এক্স এজেন্ট – ১৫

পনেরো

ফেরার সময় সন্দেহভাজন কাউকে দেখল না রানা। যদিও খচ্-খচ্ করল মন। প্রথম কাজ হওয়া উচিত ইউনার ফোনে জরুরি কিছু পাওয়া যায় কি না, সেটা দেখা। আসার পথে কয়েকবার ট্রাম ও বাস বদল করল ওরা। ভাঙা ফোনের জন্যে চার্জার কিনল ইলেকট্রনিক্সের দোকান থেকে। শেষদিকে চাপল মিনিভ্যান ট্যাক্সিক্যাবে। ওটার কাঁচ টিন্টেড। ড্রাইভারকে বলে দেয়ায় হোটেলের পেছন রাস্তায় থামল সে। কিচেনের দরজা ব্যবহার করে হোটেলে ঢুকল রানা ও তানিয়া। সামনের রাস্তায় কেউ থাকলে সে জানবে না ওরা ফিরেছে।

মেইন লবিতে না গিয়ে হোটেলের আইটি লাউঞ্জে ঢুকল ওরা। টাকার বিনিময়ে এখানে মেলে নানান টেকনোলজিকাল সহযোগিতা। অনেকে বসে আছে কমপিউটারের সামনে। ঘরের কোণে খালি এক ডেস্কে কমপিউটার দেখে ওখানে দুটো চেয়ার টেনে বসল রানা ও তানিয়া। পাবলিক লাইব্রেরির মতই নীরব আইটি লাউঞ্জ। অবশ্য মাঝে মাঝে খট-খট শব্দ তুলছে কি-বোর্ড। বা মৃদু কেশে নিচ্ছে কেউ।

‘বেশি মানুষ,’ চারপাশে চেয়ে ফিসফিস করল তানিয়া ‘আপনার সুইটে তো ওয়াই-ফাই আছে। চলুন, বরং ওখানেই যাই।’

নিজেও এ কথা ভেবেছে রানা। এবং কারণ আছে বলেই ভাবনাটা বিদায় করেছে মন থেকে। মাথা নাড়ল রানা। কেন যেন অস্বস্তি বোধ করছে। অন্তর বলছে, গোটা ব্যাপারটার ভেতর লুকিয়ে আছে খুব জটিল কিছু। মানুষ যত কম জানবে ওদের ব্যাপারে, ততই মঙ্গল। কেউ চোখ রাখলে অনায়াসেই হ্যাক করতে পারে উইন্টার গার্ডেন সুইটের ওয়াই-ফাই। ওখান থেকে অনলাইনে গেলেই ট্রেস করবে। আজকাল গোপনীয়তা বজায় রাখা কঠিন, কিন্তু হোটেলের খোলা নেটওঅর্ক অন্যকিছু। নির্দিষ্ট কাউকে খুঁজে নেয়া খুব কঠিন হবে প্রতিপক্ষের জন্যে।

কমপিউটার চালু করে ভাবল রানা, একটু পর বোঝা যাবে সকালের অভিযান সফল, নাকি ব্যর্থ। হয়তো পাবে না জরুরি তথ্য। ওর পাশে বসেছে তানিয়া আজোরভ। পকেট থেকে প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করল রানা। ওটা থেকে নিয়ে টেবিলে রাখল ভাঙাচোরা টুকরোগুলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল মেয়েটা। ফিসফিস করল, ‘সব ভেঙেচুরে শেষ। নিকোলভ এ কাজ করে থাকলে, বেশ কসরত করতে হয়েছে তাকে।’

‘আশা করি ব্যর্থ হয়েছে তার প্রচেষ্টা,’ নিচু গলায় বলল রানা।

দুষ্টু হাসল তানিয়া। ‘সত্যিই সব ডেটা হারিয়ে গেলে, বলতে হবে খামোকা মার খেল করোটকিনরা।

মাথা দোলাল রানা। ‘তিন বেচারা। ভাবছি হাসপাতালে ফুল পাঠাব।’ প্যাকেট খুলে ফোনের চার্জার নিয়ে দু’দিকে কানেকশন দিল ও। বাতি জ্বলল না নোকিয়া ডিভাইসে। ‘এত সহজে কিছুই পাওয়া যায় না,’ কথাটা বলে কমপিউটারের মাউস ধরল রানা। জ্বলজ্বল করে উঠল স্ক্রিন। কাজের জন্যে তৈরি সিপিইউ।

‘জানেন কী করতে হবে?’ সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল তানিয়া।

‘সব কিছুরই প্রথমবার বলে কথা আছে,’ জবাবে বলল রানা। ও আইটি জাদুকর না হলেও জানে কী করতে হবে। ওর দেখা সেরা চালু ব্রডব্যাণ্ডের মালিক এই হোটেল। ওই টেকনোলজির দিক দিয়ে পশ্চিমাদের পিছনে ফেলেছে রাশানরা। এক সেকেণ্ড লাগল না সার্চ ইঞ্জিন খুঁজে দিল ডেটা রিকভারি সফটওয়্যার। আজ দ্বিতীয়বারের মত মিস্টার ব্রেযনেভের ক্রেডিট কার্ডের এক্সপেন্স অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে সফটওয়্যারটা কিনল রানা। ওটা কমপিউটারে ডাউনলোড হতেই হাতে নিল ভাঙা ফোন। ভাবছে, এসডি কার্ডে পাবে ইউনার স্টোর করা ফাইল। ফোনের চেসিস পাতলা এবং হালকা, কাগজের মত সরু অ্যালয় দিয়ে তৈরি, তবে ওটা বেঁকে গেছে বলে পোর্টে শক্তভাবে আটকে আছে কার্ড। কেউ চেয়ে নেই দেখে নিয়ে ফারাযের স্টিলেটো বের করল রানা। চোখা ডগা দিয়ে পোর্ট থেকে বের করতে চাইল কার্ড।

‘সাবধান,’ রানার কাজ দেখছে তানিয়া। কুঁচকে ফেলল ভুরু। ‘জিনিসটা ভঙ্গুর। চাপ পড়লেই মট করে ভাঙবে।’

‘পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ,’ সতর্ক হাতে পোর্টে ছোরার ডগা ঢোকাল রানা। সামান্য চাড় দিতেই খুট করে খুলে গেল কার্ড। সাবধানে ওটা বের করে দেখল তিন সেকেণ্ড। ওর মনে হলো না ওটার ক্ষতি হয়েছে। কমপিউটারের বিশেষ এক পোর্টে কার্ডটা ঢুকিয়ে রিকভারি সফটওয়্যার চালু করল রানা। সফটওয়্যার স্ক্যান করছে হারিয়ে যাওয়া ফাইল। যে- কোনও সময়ে জানা যাবে কার্ড ঠিক আছে, না নোকিয়া ডিভাইসের মতই নষ্ট। টার্মিনালের আরও কাছে চেয়ার সরিয়ে আনল তানিয়া। আটকে ফেলেছে শ্বাস। ওর হাঁটু স্পর্শ করছে রানার হাঁটু। মেয়েটার পারফিউমের সুগন্ধি পেল বিসিআই এজেন্ট

তিলতিল করে পেরোচ্ছে সময়।

কাজ করে চলেছে কমপিউটার।

মনিটরে হঠাৎ করেই চালু হলো একটা স্ক্রিন। কার্ডে প্রচুর ডেটা ফাইল পেয়েছে সফটওয়্যার। জানতে চাইল, ডাউনলোড করবে কোথায়।

‘এক্সেলেন্ট,’ বিড়বিড় করল তানিয়া।

নিচু গলায় বলল রানা, ‘দেখা যাক কার্ডের ভেতর কী।’

.

লোকটা লম্বা নয়, আবার বেঁটেও নয়। পরনে সাধারণ পোশাক। একবার তাকে দেখলে দ্বিতীয়বার দেখবে না কেউ। সত্যিকারের ছায়ার মত। এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে নেগলিনায়া স্ট্রিটে, কানে মোবাইল ফোন। হোটেলের প্রবেশ-পথের ওপর চোখ। মাঝে মাঝে দেখছে উইন্টার গার্ডেন সুইটের জানালা ও টেরেস। সকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এখনও ফেরত আসেনি বাঙালি গুপ্তচরটা। মেট্রো ট্রেনে দুর্ঘটনার পর আবারও ফিরে হোটেলের ওপর চোখ রেখেছে লোকটা এবং তার সঙ্গী। অবশ্য জিপিএস ট্র্যাকিং ডিভাইসের কারণে তারা জেনে গেছে, কোথায় আছে তাদের দুই শিকার।

‘চার নম্বর বলছি,’ ফোনে রাশান ভাষায় বলল লোকটা। হোটেলে আছে মাসুদ রানা আর ওই মেয়ে। সব নিয়ন্ত্রণের ভেতর। নিয়মিত মনিটর করছি।’

লাইনের আরেক প্রান্তে ব্যক্তিগত নিরাপদ ঘরে বিরাট এক চামড়ার নরম চেয়ারে বসে আছে মিশন চিফ। সামনে বিশাল ডেস্ক। ওদিকের দেয়ালে ঝোলানো সারি সারি স্ক্রিন। অপেক্ষাকৃত বড় এক স্ক্রিনে আরারাত পার্ক হায়াত হোটেলের এরিয়াল ফিড দেখছে। পৃথিবীতে ধাক্কা খেয়ে সোজা আড়াই শ’ কিলোমিটার ওপরে উঠে জিয়োস্টেশনারি স্পাই স্যাটেলাইটে গিয়ে আবার ফিরছে ফিড।

এ ধরনের রিপোর্ট ভুল হতে পারে ভেবেই হোটেলের কাছ থেকে ফিল্ড এজেন্টদেরকে সরাল না মিশন চিফ। সকাল থেকে যা ঘটেছে, প্রায় সবই জেনেছে। এ-ও বুঝতে পারছে, এখন কী করছে মাসুদ রানা। কখন বাঙালি গুপ্তচর হোটেলে ফিরেছে, তাও তার নখদর্পণে। মাসুদ রানা যেখানেই যাক, অনায়াসেই ট্র্যাক করতে পারবে। উইন্টার গার্ডেন সুইটে রয়েছে অডিয়ো বাগিং ডিভাইস। ওয়াই-ফাই ব্যবহার করলেই মুহূর্তে তার ডেস্কে পৌঁছুবে সমস্ত ডেটা।

অপারেটিভরা ডেটা পেলেই তা পৌঁছে যাচ্ছে। এ ছাড়াও, আসছে আরও বহু তথ্য। নিচু পর্যায়ের এজেন্টদেরকে রাখা হয়েছে চারপাশে চোখ রাখার জন্যে। নতুন কিছু ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে জানাবে তারা। প্রয়োজনে বাধা দেবে মাসুদ রানাকে।

আপাতত তাকে বাধা দেয়ার কোনও কারণ দেখা দেয়নি। সব চলছে পরিকল্পনা অনুযায়ী। তবে ত্রুটি আছে একটা বিষয়ে। ওটার জন্যে অসন্তুষ্ট মিশন চিফ। ঠাণ্ডা মাথার মানুষ সে। নইলে উঠত না এত ওপরে। জরুরি মিশন সফল করতে গিয়ে কখনও কখনও কাউকে বলি দেয়। জাতে রাশান নয় সে, অন্য জাতির মানুষ। তার রাশান বক্তব্য থেকে ঝরল মারাত্মক সাপের বিষের মত বিপজ্জনক কিছু। ‘আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো, চার নম্বর। খেয়াল রেখো, কার বিরুদ্ধে কাজ করছ। মাসুদ রানা সার্ভেইলেন্স বা কাউন্টার সার্ভেইলেন্সের এক্সপার্ট। এ ছাড়া তার আছে আরও বহু গুণ, যেসব তোমাদের নেই। আবারও এই অপারেশনে ভুল হলে, বা সে সন্দেহ করে বসলে, সরিয়ে দেয়া হবে তোমাদেরকে। আমার কথা বুঝতে পেরেছ?’

সরিয়ে দেয়া মানে খতম করা, ভাল করেই জানে এজেন্ট। বড় করে ঢোক গিলল। গোপন করল ভয়। সহজ সুরে বলল, ‘আমাদেরকে আর দেখবে না, চিফ। গ্যারান্টি দিচ্ছি।’

‘মিশন গুবলেট করবে না, চার নম্বর। টিমের সবাইকে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দূর থেকে চোখ রাখো রানার ওপর। কাজে নামবে আমি নির্দেশ দিলে। সে পৌঁছে দেবে আমাদের নিকোলভের কাছে। আর তখন তুমি দেখাবে তোমার প্রতিভা।’

মৃদু হাসল এজেন্ট। তার টিমের মূল কাজ সার্ভেইলেন্স নয়। ঠিক সময়ে তুলে আনবে মাসুদ রানাকে।

‘বুঝতে পেরেছি, চিফ। ওভার অ্যাণ্ড আউট।’

ষোলো

এসডি কার্ড থেকে কমপিউটারে সব ডেটা নেয়ার পর এক এক করে ফাইল খুলছে রানা। কয়েক মুহূর্ত পর বুঝল, মুছে গেছে ফোন থেকে কলের মেমোরি ও নম্বর। রয়ে গেছে শুধু টেক্সট্ মেসেজ, ইমেজ ও কিছু ভিডিয়ো ফাইল।

টেক্সট দিয়েই শুরু করল রানা। হয়তো ওগুলোর ভেতর আছে জরুরি তথ্য। জানা যাবে কোথায় আছে নিকোলভ। রানার মনে হচ্ছে, ও ছুটছে বুনো হাঁসের পিছে, তবে এ ছাড়া আর কোনও উপায়ও নেই ওর।

কিছুক্ষণ পর বুঝল, প্রচুর মেসেজ পাঠাত ইউনা। নিচু গলায় তানিয়াকে বলল রানা, ‘সময় লাগবে সব পড়তে।’

‘আর কোনও কাজও তো নেই,’ ফিসফিস করল তানিয়া।

সত্তরটা মেসেজ পড়ার পরেও জরুরি কিছু পেল না রানা। জনা বারো ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবী আছে ইউনার। নিয়মিত তাদের সঙ্গে মেসেজে যোগাযোগ রাখত। তবে তাদের ভেতর সবচেয়ে বেশি মেসেজ পেয়েছে ভেরোনিকা নামের এক বান্ধবী। তার কাছে মনের সবই বলে ইউনা। চট্ করে ফেসবুকে ঢুকে ভেরোনিকা মোহনির ছবি দেখল রানা। ওই মেয়ে থাকে ফ্রান্সের লে ম্যান্সের সুযে-সা-সাখথে এলাকায়। বয়স বারো। লেমি লোভাগোটির মহাভক্ত। যদিও সে যে কে, জানে না রানা। আমস্টারড্যামে পুরনো দুই বান্ধবীকে ডাচ ভাষায় মেসেজ দিয়েছে ইউনা। তাদের নাম জুলি ও সোফি।

হাসিখুশি যে-কোনও মেয়ে যেভাবে বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে মেসেজের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখে, তাই করেছে ইউনা। ওর বেশিরভাগ বান্ধবী নিজেদের ভেতর আলাপ করে নিক ব্রাউন নামের এক ছেলের বিষয়ে। রানার মনে হলো ইউনাও মনে মনে তাকে পছন্দ করে। বাচ্চা এক মেয়ের ব্যক্তিগত নিষ্পাপ চিঠি পড়তে গিয়ে নিজেকে চোর বলে মনে হলো ওর। ওরা বর্তমান পপ স্টার ও সিনেমার হিরোদেরকে নিয়ে বেশ কিছু মেসেজ বিনিময় করেছে। কে দেখতে সবচেয়ে ভাল, কে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর- এসব। শ্যারন নামের এক মেয়ের জন্মদিনে গিয়েছিল ইউনা। তবে সেসময়ে অসুস্থ ছিল বলে ওখানে যেতে পারেনি ভেরোনিকা। সেজন্যে আফসোস করেছে ইউনা। এ ছাড়া ওর মেসেজে এসেছে আগুস্তে নামের এক চমৎকার বে পনির কথা। ক্রিসমাসে ওই বাচ্চা ঘোড়াটা ওকে উপহার দেন ওর নানা মিস্টার ব্রেযনেভ।

পরের সাড়ে চার শ’ মেসেজ এক এক করে খুলল রানা। বিড়বিড় করল, ‘খামোকাই পিট্টি দিলাম করোটকিনদেরকে।’ চোর পিটিয়ে ওর নিজের মনেই জাগছে চোর-চোর ভাব।

এবার ইমেজ ও ভিডিয়ো ফাইল নিয়ে পড়ল রানা। প্রচুর ছবি তোলে ইউনা। ভালগুলো বেছে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখেছে নিজের বেডরুমে। শত শত পোষা প্রাণীর ছবি। নানাধরনের কুকুর ও ঘোড়া ওর বেশি প্রিয়।

‘জীব-জন্তু পছন্দ করে,’ মন্তব্য করল তানিয়া।

‘পশু চিকিৎসক হতে চায়,’ বলল রানা।

‘ওর বয়সে আমিও তাই চাইতাম।’

তানিয়ার দিকে তাকাল রানা। ‘অবাক করলে! তোমার মনেও তা হলে নরম জায়গা আছে?’

একবার মনিটর দেখে নিয়ে রানার দিকে চাইল মেয়েটা। ‘আপনি তো আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এখন ঠোঁটে হাসি নেই।

‘কথা ঠিক,’ স্বীকার করল রানা। একের পর এক ছবি দেখছে। জানোয়ারের মাঝে রয়েছে মানুষ ও জায়গার ছবি। লুকা ব্রেযনেভের দুর্গের কয়েকটা দৃশ্য চিনল রানা। ওখানে বেড়াতে গিয়েছিল ইউনার বন্ধু-বান্ধবীরা, তখন ছবি তুলেছে। কয়েকটা ছবি ভেরোনিকা ও নিক ব্রাউনের। চমৎকার এক ছবি তুলেছে নানার গাল্‌ফ্‌স্ট্রিম জেট বিমানের। সবেমাত্র রানওয়ে ছেড়ে আকাশে উঠেছে ওটা। পেছনে মস্ত বড় লাল সূর্য। আরেক দৃশ্যে দেখা গেল বিমানের পাশে ইউনিফর্ম পরে দাঁড়িয়ে আছে পাইলট রবার্ট স্টিফান। এরপর রয়েছে এয়ারক্রাফটের ভেতরের ছবি। জানালা দিয়ে তুলেছে সাদা মেঘের দৃশ্য।

এক এক করে ছবি দেখে যাচ্ছে রানা।

হঠাৎ করেই একটা ছবির দিকে আঙুল তাক করল তানিয়া। ‘ওটা কোথায় তা জানি আমি। ভিআনুকোভা এয়ারপোর্টের একটা জায়গা। ওখানে নামে প্রাইভেট জেট বিমান।’

রানাও চিনতে পারল, যদিও দিনে অন্যরকম লাগছে। একটু আগে নেমেছে মিস্টার ব্রেযনেভের জেট বিমান। পার্ক করা হয়েছে এক হ্যাঙারের বাইরে। টারমাকে হালকা তুষার। ফাইল ইনফর্মেশন থেকে রানা জানল, ওই ইমেজ গত বছরের অক্টোবরের নয় তারিখের। সেসময় মস্কো এসেছিল ইউনা।

ছবির পর ছবি দেখছে রানা ও তানিয়া।

সবই গত বছরের অক্টোবরে তোলা। পাওয়া গেল ছোট্ট এক ভিডিয়ো ফাইল। শহরে গাড়ির জ্যাম। ধীরে ধীরে সামনে বাড়ছে সারি সারি গাড়ি। তুষারে ঢেকে গেছে রাস্তা। ভাপ ওঠা পুরনো এক গাড়ির ভেতর থেকে ভিডিয়ো তুলেছে ইউনা। রানা চিনল, গাড়িটা ফোক্সভাগেন বিটল। পেছনে ইঞ্জিন। আওয়াজ করে ইনবোর্ড মোটরের মত। পরের ফোটোতে পরিষ্কার দেখল গাড়িটা ফ্যাকাসে নীল রঙের। দাঁড়িয়ে আছে অ্যান্টোনিন নিকোলভের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের বাইরে। গাড়ির গম্বুজের মত ছাতে উঠেছে ইউনা। দু’হাত মেলে দিয়েছে দু’দিকে। ঠাণ্ডায় লালচে হয়েছে মুখ। হাসছে প্রাণ খুলে। উলের হ্যাটের নিচ থেকে বেরিয়েছে চুল। গলায় ভারী স্কার্ফ। গত কয়েক মাসে হঠাৎ লম্বা হয়েছে মেয়েটা ওর মা দেখলে অখুশি হবে, তবে ইউনাকে দেখে রানার মনে হলো, মেয়েটা আছে মহা ফুর্তিতে।

‘ওই গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করেনি,’ বলল তানিয়া। ‘নইলে জেনে যেতাম কোথায় আছে।

‘যেখানেই থাকুক, নিকোলভের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে নেই,’ মন্তব্য করল রানা।

পরের ভিডিয়ো অক্টোবরের দশ তারিখের। দেখা গেল চুল-দাড়ি ভরা অ্যান্টোনিন নিকোলভকে। মুখে বোকার হাসি। ছোট্ট কিচেনে হাঁড়ির ভেতর চামচ দিয়ে কী যেন নাড়ছে। আবছাভাবে শোনা গেল মিউযিক। তার দু’দিন পর সেলফি তুলেছে ইউনা। বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে মেয়েটা। প্রাণ খুলে হাসছে দু’জন। দাঁড়িয়ে আছে মস্কোর কোনও পার্কে। চারপাশে শুভ্র তুষার।

‘ওটা গোর্কি পার্ক,’ সাগর নীল নখ দিয়ে স্ক্রিনে টোকা দিল তানিয়া। ‘ওই যে দেখুন হাউস অভ আর্টিস্টস্, তার পেছনে ফলেন মনুমেন্টস্।’

শহরের দৃশ্যের দিকে খেয়াল নেই রানার। মন দিয়ে দেখল বাপ-মেয়ের চেহারা। ওর মনে হলো ভালবাসার কমতি নেই দু’জনের মধ্যে। নিকোলভের চোখে নরম দৃষ্টি। বিলিয়নেয়ার লুকা ব্রেনেভের কথাগুলো মনে পড়ল ওর। জঘন্য লোক নিকোলভ। মানুষ নামের অযোগ্য। চরম মিথ্যাবাদী।

হয়তো সত্যিই তেমনই লোক সে, কিন্তু কেন যেন রানার মনে হলো নিজের সন্তানকে জেনেবুঝে বিপদে ফেলবে না সে। দায়িত্ব পালন থেকে পিছিয়েও যাবে না।

অথচ এখন পর্যন্ত ওকে যা বলা হয়েছে, তা থেকে ধরে নিতে হবে ওই লোক নিজের মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে টাকার জন্যে। এটা ঠিক মেনে নিতে পারল না রানা। বিড়বিড় করে বলল, ‘হুম্।’

ওর দিকে তাকাল তানিয়া। ‘কী?’

‘কিছু না,’ পরের ফাইলে গেল রানা। আবারও দেখা দিয়েছে ফোক্সভাগেন বিটল। এবারে ছোট্ট ভিডিয়ো। তোলা হয়েছে সামনের সিট থেকে। গাড়ি চলেছে ব্যস্ত মোটরওয়ে ধরে। তুষারভরা এগারো অক্টোবর। গাড়ির ড্যাশবোর্ডের ওপর দেখা যাচ্ছে লাল দুটো ছোট জুতো। স্টিয়ারিং হুইলের সঙ্গে নড়ছে এক লোকের হাত। বোধহয় অ্যান্টোনিন, নিকোলভ।

‘ওটা ফেডারেল হাইওয়ে এম টেন,’ বলল তানিয়া। ‘বহুবার গিয়েছি ওদিকে। সোজা গেছে সাত শ’ কিলোমিটার দূরের সেই সেইণ্ট পিটার্সবার্গে।’

ওই পথে কোথায় গেছে অ্যান্টোনিন ও ইউনা, ভাবছে রানা। পরের ইমেজ একই দিনের। বিকেল। হাইওয়ে থেকে নেমে পড়েছে ওদের গাড়ি। দু’দিকের ঘন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে চলেছে বিটল। বরফে ছাওয়া আঁকাবাঁকা রাস্তাটা সরু। গাড়ির জানালা দিয়ে দূরের এক গথিক চার্চের ছবি তুলেছে ইউনা। মাঠের মাঝে ওই বাড়ি পরিত্যক্ত মনে হলো রানার। দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে ধসে পড়েছে ছাতের একাংশ। বাড়ির ভেতরে জন্মেছে বড় গাছ। সুযোগ পেলে সবই খুলে নিয়ে যেত চোর, তবে বিশাল এলাকায় জনবসতি নেই, কাজেই জিনিসপত্র বিক্রি করবে কার কাছে!

‘ওই জায়গা চিনি,’ বলল তানিয়া, ‘গেছি ছোটবেলায়। তখন ওদিকে আমাদের এক আত্মীয় থাকতেন। অনেক দিন আগে মারা গেছেন। ওই চার্চ ছিল ওই এলাকার জমিদারের তৈরি। তাও দেড় শ’ বছর আগের কথা। প্রথম যখন ওটাকে দেখি, তখনই প্রায় ভেঙে পড়েছে। বাবা শোনাতেন অনেক ধরনের গল্প। তাঁর কাছেই শুনেছি সোভিয়েত আমলে ওই গির্জাকে ব্যবহার করা হতো শস্যের গুদাম হিসেবে।’ দুঃখিত চেহারায় মাথা নাড়ল মেয়েটা। ‘বাবা মনে করেছিলেন কমিউনিস্টরা বিদায় নিলে দেশের উন্নতি হবে। ভুল। সব বদলে গেছে, তবে ভাল হয়নি কিছুই।’

‘খুঁজে বের করতে পারবে ওই গির্জা?’ জানতে চাইল রানা।

সামান্য দ্বিধার পর তানিয়া বলল, ‘মনে হয় পারব। কয়েক ঘণ্টা লাগবে পৌঁছুতে। জায়গাটা মস্কো থেকে পুবে। ধরুন, দুই শ’ কিলোমিটার দূরে।’

মনোযোগ দিয়ে গির্জা দেখছে রানা। নিচু গলায় বলল, ‘ওরা কোথায় যাচ্ছিল?’

‘খুব নির্জন এলাকা,’ বলল তানিয়া, ‘সোভিয়েত আমলে পরিত্যক্ত হয়েছে বহু গ্রাম। ওখানে এখন প্রেতাত্মা ছাড়া আর কেউ থাকে না।’

‘তার মানে বলছ ওদিকে আছে বেশ কিছু গোস্ট টাউন?’

‘খামারবাড়িগুলো এতদিনে ধসে পড়েছে। কেউ নেই যে মেরামত করবে। পরে কিছু মানুষ ফিরেছে ওদিকে। তবে হাজার হাজার বর্গ কিলোমিটারের ভেতর আছে হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন। বুঝতেই পারছেন, রাশা বিশাল বড় দেশ।’

গত বছর অক্টোবর মাসে নির্জন এক এলাকায় ইউনাকে নিয়ে গেছে ওর বাবা। ছবিতে দেখা যাচ্ছে ঘন জঙ্গল, হ্রদ ও আঁকাবাঁকা গ্রাম্য পথ। কোথাও নেই গাড়ি বা বাড়ি।

দু’দিন কোনও ছবি নেই।

এরপর আবার তোলা হয়েছে ভিডিয়ো ও ফোটো।

প্রথম ছবিটা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারল না রানা।

সতেরো

‘ওগুলো কোযি, মানে, ছাগল,’ বলল তানিয়া। এমনভাবে বলল, যেন বলতে চায়: এমন ছাগল কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি! দেশপ্রেম আর কাকে বলে!

টিটকারির ভঙ্গিতে বলল রানা, ‘সত্যিই দারুণ! আমারও মনে হয়: রাশায় এর চে’ চমৎকার আর কিছুই নেই।

‘দুনিয়ার সবচেয়ে জঘন্য প্রাণী!’ নাক কুঁচকাল তানিয়া।

‘কেন, তুমি ছাগল পছন্দ করো না?’

‘ঘৃণা করি। ছুঁচোর চেয়েও বেশি দুর্গন্ধ এগুলোর গায়ে।’

‘তুমি না পশু চিকিৎসক হতে চেয়েছিলে?’

‘তখন আমার বয়স ছিল দশ। জানতাম না কী বোঁটকা গন্ধ ছাগলের গায়ে।’

‘তাই বড় হয়ে বেছে নিলে গোয়েন্দাগিরির পেশা। আমার তো মনে হচ্ছে বুদ্ধিমতীর কাজই করেছ।’

একটা ভিডিয়ো ক্লিপ চালু করল রানা। স্ক্রিনে দেখা গেল গ্রাম্য ছোট খামার। তুষারে ভরে আছে চারপাশ। দৃশ্যের একদিকে ছোট্ট হাতে গোলাপি হাতমোজা। নিশ্চয়ই ইউনা। মুঠো করে ধরেছে শুকনো পশু-খাদ্য। তারের বেড়ার ওদিকে জড় হয়েছে একপাল সাদা ছাগল। গলার কাছে ঝুলছে দুই কান। চোখে-মুখে খিদে। দেখা না গেলেও রানা ও তানিয়া শুনল ইউনার হাসির আওয়াজ। খাবার পাওয়ার জন্যে তারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে মুখ বের করতে চাইছে ছাগলগুলো। হাত বাড়িয়ে দিল ইউনা। শীতের সাদা কুয়াশার মত ঘন শ্বাস ফেলছে ছাগল। এদিক ওদিক নড়ছে ক্যামেরা। ক্ষণিকের জন্যে ডানদিকে রানা দেখল পাথরের ছোট এক খামারবাড়ি, অর্ধেক ডুবে গেছে তুষারে। বরফে ঢাকা উঠানে কী যেন খুঁটছে কয়েকটা মুরগি। সামান্য সরে গেল ক্যামেরা। ফ্রেমের ভেতর অন্য কিছু দেখেছে রানা।

‘ওই যে,’ সায় দেয়ার সুরে বলল তানিয়া।

‘হ্যাঁ, দেখেছি।’ কয়েক ফ্রেম পিছিয়ে গেল রানা। নতুন করে টিপল প্লে বাটন। যুম করল দৃশ্য। খেয়াল রাখল রেযোলিউশন যেন ঠিক থাকে। খামারবাড়ির দরজার পাশে কাঁচা মাটির ওপর দুটো গাড়ি। একটা পুরনো আমলের জাপানি পিকআপ ট্রাক, অন্যটা নিকোলভের সেই হালকা নীল ফোক্সভাগেন বিটল। গত অক্টোবর মাসে বাপ-বেটি হাইওয়ে থেকে নেমে প্রত্যন্ত কোনও খামারে গেছে, তাতে সন্দেহ নেই।

‘কোনও খামারে বেড়াতে গেছে?’ বলল তানিয়া।

‘আর নইলে দুনিয়ার সবচেয়ে নোংরা থিম পার্ক ওটা।’

‘মনে হচ্ছে দুর্গন্ধ ভরা জন্তুগুলোকে পছন্দ করে মেয়েটা। হয়তো ছাগল দেখতেই গিয়েছিল।’

‘কিন্তু সেজন্যে অত দূরে যেতে হবে কেন?’ বলল রানা। ‘মস্কোর চিড়িয়ানায় গেলেই চলত।’

‘তা ঠিক, মস্কো চিড়িয়াখানা দুনিয়ার সেরা।’

পরের ফাইলে ছবি। খামারবাড়ির বাইরে নিকোলভ আর আরেক লোক। কাছ থেকে দেখা গেল জীর্ণ বাড়িটা। চারপাশে নানান পুরনো আবর্জনা। পশু-খাদ্যের খালি বস্তা, জ্বালানী কাঠ, মুরগি আটকে রাখার তারের বেড়া, জং ধরা বিউট্যান গ্যাসের কিছু বোতল। পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে নিকোলভ আর ওই লোক। পুরনো বন্ধুরা এভাবে ছবি তোলে। নিকোলভের পাশের লোকটা দৈর্ঘ্যে অন্তত পাঁচ ইঞ্চি বেশি লম্বা। চওড়া শরীর। চুল ও দাড়ি এলোমেলো। কোনও কেয়ার নেই। ওপর ও নিচের পাটিতে কয়েকটা দাঁত অনুপস্থিত। পরনে গ্রিস, কাদা ও ছাগলের নাদায় ভরা কোঁচকানো বয়লার সুট। রানা ভাবল, হয়তো এই জঙ্গুলে এলাকায় তাকেই মনে করা হয় সবচেয়ে স্টাইলিশ, কাঙ্ক্ষিত, যোগ্য পুরুষ।

‘এই লোক ইউনা আর নিকোলভের আত্মীয়?’ আনমনে বলল রানা।

‘রেকর্ড অনুযায়ী নিকোলভ ছিল বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান,’ বলল তানিয়া। ‘তবে ওই লোক হয়তো দূর সম্পর্কের কোনও কাজিন হতে পারে।’

‘স্কুল-জীবনে কারা নিকোলভের বন্ধু ছিল, সেটা জানো তোমরা?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

মাথা নাড়ল তানিয়া আজোরভ। ‘ছিল না কেউ। আমার মনে হচ্ছে না ওই লোকটা শিক্ষিত। ওর মত চাষারা অগা হয়, বুদ্ধিমান কারও সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না।’

‘আমার কিন্তু বেশ ক’জন চাষী বন্ধু আছে,’ বলল রানা। ‘তাতেই প্রমাণ হচ্ছে আপনি বুদ্ধিমান নন, ́ হাসল তানিয়া।

‘সেক্ষেত্রে বলব: তোমার সঙ্গে মিশেই আজ আমার এই মহাপতন।’

স্ক্রিনের দিকে আঙুল তাক করল তানিয়া। ‘দেখতে থাকুন। নতুন কিছু পাওয়া যেতে পারে।’

আরও কিছুক্ষণ ঘাঁটার পরেও ছাগলের খামার, নিকোলভ বা তার চাষী বন্ধুর সম্বন্ধে নতুন কিছু জানল না ওরা। এরপর শুরু হলো ফ্রান্সে নানার এস্টেটে ইউনার তোলা ছবি ও ভিডিয়ো। বন্ধু-বান্ধবীদের জন্যে, মাঝে মাঝে দিয়েছে পার্টি, তার ছবি। তুলেছে একগাদা ঘোড়া ও কুকুরের ফোটো। মিলল না গুরুত্বপূর্ণ কিছু। তারিখ দেখে ওরা বুঝল, ফ্রান্সে এসেছে বসন্ত। তারপর এল গ্রীষ্ম।

‘এবার শেষ ক’টা ফাইল,’ বলল রানা। গোলাপি মোবাইল ফোনের দিকে তাকাল। ফ্রান্স থেকে রাশায় আসার পর খুব খুশি ছিল ইউনা। তবে পরে ফোনটা ফেলে যেতে বাধ্য হয়েছে। এরপর নিজেই হারিয়ে গেছে কোথাও। ওর নানা বলেছেন, বাবা হয়েও ওকে কিডন্যাপ করেছে অ্যান্টোনিন নিকোলভ। অথচ, অ্যাপার্টমেণ্ট বা বাইরে যেসব ছবি বা ভিডিয়ো দেখেছে রানা, ওর মনে হয়নি এ ধরনের কাজ করবে ওই লোক। শেষ ছবিতে দেখা গেল মজার চেহারা করেছে নিকোলভ। খিলখিল করে হাসছে ওর মেয়ে।

‘আর কিছু নেই,’ বলল রানা।

স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে ওকে দেখল তানিয়া। চোখে কৌতূহল। ‘এসব থেকে কী বুঝলেন?’

‘তুমি হচ্ছ পেশাদার গোয়েন্দা, তুমি কী বুঝলে?’ জানতে চাইল রানা।

দ্বিধা নিয়ে আইটি লাউঞ্জের চারপাশে তাকাল তানিয়া। এরই ভেতর বিদায় নিয়েছে অনেকে। আবার কেউ কেউ এসেছে কমপিউটার ব্যবহার করতে। নিচু গলায় বলল সে, ‘মনে হচ্ছে ওই খামার নিয়ে ভাবতে হবে আমাদেরকে।’

মাথা দোলাল রানা। ‘অস্বাভাবিক কিছু দেখেছ?’

‘খুব প্রত্যন্ত এলাকা,’ বলল তানিয়া। ‘এমন জায়গা, যেখানে কেউ খুঁজবে না নিকোলভকে। হয়তো লুকিয়ে আছে সে।’

‘হয়তো তা-ই,’ বলল রানা। ‘আশ্রয় নিয়েছে প্রিয় কোনও বন্ধুর খামারে।’

‘আগেও ওখানে ইউনাকে নিয়ে গেছে,’ বলল তানিয়া। ‘এবারও হয়তো ওখানেই আছে। হতে পারে না?’

‘আমারও তা-ই ধারণা,’ বলল রানা।

‘যে কারণেই হোক, লুকিয়ে আছে। জন্তু-জানোয়ারের ভেতর সময়টা খারাপ কাটবে না বাচ্চা মেয়েটার। সেটাই হয়তো চেয়েছে নিকোলভ। ইউনা জানবেও না ছুটি কাটাচ্ছে না ওরা। নিকোলভ হয়তো বলেছে, ওর মা’র সঙ্গে আলাপ করেই এ ব্যবস্থা নিয়েছে। যেহেতু মোবাইল ফোন নেই, ইউনা জানবে না আসলে কোথায় আছে ও। এখন জানার বিষয় হচ্ছে, এবার কী করবে ওর বাবা? একই জায়গায় বেশিদিন থাকবে না। তাই মনে হচ্ছে সে আবারও উধাও হওয়ার আগেই আমাদের উচিত ওখানে হাজির হওয়া।’

‘পাকা গোয়েন্দার মতই বলেছ, কমরেড,’ ছোট একটা স্যালুট দিল রানা।

মৃদু হাসল তানিয়া। ‘ফোনের ব্যাপারে আপনি দারুণ দেখালেন। ওটা না থাকলে কিছুই জানতাম না। অবশ্য এই কাজের জন্যেই তো লাখ লাখ ডলার দেয়া হচ্ছে আপনাকে।’

মাথা নাড়ল রানা। ‘আমি বিনে পয়সায় কাজ করছি।’

‘তা হলে এত খাটছেন কেন?’

‘কারণ দুই বৃদ্ধ আর এক মহিলা আশা করছেন ইউনাকে আমি ফিরিয়ে নিয়ে যাব ফ্রান্সে।’ কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘এখন আমরা জানি কোথায় যেতে হবে।’

কমপিউটার বন্ধ করে আইটি সুইট থেকে বেরোল রানা। পাশে হাঁটছে তানিয়া। জানতে চাইল, ‘কীভাবে ওখানে পৌছুব আমরা?’

‘দায়িত্বটা আমি নিলাম।’

‘অনেক দূরের পথ।

‘আমার সুইটে গেস্টরুম আছে। রওনা হওয়ার আগে ফ্রেশ হয়ে নিতে পারো।’

‘ধন্যবাদ। খিদেও লেগেছে। রওনা হওয়ার আগে লাঞ্চ সেরে নেয়া উচিত। মস্কোর আরারাত পার্ক হায়াত হোটেলের রেস্টুরেন্ট ইউরোপের সেরা।’

‘তোমার কথা থেকে বুঝতে পেরেছি মস্কোর সবই সেরা,’ বলল রানা। ‘তবে ওই হোটেলে মানুষের ভিড় বেশি। আমরা রওনা হয়ে পথেই খাবার কিনে নেব। ঠিক দশ মিনিট পর রওনা হচ্ছি।’

‘আপনি ভাবছেন ওরা এখনও চোখ রাখছে?’

‘তুমি কী ভাবছ?’

‘আপনি ভাবছেন এসবের পেছনে আছে মিস্টার ব্ৰেযনেভ?’

রানার মনে হচ্ছে না এ ঘটনায় জড়িত বৃদ্ধ বিলিয়নেয়ার। অন্তর থেকে ওকে বিশ্বাস করেন তিনি। তবে পরিবারের এই মহা বিপদে রানা কতদূর কী করছে, তা হয়তো গোপনে জানতে চেয়েছেন। তবে সে সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। কখনও মিথ্যা বলেন না ভদ্রলোক।

এখনও জানি না বিষয়টা কী, বলল রানা। ‘তবে তাদের কাউকে পেলে জেনে নেব কী চায় তারা।’

‘আক্রমণাত্মক কিছু করবেন না তো?’

‘আমি সবসময় অতি ভদ্র পথে চলি।’

‘হ্যাঁ, মেজর রানা, তাই দেখেছি লেনিন বার-এ!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল তানিয়া।

আঠারো

ফ্রেশ হওয়ার জন্যে তানিয়া আজোরভকে দশ মিনিট দিয়েছে রানা, তবে আট মিনিটের মধ্যেই বাথরুম থেকে বেরোল মেয়েটা। মুখে এখন মেকআপ নেই। করিডোরের আয়নায় একবার দেখে নিয়ে নাক কুঁচকে ফেলল সে। ‘ছিহ্, আমাকে কী জঘন্য লাগছে দেখতে!’

‘একগাদা রঙ নেই বলেই আমার বরং সুন্দর লাগছে, তাকে খুশি করতে চাইল রানা।

উইন্টার গার্ডেন সুইট ত্যাগ করল ওরা। ফায়ার এস্কেপ ব্যবহার করে নেমে গেল নিচে। খালি এক কনফারেন্স রুমে ঢুকে তানিয়াকে জানাল রানা, যেন দুটো ফোন কল করে সে।

প্রথমত, বিশেষ জায়গায় হাজির থাকতে হবে সেই দানবীয় ড্রাইভারকে। আর তারপর এমন এক ট্যাক্সি ফার্মে ফোন দিয়ে ট্যাক্সি ডাকতে হবে যারা ভাড়া দেয় টিন্টেড জানালাওয়ালা হলদে মিনিভ্যান।

তানিয়ার কথা শেষ হলে লবি এড়িয়ে কিচেনে এল ওরা। ওদিকের দরজা খুলে বেরোল হোটেলের পেছনের রাস্তায়।

মস্কো শহর ‘অতিব্যস্ত হলেও মাত্র সাত মিনিট পর ওদেরকে মিনিভ্যান ট্যাক্সিতে তুলল পাখোয়াজ ড্রাইভার। নেগলিনায়া স্ট্রিট ধরে যেতে যেতে পেভমেন্টে চোখ রাখল রানা। ওর মনে হলো না হোটেলের ওপর চোখ রেখেছে কেউ।

ভিড়ের ভেতর দিয়ে পঁচিশ মিনিট যাওয়ার পর ওরা পৌছুল শহরের তৃতীয় রিং রোড লেফোর্টোভো টানেলের আগে। মিনিভ্যান ট্যাক্সি থামল নোংরা সিমেন্টের এক আণ্ডারপাসে। ভাড়া মিটিয়ে খোশ মেজাজে ড্রাইভারকে বকশিশ দিল রানা। মিনিভ্যান চলে যাওয়ার পর ছায়ার ভেতর সরে দাঁড়াল ওরা। মাথার ওপর দিয়ে সাঁই-সাঁই করে চলছে দ্রুতগামী গাড়ি। তবে আণ্ডারপাসের নিচে ওরা একা নয়। মার্সিডিয এস-ক্লাস গাড়ির পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দৈত্যাকার সেই ড্রাইভার। ঠোঁটে জ্বলছে সিগারেট। বোধহয় কোনও কাজ ছিল না তার, তাই পালিশ করে আরও চকচকে করেছে গাড়িটা। এমন কী ছায়ার ভেতরেও কালো রঙ ঝিলিক দিচ্ছে আয়নার মত। রানা ও তানিয়াকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল লোকটা। নিচু গলায় বলল, ‘অদ্ভুত জায়গায় আসতে বলেছেন। কোথায় নিয়ে যেতে হবে আপনাদেরকে?’

‘তোমার কোথাও যেতে হবে না,’ বলল রানা। ‘আজকের মত ছুটি। ইচ্ছে হলে ভালুকের সঙ্গে গিয়ে কুস্তি করতে পারো। আমি ঠিক করেছি গাড়িতে করে তানিয়াকে নিয়ে বেড়াতে যাব। পরে ফোন দিলে গাড়ি নিয়ে যেয়ো।’

‘কিন্তু এই গাড়ির ক্ষতি হলে?’ বিরক্ত কণ্ঠে জানতে চাইল দৈত্য।

‘জীবনেও কোনও গাড়ির ক্ষতি করিনি,’ ডাহা মিথ্যা বলল রানা। ‘তবে কিছু হলে, ওটার বদলে নতুন একটা দেবেন বিলিয়নেয়ার লুকা ব্রেনেভ।’

হাতদুটো মুঠো করল দানব। তবে রানার চোখে সিরিয়াস দৃষ্টি দেখে ওর হাতে দিল চাবি।

‘এবার যেতে পারো,’ বুড়ো আঙুল দিয়ে পেছন দিক দেখিয়ে দিল রানা।

মিনিটখানেক পর দৈত্য দূরে চলে গেলে তানিয়া বলল, ‘ব্যাপারটা ভাল লাগছে না। লোকটা কেমন যেন। হয়তো চেষ্টা করবে ক্ষতি করার।’

মার্সিডিযের দামি চামড়ার সিটে চাপল রানা। তানিয়ার হাতে ধরিয়ে দিল নিজের স্মার্ট ফোন। ওটার ভেতর তুলে নিয়েছে ইউনার ফোনের দরকারি ইমেজ ও ল্যাণ্ডমার্ক। ‘তুমি ন্যাভিগেট করবে, ড্রাইভ করব আমি।’

গাল ফোলাল তানিয়া। ‘পুরুষরা সবসময় ড্রাইভ করতে চায়।’

ইঞ্জিন চালু করতেই ইলেকট্রিক টারবাইনের মত মোলায়েম গর্জন ছাড়ল মার্সিডিয। আণ্ডারপাস থেকে বেরিয়ে রওনা হয়ে গেল রানা।

‘আগে রাশায় ড্রাইভ করেছেন?’ জানতে চাইল তানিয়া।

‘কখনও কখনও।

‘তবুও বলে রাখি কিছু বিষয়। টেস্ট না দিয়েও ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে পারে যে-কেউ। মাতাল না হলেও মস্কোর বেশিরভাগ ড্রাইভার আইন মেনে চলে না। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে এই দেশে। সিগনাল বাতি কখনও ব্যবহার করে না কেউ। মেনে চলে না স্পিড লিমিট। পথচারী খুন হলেও থামবে না কেউ। কিন্তু ড্রাইভার লাল বাতি না মেনে বেরিয়ে গেলে পুলিশের অধিকার আছে তাকে গুলি করার।’

‘আরও কোনও টিপ্‌স্?’ জানতে চাইল রানা।

কাঁধ ঝাঁকাল তানিয়া। ‘এমনভাবে ড্রাইভ করুন, যেন খুন করতে পিছু নিয়েছে একদল খুনি। তা হলেই ভাল থাকবেন।

‘পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ। এবার কোন্ দিকে যাব?’

‘থার্ড রিং ঘুরে ঢুকে পড়ুন টানেলে,’ সামনের দিকে আঙুল তাক করল তানিয়া।

একটু পর একসারি গাড়ির সঙ্গে ইয়াকুয়া নদীর তলার টানেল ধরে তুমুল বেগে এগিয়ে চলল রানার মার্সিডিয।

‘লেফোর্টোভো টানেল তিন কিলোমিটারের চেয়েও লম্বা,’ প্রায়ান্ধকারে ঢুকে বলল তানিয়া। ‘মানুষ এর চেয়ে বড় টানেল কমই তৈরি করেছে।’

‘ডাবলিনে একটা আছে,’ চট্ করে মেয়েটাকে দেখল রানা। টানেলের বাতির জন্যে বেগুনি দেখাচ্ছে তানিয়ার দুই ঠোঁট।

‘তার মানে আয়ারল্যাণ্ডে?’

‘হ্যাঁ।’

ওদের দেশে আবার গাড়িও আছে?’ বাঁকা সুরে বলল মেয়েটা। ‘সব জংলি। সামনের দিকে আঙুল তাক করল সে। ‘সাবধান। সামনে পানি আছে।’

ধীর হয়েছে দ্রুতগামী গাড়িগুলো। হেডলাইটের আলোয় রানা দেখল, টানেলের মেঝেতে কুলকুল করে বইছে বন্যা। ঠিক সময়ে ব্রেক কষে গতি কমিয়ে নিল ও। পানির ভেতর গাড়ি নেমে পড়তেই চারদিকে ছিটকে গেল একরাশ তরল। বাধ্য হয়ে ওয়াইপার চালু করে রানা বলল, ‘রাশান আর্কিটেকচারের এই হাল কেন? ফুটো হয়েছে তোমাদের টানেল।’

‘এমন ফুটো টানেলে আরও আছে,’ স্বীকার করল তানিয়া। ‘শীতে বরফ জমে গেলে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটে। এটাকে সবাই বলে মৃত্যু-সুড়ঙ্গ।’

‘মনে করিয়ে দিয়ো, আগামী বরফ যুগে যেন এদিকে না আসি।’

অবাক চোখে ওকে দেখল তানিয়া। ‘বরফ যুগ আবার কোথায়? সবাই তো বলছে উষ্ণ হয়ে উঠছে পৃথিবী।’

‘আমার বন্ধু সোলার সায়েন্টিস্টরা অন্য কথা বলে।’

‘আপনার দেখছি অদ্ভুত সব বন্ধু।’

মৃদু হাসল রানা। ‘ভাবতেও পারবে না ওরা কেমন।’ টানেল ফুরোতেই আবারও রোদের ভেতর বেরোল ওরা। তানিয়ার নির্দেশনা মেনে শহর পেছনে ফেলল রানা। মস্কো শহরটা বিশাল হলেও ওই কংক্রিটের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ভাল লাগছে ওর। একটু পর ওরা পড়ল এম টেন ফেডারেল হাইওয়েতে। গত হেমন্তে এ পথেই গিয়েছিল নিকোলভ আর তার মেয়ে। চুপ মেরে গেছে তানিয়া। স্মার্ট ফোনে স্ক্রল করে দেখছে ইমেজ। এই নীরবতায় নিজের চিন্তাগুলো গুছিয়ে নিতে চাইল রানা। ওর ধারণা, সঠিক পথেই আছে ওরা। এ ছাড়া আর কোনও সূত্রও ছিল না। ভাবতে চাইছে না যে শেষে হয়তো খুঁজেই পাবে না ইউনা বা ওর বাবাকে। অদ্ভুত লাগছে গোটা কেসটা। কিছুক্ষণ নানানদিক চিন্তার পর বিরক্ত হয়ে ভাবতে লাগল, কারা পিছু নিল ওদের? ড্রাইভ করার সময় একটু পর পর রিয়ারভিউ মিররে চোখ রাখছে রানা। মাঝে মাঝে বাড়িয়ে নিচ্ছে গতি, আবার কমিয়ে দিচ্ছে কিছুক্ষণ পর। ওকে পেছনে ফেলেছে একের পর এক গাড়ি। বিশেষ কোনও গাড়িকে অনুসরণ করতে দেখেনি।

দুশ্চিন্তা করার মত কিছুই হয়নি। নীল আকাশে নেই হেলিকপ্টার। ট্যাক্সি ছেড়ে নতুন গাড়ি নিয়ে রওনা হওয়ায় বোধহয় ওদেরকে হারিয়ে ফেলেছে লোকগুলো। অথবা, হয়তো সবই ছিল ওর অতি-কল্পনা। এটা ঠিক, আপাতত কোনও কিছুর ওপরেই নিয়ন্ত্রণ নেই ওদের। বুকের ভেতর কেমন অস্বস্তি বোধ করছে রানা। যেন সতর্ক করছে কেউ।

অনেকক্ষণ পর মোটরওয়ের এক সার্ভিস স্টেশনে থামল ওরা। ভরে নিল ফিউয়েল। কিনল ঠাণ্ডা স্যাণ্ডউইচ। গাড়িতে বসেই খেয়ে নিল। নন-অ্যালকোহলিক পানীয় ভাস খেল ওরা। তানিয়া জানাল, ওটা নাকি কোকের চেয়ে হাজার গুণে ভাল। রানা মুখে কিছু না বললেও ঠিক করে ফেলল, আবার কখনও রাশায় এলে এই জিনিসের ধারে কাছেও যাবে না।

কিছুক্ষণ পর হাইওয়ে থেকে নেমে পড়ল মার্সিডিয। ভয়ঙ্কর কোনও লোককে দেখেনি রানা। পিছু নিচ্ছে না কোনও গাড়ি। তবুও অস্বস্তি দূর হলো না ওর।

নীরবে চলল ওরা। একটু পর পর ইউনার তোলা ফোটোর ল্যাণ্ডমার্ক দেখছে তানিয়া।

বারকয়েক জিজ্ঞেস করেছে রানা, ‘তুমি ঠিক আছ তো?’

‘কোনও সমস্যা নেই,’ জবাবে বলেছে মেয়েটা। কিন্তু কুঁচকে আছে ভুরু।

এম টেন হাইওয়ে পেছনে ফেলার পর রানা বুঝেছে, কেন রাশায় হামলা করে হেরে গিয়েছিল হিটলার বাহিনী। আসলে রেড আর্মি নয়, অতি জঘন্য রাস্তা কাবু করেছিল জার্মান বাহিনীকে। পিচঢালা পথে জায়গায় জায়গায় মেরামতের চিহ্ন। তবুও যে ঝাঁকুনি লাগছে, নাভিশ্বাস উঠছে আধুনিক মার্সিডিয গাড়ির। বহুক্ষণ ফাঁকা রাস্তা ধরে এগোবার পর উল্টো দিক থেকে এল মুরগি ভরা পুরনো এক ট্রাক। ক্যাবের প্যাসেঞ্জার সিটে বসে জিভ বের করে হ্যা-হ্যা করছে মস্ত এক কুকুর। ড্রাইভারের বয়স কমপক্ষে নব্বুই। ট্রাকের পর এল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলের এক ট্রাক্টর’। দূরে কোথাও চলেছে দুই ভাই। অবাক চোখে দেখল চকচকে মার্সিডিযটাকে। জানে, তাদের খামার দশবার বিক্রি করলেও উঠবে না ওই গাড়ির দাম।

প্রিয় বন্ধু মউরোসের দেয়া উইস্কি ফ্লাস্ক বের করে জানতে চাইল রানা, ‘এক চুমুক চলবে?’

মুখ বিকৃত করল তানিয়া। ‘গন্ধ তো গ্যাসোলিনের মত।’

ম্যাকাল্যান রেয়ার কাস্ক ব্ল্যাক রয়েছে ফ্লাস্কের ভেতর। প্রতি লিটারের দাম ছয় শত পাউণ্ড। রাশান কভাস এখনও লেগে আছে রানার জিভে। ওটার পর দুর্মূল্য উইস্কি ওর মনে হলো স্বর্গের সুধা।

প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পৌঁছে গেছে ওরা। চারপাশে চোখে পড়ল প্রচণ্ড দারিদ্র্যের ছাপ। পেছনে ফেলল আধ পরিত্যক্ত এক জনবসতি। চারপাশ থেকে ওটাকে আবারও ঘিরে নিচ্ছে সবুজ জঙ্গল। ওখানে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে একাকী বুনো শুয়োর। গাড়ি দেখলেও বিন্দুমাত্র ভয় পেল না। সাইনবোর্ডে কালো মাটি নামের এক গ্রাম পেরোবার পর বয়স্ক এক লোককে দেখল রানা। বিপদে আছেন তিনি। রাস্তার পাশে রেখেছেন ট্রাক। সরু দুই হাতে ধরেছেন পেছনের চাকা। তিনি যুবক হলে থামত না রানা। বৃদ্ধ একসময়ে হয়তো ছিলেন সোভিয়েত আমলে শক্তসমর্থ কর্মী। পরে হেরে গেছেন বয়সের কাছে। আজ আর নেই সাধ্য। পরবর্তী আধুনিক দমকা বাতাস পৌঁছে যাওয়ার আগেই হয়তো বিদায় নেবেন পৃথিবী ছেড়ে। গাড়ি থেকে নেমে তাঁর কাজটা করে দিতে চাইল রানা। তিনি সরে যাওয়ার পর রিমের জং ধরা হুইলের নাট খুলল ও। ফুটো হওয়া ঢাকা সরিয়ে ঠিক জায়গায় আটকে দিল বাতাস ভরা চাকা। নষ্ট চাকা রাখল ফ্ল্যাটবেডের ওপর। পুরো সময়ে একটু পর পর ধন্যবাদ দিলেন বৃদ্ধ। রানার কাজ শেষ হতেই বারকয়েক মাথা দুলিয়ে ওর দিকে বাড়িয়ে দিলেন নোংরা একটা বোতল। ওটার ভেতর স্বচ্ছ কোনও অ্যালকোহলিক তরল। না খেলে অপমান বোধ করবেন বৃদ্ধ, তাই এক চুমুক খেল রানা। জিভ থেকে শুরু করে পেটের নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত কমপ্লিট জ্বলে গেল ওর। বোতল ফেরত দিয়ে উঠে পড়ল মার্সিডিযে। নতুন করে রওনা হয়ে ভাবল ‘বাপস কী খেলাম রে!’

কৌতূহল নিয়ে ওকে দেখছে তানিয়া।

‘কী?’ ভুরু নাচাল রানা।

‘কেউ বিপদে পড়লে আপনি সাহায্য করেন?

‘যদি সাহায্য দরকার হয়,’ বলল রানা। ‘আর যদি সাধ্য থাকে আমার।’

‘আপনি খুব অস্বাভাবিক মানুষ, রানা।’

দূর থেকে দূরে মিলিয়ে গেছে সরু রাস্তা। একবার পাহাড়ের মত উঠছে ওপরে, আবার নেমে যাচ্ছে অনেক নিচে। কিছুক্ষণ ধরে রানার মনে হচ্ছে, সত্যি হয়তো ইউনাকে নিয়ে এদিকে আসেইনি ওর বাবা। বহু দূর যাওয়ার পর রাস্তার পাশে ছোট এক চ্যাপেল দেখল রানা। ওটার বারান্দায় খালি একটা বালতি নিয়ে বসে আছেন এক বৃদ্ধা। ঠোঁটে ঝুলছে ধোঁয়া ওঠা পাইপ। রানার মনে হলো তিনি অপেক্ষা করছেন স্রষ্টার জন্যেই। তবে এই এলাকা বহু আগেই ত্যাগ করেছেন মহাবিরক্ত সৃষ্টিকর্তা।

একটু যেতেই দু’পাশে পড়ল পরিত্যক্ত বাড়িঘর ও দোকান। এরপর প্রতি আট-দশ মাইলে একটা-দুটো করে খালি বসতি পেতে লাগল রানা। ভাবল, ওরা বোধহয় চলেছে ভুল পথে। অবশ্য একচিলতে এই পিচের রেখাটাকে রাস্তা বলা ঠিক নয়। আরও বহুক্ষণ চলার পর হঠাৎ বাইরের দিকে আঙুল তাক করল তানিয়া। ‘ওই যে! পেয়ে গেছি!’

প্রাচীন গির্জাটা ইউনার তোলা ছবির মতই। তবে অক্টোবরে ছিল তুষারের দাপট। এখন সবুজ ঝোপঝাড়ে মুখ লুকিয়ে বসে আছে চুপচাপ। আরেকটু হলে ওটাকে দেখত না তানিয়া। ধসে পড়েছে ছাতের আরও একটা অংশ। আরও কয়েক মিনিট যাওয়ার পর গাড়ির গতি কমাল রানা। একপাশের জঙ্গলের মাঝে দেখল প্রকাণ্ড এক পরিত্যক্ত বাদি। বোধহয় একসময় ছিল জমিদারের ম্যানশন।

‘এবার কী?’ জানতে চাইল রানা।

‘সামনেই একপাশে হ্রদ,’ বলল তানিয়া। চট্ করে দেখল স্মার্ট ফোন। ‘রাস্তার ডানদিকে উপত্যকার নিচের দিকে ওটা।’

‘কোন্ দিকের রাস্তায়?’ জানতে চাইল রানা। সামনে গেছে দু’দিকে সরু দুটি পথ। ইউনা আরও ছবি তুললে বোধহয় ভাল হতো।

‘ওদিকে,’ বামদিকের রাস্তা দেখাল তানিয়া আজোরভ। ‘যুক্তি মেনে বললে, না আন্দাজে?’

‘আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করেন না, রানা?’ ভুরু কুঁচকে বিসিআই এজেন্টকে দেখল মেয়েটা।

আধাআধি চান্স। ব্যর্থ হলে আবার ফিরে এসে খুঁজবে। চারপাশে জঙ্গুলে এলাকা। তাতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তানিয়ার কথার জবাবে বলল রানা, ‘তুমি টুর গাইড। তো চললাম বামের পথে।

পাঁচ কিলোমিটার যাওয়ার পর একটা চড়াই বেয়ে ওঠার পর হঠাৎ হেসে ফেলল তানিয়া। নিচে জঙ্গলের ওপারে টলমল করছে নীল হ্রদ। ‘দেখতে পাচ্ছেন? সবসময় বিশ্বাস করতে হয় তানিয়া আজোরভের কথা।’

‘তুমি না থাকলে জীবনটাই বৃথা হয়ে যেত,’ মন্তব্য করল রানা।

‘বেশি দূরে নেই খামার,’ বলল তানিয়া। ‘রাস্তা ধরে সোজা এগিয়ে চলুন। ‘

সামনে বাড়ল মার্সিডিয।

কী ধরনের বিপদে পড়বে জানলে হয়তো ফিরে যেত রানা। আরও দশ মাইল পেরোল ওরা। চারপাশে নামছে সন্ধ্যার আঁধার। চড়াই পথ থেকে নিচের উপত্যকায় রানা দেখল সেই ছোট্ট খামার।

এখানেই শেষ হওয়ার কথা এ যাত্রা, অথচ মাত্র শুরু হয়েছে ভয়ঙ্কর বিপদের ঘনঘটা।

উনিশ

জঙ্গুলে উপত্যকার মাঝে পাঁচ একর জমি পরিষ্কার করে তৈরি ওই খামার। গিয়ার নিউট্রাল করে ইঞ্জিন বন্ধ করল রানা। ঢালু পথে নেমে চলেছে গাড়ি। কিছুটা যাওয়ার পর একঝাড় গাছের সামনে থামল ওরা। এখন খামার থেকে ওদেরকে দেখতে পাবে না কেউ। হ্যাণ্ডব্রেক টেনে গাড়ি থেকে নামল রানা, ব্যাগ থেকে নিল ছোট কিন্তু শক্তিশালী নাইট ভিশন বিনকিউলার। নিচু গলায় বলল, ‘আড়ালে থেকো, তানিয়া।’

কথাটা শুনে কড়া চোখে ওকে দেখল মেয়েটা।

গাছের সারির মাঝ দিয়ে এগোল রানা। প্রায় খাড়া ঢাল বেয়ে নেমে থামল উপড়ে পড়া এক গাছের কাণ্ডের আড়ালে। ওপর থেকে পরিষ্কার দেখছে খামার। ভিডিয়োর সেই ছোট বাড়ি। এখন তুষার নেই। জং ধরেছে টিনের চালে। কালো জমিতে হাঁটাপথ। চারপাশে জমি। খোঁয়াড়ের পাশে ঘাসের ছোট মাঠ। গোটা খামার ঘিরেছে তারকাঁটার বেড়া। ছোট এক জায়গায় জীর্ণ টিনের ঘর। আশপাশে ঘুরঘুর করছে একপাল মুরগি ও মোরগ। বাড়ির একটু দূরে তারের বেড়ার ওদিকে কান ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা সাদা ছাগল। ইউনার ভিডিয়োতে ওগুলোকে আগেই দেখেছে রানা।

খামারের সবচেয়ে সরু অংশে বাড়ি। দরজার কাছ থেকেই ছবি তুলেছিল ইউনা। আরও ভাল করে দেখতে কয়েক পা এগোল রানা। গ্রাম্য বাড়ি। তৈরি করা হয়েছে আজ থেকে অন্তত দেড় শ’ বছর আগে। একতলা। সময়ের সঙ্গে ওটার দেহে যোগ দিয়েছে একটা-দুটো ঘর। ফলে দেখতে হয়েছে বিদঘুটে। বৃষ্টির পানিতে নেমে আসা ধুলো- ময়লায় কালচে বাইরের দেয়াল। সামনে ছোট, নিচু দরজা। লম্বা কেউ ঢুকতে হলে তাকে কুঁজো হতে হবে। রাশায় উনিশ শতকের মানুষগুলো পর্যাপ্ত খাবার না পেয়ে স্বাভাবিক উচ্চতা পায়নি, ধারণা করল রানা। ছোট জানালা তৈরি করা হয়েছে শীত ঠেকাবার জন্যে। বিংশ শতকে হিমশীতল হাওয়া রুখতে জানালায় কাঁচ বসাতে শুরু করে রাশানরা। জং-ধরা টিনের চাল ফুঁড়ে উঠেছে ধাতব চিমনি। ওই পথে বেরোয় চুলোর ধোঁয়া। খামারবাড়ির চারপাশে আবর্জনা। বস্তা থেকে শুরু করে গ্যাসের খালি বোতল— কী নেই? এখন তুষারাবৃত অক্টোবর নয়, সব ছেয়ে ফেলেছে গ্রীষ্মে জন্মানো ঝোপঝাড়। ভাঙা এক রকিং চেয়ারে বসে উদাস চোখে মুরগি দেখছে বুড়ো এক বেড়াল। সাধ্য নেই ধাওয়া করবে। মাঝে মাঝে কক-কক্কর আওয়াজ করছে মোরগ-মুরগি। খোঁয়াড়ের ভেতর ম্যা-ম্যা শব্দে ডাকছে ছাগল। বাড়ির ভেতর প্রাণপণে ঘেউ-ঘেউ করছে একটা কুকুর।

প্রাণীগুলোকে বাদ দিলে কোথাও কোনও নড়াচড়া নেই। তবে কেউ না কেউ আছে বাড়ির ভেতর। বাইরে সেই পুরনো পিকআপ ট্রাক। রানার মনে হলো না গত ক’মাসে সরানো হয়েছে ওটাকে।

পাশেই ফ্যাকাসে নীল রঙের ফোক্সভাগেন বিটল।

খামারবাড়িতেই আছে ইউনা আর নিকোলভ।

বিনকিউলার তাক করে ফোক্সভাগেন দেখতে গিয়ে রানা টের পেল, পেছনে এসে থেমেছে কেউ। চমকে ঘুরে দাঁড়াল ও। কোনও আওয়াজ না করেই পৌঁছে গেছে তানিয়া আজোরভ। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর রানার জন্যে। ও কি হয়ে উঠছে অসতর্ক?

‘পাওয়া গেল,’ ফিসফিস করল মেয়েটা। কড়া চোখে দেখছে বাড়ি।

‘মেয়েটাকে এখনও দেখিনি,’ পাল্টা ফিসফিস করল রানা।

ম্লান হয়েছে দিনের আলো। বাড়ির একটা জানালায় আলো। জ্বেলে নেয়া হয়েছে ল্যাম্প। অন্য ঘরের জানালা দিয়ে চোখ যেতেই রানা দেখল, পুরনো ওক কাঠের টেবিলের কিনারা। ওই ঘর বোধহয় লিভিংরুম বা কিচেন। জানালার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল কেউ। লোকটা ইয়া মোটা। টেবিলের পাশে চেয়ার টেনে বসল সে।

ইউনার ছবি থেকে নিকোলভের গ্রাম্য বন্ধুকে চিনল রানা। এখন তার পরনে বয়লার সুটের বদলে মোটা কাপড়ের নীল প্যান্ট ও আর্মির খাকি রঙের জাম্পার। হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওদিক থেকে সাদা, চ্যাপ্টা কী যেন টেনে নিল। খবরের কাগজ। ঝুঁকে দেখছে প্রথম পৃষ্ঠা। কয়েক মুহূর্ত পর মুখ তুলে তাকাল। কী যেন বলছে ঘরের ওদিকের কাউকে। বিকট শব্দে ঘেউ-ঘেউ করছে কুকুর। ওটার আওয়াজে বিরক্ত নিকোলভের বন্ধু। মিনিটখানেক পর চেয়ার ছেড়ে কোন্ দিকে যেন গেল।

সামান্য খুলল সামনের দরজা। চৌকাঠে এসে দাঁড়াল মোটা লোকটা। তাকে পাশ কাটিয়ে তীর বেয়ে উঠানে হাজির হলো শিকারি কুকুর। প্রচণ্ড ঘেউ-ঘেউ করছে। কোমর চিকন, চওড়া কাঁধ। কোন্ জাতের চিনল না রানা। তবে বুঝল, ঝামেলা করবে ওটা। কিছু বদমেজাজি কুকুর আগন্তুক দেখলেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, এটা ওই টাইপের। উঠানের নানাদিকে ছুটে যাচ্ছে কুকুরটা। সেইসঙ্গে বিকট ঘেউ-ঘেউ। অতীতে ওই কুকুরের সঙ্গে লড়াই করেছে বুড়ো বেড়াল। আস্তে করে রকিং চেয়ার ছেড়ে নেমে ঝোপের ভেতর ঢুকল ওটা।

ওই কুকুর যে আস্ত বিপদ, বুঝতে পারছে রানা।

কোনও আর্মি আজও বের করতে পারেনি কীভাবে শান্ত করবে খেপা কুকুর। ওগুলো যেন লো বাজেট আর্লি ওঅর্নিং সিস্টেম। বহু দূর থেকে বোঝে কেউ আসছে। আর একবার চেঁচাতে শুরু করলে থামবে না মালিক না এলে। ওটাকে খুন করতে গেলেও আওয়াজ হবে। আর তারপর হত্যার পর মনে হবে, কাজটা ভাল করিনি। ড্রাগ ভরা মাংস দিয়ে কুকুরকে ঠাণ্ডা করাটা দেখা যায় শুধু বাজে অ্যাকশন- সিনেমায়। আগের চেয়ে জোরে ডাকছে শিকারি কুকুর। শহর হলে কেউ ধমক দিয়ে থামিয়ে দিত। কী কারণে ঘেউ-ঘেউ করেছে দেখতেও যেত না। কিন্তু গ্রামে কুকুর চিৎকার করলে সতর্ক হয় সবাই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখে গবাদি পশু ঠিক আছে কি না।

এখনও তা-ই ঘটল। দরজা ছেড়ে উঠানে দাঁড়াল নীল প্যান্ট পরা মোটা লোকটা। বিনকিউলারের মাঝ দিয়ে দিনের সবুজ-বাদামি আলো দেখছে রানা। নেমে আসছে অন্ধকার। মোটা লোকটাকে চিন্তিত মনে হলো। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় সঙ্গে নিয়েছে টর্চ ও শটগান। অস্ত্রটা টুইন হ্যামার। কাছাকাছি লক্ষ্যে ওটার চেয়ে বিপজ্জনক আর কিছুই নেই।

ওর কাজ কঠিন হয়ে উঠছে ক্রমে, ভাবল রানা।

উঠানে নানাদিকে আলো ফেলছে লোকটা। একবার দেখল ছাগলের খোঁয়াড়। তারপর মুরগির ঘর। আলো গেল গাড়িদুটোর ওপর। আলো পড়ল তারের বেড়ায়।

খামার মালিকের পাশে এসে দাঁড়াল কেউ। আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট। মাঝারি গড়ন। পরনে গ্রাম্য পোশাক। জিন্স ও ঢোলা শার্ট। চুল-দাড়ি দেখে রানার মনে হলো, সে হিপ্পি। আরও এক সেকেণ্ড পর চিনল অ্যান্টোনিন নিকোলভকে।

‘নিকোলভ না?’ উত্তেজিত সুরে বলল তানিয়া।

‘হ্যাঁ।’ মেয়েটার হাতে বিনকিউলার দিল রানা। কয়েক মুহূর্ত নিকোলভকে দেখার পর চোখ থেকে বিনকিউলার নামাল তানিয়া। রানার হাতে ধরিয়ে দিল।

বন্ধুর চেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন নিকোলভ। হাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বোল্ট অ্যাকশন মিলিটারি রাইফেল। দূর থেকে ওটা রাশান মসিন নাগাণ্ট বলেই মনে হলো রানার। তৈরি হয়েছিল চল্লিশ মিলিয়ন পিস। সাধারণ মানুষের হাতে রয়ে গেছে বলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। চারদিকে রাইফেলের মাযল ঘোরাচ্ছে নিকোলভ।

গাছের ঝাড়ের মধ্যে ওকে বা তানিয়াকে দেখবে না সে। তবুও ঝুঁকে বসল রানা। তার আগে কাঁধ ধরে মাটিতে বসিয়ে দিয়েছে তানিয়াকে। বহুদূর যায় মসিন নাগাণ্টের গুলি। আরও খারাপ কথা, হঠাৎই গুলি ছুটে যায় ওটা থেকে। আনাড়ি কারও হাতে ওই জিনিস ভীষণ বিপজ্জনক।

বন্ধুর পাশে থেমে কী যেন বলল নিকোলভ।

আলাপ করছে তারা।

‘কী দেখছেন?’ অধৈর্য সুরে জানতে চাইল তানিয়া। তাকে বিনকিউলার দেবে ভেবেছে রানা, এমনসময় আলোকিত দরজায় দেখল ছোটখাটো কাউকে। বারো বছরের মেয়েটার পরনে হাতকাটা গোলাপি জ্যাকেট। কবাট ধরে দাঁড়াল সে। অনিশ্চিত চোখে দেখছে উঠানের আঁধার। বাবা আর তার বন্ধুর হাতে অস্ত্র দেখে চিন্তিত। ওই মেয়ে ইউনা, আস্তে করে শ্বাস ফেলল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *