এক
মস্কো, ইউএসএসআর।
উনিশ শ’ সাতান্ন সালের ফেব্রুয়ারি মাসের উনিশ তারিখ।
ভীষণ ঠাণ্ডা দিনটা ফুরোতেই নেমেছে হিমশীতল সন্ধ্যা। ভারী গ্রেটকোটের কলার সিধে করে ফাঁকা রাস্তায় হাঁটার গতি বাড়াল জন গ্রাহাম। আজই তার জীবনের শেষ রাত, তবে সেটা জানে না সে। পিছলা পথে বরফগলা, কাদাভরা পানিতে ভিজে গেছে জুতো। শোঁ-শোঁ হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঝরঝর করে ঝরছে তুষার, হয়তো চারপাশ আবারও হয়ে উঠবে শ্বেতশুভ্র।
বিপজ্জনক মিশনের শেষাংশে পৌঁছে আজ সত্যিই বুক কাঁপছে গ্রাহামের। ধরা পড়ে যাবে না তো? সেক্ষেত্রে মরবে প্রচণ্ড কষ্ট পেয়ে।
তার নকল কাগজপত্রে লেখা, সে রাশান নাগরিক। অথচ দু’চারটে কথা বললেই যে-কেউ বুঝে ফেলবে, ও বিদেশি মানুষ। চোরাই পথে পাঁচ সপ্তাহ আগে পৌঁচেছে ইউএসএসআর-এ। এরপর থেকে সযত্নে এড়িয়ে চলেছে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি।
সতর্কতার সঙ্গে তৈরি করা হয়েছে কাভার। ওর নাম : ইউরি সলোকভ। পেশায় পিয়ানো টিউনার। ওই একই কাজ করছে বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকে। আসলে সে ব্রিটিশ আর্মির মৃদুভাষী, অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন। পঁয়তাল্লিশ সালে যুদ্ধ শেষ হলে দেশের সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসে স্পেশাল এজেন্ট হিসেবে যোগ দিয়েছে। মস্কো শহরে তার মিশন ছোট হলেও তা মূল অপারেশনের সাফল্যের জন্যে খুবই জরুরি। পাঁচ সপ্তাহের টানা মানসিক যন্ত্রণা থেকে আজই মুক্তি পাবে সে। খারাপ কিছু না ঘটলে আজই কাজ, শেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমান্ত পেরিয়ে রওনা দেবে ব্রিটেনের উদ্দেশে।
হনহন করে হাঁটছে জন গ্রাহাম। বারকয়েক দেখেছে পেছনের রাস্তা। মাঝে মাঝে শিউরে উঠছে। হয়তো যখন তখন হঠাৎ হাজির হবে কেজিবির গুণ্ডারা। সেক্ষেত্রে শুরু হবে অকথ্য নির্যাতন এবং শেষে করুণ মৃত্যু!
গ্রেটকোটের গভীর পকেটে আছে অতি গোপন এক জিনিস। আজ রাতে ঠিক জায়গায় রাখবে সে ওটা। তারপর শুরু হবে মিশনের দ্বিতীয় পর্যায়। ওর সঙ্গের প্যাকেজ দেখলে যে-কেউ ভাববে, ওটা খুব সাধারণ জিনিস- তামাকের টিনের বৃত্তাকার কৌটা। সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিদিন ওই জিনিস নিয়ে কাজে বেরোয় লাখ লাখ মানুষ। তবে গ্রাহামের কৌটা এক টন টিএনটির চেয়েও বিপজ্জনক। ওটা সহ ধরা পড়লে নিজে তো মরবেই, সর্বনাশ হবে মিশনের।
অন্ধকার পথে বাঁক নিতেই গ্রাহামের মুখে এসে লাগল হাড়-কাঁপানো শীতের হাওয়া। ছলছলে হয়ে গেল দু’চোখ। বস্তির মত এলাকায় ভাড়া করা ঘর থেকে পুরো একমাইল হেঁটে এসেছে সে। আর কিছুটা দূরে একটা ওয়্যারহাউস, ঢুকবে ওখানে। শহরের এদিকটা ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া- মস্কোর অন্যান্য এলাকার তুলনায় অনেক বেশি নিরানন্দ ও অবহেলিত। বিপ্লবের আগের সব দালান এখন পরিত্যক্ত। জং ধরা কাঁটাতারের বেড়া থাকলেও কোথাও কোনও সম্পদ নেই, তাই গার্ডও নেই। তবুও সতর্ক হয়ে আছে ওর শরীরের প্রতিটি স্নায়ু। জ্বলে উঠেই আবার নিভে যাচ্ছে পথের নষ্ট বালবের চকিত হলদেটে আলো। দূরে গিয়ে পড়ছে ছায়া। ওদিকে চেয়ে রইল গ্রাহাম।
একটু পর ওর মনে হলো, অস্ত্র হাতে লুকিয়ে নেই কেউ। আরও কিছুক্ষণ পর সন্তুষ্ট হয়ে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে গিয়ে থামল সে। তুষারভরা বেড়ার মধ্যে চট করে কারও চোখে পড়বে না, ওখানে আছে একটা গর্ত। হালকা- পাতলা যে-কেউ চলে যেতে পারবে বেড়ার ওদিকে। তিন দিন আগে গ্রাহাম কেটে রেখে গেছে খানিকটা তার।
আগে ওয়্যারহাউসটা ছিল মিট প্যাকিং প্ল্যান্ট। বহু বছর আগে বন্ধ হয়েছে ব্যবসা। ক্ষয়ে গেছে দরজাগুলোর কবাট। খসে পড়েছে কব্জা থেকে। দালানের ভেতর আবছা আলো। মেঝেতে বরফে ঢাকা শক্ত, আধখাওয়া ইঁদুরের লাশ ডিঙিয়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছুল গ্রাহাম। এখানেই রাখতে হবে জিনিসটা। এরপর তথ্যটা জানিয়ে দিলেই একদিনের ভেতর ওখান থেকে ওটা সরিয়ে নেবে দলের কেউ। মিশনের শুরুতেই স্থির হয়েছে, কারও হাতে না দিয়ে, জিনিসটা রাখা হবে গোপন কোথাও। তা নাকি কম ঝুঁকিপূর্ণ। হাতে হাতে বিনিময় হলে খুশি হতো গ্রাহাম, কিন্তু তাতে রাজি নন বড়কর্তারা।
সাবধানে প্যাকেজ লুকিয়ে রাখার পর, কারও চোখে না পড়ে ওয়্যারহাউস থেকে বেরোল গ্রাহাম। এবার দ্বিতীয় কাজ। হিমঠাণ্ডার ভেতর অন্ধকারে চলেছে ও রন্দেভু পয়েন্টের দিকে। এই লোককে আগে কখনও দেখেনি সে, এরপর আর কখনও দেখবেও না। গ্রাহামের পকেটে ওঅটারপ্রুফ এনভেলপের ভেতর ছোট্ট এক কাগজের স্লিপ। তাতে রয়েছে চার লাইনের এনক্রিপ্ট করা মেসেজ। একবার এনভেলপ দিয়ে দেয়ার পর মাথা থেকে সমস্ত বোঝা নেমে যাবে গ্রাহামের। এরপর সব দায়িত্ব অন্যজনের। গোপন তথ্য ডিকোড করে সে বুঝে নেবে কোথায় আছে জিনিসটা। পৌঁছে দেবে পূর্ব বার্লিনে। ওখানে অধীর অপেক্ষায় রয়েছে ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের আরেকদল অফিসার। সব বুঝে নেবে তারা। আর একবার ওটা নিরাপদে লণ্ডনে পৌঁছুলেই শুরু হবে ওটার অ্যানালাইসিস। আশা করা হচ্ছে, এর ফলে বদলে যাবে বহু মানুষের জীবন। তবে জীবনের এতবড় ঝুঁকি নিয়ে যারা এসব সংগ্রহ করেছে, কখনও উচ্চারিত হবে না তাদের নাম।
জনবিরল রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চট্ করে একবার হাতঘড়ি দেখল গ্রাহাম। চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝল, পিছু নেয়নি কেউ। হুইশ আওয়াজে পাশ কাটাল পুলিশের একটা গাড়ি। ছিটকে দিয়েছে কাদাপানি। এক মুহূর্তের জন্যে, গ্রাহামের মনে হলো: যাহ্, ধরা পড়ে গেছি!
কিন্তু না-থেমে অন্ধকার রাতে হারিয়ে গেল গাড়িটা। হাঁটতে হাঁটতে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে গ্রাহাম। মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্যে কন্ট্যাক্টের সঙ্গে দেখা হবে ওর। তবে ওই সময়ে দু’জনই থাকবে মহাবিপদে। একসঙ্গে ধরা পড়লে তা হবে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন।
‘প্রায় পৌঁছে গেছি, এনভেলপ দিয়ে দিলেই ব্যস, ছুটি,‘ বিড়বিড় করল গ্রাহাম। ‘তারপর সোজা ফিরব দেশে।’
একটা শাখা রাস্তা পার হতেই কোথা থেকে যেন হাজির হলো লম্বা কোট পরা দীর্ঘদেহী এক লোক। মাথায় চওড়া হ্যাট। কাছে এসে রাশান উচ্চারণে ইংরেজিতে বলল সে ‘গুড ইভিনিং!’ দুষ্ট হাসি হাসছে। ডানহাত ঢুকে গেছে কোটের পকেটে। শক্ত করে ধরেছে পিস্তলের বাঁট।
গ্রাহাম বুঝে গেল, যার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, এই লোক সে নয়। এ কোমিতেত গসুদারস্তভেন্নায় বেযোপাস্নস্তি বা কেজিবির এজেন্ট। সোভিয়েত রেজিমের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলেছে বা বলবে, তাদেরকে খুন করার মহান দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে কেজিবির খুনিরা। এদের কারণে নিজ দেশেও বন্দি সাধারণ মানুষ। আগে পুরনো আমলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল যে খুনে সংগঠন, সেটার নাম ছিল চেকা বা সিক্রেট পুলিশ। তাদের কাছ থেকে সবই বুঝে নিয়েছে কেজিবি। দক্ষতার সঙ্গে খুন করতে অভ্যস্ত। ঠিক সিআইএ-র মত।
পেটের ভেতর পাক খেল গ্রাহামের। বুঝে গেছে, ওরই পিছু নিয়েছে কেজিবির এই এজেন্ট। বরফঢাকা রাস্তা আড়াআড়িভাবে ছুটে পেরোল ব্রিটিশ এজেন্ট। আরেকটু হলে বাঁকে পিছলে যেত। সামলে নিল নিজেকে। তখনই দেখল সামনের মোড়ে আরেক লোক। পালাতে দেবে না ওকে। দ্বিতীয় এজেন্টের মুখে হাসি নেই। কোটের পকেট থেকে বের করল সার্ভিস অটোমেটিক পিস্তল।
কীভাবে ধরা পড়লাম, ভাবছে গ্রাহাম। হয়তো এরই ভেতর ওর কন্ট্যাক্টের মুখ খুলিয়ে ছেড়েছে কেজিবির লোক! ওদের নিজেদের দলেই ছিল বিশ্বাসঘাতক?
এখন এসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই।
রাস্তার উল্টোদিকে ছুট দিল গ্রাহাম।
ওর পিছু নিল দুই এজেণ্ট।
‘বুম্!’ করে উঠল পিস্তল। বাঁকের কাছে দেয়ালের ভাঙা ইঁটের টুকরো ছিটকে লাগল গ্রাহামের পায়ে। বুঝে গেছে, খুন নয়, ওকে আহত করতে চায় এরা। একবার গ্রেফতার হলে জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতনের শেষ থাকবে না। কিন্তু মুখ খুলবে না গ্রাহাম। তার মত এজেন্টদেরকে আগেই বলা হয়েছে, কী করতে হবে। ওর কলিগদের মতই গ্রাহামের জুতোর হিলের ভেতর রয়েছে কাঁচের ছোট্ট ভায়াল। ওটার মধ্যে রয়েছে সায়ানাইড পিল। ধরা পড়বে বুঝলে গিলে ফেলবে ওটা। মৃত্যু কখনও আনন্দের নয়, তবে শত্রুর হাতে বন্দি হয়ে যন্ত্রণা পেয়ে মরার চেয়ে, অপেক্ষাকৃত কম কষ্টে চলে যাওয়া ভাল।
কোবল পাথরের সরু গলি ধরে ছুটছে গ্রাহাম। পাশের দেয়াল টপকে ওদিকে নামতে গিয়ে আরেকটু হলে ঘাড় ভেঙে মরত। বরফে ঢাকা খাড়া সব পিছলা সিঁড়িতে পড়েছে ওর পা। সড়াৎ করে নেমে গেল নিচে। উঠে এক দৌড়ে ঢুকল ডানের গলিতে। বাঁক নিল বামে। তারপর ডানে। গ্রাহাম বুঝতে পারছে অন্ধকার, সরু গলির গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেছে সে। তবে এখন প্রথম কথা: যেমন করে হোক শত্রু এড়িয়ে পালাতে হবে বহু দূরে। যুদ্ধের সময় অন্তত বারোজন সৈনিককে খুন করেছে গ্রাহাম। তবে এবার ওকে কোনও অস্ত্র ইণ্ড্য করেনি সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস। হয়তো ভেবেছে আণ্ডারকাভার এজেণ্ট, কাজ পিয়ানো টিউন করা; তার কাছে পিস্তল থাকার কথা নয়। তবে এখন একটা অস্ত্র পেলে মন্দ হতো না। আর যাই হোক, টিউনিং ফর্ক দিয়ে কিছুই করতে পারবে না সে।
দৌড় থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল গ্রাহাম। শ্বাস ফেলছে ফোঁস-ফোঁস করে। গলার কাছে উঠে এসেছে হৃৎপিণ্ড। শুকিয়ে গেছে মুখ। কান পাতল। কোথাও কোনও আওয়াজ নেই। ওকে বোধহয় হারিয়ে ফেলেছে লোকদু’জন। তবে আন্দাজে ভর করে স্বস্তি পাওয়ার উপায় নেই ওর।
পকেটে গোপন সাইফার। ওটা নিয়ে ধরা পড়লে সর্বনাশ হবে। এনভেলপ বের করে ব্যস্ত চোখে চারপাশে তাকাল গ্রাহাম। লুকিয়ে ফেলবে জিনিসটা। পরে সুযোগ পেলে আবারও ‘ফিরে এসে সংগ্রহ করবে। সরু গলির দু’দিকে ধূসর পাথরের পুরনো সব বাড়ি, পরিত্যক্ত। ডানদিকে বরফের মত ঠাণ্ডা, রুক্ষ সিমেন্টের দেয়াল। জায়গায় জায়গায় পাথরের স্ল্যাবের মাঝে ফাটল। সংকীর্ণ চেরা একটা অংশ পেয়ে ওটার ভেতর এনভেলপটা গুঁজল গ্রাহাম। আঙুল দিয়ে ঠেলে দিল আরও ভেতরে। কাজটা শেষ হতেই আবারও ছুটল পিচ্ছিল পথে।
বেশ কয়েক মুহূর্ত পেরিয়ে যাওয়ার পর ওর মনে হলো, ওকে হারিয়ে ফেলেছে কেজিবির এজেন্টরা। কিন্তু তখনই শুনল, পেছন থেকে আসছে একজোড়া পদশব্দ। সামনে থেকেও এল পায়ের আওয়াজ। গ্রাহাম বুঝে গেল, ওকে কোণঠাসা করে ফেলেছে লোকদু’জন।
এবার আর পালাতে পারবে না সে। হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল গ্রাহামের মন। বুঝেছে, শেষ হয়েছে পৃথিবীতে ওর জন্যে বরাদ্দ সময়। এবার শত্রুরা ধরে ফেলার আগেই জুতোর নকল হিলের ভেতর থেকে বের করতে হবে সায়ানাইড ভরা ক্যাপসুলটা। বসে পড়ল সে। চাপ দিতেই একপাশে সরে গেল হিলের একাংশ। ক্যাপসুলটা বের করে হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। এমনি সময়ে কানে এল তীক্ষ্ণ হুইসেলের আওয়াজ। কেঁপে উঠল গ্রাহাম। ভীষণ ঠাণ্ডায় প্রায় অবশ ওর আঙুল, হাত ফস্কে পড়ে গেল সায়ানাইডের ক্যাপসুল। ব্যস্ত হয়ে হাঁটু গেড়ে ওটা খুঁজতে চাইল ব্রিটিশ এজেন্ট। কিন্তু দেরি করে ফেলেছে। দু’পাশ থেকে তার দু’হাত চেপে ধরল দুই লোক। হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিল।
গ্রাহামের কানের পাশে ঠেসে ধরা হলো পিস্তলের মাযল। ঝটকা দিয়ে সরতে গেলে বুলেট ঢুকবে মগজে। তাই করত গ্রাহাম, কিন্তু তার মাথার আরেক পাশে পড়ল পিস্তলের জোরালো আঘাত। প্রায় অচেতন হয়ে গেল সে। তাকে টেনে নেয়া হলো রাস্তার মুখে এক গাড়িতে। স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে বসে আছে কেজিবির আরেক এজেন্ট। ঠোঁটে সিগারেট। পেছনের সিটে গ্রাহামকে তুলে দু’দিক দিয়ে গাড়িতে উঠল দুই এজেণ্ট। রওনা হয়ে গেল গাড়ি।
চলেছে মস্কোর কুখ্যাত লুবিয়াঙ্কা জেলখানা ও কেজিবি হেডকোয়ার্টারের দিকে। গ্রাহামের পেট থেকে সব বের করার জন্যে ওখানে অপেক্ষা করছে প্রশিক্ষিত টরচার মাস্টার।
জন গ্রাহামের জীবনের শেষ এই রাতটা হবে খুব দীর্ঘ ও অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক।
দুই
বর্তমান সময়।
মস্কো শহরের একটা ক্যাথোলিক চার্চের ভেতর হাঁটু গেড়ে বসে পাপ স্বীকার করছে অ্যান্টোনিন নিকোলভ। পর্দার ওপাশে চুপচাপ বসে সব কথা মন দিয়ে শুনছেন একজন ফাদার। নিচু গলায় বলে চলেছে নিকোলভ কত পাপ জমেছে তার মনে। নীরবে শুনছেন যাজক। সেই যুবা বয়স থেকেই পাপ থেকে মুক্তি দেয়ার জন্যে মানুষের মনের কথা শুনে যাওয়ার কাজে নিয়োজিত তিনি।
‘আমাকে মাফ করবেন, ফাদার, আবারও বলছি: গত দুই সপ্তাহে অনেক পাপ করেছি…’ বলে চলেছে নিঙ্কোলভ। ছোটখাটো পাপ বলতে মদ্যপান করেছে, এ ছাড়া রাতে মাফ চেয়ে প্রার্থনা করেনি স্রষ্টার কাছে। তবে তার চেয়েও বড় কারণে আজ ছুটে এসেছে দিক নির্দেশনার জন্যে। ‘বিশাল এক বোঝা চেপে বসেছে আমার মনে, ফাদার,’ নার্ভাস সুরে বলল সে। ‘জানতে পেরেছি ভয়াবহ এক তথ্য। এখন জানি না কী করব। ভীষণ ভয় লাগছে।’
এতক্ষণ চুপচাপ শুনেছেন ফাদার। এবার বললেন, ‘বাছা, ভেবে দেখো, তোমার সেই গোপন কথা আমাকে জানাবে কি না।’
‘জানাব, ফাদার। কিন্তু সেই কথা বলে আপনাকে না আবার ফেলে দিই মস্তবড় বিপদে।’
‘ভুল বা পাপ না করলে বিপদে পড়ার কথা ওঠে না, বাছা।’
‘জানি, মিথ্যা বলা বা সত্য গোপন করা মহাপাপ, ফাদার। বহুবার ওই কাজ করেছি। তথ্য গোপন করেছি সারাজীবন। কিন্তু সেসব এত ভয়ঙ্কর কিছু ছিল না। এখন খুলে বললে হয়তো মরতে হবে। তাই চাইছি আমাকে সাহায্য করুন স্বয়ং স্রষ্টা।’
ওর বিস্তারিত বক্তব্য শেষ হওয়ার পরেও দীর্ঘ সময় নীরব থাকলেন ফাদার। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বাছা, সাহায্য চাও সত্যিকারের মালিকের কাছে। অন্তর খুলে দাও তাঁর কাছে। তিনিই দেখাবেন সঠিক ‘পথ।’ কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘আশা করি আমাদের মিলিত প্রার্থনায় হয়তো স্রষ্টা ক্ষমা করে দেবেন তোমাকে, উদ্ধার করবেন বিপদ থেকে।’
‘আমেন,’ বিড়বিড় করল নিকোলভ।
‘তোমার মনে শান্তি ফিরে আসুক, বাছা। আমার বিশ্বাস, প্রভুর সাহায্য নিয়ে ঠিক কাজটাই করবে তুমি।’
ফাদারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ক্যাথেড্রাল থেকে মালায়া গ্রুযিনস্কায়া স্ট্রিটে নেমে এল অ্যান্টোনিন নিকোলভ। জুন মাস, মস্কো শহরের উজ্জ্বল রোদে ঝলমল করছে চারপাশ। তবে মনে স্বস্তি নেই তার। বড় দ্বিধা বুকে। এতই ভয় পেয়েছে, কোনও দিকেই খেয়াল নেই। বারবার নিজেকে বলছে, আবার এসবে জড়িয়ে গেলাম কী করে? বিশাল গথিক চার্চ পেছনে ফেলে হাঁটতে লাগল সে। ভাবছে, কী করে গত ক’দিনে এত বদলে গেল তার জীবন?
হ্যাঁ, খুব ভয়ানক খারাপ কিছুর ভেতর পড়ে গেছে নিকোলভ!
.
অ্যান্টোনিন নিকোলভের বয়স ঊনচল্লিশ। তালাকপ্রাপ্ত। একাকী। বর্তমানে বেকার। নিয়মিত কোনও কাজ যে করবে, সে ইচ্ছেও নেই। গত পনেরো বছর সবার কাছ থেকে গোপন করেছে, সে আসলে
আসলে ছিল রাশান ইন্টেলিজেন্সের একজন গুপ্তচর। কখনও অবশ্য বড় কোনও দায়িত্ব পায়নি। গত দশ বছর থেকেছে আমস্টারড্যামে। আশপাশের প্রতিবেশীরা ভাবতেও পারেনি কী ধরনের কাজ করে সে। এমন কী তার প্রাক্তন স্ত্রী তামারা বা ওদের ছোট্ট মেয়ে ইউনাও কিছু জানত না। সবাই ভাবত, নেদারল্যাণ্ডে আন্তর্জাতিক এক সফটওয়্যার
সফটওয়্যার কোম্পানিতে সিনিয়র টেকনিকাল সাপোর্ট অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ করে সে। জীবন ছিল নিরানন্দ। আশপাশের সবাই ভেবে নিয়েছে, রাশান ভাষা জানে বলেই তাকে বিশেষ কদর করে কর্মকর্তারা। কখনও কিছু সন্দেহ করেনি কেউ। প্রতিদিন সকালে স্ত্রী ও মেয়ের গালে চুমু দিয়ে সোজা যেত নকল অফিসে। সেক্রেটারির সঙ্গেই কাটাত সারাটা দিন। বিকেলে বাড়ি ফিরত হতাশ হয়ে।
বেশ অনেক দিন ধরেই ইউরোপের দেশগুলোতে নিজেদের গুপ্তচর তৎপরতা বজায় রেখেছে রাশান ইন্টেলিজেন্স। হাতিয়ে নিচ্ছে অনেক দেশের গোপন, জরুরি তথ্য। তবে নিকোলভের কাজের কোনও মূল্য ছিল না। সে হতে পারেনি জেমস বণ্ডের মত উঁচু পর্যায়ের গুপ্তচর। কখনও ওকে ব্যবহার করতে হয়নি পিস্তল। ঝুঁকিপূর্ণ কাজও আসেনি হাতে। আমস্টারড্যামে তার কাজ ছিল বিরোধী দেশগুলোর গুপ্তচরদের ওপর নজর রাখা। কিন্তু তারাও খুঁজে পায়নি গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজ। ইন্টারনেট ঘাঁটা ছাড়া কিছুই করার ছিল না অ্যান্টোনিন নিকোলভের। ফলে ধীরে ধীরে বিন্দু বিন্দু করে বুকে জমেছে অসন্তোষ। তার ক্যারিয়ারে বিশ্রী হতাশা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
উঁচু মানের কোড ক্র্যাকার সে। কিন্তু চাকরিতে যোগ দেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই দেখল, আজকাল দেশের সব এজেন্সি কোড ভাঙতে ব্যবহার করছে কমপিউটার। সেসব পনেরো ডিজিটের দানবীয় জটিল সত্তর মিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন পারমিউটেশন ভরা কোড ভাঙার কাজ করছে শক্তিশালী সব মেশিন। ফলে ক্রমেই রাশান সরকারের কাছে দাম কমতে থাকল নিকোলভের। কর্মকর্তাদের প্রতি ওর বুকে জমল তিক্ততা ও ঘৃণা। কোনও কাজই আর রইল না তার হাতে।
তারপর দশ বছর আগে নিকোলভের সঙ্গে ইণ্টারনেটের পর্দায় আবারও নতুন করে পরিচয় হলো স্কুলের বন্ধু তাতভ বেযুখফের। সেই সাত বছর বয়স থেকে ওদের বন্ধুত্ব। এরপর তারুণ্যে সেন্ট পিটার্সবার্গে আইটি বিভাগে লেখাপড়া করতে গেল নিকোলভ। তাতভ বসল বাবার রেডিয়ো মেরামতের দোকানে।
এরপর পেরোল কয়েকটা বছর। ষড়যন্ত্রের থিয়োরির জগতে তলিয়ে গেল তাতভ বেযুখফ। ততদিনে বন্ধ হয়েছে রেডিয়ো মেরামতির দোকান। জনবসতি থেকে বহু দূরে রাশার প্রত্যন্ত এলাকায় ছোট এক খামার কিনল বেযুখফ। সঙ্গী বলতে থাকল কয়েকটা আধা জংলি বেড়াল, কয়েক পাল মুরগি ও ছাগল। গোপন এক ট্রেইলার থেকে বেআইনী রেডিয়ো স্টেশন চালু করল সে। প্রচার করতে লাগল, কত ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে জড়িত রাশান সরকার। তারা নাকি শেষে ক্রীতদাস করে পৃথিবীর সব মানুষকে পাঠিয়ে দেবে মঙ্গল গ্রহে। দুনিয়ায় আসলে গণতন্ত্র বলতে কিছুই নেই। গোপনে ছায়ার ভেতর বসে ভিনগ্রহের একপাল অতিবুদ্ধিমান গিরগিটি চালাচ্ছে গোটা পৃথিবী।
ফেসবুকে নিয়মিত আলাপ হলেও বেযুখফের গাঁজাখুরি গল্প হজম করতে পারেনি অ্যান্টোনিন নিকোলভ। তবে তাতে নষ্ট হয়নি ওদের বন্ধুত্ব। প্রি-পেইড ফোনে জমে উঠল দু’জনের গল্প। ততদিনে নিজের কাজ নিয়ে যে হতাশা জমেছে নিকোলভের মনে, তাতে সে তলিয়ে গেল মদ ও গাঁজার ধোঁয়াটে জগতে। ফলাফল হলো খুবই খারাপ। কী কাজ করে তা স্ত্রীকে বলতে পারল না বলেই ক্রমে দূরে সরে গেল ওরা দু’জন। নিজেদের ভেতর বাড়ল তিক্ততা। একসময় অ্যান্টোনিনকে তালাক দিয়ে দশ বছর বয়সী একমাত্র মেয়েটাকে নিয়ে তামারা গিয়ে উঠল ফ্রান্সে চাচার বাড়িতে। জীবনে আর কিছুই থাকল না নিকোলভের। চাকরি ছেড়ে দিল সে। ফিরল মস্কো শহরে। জনসাধারণের কমপিউটার ভাইরাস ও টুকিটাকি দোষত্রুটি দূর করার কাজ নিল। তাতে যে সামান্য টাকা এল, তাতে কোনওমতে চলতে লাগল তার জীবন। তবে মন তো পুড়ছে প্রাণের ধন প্রিয় মেয়েটার জন্যে। ফলে বারবার ফোনে অনুরোধ করে প্রাক্তন স্ত্রী তামারাকে রাজি করাল, মহিলা যেন মাঝে মাঝে মেয়েটাকে আসতে দেয় মস্কো শহরে বাবার কাছে বেড়াতে। মেয়ের যাতে এখানে থাকতে কষ্ট না হয়, সেজন্যে খুব কম দামের ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্টও ভাড়া নিল নিকোলভ। এরপর প্রতি বছর অন্তত দু’বার তার কাছে বেড়াতে আসতে লাগল ইউনা। বেশ কয়েক মাস আগেও ওকে বেযুখফের খামার থেকে ঘুরিয়ে এনেছে নিকোলভ।
খামারে দেখা হলেই প্রায় সর্বক্ষণ ভোদকা গিলতে গিলতে আড্ডা দেয় দুই বন্ধু। ক’দিন আগে বেযুখফ বলেছে, ‘দোস্ত, তুমি তো কিছুই বিশ্বাস করবে না, তবে খেয়াল করে দ্যাখো কী ঘটছে। পেয়ে যাবে সব প্রমাণ। মানুষের মগজ দখল করে নিচ্ছে ভিনগ্রহের গিরগিটিরা। ঠেকাতে পারবে না কেউ। এখন যারা ঠাট্টা করছে, একদিন তারা বলবে তাতভ বেযুখফ একটা কথাও মিথ্যা বলেনি।’
পাগলাটে বন্ধুর কথা শুনে হেসেছে নিকোলভ। তবে তার জানা নেই, তাতভ বেযুখফ দিয়েছে জরুরি এক তথ্য: সত্যিই মানুষের মগজ দখল করতে মারাত্মক এক ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে গেছে মানব সমাজের ওপরমহলের কিছু লোক।
তিন
ক’দিন আগে ওর ছোট্ট অ্যাপার্টমেণ্ট থেকে বেরিয়ে চেনা এক কমপিউটারের দোকানের দিকে চলেছে নিকোলভ, এমন সময় টের পেল, পিছু নিয়ে ধীর গতিতে আসছে রহস্যজনক এক কালো মার্সিডিয গাড়ি। তার পাশে এসে থামল ওটা। নিকোলভ বুঝে গেল, এরা প্রাক্তন কেজিবির পেটের খাস সন্তান এফএসবি তথা ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের লোক। বরাবরের মতই ব্যবহার করছে কালো গাড়ি। অ্যান্টোনিন ভাবল, ঝেড়ে দৌড় দিয়ে হারিয়ে যাবে ভিড়ের ভেতর। কিন্তু কিছু করার আগেই মার্সিডিযের পেছন দরজা খুলে নেমে পড়ল কালো সুট পরা ষণ্ডা চেহারার দুই লোক। আগে কখনও তাদেরকে দেখেনি নিকোলভ।
ডানদিকের লোকটা বলল, ‘হ্যালো, অ্যান্টোনিন।’
অন্যজন দেখাল কালো গাড়িটা। ‘উঠে পড়ো। কথা আছে।’
আপত্তি করে লাভ হবে না বুঝে কালো মার্সিডিযের পেছন সিটে উঠল অ্যান্টোনিন। দু’পাশে চেপে বসল দুই এজেন্ট। ‘আপনারা আমার কাছে কী চান?’ জানতে চাইল সে। ‘আপনারা কারা? আমি তো আপনাদেরকে চিনি না।
‘আরে, চেনো, চেনো! সবই জানবে, এখন চুপচাপ বসে থাকো,’ বলল ডানদিকের লোকটা।
বিশ মিনিট পর মার্সিডিয থামল গম্ভীর দর্শন সরকারি এক ভবনের সামনে। আগে কখনও এখানে আসেনি নিকোলভ। দু’বার চেক পয়েন্ট পার হওয়ার পর আবারও থামল গাড়ি পাতাল এক গ্যারাজে। নিকোলভকে নিয়ে লিফটে চেপে বেশ কয়েক তলা ওপরে উঠল লোকদু’জন। দরজা খুলে যেতেই সামনে নিকোলভ দেখল দীর্ঘ এক ধূসর করিডোর। চারপাশে জানালা নেই। খুব ঘাবড়ে গেল নিকোলভ। ভাবতে লাগল, নিশ্চয়ই এখানে এনেছে ওকে মেরে ফেলার জন্যে।
একটা সাদামাটা দরজার সামনে থামল দুই এজেন্ট। তাদের একজন বলল, ‘ভেতরে যাও, নিকোলভ।’
নির্দেশ পালন না করে উপায় নেই। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে সাধারণ একটা ঘর দেখল নিকোলভ। আসবাবপত্র বলতে একটা টেবিল, কয়েকটা কেবিনেট ও চেয়ার। সব ধূসর রঙের। মেঝেতে কার্পেট নেই। ধুলোভরা একমাত্র জানালার কাঁচ ভেদ করে আসছে হলদেটে রোদ। ডেস্কের ওপর একটা টেলিফোন, কমপিউটার ও কার্ডবোর্ড ফোল্ডার।
ডেস্কের পেছনে বসে আছে পরিচিত এক লোক। চাকরি ছেড়ে দেয়ার আগে সে ছিল নিকোলভের বস্। তাকে ডাকত চিফ হিসেবে। নাম ভ্যানকিন কাপরিস্কি। মাথা ভরা সাদা চুল মিলিটারি কায়দায় ছাঁটা। পাথরের মত রুক্ষ তার কঠোর চেহারা। বয়স হবে কর্মপক্ষে সত্তর। নিকোলভ শুনেছে, যৌবনে নিজ হাতে খুন করেছে বেশ কয়েকজন সিআইএ এজেণ্টকে। কাপরিস্কির ধারণা আজও আগের মতই আছে কেজিবি।
হাতের ইশারায় নিকোলভকে সামনের চেয়ারে বসতে ইশারা করল ভ্যানকিন কাপরিস্কি। ঠোঁটে বাঁকা হাসি। ‘নিকোলভ, ওরা তোমাকে ভাল ট্রেনিং দিয়েছে, নইলে আগেই খুঁজে পেতাম। আজকাল কী করছ?’
ঢোক গিলল নিকোলভ। ‘আমি আসলে কোথায় আছি? আমার কাছে কী চান আপনি?’
‘এটা বলা যায়, আপাতত আবারও আমাদের হয়ে কাজ করছ তুমি,’ বলল কাপরিস্কি। ‘তোমাকে আবারও একটু দরকার আমাদের।
‘কিন্তু আমি তো অবসর নিয়েছি,’ আপত্তির সুরে বলল অ্যান্টোনিন। ‘এখন তো আর কারও চাকরি করি না।’
‘বলা চলে আবারও দায়িত্ব ফিরে পেয়েছ,’ বলল কাপরিস্কি। ‘ভুলে গেলে, একবার এই ক্লাবে ভর্তি হলে সদস্যপদ বাতিল হয় না? খেলাটা এমনই। চাও বা না চাও, খেলতে হবে তোমাকে। তোমার জন্যে জরুরি একটা কাজ তৈরি হয়েছে।’
চুপ করে থাকল নিকোলভ। তার দিকে • কার্ডবোর্ড ফোল্ডার ঠেলল ভ্যানকিন কাপরিস্কি। ‘ওটা খোলো।’
নীরবে নির্দেশ পালন করল নিকোলভ। কার্ডবোর্ড ফোল্ডারের ভেতরে রয়েছে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ফাইল। ওটা থেকে একমাত্র কাগজটা নিল সে। বছরের পর বছর প্রাকৃতিক অত্যাচারে জীর্ণ হয়েছে ওটা। ভাঁজের জায়গাগুলো প্রায় ছেঁড়া। কাগজে কালো কালিতে লেখা চারটে লাইন। এখনও ভালভাবেই পড়া যাচ্ছে। ভাষাটা রাশান নয়। অক্ষরগুলো ইংরেজি। যদিও ভাষাটা ওই দেশের নয়।
‘একটা সাইফার,’
‘বলল নিকোলভ। বুঝে গেছে, কাগজটা অন্তত কয়েক দশক আগের। বুকে টের পেল কৌতূহলের খোঁচা।
‘ভাল লাগছে যে খেয়াল করার ক্ষমতা হারিয়ে বসোনি, এজেণ্ট নিকোলভ।’
‘দয়া করে আমাকে আর এজেন্ট বলে ডাকবেন না।’
‘এই সাইফারের জন্যেই তোমাকে ডেকেছি,’ বলল স্টেশন চিফ। ‘পুরনো আমলের মত ওটা ডিকোড করবে আমাদের হয়ে।
আরও মনোযোগ দিয়ে সাইফার দেখল নিকোলভ। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, আগে কখনও এ ধরনের সাইফার দেখেনি। এমন কী ওর আমলের চেয়েও ওটা পুরনো। ‘সহজ হবে না ডিকোড করা।’
‘সেজন্যেই তো তোমার সাহায্য চাই,’ বলল স্টেশন চিফ। ‘আমরা মনে রেখেছি যে হারামজাদা কমপিউটার আসার আগে তুমিই ছিলে আমাদের সেরা কোড ব্রেকার। তিক্ত শোনাল তার কণ্ঠস্বর।
এনক্রিপটেড টেক্সট্ আবারও দেখল অ্যান্টোনিন।
নিজের হতাশা সামলে চিফ বলল, ‘দু’সপ্তাহ আগে মস্কোর নোভোজিরেয়েভো এলাকার কয়েকটা বাড়ি বোমা দিয়ে ধূলিসাৎ করার সময় একটা বাড়িতে মেলে ওই সাইফার। দেয়ালের ফাটলের মাঝে ছিল ওই এনভেলপ। দেয়াল ভাঙার পর ওটা দেখে বিস্মিত হয় কর্মীরা। দেরি না করে পৌছে দেয় পুলিশের হাতে। … কী বলো, একেই বলে দেশপ্ৰেম।’
‘এনভেলপ ওখানে গেল কী করে?’ জানতে চাইল নিকোলভ।
মৃদু হাসল চিফ কাপরিস্কি। বুঝে গেছে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে প্রাক্তন এজেন্ট। ‘আমাদের ধারণা, ওই এনভেলপ লুকিয়ে রাখা হয় উনিশ শ’ সাতান্ন সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। কাজটা করে এক ব্রিটিশ গুপ্তচর। তার কাভার আইডি ছিল ইউরি সলোকভ। আসল নাম জন গ্রাহাম। যুদ্ধের আগে ছিল ব্রিটিশ আর্মির ক্যাপ্টেন। জানুয়ারির দিকে সে এবং আরও কয়েকজনকে ঢুকিয়ে দেয়া হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেতর। ওই স্পেশাল অপারেশন কীসের জন্যে, সেটা জানার দরকার নেই তোমার। শুধু এটা জানলেই চলবে, আমাদের দেশের গোপনীয় জিনিসপত্র চুরি করছিল তারা। এর কিছু দিন পর নানাভাবে ঝামেলা করে পশ্চিমারা।’ নিকোলভ বুঝে গেল বহুকাল আগের কথা বলছে চিফ। তখন বার্লিনের দেয়াল নিয়ে হৈ-চৈ চলছিল দুনিয়া জুড়ে।
চেয়ার ছেড়ে ধুলো ভরা জানালার সামনে গেল চিফ কাপরিস্কি। তার পিঠ নিকোলভের দিকে। নিচু গলায় বলল সে, ‘ওরা রাশান জমিতে পা রাখতেই সতর্ক হয়ে ওঠে আমাদের ছেলেরা। আমরা খোঁজ নিই কী চাইছে তারা। ওই সাইফারে ছিল জরুরি তথ্য। সেটা কী, তা জানা যাবে ওটা থেকেই। দলের এক গুপ্তচরের কাছে তথ্য পাচার করছিল ক্যাপ্টেন জন গ্রাহাম। কিন্তু তাকে একটু আগেই ধরে ফেলে কেজিবির ছেলেরা। ওরা যদি দু’জনকে দেখা করতে দিত, একইসঙ্গে দু’জনকে গ্রেফতার করতে পারত। সমস্ত তথ্যও আমরা পেয়ে যেতাম।’ ঘুরে কাঁধ ঝাঁকাল কাপরিস্কি। ‘তবে মানুষের কাজে তো ভুল হয়ই। ওই লোক যখন বুঝল যে- কোনও সময়ে ধরা পড়বে, লুকিয়ে ফেলল ওই এনভেলপ। ভেবেছিল প্রাণে বাঁচলে পরে গিয়ে ওটা সরিয়ে নেবে।’
‘কিন্তু বাঁচল না।’
মাথা নাড়ল চিফ কাপরিস্কি। ‘তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো লুবিয়াঙ্কায় জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে। আমাদের দুর্ভাগ্য, যে লোক তার পেট থেকে সব বের করবে, সে ছিল নিজের কাজে একটু বেশি উৎসাহী। ফলে জরুরি তথ্য দেয়ার আগেই মরে গেল ক্যাপ্টেন জন গ্রাহাম।’
কথাটা শুনে অসুস্থ বোধ করল নিকোলভ। ওই লোকের কী হয়েছিল, সেটা পরিষ্কার মনের চোখে দেখতে পাচ্ছে সে।
‘তবে মরার আগে উঁচু পর্যায়ের কিছু তথ্য দিল,’ বলল চিফ। ‘ওই বিষয়টি ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক।’ এবার জোর দিয়ে বলল সে, ‘আমরা এখনও চাই গোপন থাকুক এসব তথ্য। আমাদের ধারণা, এই সাইফার ভাঙলে জানা যাবে কতটা জানত লোকটা। বা কারা ছিল এসবের সঙ্গে জড়িত। এ-ও জানা যাবে, কতটা ক্ষতি হয়েছে আমাদের সিকিউরিটির।’
‘এসব তো বহু বছর আগের কথা,’ ভুরু কুঁচকে বলল নিকোলভ, ‘এখন কি আর ওই তথ্যের কোনও মূল্য আছে?’
‘বড় ধরনের গোপন তথ্য কিন্তু প্লুটোনিয়ামের মতই, ‘ জবাবে বলল চিফ কাপরিস্কি। ‘সময়ের সঙ্গে বদলে যায় না তার গুরুত্ব।’
নীরবতা বিরাজ করছে ঘরে।
ডেস্কের একটা ড্রয়ার টেনে খুলল চিফ। ‘তুমি তো জানো, কোল্ড ওঅরের সময়ে যেসব শত্রু গুপ্তচর ধরা পড়েছিল, তাদের বিষয়ে বিস্তারিত আর্কাইভ ছিল কেজিবির হাতে। সোভিয়েত রেজিম বিদায় নিলেও নষ্ট করা হয়নি সেসব। সরিয়ে নেয়া হয়েছে মাটির নিচের হাই সিকিউরিটি ভল্টে। তারই একটা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। ফলে ভালভাবেই পড়েছি গ্রাহামের ফাইল। তাতে পেয়েছি এমন কিছু তথ্য, যা আমাদের নিরাপত্তার জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ। যে রাতে ধরা পড়ল, সেদিন খুব বিপজ্জনক কিছু সরিয়ে নেয় সে।’
ড্রয়ার থেকে নিয়ে নিকোলভের দিকে একটা প্যাকেট ঠেলে দিল চিফ কাপরিস্কি। ওটা নেবে কি না ভাবতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ল নিকোলভ। তারপর প্যাকেট খুলে চোখ বোলাল ভেতরে। মুখ তুলে দেখল চিফকে।
‘টিউনিং ফর্কস্,’ বলল কাপরিস্কি, ‘ওটা ছিল ওর কাভারের অংশ। ওগুলো জরুরি নয়। আমি জানতে চাই ওই বইয়ের ব্যাপারে।’
পেপারব্যাক বই। পঞ্চান্ন সালের এডিশন। লাকি জিম নামের বইটি লেখেন কিংসলে অ্যামিস। সরকারি গোপন গুদামে থাকলেও বয়সের ভারে হলদে হয়ে গেছে কাগজ।
‘বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়েছে কোনও কোনও পাতা, ‘ বলল চিফ কাপরিস্কি, ‘তুমি ভাল করেই জানো, সেটা কেন করা হয়েছে।’
মৃদু মাথা দোলাল নিকোলভ।
পুরনো আমলের বেশিরভাগ সাইফার তৈরির সময় ব্যবহার করা হতো নির্দিষ্ট কোনও বইয়ের অংশ। যে তৈরি করত কোর্ড, কোড ব্রেকারকে সে জানিয়ে দিত বইয়ের কোন্ অংশ থেকে পাওয়া যাবে ডেটা। ওই বই না পেলে গোপন মেসেজের অর্থ খুঁজে নেয়া হতো প্রায় অসম্ভব। আনমনে মাথা নাড়ল নিকোলভ। গাধা ছিল জন গ্রাহাম। নইলে ধরা পড়ার সময় নিজের কাছে রাখত না এই বই। মস্তবড় ভুল করেছিল সে। হয়তো মারা গেছে সেজন্যেই।
‘কাজে নেমে পড়ো,’ বলল কাপরিস্কি। ‘দ্রুত ফলাফল চাই, এজেণ্ট নিকোলভ। আরেকটা কথা, এখান থেকে বেরিয়ে প্রথমেই কেটে নেবে চুল-দাড়ি। তোমাকে দেখাচ্ছে বিটনিকদের মত। আমি কিছু না বললেও যে-কোনও সময়ে তোমাকে জেলখানায় ভরবে পুলিশ।’
চার
ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে নিজের স্যাঁতসেঁতে, ঘুপচি অ্যাপার্টমেন্টে ফিরল অ্যান্টোনিন নিকোলভ। ভাবতেও পারেনি, চাকরি ছেড়ে দেয়ার এতদিন পরেও নিজেদের স্বার্থে ওকে ব্যবহার করতে চাইবে ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস।
এখন?
ওদের দেয়া কাজটা না করে কোনও উপায় আছে তার? নিজেকে বুঝ দিচ্ছে না, আসলে কাজটা পেয়েই ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে সে। ওর মন বলছে, দ্যাখ পারিস কি না সাইফারের জট খুলতে! বহু দিন ধরেই বাঁচার জরুরি কোনও উদ্দেশ্য নেই তোর। যা সবচেয়ে ভাল পারিস, সেই কাজই পেয়েছিস এতদিনে। চিফ কাপরিস্কিকে সন্তুষ্ট করতে নয়, নিজের কাছে নিজের ক্ষমতা প্রমাণ করতেই তোর উচিত সাইফার ভেঙে দেখা।
একবার দেখেই বুঝেছে, আগে কখনও ওই ধরনের সাইফার দেখেনি। ওস্তাদ তালামিস্ত্রির অবস্থা ওর। সামনে যেন প্রাচীন আমলের মিশরীয় বা চৈনিক জটিল কোনও তালা। খুলতে হবে ওটা’। ছোট্ট লিভিংরুমের কোণে টেবিলের ওপর বইটা রাখল নিকোলভ। কফি তৈরি করে আবারও ফিরল টেবিলে। চেয়ারে বসে বামে রাখল জন গ্রাহামের লাকি জিম বইটা। তার পাশে সাইফার, নোটপ্যাড, কলম এবং বিশ্বস্ত ল্যাপটপ। ডান কনুইয়ের কাছে থাকল ধূমায়িত কফি। ডুবে গেল ও কাজে। খেয়াল নেই দুনিয়ার আর কোনও বিষয়ে। ল্যাপটপে রয়েছে ওর নিজের তৈরি কিছু ডিক্রিপশন প্রোগ্রাম। তবে এবার কাজে আসবে না ওসব আধুনিক টেকনোলজি। নিজের মগজ খাটাতে হবে সেই পুরনো আমলের মত।
সাইফারটা মডিফাই করা পলিবিয়াস স্কয়্যার, সঙ্গে ছড়িয়ে আছে বাইপারটাইট মোনোঅ্যালফাবেটিক সাবস্টিটিউশন। সুপার-এনসাইফার করা হয়েছে ডাবুল ট্র্যান্সপোযিশন ব্যবহার করে। সংক্ষেপে বললে, সাইফার হয়ে উঠেছে অত্যন্ত কঠিন। হলদেটে পুরনো বইটা না পেলে কিছুই করতে পারত না অ্যান্টোনিন। পাতাগুলোর ভেতর নিশ্চয়ই কোথাও আছে সূত্র। ব্রিটিশ গুপ্তচর ওই জিনিসই দিতে চেয়েছিল তার সহযোগীকে।
সারারাত কাজে বুঁদ হয়ে থাকল নিকোলভ। পেরিয়ে গেল দ্বিতীয় দিন এবং পরের রাতটাও। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইল শরীর। ভুলে গেল খাবার খেতে। দু-একবার ডেস্কে বসেই ঘুমিয়ে নিল। ওয়াশরুমে যাওয়া ছাড়া চেয়ার ছেড়ে কোথাও নড়ল না। ঘরের মেঝে ভরে গেল মুচড়ে ফেলা কাগজের টুকরোয়। নিজের কাজে এতই মগ্ন যে জানে না ইতিমধ্যে কতবার কাপরিস্কির লোক উঁকি দিয়ে দেখে গেছে ওকে।
কিন্তু তৃতীয় ভোরে শেষ পর্যন্ত আলোর দিশা পেল সে। নিজের তৈরি, প্রোগ্রাম ব্যবহার করে জেনে গেল, কী আছে সাইফারের ভেতর। চেয়ারে হেলান দিয়ে বহুক্ষণ চেয়ে রইল সে স্ক্রিনের দিকে। ডিকোড করা মেসেজ সংক্ষিপ্ত। ওপরের লাইনে ইংরেজিতে মাত্র চারটে শব্দ: অপারেশন মাস্টার্স ইয রিয়েল! নিচের লাইনে একটা জিয়ো কোঅর্ডিনেট।
ওই চারটে শব্দ ভীষণ ঝাঁকিয়ে দিল নিকোলভকে। বুকে হাই-পাওয়ারের রাইফেলের বুলেট লাগলেও এতটা বিস্মিত হতো না। কোল্ড ওঅরের সময় চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল একটা ষড়যন্ত্রের থিয়োরি। আজও ওটা নিয়ে আলোড়ন আছে ইণ্টারনেট জগতে। অনেকে বলে ওটা ছিল বদ্ধ কোনও উন্মাদের দুঃস্বপ্ন। কিন্তু বাস্তবে সেটা ছিল সোভিয়েত আমলের অত্যন্ত গোপন একটা হাইলি ক্লাসিফায়েড অপারেশন। মাঝে মাঝেই এ বিষয়ে আলাপ করত তাতভ বেযুখফ। তবে নিজে কখনও ওই ব্যাপারে মন্তব্য করেনি অ্যান্টোনিন। ভেবেছে, বিষয়টি আসলে তাতভের ভিনগ্রহী গিরগিটির থিয়োরির মতই গাঁজাখুরি।
এখন আর হাসতে পারছে না অ্যান্টোনিন। আস্তে করে শ্বাস ফেলে বিড়বিড় করল, ‘তা হলে সত্যিই আছে ওই ডিভাইস?’
নইলে ব্রিটিশ গুপ্তচর কেন লিখবে:
অপারেশন মাস্টার্স ইয রিয়েল?
আজ থেকে বহু বছর আগেই এ বিষয়ে জেনে গিয়েছিল ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স। তারাই পাঠিয়েছিল জন গ্রাহামকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খুব সম্ভব ওই ডিভাইস চুরি করে সে। আর সেজন্যে শেষপর্যন্ত মরতে হয় তাকে।
গুগল-এ জিয়ো কোঅর্ডিনেট দিতেই নিকোলভ জেনে গেল, মস্কো শহরেই রয়েছে চোরাই ওই ডিভাইস। এ-ও বুঝল, মাত্র একটা কাজই করতে পারে ও এখন।
প্রাচীন ঝরঝরে এক ফোক্সভাগেন গাড়ি আছে তার। প্রতি বছরই হালকা হচ্ছে গাড়িটা, কারণ রাস্তায় যেখানে সেখানে খসে পড়ে পার্ট। আশা করা যায় আধমরা গাড়ি নিয়ে ভোরের ফাঁকা রাস্তায় বেরোলে ঠিক সময়ে পৌঁছুবে গন্তব্যে। পুবে নোভোজিরেয়েভো ডিসট্রিক্ট। ওখানেই সাতান্ন সালে ব্রিটিশ গুপ্তচরকে গ্রেফতার করে কেজিবির এজেন্ট।
কোঅর্ডিনেট অনুযায়ী গাড়ি চালিয়ে সোভিয়েত আমলের পুরনো এক পরিত্যক্ত ওয়্যারহাউসের সামনে থামল নিকোলভ। চারদিকে উঁচু ওয়াএয়ারের বেড়া। যে-কোনও দিন ভেঙে ফেলা হবে এদিকের সব বাড়িঘর।
জন গ্রাহামের ডিকোডেড ডিরেকশন একদম নিখুঁত। জংধরা কিছু ধাতব খালি ক্রেটের ওদিকে অ্যান্টোনিন পেল তামাকের একটা কৌটা। বহু বছর আগে ওখানেই রেখেছিল ওটা ব্রিটিশ এজেন্ট। ওটা নিয়ে ওয়্যারহাউস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠল অ্যান্টোনিন। হলদেটে জঙে ভরে গেছে টিনের কৌটার বাইরের দিক। একটা কয়েন দিয়ে চাড় দিতেই ঢুপ আওয়াজে খুলল এয়ারটাইট কৌটোর ঢাকনি।
ভেতরে ছোট এক রোল মাইক্রোফিল্ম। আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করে নিজের কমপিউটারের মাধ্যমে ওটা স্ক্যান করতে পারবে অ্যান্টোনিন। এ ছাড়া কৌটায় রয়েছে ছোট চারকোনা কাপড়ে মোড়া কিছু। কাপড়টা খুলতেই হাতে পড়ল আয়তাকার ধাতব একটা ডিভাইস। দৈর্ঘ্যে মাত্র কয়েক মিলিমিটার। দু’দিক ডিম্বাকৃতির। অনেকটা মেডিসিন ক্যাপসুলের মত। মসৃণ স্টেইনলেস স্টিলের মত চকচকে।
অ্যান্টোনিন ভাবছে, এটা সত্যিই সে-জিনিস হলে এবার দুনিয়া জুড়ে শুরু হবে তোলপাড়। প্রথমবারের মত মিলবে ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমাণ। ফলে বদলে যাবে বর্তমান মানব-সভ্যতা। তবে কেউ যেন ওটার অস্তিত্ব জানতে না পারে, সেজন্যেই এত ব্যস্ত কাপরিস্কি এবং তার দলের সবাই। চিফ বলেছিল, ওই গোপন তথ্য প্লুটোনিয়ামের মতই। ষাট বছরেরও বেশি পুরনো আণবিক বোমার চেয়েও হয়তো বেশি বিপজ্জনক। কিন্তু জিনিসটা পেলে কী করবে হারামজাদারা? বর্তমান টেকনোলজি তো বোধহয় আরও আধুনিক। এসব ভাবতে গিয়ে গলা শুকিয়ে গেল অ্যান্টোনিন নিকোলভের। মনে মনে বলল, ‘সব খুলে বলব তাতভ বেমুখফকে। ও হয়তো বলতে পারবে এরপর কী করা উচিত।’
পকেট থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে বিড়বিড় করে নিজেকে গালি দিল অ্যান্টোনিন। তাতভের আস্তানা গোপন রাখতে তাকে কল দেয়ার সময় প্রি-পেইড ফোন ব্যবহার করে সে। সেটা রেখে এসেছে বাড়িতে। গত দু’দিন হলো সাধারণ মোবাইল ফোনটাও চেক করেনি। এখন দেখল প্রাক্তন স্ত্রী পাঠিয়েছে ই-মেইল।
চিঠিটা পড়ে বিড়বিড় করল অ্যান্টোনিন, ‘মহাবিপদ!’
কড়া হুমকি দিয়েছে তামারা। যে-কোনও দিন আইনী ব্যবস্থা নেবে। একমাত্র মেয়ে ইউনার প্রতি নিজের দায়িত্ব পালন করছে না অ্যান্টোনিন। কাজেই আদালতের মাধ্যমে ওর সব অধিকার কেড়ে নেবে তামারা। গত পাঁচবারের ভেতর তিনবার মস্কো শহরে গিয়েও বাবার দেখা পায়নি ইউনা। মন খারাপ করে ফিরেছে ফ্রান্সে নানার বাড়িতে। কাজেই এবার অ্যান্টোনিন এয়ারপোর্টে ঠিক সময়ে না গেলে ভবিষ্যতে ধরে নিতে হবে, আর কখনও ইউনাকে দেখতে পাবে না সে।
অ্যান্টোনিন নিকোলভ জানে, বড় কোনও অপরাধ করেনি। ওই তিনবারের দু’বার ভীষণ জ্বর ও যক্ষ্মায় ভর্তি ছিল হাসপাতালে। যারা পৌঁছে দেয় ওখানে, তারা বুদ্ধি করে অ্যাপার্টমেণ্ট থেকে মোবাইলটা নিয়ে ওর হাতে দেয়নি। কাজেই নিকোলভ জানত না কবে মস্কোতে আসছে ইউনা। আর শেষবার ই-মেইল না করেই মেয়েকে পাঠিয়ে দেয় তামারা। তখন সেইণ্ট পিটার্সবার্গে ওর ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল অ্যান্টোনিন।
দেখা যাচ্ছে প্রতিশোধপরায়ণা হয়ে উঠেছে তামারা। তাই বলে বাবার সঙ্গে মেয়ের সাক্ষাৎ বন্ধ করে দিতে পারে না সে! রেগে গেলেও কয়েক মুহূর্ত পর অ্যান্টোনিন বুঝল, সত্যিই যা খুশি করতে পারবে তামারা। তার চাচা ইউরোপের সবচেয়ে ধনী বিলিয়নেয়ার। টাকা খরচ করা তার জন্যে কিছুই নয়। প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী লোক। তাতভের- বক্তব্য অনুযায়ী, সে আসলে পৃথিবীর কেউ নয়, ভিনগ্রহের ভয়ঙ্কর বিষাক্ত এক গিরগিটি!
ই-মেইলটা দেখে অ্যান্টোনিনের মনে পড়েছে, আজই দুপুরের আগে এয়ারপোর্টে গিয়ে ইউনাকে অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যাওয়ার কথা ওর। সাইফার নিয়ে এতই মেতে ছিল, মনেই পড়েনি আগামী পাঁচদিন ওর সঙ্গে ছুটি কাটাবে মেয়েটা। এবার এয়ারপোর্টে যেতে ভুল করলে পস্তাতে হবে ওকে। তামারা আইনী ব্যবস্থা নিলে একমাত্র মেয়েকে আর দেখতে পাবে না, এ কথা ভাবতে গিয়ে বুক ভেঙে যেতে চাইল নিকোলভের।
এমনিতেই মাথা নষ্ট হওয়ার দশা!
সাইফার আর ওর আবিষ্কার নিয়ে এবার কী করবে সে?
ভাবতে গিয়ে বুঝে গেল, বেশি কিছু করতে পারবে না।
কৌটার ভেতর কী, সেটা কাপরিস্কিকে জানানো মানেই নিজের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা। এ যুগেও সামান্য কারণে যে-কোনও মানুষকে গায়েব করে দেয় কেজিবির দোসর সমস্ত এসপিয়োনাজ সংগঠন। অ্যান্টোনিন, তথ্য গোপন করলে, ওর দিকে আঙুল তাক করবে কাপরিস্কি। ফলে দুনিয়ার কোথাও গিয়ে বাঁচতে পারবে না সে। মরবে মগজে একটা বুলেট নিয়ে।
থরথর করে কাঁপছে হাত, টের পেল অ্যান্টোনিন। টিনের কৌটার ভেতর রেখে দিল মাইক্রোফিল্ম ও খুদে ডিভাইস। গাড়ির ইঞ্জিন চালু করবে ভেবেছে, এমন সময় বেজে উঠল মোবাইল ফোন। কল রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই ঘেউ করে উঠল গম্ভীর এক কণ্ঠ: ‘কী? কাজ এগোল? কয়েকটা দিন তো পেলে!’
‘ও, আপনি, চিফ,’ ব্যস্ত হয়ে মগজ খাটাতে চাইল সে। এবার নিতে হবে দ্রুত সিদ্ধান্ত। ‘ইয়ে… আসলে… চিফ… হয়েছে কী……
‘আগেই বলেছি কাজটা দ্রুত শেষ করবে।’
‘সাইফার ঠিকই ডিকোড করতে পারব, চিফ। তবে বড়ই কঠিন, আরও কিছু সময় দিতে হবে।’
‘এত সময় লাগছে কেন?’
‘যা ভেবেছি, তার চেয়েও জটিল। তবে পারব, চিফ। আমার ওপর ভরসা রাখুন।’
নিচু গলায় কাকে যেন গালি দিল ভ্যানকিন কাপরিস্কি। তারপর একটা কথাও না বলে ফোন রেখে দিল।
ইঞ্জিন চালু করে নীল ধোঁয়া ছেড়ে ছ্যার ছ্যার আওয়াজে ফোক্সভাগেন নিয়ে রওনা হলো অ্যান্টোনিন। তাতভের সঙ্গে গোপন বিষয়ে আলাপ করবে ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল কাপরিস্কির হুমকি। তাতভ এসব জানলে প্রথম সুযোগেই রেডিয়োতে আর ইন্টারনেটে সব ছড়িয়ে দেবে। ফলে আরও খেপে যাবে কেজিবি। প্রাণে বাঁচতে দেবে না ওকে।
আগে দেখব মাইক্রোফিল্মের ভেতর কী, ভাবল অ্যান্টোনিন। তারপর ভাবব কী করা যায়। পুরনো গাড়ি সাধ্যমত দ্রুত চালিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরল সে। প্রায় লাফিয়ে গিয়ে বসল লিভিংরুমের টেবিলে। চালু করল পিসি ও স্ক্যানার। মাইক্রোফিল্ম প্রসেস করা সহজ কাজ। তবে তাতে সামান্য ডেটা সংগ্রহেও লাগে বেশ সময়। পঞ্চাশ দশকের মাইক্রোফিল্মের সব তথ্য এঁটে যাবে ছোট্ট এক ডিজিটাল স্টোরেজে। তবে ডেটা যেসব পেল অ্যান্টোনিন, হতবাক না হয়ে পারল না। প্রতিটি ডেটা রাশান ভাষায় লেখা। অচেনা এক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিটি তথ্যে সোভিয়েত আমলের অফিশিয়াল সিল। দেয়া হয়েছে বিস্তারিত ব্যাখ্যা, পরিকল্পনা, ব্লুপ্রিন্ট, কেস স্টাডি এবং আরও বহু কিছু। সব দেখার পর হাসবে না কাঁদবে বুঝল না অ্যান্টোনিন। সাবধানে সমস্ত ডেটা সংগ্রহ করল ছোট এক ফ্ল্যাশ ড্রাইভে। ঠিক করেছে, যেখানে যাবে, সঙ্গে নেবে ওটাকে। কমপিউটার থেকে মুছে দিল সব ধরনের প্রমাণ। অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর হাঁটতে গিয়েও ওর মনে হলো, পকেটে করে ঘুরছে এক মেগাটন শক্তির আণবিক বোমা। বুঝে গেল, বাঁচতে হলে ওর চাই ঈশ্বরের সহায়তা।
দুই মগ কফি ও প্রায়-বাসি একটা বিস্কুট শেষ করে অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে প্রায় দৌড়ে নেমে এল অ্যান্টোনিন। গাড়ি নিয়ে রওনা হলো ক্যাথেড্রালের উদ্দেশে। গির্জায় গিয়ে আলাপ করবে ফাদারের সঙ্গে। তিনি জ্ঞানী মানুষ। হয়তো বলে দেবেন এরপর কী করা উচিত 1
একঘণ্টা ধরে বুড়ো যাজককে সব খুলে বলল নিকোলভ। তবে কোনও পথ দেখাতে পারলেন না ফাদার। মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে গির্জা থেকে বেরোল ও। মালায়া গ্রুযিনস্কায়া স্ট্রিটে রেখেছে গাড়ি। ওটা নিয়ে রওনা হলো এয়ারপোর্টের উদ্দেশে।
এবার ঠিক সময়েই তুলে নিল ইউনাকে।
একমাত্র মেয়েটাকে জীবন দিয়ে ভালবাসে সে। তার গর্ব ও আনন্দ বলতে ওই ইউনা। কী বুদ্ধিমতীই না হয়েছে বাচ্চাটা! ওকে দেখে নিজের সমস্ত দুঃখকষ্ট ও ব্যর্থতা ভুলে যায় সে। ইউনাকে নিয়ে চরকির মত ঘুরিয়ে দেখাল গোটা শহর। বাদ পড়ল না পার্ক, চিড়িয়াখানা বা সিনেমা হল। বাড়ি ফিরে দারুণ কয়েক পদ রান্না করল দু’জন মিলে। ইউনার মজার মজার গল্প শুনে হাসতে হাসতে হাঁফ ধরে গেল ওর। বিকেলে হাসির ডিভিডি দেখল ওরা। সন্ধ্যার দিকে ক্লান্ত হয়ে কিছুক্ষণের জন্যে বিশ্রাম নেবে ভাবল অ্যান্টোনিন। প্রি-পেইড ফোনে কল দিল তাতভ বেযুখফকে। তবে কল রিসিভ করল না সে। বোধহয় দুনিয়া ভরা সব ষড়যন্ত্রের পাঁকে পড়ে আবারও ডুব দিয়েছে সে মদের বোতলে।
পরদিন সকালেও যোগাযোগ করল না তাতভ। কপাল ভাল, হুমকি দিয়ে ফোন করেনি কাপরিস্কি। তবে আবারও যে ফোন করবে, তাতেও ভুল নেই। ইউনাকে নিয়ে বাইরে লাঞ্চ সারবে ঠিক করল অ্যান্টোনিন। রেস্টুরেন্টে দামি কোনও পদ চাইল না ইউনা। কারণ ও জানে, বেশি টাকা নেই বাবার। খেতে বসে আমস্টারড্যামে ওদের কাটিয়ে দেয়া সেই সুখময় সময়ের কথা ভেবে ডাচ ভাষায় আলাপ করল ওরা। আবছাভাবে তামারার কথা তুলল অ্যান্টোনিন। বুঝে গেল, ইউনা জানে না ওর মা উকিলের সঙ্গে আলাপ করেছে। মেয়ে এখনও আমারই, এটা ভেবে সান্ত্বনা পেল অ্যান্টোনিন। ওর মনে হলো, হয়তো সত্যিই আইনী ব্যবস্থা নেবে না তামারা। তবে বৈবাহিক জীবনে কখনও কখনও যে ব্ল্যাকমেইল করেনি সে, তেমনও নয়। এবার হয়তো চাইছে আরও বেশি মানসিক যন্ত্রণা দিতে।
লাঞ্চের পর হেঁটে অ্যাপার্টমেন্টের দিকে রওনা হয়ে খবরের কাগজের এক স্টলের সামনে থামল অ্যান্টোনিন। মাঝে মাঝে এখান থেকে পত্রিকা কেনে সে। আজও পেল মেট্রো মস্কো পত্রিকার বৈকালিক সংস্করণ। ওটা কিনে প্রথম পাতায় একটা খবর দেখেই চমকে গেল সে। বারকয়েক চোখ পিটপিট করল। ভাবল, এসব ভুল দেখছে।
গতকাল গির্জায় গিয়ে যে ফাদারের সঙ্গে কথা বলেছে, সেই মানুষটাকে আজ ভোরে পাওয়া গেছে এক সেতু থেকে ঝুলন্ত অবস্থায়। পুলিশ নিশ্চিত করেছে, কেসটি আত্মহত্যার।
শ্বাস আটকে গেছে অ্যান্টোনিনের।
কুকুরগুলো নেমেছে মানুষ শিকারে!
তথ্য পেতে বুড়ো মানুষটাকে নির্যাতন তো করেইছে, খুন করে ঝুলিয়ে দিয়েছে সেতু থেকে। তারা আগে থেকেই জানত ফাদারের কাছে গিয়ে সব বলতে পারে সে।
হাত থেকে পত্রিকা পড়ে গেছে, চট্ করে চারপাশে চোখ বোলাল অ্যান্টোনিন। মনে হলো না ব্যস্ত রাস্তায় কেউ দেখছে তাকে। কিন্তু ওরা ঠিকই আসবে ওকে খুন করতে। ভীষণ কাঁপছে ওর বুক। মনে পড়ল তামাকের কৌটা আর ফ্ল্যাশ ড্রাইভ রেখে এসেছে অ্যাপার্টমেন্টে। ওগুলো ডাকাতি হলে আর কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না সে। ভীষণ ভয় পেল অ্যান্টোনিন।
তা হলে কি এরই ভেতর অ্যাপার্টমেন্টের ওপর চোখ রাখছে কাপরিস্কির লোক?
তারা কি জানে কোথায় থাকে সে?
হয়তো জানে, তবুও একটিবারের জন্যে ওখানে না গিয়ে উপায় নেই তার। খপ করে মেয়ের হাত চেপে ধরল অ্যান্টোনিন। চাপা স্বরে বলল, ‘জলদি, ইউনা। বাড়ি ফিরতে হবে। হাতে সময় নেই, সোনাপাখি!’
‘কেন? কী হয়েছে?’ বাবাকে বিচলিত হতে দেখে ঘাবড়ে গেছে ইউনা।
‘ওখান থেকে একটা জিনিস নেব। তারপর অন্য এক জায়গায় চলে যাব আমরা।’
‘গতবারের মত কোথাও বেড়াতে যাব? কোথায়? তাতভ আঙ্কেলের ওখানে?’
‘ঠিকই বলেছ, সোনাপাখি। জায়গাটা ভাল লেগেছিল, তাই না? তবে এখন ওর নাম মুখে নিয়ো না, ঠিক আছে? ওখানে যাওয়ার পর অনেক মজা করব আমরা।’
‘তার আগে আঙ্কেলের নাম নেব না কেন?’
‘কারণ আমি মানা করেছি।’
দ্রুত অ্যাপার্টমেন্টে ফিরল অ্যান্টোনিন ও ইউনা। ডাকাতি হয়নি বাড়িতে। লিভিংরুমের টেবিলে রয়েছে সব প্রমাণ। ছোঁ দিয়ে তামাকের কৌটা ও ফ্ল্যাশ ড্রাইভ নিয়ে পকেটে পুরল অ্যান্টোনিন। ‘ঠিক আছে, সোনাপাখি। এবার আমরা রওনা হব।’
‘কিন্তু আমার ব্যাগ?’ আপত্তি তুলল ইউনা। ‘ওটার ভেতর কাপড়চোপড় আর দরকারি সব!’
যে-কোনও সময়ে আসবে কেজিবির খুনি। ‘এখন হাতে সময় নেই, সোনাপাখি। যাওয়ার পথে সব কিনে নেব। এবার চলো!’
‘কিন্তু আমার ফোন?’ গেস্ট রুমের বিছানার ওপর রয়েছে গোলাপি মোবাইল ফোন। ওই রঙটা ওর খুব প্রিয়।
অ্যান্টোনিন ভাল করেই জানে, ওই মোবাইল ফোনে আছে জিয়ো লোকেশন সিস্টেম। ওটা চালু থাকলে অনায়াসে ওদেরকে খুঁজে নেবে ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস। ওই একই কারণে অ্যান্টোনিন ঠিক করেছে এবার সঙ্গে নেবে না ল্যাপটপ। ‘না, সোনাপাখি, ওটা এখন ফেলে যেতে হবে।’
‘কিন্তু জিনিসটা তো আমার!’
‘দুঃখিত, সোনা। কেন নিতে পারবে না, পরে তা তোমাকে খুলে বলব। জিনিসটা এখন খুব বিপজ্জনক।’
‘তুমি কী বলছ, পাপা? ফোন কেন বিপজ্জনক হবে?’
‘পরে বলব! এখন এসো তো, ইউনা!’ মেয়ে কথা শুনবে না, বুঝে গেছে অ্যান্টোনিন। এ-ও টের পেল, এখন তর্ক বন্ধ করতে হলে রেগে যাওয়ার ভান করতে হবে। মেয়েকে পাশ কাটিয়ে গেস্ট রুমে ঢুকল সে। বিছানা থেকে তুলে নিল গোলাপি মোবাইল ফোন। মেঝেতে ফেলে বুট দিয়ে মাড়িয়ে বারোটা বাজাল জিনিসটার। কয়েক টুকরো হয়েছে ফোনের কেসিং। এত ভাল একজন বাবা কী করে এমন কাজ করতে পারল, ভেবে পেল না ইউনা। মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল বেচারি।
‘আর কেঁদো না,’ কড়া সুরে বলতে গিয়ে বুক ভেঙে গেল অ্যান্টোনিনের। তবুও বলল, ‘এবার আর ফোন নিয়ে ভাবতে হবে না। জলদি চলো!’ কবজি ধরে প্রায় জোর খাটিয়েই মেয়েকে নিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরোল অ্যান্টোনিন। ভাল করেই জানে, বাকি জীবনেও আর এখানে ফিরবে না। পালাতে হবে এখান থেকে বহু দূরে।
তবে নিকোলভ জানে না, একটু পরেই ওদেরকে গ্রেপ্তার করতে চলে আসবে এফএসবির একদল নিষ্ঠুর খুনে এজেন্ট!