এক্স এজেন্ট – ৩৫

৩৫

নাক কুঁচকে ফেলল বেযুখফ। ‘একমিনিট! ওরা কী করে জানল যে…

‘আমি খামারে আছি?’ কথাটা শেষ করল রানা। ‘ভাল প্রশ্ন।’ বুঝে গেছে, কেন খামারে হাজির হয়েছিল বিশজনেরও বেশি প্রাক্তন সৈনিক। কিন্তু এটা অস্পষ্ট, শত্রুপক্ষ জানল কী করে যে ওখানে আছে ওরা? কড়া চোখে রাশান সৈনিককে দেখল রানা। ‘জানলে কী করে?’

‘যা জানি, সবই বলেছি,’ কাঁপা গলায় বলল লোকটা। কাবাবওয়ালার দিকে চেয়েও নিচু করে নিল চোখ।

তাকে অবিশ্বাস করছে না রানা। উঠে দাঁড়াতেই জানতে চাইল বেযুখফ, ‘কোথায় চললে?’

‘ছোরায় ধার দিতে,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা। ‘ফিরে না আসা পর্যন্ত এর ওপর চোখ রাখবে।’ কিছু হিসাব মেলাতে হবে, সেজন্যে সময় চাই। নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে মনে। ঘর থেকে বেরিয়ে বুক ভরে ভোরের তাজা হাওয়া নিল রানা। গাছে কিচিরমিচির করছে এক ঝাঁক পাখি। অদ্ভুত চিন্তা এল ওর মনে: এটা কি হতে পারে যে শত্রুপক্ষ জানে এখানে কী ঘটছে?

যা খুশি ভেবেছে বলে নিজেকে বোকা গাধা মনে হলো রানার। খামার ঘুরে দেখতে বেরোল। বড় কুটিরের পাশে ছোট কয়েকটা কুঁড়ে ঘর। ভেতরে কাজে লাগবে এমন সব পুরনো যন্ত্রপাতি। সব জং ধরা। খড়ের স্তূপে বাড়ি তৈরি করেছে একপাল ইঁদুর। বেশ কয়েকটা বস্তায় ছিল গবাদি পশুর শুকনো খাবার। সবই সাবড়ে দিয়েছে। খোঁয়াড়ে জন্মেছে দীর্ঘ ঘাস ও ঝোপঝাড়। প্রায় ধসে পড়া শস্যাগারে ঢুকবে না ভাবল রানা। ভাবছে এবার ফিরবে ঘরে, এমন সময় চোখ পড়ল পাশের ছাউনির ওপর। ওখানে নানান যন্ত্রপাতির ভেতর দেখল প্লাস্টিকের তারপুলিন দিয়ে ঢাকা কী যেন। আকৃতিটা ওর পরিচিত।

ছাউনির ভেতর ঢুকল রানা। তারপুলিন সরাতেই দেখল থম মেরে বসে আছে পিতরের ভ্যায স্টেশন ওয়্যাগন। এতই পুরনো, বলা চলে প্রায় বুড়োর বয়সী। চালু হবে না ওই গাড়ি, ভাবল রানা। তবে কয়েকবার আপত্তির পর থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে চালু হয়ে গেল ইঞ্জিন। অবশ্য গাড়ি নিয়ে কোথাও যেতে পারবে না ওরা। ফুটো একটা চাকা লেপ্টে আছে মাটিতে।

বাতাস ভরা একটা চাকা রিমে বসাতে গিয়ে মনের ভেতর নানাদিক উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল রানা। একটা কথা বারবার ফিরছে মনে। পিছু নিয়ে বেযুখফের খামারে কীভাবে এল প্রাক্তন সৈনিকরা! আরেকটা কথা খচ খচ করছে মনে শত্রুর কবল থেকে কীভাবে উদ্ধার করবে ইউনাকে? ওদিকে জটিল হয়ে উঠেছে তানিয়ার বিষয়টা। এত শক পেয়েছে, প্রায় বোবা হয়ে গেছে মেয়েটা।

রাশায় আসার পর কয়েকবার তানিয়ার কাজ ভাল লেগেছিল ওর। প্রথমে দু’জনের ভেতর ছিল শীতল সম্পর্ক। তবে পরে গলতে থাকে সেই বরফ। আর সে কারণেই হয়তো ওর চোখে পড়েনি কোনও অস্বাভাবিকতা।

লুকা ব্রেযনেভ মস্ত বড়লোক। সেরা ডিটেকটিভকে ভাড়া করেছেন। তবে রানার মনে হয়েছে, তানিয়া যথেষ্ট পেশাদার নয়। নিকোলভের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সূত্র সংগ্রহ করার পর, সে বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি সে। শুধু তা-ই নয়, অ্যাপার্টমেন্টের কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞাসাবাদের সময়েও প্রায় চুপই থেকেছে। রানার মনে হয়েছে, ও কাজ করছে কাঁচা এক গোয়েন্দার সঙ্গে।

অথচ, কিছু বিষয়ে তানিয়ার তুলনা হয় না। হাতাহাতি মারপিটে অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার বা মিলিটারির অনেকের চেয়ে দক্ষ সে। তারপর বেযুখফের খামারের কাছে পৌঁছুবার পর গোপনে ওর পেছনে এসে থেমেছিল। ওই ক্ষমতা অস্বাভাবিক মনে হয়েছে রানার। সাধারণ গোয়েন্দাদের ওই ধরনের দক্ষতা থাকে না। তানিয়া যেন ট্রেইনিং নিয়েছে কমাণ্ডো হিসেবে। কথাও বলে মিলিটারি অফিসারের ধাঁচে। ক’বার মুখ ফস্কে রানাকে বলেছে: মেজর কমরেড।

তার ওপর, গতকাল অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে তার ভেতর। বেযুখফের খামারবাড়িতে ঢোকার পর রানা খেয়াল করেছে, ক্রমেই চুপ হয়ে গেছে সে। এখন মনে হচ্ছে, ভয়ানক কোনও ট্রমার ভেতর আছে মেয়েটা। অথচ, প্রায় অক্ষত অবস্থায় বড় কোনও ঝামেলা ছাড়াই জঙ্গলের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল ও। কীভাবে পালিয়ে এসেছে, তা নিয়ে প্রায় কোনও কথাই বলেনি। গোটা ব্যাপারটা রয়ে গেছে আবছা বা ঘোলাটে।

চুপচাপ কাজ করতে করতে রানা ভাবল, কতটা চিনি তানিয়া আজোরভকে?

ওর মন বলছে, কোথাও যেন আছে বড় ধরনের কিছু গোলমাল।

শেষ নাট লাগাবার পর পুরনো এক ন্যাকড়ায় নোংরা হাত মুছল রানা। পকেট থেকে নিল স্মার্ট ফোন। কুটির থেকে দু’শ’ গজ যাওয়ার পর পেল মাঝারি রিসেপশন। ফ্রান্সের প্রত্যন্ত এলাকা হলে ফোনের সিগনাল থাকত না। সত্যিই টেকনোলজির দিক গিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে রাশা। দ্রুত ইন্টারনেট সার্চ করল রানা। জেনে নিল তানিয়ার ডিটেকটিভ এজেন্সির ঠিকানা। মেয়েটার নাম ব্যবহার করল কি-ওঅর্ড হিসেবে। সময় লাগল না মস্কো ডিটেকটিভ এজেন্সির সাইট পেতে। রাশান ও ইংরেজিতে লিখিত পেজ। সাইড মেনু ট্যাব থেকে রানা পেল এজেন্সির ছয় পার্টনারের নাম। তাদের ভেতর রয়েছে তানিয়া আজোরভ। আরও জানার জন্যে মেয়েটার নামের ওপর ক্লিক দিল রানা।

স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে ফুটল তানিয়ার আজোরভের সংক্ষিপ্ত বায়োডেটা ও ছবি। পরনে বিযনেস সুট। চুল কুচকুচে কালো। এজেন্সির দ্বিতীয় পুরনো পার্টনার সে। নিচে অভিজ্ঞতার বিশদ বর্ণনা। সাধে তাকে কাজে নেননি ব্রেযনেভ। দেশের সেরা সে।

কিন্তু সমস্যা অন্যখানে।

ছবিটা রানার চেনা তানিয়া আজোরভের নয়!

ছবির মহিলার বয়স কমপক্ষে চল্লিশ।

নকল তানিয়ার চেয়ে ওজনে সে অন্তত বিশ পাউণ্ড বেশি।

আরও কয়েক সেকেণ্ড ছবিটা দেখল রানা। ভাবছে, তা হলে যার সঙ্গে এখানে এলাম, সে কে?

বড় একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়াল রানা। কয়েকবার বড় করে শ্বাস নিয়ে চট্ করে দেখল হাতঘড়ি। মস্কোয় এখন অফিস খোলার কথা নয়। কিন্তু এজেন্সির সাইটে রয়েছে মোবাইল ফোনের কন্ট্যাক্ট নাম্বার। হয়তো ভোরেও ওই অফিসে থাকে কেউ। ওই নাম্বারে ডায়াল করল রানা। চারবার রিং হওয়ার পর ওদিক থেকে কর্কশ স্বরে বলল এক বয়স্ক লোক, ‘জী, বলুন?’

‘এত ভোরে ফোন করেছি বলে দুঃখিত,’ বলল রানা। ‘আমি জরুরি ভিত্তিতে তানিয়া আজোরভের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

‘দুঃখিত,’ হঠাৎ করেই বিমর্ষ হলো লোকটার কণ্ঠ। ‘কী বিষয়ে কথা বলতে চান, সেটা কি বলা যাবে?’

‘খুবই গোপনীয়,’ বলল রানা, ‘এবং খুব জরুরি।’

‘তানিয়া আজোরভ আর আমাদের সঙ্গে নেই,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল লোকটা।

‘ও। অন্য এজেন্সিতে যোগ দিয়েছেন?’ কু ডাকছে রানার মন। ‘তা হলে কি তাঁর ফোন নাম্বারটা দিতে পারেন?’

‘না, আসলে বলতে চাইছি, পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন তানিয়া আজোরভ,’ একটু জোর দিয়ে বলল লোকটা। ‘কয়েকদিন আগের কথা। খুবই দুঃখজনক। উনি… উনি আসলে… আমরা সবাই…’ কয়েক মুহূর্ত পর বলল সে, ‘এই কারণে পুরো সপ্তাহ বন্ধ ছিল অফিস।’

শিরশির করে উঠল রানার মেরুদণ্ড। নরম সুরে জিজ্ঞেস করল ও, ‘কী হয়েছিল?’

‘কেউ জানে না। পোলিতসিয়া এখনও কোনও স্টেটমেন্ট দেয়নি। তানিয়াকে পাওয়া যায় তাঁর বাড়িতেই। হয়তো চুরি ঠেকাতে গিয়েছিলেন। বা লোকটা হয়তো ছিল বদ্ধ উন্মাদ।’ আরও বিমর্ষ হলো লোকটার কণ্ঠ: ‘বলতে খারাপ লাগছে যে তানিয়া আজ আমাদের মাঝে নেই। আমরা সবাই ওঁকে ভালবাসতাম। যা ঘটে গেছে, সেটা এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। আমরা এতই ভেঙে পড়েছি যে এখনও ওয়েবসাইটে আপডেট দিইনি।’

তানিয়া আজোরভের এই আকস্মিক মৃত্যুর জন্যে দুঃখপ্রকাশ করল রানা। সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ দিল লোকটাকে, তারপর কেটে দিল কল। পুরো তিন মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল ও। রাগে শিরার ভেতর দিয়ে গরম তেলের মত ফুটছে ওর রক্ত।

দ্রুত পায়ে চলল বড় কুটিরের দিকে।

৩৬

এখনও আর্মচেয়ারে বসে আছে নকল তানিয়া। ছুঁয়েও দেখেনি স্টু। ওটা সড়াৎ-সড়াৎ করে চেটে খাচ্ছে টোমা। জানালা থেকে চোখ সরিয়ে এখন বেযুখফের দিকে চেয়ে আছে মেয়েটা।

ঘরের চারপাশ দেখে নিল রানা। এককোণে কাত হয়ে শুয়ে আছে নিকোলভ। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। নিজেও আগের জায়গায় চুপ করে বসে আছে বেযুখফ। হাত-পা বাঁধা বলে পাথরের মূর্তির মত থম মেরেছে প্রাক্তন সৈনিক।

‘ওই যে, ফিরেছে কাবাবওয়ালা,’ বিরক্তি নিয়ে বলল বেযুখফ।

টু শব্দ না করে তার কোলে স্মার্ট ফোন ফেলল রানা। কেটে গেছে ইণ্টারনেট কানেকশন। তবে স্ক্রিনে রয়েছে ডিটেকটিভ এজেন্সির ওয়েবপেজ। ওপরে তানিয়া আজোরভের ছবি ও বায়োডেটা। ফোনটা নিয়ে ছবি দেখল বেযুখফ। কয়েক সেকেণ্ড পর মুখ তুলে তাকাল রানার চোখে। ‘আমিও তা-ই ভেবেছি!’

নড়ে উঠে জেগে গেল নিকোলভ। ‘অ্যা? কী হয়েছে?’

আর্মচেয়ারের পাশে পৌছে খপ করে নকল তানিয়ার বাহু ধরল রানা। ঝাঁকি দিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল তাকে। মেয়েটার চোখ কেমন যেন ঘোলা। তার নাক-চোখের সামনে তর্জনী নাচাল রানা। প্রায় যোম্বির মত বসে আছে মেয়েটা। কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।

‘সর্বনাশ!’ বিড়বিড় করল বেযুখফ। ‘একদৃষ্টে চেয়ে আছে বলে ভেবেছি আমার প্রেমে পড়েছে বুঝি!’

‘কী হয়েছে?’ জানতে চাইল নিকোলভ। পা সোজা করে বসতে গিয়ে ব্যথায় কুঁচকে গেল গাল। আস্তে করে বন্ধুর দিকে মোবাইল ফোন ছুঁড়ল বেযুখফ। খপ্ করে ওটা নিল নিকোলভ। দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত ছবি দেখল। চট্ করে পড়ে নিল লেখাগুলো। হতবাক হয়ে গেছে। একবার তাকাল নীরব রাশান সৈনিকের দিকে।

‘এই মেয়ে ওদের দলের,’ বলল বেযুখফ।

‘দলটা কীসের?’ জানতে চাইল রানা।

‘প্রথম থেকেই সন্দেহ করেছি,’ জানাল বেযুখফ।

‘তা-ই?’ বন্ধুকেও যেন বিশ্বাস করছে না নিকোলভ।

‘হ্যাঁ, প্রথম থেকেই।’ রানার দিকে তাকাল বেযুখফ। ‘সব দোষ তোমার, রানা! কুত্তীটাকে এনেছ আমার এখানে!’ কড়া চোখে রানা তাকিয়ে আছে দেখে মুখ বুজে ফেলল সে।

এইমাত্র নকল তানিয়ার বাসন চেটে সাফ করেছে টোমা। আর কিছু নেই দেখে ঘরের কোণে গিয়ে শুয়ে পড়ল। কুকুরের কী ঠেকা পড়েছে, মানুষের জটিল সমস্যা নিয়ে ভাববে!

নিচু হয়ে মেয়েটার চোখে চোখ রাখল রানা। ‘মস্কো ডিটেকটিভ এজেন্সির তানিয়া আজোরভ মারা গেছে। আমি জানতে চাই, তুমি কে এবং কার হয়ে কাজ করছ। জবাবটা তোমাকে এখনই দিতে হবে।’

চুপ করে থাকল মেয়েটা। নির্বিকার চেহারা। যেন শ্বাসও নিচ্ছে না। যে-কেউ ধরে নিতে পারে, মারা গেছে সে। কষে তার গালে চড় দিল রানা। কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।

‘আমার কথা বোঝার চেষ্টা করো। তোমাকে মুখ খুলতে হবে। নইলে পড়বে প্রচণ্ড নির্যাতনের মুখে। তুমি মেয়ে বলে ছাড় পাবে না।’

আগ্রহ নিয়ে রানা ও মেয়েটাকে দেখছে প্রাক্তন সৈনিক। সুন্দরী মেয়েটার রক্তপাত হলে ক্ষতি নেই তার। কাবাবওয়ালা তার দিকে না এলেই হলো।

কাবাবওয়ালার গল্পের মতই মিথ্যা হুমকি দিচ্ছে রানা। তবে তা জানার কথা নয় এই মেয়ের। কয়েক মুহূর্ত পর রানা বুঝল, কোনও দিকেই হুঁশ নেই তার।

বেল্ট থেকে পিস্তল নিয়ে মেয়েটার কানের নিচে নরম অংশে মাযল ঠেকাল রানা। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘মুখ খোলার জন্যে মাত্র তিন সেকেণ্ড পাবে। এক…

নিথর বসে আছে মেয়েটা। কোনও সাড়া নেই।

‘দুই…’. রানা বুঝে গেছে, তিন বলার পর ধরা পড়বে ওর মিথ্যাচার। অথবা, সত্যিই নির্যাতনের জন্যে নিতে হবে মানসিক প্রস্তুতি।

‘তিন,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা। পরের সেকেণ্ডে টিপে দিল ট্রিগার।

ছোট্ট ঘরে বিকট আওয়াজ তুলল পিস্তল। ভীষণভাবে চমকে গেল নিকোলভ, বেযুখফ ও প্রাক্তন সৈনিক। ঘরের কোণে শরীর গুঁজে দিল টোমা। মাথার এক ইঞ্চি ওপর দিয়ে বুলেট গেলেও নির্বিকার বসে আছে মেয়েটা। ছাত ভেদ করে বেরিয়ে গেছে বুলেট। শনের চাপড়া থেকে ঝরঝর করে নিচে ঝরল ধুলোবালি।

বিড়বিড় করে রাশান গালি বকে চলেছে বেযুখফ। হাঁ হয়ে গেছে নিকোলভ। কয়েক সেকেণ্ড পর আঙুল তাক করে মেয়েটাকে দেখাল। ‘এটা খুব অস্বাভাবিক। ঘোরের ভেতর আছে।’

গুলি করে মেয়েটার পা ফুটো করলেও লাভ হবে বলে মনে হলো না রানার। সেক্ষেত্রে রক্তপাতের কারণে মরবে নকল তানিয়া। জোর গলায় জানতে চাইল রানা, ‘আসলে তুমি কে?’

নিস্পৃহ নীল চোখে রানাকে দেখল মেয়েটা। পেরিয়ে গেল কয়েক মুহূর্ত। তারপর হঠাৎই উল্টে গেল তার দুই চোখের মণি। সাদা অংশ ছাড়া আর কিছুই নেই। আস্তে করে আর্মচেয়ারে লাশের মত কাত হয়ে পড়ল মেয়েটা।

‘হলোটা কী?’ অবাক স্বরে বলল বেযুখফ।

নকল তানিয়ার পাল্স্ দেখল রানা। স্পন্দন স্বাভাবিক। শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়মিত। ত্বক উষ্ণ। শারীরিকভাবে সে ঠিক থাকলেও অদ্ভুত কোনও কারণে চলে গেছে ক্যাটাটনিক স্টেট- এ। আগে কখনও এ ধরনের কিছু দেখেনি রানা।

‘গুলি করে মেরে ফেললে?’ রানাকে বলল নিকোলভ। ‘বোকার মত কথা বোলো না। বুলেট গেছে এক মাইল দূর দিয়ে।’

ঘন ঘন মাথা নাড়ল বেযুখফ। ‘তোমরা বুঝছ না। অন্য কিছু হয়েছে মেয়েটার।’

‘নিশ্চয়ই অভিনয় করছে,’ বলল নিকোলভ। ব্যথা সহ্য করে একটু দূরের বাসন থেকে কাঁটা চামচ নিল সে। ওটা দিয়ে খোঁচা দিল মেয়েটার উরুতে। প্রতিক্রিয়া নেই নকল তানিয়ার। এবার তার বাহুতে কাঁটা বেঁধাল নিকোলভ। ত্বক ফুটো হওয়ায় রক্তে ভরে গেল ছোট সব গর্ত। চেয়ারে কাত হয়ে পড়ে আছে মেয়েটা

এটা যদি অচেতন হওয়ার ভান হয়, তো বলতে হবে সে দুনিয়ার সেরা অভিনেত্রী!

‘তুমি নিজে চেষ্টা করে দেখো,’ রানার দিকে কাঁটা চামচ বাড়িয়ে দিল নিকোলভ।

‘কাঁটা চামচ দিয়ে কী করব?’ জানতে চাইল রানা।

‘জানি না। হয়তো… চোখ উপড়ে নিতে পারো।’

প্রথম ধাপ্পা হিসেবে রাশান সৈনিকের দিকে পিস্তল তাক করল রানা। ‘কথা শুনছ, তানিয়া? অভিনয় বাদ দাও। নইলে গুলি করে কপাল ফুটো করব তোমার কমরেডের।’

পিছিয়ে যেতে চাইল প্রাক্তন সৈনিক। পিঠ ঠেকল দেয়ালে। কয়েক পা গিয়ে লোকটার কপালে পিস্তল ঠেকাল রানা। ‘শুনছ, তানিয়া? তোমার কারণে খুন হচ্ছে নিরস্ত্র এক বন্দি। বিবেকের কাছে কী জবাব দেবে?’

আর্মচেয়ারে পড়ে থাকল মেয়েটা। খাঁচায় বন্দি ভীত বাঁদরের মত সরতে চাইছে প্রাক্তন সৈনিক। পিস্তলের বাঁট দিয়ে তার মাথায় মাঝারি গুঁতো দিতেই জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ল সে। রানার ধাপ্পা দেয়ার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ।

‘ভান করছে না, রানা,’ বলল বেযুখফ। ‘ঘোরের ভেতর চলে গেছে। কোনওভাবেই একে সচেতন করতে পারবে না।’

পায়ের ব্যথা ভুলেছে নিকোলভ। আস্তে করে মাথা নাড়ল। ‘আসলে কী হচ্ছে?’

‘রেডিয়ো ব্যবহার করে ওই মেয়েকে বশ করেছে,’ বলল বেথুখফ, ‘আর কিছু না।’

গম্ভীর চেহারায় তাকে দেখল রানা।

দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দিল বেযুখফ। ‘ব্যাখ্যা হিসেবে শুধু এটা বলব: ওই মেয়ের মাথায় আছে বিশেষ একটা চিপ। ঠিক যেমন রাখা হয়েছিল অ্যালেক্স বার্টোসের মগজে। এমন হাজার মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবী জুড়ে। অথচ, তারা নিজেরাও জানে না যে একটা সুইচ টিপে দিলেই সে হবে স্রেফ একটা রোবট।’

মাথা নাড়ল বেযুখফ। ‘এ ছাড়া আর কোনও ব্যাখ্যা নেই। নিজ চোখে দেখছ মেয়েটাকে। জঙ্গলে ঢোকার সময়েই ছিল অর্ধেক বিবশ। জানেও না কোথায় আছে। ওরা ইচ্ছে করলে একেবারে মেরেও ফেলতে পারে। মগজের সুইচ এমনই। যতই জিজ্ঞাসাবাদ করো, ওর পেট থেকে কিছুই বের করতে পারবে না। মন বলে আর কিছুই নেই ওর। এখন যদি এমআরআই স্ক্যান করো, দেখবে মগজের বড় এক অংশ হয়ে গেছে নর্থ কোরিয়ার রাতের আকাশের মত অন্ধকার।’

সুস্থ এক মেয়ের হঠাৎ এমন হয়েছে শুনলে বিশ্বাস করত না রানা। এখন নিজ চোখে দেখছে সব। বুঝতে পারছে, গতরাতে এবং একটু আগে যা বলেছে বেযুখফ, প্রতিটি কথা সত্য। রানা বুঝে গেল, ভয়ঙ্কর শক্তিশালী একদল মানুষের বিরুদ্ধে লড়তে হবে ওকে। সম্ভবত একা। চারদিকে চোখ রেখেছে তারা। অ্যান্টোনিন নিকোলভ় পালিয়ে যেতেই নেমে পড়েছে কাজে। লুকা ব্রেনেভ মস্কো ডিটেকটিভ এজেন্সিতে যোগাযোগ করার পরই মেরে ফেলা হয়েছে আসল তানিয়া আজোরভকে। তার বদলে প্রক্সি দিচ্ছে এই মেয়ে।

যেন রানার মন পড়ছে নিকোলভ। নরম সুরে জিজ্ঞেস করল সে, ‘আসল তানিয়া আজোরভের কী হয়েছিল?’ ..

‘খুন হয়েছে,’ শুকনো গলায় বলল রানা। ‘পুলিশ ভাবছে ডাকাতের গুলিতে মারা গেছে। অথবা খুন করেছে কোনও সাইকো।’

‘এখন নিশ্চয়ই বুঝছ, ওই মহিলার বদলে অভিনয়ের জন্যে পাঠানো হয়েছে এই কুত্তীকে,’ বলল বেযুখফ। ‘একে বলতে পারো রিমোট কন্ট্রোল্ড স্পাই। এর কাজ হচ্ছে কোনও প্রমাণ ফাঁস হওয়ার আগেই এস. এম. ৬১৪৩ ডিভাইস সরিয়ে ফেলা।’

‘তা হলে ঠিক সময়ে পিস্তল বের করল না কেন?’ জানতে চাইল নিকোলভ। ‘সুযোগ তো পেয়েছে।’

কাঁধ ঝাঁকাল বেযুখফ। ‘জানি না। হয়তো অপেক্ষা করছিল ঠিক সময়ের জন্যে। তবে পরে আর সুযোগ করে উঠতে পারেনি।’

‘তো এবার কী করব আমরা?’ জানতে চাইল নিকোলভ।

জবাব দিল না সবজান্তা বেযুখফ। কয়েক সেকেণ্ড পর হামাগুড়ি দিয়ে চার হাত-পায়ে ভর করে মেয়েটার সামনে পৌঁছে গেল। তর্জনী দিয়ে খোঁচা দিল নকল তানিয়ার পেটে। ‘না, এক ফোঁটা সাড় নেই।’ খসখস করে মাথা চুলকে নিল সে। ‘একটা কথা ভাবছি।’

‘বলে ফেলো,’ বলল রানা।

‘কেমন হয় ওর মাথাটা কেটে ডিভাইস বের করলে?’ কোঁচকানো প্যান্টের পকেট থেকে পেন নাইফ বের করল বেযুখফ। খুলল জং ধরা ফলা। ওটা দেখতে অনেকটা স্ক্যালপেলের মত। ‘নাক দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাই মনে হচ্ছে, নাক কেটে কপালের কাছে ফলাটা নিলেই ওটা পেয়ে যাব।’

বন্ধু পাগল, সে দৃষ্টিতে বেযুখফের দিকে তাকাল নিকোলভ। ‘অপারেশন করবে তুমি?’

‘আরও দু’চারটে যন্ত্র লাগবে,’ বলল বেযুখফ। ‘বুড়ো পিতরের কাছে নিশ্চয়ই করাত আর ড্রিল মেশিন ছিল।’

‘তুমি ডাক্তার নও,’ আপত্তি তুলল নিকোলভ। ‘তুমি তো খুন করবে মেয়েটাকে!’

‘মরলেই বা কী? এমনিতেই তো তার জীবন শেষ! ‘

‘ছুরিটা সরিয়ে রাখো,’ কঠোর সুরে বলল রানা। ‘ওটা দিয়ে তোমার পেছনদিকে খোঁচালে তুমি খুব অখুশি হবে।’

হতাশ হওয়ায় কাঁধ ঝুলে গেল বেযুখফের। ‘সহজ একটা ব্যাপার বুঝতে পারছ না? আমরা পেয়ে যাব নতুন টেকনোলজির ডিভাইসটা। আর একবার দুটো ডিভাইস পাশাপাশি রেখে ছবি তুললে দুনিয়াকে দেখাতে পারব এরা আসলে কী করছে।’

করুণ চোখে বন্ধুকে দেখল নিকোলভ। ‘তাতভ, পুরনো ডিভাইসটা আর আমার কাছে নেই।’

অবাক হয়ে তাকে দেখল বেযুখফ। ‘কী বললে? হারিয়ে ফেলেছ?’

‘না, লুকিয়ে ফেলেছি। বাদ পড়েনি মাইক্রোফিল্ম আর ফ্ল্যাশ ড্রাইভ। কাজটা করেছি ট্রেইলার থেকে এদিকে আসার সময়।’

‘জঙ্গলে?’ ঝট্ করে জানালার দিকে তাকাল বেযুখফ। তার ভাব দেখে রানার মনে হলো, দৌড়ে গিয়ে ঢুকবে জঙ্গলে।

‘কাউকে বলব না কোথায় কাজটা করেছি। কেউ খুঁজে পাবে না। এমন কী তুমিও না, তাতভ।’

রাগে বেগুনী হলো রেডিয়ো স্টেশনের মালিক। ‘তুমি কি পাগল হলে, অ্যান্টোনিন? ওটা আমাদের একমাত্র সলিড প্রমাণ! ওটার জন্যে নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছ!’

‘ওদের হাতে ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে ডিভাইসটা কেড়ে নেবে,’ বলল নিকোলভ। ‘বদলে মগজে গেঁথে দেবে বুলেট। কিন্তু আমাকে বাঁচতে হবে ইউনার জন্যে। ও ছাড়া আমার আর কেউ নেই।’

এতই রেগেছে, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল তাতভ বেযুখভ। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘আসলে নিজের দোষেই সব হারিয়ে বসলে, নিকোলভ। হাতে কোনও প্রমাণ থাকল না। অথচ ভেবেছিলাম দু’জন মিলে লড়ব জানোয়ারগুলোর বিরুদ্ধে।’

নিচু গলায় বলল নিকোলভ, ‘ইউনাই ছিল আমার সব, ওকে যখন হারিয়ে বসেছি, প্রাণে বেঁচেই বা লাভ কী আমার?’

‘হায়, যিশু,’ মেঝেতে থুতু ফেলল তাতভ। ‘আসল দিকটাই চোখে পড়েনি তোমার! প্রমাণ হিসেবে খুব দরকারি ছিল ওই ডিভাইস। ওরা নিয়ে গেছে তোমার মেয়েকে। এবার আর কখনও ওকে দেখতে পাবে না। ‘

রানার দিকে তাকাল নিকোলভ। ‘রানা কথা দিয়েছে, ইউনাকে ফিরিয়ে আনবে। আমি ওকে বিশ্বাস করি।’

‘তো হঠাৎ করে কোথা থেকে এল. এত বিশ্বাস?’ ঝগড়াটে সুরে বলল বেযুখফ।

‘তা জানি না,’ অকপটে স্বীকার করল নিকোলভ।

‘তুমি পাগল হয়েছ, অ্যান্টোনিন,’ বিড়বিড় করে গালি দিতে শুরু করেছে তাতভ। কয়েক মুহূর্ত পর ভারী গলায় বলল, ‘ভাবতে পারছি না তুমি ওই কাজ করেছ! এবার খুন হব আমরা। ভাল চাইলে বলো কোথায় লুকিয়ে রেখেছ!’

‘বলতে পারব না, তাতভ,’ বলল নিকোলভ, ‘সত্যিই দুঃখিত। ওরা আমাদেরকে ধরে ফেললে তোমার পেট থেকে সব বের করে নেবে। সেক্ষেত্রেও মরব আমরা।’

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল বেযুখফ। ‘তুমি সর্বনাশ করলে, অ্যান্টোনিন। সত্যিই এবার খুন হব আমরা। তবে তার আগে শেষ কামড় দেব ওদের বুকে। চাই না তোমার ডিভাইস। কুড়াল দিয়ে এক কোপে মাথা কেটে নেব এই হারামজাদীর। তা হলেই পেয়ে যাব নতুন ডিভাইস!’

ছোট্ট ছুরি হাতে নকল তানিয়ার দিকে ফিরল বেযুখফ। নিথর পড়ে আছে মেয়েটা। তবে মোটা লোকটা এগোবার আগেই তার বুকে পিস্তল তাক করল রানা। নিচু স্বরে বলল, ‘পিস্তলে এখনও সতেরোটা বুলেট আছে। তোমার জন্যে লাগবে বড়জোর একটা। আর এক পা এগোলেই খুন হবে তুমি।’

জায়গায় থমকে গেছে বেযুখফ। ‘ওই মেয়ের প্রেমে পড়েছ, রানা? পাগল হলে তোমরা?’ আবারও এক পা এগোল সে।

শেষবারের মত সতর্ক করছি, বেযুখফ,’ ভীষণ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা। ‘হাত থেকে ছুরিটা ফেলো।’

রানার হাতের গ্লক পিস্তলের মাযল চেয়ে আছে তাতভ বেযুখফের কপালের দিকে। এত কম রেঞ্জে বড়সড় মিষ্টি কুমড়োর সমান লাগছে মাথাটা। চোখ বুজেও গুলি করতে পারবে রানা। হলোপয়েন্ট বুলেট ফাটিয়ে দেবে করোটি। রানার তর্জনী চেপে বসল ট্রিগারে।

‘ভাঁওতা,’ বলল বেযুখফ। ‘এরই ভেতর দু’বার ধাপ্পা দিয়েছ। বুঝে গেছি, তুমি গুলি করবে না।’

‘বাড়াবাড়ি করলে মাথাটা উড়ে যাবে,’ সতর্ক করল রানা। বাধ্য হলে সত্যিই গুলি করবে। তবে চাইছে না কাজটা করতে। আরেকটু চেপে বসল ট্রিগারে তর্জনী।

ঠিক তখনই হাত ফসকে মেঝেতে পড়া পাকা তরমুজের মত বিস্ফোরিত হলো তাতভ বেযুখফের গোটা মাথা!

৩৭

রানার চোখের সামনে চার টুকরো হয়ে নানাদিকে ছিটকে গেছে তাতভ বেযুখফের মাথা। দু’পা পিছিয়ে গেল লাশ, তারপর ধড়াস্ করে পড়ল মেঝেতে। পেছনের দেয়ালে ছলাৎ করে ছিটকে লেগেছে তাজা রক্ত।

মুহূর্তে বরফের মূর্তির মত জমাট বেঁধে গেছে রানা। ওর পিস্তল থেকে বেরোয়নি বুলেট। যদি বেরোত, তাওঁ নাইন এমএম বুলেট কোনওভাবেই কারও মাথা উড়িয়ে দিতে পারত না। ওই গুলি যে হাই-পাওয়ার্ড রাইফেলের, সেটা বুঝতে পরমুহূর্তের অর্ধেকটা ব্যয় হলো রানার। ওর পেছনে জঙ্গল থেকে এসেছে স্নাইপারের গুলি। ধোঁয়া দূর করতে যে জানালা খুলেছিল রানা, সেটা গলে ওর কাঁধের ওপর দিয়ে গিয়ে বেযুখফের কপালে ঢুকেছে বুলেট।

এবার হঠাৎ করেই শুরু হলো গুলির পর গুলি। ঝাঁঝরা হলো জানালার চৌকাঠ ও দেয়াল। বেশ কয়েকটা গুলি বিধল মেঝেতে। একটা বুলেট বুকে নিয়ে কাত হয়ে পড়ল প্রাক্তন সৈনিক। আরেকটা গুলি লাগল মৃত বেযুখফের ঊরুতে। মাংস খুবলে ফাটিয়ে দিল হাড়। জায়গাটা থকথক করছে রক্তে।

আগেই মেঝেতে ঝাঁপ দিয়েছে রানা, নিকোলভকে নিয়ে হুড়মুড় করে পড়েছে আরেক দিকে। ওদিকটা দেখতে পাবে না স্নাইপার। ব্যথায় ও ভয়ে আঁতকে উঠেছে নিকোলভ। পাথরের দেয়ালের কোণে তাকে ঠেলল রানা। চট করে তাকাল জানালার দিকে। হঠাৎ থেমে গেছে গুলি। জঙ্গলে কয়েকজনকে দেখতে পেয়ে রানা বুঝে গেল, মাত্র শুরু হয়েছে হামলা।

আবারও ওদেরকে খুঁজে নিয়েছে শত্রুরা। কীভাবে তা পারল, বুঝতে দেরি হলো না রানার। চট করে দেখল নকল তানিয়াকে। টের পেল, এবার হাতে সময় পাবে না ওরা। খপ্ করে নিকোলভের কাঁধ ধরল রানা, লোকটাকে ঠেলল দরজার দিকে। একমাত্র ওদিক দিয়েই বেরোতে পারবে ওরা। কপাল ভাল হলে পৌঁছে যাবে ছাউনির তলায়। সেক্ষেত্রে বুড়ো পিতরের স্টেশন ওয়্যাগনে চেপে…

কিন্তু মাত্র দু’কদম টলমল করে এগিয়েই হাঁটু ভেঙে পড়ল নিকোলভ। কাঁধ জড়িয়ে ধরে এগোতে গিয়ে উবু হয়েছে রানা। সোজা হয়ে ঝট করে খুলে দিল দরজার কবাট। আরেকটু হলে হোঁচট খেত টোমার গায়ে। গুলির আওয়াজে ভীষণ ভয় পেয়েছে কুকুরটা। লাফিয়ে গিয়ে পড়ল বারান্দার পচা কাঠের সিঁড়ির ধাপে। ওখান থেকে তীরবেগে ছুটে গিয়ে ঢুকল জঙ্গলে। দূর থেকে এল ওটার তারস্বরের ঘেউ-ঘেউ।

জঙ্গলের চারপাশ থেকে আসছে কালো পোশাক পরা সশস্ত্র লোক। বাড়ি ঘিরে ফেলছে তারা। রানা বুঝে গেল, দিনের আলোয় কোনওদিকেই কাভার নিতে পারবে না। অস্ত্র বলতে মাত্র একটা পিস্তল!

নিকোলভকে দাঁড় করিয়ে বাম হাতে তাকে ধরে রাখল রানা। দুটো গুলি পাঠাল জঙ্গলের দিকে। তবে ওদিক থেকে এল অন্তত ত্ৰিশটা বুলেট। চুরমার হলো বারান্দার কাঠ। বাধ্য হয়ে আবারও পেছাল রানা ও নিকোলভ। দু’জনই বুঝে গেল, কোথাও পালাতে পারবে না ওরা। চারদিক থেকে আসছে অন্তত দশজন সৈনিক। একটু পর ঝাঁঝরা হবে ওরা।

লাথি মেরে দরজা বন্ধ করল রানা।

‘আমরা ফাঁদে পড়েছি!’ বেসুরো কণ্ঠে বলল নিকোলভ। ‘এবার খুন হব। কিছুই করার নেই।’

‘ওরা তোমাকে খুন করবে না,’ বলল রানা। ওর ধারণা, বেহুদা মরেছে তাতভ বেযুখফ। ওই গুলি ছিল ওকে শেষ করার জন্যে। এরপর নিশ্চয়ই সতর্ক করা হয়েছে স্নাইপারকে। অ্যান্টোনিন নিকোলভকে মারা যাবে না। এক্স এজেন্টের কাছেই থাকার কথা এস. এম. ৬১৪৩ ডিভাইস। ওটা চাই তাদের।

‘আর তোমাকে?’ জানতে চাইল নিকোলভ, ‘মেরে ফেলবে?’

‘একসময়ে তো বিদায় নিতেই হয়,’ বলল রানা। ‘কবে, কখন বা কীভাবে বিদায় নেব সেটাই দেখার বিষয়।’ পিস্তলে রয়েছে মাত্র পনেরোটা বুলেট। রানা ঠিক করেছে, চেষ্টা করবে অন্তত পনেরোজনকে পৃথিবী থেকে বিদায় করতে। সবসময় চেয়েছে: মৃত্যু যেন হয় রণক্ষেত্রে। সেটাই বোধহয় নিয়তি ওর।

শেষবারের মত লড়বে। খুব শান্ত হয়ে গেছে রানার মন। নরম সুরে বলল, ‘নিকোলভ, চুলোর ওদিকে যাও। ওটা লোহার তৈরি। ওখানে আড়াল নিলে গায়ে গুলি লাগবে না। একটু পর গুলি করতে করতে আসবে ওরা।’

‘তোমার পাশেই থাকব,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল নিকোলভ, ‘কাপুরুষ নই।

আস্তে করে মাথা নাড়ল রানা। খপ করে ধরল আহত লোকটার ডান বাহু, জোর করে তাকে ঠেলে দিল চুলা ও দেয়ালের মাঝে সরু জায়গাটায়। ‘মাথা নিচু রেখো, নিকোলভ। কোথাও সরে যেয়ো না। নইলে আমি নিজেই গুলি করব। বুঝতে পেরেছ?’

চুপ করে ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকল রানা। বড় করে দম নিল। পিস্তল তাক করল দরজার দিকে। বিড়বিড় করে নিজেকে বলল, ‘তা হলে বিদায়, রানা!’

তখনই বিস্ফোরণের মত আওয়াজ তুলে দুম করে খুলে গেল দরজা!

৩৮

পর পর দু’বার গুলি করল রানা। দরজা দিয়ে ঢুকেই মেঝেতে পড়ল প্রথম সৈনিক। লাশ হয়েছে মাথায় বুলেট নিয়ে। তার পাশেই শুয়ে পড়ল দ্বিতীয় সৈনিকের লাশ। বাইরে বুটের আওয়াজ। কয়েকজন। মুহুর্মুহুঃ গর্জে উঠছে আগ্নেয়াস্ত্র।

দৃঢ় ভঙ্গিতে ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকল রানা, টার্গেট পাওয়ার জন্যে তৈরি। আবারও দু’বার গুলি করল। দেখতে পেল দরজার ঠিক বাইরেই হুড়মুড় করে পড়ল দুই সৈনিক। একবার দরজার সামনে বালির বস্তার মত লাশ জমে গেলে শত্রুদেরকে আসতে হবে জানালা দিয়ে।

এবার হয়তো সেটাই করবে তারা।

গ্লকের মাযল থেকে বেরোচ্ছে ধূসর ধোঁয়া। রানার পিস্তলে আছে এগারোটা বুলেট। ধীর গতি তুলে চলছে ওর হৃৎপিণ্ড। ‘আয়, সব শেষ হোক,’ বিড়বিড় করল রানা।

কিন্তু তখনই দুই জানালা গলে ভেতরে পড়ল চল্লিশ এম এম-এর দুটো গ্রেনেড। একটা থামল রানার পায়ের পাশে।

পরক্ষণে এল বিকট আওয়াজ। ঝলসে উঠল অত্যুজ্জ্বল সাদা আলো। দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি দুটোই হারাল রানা। টের পেল, হাত থেকে খসে পড়েছে গ্লক পিস্তল। পরমুহূর্তে বুঝল, ওর দিকে সাঁই করে উঠে আসছে মেঝেটা।

ঘরে ফেলা হয়েছে স্টান গ্রেনেড। নিজেদের সুনাম বজায় রেখেছে ওগুলো। কোটি ক্যাণ্ডেলা ম্যাগনেসিয়াম ফ্লেয়ার আর অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিস্ফোরিত হওয়ায় তৈরি হয়েছে এক শত আশি ডেসিবল আওয়াজ। পৃথিবীর সেরা শক্তিশালী লোকও প্রায় অচেতন হবে। জেদ করে উঠে দাঁড়াতে চাইল রানা। কিন্তু কানের ওপর ভয়ানক চাপ পড়ায় নষ্ট হয়েছে ভারসাম্যের চেতনা। মাথার ভেতর জোরালো ঝিনঝিন আওয়াজ। বেশ কিছুক্ষণ জ্বলজ্বলে সূর্য দেখলে যেভাবে চোখ ধাঁধিয়ে যায়, সেই অবস্থা ওর।

আবছা বুঝল কী যেন হচ্ছে চারপাশে। কাঁপছে মেঝে। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল কারা যেন। একটা বুট চেপে বসল ওর বুকে। খপ্ করে ধরা হলো দুই হাত। পরক্ষণে টেনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো ওকে। হ্যাণ্ডকাফে দু’হাত আটকে দিল কেউ। কাছেই ধস্তাধস্তির আওয়াজ। বন্দি হয়েছে নিকোলভ। রানার ঘাড়ে ঠেসে ধরা হলো রাইফেলের শীতল নল। পেছন থেকে ঠেলা দিল কারা যেন।

দরজা পার করে বারান্দায় নেয়া হলো রানাকে। চারপাশে শুধু উজ্জ্বল সাদা আলো দেখছে ও। তবে জানে, ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে অনুভূতি। তখন আসবে বমি-বমি ভাব, মাথাঘোরা ও সামান্য ভারসাম্যহীনতা। আপাতত অসহায় ও, লড়তে পারবে না। দাঁড়িয়ে থাকাও প্রায় অসম্ভব।

কানে যেন ঢুকেছে হাজারখানেক ঝিঁঝি পোকা। তারই ভেতর শুনতে পেল কারা যেন কথা বলছে। কাছেই ভারী ডিজেল ইঞ্জিনের ট্রাক। নাকে এল ঝাঁঝাল ধোঁয়া। ওকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কারা যেন। তুলে দেয়া হলো সমতল কোনও মেঝেতে। ওর সঙ্গে নিকোলভকে তোলা হয়েছে কি না, বলতে পারবে না রানা। বিড়বিড় করল, ‘নিকোলভ?’ ওর মনে হলো বহু দূর থেকে এল নিজের কণ্ঠস্বর।

কর্কশ হাসল কেউ। ‘আরে, শালা, নিজে বাঁচবি কি না, সেটা ভেবে দ্যাখ!’

একা হয়েছে, টের পেল রানা। ধুম শব্দে বন্ধ হলো ধাতব দরজা। হাতড়ে দেখল, একদিকে লোহার দেয়াল। ওকে তোলা হয়েছে কাভার্ড ট্রাকে। হোঁচট খেয়ে রওনা হলো গাড়ি। পেরিয়ে গেল অস্বস্তিকর কিছুক্ষণ। সময় কাটতে চাইছে না ওর। উঁচু-নিচু সরু রাস্তা ধরে দুলতে দুলতে চলেছে ট্রাক। একদিকের দেয়ালে দু’পা ঠেকিয়ে সোজা হয়ে বসতে চাইল রানা। কিছুক্ষণ পর বুঝল, ওরা উঠেছে পাকা সড়কে। এরই ভেতর ফিরে পেয়েছে শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির নব্বুই ভাগ। বাকি দশ ভাগ ফিরতে লাগবে পুরো দুই দিন।

মনে মনে কিছু বিষয় গুছিয়ে নিতে চাইল রানা।

প্রথম থেকেই ভুল পথে ছিল। সঙ্গে জুটে গিয়েছিল নকল ডিটেকটিভ। ভাবতে গিয়ে তিক্ত হাসল রানা। ওই মেয়ে বিপদে পড়েছে ভেবে দুশ্চিন্তা করেছে। আর এখন ও নিজেই বন্দি। ইউনা বা তার বাবা কোথায়, জানে না। ওর দায়িত্ব ছিল বাচ্চা মেয়েটাকে ফ্রান্সে পৌঁছে দেয়া। পরে বুঝেছে, নিরীহ একজন বাবা চাইছে সন্তানকে বিপদ থেকে আড়াল করতে। সেটা পারেনি সে। রানা নিজেই বা কী করতে পেরেছে? ইউনা ও নিকোলভের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে ও।

মাত্র একটা উপায়ে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়।

আগে মুক্ত হতে হবে, তারপর খুঁজে বের করবে ইউনা আর ওর বাবাকে। তাদেরকে পৌঁছে দেবে ফ্রান্সে। এ ছাড়া নিজের দায় এড়াতে পারবে না রানা।

একঘণ্টার বেশি হলো এগিয়ে চলেছে ট্রাক। বদ্ধ বাক্সের ভেতর ইঞ্জিনের চাপা আওয়াজ শুনছে রানা। মাঝে মাঝে কমে আসছে ট্রাকের গতি। সামনে বোধহয় পড়ছে গ্রাম, বা জ্যাম বেধেছে হাইওয়েতে। ট্রাকের সঙ্গে কোনও কনভয় আছে কি না, জানা নেই ওর। হয়তো অন্য কোনও ট্রাকে তোলা হয়েছে নিকোলভকে। ওর ভুল না হলে ওকে নেয়া হচ্ছে মস্কো শহরে। এরপর কী করবে, সেটা স্পষ্ট নয়। তবে সম্ভাবনা খুব বেশি, ক্লোনও বাড়ির ভেতর নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, তারপর ওর মগজে গেঁথে দেবে দুটো বুলেট। পরদিন সকালে বা বিকেলে নর্দমায় পাওয়া যাবে ওঁর লাশ।

কিন্তু খুনই যদি করবে, তো ওই খামারেই তা করতে পারত। রানার মনে হলো, অন্য উদ্দেশ্য আছে এদের। সঠিক সময়ে জানা যাবে সেটা 1

মসৃণ হলো পিচঢালা পথ। রানা বুঝল, ট্রাক উঠেছে ফেডারেল হাইওয়েতে। মস্কো ত্যাগ করে এ পথেই নকল তানিয়াকে নিয়ে বেযুখফের খামারে গিয়েছিল ও। আরও কিছুক্ষণ পর মস্কোর শহরতলীতে পৌছল ট্রাক। একটু পর পর থামতে হচ্ছে ওটাকে। স্টান গ্রেনেডের বিস্ফোরণে এখনও ঝনঝন করছে রানার কান। তবুও ধাতব দেয়াল ভেদ করে আসছে বাইরের নানান আওয়াজ। আরও মিনিট দশেক পর উধাও হলো ইঞ্জিনের গর্জন। থেমে গেল ট্রাক। বাইরে কথা বলছে কারা যেন। খড়-খড় আওয়াজে কী যেন সরে গেল। রানা আন্দাজ করল, ওটা ভারী ওয়াএয়ার মেশ সিকিউরিটি গেট। হোঁচট খেয়ে এগোল ট্রাক। তবে এক শত গজ যাওয়ার পর থামল। খুলে গেল পেছনের দরজা। হঠাৎ চোখে উজ্জ্বল আলো পড়তেই আবার অন্ধ হলো রানা। এখনও পরিষ্কার হয়নি দৃষ্টি। কয়েক সেকেণ্ড পর আবছাভাবে দেখল দুই লোককে। তারা হাত বাড়িয়ে ট্রাক থেকে নামিয়ে নিল ওকে। শক্তপোক্ত দেহের লোক তারা। পরনে কালো জ্যাকেট। মাথা ন্যাড়া। রানার দু’হাত শক্ত হাতে ধরে এগোল দু’জন। চারপাশে কংক্রিটের উঠান। প্রায় অন্ধ রানা দেখল, দূরে ইঁটের উঁচু দেয়ালের ওপর ধাতব বেড়া। জায়গাটা বোধহয় একসময় মিলিটারি বেস বা জেলখানা ছিল। এখন সবই পরিত্যক্ত। শহর থেকে বোধহয় দূরে। আশপাশে কোনও আওয়াজ নেই। তার মানেই, কোনও সাক্ষী থাকবে না।

‘এটা আমার হোটেল নয়,’ জানাল রানা। ওর মনে হলো না কথাটা শুনে মজা পেয়েছে লোকদু’জন। ওকে নিয়ে ধূসর এক দালানে ঢুকল তারা। স্টান গ্রেনেড বিস্ফোরণের কারণে এখনও টলছে রানা। হাঁটছে সরু এক করিডোর ধরে। ভাবছে, ও যেন আছে ঝোড়ো সাগরে কোনও জাহাজে। দূরে গেছে সংকীর্ণ করিডোর। কিছুক্ষণ পর একটা ঘরে ঢোকানো হলো রানাকে। ছোরা বের করে কেটে দেয়া হলো দুই কবজির কে টাই। খুলে নেয়া হলো জ্যাকেট। বাদ পড়ল না রানার বেল্ট, হাতঘড়ি ও বুট। ওকে পুরো উলঙ্গ করেনি এরা। আবারও ওকে নিয়ে রওনা হলো লোকদু’জন। রানা বুঝল, আকারে বিশাল এই দালান। নানান করিডোর ধরে এগোবার পর ওকে দাঁড় করানো হলো ধাতব এক দরজার সামনে। খোলা হলো তালা। জোরে ঠেলা দিতেই ভেতরের দিকে খুলে গেল কবাট। পেছন থেকে ঘরের ভেতর ঠেলে দেয়া হলো রানাকে। ছোট্ট ঘর। জানালা নেই। আসবাবপত্র বলতে কাঠের একটা বেঞ্চি। উল্টোদিকে ধাতব টয়লেট।

‘অনেক ধন্যবাদ,’ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল রানা। ‘এবার বলো, কাঁটায় ডিনার? খিদে লেগেছে।’

দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ওকে দেখল লোকদু’জন। দড়াম করে বন্ধ করল ধাতব দরজা। রানা দেখল, ভেতরের দিকে হ্যাণ্ডেল নেই। যন্ত্রপাতি থাকলেও খুলতে পারত না এই দরজা।

আপাতত কিছুই করার নেই। বেঞ্চিতে বসে চারপাশ দেখন। ছাতে সাদা নিয়ন বাতি। এরপর কী ঘটে সেজন্যে অপেক্ষা করতে হবে ওকে।

৩৯

অপেক্ষা করল রানা। পেরোল বেশ কয়েক ঘণ্টা। স্বাভাবিক হয়েছে দৃষ্টিশক্তি। কানের ভেতর কমেছে ঝিঁঝিপোকার ডাক। ছোট্ট ঘরে পায়চারি করে রানা দেখল, ঠিকভাবেই ফিরেছে ভারসাম্য। এই ঘরে দৃশ্যমান কোনও ক্যামেরা নেই। তবে গোপনে হয়তো রাখা হয়েছে। হয়তো ওর ওপর চোখ রেখেছে লোকগুলো।

সময় কাটছে না বলে এক শ’বার বুকডন দিল রানা। বেঞ্চির নিচে পা বাধিয়ে সিট আপ করল এক শ’বার। পেটের পেশিতে টান পড়ায় বাদ দিল ব্যায়াম। মনের ঘড়িটা টিকটিক করে চলছে অবিরাম। মাঝে মাঝেই ভাবছে, আর কতক্ষণ আটকে রাখবে এরা?

আরও বহুক্ষণ পর দরজার বাইরে চাবির ঝনঝন শুনল রানা। বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ন্যাড়া-মাথা সেই দুই লোক ঢুকল ঘরে। চোখে স্পষ্ট রাগ। একজনের হাতে পিস্তল। ওটা চিনল রানা। এমপি-৪৪৩ গ্র্যাচ নাইন এমএম। আজকাল ওটা ব্যবহার করছে রাশান মিলিটারি। ভারী অস্ত্র। কার্বন ও স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি। ম্যাগাযিনে আঠারোটা বুলেট। ভরসা করার মতই মেশিন পিস্তল। মাযলে পেঁচিয়ে আটকে নেয়া হয়েছে সাইলেন্সার। বদ্ধ জায়গায় এক গুলিতে ওর মগজ নানানদিকে ছিটিয়ে দিতে পারবে লোকটা। সেজন্যে কানে আওয়াজের চাপ নিতে হবে না।

দ্বিতীয় গার্ডের হাতে ব্যাগ। ওটা থেকে বেরোল রানার জ্যাকেট, বুট, বেল্ট ও হাতঘড়ি। রানা বুঝল, ওকে ছেড়ে দেবার জন্যে এখানে আসেনি এরা। পোশাক, বেল্ট ও বুট নিয়ে ধীর ভঙ্গিতে রেডি হতে লাগল ও। ভাবছে, কীভাবে কাবু করবে দুই ষণ্ডাকে। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, আসলে কোনও উপায় নেই। বুটের ফিতা দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করতে পারবে না এদের। চট করে হাতে আসবে না নাইন এমএম গ্র্যাচ। সুতরাং, আপাতত অপেক্ষা করতে হবে ওকে।

বুট পরার পর ওকে উঠে দাঁড়াতে ইশারা করল তারা। দূর থেকে ওর মাথার দিকে পিস্তলের মাযল তাক করেছে একজন। অন্যজন কোমরের কাছ থেকে হ্যাণ্ডকাফ নিয়ে এগিয়ে এল। তার দিকে বাধ্য ছেলের মত দু’হাত বাড়িয়ে দিল রানা। লোকটার ঘাড় ভেঙে দিলে নিজেই খুন হবে গুলি খেয়ে।

সেল থেকে বের করে একইরকম বেশ কয়েকটা করিডোর ধরে রানাকে নিয়ে চলল তারা। এসব করিডোরের মানচিত্র মনে মনে তৈরি করছে বিসিআই এজেন্ট। কিছুক্ষণ হাঁটার পর পৌঁছুল সাধারণ এক দরজার সামনে। কবাটে টোকা দেয়ার পর দরজা খুলল ডানদিকের গার্ড। কোমর থেকে নিল এক গোছা চাবি। ওখান থেকে একটা বেছে নিয়ে খুলল হ্যাণ্ডকাফের তালা। অন্য গার্ড সর্বক্ষণ মেশিন পিস্তলের মাযল তাক করে রাখল রানার মাথার দিকে। এবার ধাক্কা দিয়ে ওকে পাঠিয়ে দেয়া হলো ঘরের ভেতর।

হোঁচট খেয়ে এগোল রানা। ঢুকে পড়েছে বড় এক ঘরে। একসময় এ দালান বোধহয় ছিল মিলিটারির ফ্যাসিলিটি। এ ঘর ছিল মেস হল বা রিসেপশন লাউঞ্জ। জানালায় ঝুলছে পর্দা। সেগুলোর মাঝ দিয়ে রানা দেখল, ফুরিয়ে এসেছে দিনের আলো। ছাতের ফিটিং থেকে আসছে মোলায়েম বাতি। মেঝেতে বহুকালের পুরনো হলদেটে লিনোলিয়াম টাইল্স্। ঘরের ভেতর মুখোমুখি দুটো নীল সোফা। একপাশে নিচু টেবিল। আসবাবপত্র দেখে রানার মনে হলো, কেউ ব্যর্থ চেষ্টা করেছে কাউকে আপ্যায়ন করতে। খুব দ্রুত গুছিয়ে নেয়া হয়েছে এ ঘর। একদিকের দেয়ালে পুরনো একটি টেবিল। ওটার ওপরদিক ফরমাইকা দিয়ে তৈরি। টেবিলের ওপর একটা ট্রে। ওখানে ক্রিস্টালের দুটো গ্লাস ও একটা ডিক্যান্টার। ওই বোতলের ভেতরে উইস্কি বা ব্র্যাণ্ডি। এসব ঠিক মানাচ্ছে না যেন। বাতাসে সোঁদা গন্ধ। ওটা বলে দিচ্ছে, বহু দিন পর খোলা হয়েছে এ ঘর।

দরজার দিকে মুখ করে সোফায় বসে আছে একহারা এক লোক। পরনে নামকরা দরজির তৈরি হালকা ধূসর, দামি সুট। রানা ভেতরে পা রাখতেই উঠে দাঁড়িয়েছে লোকটা। বয়স হবে ষাট মত। চেহারায় আভিজাত্য। উঁচু দুই ভুরু থেকে দেড় ইঞ্চি ওপরে শুরু হয়েছে পাতলা, ধূসর চুল। টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। যে কেউ বুঝবে, এই বয়সেও সম্পূর্ণ ফিট। পায়ে কালো চামড়ার জুতো আয়নার মত চকচক করছে, দেখে নেয়া যাবে নিজের মুখ। পলকে রানা বুঝল, এক সময় এই লোক ছিল আর্মি অফিসার।

‘আপনাকে দেখে খুশি হলাম,’ বাগানে কারও দেয়া পার্টিতে পরিচিত হচ্ছে, সেই সুরে পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল লোকটা। ‘আজকের দিনটা ছিল দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর। প্লিয, এগিয়ে এসে সোফায় বসুন।’

‘আপনি ইংরেজ,’ বিস্ময় লুকাতে পারল না রানা। ভেবেছিল দেখবে রাশান ইন্টেলিজেন্সের অফিসার ভ্যানকিন কাপরিস্কিকে। তাকে ভীষণ ভয় নিকোলভের।

‘আপনাকে এতক্ষণ আটকে রাখা হয়েছে বলে সত্যিই দুঃখিত,’ বলল লোকটা। ‘তবে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, সময় স্বল্প বলে এই ঘরটাও গুছিয়ে নিতে পারেনি রাশানরা। এই দেশ তো আর ইংল্যাণ্ড নয়।’ চট্ করে হাতঘড়ি দেখল সে। হাতের ইশারায় দেখাল টেবিলে রাখা গ্লাস ও ডিক্যান্টার। ‘আশা করি ড্রিঙ্ক নেবেন, মেজর রানা? নাকি আপনাকে ডাকব বিসিআই-এর উজ্জ্বলতম এজেন্ট এম. আর. নাইন নামে? শুনেছি সব ধরনের মদের ভেতর স্কচই বেশি পছন্দ করেন।’

‘খালি পেটে ওসব খাই না,’ বলল রানা। ‘তা ছাড়া, অচেনা কারও সঙ্গে ড্রিঙ্কেও আপত্তি আছে আমার। মনে তো পড়ছে না যে নিজের পরিচয় দিয়েছেন আপনি।’

‘আমি শোফেল্ড। কর্নেল উইলিয়াম শোফেল্ড।

‘তো, এখন নিশ্চয়ই আশা করছেন আপনাকে স্যর বলে সম্বোধন করব?’

‘না, তা নয়। আমি অবসরপ্রাপ্ত। রাশানদের মত পুরনো র‍্যাঙ্ক নিয়ে বাড়াবাড়ি করি না। অবশ্য সম্মান দেখালে কারই বা খারাপ লাগে?’

‘আমার ধারণা, সম্মান পেতে হলে সেটা অর্জন করতে হয়।’

‘আমার পদবি যথেষ্ট নয়?’

‘সবসময় নয়।’

‘আপনি উজ্জ্বল মিলিটারি ক্যারিয়ার ছেড়ে বিসিআই-এ যোগ দেন। তারপর হয়ে ওঠেন দুনিয়ার সেরা কয়েকজন স্পাইয়ের একজন।

‘মনে হচ্ছে ডোশিয়েটা ভাল করেই ঘেঁটে দেখেছেন।’

মৃদু হাসল কর্নেল শোফেল্ড। ‘ধরে নিন কিছুই বাদ পড়েনি। নিজেকে যতটা চেনেন, আমি হয়তো তার চেয়ে বেশিই চিনি আপনাকে।’

‘তো এখানে কী করছেন আপনি?’

টেবিলের পাশে থামল প্রাক্তন কর্নেল। উইস্কির বোতল থেকে গ্লাসে ঢেলে নিল সোনালি তরল। সরাসরি তাকাল রানার চোখে। ‘অফিশিয়ালি আমি প্রাক্তন কেজিবি বা বর্তমান এফএসবির মিশন চিফ। বলতে পারেন গাল ভরা পদবি। তবে অফিশিয়ালি আমার অস্তিত্ব নেই এ দেশে। পরে এ বিষয়ে আপনাকে সব খুলে বলব। তার আগে জরুরি কিছু কথা বলে নিতে চাই।’ যে সোফায় বসে ছিল, তার উল্টোদিকের সোফা দেখাল। ‘আসুন, বসে আলাপ করি?’

‘গত কয়েক ঘণ্টা বসে থেকেছি, এখন আর বসতে চাই না,’ বলল রানা।

‘আপনি দাঁড়াতে চাইলে আমার আপত্তি নেই,’ নিজের সোফায় গিয়ে আরাম করে বসল শোফেল্ড। স্কচে হালকা চুমুক দিয়ে হেলান দিল সোফার পিঠে। ডান পা তুলে দিয়েছে অন্য পায়ের ওপর। ‘বহু দিন ধরেই ভাবছি, সত্যিই ভাল হতো আপনার সঙ্গে দেখা হলে। তবে আপনাকে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন কাজ।’

‘তা-ই?’

‘হ্যাঁ।’ মৃদু হাসল উইলিয়াম শোফেল্ড।

‘আমার কিন্তু ভাল লাগছে না শত্রুর সঙ্গে এসব গল্প করতে।’

হাসিটা চওড়া হলো শোফেল্ডের। ‘জানলে খুশি হবেন, আপনার কারণে বদলে নেয়া হয়েছে আমাদের প্ল্যান। ‘

‘আরেকটু হলে গুলি করে ঘাড় ছিঁড়ে নিত আপনাদের স্নাইপার। আমার বদলে মারা পড়েছে তাতভ বেযুখফ। খুশি হওয়ার মত কিছু দেখছি না।’

‘গুলির জন্যে দুঃখিত,’ মুচকি হাসল শোফেল্ড। ‘বোধহয় খিঁচ ধরেছিল স্নাইপারের আঙুলে। নিশ্চয়ই বোঝেন, এমন কী মিশন চিফও প্ল্যান অনুযায়ী সব করতে পারে না। সব কিছুতেই থাকে’ সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য। তবে এখন অতীত ঘেঁটে লাভ নেই। আপনি আর আমি আছি নিরাপদে।’

‘এখানে ধরে এনেছেন, সেজন্যে বোধহয় খুশি হওয়া উচিত আমার?’ বলল রানা, ‘এবার ঝেড়ে কাশুন, বুঝিয়ে দিন আপনার উদ্দেশ্যটা কী।’

‘একদম সঠিক পয়েণ্টে পৌঁছে গেছেন।’

‘তবে আপনার বক্তব্য শোনার আগে আমি জানতে চাই, অ্যান্টোনিন নিকোলভ আর তার মেয়ে এখন কোথায়।’

‘ভাল আছে,’ বলল শোফেল্ড। ‘আমরা তো আর পশু নই। ওই বাচ্চার দায়িত্বে আছেন দক্ষ এক মহিলা ডাক্তার। নিকোলভের কাছ থেকে জরুরি কিছু তথ্য চাইছি। সেজন্যে তাকে নেয়া হয়েছে অন্য জায়গায়। যে বিষয় নিয়ে এত কিছু, সেটি কিন্তু লেখা হয়েছে ইতিহাসের পাতায়।

‘তাই শুনেছি।’

আরেক চুমুক উইস্কি গিলে মুখ দিয়ে চপ্ করে আওয়াজ তুলল প্রাক্তন কর্নেল। ‘অনেক কিছুই জেনেছেন। আপনাকে খুলে বলেছে অ্যান্টোনিন নিকোলভ আর তাতভ বেযুখফ। তবে আরও বহু কিছু একদম জানেন না। সেটা জানাব আমি।’

‘এটা জানি, রাশান ইন্টেলিজেন্সের হয়ে কাজ করত নিকোলভ,’ বলল রানা। ‘এ কারণেই কৌতূহল হচ্ছে: আপনার বলা আমরা আসলে কারা?’

পাত্তা না দেয়ার ভঙ্গিতে আস্তে করে হাত ঝাড়ল শোফেল্ড। ‘বলুন কারা নই? রাশান, ব্রিটিশ, আমেরিকান, চাইনিয, ফ্রেঞ্চ, ভারতীয়… কে নেই এই দলে? এ যুগে আমরা আর ওরা বলে দেশ ভাগ করতে পারবেন না। বহু দিন থেকেই হিংসা-প্রতিহিংসা ভুলে পরস্পরকে সহায়তা করছি আমরা। মহাশূন্য বিজয়, অস্ত্র ব্যবসার প্রতিযোগিতা সবই এখন অতীতের বিষয়। আমরা বহু আগেই জেনেছি প্রতিযোগিতা চললে বেশিদূর এগোতে পারব না। তাই বহু দিন ধরেই পরস্পরকে সাহায্য করছে শক্তিশালী প্রতিটি দেশ। উদ্দেশ্য মহৎ। উন্নয়নের জন্যে পৃথিবীর প্রতিটি অংশে বজায় রাখতে হবে ভারসাম্য। পুব ও পশ্চিমের শক্তিগুলো সেটাই চাইছে। যদিও সাধারণ মানুষের চোখে ধুলো দেয়ার জন্যে চলছে দুই পক্ষের পুতুল নাচ বৈরিতার খেলা। ফলে ব্যস্ত হয়ে পক্ষ বেছে নিচ্ছে দুর্বল মনের সাধারণ মানুষ। তাতে তারা যথেষ্ট খুশি। আমরাও ঘাঁটাচ্ছি না তাদেরকে।’

‘মানুষের জন্যে এতকিছু করছেন শুনে খুশি হলাম,’ বলল রানা। ‘আন্দাজ করছি, আপনি নিজেও পুতুল নাচের কয়েকটা সুতো হাতে রেখেছেন। …এত ক্ষমতাশালী একজনের সামনে হাজির হয়ে আমার বোধহয় গর্বিত হওয়া উচিত।’

মৃদু কাঁধ ঝাঁকাল শোফেল্ড। নীরবে যেন বুঝিয়ে দিল, কাউকে না কাউকে তো দায়িত্ব নিতেই হবে।

‘আপনি তো রাশানদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করছেন,’ বলল রানা, ‘তো নিশ্চয়ই জানেন, তানিয়া আজোরভ নামে যে মেয়েকে পাঠানো হয়েছিল, সে নকল ডিটেকটিভ। আমি জানতে চাই, আসলে সে কে। কৌতূহল হচ্ছে সে এখন কেমন আছে।’

‘ওই মেয়ে এজেণ্ট বেলিনভ। শুনে খুশি হবেন, ভয়াবহ ট্রমা থেকে চমৎকারভাবে সুস্থ হয়ে উঠছে সে। যদিও মনে পড়বে না গত দেড় দিনের স্মৃতি। শত্রু এজেন্টের ব্যাপারে ভালমন্দ খোঁজ নিচ্ছেন বলে ভাল লাগছে। ভাবতে পারিনি আপনি এতটা ভাবপ্রবণ।’

‘পায়ের কড়ে আঙুল থেকে শুরু করে আমার মাথা জুড়ে বিশাল হৃদয়,’ বলল রানা। ‘দয়া করে বলতে পারেন মেয়েটার ডাক নাম কী?’

‘নিশ্চয়ই বলতে পারি। ওর ডাক নাম গালিনা। পদবি সহ তার নাম মেজর গালিনা বেলিনভ। বহু দিন ধরেই কাজ করছে আমাদের সঙ্গে।’

‘মেয়েটার মাথায় বিশেষ এক ডিভাইস ঢোকানো হয়েছে,’ বলল রানা। ‘ঠিকই বলেছিল বেয়ুখফ। বর্তমান ডিভাইসটা নিশ্চয়ই এস. এম. ৬১৪৩ ডিভাইসের উত্তরসুরি?’

‘ভুল নয়,’ সামান্য বিস্ময়ের সঙ্গে বলল প্রাক্তন কর্নেল, ‘ভাবতে পারিনি যে এতটা জেনে নিতে পারবেন।’

‘আরও কিছু বিষয় জেনেছি,’ বলল রানা, ‘যেমন ওই ডিভাইস দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। একইসঙ্গে ওটা হোমিং ডিভাইসও। আর এজন্যেই এত সহজে আমাদের খুঁজে পেয়েছে আপনাদের গুণ্ডারা। সেই প্রথম থেকেই ট্র্যাক করছেন মেজর বেলিনভকে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *