এক্স এজেন্ট – ১০

দশ

বোকার মত সময় নষ্ট করছি আমরা,’ বিরক্তির সুরে বলল তানিয়া।

‘তা-ই ভাবছ?’ জানতে চাইল রানা। দু’দিক ও পেছনে দেখল। মোটর সাইকেলে চেপে আশপাশে কেউ নেই।

‘মিস্টার ব্রেযনেভ আমাদের ওপর চোখ রাখতে বললেই বা কী?’ বলল তানিয়া। ‘উনি তো আগেই জানেন আমরা কোথায় চলেছি। নিকোলভের অ্যাপার্টমেন্টে।’

‘কিন্তু অন্য কেউ চোখ রাখলে?’ মেয়েটার চোখে তাকাল রানা।

মাথা নাড়ল তানিয়া। ‘কার ঠ্যাকা পড়েছে?’

‘তা জানি না,’ বলল রানা। ‘তবে এটা জানি, কেউ পেছন থেকে ঘাড়ে শ্বাস ফেললে আমার রাগ লাগে।’

‘আপনি আছেন রাশায়,’ বলল তানিয়া, ‘ধরে নিন, সর্বক্ষণ আপনার ওপর চোখ রেখেছে কেউ না কেউ।’

শুরুর দিকে গতি তুললেও পরে ট্র্যাফিকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধীর হয়েছে ট্যাক্সি ড্রাইভার। সামনে দুই লেনের মাঝে নষ্ট হয়েছে পুরনো এক ট্রাক। চারপাশে হর্নের আহাজারি। দুঃখ প্রকাশ করল ড্রাইভার, ‘সরি, বস্। জোরে যাওয়ার উপায় নেই।’

‘রাস্তা দিয়ে গেলে সবসময় দেরি হয়,’ বিজয়িনীর দৃষ্টিতে রানাকে দেখল তানিয়া। ‘বলেছিলাম না গাড়ি নেয়া ভুল হবে?’

‘আমি নানামুখী প্রতিভার অধিকারী,’ জবাবে বলল রানা। ‘এবার, চলো, অন্য উপায় দেখি।’

ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ল ও। গাড়িগুলোর হর্ন পাত্তা না দিয়ে পেরিয়ে গেল রাস্তা। তাল মেলাল তানিয়া আজোরভ। ট্রাম লাইনে চলেছে লাল-হলুদরঙা এক ট্রাম। প্রায় দৌড়ে গিয়ে ওটাতে উঠল রানা। ওকে অনুসরণ করে লাফিয়ে ট্রামে চাপল তানিয়াও। বিরক্ত স্বরে বলল, ‘আমরা যাচ্ছি ভুল দিকে! নিকোলভের অ্যাপার্টমেন্ট এখান থেকে পুবে।’

আরও কেউ পিছু নিয়েছে কি না, তা দেখতেই ট্রামে উঠেছে রানা। আরেকটা উদ্দেশ্যও আছে। কোনও ক্যাথোলিক চার্চ দেখলে চিনে রাখবে ওটা। কিছুটা যাওয়ার পর চোখে পড়ল পেঁয়াজের মত গম্বুজওয়ালা এক অর্থোডক্স চার্চ এবং একটা মসজিদ। সম্ভাবনা খুব কম, তবে আজও হয়তো প্রার্থনার জন্যে চার্চে গেছে নিকোলভ। অবশ্য তাকে খুঁজে নিতে হলে সৌভাগ্যের সহায়তা চাই, ভাবল রানা।

কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর ট্রাম থেকে নেমে পড়ল ওরা। হেঁটে গিয়ে নামল কাছের সাবওয়ে স্টেশনে। এবার ঠিক সময়ে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছল দু’জন। ছেড়ে দেবে এমনসময় ছুটে গিয়ে উঠল ট্রেনে। ওরা বগিতে উঠতেই বন্ধ হয়েছে দরজা। কারও উপায় নেই অনুসরণ করে। তানিয়াকে বলল রানা, ‘আগেই বলেছি, আমার সঙ্গে চললে তাড়াহুড়ো করতে হবে।’

‘বদ্ধ উন্মাদ!’ কয়েকবার বড় দম নিয়ে বলল তানিয়া।

‘তাও তো এখনও গোলাগুলি আর গাড়ির ধাওয়া-ধাওয়ি শুরু করিনি,’ বলল রানা। ‘এখন পর্যন্ত সবই ঘটছে সহজভাবে।’

কয়েকটা স্টেশন পেরোবার পর কড়া রোদে বেরিয়ে এল ওরা। আবারও ট্যাক্সি নিল রানা। নিকোলভের অ্যাপার্টমেন্টের কাছে পৌঁছে যাওয়ার আগেই বুঝল, পিছু নিচ্ছে না কেউ। তবে সামনে বিপদ হতে পারে। হা নিকোলভের অ্যাপার্টমেন্টের ওপর চোখ রাখছে ে হয়তো নিজের লোকদেরকে সরিয়ে নেননি ব্রেযনেভ।

ঝকঝকে সোনালি রোদে নিকোলভের ধূসররঙা, তেতলা * অ্যাপার্টমেন্ট ভবনটা বিষাদময় লাগল রানার। যেন আধুনিক মস্কোর অংশ নয় এদিকটা। এখানে ওখানে ভাঙা জানালার কাঁচ। গলি বা ফুটপাথের পাশে আবর্জনা। ন্যাড়া সব দেয়ালে অশ্লীল সব বাক্য লেখা। অক্ষর রাশান না হলে রানার মনে হতো, ওরা আছে ইটালির কোনও শহরে। পরিবেশটা এতই নোংরা, পরিষ্কার বুঝল মেয়েকে কেন এখানে পাঠাতে চায় না তামারা ব্রেনেভ।

বেশ কিছুক্ষণ চারপাশে চোখ বোলাল রানা। আশপাশে কেউ নেই। ওর মনে প্রশ্ন জাগল: তা হলে ওই দু’জন কারা?

নিজেকে বলল রানা, সময়ই বলে দেবে সব

সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল তানিয়া, পিছু নিল রানা। একপাশে জং ধরা লোহার রেলিং। দোতলায় উঠে মলিন, সবুজ রঙের চারটে প্লাইউডের দরজা পেরিয়ে তারপর থামল মেয়েটা ‘এটাই। নিকোলভের অ্যাপার্টমেন্ট।’

আবছা আঁধার করিডোরে পঞ্চম দরজা থেকে তিন ফুট দূরে থামল রানা। ‘এবার দেখা যাক ভেতরে কে বা কী আছে।’

‘খামোকা ঝামেলা বাড়াচ্ছেন,’ বলল তানিয়া, ‘আগেই বলেছি, ভেতরে কেউ নেই।’

‘বলেছ। আরও বলেছ, ভেতরে ঢোকার অধিকার শুধু পুলিশের। তবে আমার সেরকম মনে হচ্ছে না।’

‘আপনি নিশ্চয়ই দরজা ভাঙবেন না, মেজর রানা?’ তিক্ত সুরে বলল তানিয়া।

‘পাগলে কী না করে, মিস আজোরভ, জবাবে বলল রানা। ‘আগেও ভেঙেছি দরজা। এমন কবাট দেখিনি, যেটার তালা ভাঙতে পারিনি। তবে মাঝে মাঝে লাগে কয়েকটা লাথি।’ ডান-বাম দেখে নিল রানা। এক পা বাড়িয়ে পৌঁছে গেল দরজার সামনে।

ওখানেই থামতে হলো ওকে।

ওর কাজটা আগেই সেরে দিয়ে গেছে কেউ!

একটু ফাঁক হয়ে আছে দরজা। দূর থেকে মনে হয় বন্ধ।

‘বোধহয় ফিরেছে,’ ফিসফিস করল তানিয়া।

‘তা হলে বলতে হয় চাবি হারিয়ে ফেলেছে,’ ভাঙা তালা দেখাল রানা। অ্যালিউমিনিয়াম কেসিঙের ভেতর বাঁকা হয়েছে সস্তা ডোরফ্রেম। ফাঁকে চাড় দিয়ে ঢোকানো হয়েছে প্রাই বার। পা দিয়ে ঠেলতেই ভেতরে খুলল দরজা। ওদিক থেকে হামলা করতে পারে শটগান হাতে কেউ। দ্রুত একপাশে সরে গেল রানা।

তবে ঘটল না কিছুই। দরজায় থেমে কান পাতল রানা। কোথাও কোনও আওয়াজ নেই। কেউ লুকিয়ে থাকলে সে খুব সতর্ক এবং নীরব। দশ সেকেণ্ড অপেক্ষার পর রানা পা রাখল অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর। খাঁ-খাঁ করছে চারপাশ। দুশ্চিন্তা নিয়ে চারপাশ দেখল তানিয়া। তারপর সরব প্রতিবেশীদের কারও এদিকে নজর নেই বুঝে ঢুকে পড়ল অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর।

এন্ট্রান্সের পর অ্যান্টোনিন নিকোলভের লিভিংরুম। খুবই ছোট এবং ফাঁকা। আসবাবপত্র বলতে উল্টে থাকা দু’একটা চেয়ার আর পুরনো একটা সোফা। তন্নতন্ন করে সার্চ করা হয়েছে চারপাশ। একমাত্র টেবিলের ড্রয়ারের সবকিছু পড়ে আছে মেঝেতে। টিভি ও স্টেরিও উধাও। টেবিলের ওপর চৌকো জায়গায় ধুলো কম। ওখানে বোধহয় ছিল ল্যাপটপ কমপিউটার। বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে বলেই মনে হলো রানার। অথবা, সেটাই বিশ্বাস করাতে চেয়েছে দক্ষ কেউ।

‘তোমরা চলে যাওয়ার সময় সঙ্গে মিস্টার ব্রেযনেভের লোক ছিল?’ জানতে চাইল রানা।

‘রয়ে যায় দু-একজন,’ বলল তানিয়া, ‘যদি ফেরত আসে নিকোলভ, তাই।’

‘বুঝলাম,’ বলে পকেট থেকে মোবাইল ফোন নিল রানা। আবার স্পিড-ডায়াল করল বিলিয়নেয়ারের ফোনে। ‘আবার আমি, মিস্টার ব্রেনেড়। আপনি আপনার লোকদেরকে নিকোলভের অ্যাপার্টমেন্ট তল্লাসী করতে বলেছিলেন?’

আগের মতই অবাক হলেন ভদ্রলোক। ‘অবশ্যই না! ওদেরকে পাঠাই চারপাশে চোখ রাখতে। জিজ্ঞাসাবাদ করতে আশপাশের সবাইকে।’

‘এমন কি হতে পারে, আপনার নির্দেশ পুরোপুরি মেনে নেয়নি তারা?’

‘না, তা হতে পারে না। একটু খুলে বলো, রানা। আসলে কী হয়েছে? পেলে ইউনাকে?’

ক্রমেই কঠিন হচ্ছে কাজ, ভাবল রানা। ‘পরে জানাব,’ বলে কেটে দিল কল। পরের কয়েক মিনিট লিভিংরুমের আবর্জনা দেখল। জরুরি কিছু না পেয়ে প্যাসেজ ধরে ঢুকল অ্যাপার্টমেন্টের আরও ভেতরে।

নিকোলভের পয়সা নেই, তা বুঝবে যে-কেউ। রানার হোটেল সুইটের বাথরুমের তিনভাগের একভাগ এই অ্যাপার্টমেন্টের বাথরুম। মেঝের টাইল্স্ ফাটল ধরা। দেয়ালে পানির হলদেটে বাজে দাগ। বেসিনের ওপরের তাক থেকে সরিয়ে নেয়া হয়নি টুথপেস্ট, ব্রাশ বা শেভিংকিট। প্যাসেজের ডানে মেইন বেডরুম। ওয়ার্ডোবে সস্তা কয়েকটা পোশাক। জন লে কারের একটা বইয়ের ওপর রাখা রিডিং গ্লাস। বিছানার নিচে খালি একটা সুটকেস।

পাশের বেডরুমে আসবাবপত্র বলতে বিছানা, কমদামি এক ওয়াড্রোব ও ড্রেসিং টেবিল। আর কিছু রাখার জায়গাও নেই ঘরে। বেডে ছোট সুটকেস ও দুটো গোলাপি পোশাক। এই ঘর ইউনার, বুঝল রানা। নিকোলভের জিনিসপত্রের মতই তাড়াহুড়ো করে রেখে যাওয়া হয়েছে সব।

পায়ের নিচে কিছু কুড়মুড় করে উঠতেই ওদিকে তাকাল রানা। জিনিসটা গোলাপি প্লাস্টিকের। সবচেয়ে বড় টুকরো তুলে দেখল ও। ওটার গায়ে এমবস করা একটা ‘এন’ অক্ষর। মোবাইল ফোন নোকিয়ার লোগোর অংশ। আগে ছিল কেসিঙের টুকরো। নিচু হয়ে খাটের তলায় একগাদা ঝুলের ভেতর আরও কয়েকটা টুকরো পেল রানা। ওগুলো জড় করে হাতে নিল। তবে কোথাও পেল না যন্ত্রটা।

পকেটে প্লাস্টিকের বড় টুকরোটা রেখে পেছনে কারও উপস্থিতি টের পেল রানা। ঘুরে দেখল, প্যাসেজের দেয়ালে হেলান দিয়ে বুকে দুই হাত ভাঁজ করে ওকে দেখছে তানিয়া আজোরভ।

‘এখানে কী পাবেন ভাবছেন?’ জানতে চাইল মেয়েটা।

কী যেন ভেবে নিয়ে রানা বলল, ‘মিস আজোরভ, এবার সেরে নেব জরুরি আলাপ। তবে সেটা তোমার সঙ্গে নয়।

এগারো

নিকোলভের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিল রানা। তানিয়াকে নিয়ে সরু সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নিচতলায়। সামনেই নোংরা উঠান। মাছি ভরা একসারি ডাস্টবিনের পাশে একগাদা আবর্জনা ফেলছে এক মহিলা।

সে-ই কেয়ারটেকার, রানাকে জানাল তানিয়া।

মহিলার বয়স হরে চল্লিশের সামান্য এদিক বা ওদিক। পরনে ধূসর কোঁচকানো ওভারঅল, পায়ে বেঢপ জুতো। ওটা আরেকটু বড় হলে হয়তো নৌকা হিসেবে ব্যবহার করা যেত।

‘আগে এঁর সঙ্গে কথা হয়েছে?’ তানিয়ার কাছে জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়ল মেয়েটা।

রানা ও তানিয়া এগোতেই কবুতরের মত ছোট ছোট চোখে ওদেরকে দেখল মহিলা। কড়া সুরে জানতে চাইল, ‘কী চাই?’

রানা কিছু বলার আগেই নিজের প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর আইডি কার্ড তার হাতে দিল তানিয়া। গভীর সন্দেহ নিয়ে ওটা দেখল মহিলা। ওরা জরুরি বিষয়ে আলাপ করতে চায়, নরম সুরে বলল তানিয়া।

তাতে বারকয়েক মাথা নাড়ল মহিলা। কথা বলতে রাজি নয় সে। তার মাথার চারপাশে উড়ছে এক ঝাঁক মাছি।

রানার মনে হলো, ভাল হতো গোটা তিনেক মাছি মহিলার নাকেমুখে ঢুকলে। কঠোর সুরে বলল, ‘কেন অ্যাপার্টমেন্টের দরজা ভাঙা হয়েছে, আপনাকে এর জবাব দিতে হবে পুলিশের কাছে।’

কথাটা শুনে ফ্যাকাসে হলো মহিলার মুখ।

‘ভাল করবেন মুখ খুললে,’ পরামর্শ দিল তানিয়া।

হড়বড় করে মহিলা জানাল, অ্যাপার্টমেন্টের দরজা ভেঙে ভেতরে কেউ ঢুকেছে কি না, সেটা জানে না সে। কপাল চাপড়ে বলল, বহু টাকা লাগবে দরজা মেরামত করতে। তাই এবার তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করবেন বাড়ির মালিক।

‘আমি মিস্টার নিকোলভ সম্পর্কে দু’চারটে প্রশ্ন করব, বলল রানা। ‘তার জবাব না পেলে ধরে নেব আপনি এই ডাকাতির সঙ্গে জড়িত।’

মাথা নাড়ল মহিলা। ‘কিন্তু আমি তো কিছুই জানি না!’

‘শেষ কবে দেখেছেন তাঁকে, সেটা বলতে পারেন?’ জানতে চাইল রানা।

‘শেষ দেখেছি আট-দশ দিন আগে,’ চেহারায় দ্বিধা নিয়ে বলল মহিলা।

‘তার আগে অ্যাপার্টমেন্টেই ছিল?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘সেদিন বের হচ্ছিল। কোথায় যেন যাবে।’

‘একা ছিল?’

‘না, একা ছিল না।’

‘সঙ্গে কে ছিল? ছোট একটা মেয়ে?’

মাথা দোলাল কেয়ারটেকার।

ইউনার ছবি বের করে তাকে দেখাল রানা। ‘এই মেয়ে?’

আবারও মাথা দোলাল মহিলা। ‘ভাল করে দেখিনি। তবে এই মেয়েও হতে পারে। কেন, কী হয়েছে?’

‘মিস্টার নিকোলভ কোথায় চলেছেন, সে বিষয়ে কিছু বলেছিলেন?’ জানতে চাইল রানা।

কাঁধ ঝাঁকাল মহিলা। ‘দিনরাত মানুষ আসছে, আবার চলে যাচ্ছে। আমি কখনও কারও ব্যাপারে নাক গলাই না।’

‘মিস্টার নিকোলভের সঙ্গে লাগেজ বা ব্যাগ ছিল?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

নাক কুঁচকে ফেলল মহিলা। ‘আমি তো আর পাহারাদার নই যে এসব দেখে বেড়াব। মাঝ থেকে ঝামেলায় পড়লাম।’ তার ভাব দেখে মনে হলো, খুশি হবে আইনী সমস্যা না হলে। জিজ্ঞেস করে ফেলল, ‘আপনারা কি পুলিশে খবর দেবেন?’

রানা বা তানিয়া জবাব দেয়ার আগেই নিচতলার এক অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরোল আরেক মহিলা। বয়স অন্তত ষাট। পাটকাঠির মত চিকন। চুল ধূসর রঙের। সরু কাঁধে সস্তা শাল। রানা ও তানিয়া বুঝে গেল, ওদের প্রতিটি কথা কান পেতে শুনেছে সে। এবার এসেছে কেয়ারটেকার মহিলার মাথায় কুড়ালের ঘা দিতে। ঝড়ের বেগে কথা বলল। তাল রাখতে গিয়ে রীতিমত হিমশিম খেল রানা। বয়স্কা মহিলা বলছে, এই এলোইস গুস্তাভ আসলে পচে যাওয়া এক মরা কুত্তী। লজ্জা বলতে কিছুই নেই। পুলিশী ঝামেলা এড়াতে চাইছে, কারণ বাঁচাতে চায় ড্রাগ ব্যবসায়ী, চোরের বাচ্চা প্রেমিককে। ওই কুকুর এতই খারাপ, মানুষের পুরনো জুতো চুরি করতেও রুচিতে বাধে না।

এ পর্যায়ে গলা ফাটিয়ে প্রবল আপত্তি তুলল কেয়ারটেকার মহিলা। উঠান ভরে গেল দুই মহিলার উত্তপ্ত বাদানুবাদে।

বয়স্কা মহিলা চিৎকার করে বলল, গত দু’বছরে দু’বার তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে মালপত্র চুরি করেছে ওই শয়তান। সবাই জানে, তাকে আস্কারা দিচ্ছে কেয়ারটেকার এলোইস গুস্তাভ। এর কারণও পরিষ্কার, বিছানায় তাকে নিয়মিত শান্তি দেয় ওর ছেলের বয়সী ওই বদমাশ। চারপাশের বাড়িঘরে নানান জিনিস চুরি করছে শুয়োরটা। তবে বারবার শয়তানটাকে বাঁচাতে গিয়ে ডাহা মিথ্যা বলছে এই হারামি বেটি।

কেয়ারটেকারের ভাব দেখে রানার মনে হলো, যে- কোনও সময়ে দু’হাতে খামচে তুলবে বয়স্কা মহিলার দুই চোখ। বিশাল দুই জুতো দিয়ে লাথি মেরে শুকনো পাছা ফাটিয়ে খুন করবে বুড়িকে।

‘নির্লজ্জ মাগী, তুই লুটের মালের ভাগ পাস!’ খনখনে কণ্ঠে জানাল বয়স্কা মহিলা।

পাল্টা চেঁচাল কেয়ারটেকার, ‘মিথ্যার ঝুড়ি, নষ্টা বুড়ি, কুটনী ডাইনী! তুই দূরে গিয়ে মর্! অন্যখানে গিয়ে বল্ তোর মিথ্যা গল্প!’

‘কার চোখ ফাঁকি দিস তুই, হারামজাদি?’ চিলচিত্কার ছাড়ল বয়স্কা মহিলা, ‘নিজ চোখে দেখেছি তেতলার লোকটার বাড়ি থেকে বাক্স ভরে কীসব যেন নিয়ে যাচ্ছে ফাদিল করোটকিন! তখন দু’দিনও হয়নি উনি কোথাও গেছেন।’

‘ওই লোকের নাম ফাদিল করোটকিন?’ ঝগড়ায় বাগড়া দিল রানা।

থমকে গেছে দুই মহিলা। তবে সেটা মুহূর্তের জন্যে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বয়স্কা মহিলা বলল, ‘ওই ফাদিল করোটকিন থাকে কয়েক গলি দূরের বাড়িতে। তার সঙ্গে চুরি করে বেড়ায় শুয়োরটার আপন দুই ভাই। একটার নাম ফ্যালকো, আরেকটার ফারায। এই কুত্তী বেটির সঙ্গে বিছানায় না থাকলে ফাদিল থাকে তাদের সঙ্গেই।’

যথেষ্ট মানসিক নির্যাতনে হাল ছেড়ে দিল এলোইস গুস্তাভ। দু’চোখ বেয়ে নেমেছে অশ্রু। বিরাট জুতোর ধুপধাপ আওয়াজ তুলে ঢুকে পড়ল নিজের অফিসে। পরক্ষণে মেঝেতে ভারী কিছু ফেলার আওয়াজ হলো।

ওই তিন ভাইকে এখন কোথায় পাব?’ বয়স্কা মহিলার কাছে জানতে চাইল রানা।

‘দুই গলি দূরেই থাকে,’ বলল মহিলা। ‘তবে এখন সেখানে পাবেন না। তিন চোর মিলে সর্বক্ষণ ঘুরে বেড়ায় মোটর সাইকেলে চেপে। আর তা যখন করে না, তখন থাকে একটা ভোদকার বার-এ। ওটার নাম লেনিন।’

‘কীভাবে চিনব কে ফাদিল করোটকিন?’ জানতে চাইল রানা।

‘চোখ থাকলে যে-কেউ চিনবে,’ বলল মহিলা, ‘তার কপালে মাকড়সার বড় একটা নীল উলকি। বাম কান কেটে নিয়েছে অন্য এলাকার মস্তান। তবে কথা হচ্ছে, আপনি তাকে ধরতে গেলে আমি পরামর্শ দেব, সময় নষ্ট না করে গলাটা কেটে দেবেন। ওর মত হারামজাদা এই তল্লাটে আর একটাও নেই!’

‘সাহায্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ,’ বলে ব্রেযনেভের দেয়া রুবলের বাণ্ডিল থেকে বড় একটা নোট বাড়িয়ে দিল রানা। ট্যাক্সি ড্রাইভারের চেয়েও দ্রুত ওটা নিল মহিলা। বিড়বিড় করে ধন্যবাদ জানিয়ে ঢুকে পড়ল নিজের অ্যাপার্টমেন্টে।

‘এবার কী করতে চান, রানা?’ জানতে চাইল তানিয়া। ‘চলো, যেতে যেতে বলি,’ বাড়ির গেটের দিকে পা বাড়াল রানা।

‘কোথায় যাব?’ পিছু নিল তানিয়া আজোরভ।

‘লাঞ্চের সময় হয়েছে। তার আগে চাই একটু ড্রিঙ্ক, কী বলো? শুনেছি কাছেই বার আছে।’ হাঁটার গতি বাড়ল রানার।

বারো

তানিয়া আজোরভ স্মার্টফোনের সাহায্য নিয়ে খুঁজে বের করল লেনিন বার। নিকোলভের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে মাত্র কয়েক মিনিট দূরেই ওটা। দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে পকেট থেকে গোলাপি প্লাস্টিকের টুকরো বের করে দেখল রানা।

‘বলেছিলেন পরে ব্যাখ্যা দেবেন,’ মনে করিয়ে দিল তানিয়া।

‘আগে কখনও কিডন্যাপ কেস নিয়ে কাজ করেছ?’ মাথা নাড়ল মেয়েটা। ‘আপনি এ ব্যাপারে কী ভাবছেন?’

‘কেউ নিজের বাচ্চাকে নিজেই কিডন্যাপ করলে ধরে নিতে হবে, ওর বাবা কিংবা মা চলে গেছে চরম পর্যায়ে,’ বলল রানা, ‘তার আগে সময় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছে। গুছিয়ে নিয়েছে ব্যাগে পোশাক থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব। বাদ পড়েনি টুথব্রাশ, পেস্ট, রেযার বা ব্যক্তিগত জিনিস। কিন্তু নিকোলভের বেলায় এমনটা হয়নি। ওয়াড্রোবে পোশাক। খাটের নিচে সুটকেস। নিতে ভুলে গেছে অর্ধেক পড়া বই বা চশমা। একই কথা খাটে ইউনার ব্যাপারেও। কেন যেন মনে হচ্ছে, খুব তাড়া ছিল ওদের। তার আগে কিছুই গুছিয়ে নিতে পারেনি।’

‘আর এটার কী ব্যাখ্যা?’ রানার হাতের প্লাস্টিকের টুকরো দেখাল তানিয়া। ‘আমার মনে হচ্ছে ওটা কোনও সেল ফোনের কেসিঙের টুকরো।’

‘গোলাপি ফোন,’ বলল রানা, ‘মনে হয় না নিকোলভের।’

‘হতে পারে সে একজন…’

‘গোলুবই?’

‘আপনি একবার কিছু শুনলে ভোলেন না, না?’ হাসল তানিয়া।

‘আমার মনে হয় ওটা ইউনার। তবে ভেঙে ফেলেছে কেউ।

ঠোঁট বাঁকা করল তানিয়া। ‘জানলেন কী করে? জিনিস তো ভেঙেও যায়।’

‘মোবাইল ফোনের কেসিং শক্তভাবে তৈরি করা হয়, বলল রানা। ‘কয়েক ফুট ওপর থেকে পড়লেও ভাঙে না। চুরমার করতে লাগে প্রচুর শক্তি। কখনও কখনও এক- আধটা ভেঙেছি। নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে মনে হচ্ছে, হাতুড়ি দিয়ে ভাঙা হয়েছে এটা। অথবা, মোবাইল ফোন মেঝেতে ফেলে মাড়িয়ে দেয়া হয়েছে বুট দিয়ে। ছোট কোনও মেয়ের কাজ মনে হচ্ছে না। ইউনার তো যত্নে রাখার কথা এ ধরনের জিনিস। বখে যাওয়া মেয়ে বলে ওকে মনে হয়নি আমার।’

ঠোঁটের দু’কোণ নিচু হলো তানিয়ার। ‘তা হলে বলতে চান, জিনিসটা ভেঙেছে অ্যান্টোনিন নিকোলভ?’

‘অথবা ভেঙেছে অ্যাপার্টমেন্টে ডাকাতির সময় অন্য কেউ,’ বলল রানা। ‘কিন্তু সেটা কেন করবে সে? বিক্রি করলেই পাবে টাকা। এদিকে নিকোলভ ভাঙলে, কী কারণে নিজের মেয়ের ফোন চুরমার করল সে? নিশ্চয়ই কোনও কারণ ছিল?’

কী যেন ভেবে বলল তানিয়া, ‘হয়তো চেয়েছে যাতে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে না পারে ইউনা। যাতে সাহায্য চাইতে না পারে। আর এ থেকেই প্রমাণ হচ্ছে, নিজের মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে অ্যান্টোনিন নিকোলভ।’

‘এটা সম্ভাবনা,’ বলল রানা। ‘কিন্তু অন্যদিকেও নজর দিতে হবে। অ্যান্টোনিন মোবাইল ফোন ভাঙলেও সেটা থাকার কথা মেঝেতে বা খাটের নিচে। যন্ত্রটা কিন্তু নেই।’

‘আপনি ভাবছেন ডাকাতরা নিয়ে গেছে?’

‘হতে পারে। কেসিং ভাঙলেও মেরামত হয় যন্ত্র।’

‘তা হলে এতক্ষণে চোর ওটা বিক্রি করে দিয়েছে।’

‘সত্যিই বিক্রি করেছে কি না, তা জানতে চাইব ফাদিল করোটকিনের কাছে। দরকার হলে জেনে নেব কার কাছে বিক্রি করেছে।’

‘যদি চোর হয়ে থাকে ফাদিল করোটকিন, তবে।’

‘সেটাও জেনে নেব,’ বলল রানা, ‘মুখোমুখি আলাপে কপাল খুলতে পারে।’

‘কিন্তু আমরা এত ঝামেলার ভেতর যাব কেন?’ জানতে চাইল তানিয়া আজোরভ।

‘কারণ, ওই ফোন হাতে পেলে, আর যদি জানতে পারি ওটা ইউনার, হয়তো ভেতরে পাব অন্যান্য নম্বর। সেগুলোর ভেতর থাকতে পারে ওর বাবারটাও। সেটা কাজে আসবে। অথবা, ওটার ভেতর এমন কিছু থাকতে পারে, যার মাধ্যমে জেনে যাব ওরা কোথায় গেছে।

‘অনেক হয়তো আপনার কথার ভেতর, ‘ বলল তানিয়া। ‘হয়তো এরই ভেতর ফোন থেকে মুছে দিয়েছে সব ডেটা।’

‘কোনও ডেটা পাওয়া গেলে সেটা হবে জরুরি ব্লু, মিস আজোরভ,’ বলল রানা। ‘আপাতত হাতে কোনও সূত্র নেই। তাই ছোটখাটো তথ্য পেলে সেটাও অনেক।’

লেনিন বার-এর কাছে পৌঁছে গেছে ওরা। মস্কোর পুরনো কিছু এলাকা নতুন করে ভেঙে গড়বে রাশান সরকার, পত্রিকায় পড়েছে রানা। এ এলাকাও বোধহয় তার ভেতর আছে। যে-কোনও দিন হাজির হবে মেয়রের বুলডোযার বাহিনী। ফাঁকা পড়ে আছে ধূসর রাস্তা। দু’পাশে ভাঙাচোরা, জীর্ণ, পুরনো বাড়ি।

রাস্তার মোড়ে লেনিন বার-এর কাছে পৌঁছুবার আগেই জোরালো মিউযিকের আওয়াজ শুনেছে ওরা। কংক্রিটের তৈরি একতলা ধূসর দালানে বার। উঠানের এদিকে তারের বেড়া। চারপাশে পতিত জমি। বার-এর দরজার ওপরে অস্পষ্ট লেনিন বার লেখা না থাকলে যে-কেউ ভাববে ওটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলের বাঙ্কার। চারপাশে জানালা নেই। দরজার সামনে গ্যালভানাইড্ স্টিলের গ্রিড। উঠানে কাত হয়ে স্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে আছে ডযনখানেক মোটর সাইকেল। বেশিরভাগই হার্লে ডেভিডসন মোটর সাইকেলের নকল। সামনের ফোর্ক লম্বা। ওপরে উঁচু হ্যাণ্ডেলবার। গ্রীষ্মের গরমে সাঁই-সাঁই করে যাওয়ার সময় গাছে ঝুলন্ত শিম্পাঞ্জির মত ঘামে ভেজা বগল শুকিয়ে নেবে আরোহী। পাশাপাশি কুটকুটে কালো তিনটে মোটর সাইকেল দেখা গেল। টাঙ্কির ওপর অদক্ষ হাতে আঁকা কাস্তে-হাতুড়ি, স্বস্তিকা ও করোটি।

‘কত হারামি হলে এসব মোটর সাইকেল চালায়,’ মন্তব্য করল তানিয়া।

‘তাদের একজনের কপালে মাকড়সার উলকি,’ জানাল রানা, ‘আমরা বোধহয় পেয়েছি করোটকিন ভাইদেরকে।’

‘মনে হয় না এই বার-এ ড্রিঙ্ক করার মানসিকতা আমার আছে,’ দালানটা আরেকবার দেখল তানিয়া।

‘কী যে বলো! খবর জানতে এসব জায়গা দারুণ কাজের।’

স্টিলের গ্রিড ও দরজা খোলা। কবাট সরিয়ে বাড়ির ভেতর পা রাখল রানা। পিছু নিল তানিয়া।

লেনিন বার-এর ভেতর বিশগুণ জোরে বাজছে মিউযিক। বাতাসহীন অন্ধকার পরিবেশ বদ্ধ ও উষ্ণ। ঘাম, সিগারেটের ধোঁয়া ও অ্যালকোহলের কড়া দুর্গন্ধ। জায়গায় জায়গায় দপদপ করে জ্বলে উঠে আবারও নিভে যাচ্ছে রঙিন বাতি। পচে যাওয়া মানুষের আস্তানা, দারুণ আকর্ষণীয়। দূরে, নিচু মঞ্চে দুটো খুঁটি ধরে নেচে চলেছে দুই প্রায়- ন্যাংটো ভদ্রমহিলা। তাদেরকে ঘিরে রেখেছে মদ বা বিয়ারের বোতল হাতে আধ মাতাল একদল বদমাশ। ভেতরে হৈ-চৈ ও হট্টগোল। হাত তুলে নতুন বোতল বা ড্রিঙ্ক চাইছে কেউ কেউ। রানার ধারণ হলো, অনেকে বাড়ি না ফিরে এখানেই কাটিয়ে দিয়েছে গত রাতটা। .

চারপাশ দেখল রানা। বামে একটা টেবিলে বসে ড্রাগ নিচ্ছে মাতাল চার যুবক। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ডিলার। টেবিলের ওপর তার ব্যাগ ও টাকার বাণ্ডিল। এইমাত্র ব্যাগ থেকে কী যেন দিল বামদিকের যুবকের হাতে। ডানদিকের কোণে বড় একটা কাউচের ওদিকে গ্লাস-বোতল ভরা টেবিল। সেখানে বসেছে তিন যুবক। বয়স পঁচিশ থেকে ত্রিশ। চেহারার মিল দেখে রানা বুঝল, পেয়েছে তিন করোটকিনকে। তাদের একজন নোংরা কৌতুক বলেছে। তাতে প্রায় গড়িয়ে পড়তে গিয়েও সামলে নিল অন্য দু’জন। দুই হাতে চাপড় দিল উরুতে।

একবার তানিয়াকে দেখল রানা।

ওর মত একই কথা ভাবছে মেয়েটা।

লেনিন বার-এ ওরা পেয়েছে করোটকিনদেরকে।

এবার কী?

এই নোংরা পরিবেশে অভ্যস্ত এরা। মাঝের যুবক আকারে ও বয়সে অন্য দু’জনের চেয়ে বড়। অলস ভঙ্গিতে হাত-পা ছড়িয়ে বসেছে। ছোটদের জন্যে অপেক্ষাকৃত কম জায়গা। ক’দিন আগে ধান কেটে নেয়ার পর খেতের যে হাল হয়, সেই একই হাল বড়টার মাথার। খোঁচা খোঁচা চুল। গোপন করছে না কাটা কান। কপালের মাঝে মস্ত এক নীল ট্যারান্টুলা মাকড়সা।

সে ফাদিল করোটকিন, অন্য দু’জন ছোটভাই ফ্যালকো ও ফারাজ। ছোটজন দেখতে প্রায় সুদর্শন, তবে চেহারার বারোটা বেজেছে ঠোঁটের বাঁকা হাসিতে। পনি টেইল করা লম্বা চুল খুব নোংরা। হাসি ও চুলের জন্যে তাকে দেখাচ্ছে নর্দমার ছুঁচোর মত। তৃতীয়জনের কপাল খুলছে- মানে, টাক পড়তে শুরু করেছে। তাতে কী, ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েছে দেড় হাত লম্বা, ঘন কালো দাড়ি দিয়ে। তিন ভাইয়ের সামনের টেবিলে কয়েক সারি বিয়ারের খালি বোতল। এরই মধ্যে প্রত্যেকে কমপক্ষে গিলেছে তিন থেকে চার বোতল বিয়ার।

রানার সঙ্গে বার-এ তানিয়া ঢুকতেই অনেকের চোখ পড়েছে ওদের ওপর। ঘুরে ঘুরে মেয়েটাকে দেখছে তারা। ভিড়ের ভেতর দিয়ে বার কাউন্টারে পৌঁছুল রানা। হাত নেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করল বারম্যানের। জানিয়ে দিল, ওর চাই উইস্কি। তানিয়ার জন্যে ভোদকা। খদ্দেরদের মত বারম্যানকেও হারামি লোক বলেই মনে হলো রানার। এ-ও বুঝল, এদের বেশিরভাগকে ডাক নামে চেনে সে। ড্রিঙ্ক ঢালতে শুরু করতেই লোকটাকে হাতের ইশারা দিল রানা। হাত তুলে দেখাল কোণের কাউচের তিনজনকে। গলা চড়িয়ে জানতে চাইল, ‘ওখানে ফাদিল করোটকিন আছে, তাই না?’

টু শব্দ না করে ভুরু কুঁচকে ওকে দেখল বারম্যান। ঠকাস্ করে ওর সামনে রাখল দুটো গ্লাস। হাত বাড়িয়ে দিল টাকার জন্যে।

আর কিছু জানতে বাকি নেই রানার।

ড্রিঙ্ক নিতে আপত্তি আছে তানিয়ার। মাথা নাড়ল। দুপুরের আগে মদ্যপান করবে না সে।

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ঢক করে গিলে নিল ওর ড্রিঙ্ক। গলা জ্বলে উঠতেই বুঝল, ওটা স্কচ নামের কলঙ্ক।

‘আমরা কি এখানে মদ গিলতে এসেছি?’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল তানিয়া।

মাথা নাড়ল রানা। ‘না, তা নয়।’

‘তা হলে কী করতে এসেছি?’

‘চুপচাপ দেখো কী হয়।’

‘কী করবেন ভাবছেন?’

‘যা করা উচিত,’ বলল রানা। ‘ভরসা রাখো আমার ওপর।’

খালি গ্লাস বার কাউন্টারের দূরে ঠেলে উঠে দাঁড়াল রানা।

বসে বসে গল্প করছে করোটকিন ভাইয়েরা।

তাদের দিকে রওনা হয়ে গেল ও।

তেরো

আরও একটা নোংরা কৌতুক শুনে হেসে খুন হয়ে যাচ্ছে ছোট ভাই। তিন ভাই হঠাৎ টের পেল, পাশে থেমেছে কালো চুলের বাদামি ত্বকের এক যুবক। হাসি বন্ধ করে তার দিকে তাকাল তিন করোটকিন। তারপর বিয়ার গেলা, ঝাপসা চোখে দেখল বারের কাছে দাঁড়ানো তানিয়াকে।

টেবিলের কোণে দাঁড়িয়ে তিন যুবককে ঝুঁকে দেখল রানা। ‘তোমাদের ভেতর কোন্‌জন ফাদিল?’ আগেই জেনেছে, তবে এখন ওর উদ্দেশ্য এদের মনোযোগ কেড়ে নেয়া।

সহজ ওর পরিকল্পনা। চাপ দিয়ে জেনে নেবে, নিকোলভের অ্যাপার্টমেন্টে ফাদিল ঢুকেছিল কি না। তবে সেজন্যে আগে বাইরে নিতে হবে তাকে। এ-ও মেনে নিতে হবে, সঙ্গে যাবে তার দুই ভাই।

তাতে সমস্যা নেই। ডান হাতের বুড়ো আঙুল ও তর্জনী দিয়ে ধরে ফাদিলের বিয়ারের গ্লাসটা টেবিলে কাত করল রানা।’ তিন গড়ান ‘দিয়ে মেঝেতে পড়ে ঠুং শব্দে ভাঙল গ্লাস! সোনালি তরলে ভেসে গেছে টেবিল। কোল ও ঊরু ভিজতেই রেগে গিয়ে চিৎকার ছাড়ল ফাদিল। চট্ করে তাকাল নিজের জিন্সের প্যান্টের দিকে। যে-কেউ বলবে, হিসু করেছে সে। মুখ তুলে রানাকে দেখল। চোখে রাগের দাউ-দাউ আগুন।

বাড়াবাড়ি দরকার, জানে রানা। এবার প্রতিপক্ষকে চরম অপমান করতে হবে। ফাদিলের দিকে তর্জনী তুলে জোর গলায় বলল ও, ‘শালা, হারামজাদা গোলুবই!’

তাতেই কাজ হলো। লাফিয়ে কাউচ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তিন ভাই। যে-কোনও সময়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে রানার ওপর। ড্রিঙ্ক করা বা ন্যাংটো মেয়ে দেখা বাদ দিয়ে ঘুরে চেয়েছে সবাই। রানার অভিজ্ঞতা বলছে, করোটকিনদের সাহায্য করবে না কেউ। প্রতিদিন মারামারি হয় বার-এ। কেউ নিজেকে রক্ষা করতে না পারলে তার উচিত নয় এখানে আসা।

‘বাইরে একহাত হয়ে যাক,’ ইশারা করে দরজা দেখিয়ে ওদিকে রওনা হলো রানা। বার-এর কাছ থেকে অবাক চোখে চেয়ে আছে তানিয়া আজোরভ।

তারের বেড়া দেয়া উঠানে বেরোল রানা। আগের মতই ফাঁকা রাস্তা। পার্ক করা মোটর সাইকেলের পাশে থামল ও।

বার থেকে ঝড়ের বেগে বেরোল তিন করোটকিন। সামনে ফাদিল, রাগে জ্বলছে দুই চোখ। আরও খেপল রানার কাণ্ড দেখে। এইমাত্র ব্যাটা লাথি মেরে তাদের দুটো মোটর সাইকেলের ওপর হুড়মুড় করে ফেলেছে আরেকটা। উঠানে কাত হয়ে পড়ে আছে ওগুলো।

রানা জানে, মোটর সাইকেল ফেললে সবচেয়ে বেশি খেপে মোটর সাইক্লিস্ট। সুতরাং এখন তৈরি হয়েছে লড়ার উপযুক্ত পরিবেশ।

বিদেশিকে দু’হাতে ছিঁড়বে ফাদিল, ফ্যালকো ও ফারায। অন্তত চেষ্টা করবে। অর্ধচন্দ্র তৈরি করে এগোল তিন ভাই। মোটর সাইকেল থেকে সরে দাঁড়াল রানা। বার- এর দরজায় হাজির হয়েছে করোটকিনদের ক’জন বন্ধু, চোখে রাগ।

তাদের কয়েকজন চিৎকার করল: ‘ধর্ ওকে, ফাদিল!’

‘ছিঁড়ে ফেল হারামজাদাকে!’

‘লাথি মেরে বিচি ফাটিয়ে দে!’

তাদের মাঝ দিয়ে পথ করে বেরোল তানিয়া, চোখে অনিশ্চয়তা ও দ্বিধা।

কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে রানার দিকে চলেছে তিন করোটকিন। মাঝে বড় ভাই ফাদিল। চোখে আত্মবিশ্বাস। বহুবার ঘুষিয়ে নাক-মুখ ফাটিয়েছে অনেকের। সে জিতবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তা ছাড়া, তারা তিন ভাই। বিপক্ষে মাত্র একজন।

পিছিয়ে গেল না রানা। দাঁড়াবার ভেতর অলস ভঙ্গি। ধীরে ধীরে চলছে হৃৎপিণ্ড। দেহের দু’পাশে ঝুলছে দুই হাত।

আরেক পা এগোল তিন ভাই। ডানে ফারায করোটকিন। রানা পিছিয়ে যাচ্ছে না দেখে সন্দেহ জাগল তার মনে।

রানা বাজি ধরতে পারে, তিনজনের ভেতর আগে হামলা করবে ফাদিল। ওর ভাবনাই ঠিক হলো, দু’সেকেণ্ড পর চাপা গর্জন ছেড়ে মাথা নিচু করল সে। হাতদুটো কাঁকড়ার দাঁড়ার মত করে সরাসরি তেড়ে এল রানার দিকে। দেহের সমস্ত ওজন দিয়ে উড়িয়ে দেবে বিদেশি যুবককে।

পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে রানা। ফাদিল গায়ের কাছে আসতেই ঝট্ করে একপাশে সরে সামনে বাড়িয়ে দিল পা। রেলগাড়ির মত তেড়ে এলেও ঠিক সময়ে থামতে পারল না ফাদিল। ল্যাং খেয়ে হুড়মুড় করে পড়ল সিমেন্টের চাতালে। চাপ খেয়ে পেট থেকে ভুশ্ আওয়াজে বেরোল বাতাস। তার মাথার পাশে ছোট্ট একটা মাপা লাথি দিল রানা। আপাতত চট করে উঠবে না সে।

বড় ভাইয়ের পতন দেখেছে দুই করোটকিন। একবার দেখল পরস্পরকে, তারপর একযোগে তেড়ে এল রানার দিকে। এরা যে মারপিটে অভ্যস্ত নয়, বুঝে গেছে রানা। ওর কনুই নামল ছোটজনের নাকে, একইসময়ে বুটটা খটাৎ শব্দে লাগল দেড়েলের হাঁটুর ওপর। চিত হয়ে উঠানে পড়ল ফারায, ওদিকে হুমড়ি খেয়ে চাতালে উপুড় হয়েছে ফ্যালকো। প্রায় সুদর্শন ছিল ছোটজন, কিন্তু নাক ফেটে যাওয়ায় এখন সুন্দর বলবে না কেউ। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। একহাতে ধরল ছেঁচে যাওয়া নাক। বিস্মিত চোখে দেখছে ভূমিশয্যায় বিশ্রামরত বড় দুই ভাইকে। আর চেহারা দেখে রানা বুঝল, এখন যে-কোনও মুহূর্তে লেজ গুটিয়ে ভাগবে যুবক। উঠানে হাঁটু চেপে ধরে ছটফট করছে দাড়িওয়ালা করোটকিন। ভীষণ ব্যথায় গলা থেকে বেরোচ্ছে ষাঁড়ের আর্তনাদ। বিকট আওয়াজে বিরক্ত হয়ে তার মাথার পাশে কষে লাথি মারল রানা। মুহূর্তে অজ্ঞান হলো লোকটা

তিনজনের বিরুদ্ধে লড়তে সময় নিয়েছে রানা সবমিলে চার কি পাঁচ সেকেণ্ড। এখন বার-এর দরজা থেকে উৎসাহ দিচ্ছে না কেউ। হতবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে তানিয়া। নাকের রক্ত আস্তিনে মুছে রানাকে ঘিরে হাঁটতে শুরু করেছে ফারায করোটকিন।

‘আমাদের হাতে সারাদিন নেই,’ বলল রানা। ‘যা করার জলদি!’

বেল্টের খাপ থেকে স্টিলেটো বের করল ফারাজ। নিষেধের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রানা। যারা ব্যবহার জানে না, তাদের জন্যে নয় ওই অস্ত্র।

হিংস্র ভঙ্গিতে ছোরা দোলাচ্ছে ফারাজ। ওটা গেঁথে দেবে রানার বুকে। ছোরা চালাতেই হাতের তালুর ওপর দিয়ে ফলা যেতে দিল রানা, পরক্ষণে মোচড় দিয়ে কেড়ে নিল ওটা, যেন শিশুর হাতের ললিপপ। নাক দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে ফারাযের। ছোরা হারিয়ে অবাক চোখে দেখল নিজের শূন্য হাত। পরক্ষণে দেখল উঠানে পড়ে থাকা দুই ভাইকে। আবার তাকাল রানার দিকে। পরমুহূর্তে পালিয়ে যাওয়ার জন্যে ঝেড়ে দৌড় দিল সে।

‘এত তাড়া কীসের?’ দু’পা এগিয়ে খপ্ করে যুবকের পনি টেইল চেপে ধরল রানা। হ্যাঁচকা টান দিল পেছনে। ফলে তাল হারিয়ে চিত হয়ে উঠানে পড়ল ফারায। চোয়ালে দুটো লাথি মেরে তাকেও ঘুম পাড়িয়ে দিল রানা। সবমিলে লড়তে গিয়ে ব্যয় হয়েছে পনেরো সেকেণ্ড। খরচ করতে হয়নি একটা ঘুষিও।

তবে এমনি সময়ে দরজা খুলে বেরোল লেনিন বার-এর বারম্যান। সে দক্ষ লোক। হাতে পাম্প শটগান। ওটা তাক করল বিদেশি যুবকের বুক লক্ষ্য করে। বুঝিয়ে দিল, শেষ হয়নি লড়াই

চোদ্দ

জন্মের সময় বন্দুকটা ছিল বারো গেজের পাম্প-অ্যাকশন হান্টিং শটগান। সাধারণত এগুলোর নলের দৈর্ঘ্য হয় আটাশ ইঞ্চি। স্মুথবোর। প্রচণ্ড ধাক্কা সহ্য করার জন্যে থাকে ওয়ালনাট কাঠের বাঁট। কিন্তু এই অস্ত্রটায় কারিগরি ফলানো হয়েছে। ছেঁটে ফেলা হয়েছে নল ও বাঁটের বড় অংশ। শটগানে এখন অবশিষ্ট রয়েছে শুধু ছোট্ট একটু পিস্তল গ্রিপ আর বারো ইঞ্চি নল। ডাকাত পড়লে বা রায়ট বাধলে এর চেয়ে ভাল অস্ত্র আর হয় না। যদিও নিখুঁত লক্ষ্যভেদ করা কঠিন, কাউকে কাছ থেকে গুলি করা হলে দু’টুকরো হয়ে যাবে সেই লোক। বার-এর নিচের তাক থেকে বের করে এনেছে ওটা গোমড়ামুখো বারটেণ্ডার।

রাগী চেহারায় বন্দুকে পাম্প করল বানম্যান। ধাতব ক্রাঞ্চ-ক্রাঞ্চ শব্দ তুলল বন্দুক। দু’পা ফাঁক করে ডান কোমরে ঠেকাল বন্দুকের বাঁট। নল তাক করেছে রানার বুক লক্ষ্য করে।

স্টিলেটো হাতে দাঁড়িয়ে আছে দুর্ধর্ষ বিসিআই এজেন্ট ভাবছে, পারব তো ঠিক সময়ে তার চোখ ভেদ করতে? নইলে বুকে ঢুকবে সোয়া এক আউন্স বাক শট। নলকাটা বন্দুক থেকে বেরোবার সময় গুলির গতি হবে সেকেণ্ডে পনেরো শ’ ফুট।

লড়াইয়ের সময় মূর্তির মত স্থির ছিল তানিয়া আজোরভ। এবার হঠাৎ যেন ফিরে পেল প্রাণ। কেউ কিছু বোঝার আগেই দ্বিধাহীনভাবে চলে গেল বারম্যানের পেছনে। বিদ্যুদ্বেগে তার হাতের তালু নামল লোকটার ঘাড়ের ওপর।

টলমল করে উঠল বারম্যান। অর্ধেক ঘুরল তানিয়ার দিকে। কিন্তু ততক্ষণে ছোঁ দিয়ে তার হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিয়েছে মেয়েটা। পরমুহূর্তে বন্দুকের বাঁট লাগল লোকটার থুতনির নিচে। নরম মাংস, দাঁতের পাটি ও কাঠের সংঘর্ষে চারপাশে ছড়াল থ্যাচ-খট আওয়াজ। ভেজা কাপড়ের মত উঠানে নেতিয়ে গেল বারম্যান, বেহুঁশ।

পরের সেকেণ্ডে ঘুরেই দরজায় দাঁড়ানো লোকগুলোর দিকে বন্দুক তাক করল তানিয়া। নলটা কোনদিকে দেখেই হুড়মুড় করে বার-এ ঢুকল সবাই। মরলে মরুক ওরা চার বন্ধু! শেষজন পেছনে দড়াম করে আটকে দিল দরজা। ভাঁজ খুলে বন্দুকের রিসিভার থেকে গুলি নিল তানিয়া। ছুঁড়ে ফেলল লেনিন বার-এর ছাতে। মই না পেলে ওগুলো সংগ্রহ করতে পারবে না কেউ। দালানের পাশের ঝোপে বন্দুক ফেলে বলল মেয়েটা, ‘এবার আমাদের চলে যাওয়া উচিত। যে-কোনও সময়ে পুলিশ আসবে।’

‘পুলিশ ডাকলে ফেঁসে যাবে ওরাই,’ প্রায় অচেতন ফাদিলের পাশে থামল রানা। হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিল তাকে। কাত হয়ে পড়তে গিয়েও সামলে নিল রাশান মস্তান। অবাক চোখে দেখল রানাকে। তিন সেকেণ্ড পর চিনল কে ওই বাদামি যুবক। ভীষণ ভয়ে পিছিয়ে যেতে চাইল ফাদিল।

‘চলো! লুঠের জিনিস কোথায় দেখিয়ে দেবে,’ বলল রানা, ‘ওগুলোর ভেতর আমাদের জিনিস আছে। ওটা ফেরত চাই। চালাকি করবে না। নইলে ভাঙব দুই কবজি। একই হাল হবে তোমার দুই ভাইয়ের। ওরা হাসপাতাল থেকে বেরোলে টের পাবে, কয়েক মাস বড় ভাইয়ের পাছা পরিষ্কার করতে হবে ওদেরকে।’

বিড়বিড় করে ফাটা গলায় বলল ফাদিল, ‘শালা, কী চাস্! শুয়োরের বাচ্চা!’

এক পা সামনে বেড়ে হাত ওপরে তুলল রানা।

মার খাওয়া কুকুরের মত কুঁকড়ে গেল রাশান যুবক। ‘না, না, দেখিয়ে দেব কোথায় রেখেছি। জায়গাটা বেশি দূরে না।’

‘ফাদিল, নিজের বাড়িতে চোরাই মাল রাখো তুমি?’ একটু থমকে গিয়ে জানতে চাইল রানা।

কাঁধ ঝাঁকাল ফাদিল। সে হয়তো হদ্দবোকা, তবে এতটা নয় যে রানার কথামত চলবে না। মার খেয়ে ভূত হওয়ার ইচ্ছে নেই তার। ‘যে-কোনও কিছু নিতে পারেন। শুধু একটা কথা, ভাই, আর মারবেন না। ঠিক আছে তো?’

‘কথা দিতে পারছি না। এগোও।’

কাত হয়ে পড়ে থাকা মোটর সাইকেল একবার দেখে নিয়ে রওনা হলো ফাদিল করোটকিন। দ্বিতীয়বার তাকাল না অজ্ঞান দুই ভাই বা বারম্যানের দিকে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলেছে। পিছু নিল রানা ও তানিয়া। মিনিটখানেক পর আবারও ধূসর, নির্জন এক রাস্তায় পড়ল ওরা।

একটু দূরেই অ্যান্টোনিন নিকোলভের অ্যাপার্টমেন্ট।

জীর্ণ এক বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে লেংচে লেংচে চারতলায় উঠল ফাদিল। মার খাওয়া জায়গার ব্যথায় মাঝে মাঝে কাতরে উঠছে। একটা দরজার তালা খুলে ভেতরে ঠেলে সরাল করাট। তার অ্যাপার্টমেন্টের তুলনায় নিকোলভেরটা রীতিমত রাজসিক। বদ্ধ এই দু’ঘরের ফ্ল্যাটে গাঁজার ধোঁয়ার কুবাস আর ঘামের দুর্গন্ধ।

বাড়তি ঘরে জড় করেছে লুঠের মাল। বাক্সের পর বাক্স চোরাই জিনিসপত্র। মেঝেতে তিন সেন্টিমিটার পুরু ধুলো।

‘আপনার কী চাই? টিভি? ভিডিয়ো?’ বিড়বিড় করল ফাদিল। দেখাল ইকুইপমেণ্ট ভরা ক্রেট। ‘দিতে পারি পঞ্চাশ ইঞ্চির প্যানাসনিক টিভি। প্রায় নতুন। আরও অনেক কিছু আছে। সব আপনার জন্যেই তো, বড় ভাই!’

‘অ্যান্টোনিনের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে যা যা এনেছ, সব বের করো।’

রানার নির্দেশে দুটো বাক্স সরাল ফাদিল। আঙুল তাক করে দেখাল ছোট এক ক্রেট। বদমেজাজি যুবকের ধমক খেয়ে পিছিয়ে গেল সে। অবাক হয়ে দেখল, আবর্জনার ভেতর কী যেন খুঁজছে লোকটা! এবার ফাদিল পরিষ্কার বুঝল, আসলেই বদ্ধ উন্মাদ এই বাদামি যুবক।

‘আপনি তা হলে বোধহয় ওই লোকের বন্ধু?’ বলল ফাদিল। ‘বুঝেছি। সব ফেরত দেব। এমনিতেই বিক্রির মত কিছুই ছিল না। ওই যে, ওখানে তার ডিভিডি মেশিন। একদম ধচাপচা। একদম নতুন একটা দেব। সঙ্গে একগাদা পর্নো ছবি। তা হলে চলবে তো?’

‘অ্যাই, একদম চুপ!’ ধমক দিল রানা। কয়েক মুহূর্ত পর সোজা হয়ে দাঁড়াল। হাতে প্লাস্টিকের ছোট ব্যাগ। ওটার ভেতর হালকা গোলাপি ছোট্ট, অকেজো নোকিয়া সেল ফোন।

ছোট মাপের চোর হলেও নাক বাঁকা করল ফাদিল ‘আপনি ওটার জন্যে এসেছেন, ভাই? আপনি তো দেখছি আমার চেয়েও গরিব! ওই ফোন মেরামত করতে গেছিলাম, মেকানিক বলেছে, ওটা বাতিল মাল।’

প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে যন্ত্রটা নিয়ে মন দিয়ে দেখল রানা। আঠা দিয়ে প্লাস্টিকের কেসিং ঠিক করতে চেয়েছে তিন চোর। তারপর টের পেয়েছে, সব টুকরো নেই। বাঁকা হয়েছে যন্ত্রের চেসিস ও কি-প্যাড। তিন জায়গায় ফেটেছে স্ক্রিন। নষ্ট হয়ে গেছে পাওয়ার বাটন। প্লাস্টিকের ব্যাগে সব রাখল রানা। ব্যাগটা গেল প্যান্টের পকেটে।

নিজের সৌভাগ্য দেখে হতবাক ফাদিল। বাদামি শালা ট্রাক এনে ঘরের সব নিয়ে গেলেও কিছুই করতে পারত না সে। অথচ বিদেশি পাগলা নিয়েছে অকেজো একটা সেল ফোন। বেধড়ক মার খেয়েও চওড়া হাসি দিল ফাদিল। ভুলে গেছে লেনিন বার-এর বাইরে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে দুই ভাই। রানাকে বলল, ‘যা চেয়েছেন, সবই তো পেলেন। এবার আমাকে ছেড়ে দিন।’

এবারের মত,’ বলল রানা। ‘কিন্তু মাথার ভেতর একটা কথা গুঁজে নাও। চুরির দিন শেষ। এখন থেকে তোমার ওপর চোখ রাখব আমরা। আবারও চুরি করে বেড়াচ্ছ দেখলে হাজির হবে আমার বন্ধুরা। ওরা আবার আমার মত নরম মনের মানুষ নয়। একটা একটা করে হাড় তো ভাঙবেই, তার আগে ভোঁতা ছুরি দিয়ে তোমাকে খাসি করে দেবে। কাজেই… হুঁ-হুঁ-হা-হা-হা-হা! বোঝা গেছে?’ নিষ্ঠুর হাসি হাসল রানা।

ঠোঁট থেকে আনন্দের হাসি উধাও হয়েছে ফাদিলের। মাথা নিচু করে বিড়বিড় করল, ‘ঠিক আছে। আপনি হচ্ছেন বস্!’

বদ্ধ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরোল রানা ও তানিয়া। নিচে নেমে রাস্তায় পড়ার পর দুষ্টু হাসল মেয়েটা। ‘এটা বলতে বাধ্য হচ্ছি, মেজর, আপনার পদ্ধতি বড় অদ্ভুত। তবে কাজ হয়। আর ওই খাসি করার ব্যাপারটা… আমার ওসব নেই, তবু জিভ শুকিয়ে এসেছিল।’

‘ভাঙা ফোন ছাড়া কিছুই পাইনি,’ মৃদু হেসে বলল রানা, ‘ওটা থেকে কিছু পাব কি না, জানি না। আর ফাদিলের কথা ভেবে লাভ নেই। বড়জোর একসপ্তাহ, তারপর আবারও বেরোবে চুরি করতে।’

‘মনে হয় না।’ মাথা নাড়ল তানিয়া। ‘রাশান যুবকরা নপুংসক হতে ভীষণ ভয় পায়।’

‘ওই ব্যাপারে শুধু ওদেরকে দোষ দিয়ে লাভ নেই,’ উদাস হয়ে গেল রানা। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘বার-এর সামনে সাহায্য করেছ। সেজন্যে তোমাকে ধন্যবাদ দেয়া হয়নি। এখন দিচ্ছি: থ্যাঙ্ক ইউ। অনায়াসে বারম্যানের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিলে। কোথায় শিখলে ওই কৌশল?’

কাঁধ ঝাঁকাল তানিয়া। ‘জীবনে চলার পথে।’

‘জানতাম না তুমি এত গুণী মেয়ে,’ বলল রানা। হাঁটার গতি বাড়ল ওর। ‘এবার ফিরব হোটেলে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *