ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে ভাড়া করেছি।’ ধূসর দাঁতগুলো বের করে শুকনো হাসলেন বৃদ্ধ। চট্ করে দেখলেন হাতঘড়ি। ওটা ক্যাসিও কোম্পানির সবচেয়ে সস্তা ডিজিটাল মডেল। ‘যেহেতু টাকার ব্যবস্থা হয়েছে, আমাদের বোধহয় দেরি করা ঠিক নয়। রানা, কখন রওনা হতে চাও মস্কোর দিকে?’

‘ট্র্যাভেল ভিসাটা পেলেই,’ বলল রানা।

ডানহাত নাড়লেন ব্রেযনেভ। মনে হলো : মাছি তাড়াচ্ছেন। ‘ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আগেই সব করে রাখা হয়েছে।’

‘সেক্ষেত্রে এখনই রওনা হতে চাই,’ বলল রানা।

‘তৈরি আছে বিমান,’ বললেন ব্রেযনেভ, ‘ম্যান্স-অনাজ এয়ারপোর্টে আছে। তুমি চেনো ফ্লাইট ক্রুদেরকে। বরাবরের মতই বিমান চালাবে ক্যাপ্টেন রবার্ট স্টিফান আর কো- পাইলট এদোমন্দ মার্কাস। মস্কোতে পৌঁছুতে লাগবে তিন ঘণ্টা এগারো মিনিট। ওখানে তখন প্রায় সন্ধ্যা। তোমার সঙ্গে যাবে আমার শেফ। তাকে বললে যে-কোনও খাবার তৈরি করে দেবে। বিমান নামবে শহর থেকে আটাশ কিলোমিটার দূরে ভিআনুকোভা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। ওখানে অপেক্ষা করবে তোমার অ্যাসিন্ট্যান্ট। গাড়ি করে পৌছে দেবে হোটেলে। আশা করি তোমার খারাপ লাগবে না ওদের দেয়া কামরা।’

‘বিলাসবহুল কোনও কামরা চাইছি না,’ বলল রানা।

‘বিশেষ ভাল নয় ওই হোটেল, তবে আশা করি ওখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে।’

‘রওনা হওয়ার আগে টুকটাক আরও কয়েকটা বিষয় আছে,’ বলল রানা। ‘প্রথমেই লাগবে ইউনার একটা ফোটো।’

ছোট্ট হাতব্যাগ থেকে চকচকে একটা ছবি বের করে রানার হাতে দিল তামারা। ‘কয়েক দিন আগে তোলা।’

গাঢ় চুলের হাসিখুশি এক মেয়ের ছবি দেখল রানা। চিকচিক করছে বাদামি চোখ। ছবিটা তোলা হয়েছে লেকের পাড়ে। তামারা বলল, ‘ওর ঘরে আরও ছবি আছে। দেখতে চান?’

মাথা দোলাল রানা।

চাচা ও রানাকে পেছনে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরোল তামারা। চারপাশের মেঝের মার্বেল ঢেকে রেখেছে অমূল্য সব কার্পেট। আসবাবপত্র রাজকীয়। চওড়া এক সিঁড়ি বেয়ে উঠে দ্বিতীয়তলায় বিশাল এক বেডরুমে ঢুকল ওরা। দামি যে-কোনও পেন্টহাউসের চেয়েও আধুনিক ও সুন্দর ঘর। একপাশে বাথরুম, ড্রেসিংরুম ও ওঅক-ইন ওয়ার্ডোব। প্রতিটি দেয়াল হালকা গোলাপি রঙের। ঘরের একদিকে ক্যাডিলাক গাড়ির চেয়েও বড় ফোর-পোস্টার বেড। ওটার ওপর বালিশের পাশে টেডি বিয়ার। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য বই। বেডের একদিকের গোলাপি কেবিনেটে দস্তোয়েভস্কির দ্য ব্রাদার কারাম্যাযোভ উপন্যাস ও লেখকের ছোট গল্পের কালেকশন। আরও আছে অ্যালেক্যাণ্ডার পুশকিনের ইউজিন অনগান, পাশে মিখাইল লারমোনটভের কাব্য। ওই পিচ্চি মেয়ে এসব ভারী ভারী রাশান ক্লাসিক সাহিত্য পড়ছে ভেবে অবাক হলো রানা। বইগুলোর দিকে চেয়ে আছে দেখে ওকে বলল তামারা, ‘বই পড়তে খুব পছন্দ করে। তা ছাড়া, ও চেয়েছিল বাবার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই ভালভাবে রাশান ভাষা শিখে নিতে। কিছু দিন পর ওর বাবার চল্লিশ বছর হবে, তখন চমকে দিতে চেয়েছে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল তামারা। চোখ বুজে শিউরে উঠল। তারপর রেগে গিয়ে মাথা নাড়ল। ‘আর ওর বাবা কী করল? কী চরম অন্যায়!’

‘বুঝতে পারছি ইউনা বুদ্ধিমতী মেয়ে,’ মন্তব্য করল রানা।

‘ছোট হলেও সত্যিই জিনিয়াস আমার নাতনি,’ ভারী কণ্ঠে বললেন ব্রেযনেভ, ‘এরই ভেতর শিখেছে ডাচ, জার্মান আর ইংরেজি। এখানে আসার পর শিখেছে চলনসই ফ্রেঞ্চ। এ ছাড়া পারে কঠিন সব অঙ্ক। বিজ্ঞান ওর প্রিয় বিষয়। লেখাপড়ায় ভাল বলে যে-কোনও সাবজেক্টে পড়াশোনা করতে পারবে। অভিনয়েও অসম্ভব পারদর্শী। যে-কোনও মানুষের আচরণ নকল করতে পারে।’

‘তবে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে বোবা জন্তু-জানোয়ার,’ বলল তামারা। ‘আর তাই ঠিক করেছে, বড় হয়ে পশু চিকিৎসক হবে।’

এজন্যেই দেয়ালে দেয়ালে এত পশুর ছবি, ভাবল রানা। সেগুলোর ভেতর রয়েছে নানান জাতের কুকুর, ঘোড়া ও বিড়াল। অশ্রু সামলে রেখেছেন লুকা ব্রেনেভ। চাপা স্বরে বললেন, তাঁর নাতনি এত কমবয়সেও পাকা ফটোগ্রাফার। যেখানে যায়, ছবি তোলে জন্তু-জানোয়ারের। নানান ছবিতে দেখা যাচ্ছে ইউনাকে, জড়িয়ে ধরেছে বাচ্চা কুকুর, বিড়াল ও ঘোড়া। মুখে মিষ্টি হাসি।

ছবিগুলোর দিকে চেয়ে আবারও কেঁদে ফেলল তামারা। চোখ মুছে চলে গেল একটা চেয়ারের পাশে। ওটার পিঠ থেকে নিল গোলাপি একটা জ্যাকেট। বুকে জড়িয়ে ধরল জিনিসটা। ফুঁপিয়ে উঠে বলল, ‘এমনই আরেকটা পরে মস্কো শহরে গেছে। একইরকম দুটো তৈরি করে দিয়েছিল দর্জি। হালকা গোলাপি রঙ ওর খুব প্রিয়।’

‘তথ্যগুলো হয়তো কাজে লাগবে,’ বলল রানা। ‘আর সেজন্যেই জানতে চাইছি ওর বাবার সম্পর্কে।’

ঠোঁট বাঁকা করে ফেললেন ব্রেযনেভ। ভাতিজি যেন বুঝতে না পারে, সেজন্যে ফ্রেঞ্চ ভাষায় বললেন, ‘ওকে মাফ করো, রানা। ইউনার বাবা সত্যিকারের পশু। আমি জানি না কী করে এত বুদ্ধিমতী হলো মেয়েটা।’

তামারার দিকে তাকাল রানা। নরম সুরে বলল, ‘আমি আসলে জানতে চাই, ইউনার বাবার ছবি আছে কি না আপনাদের কাছে।’

মাথা নাড়ল তামারা। পরক্ষণে মাথা দোলাল। ‘আমার কাছে নেই। তবে ইউনার কাছে থাকতে পারে।’ গিয়ে বেডসাইড ড্রয়ার খুলল সে। বারো বছর বয়সী ব্রিলিয়ান্ট মেয়েরা যত ধরনের অদ্ভুত জিনিস সংগ্রহ করে, সবই আছে ড্রয়ারের ভেতর। সুঁই থেকে শুরু করে পবিত্র বাইবেল ও আল কোরআনও বাদ পড়েনি।

‘আপনার প্রাক্তন স্বামী সম্পর্কে একটা ধারণা দিতে পারেন?’ জানতে চাইল রানা।

ভুরু কুঁচকে ওকে দেখল মহিলা। ‘কী বিষয়ে জানতে চান?’

‘যেমন তার বন্ধু কারা, কোথায় যায়, কী ধরনের হবি, বা কী ধরনের কাজ করতে পছন্দ করে- এসব। বুঝতে পারছি আপনার জানার কথা নয় কে এখন তার গার্লফ্রেণ্ড। তবে তার সম্পর্কে যত জানব, ততই সহজ হবে তাকে খুঁজে বের করা।’

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল তামারা। কয়েক মুহূর্ত পর মাথা নাড়ল। ‘না, সরি, এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারব না। মস্কো শহরে ফিরে যাওয়ার আগে তাকে কখনও দেখিনি কোনও বন্ধুর সঙ্গে মিশতে। কোনও বিষয়ে কোনও আগ্রহ বা হবি ছিল না। নিয়মিত অফিসে যেত। ফিরত মাতাল হয়ে। তবে ভক্তি ছিল ধর্মের প্রতি। ক্যাথোলিক বলে ক’দিন পর পর যেত গির্জায়।’

‘এটা জরুরি তথ্য,’ বলল রানা। তবে বুঝে গেছে, রাশার শত শত ক্যাথোলিক গির্জায় ঢু দিয়ে নিকোলভ সম্পর্কে কিছু জেনে নেয়া প্রায় অসম্ভব। সে সময়ও নেই ওর হাতে। এবার জানতে চাইল, ‘আপনার কাছে তার মোবাইল ফোনের নম্বর আছে? ওটা কাজে লাগবে।’

‘বহু দিন হলো তার সঙ্গে কথা হয়নি,’ বলল তামারা। এখনও ঘাঁটছে বেডের পাশের ড্রয়ার। ‘চাইও না কথা বলতে। কে চাইবে তর্কে জড়িয়ে যেতে? তবে তার ই-মেইল অ্যাড্রেস আছে। ইউনার কাছে শুনেছি, বারো-চোদ্দবার বদলে নিয়েছে ফোনের নম্বর। …এই যে, পেয়েছি।’ ড্রয়ার থেকে কী যেন বের করে রানার দিকে বাড়িয়ে দিল মহিলা।

ছবিটা নিয়ে চোখ বোলাল রানা। বেশ পুরনো ছবি। তখনও ভেঙে যায়নি পরিবারটা। হাসছে অ্যান্টোনিন ও তামারা। দু’জনের মাঝে পিচ্চি ইউনা। মাত্র পড়েছে সামনের দুটো দাঁত। হেয়ার স্টাইল অন্যরকম ছিল তামারার। লালচে ঠোঁটের কোণে খুশির হাসি। অ্যান্টোনিনের মাথাভরা ঝাঁকড়া চুল। চওড়া চেহারা সুদর্শন না হলেও কদর্য নয়। চোয়াল একটু উঁচু। কালো চোখে বুদ্ধির ঝিলিক। মিস্টার ব্রেনেভের বর্ণনার সঙ্গে তাকে মেলাতে পারল না রানা।

‘শুনেছি এখন মোটা হয়েছে,’ বলল তামারা, ‘ইউনা বলেছে, লম্বা চুল রাখে সে। দাড়িও আছে।’

‘সত্যিকারের পশু,’ পেছন থেকে বিড়বিড় করলেন ব্রেযনেভ।

‘ছবিটা নিতে পারি?’ জানতে চাইল রানা।

একবার শিউরে উঠল তামারা। ‘নিন। সরিয়ে ফেলুন আমার চোখের সামনে থেকে। জীবনেও আর দেখতে চাই না ওই চেহারা।’

আট

ফ্রেঞ্চ পুলিশের বড় কর্মকর্তার সঙ্গে বোধহয় যোগাযোগ করেছেন বিলিয়নেয়ার লুকা ব্রেনেভ। ট্রাফিক সব আইন ভেঙে তুমুল বেগে গাড়ি চালিয়ে এক রেসিং ড্রাইভার রানাকে পৌঁছে দিল ম্যান্স-অনাজ এয়ারপোর্টে। তাতে লাগল বড়জোর দশ মিনিট। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল ছিল না লোকটার। মার্সিডিয এস ক্লাসের গাড়ি টার্মিনালে পৌঁছুতেই রানা দেখল, প্রাইভেট টার্মিনালের বাইরে ব্রেযনেভ কৰ্পো লেখা বিশাল হ্যাঙার থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি করছে জি৬৫০ গাল্‌ফ্‌স্ট্রিম জেট বিমান। রানওয়ের দিকে গেল ওটা। আগেই পেটে ভরে দেয়া হয়েছে ফিউয়েল। যে-কোনও সময়ে টেকঅফ-এর জন্যে তৈরি এখন। সন্ধ্যার আলোয় টিপটিপ করে জ্বলছে বিমানের বাইরের ক’টা রঙিন বাতি।

কয়েক মিনিট পর টারমাকে পাইলট ও কো-পাইলট রবার্ট স্টিফান ও এদোমন্দ মার্কাসের সঙ্গে দেখা হলো রানার।

‘কী দুঃখজনক যে লক্ষ্মী মেয়ে ইউনার জীবনে এসব ঘটছে,’ মন্তব্য করল পাইলট স্টিফান। ‘আমরা সবাই ওকে ভালবাসি। কী হাসিখুশি, কী মিষ্টি আচরণ সবার সঙ্গে।’

‘অ্যান্টোনিন নিকোলভের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে?’ বলল রানা। পাইলট মাথা ঝাঁকাতে জিজ্ঞেস করল, ‘মানুষ হিসেবে সে কেমন? যে-কোনও তথ্য কাজে আসবে আমার।’

রাগ চেপে মাথা নাড়ল ক্যাপ্টেন, কুকুরটাকে বেশিরভাগ সময় দেখতাম না। তবে ইউনাকে নিয়ে যাওয়ার পর তিনবার দেখেছি সে মেয়েকে নিতে আসেনি। সত্যি বলতে, একবার মুখোমুখি হলে ঘুষিয়েই ফেলে দেব তার দাঁতগুলো।’

যা বোঝার বোঝা শেষ রানার। নিজের কাজে গেল পাইলট ও কো-পাইলট। তাদের সঙ্গে বিমানে উঠল রানা। ভেতরে উনিশটা চামড়ামোড়া প্যাসেঞ্জার আর্মচেয়ার। সামনে মার্বেল-টপ টেবিল। একটা আর্মচেয়ারের পাশে ডিযাইনার ট্র্যাভেল ব্যাগ রাখা। ওটার ভেতর রয়েছে রানার ভিসার কাগজপত্র এবং হাতখরচের জন্যে পাঁচ মিলিয়ন রুবল। অর্থাৎ ছয় লাখ ইউরো! কোনওদিক বাদ দেননি ব্রেযনেভ। নিজের পুরনো হ্যাভারস্যাকে ক্যাশ টাকা রেখে জানালার পাশে বসল রানা।

পাঁচ মিনিট পর উড়াল দিল আধুনিক জেট বিমান। গ্যালি থেকে বেরিয়ে কোমর দোলাতে দোলাতে রানার সামনে এসে থামল ইউনিফর্ম পরা চকচকে কালো চুলের এক জাপানি সুন্দরী, ফ্লাইট অ্যাটেণ্ড্যান্ট। নিউ ইয়র্কবাসীর উচ্চারণে জানতে চাইল, কী ধরনের ডিনার পছন্দ রানার। ‘আপনার জন্যে রয়েছে ফুল আ লে কার্ট মেন্যু। বললে দেব বাটার পোড় লবস্টার। আজই ধরা পড়েছে। ওটা খুব পছন্দ করেন মিস্টার ব্রেযনেভ।’

‘যা চাই, তা-ই পাব?’ জানতে চাইল রানা।

মিষ্টি হাসল মেয়েটা। ‘যে-কোনও খাবার বা পানীয়, স্যর। নির্দেশ দিলেই হাজির করা হবে সব।

‘তা হলে একটা বিফ স্যাণ্ডউইচ দিন। ওটার ভেতর হালকা করে দেবেন মাখন। সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে মাস্টার্ড।

অর্ডার শুনে ফ্যাকাসে হলো সুন্দরী। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘সঙ্গে কি, স্যর, এক গ্লাস শ্যাম্পেইন দেব? আমাদের কাছে আছে দুনিয়ার সেরা ক্রুগ প্রাইভেট কিউভেই।’

‘তার বদলে নেব তিন পেগ সিংগল মল্ট স্কচ। তাতে বরফ বা পানি দেবেন না।’ দু’দিন আগে ধূমপান ছেড়ে দিলেও একটা সিগারেটের জন্যে কেমন যেন লাগছে রানার। তাই যোগ করল, ‘আশা করি আপনাদের বিমানে সিগারেট আছে?’

শখের বেড়ালকে কেউ ইচ্ছে করে মাড়িয়ে দিলে যে দৃষ্টিতে মালিক তাকায়, সেভাবে ওকে দেখল মেয়েটা। ‘না, স্যর, বিমানে ধূমপানের অনুমতি নেই।’

‘তার মানে, যা চাই তা পাব না,’ উদাস ভঙ্গি করে জানালা দিয়ে নিচে তাকাল রানা।

গটগট করে গ্যালির দিকে গেল অ্যাটেণ্ড্যান্ট। নির্ঘাত শেফকে বলবে, একদম ফালতু লোক উঠেছে বিমানে। সাত মিনিট পর স্যাণ্ডউইচ ও স্কচ দিয়ে গেল সে। .

নিজের পণ্ডিতি ফলাতে স্যাণ্ডউইচে ভেষজ দিয়েছে শেফ। তাতে খারাপ লাগল না খেতে। একটু পর ওমেগা ডাইভার্স ঘড়িতে ফ্রান্স ও রাশার মাঝের সময়ের তফাৎ ঠিক করে নিল রানা। চুমুক দিল স্কচে। ওটা শেষ করে গ্লাস টেবিলে রেখে চোখ বুজল। রাতের কালো আকাশ চিরে চলেছে বিমান। ভেতরে ধরতে গেলে কোনও আওয়াজই নেই।

পুরো দু’ঘণ্টা পর চোখ মেলল রানা, দেখল নিচে বিশাল এলাকা নিয়ে আলোকিত মস্কো শহর। গাফ্স্ট্রিম জেট বিমান চলেছে ভিআনুকোভা ইণ্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের উদ্দেশে। ঝলমলে শহরের দিকে চেয়ে ভাবল ও, হয়তো খুব কঠিন হবে না ইউনা আর ওর বাবাকে খুঁজে বের করা!

একদম ঠিক কথা বলেছেন বিলিয়নেয়ার ব্রেযনেভ। টেকঅফের তিনঘণ্টা এগারো মিনিট পর রানওয়েতে নামল বিমান। পাঁচ মিনিট পর ট্যাক্সি করে বিযনেস এভিয়েশন টার্মিনালের সামনে থামল ওটা। গ্যালি থেকে ফিরল জাপানি সুন্দরী। নকল মিষ্টি হেসে বলল, এবার নেমে পড়তে পারে ও।

মিনিটখানেক পর গ্যাংওয়ে বেয়ে নেমে এল রানা গ্রীষ্মের মৃদু উষ্ণ রাতে। ওর কাঁধে ঝুলছে ব্যাগ। ঘুরে তাকাল চারপাশে। ব্রেনেভ বলেছেন, এয়ারপোর্টে ওর জন্যে অপেক্ষা করবে ডিটেকটিভ এজেন্সির গোয়েন্দা। টারমাকে জ্বলজ্বল করছে ফ্লাডলাইট। ওই ধবধবে আলো উঁকি দিয়েছে ছায়াময় প্রাইভেট এয়ারক্রাফট হ্যাঙারগুলোর ভেতর। এইমাত্র জোরালো ক্রিচ্ আওয়াজে রানওয়েতে নেমেছে এক জাম্বো জেট। কানে তালা লেগে গেল রানার। একটু পর ওই আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই শুনল পেছন থেকে আসছে একটা গাড়ি। ঘুরে দাঁড়াল রানা। চোখ কুঁচকে গেল হেডলাইটের উজ্জ্বল আলোয়।

ওর পাশে চাকার মৃদু হিস্ শব্দে থামল গাড়িটা। লে ম্যান্স-অনাজের সেই গাড়ির মতই এটাও মার্সিডিয এস- ক্লাস, কালো রঙের। জানালা টিণ্টেড। বাইরের কেউ দেখবে না ভেতরে কে আছে। খুলে গেল পেছনের দরজা। রানা দেখল, কালো হাইহিল দুটো জুতো। দুই সেকেণ্ড পর গাড়ির পাশে সোজা হয়ে দাঁড়াল হালকা-পাতলা শরীরের এক যুবতী। পরনে ছাই রঙের বিযনেস সুট। রানার অচেনা হলেও ওকে যে সে চিনেছে, তাতে ভুল নেই।

‘মেজর রানা?’ রাশান উচ্চারণে জানতে চাইল মেয়েটা।

‘শুধু মাসুদ রানা, এখন আর মেজর নই,’ বলল রানা।

মার্সিডিয থেকে সরে রানার সামনে থামল মেয়েটা হাইহিলের কল্যাণে দৈর্ঘ্যে সে বিসিআই এজেন্টের সমান। সুঠাম দেহটা সুপার মডেলদেরকে হার মানালেও চওড়া কাঁধ পেশাদার সাঁতারুর মত। চোখদুটো গভীর সাগর-নীল। মাথার সোনালি চুলগুলো যেন এক ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের তারকাঁটা। দেখতে রীতিমত ভাল হলেও চেহারায় কঠোরতা ও দৃঢ়তা। রানা বুঝে গেল, একবার কোনও কাজে হাত দিলে সেটা শেষ না করে থামে না এই মহিলা।

‘আমি তানিয়া আজোরভ,’ বলল মেয়েটা। ‘আপনার সুবিধা হবে বলে আমাকে পাঠানো হয়েছে ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে।’

হাত মিলিয়ে রানা টের পেল, পাথরের মত শক্ত তার আঙুল ও হাতের তালু। ‘আমাকে তা-ই বলা হয়েছে। তবে একাই কাজ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। তাই আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়েই ছুটি নিতে পারেন। পরে মিস্টার ব্রেযনেভের সঙ্গে কথা বলে নেব। সেক্ষেত্রে দু’পক্ষের ভেতর ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা থাকবে না।’

‘এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আমার নেই,’ বরফের মত ঠাণ্ডা হাসল তানিয়া আজোরভ। ‘অফিসের নির্দেশ, তাই সরে যাব না নিজের দায়িত্ব থেকে।’

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘সেক্ষেত্রে আপাতত আমরা পাশাপাশি কাজ করছি। বেশ।’

খুলে গেল ড্রাইভারের দরজা। গাড়ি থেকে নামল পাহাড়ের সমান এক লোক। মার্সিডিয যথেষ্ট বড় গাড়ি হলেও সাত ফুটি দানবের জন্যে চাই হামভি জিপগাড়ি। ফ্রান্সে লুকা ব্রেযনেভ দিয়েছিলেন রেসিং ড্রাইভার, আর এই লোক অতীতে বোধহয় ছিল আল্ট্রা-হেভিওয়েট বক্সার। নাক ভেঙেছে কয়েকবার। ন্যাড়া মাথা। কানদুটো ফুলকপির মত। খপ্ করে রানার ব্যাগ তুলে নিয়ে রেখে দিল গাড়ির বুটে।

‘আপনার আর কোনও ব্যাগেজ নেই?’ চোখে বিতৃষ্ণা নিয়ে রানার পুরনো হ্যাভারস্যাকটা দেখে নিয়েছে তানিয়া আজোরভ।

হাসল রানা। ‘এবার আর গল্ফ ক্লাবগুলো আনিনি।’

দুই ভুরু কুঁচকে ওকে দেখল মেয়েটা। ‘আমার মনে হয় না আমরা কোনও ধরনের খেলার সময় পাব। কাজের তো আর শেষ নেই।’

একেবারেই রসকষহীন মেয়ে, বুঝে গেল রানা।

গাড়ির পেছনের সিট দেখাল তানিয়া আজোরভ। ‘দয়া করে উঠে পড়ুন।’

রানা ওঠার পর সামনের সিটে বসল মেয়েটা। স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে চাপল দানব। নীরবে রওনা হলো গাড়িটা। আটাশ কিলোমিটার পেরোবার পর ঢুকে পড়ল ওরা মস্কো শহরতলীতে।

সন্ধ্যা হয়েছে আগেই। সারি সারি গাড়ির মাঝ দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে মার্সিডিয নিয়ে চলেছে দানব। জানালা দিয়ে দূরে চেয়ে আছে তানিয়া আজোরভ। এরা যেন ইচ্ছে করেই উপেক্ষা করছে রানাকে। মাঝে মাঝে নিচু গলায় আলাপ করছে নিজেদের ভেতর।

শহরে ঢোকার ‘বিশ মিনিট পর রানার উদ্দেশে বলল তানিয়া, ‘আমরা পৌঁছে গেছি।’

শহরের বুকে নেগলিনায়া স্ট্রিটে আরারাত পার্ক হায়াত হোটেলের সামনে থেমেছে মার্সিডিয। আগেও এদিকে এসেছে রানা। লুকা ব্রেযনেভ বলেছিলেন, সাধারণ হোটেলে ওর জন্যে কামরা ভাড়া করেছেন, অথচ ইউরোপের বিখ্যাত কয়েকটি হোটেলের ভেতর এটা অন্যতম। বিলিয়নেয়ার একবার ক্যাম্পিং এক্সপিডিশনে গেলে কী ভাববেন, সেটা জানার আগ্রহ হলো রানার মনে।

‘আপনার জন্যে বুক করা হয়েছে উইন্টার গার্ডেন সুইট, ‘ রানাকে বলল তানিয়া আজোরভ।

গাড়ির বুট থেকে নিয়ে রানার ব্যাগ হোটেলের ভ্যালের হাতে দিল ড্রাইভার। অদ্ভুত সব অতিধনী মানুষ ওঠেন এ হোটেলে, তাই ফ্যাড়ক্যাড়া কাপড়ের পুরনো ব্যাগ দেখে বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ পেল না ভ্যালের চেহারায়। তার পিছু নিয়ে ক্যাথেড্রালের মত বিশাল এইট্রিয়ামে পা রাখল রানা ও তানিয়া। চারপাশে বহু মানুষের ব্যস্ততা। স্টিল ও কাঁচের আল্ট্রামডার্ন আর্কিটেকচার। তবে মাত্র একটা সুইটের জন্যে প্রতি দিন ওর পকেট থেকে হাজার হাজার রুবল দিতে হলে বেঁকে বসত রানা।

পাসপোর্ট না দেখিয়ে, সই না করে নিজের সুইটে পৌঁছে গেল ও। দরজার কাছ থেকে তানিয়া বলল, ‘আশা করি তিরিশ মিনিট পর আপনার সঙ্গে নিচের লাউঞ্জে দেখা হবে।’

উইন্টার গার্ডেন সুইটের ওদিকে দেখার মত সুন্দর বলশোই থিয়েটার ও রেড স্কয়্যার। রাতের আকাশে দেখা যাচ্ছে অপূর্ব ক্রেমলিন টাওয়ারগুলো। আরেক দিকে খাবার টেবিলে কারুকাজ করা বিশাল এক ডোর্টের মত ঝলমল করছে রঙিন আলোয় ভরা সেন্ট ব্যাসিল্স্ ক্যাথেড্রালের গম্বুজ। সুইটের ভেতর চোখ বুলিয়ে রানা বুঝল, মাত্র একজনের জন্যে অনেক বেশি আসবাবপত্র এখানে। রয়েছে এমন আর্ট কালেকশন, যেটা পেলে বর্তে যেত ছোট কোনও গ্যালারি। বাথরুমে মার্বেল দিয়ে তৈরি বাথটাবটা আরেকটু বড় হলে সাঁতরে বেড়াতে পারত। এই বাথরুমে বিরক্তি এলে রয়েছে গেস্ট বাথরুম। অতিথির জন্যে যে কামরা, সেটা ব্রেযনেভের দুর্গে ইউনার গোলাপি সুইটের চেয়েও বড়। জানালায় রয়েছে রিমোট কন্ট্রোল্ড ব্লাইণ্ড। প্রথমবারের মত ওই জিনিস দেখল রানা। আজকাল খড়খড়িও টেনে নিতে হয় না কাউকে। এ ছাড়া, সুইটে অন্যান্য সুযোগ সুবিধার সঙ্গে রয়েছে একটি অত্যাধুনিক কফি মেশিন।

চারপাশ চটপট দেখা শেষে বাথরুমে ঢুকল রানা। শাওয়ার সেরে কয়েক মিনিট পর বেরিয়ে এল নতুন জিন্স ও ডেনিম শার্ট পরে। একবার জানালায় দাঁড়িয়ে দেখল নেগলিনায়া স্ট্রিট ধরে সাঁই-সাঁই চলেছে সারি সারি গাড়ি। কয়েক মুহূর্ত ওদিকে চেয়ে থেকে সুইট থেকে বেরিয়ে নিচতলায় নেমে এল রানা। ওর জন্যে অপেক্ষায় আছে মহিলা গোয়েন্দা।

তানিয়া আজোরভকে রানা পেল বার-এ। মেয়েটার সামনের কাউন্টারে ছাতিওয়ালা দীর্ঘ গ্লাসে ভোদকা ককটেল। মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে স্বচ্ছ তরলে। ওর পাশে থেমে ডাবল স্কচের জন্যে বারটেণ্ডারকে অর্ডার দিল রানা। অবাক হয়েছে লোকটার অবিশ্বাস্য সিংগল

সিংগল মল্টের কালেকশন দেখে। পাশাপাশি দুই বার-স্টুলে বসেছে রানা ও তানিয়া। এরই ভেতর বিদায় নিয়েছে অন্যান্য কাস্টোমার। সব পরিষ্কার করা এবং গুছিয়ে নেয়ার কাজে নেমেছে স্টাফরা। একটু পর আজকের মত বন্ধ হবে বার। তবে এ হোটেলের মত নামীদামি জায়গায় কখনও কোনও খদ্দেরকে বিদায় নিতে বলা হয় না।

‘আমাকে বলা হয়েছে, আপনি সাধারণ মেজর নন,’ ককটেল স্টিক দিয়ে গ্লাসের ভেতর নাড়ল তানিয়া। রানা খেয়াল করল, নীল চোখের মত একই রঙের চকচকে মেয়েটার নেলপলিশ। ‘আপনি ছিলেন স্পেশাল ফোর্সের কমাণ্ডো লিডার। জিআরইউ স্পেনেজ ফোর্সের টিম লিডারের মত।’

মেয়েটার দৃষ্টিতে কী যেন, ওটা পড়তে পারল না রানা। ভাবল, ওর প্রশংসা করতে গিয়ে বেশি বলে ফেলেছেন ব্রেযনেভ। সরাসরি কাজের কথায় এল ও, ‘ভেবেছিলাম আপনি বলবেন আগামীকাল কোথা থেকে কাজ শুরু করব আমরা।

‘তা বলব, তবে তার আগে জেনে নিতে চাই কার সঙ্গে কাজ করছি। …আমি কি মিথ্যা শুনেছি, মেজর রানা?’

এই মেয়ে নাছোড়বান্দা, বুঝে গেল রানা। ‘বহু দিন হলো আর্মি থেকে অবসর নিয়েছি। তার আগে, হ্যাঁ, মেজর ছিলাম। তবে এখন আর মেজর বলে ডাকে না কেউ। আমি কি তোমাকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছি?’

‘তা হলে বলতে চান আমি যেন মেজর বলে না ডাকি?’

‘আমাকে রানা বলে ডাকলেই চলবে।’

‘আনুষ্ঠানিক পদবিতে আমি অভ্যস্ত,’ রানার চোখে কী যেন খুঁজছে তানিয়া। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘আপনি অবসর নেয়ার তুলনায় অনেক কমবয়সী।’

‘বেকার বসে আছি, তা কিন্তু নয়।’

‘শুনেছি আপনার একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি আছে।’

‘হ্যাঁ, আছে।’

হাসল তানিয়া আজোরভ। ‘পেশাদার আর্মি অফিসার এত কমবয়সে অবসর নিয়ে গোয়েন্দা এজেন্সি খুলেছেন, ‘অবাক লাগছে।’

‘অবাক হওয়ার কিছু নেই।’

গভীর চোখে রানাকে দেখল তানিয়া। ‘যতটা মনে হয়, তার চেয়েও বেশি আপনার অভিজ্ঞতা।’ গ্লাসে চুমুক দিল মেয়েটা। চোখ সরল না রানার চোখ থেকে। নরম সুরে বলল, ‘আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন না মিসেস রানা?’

রানার চোখের তারায় খেলে গেল প্রিয় কয়েকটি মুখ। কখনও বাধ্য হয়ে নিজেই সরে গেছে ও, আবার কখনও মেয়েটি মারা গেছে বা অভিমান করে বিদায় নিয়েছে- সেজন্যে শেষপর্যন্ত কারও বাঁধনে জড়িয়ে পড়া হয়ে ওঠেনি ওর।

চুপ করে থাকল রানা।

‘অর্থাৎ স্ত্রী নেই। বিয়ে না করে হয়তো ভালই করেছেন, নইলে দেয়ালঘড়ির মত লটকে যেতেন। দিনে-রাতে দু’বার করে বারোটা বাজত আপনার।’ মৃদু টিটকারির হাসি ফুটল তানিয়ার ঠোঁটে। ‘তাই বলে কোনও বান্ধবীও নেই? আপনি কি তা হলে গোলুবই? ইংরেজিতে বোধহয় তাদেরকে বলে গে।’

‘না, তা নই,’ আত্মরক্ষা করল রানা।

গ্লাসে চুমুক দিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল তানিয়া।

‘তা হলে এবার কাজের কথায় আসা যাক, কেমন?’ বলল রানা।

‘নিশ্চয়ই।’

‘তো খুলে বলো কী ধরনের মানুষ অ্যান্টোনিন নিকোলভ।’

‘প্রায় তেমন কিছুই জানি না,’ স্বীকার করল তানিয়া। তার ডিটেকটিভ এজেন্সির বেশ সমস্যা হয়েছে নিকোলভের ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে। পুলিশের কাছেও গেছে তারা। কোনও ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই ওই লোকের নামে।

‘কী কাজ করে সে?’ জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়ল তানিয়া। ‘যে কাজই করুক, সেটার জন্যে নগদ টাকা নেয় সে। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রায় কোনও টাকাই নেই। গত এক বছরে একবারও লেনদেন করেনি।’

লুকা ব্রেনেভের কথা মনে পড়ল রানার। প্রায় ফতুর লোক ওই নিকোলভ। হয়তো ছোটখাটো অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এখনও ধরা পড়েনি। ‘প্রথমে ঘুরে দেখতে চাই তার অ্যাপার্টমেণ্ট,’ বলল রানা।

‘এখন ওখানে নেই সে,’ বলল তানিয়া, ‘আমি তো ভেবেছিলাম আপনাকে সেটা জানানো হয়েছে।’

‘তোমরা ওখানে কী পেয়েছ?’

লুকা ব্রেযনেভ যেসব তথ্য দিয়েছেন, সেগুলো আবারও বলতে গিয়ে বিরক্তির ছাপ পড়ল তানিয়ার কণ্ঠে, ‘সবই আমার রিপোর্টে আছে। আমরা যাই ওই ঠিকানায়। দরজা তালা দেয়া। অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে কেউ ছিল না।’

‘ভেতরে ঢুকেছিলে তোমরা?’

‘বেআইনীভাবে ঢুকতে চাইনি।’

‘অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক হলে ওখানে কেয়ারটেকার বা কনসিয়ার্জ থাকবে। তার কাছ থেকে চাবি নেয়া যাবে।’

‘ওটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি। একমাত্র পুলিশ পারবে ওখানে সার্চ করতে।’

‘বুঝলাম,’ বলল রানা, ‘তার মানে ভেতরে যাওনি তোমরা। তা হলে নিশ্চিত হলে কী করে যে অ্যাপার্টমেন্ট ফাঁকা?’

‘অ্যান্টোনিন নিকোলভকে চলে যেতে দেখা গেছে। এরপর আর ফেরেনি সে। আমি কথা বলেছি প্রতিবেশীদের সঙ্গে। তারা বলেছে গত কয়েক দিন হলো আর আসেনি সে।’

‘ঠিক আছে,’ বলল রানা, ‘তবে নিজে ওখানে গিয়ে দেখতে চাই। কাজটা করব আগামীকাল সকালে। ঠিক সময়ে হাজির হবে আটটায়।’

আপত্তি তুলল না মেয়েটা। স্বাভাবিক সুরে জানতে চাইল, ‘এ ছাড়া আর কোনও নির্দেশ?’

মাথা নাড়ল রানা। ‘সাধারণত একা কাজ করি। আশা করি আমার সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে। …মনে হয় না নিজের মেয়ের ক্ষতি করবে ওই লোক। তবে প্রথম সুযোগে তার কাছ থেকে মেয়েটাকে সরিয়ে নেব। যা করার করব দ্রুত। কাজেই তুমি পিছিয়ে পড়লে ফেলে যাব তোমাকে। কথাটা বুঝতে পেরেছ?’

‘আমি পেশাদার,’ ঠাণ্ডা গলায় বলল তানিয়া। ‘আমাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না।’

‘শুনে খুশি হলাম। এবার আসি ট্র্যান্সপোর্টের ব্যাপারে। তোমার গাড়ি আছে? নাকি ব্যবহার করতে হবে মিস্টার ব্রেযনেভের গাড়ি? এ কথা জানতে চাইছি, কারণ দৈত্যের মত ড্রাইভারকে লেজে নিয়ে ঘুরতে চাই না।’

‘এ শহরে গাড়ি ব্যবহার করা মস্তবড় ভুল, হাঁফ লেগে গেছে, এমন ভঙ্গি করল তানিয়া। ‘সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকে মস্কো শহরে জ্যাম। ওটা লস অ্যাঞ্জেলেসের চেয়েও বেশি। তবে মস্কোর পাবলিক ট্র্যান্সপোর্ট দুনিয়ার সেরা। সেটাই ব্যবহার করব আমরা।’ গাম্ভীর্যের বরফ গলতে শুরু করেছে মেয়েটার মুখ থেকে। ‘আমি মস্কোর মেয়ে। ভাববেন না, মেজর রানা। ডুবিয়ে দেব না আপনাকে।’

নয়

বরাবরের মতই ভোরে ঘুম ভাঙল রানার। এইমাত্র লাল রোদ এসে পড়েছে রেড স্কয়্যার পেরিয়ে ওর ব্যালকনিতে বিছানা ছেড়ে পঁচিশটা করে চার দফায় এক শ’টা বুকডন দিল রানা। এরপর শুরু হলো এক শ’বারের সিট-আপ। আজ বেশি সময় পাবে না বলে বাদ দিল দশ মাইলের দৌড়। মুখ-হাত ধুয়ে এসে কফি মেশিনে তৈরি করল এসপ্রেসো কফি। মগ হাতে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। নিচের রাস্তায় শুরু হয়েছে গাড়িঘোড়ার আনাগোনা।

কফি শেষ করে মার্বেলের বিশাল শাওয়ার রুমে ঢুকে সেরে নিল স্নান। তানিয়ার সঙ্গে দেখা করতে নিচে নামল আটটা বাজার ঠিক তিন মিনিট আগে। হাঁটতে হবে বলে মেয়েটার পায়ে আজ ফ্ল্যাট সোলের জুতো। দৈর্ঘ্যে পুরো তিন ইঞ্চি কমে গেছে সে। আগের সেই ছাই রঙা সুটের বদলে পরনে ভারী অ্যাপলেট সহ ডাবল ব্রেস্টেড নেভি কোট। ওটা দেখে রাশান মিলিটারি ইউনিফর্মের কথা মনে পড়ল রানার।

‘গুড মর্নিং, কমরেড মেজর রানা,’ চট্ করে বলল মেয়েটা।

‘গুড মর্নিং, মিস আজোরভ,’ জবাবে বলল রানা। মেয়েটার পিছু নিয়ে হোটেলের ব্যস্ত লবি পার হয়ে নেমে পড়ল নেগলিনায়া স্ট্রিটে। আট মাস আগেও ওটা ছিল বরফে ঢাকা। তবে আজ গ্রীষ্মের রোদে তপ্ত হয়ে উঠেছে চারপাশ। গম্ভীর চেহারায় যে যার কাজে চলেছে মানুষ।

এবার কোন্ দিকে?’ জানতে চাইল রানা। ‘বাসে উঠব, নাকি ট্রাম?’

‘কোনওটাই না,’ বলল তানিয়া। ‘মস্কোর মেট্রো সিস্টেম দুনিয়া-সেরা। নিজে গেছি নিউ ইয়র্ক, লণ্ডন আর প্যারিসে। তাদের ব্যবস্থাপনা রাশানদের কাছে একদম শিশু।’ পশ্চিমারা এ বিষয়ে ব্যর্থ, সেটা বোঝাতে গিয়ে মাথা নাড়ল মেয়েটা। ‘এ দেশে পরের ট্রেনের জন্যে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে বড়জোর

হবে বড়জোর এক মিনিট আর স্টেশনগুলোও যে-কোনও দেশের স্টেশনের তুলনায় অনেক সুন্দর। যে-কোনও জায়গায় পাবেন ফ্রি ওয়াই-ফাই। তা ছাড়া, স্টেশনের আর্কিটেকচার দেখলে হাঁ হয়ে যাবেন।’

মস্কোয় বেশ ক’বার এসেছে বলে রানা ভাল করেই জানে মেট্রো স্টেশনগুলো দেখতে সত্যিই দারুণ। মুখে বলল, ‘তুমি দেখছি চমৎকার গাইড। পথ দেখাও।’

আগের চেয়ে বেড়েছে মস্কোর জ্যাম। গাড়ি করে কোথাও যেতে হলে লাগবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ধোঁয়া ও গ্যাস ভরা রাস্তা ধরে হেঁটে চলল ওরা। চারপাশে পুরনো ইউএসএসআর-এর কোনও আলামত নেই। একসময় দুনিয়ার মানুষকে ভয় দেখাতে যেসব রাস্তা দিয়ে সদর্পে চলেছে স্ট্যালিনের ট্যাঙ্ক ব্যাটেলিয়ান, এখন সেসব আধুনিক ব্যস্ত সড়ক। রানা দেখল দু’পাশে পশ্চিমা শহরের মতই স্টারবাক বা লে পেইন কুয়োটিডিয়েনের দোকান। আর কোনও শহরে এত বেশি ফুলের দোকান দেখেনি বলে জানতে চাইল, ‘এত ফুলের দোকান কেন?’

‘কারণ রাশান পুরুষ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে রোমান্টিক,’ জবাবে বলল তানিয়া। ‘সবসময় চায় প্রেয়সীকে খুশি রাখতে।’

লুকা ব্রেযনেভের নাতনির কথা মনে পড়ল রানার। মনে মনে বলল, তা হলে ধরে নিতে হবে অ্যান্টোনিন নিকোলভ সাধারণ রাশানদের মত নয়। কপাল মন্দ পিচ্চি ইউনার।

হোটেল থেকে পাঁচ মিনিট হেঁটে ওরা পৌঁছুল লুবিয়াঙ্কা মেট্রোর সামনে। একই নামে ইতিহাসে রয়ে গেছে কুখ্যাত একটি বিশাল দালান, মনে পড়ল রানার। একটু দূরে চোখে পড়ল ওই দালান। লুবিয়াঙ্কা জেলখানা। আগে ওখানেই ছিল সেভিয়েত আমলে সিক্রেট পুলিশ চেকা’র হেডকোয়ার্টার। পরে ওটার মালিক হয় কেজিবি। তাদের নিষ্ঠুরতা নিয়ে পশ্চিমা দেশে রয়েছে সত্যমিথ্যা নানান রটনা। উনিশ শ’ ত্রিশ সালে বিরোধীদেরকে নির্মূল করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন স্ট্যালিন। ওটা ছিল ইউএসএসআর- এর সত্যিকারের কালো একটি অধ্যায়। নির্যাতন করে খুন করা হয় শত শত মানুষকে। অফিশিয়ালি কোথাও নেই তাদের নাম।

দু’হাজার দশ সালে বোমা হামলা হয় লুবিয়াঙ্কা স্টেশনে। দোষ পড়ে ইসলামিক টেরোরিস্টদের ওপর। যদিও অনেকে ধারণা করেন, রাশান রাজনৈতিক জটিলতা এড়াতে গিয়ে ওই কুকীর্তিটা নিজেরাই করে রাশান সিকিউরিটি ফোর্স। ওই ভয়াবহ হামলার যে বর্ণনা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ, সেটা নাকি বহুল অংশে অসত্য।

খিলান করা স্টেশনের এন্ট্রান্স পেরিয়ে হাজারো যাত্রীর ভিড়ে মিশে গেল রানা ও তানিয়া। আগেই দুটো প্রিপেইড কন্ট্যাক্টলেস ট্রোইকা কার্ড জোগাড় করেছে মেয়েটা। ওগুলোর কারণে অনায়াসেই মস্কোর যে-কোনও দিকে মেট্রো রেলে করে যেতে পারবে ওরা। নিচে ট্রেনের প্ল্যাটফর্মের দিকে রওনা হয়েও থমকে গেল রানা। বসে পড়ে বাঁধতে লাগল ডান জুতোর ফিতা। ওকে দু’দিক দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলেছে যাত্রীরা। কারও খেয়াল নেই এদিকে। অবশ্য অধৈর্য চোখে রানাকে দেখছে তানিয়া। তপ্ত সুরে বলল, ‘এখন দেখছি আমি নই, আপনিই দেরি করিয়ে দিচ্ছেন!’

বুটের ফিতা বাঁধতে একটু দেরি হলো বলে প্রথম ট্রেনটা মিস করল রানা ও তানিয়া। ওরা মাত্র প্ল্যাটফর্মে পা রেখেছে, এমন সময় হুইশ্ শব্দে রওনা হলো ট্রেন। পরেরটার জন্যে অপেক্ষার সময় চারপাশ দেখে নিল রানা।

‘ভাবছেন এটা সাধারণ স্টেশন, তাই না?’ বলল তানিয়া। ‘এরপরের স্টেশনে দেখবেন সোভিয়েত আমলের কীর্তি।’

একমিনিট পেরোবার আগেই এল আরেকটা ট্রেন। ভিড় করে ওটাতে উঠল একগাদা মানুষ। তাদের সঙ্গে উঠেছে রানা। গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়াতে হলো বগির ভেতর। শহরের তলা দিয়ে তুমুল বেগে চলল মেট্রো রেল। একটু পর পর পড়ছে স্টেশন, সবই দেখার মত সুন্দর। বিশাল ছাত অনেক ওপরে। সেখান থেকে ঝুলছে ঝাড়বাতি। এদিকে ওদিকে অপূর্ব সব মুরাল, ছাতে কারুকাজ। নানাদিকে অস্বচ্ছ কাঁচ ও সোনালি রঙের ঝিলিক। চারপাশে রয়েছে মার্বেলের খিলান করা কলাম ও সমাজতন্ত্রের নামকরা মানুষগুলোর ব্রোঞ্জের নিখুঁত মূর্তি। স্পষ্ট অনুভব করা যায় সেসময়ের পরিবেশ।

ট্রেনের চাপা খট-খট ও গুরুগম্ভীর আওয়াজের ওপর দিয়ে বলল তানিয়া, ‘কমিউনিস্ট আমলের বিজয় বোঝাতে এভাবে মেট্রো স্টেশন তৈরি করতে বলেন স্ট্যালিন। তবে পরে সেই আমলে এত খরচের জন্যে সমালোচনা করেন ক্রুশ্চেভ ও অন্যান্য নেতারা। ফলে উনিশ শ’ ষাট বা সত্তর দশকের স্টেশন তৈরি করা হয় অনেক সাদামাটাভাবে।

তানিয়ার কাছ থেকে সোভিয়েত আমলের গল্প শুনছে রানা চুপচাপ। চোখ-কান খোলা। হোটেল থেকে বেরোবার একটু পর কাউন্টার সার্ভেইলেন্স ট্রেনিঙের কারণে টের পেয়েছে, অনুসরণ করা হচ্ছে ওদেরকে। নানান দোকানের কাঁচে চোখ রেখে বুঝেছে, সংখ্যায় তারা দু’জন। যথেষ্ট দক্ষ। পরনে সাধারণ পোশাক। লম্বা নয়, আবার বেঁটেও নয়। প্রায় ছায়ার মত। সাধারণ কেউ দ্বিতীয়বার তাকাবে না তাদের দিকে।

ঘুরে না চেয়ে দু’জনের ওপর চোখ রেখেছে রানা। পিছু নিয়ে এসেছে তারা লুবিয়াঙ্কা স্টেশনে। তখন বুটের ফিতা বাঁধার ভঙ্গি করে তাদেরকে মেপে নিয়েছে বিসিআই এজেণ্ট। তাদের একজনের হাতে ছিল মোবাইল ফোন। সরে গেছে প্ল্যাটফর্মের অন্যদিকে। আরেকজন ছিল সিঁড়িতে- হাতে পত্রিকা। রানা ও তানিয়া ট্রেনে চাপতেই চট করে এই বগিতে উঠেছে দু’জন। এখন আছে পেছনের দিকে। মাঝে মাঝে চোখ তুলে দেখছে ওদের। এখনও বুঝতে পারেনি ধরা পড়ে গেছে রানার চোখে।

রাশার অতীত ঐতিহ্য নিয়ে বলে চলেছে মেয়েটা। তার কানের কাছে মুখ নিল রানা। নাকে এল সোনালি চুলে আপেলের গন্ধ। ‘কারও দিকে তাকাবে না। আমাদের পিছু নিয়েছে দু’জন।’

কথাটা শুনে কুঁচকে গেল তানিয়ার নাক। সরু হয়েছে নীল দুই চোখ। ফিসফিস করল, ‘কারা? আমাদের পেছনে কেন?’

‘চলো, জিজ্ঞেস করি গিয়ে?’ বলল রানা। ‘তোমার কী ধারণা? এরা কারা হতে পারে?’

‘আপনি বোধহয় ভুল ভাবছেন,’ জানাল তানিয়া। ‘মনে হচ্ছে, আপনার জটিল একটা রোগ আছে। প্যারানোইয়া।’

‘থাকতে পারে,’ বলল রানা। ‘তবে ঘুরে দেখবে না পেছনে। ওরা এখনও জানে না আমি জেনে গেছি।’

‘এবার কী করবেন ভাবছেন?’

‘আগে ফোন করব।’

‘তারপর?’

‘এরপর হয়তো মুখোমুখি হব। গুলি করে মেরে লাশ ফেলে দেব বাইরে।’ ভীষণ গম্ভীর চেহারা করেছে রানা। ‘তোমার কাছে পিস্তল আছে?’

ভুরু কুঁচকে ফেলল তানিয়া। ‘আপনি কি ঠাট্টা করছেন?’

নিজের মোবাইল ফোনের স্পিড ডায়ালে লুকা ব্রেযনেভের নম্বর রেখেছে রানা। কয়েকটা বাটন টিপতেই মস্কোর সুড়ঙ্গের ভেতর পনেরো শ’ মাইল দূর থেকেও শুনল কড়কড়ে কণ্ঠ। ‘হ্যাঁ, রানা? পেলে ইউনাকে?

জবাবে নিচু গলায় ফ্রেঞ্চ ভাষায় বলল রানা, ‘মিস্টার ব্রেযনেভ, আপনি বলেছিলেন এই কাজ থেকে সরিয়ে নিয়েছেন নিজের লোকদেরকে।’

‘মিথ্যা বলিনি, ‘ একটু থমকে গিয়ে গিয়ে বললেন বিলিয়নেয়ার।

‘তা হলে তো মুশকিল। পিছু নিয়েছে দু’জন।’

‘তোমাকে বলছি, কাউকে পাঠাইনি। তুমি শিয়োর যে…’

‘শিয়োর। ঠিক আছে, পরে যোগাযোগ করব।’ কল কেটে দিল রানা। পলকের জন্যে ভাবল, বাড়তি লোক রেখে থাকতে পারেন ব্রেযনেভ। তবে পরক্ষণে চিন্তাটা উড়িয়ে দিল। মিথ্যার আশ্রয় নেবেন না স্পষ্টভাষী মানুষটা।

ভুরু উঁচু করে রানাকে দেখছে তানিয়া। ‘তো এবার কী করব আমরা?’

চট্ করে রানা ভাবল মেট্রো সিস্টেমের কোথায় ফাঁদে ফেলতে পারবে লোকদু’জনকে। পুরুষ-টয়লেট আদর্শ জায়গা হতে পারে। মারধর করলে কি জেনে নেয়া যাবে কার হয়ে কাজ করছে এরা? সম্ভাবনা খুবই কম। তা ছাড়া এরা অন্য কারও হয়ে পিছু নিলে, জোর খাটালে সেটা হয়তো হবে বোলতার চাকে ঢিল দেয়ার মত। আপাতত এমন কিছু করা উচিত হবে না ওর। রানা ঠিক করল, পরে জেনে নেবে আসলে এরা কারা। এখন জরুরি কাজ এদেরকে লেজ থেকে খসিয়ে দিয়ে নিজের কাজে মন দেয়া।

‘পরের স্টেশনে নামব,’ তানিয়াকে বলল রানা।

‘কিন্তু আমরা তো অর্ধেক পথও আসিনি।’

‘প্যারানোইয়া দম আটকে দিয়েছে। তাজা বাতাস চাই।’

পরের স্টেশন আরও রাজকীয়। রানা ট্রেন থেকে নামতেই বিরক্ত চেহারায় পিছু নিল তানিয়া। ভিড় করে নামছে যাত্রীরা। তাদের মাঝ দিয়ে পথ করে অনুসরণ করল লোকদু’জন। দ্রুত হাঁটছে রানা। ওর সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে প্রায় ছুটতে হচ্ছে মেয়েটাকে। দূরত্ব বজায় রেখেছে পেছনের লোকদুটো। তবে হাঁটাচলার ভেতর আগের চেয়ে বেশি তাড়া। দলে আরও লোক আছে কি না, তা বুঝতে হলে এখনই পরখ করতে হবে।

রাস্তায় উঠে রানা দেখল, এখনও ওরা রয়েছে শহরের মাঝে। ভারী ট্রাফিকের জন্যে চারপাশে জ্যাম। ফুটপাথে গিজগিজ করছে পথযাত্রী। খদ্দের পাওয়ার জন্যে কাছের ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে অপেক্ষা করছে হলদে সব ল্যাডা। ওগুলোর সামনের গাড়িটা হাতের ইশারায় ডাকল রানা। একমিনিটের ভেতর উঠে পড়ল পেছনের সিটে। পাশেই বসল তানিয়া।

‘রওনা হও, তাড়া আছে,’ দুই সিটের মাঝের ফাঁক দিয়ে বেশ কিছু রুবল বাড়িয়ে দিল রানা।

সাঁৎ করে গায়েব হয়ে গেল ওগুলো।

‘বিশ বছর ধরে আশা করেছি, কেউ এ কথা বলবে, চওড়া হাসি দিয়ে অ্যাক্সেলারেটর দাবাল ড্রাইভার। গাড়ির সারির ভেতর সামিল হলো ছোট্ট ল্যাডা। জানালা দিয়ে পেছনে তাকাল রানা। এইমাত্র সাবওয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসেছে লোকদু’জন। দেখছে এদিক ওদিক; চোখে- মুখে ভয়। কয়েক সেকেণ্ড পর পেছনের ভিড়ে হারিয়ে গেল তারা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *