এক্স এজেন্ট – ৩০

৩০

সামনে বেড়ে বেযুখফের কনুই ধরতে চাইল রানা, কিন্তু ঝটকা দিয়ে হাত গুটিয়ে নিল লোকটা। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ভারী শরীর নিয়ে উঠানের তারের বেড়ার দিকে ছুটছে সে প্রাণপণে।

তখনই বাড়ির দরজার কাছ থেকে এল হেঁড়ে চিৎকার। বেযুখফকে দেখে ফেলেছে কেউ। পলাতক লোকটাকে ধরতে তীর বেগে ছুট দিল দুই সৈনিক। একবার কাঁধের ওপর দিয়ে তাদেরকে দেখে নিয়ে আরও জোরে দৌড়াতে চাইল বেযুখফ বাচ্চা হাতির ভঙ্গিতে।

কিছু করার আগেই কড়াৎ আওয়াজ পেল রানা। অন্ধকারে কী যেন ছুটে গেল বেযুখফের দিকে। জিনিসটা আঘাত হানার আগেই রানা বুঝে গেল ওটা কী।

সাধারণ টেযার গানের রেঞ্জ বড়জোর পনেরো ফুট। ডার্টের পেছনে থাকে দুটো তার। সেগুলোর মধ্য দিয়ে বয়ে যায় পঞ্চাশ হাজার ভোল্ট বিদ্যুৎ। ডার্ট একবার কারও দেহে গেঁথে গেলে শুরু হবে অকল্পনীয় যন্ত্রণা। থরথর করে কাঁপতে থাকবে শরীরের সমস্ত পেশি। আজকাল পুলিশবাহিনী ও মিলিটারি সদস্যদেরকে দেয়া হয় আধুনিক টেযার।

বিদ্যুৎবাহী অস্ত্রের ডার্ট বিধল বেযুখফের নিতম্বের বাম দিকে। হাউমাউ করে উঠল সে: ‘বাবারে! ওরে, বাবারে! মরে গেলাম! বাঁচাও! বাঁচাও!’ পরমুহূর্তে উঠানের ধুলোর ভেতর মুখ থুবড়ে পড়ল। মাটিতে তোলা বাইন মাছের মত কিলবিল করছে। তার দিকে ছুটে যাচ্ছে দুই সৈনিক। সাইলেন্স্ড্ সাবমেশিন গানের গুলি এত ব্যথা দেবে না, যেটা এখন পাচ্ছে বেওকুফ।

বাড়ির পাশ থেকে সরে ডানদিকের লোকটার গলায় লাল লেযারের বিন্দু তাক করল রানা। আস্তে করে টিপে দিল ট্রিগার। সেলাই মেশিনের মত খির-খির শব্দে জেগে উঠল কাশতান সাবমেশিন গান। দূরে ছিটকে পড়ল গুলির খোসা। বুকের বুলেটপ্রুফ ভেস্ট কাজে এল না, হোঁচট খেয়ে উঠানে পড়ল সৈনিকের লাশ। রানা দ্বিতীয় দফা গুলি করতেই শূন্যে ভেসে কয়েক ফুট গিয়ে মাটিতে পড়ল অন্যজন।

এবার শুরু হবে পুরোদস্তুর লড়াই। গলা শুকিয়ে গেল রানার। উপায় নেই পালিয়ে যাওয়ার। দৌড়ে বেযুখফের পাশে পৌঁছে গেল ও। মাপা একটা লাথি দিল মোটা লোকটার ফোলা নিতম্বে। মাংসে গেঁথে আছে হাই ভোল্টেজের ডার্ট। ছিটকে পড়ল ওটা। থেমে গেছে বেযুখফের থলথলে নিতম্বের অদ্ভুত কম্পন। উঠে বসতে গিয়েও পারল না সে। জোরালো শকের কারণে চলে গেছে ঘোরের ভেতর। ঘুরে নিকোলভ ও তানিয়ার উদ্দেশে হাতের ইশারা করল রানা। যে যেভাবে পারো পালিয়ে যাও। প্রতিটি মুহূর্ত এখন মূল্যবান। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে আরও সৈনিক। তার ওপর, যে-কোনও সময়ে আকাশপথে হাজির হবে হেলিকপ্টার। সেক্ষেত্রে সরে যাওয়ার সুযোগ পাবে না ওরা। দরজা দিয়ে প্রথম লোকটা বেরোতেই গুলি পাঠাল রানা। তিনটে বুলেট বিঁধল শত্রুর গলা ও কপালে। ভেজা ময়দার বস্তার মত মাটিতে পড়ল লোকটা।

আঁধার দরজার ওদিক থেকে এল মাযল ফ্ল্যাশের কমলা ঝলকানি। ছায়ার ভেতর সৈনিকদের দেখছে রানা। নাইট ভিশন গগলসের জন্যে উঠানে তারা রানাকে দেখছে হলদে- সবুজ ভূতের মত। কুঁজো হয়ে কয়েক লাফে অকেজো ট্র্যাক্টরের আড়াল নিল রানা। ওর পায়ের কাছে মাটি খুবলে তুলল কয়েকটা বুলেট। আরও ক’টা লাগল ট্র্যাক্টরের ধাতব গায়ে। বামে-ডানে মাযল ঘুরিয়ে চারদিক দেখছে রানা। ছায়ার ভেতর নড়াচড়া দেখলেই গুলি করছে। পড়েছে নতুন দুশ্চিন্তার ভেতর। ওর কাছে আছে মাত্র একটাই ম্যাগাযিন। তাও প্রায় খালি। বাড়ির কাছে আরেকজনকে দেখে গুলি পাঠাল রানা। থমকে গেল ছায়ামূর্তি, তারপর কাত হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।

এক এক করে গুনছে রানা, গুলি লেগেছে শত্রুপক্ষের সাতজনের গায়ে। দুটো গুলি করতেই বাড়ির দেয়ালের কাছ থেকে সরে নিকোলভের ফোক্সভাগেন ও টিনের ছাউনির মাঝে সরল আরও দু’জন। গাড়ির দরজা ভেদ করে ড্রাইভারের জানালা চুরচুর করল রানার আরেকটা গুলি।

থেমে গেল দুই পক্ষের গোলাগুলি। বাড়ির ভেতর নতুন করে তৈরি হচ্ছে রাশান সৈনিকরা। দলে ক’জন জানা নেই রানার। হাত ও হাঁটুর ওপর ভর করে গুঙিয়ে চলেছে বেযুখফ। বিরক্ত হয়ে ছুটে গিয়ে তার পাঁজরে হালকা লাথি দিল রানা। ‘ওঠো! দৌড়াও!’

তাতেও উঠল না বেওকুফ। খপ্ করে তার দাড়ি চেপে ধরে ওপরে টান দিল রানা। এবার ভীষণ ব্যথা পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল লোকটা। বৈদ্যুতিক ডার্ট নিতম্বে লাগলে যেভাবে কাতরে উঠেছিল, দাড়ি ছিঁড়ে যাওয়ায় তার দ্বিগুণ জোরে হাউমাউ করে উঠেছে সে। কনুই ধরে অর্ধেক টেনে, অর্ধেক ছেঁচড়ে তাকে নিয়ে চলল রানা। টলমল করতে করতে নানাদিকে সরে উঠানের দক্ষিণ দিকে চলেছে ওরা। দূরে অন্ধকার জঙ্গল।

মাথার ওপর দিয়ে, কানের পাশ কাটিয়ে হুইশ্ আওয়াজে চলে যাচ্ছে বুলেট। আকারে বিশাল বেযুখফ। দ্বিগুণ ভাল তার কপাল, এখনও গুলি লাগেনি শরীরে। একহাতে বাড়ির দিকে দু’একটা গুলি পাঠাল রানা। ছেড়ে দিল বেযুখফের কনুই। তাড়া দিল, ‘জঙ্গলের দিকে দৌড় দাও!’

মোটা লোকটা তারের বেড়া টপকে যেতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে রানার মনে। তবে এবার মনোযোগ দিতে হবে দলের অন্যদের দিকে। বিশেষ করে ইউনা। এখনও বাড়ির পাশে দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। নিকোলভ, ইউনা ও তানিয়া যেন জঙ্গলের দিকে ছুটতে পারে, সেজন্যে দিতে হবে কাভারিং ফায়ার। এদিকে প্রায় খালি হয়ে গেছে রানার সাবমেশিন গানের ম্যাগাযিন।

উঠানে পড়ে থাকা ট্র্যাক্টরের বিশাল এক চাকার আড়ালে থামল রানা। একবার ট্রিগার টিপলে বেরোচ্ছে অন্তত তিনটে করে গুলি। এত খরচ করতে পারবে না ও। বাধ্য হয়ে সিঙ্গল শট সুইচ অন করল রানা। খুব সতর্কতার সঙ্গে দুটো গুলি পাঠাল বাড়ির দিকে। ফোক্সভাগেনের বোঁচা বনেটের ওদিক থেকে গুলি করছে এক সৈনিক। তার নাকটা উড়ে যেতেই পিছলে গাড়ির ওদিকে পড়ল লাশ। দরজার কবাটের আড়ালে আরেকজন, মাথাটা বের করতেই বুলেট বিঁধল থুতনিতে। মাথার তালু উড়িয়ে ওদিকের দেয়ালে বিঁধল গুলি। রানার হিসাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে নয়জন সৈনিক। তবে এখন আর ম্যাগাযিনে একটা গুলিও নেই!

বেযুখফের পেছনে যে দু’জন এসেছিল, তাদের লাশ পড়ে আছে কয়েক গজ দূরে। একজনের মুঠোর ভেতর অস্ত্রের পিস্তল গ্রিপ। সাবমেশিন গানটা হাতে না পেলে কাউকে কাভার ফায়ার দিতে পারবে না রানা। সুতরাং, এবার বেরোতেই হবে ওকে খোলা জায়গায়। দু’হাতে সাবমেশিন গান বাগিয়ে ধরে ট্র্যাক্টরের আড়াল থেকে বেরোল রানা। ভঙ্গি করছে গুলি আছে অস্ত্রে। তবে ধোঁকা দেয়া গেল না সৈনিকদেরকে। ফোক্সভাগেনের ওদিক থেকে বেরোল দুই সৈনিক। সাবমেশিন গান তাক করছে বিদেশি লোকটার বুক লক্ষ্য করে। এই ব্যাটাই বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে তাদের নিখুঁত পরিকল্পনার।

খোলা জায়গায় বেরিয়ে মহাবিপদে আছে রানা। খুন হতো, কিন্তু বেযুখফ যে ছাউনির ভেতর কুকুর রেখেছে, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সেই দরজার ছিটকিনিতে কনুই বাধিয়ে বসল এক আততায়ী। ধাক্কা খেয়ে খুলে গেল দরজা। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড আওয়াজে খেপে আছে টোমা। তার ওপর অচেনা মানুষ দেখে উত্তেজিত। ছিটকে বেরিয়েই লোকটার কবজি কামড়ে ধরল হাউণ্ড। ভীষণ ভয় পেয়েছে সৈনিক। রক্তাক্ত হাত টেনে নিয়েই এক লাফে গিয়ে ঢুকল ছাউনি ঘরের ভেতর। ধুম্ করে আটকে দিল দরজা। এদিকে অস্ত্রের নল রানার দিকে তাক করছে তার সঙ্গী। সাইটের মাঝ দিয়ে দেখতে পেল হলদে-সবুজ ছায়ামূর্তি।

মাটিতে পড়ে থাকা সাবমেশিন গানের কাছে প্রায় পৌঁছে গেছে রানা, এমন সময় বুকে দেখল লেযারের লাল বিন্দু। বুঝতে দেরি হলো না, এবার ওকেও যেতে হবে পরপারে।

কিন্তু তখনই ছায়া থেকে বেরোল আবছা কী যেন। ভোঁতা চোয়াল ভরা একগাদা দাঁত কামড়ে ধরল আততায়ীর কনুই। হ্যাঁচকা টান খেয়ে মাটিতে পড়ল সৈনিক। হাত থেকে খসে পড়েছে অস্ত্র। প্রাণপণে কনুই ছুটিয়ে নিতে চাইল লোকটা। কিন্তু কুকুরের চোয়াল ইঁদুরের কলের চেয়েও মারাত্মক। একেকবারে ভয়ানক সব ঝাঁকি দিচ্ছে টোমা। শিকারের ঘাড় ভাঙতে গিয়ে শিকারি প্রাণী তা-ই করে। ছটফট করছে লোকটা, সেইসঙ্গে করুণ আর্তনাদ। লাথি মেরে সরাতে চাইল কুকুরটাকে। খুব হুঁশিয়ার কুকুর টোমা, সরে গিয়ে ভাঙতে চাইছে সৈনিকের কনুইয়ের হাড়। লোকটার পা লাগল বাড়ির পাশে এক প্রোপেন বটলের গায়ে। কাত হয়ে পড়ে উঠানের আরেক দিকে গড়িয়ে গেল ওটা। কুকুরের খপ্পর থেকে রেহাই নেই সৈনিকের। খালি হাতে আত্মরক্ষা অসম্ভব। তার সঙ্গের কমরেডদের মনোযোগ অন্যদিকে। সাহায্য করতে এল না কেউ।

মৃত লোকটার শিথিল হাত থেকে সাবমেশিন গান নিল রানা। একপশলা গুলি পাঠাল ছাউনির দরজা লক্ষ্য করে। ওদিকেই লুকিয়ে আছে অন্য লোকটা। এক ছুটে আবারও ট্র্যাক্টরের পেছনে পৌঁছুল রানা। নতুন করে শুরু করল কাভারিং ফায়ার। বাড়ির ভেতর থেকে আর বেরোচ্ছে না সৈনিকরা। জঙ্গলের দিকে ছুটে চলেছে বেযুখফ, নিকোলভ ও ইউনা।

আছড়ে-পিছড়ে সীমানা বেড়া টপকে জঙ্গলের ভেতর হারিয়ে গেল বেযুখফ। চোখের কোণে রানা দেখল, মেয়ের হাত ধরে উঠানের মাঝখান দিয়ে দৌড়াচ্ছে নিকোলভ। আশপাশে কোথাও নেই তানিয়া। হয়তো পালিয়ে গেছে অন্য কোথাও।’

সবই ভাল যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ বিগড়ে গেল পরিস্থিতি। রানা খেয়াল করেনি দু’জনকে। বাড়ির পেছন ঘুরে দেয়ালের পাশে থেমেছে তারা। কিছুক্ষণ আগে ওখানে ছিল নিকোলভ, ইউনা ও তানিয়া। ওখান থেকে সরাসরি গুলি করতে পারবে লোকদু’জন উঠানের যে-কোনও দিকে। রানার মনে হলো এক টানে খুলে নেয়া হয়েছে ওর জাঙ্গিয়া। নতুন অ্যাংগেল থেকে অনায়াসেই ওকে গেঁথে ফেলতে পারবে’, তারা। ট্র্যাক্টরের পেছনে সরে যেতে বাধ্য হলো ও। আপাতত কাউকে কাভারিং ফায়ার দিতে পারবে না। প্রায় নিঃশব্দে হাজির হলো একরাশ গুলি। ঠুং-ঠাং আওয়াজে বিঁধল ট্র্যাক্টরের ভারী ইঞ্জিনে। কয়েকটা বুলেট লাগল রানার মাথার কয়েক ইঞ্চি দূরে। ছিঁড়েখুঁড়ে গেল বিশাল আকারের একটা চাকা। বাতাস বেরোতেই একদিকে কাত হলো মেশিন।

অ্যাসল্ট টিমকে বোধহয় বলে দেয়া হয়েছে নিকোলভকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তার মানে এটা নয় যে, আহত করা যাবে না। নিকোলভের আর্তচিৎকার শুনল রানা। ঘুরে তাকাতেই দেখল কাত হয়ে মাটিতে পড়েছে এক্স এজেণ্ট। এখনও ধরে রেখেছে ইউনার হাত। হোঁচট খেয়ে পড়েও প্যারাশুটিস্টের মত গড়ান দিয়ে উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। রাগ ও ক্ষোভ নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘বাবা!’ নিকোলভকে আহত ও রক্তাক্ত দেখে ঘাবড়ে গেছে মেয়েটা।

হাঁটুর নিচে কাফ মাসলে গুলি লেগেছে নিকোলভের। দুই হাতে খামচে ধরেছে জায়গাটা। ডাচ ভাষায় চিৎকার করল: ‘পালাও, ইউনা! পালাও!’

দ্বিধায় পড়েছে মেয়েটা। একদিকে বাবা আহত, ওদিকে যে-কোনও সময়ে ও নিজেই মরবে গুলি খেয়ে। অবশ্য ওকে নিতে হলো না সিদ্ধান্ত। ইউনাকে ধরতে ছুটে গেল বেশ ক’জন সৈনিক। ভীষণ ভয়ে আর্তচিৎকার করে হরিণের বেগে আরেক দিকে ছুটল মেয়েটা।

বাড়ি থেকে বেরোল কালো পোশাক পরা একদল সৈনিক। ঝলসে উঠছে মাযলের মুখে আগুন। ট্র্যাক্টরের পেছনে শুয়ে পাল্টা গুলি পাঠাল রানা। মাথায় গুলি খেয়ে মরল একজন। তারপর দ্বিতীয়জন। বারোজনের বেশি শত্ৰু এরই ভেতর মারা পড়েছে। নিজেকে জিজ্ঞেস করল রানা, আর কয়জন আছে? একের পর এক আসছে, যেন এর শেষ নেই। একটু পর ফুরিয়ে যাবে দ্বিতীয় সাবমেশিন গানের গুলিও।

ভাল জায়গায় কাভার নিতে পারেনি রানা। খুব কাছে এসে গুলি বিঁধছে মাটিতে। মুখে এসে লাগছে ধুলো ও কাঁকর।

টলমল করে উঠে দাঁড়াতে চাইল নিকোলভ। কিন্তু তখনই তার পিঠে বিধল টেয়ার গানের ডার্ট। বেযুখফের মতই খাবি খেতে শুরু করেছে এক্স এজেন্ট। থরথর করে কাঁপছে প্রতিটি মাংসপেশি। টেযার হাতে তার দিকে ছুটল এক সৈনিক। দরকারে দ্বিতীয় ডার্ট গাঁথবে নিকোলভের পিঠে। তার সামান্য পেছনে ছুটছে তার সঙ্গী, হাতে সাবমেশিন গান। ট্র্যাক্টরের তলা থেকে বেরোতে গিয়ে রানা খেয়াল করেছে তাকে। একরাশ গুলি পাঠাতেই চুরমার হলো তার চিবুক থেকে চোয়াল পর্যন্ত। হাত থেকে অস্ত্র ফেলে মুখ চেপে ধরল সে, পরক্ষণে উপুড় হয়ে পড়ল উঠানে। ধুলোর বিছানায় ঠাঁই নেয়ার আগেই লাশ হয়ে গেছে।

টেযার হাতে লোকটা ঘুরেই ডার্ট ছুঁড়ল রানাকে লক্ষ্য করে। প্রায় বসে পড়েছে রানা। ওর কাঁধের ওপর দিয়ে গেল ডার্ট। হিসাব ঠিক থাকলে রানার সাবমেশিন গানে এখন গুলি আছে মাত্র চারটে। তবে অন্য কাজেও ব্যবহার করা যায় আগ্নেয়াস্ত্র। রানার প্রতিপক্ষ সাড়ে ছয় ফুটি এক দানব। যেমন লম্বা তেমনই চওড়া। ওজন অন্তত আড়াই শ’ পাউণ্ড। তবে এর চেয়েও দৈত্যাকৃতির লোকের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই করেছে রানা। তৃতীয় ডার্ট ছোঁড়ার আগেই দানবের দেড় ফুটের ভেতর পৌঁছে গেল ও। সাবমেশিন গানের নল গেঁথে দিল দৈত্যের গলার ওপর। পরক্ষণে বাঁট পড়ল লোকটার মুখের ওপর। ফাটা ঠোঁট ও নাক দিয়ে ছিটকে বেরোল রক্তের স্রোত। প্রচণ্ড মার খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল লোকটা।

বৈদ্যুতিক শক খেয়ে থরথর করে কাঁপছে নিকোলভ। তার দুই কাঁধের মাঝে গেঁথেছে টেযার গানের ডার্ট সাবমেশিন গান দিয়ে সরাতে পারবে না বুঝে বামহাতে ফলাটা চেপে ধরল রানা। বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে কুঁচকে গেল ওর নাক-মুখ। হাতে শুরু হয়েছে যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি। হাত ঝেড়ে ছিটকে ফেলল ডার্টটা। নিকোলভের ডান পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে দরদর করে পড়ছে রক্ত। রানা বুঝে গেল, বুলেটের আঘাতে ফুটো হয়েছে লোকটার কাফ মাসল। উপায় নেই যে হাঁটবে। তার ওপর টেযারের বিদ্যুতের কারণে প্রায় অচেতন। নিকোলভের কলার চেপে ধরে নিরাপদ জায়গার দিকে তাকে টেনে নিয়ে চলল রানা। একবার ঘুরে দেখল খামারবাড়ি। মরা কাঠের মত শুকিয়ে গেল গলা। দরজা দিয়ে বেরোচ্ছে একের পর এক সৈনিক!

রানার মনে প্রশ্ন জাগল: ইয়া মোটা এক লোক, এক এক্স এজেন্ট আর বারো বছরের এক মেয়েকে ধরতে এত আয়োজন কেন? এটাও বুঝল, ওদের বাঁচার সম্ভবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়। বহুবার মৃত্যুকে কাঁচকলা দেখিয়েছে ও, তবে একদিন তো হেরে যেতেই হয়!

আর সেদিনটা সম্ভবত আজই!

৩১

না পারবে রানা প্রায় অচেতন, আহত নিকোলভকে ফেলে সরে যেতে, না পারবে নিজেকে রক্ষা করতে। এখন রুখে দাঁড়ালে গুলি করে ছিন্নভিন্ন করা হবে ওকে। কোনও দিকে কোনও পথ খোলা নেই ওর জন্যে। কলার ধরে এক পা এক পা করে নিকোলভকে টেনে নিয়ে চলেছে রানা। বামহাতে প্রায়-খালি সাবমেশিন গান। ওটা তাক করেছে বাড়ির দরজার দিকে। বেরিয়ে আসছে আরও সৈনিক।

ম্যাগাযিনে আছে মাত্র চারটে বুলেট। জীবনে শেষবার লড়াই করার জন্যে তৈরি হলো মাসুদ রানা। ওই ক’টা রাউণ্ডের কারণে হয়তো বাঁচবে, অথবা মরবে করুণভাবে। নল তাক করে ট্রিগারে তর্জনীর চাপ বাড়াল রানা।

লক্ষ্যভেদে কখনোই ভাল হয় না সাবমেশিন গান। বোঝার মত ভারী নিকোলভকে নিয়ে যাওয়ার ফাঁকে একহাতে কাঁধের ওপর দিয়ে গুলি করলে নিখুঁত হবে না তাক। রানার প্রথম গুলি ছিঁড়ে নিল এক সৈনিকের কানের লতি। বুলেট গিয়ে ঝনঝন করে ভাঙল বাড়ির জানালার কাঁচ। রানার দ্বিতীয় গুলি লাগল আরেক সৈনিকের বাহুতে। কোথাও লক্ষ্যভেদ করল না তৃতীয় গুলি।

এবার হাল ছেড়ে দেয়ার সময়। তবে মাসুদ রানার বন্ধুরা সবসময় বলে, শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে ওদের বন্ধু।

এখনও বাড়ির পাশে আগুনে পুড়ছে ইলেকট্রিকাল ট্র্যান্সমিটার। নানাদিকে ফুলকি ছড়াচ্ছে ওটা। চকচক করছে কাটা পড়া হাই-ভোল্টেজ তার। ওগুলোর একটু দূরেই এক সৈনিকের লাথি খাওয়া সেই প্রোপেন গ্যাসের বটল। ওটা আছে একদম সঠিক অ্যাংগেলে। রানা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে ওই বোতলে গুলি লাগলে পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

তবে কম শক্তির নাইন এমএম ম্যাকারভ রাউণ্ড কি ভেদ করবে বোতলের স্টিলের পুরু দেহ?

সেটা জানতে হলে গুলি করতে হবে।

দেখা যাক! বিড়বিড় করল রানা। পরক্ষণে ঠিক জায়গায় তাক করে টিপে দিল ট্রিগার।

‘ক্ল্যাক!’ শব্দে আটকে গেল সাবমেশিন গানের বোল্ট। পরক্ষণে এল ‘ক্ল্যাঙ্ক!’ আওয়াজ। বুলেট ফুটো করেছে ধাতব বোতলের নিচের অংশ। ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে বুলেট।

সিনেমায় দেখা যায় গুলি করা হলে এক টন টিএনটির মত বিস্ফোরিত হয় গাড়ির ফিউয়েল ট্যাঙ্ক, প্রোপেন ক্যানিস্টার বা এ ধরনের কিছু। মরে ভূত হয় যত খারাপ লোক। কিছুই হয় না নায়কের। এ ধরনের সিনেমা দেখতে বাধ্য হলে মাত্র কয়েক মিনিটে ঘুমিয়ে পড়ে রানা। নিজ অভিজ্ঞতায় জেনেছে, বাস্তব দুনিয়ায় এভাবে রক্ষা পাওয়া যায় না।

জীবন কোনও সিনেমা নয়।

রানা গুলি করেছে প্রোপেন গ্যাসের সিলিণ্ডারে। প্রেশারাইড্ গ্যাস বেরোচ্ছে বুলেটের তৈরি দুই ফুটো দিয়ে। তাতে ক্ষতির সম্ভাবনা এক শ’ ভাগের এক ভাগও নেই। অবশ্য পাশেই জ্বলছে ফুলকি ভরা ট্র্যান্সমিটার। বাতাসের সঙ্গে মিশে যাওয়ার সময়টায় সবচেয়ে বিপজ্জনক হয় দাহ্য গ্যাস। হিসহিস করে বেরোতে শুরু করা গ্যাসের ধারা সোজা হয়ে পড়েছে ফুলকির ভেতর। ফলে এত দ্রুত বিস্ফোরণ হলো যে, বাড়ি থেকে বেরোনো সৈনিকরা বাঁচার কোনও সুযোগই পেল না। নীল আগুনের বিরাট এক গোলা আলোকিত করল গোটা উঠান। আগুন গপ্ করে গিলে ফেলল নিকোলভের ফোক্সভাগেন ও বেযুখফের পিকআপ। পরক্ষণে বোমার মত ফাটল দুই গাড়ির ফিউয়েল ট্যাঙ্ক। বোতলে আটকা পড়া জ্বলন্ত প্রোপেন গ্যাস ফাটিয়ে দিল স্টিলের সিলিণ্ডার। চারদিকে ছিটকাল স্টিলের মৃত্যুবাহী শত শত টুকরো। আগুনের কমলা-নীল ফুটবলের কাছে নেই এমন এক সৈনিক কিছু বোঝার আগেই হলো প্রায় দু’টুকরো। পেট থেকে থপ্ করে ধুলোয় পড়ল রক্তাক্ত নাড়িভুঁড়ি।

বিস্ফোরণের প্রচণ্ড গরম হাওয়া ও শকওয়েভের ধাক্কায় কয়েক ফুট পিছিয়ে গেল রানা। হাত থেকে পড়ে গেছে খালি আগ্নেয়াস্ত্র। দু’হাতে ধরল নিকোলভের দুই কবজি। টান দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল আহত লোকটাকে। চিৎকার করে বলল, ‘রওনা হও বেড়ার দিকে!’

কিন্তু মাটিতে পড়ে গেল নিকোলভ। বাধ্য হয়ে হাঁটু গেড়ে বসল রানা। ঝটকা দিয়ে নিকোলভকে তুলে নিল ডান কাঁধে। উঠে ছুটে চলল তারের বেড়ার দিকে। জানা নেই বিস্ফোরণের পর রয়ে গেছে আর ক’জন শত্রু। এটা রানা বুঝেছে, আগুনের হলকা কমে যাওয়ার আগেই সরে যেতে হবে ওকে।

তারের বেড়ার দিকে কুঁজো হয়ে ছুটে চলেছে রানা। ভাবছে, কপাল ভাল; নিকোলভের বদলে ওর ঘাড়ে এখন আরও মোটা বেযুখফ নেই!

একটু দূরেই’ অন্ধকার জঙ্গল। রানার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে প্রোপেন গ্যাসের বিস্ফোরণের উজ্জ্বল আলো। চোখ পিটপিট করে স্বাভাবিক করতে চাইল রেটিনা। কয়েক সেকেণ্ড পর পরিষ্কার হলো চারপাশের দৃশ্য। খামারের উঠান যেন রণক্ষেত্র। আগুনে পুড়ে কয়লা হচ্ছে কয়েকটা লাশ। দাউ-দাউ করে জ্বলছে বেযুখফের গোটা খামারবাড়ি।

তারের বেড়ার কাছে পৌঁছে চারপাশে তাকাল রানা। গলা ছেড়ে ডাকল, ‘ইউনা! তুমি কোথায়?’

মেয়েটাকে শেষবার দেখেছে আহত নিকোলভের পাশে। আশপাশে কোথাও দেখা গেল না তাকে। আবারও চিৎকার করল রানা, ‘ইউনা! তুমি কোথায়?’

খামারবাড়ির আগুন এড়িয়ে ছুটে আসছে কয়েকজন সৈনিক। ভালভাবেই দেখেছে রানা ও নিকোলভকে।

কাঁধে ভারী বোঝা নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে তারের বেড়া টপকে গেল রানা। এবড়োখেবড়ো জমিতে হোঁচট খেয়ে ঢুকে পড়ল অন্ধকার জঙ্গলে। চারপাশ থেকে ওকে বাধা দিচ্ছে ঘন সব ঝোপ। একটু দূর থেকে মানুষের গলা শুনে চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল রানা।

‘স্! এখানে!’ কণ্ঠ তাতভ বেযুখফের। জঙ্গলের কিনারায় লুকিয়ে আছে মোটা লোকটা। দৌড়ে এসেছে বলে হাপরের মত হাঁপিয়ে চলেছে। তার চোখের মণিতে দূরের আগুনের প্রতিচ্ছবি দেখল রানা। ছাইয়ের মত ফ্যাকাসে হয়েছে তার মুখ। বেসুরো কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘মেয়েটা কই? ইউনা?’

‘জানি না,’ স্বীকার করল রানা। ‘শেষ দেখেছি ওর বাবার সঙ্গে।

‘হায়, ঈশ্বর! এখন কী হবে?’

‘খামারের সবই তো চেনে,’ আশ্বস্ত করতে চাইল রানা। কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস নেই। ‘নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে পড়েছে। পরে খুঁজে বের করব। আগে নিরাপদ কোথাও সরাতে হবে নিকোলভকে। আহত।’

খুব সাবধানে বন্ধুর বাহু স্পর্শ করল বেযুখফ। ভাব দেখে রানার মনে হলো, পচা লাশ ধরছে লোকটা। ‘হায়, যিশু! ও কি বাঁচবে?’

‘তুমি মেরে না ফেললে,’ বলল বিরক্ত রানা। ‘আগে গুলি বের করতে হবে ওর পা থেকে। পিঠেও টোরের ডার্টের ক্ষত।’

মাথা দোলাল বেযুখফ। ‘জানি কেমন লাগে। তোমার সঙ্গের ওই মেয়েটা কই? কী যেন নাম? যারা?’

‘তানিয়া।’ মাথা নাড়ল রানা। ‘জানি না কোথায়।’ খানিকটা বিস্ময় কাজ করছে ওর মনে। হঠাৎ কোথায় লুকিয়ে পড়ল সে?

খামারবাড়ির দিক থেকে আরেকটা বিস্ফোরণের আওয়াজ আসতেই প্রায় লাফিয়ে উঠল বেযুখফ। বিড়বিড় করে বলল, ‘হায়, ঈশ্বর! গেল আমার বাড়ি!’

‘এমনিতেই আর ওখানে থাকতে পারতে না,’ বলল রানা। ‘এবার বকবক বন্ধ করে ট্রেইলারে চলো। তোমার বন্ধু আহত। নাকি আমাকেই খুঁজে বের করতে হবে ওটা?’

পথ দেখিয়ে আরও ঘন জঙ্গলের দিকে চলল বেযুখফ। কয়েক শ’ গজ যাওয়ার পর পেছনে হারিয়ে গেল জ্বলন্ত খামারবাড়ির আগুনের কমলা আলো। জলহস্তির মত ঝোপঝাড় ভেঙে এগিয়ে চলেছে বেযুখফ। নীরবে পিছু নিচ্ছে রানা, কাঁধে নিকোলভ। ক্রমেই আরও ভারী লাগছে অচেতন লোকটাকে।

হঠাৎ করেই কাছে মট্ করে শুকনো ডাল ভাঙার আওয়াজ পেল রানা। চমকে গেছে ভীষণ। দ্রুত আসছে কী যেন!

ঝট্ করে ঘুরে দাঁড়াল রানা। বিপদের জন্যে তৈরি।

৩২

দু’পেয়ে কেউ অনুসরণ করেনি রানা বা বেযুখফকে। ছুটে এসে রানার পাশে থেমে চার পায়ে বসল টোমা। বের করেছে আধ হাত লম্বা লালচে জিভ। কুকুরটার মাথা মৃদু চাপড়ে দিল রানা। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অক্ষত অবস্থায় মালিকের কাছে পৌঁছে গেছে প্রভুভক্ত জন্তুটা। রোমে লেপ্টে থাকা রক্ত ওটার নিজের নয়। ‘বিপদের সময় সাহায্য করেছিস, টোমা,’ নরম সুরে বলল রানা।

নিজের নাম শুনে কান খাড়া করল কুকুরটা।

আবারও এগোল বেযুখফ। পেছনে নিকোলভকে কাঁধে নিয়ে রানা। পিছু নিল টোমা। ধেয়ে আসছে না কেউ অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলল ওরা। বেশ কিছুক্ষণ পর রানা যখন ভাবতে শুরু করেছে জঙ্গলের মাঝে পথ হারিয়ে বসেছে বেযুখফ, ঠিক তখনই থমকে ডানদিকে আঙুল তাক করল সে। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, ‘পৌঁছে গেছি।’

গাঢ় ছায়ার ভেতর প্রথমে কিছুই দেখল না রানা। অবশ্য কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, সামনে ঠিক স্বাভাবিক নয় কালো ঝোপঝাড়। কয়েক পা গিয়ে হাত বাড়াতেই রানা টের পেল, চারপাশে ক্যামোফ্লেজ করা পুরু নেটিং। ভালভাবেই ট্রেইলার লুকিয়ে রেখেছে বেযুখফ। জঙ্গলের এত গভীরে অন্ধকারে চট্ করে বোঝা কঠিন, এখানে আছে বিশাল এক ট্রাক ও ট্রেইলার। হয়তো ড্রপ যোন থেকে খামারবাড়িতে যাওয়ার সময় এ জায়গার কয়েক ফুট দূর দিয়ে গেছে অ্যাসল্ট টিম, টের পায়নি কিছু। আজ দ্বিতীয়বারের মত মনে মনে বেযুখফের প্রশংসা না করে পারল না রানা।

অন্ধকারে কয়েক পরত নেটিং সরিয়ে ট্রেইলারের দরজার তালায় চাবি ভরতে চাইল বেষুখফ। দু’বার চেষ্টার পর খুলে গেল তালা। ট্রেইলারের মেঝেতে নিকোলভকে তুলল রানা ও বেযুখফ মিলে। আহত মানুষটাকে শুইয়ে দেয়া হলো চিত করে। দরজা বন্ধ করে বোল্ট আটকে দিল বেযুখফ। কয়েক সেকেণ্ড খোঁজার পর পেয়ে গেল বাতি জ্বালবার সুইচ। ওটা টিপে দেয়ার পর মনে পড়ল, আশপাশে বিদ্যুৎ নেই। আরেক দফা খোঁজার পর পেল গ্যাস চালিত সার্ভাইভাল লণ্ঠন।

‘বাতির দরকার নেই,’ বলল রানা।

‘সব জানালা লেপে রেখেছি কালো কালি দিয়ে,’ বলল বেযুখফ। ‘কেউ আলো দেখতে পাবে না।’

‘তা হলে মৃদুভাবে আলো জ্বালো।’

ট্রেইলারের ভেতর জ্বলে উঠল আবছা আলো। বেযুখফের গোপন আস্তানা দৈর্ঘ্যে চল্লিশ ফুট। তিন ভাগের দু’ ভাগ জুড়ে শত রকমের রেডিয়ো ইকুইপমেণ্ট। সমতল জায়গার বেশিরভাগ অংশ ভরে গেছে নোংরা কফির মগ ও খাবারের বাসি প্লেটে। দেয়ালে দেয়ালে রাশান ও ইংরেজি ষড়যন্ত্রমূলক পোস্টার। একটার ওপর চোখ পড়তে রানা জানল, ইউএসএর বর্তমান প্রেসিডেন্ট আসলে ইবলিশের সন্তান। নইলে তার চোখ এত কুঁতকুঁতে হতো না! এ ছাড়া অন্য প্রমাণও আছে। শয়তানের সন্তান বলেই তার কান ছাগলের কানের মত খাড়া। বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে চাইতেই রানা দেখল, মেঝেতে সাপের মত অসংখ্য ইলেকট্রিক কেব্‌ল্।

‘হোঁচট খেয়ো না,’ সতর্ক করল বেযুখফ।

‘এখান থেকেই তোমার মহাবার্তা সম্প্রচার করো?’ একগাদা কমপিউটার ও নানান ধরনের যন্ত্রপাতি দেখছে রানা।

‘বিদ্যুৎ পেতাম বাড়ি থেকে। মাটির চার ফুট তলা দিয়ে এসেছে তার। এ ছাড়া, দুটো ব্যাকআপ জেনারেটরও আছে।’

‘তুমি তো খুব সতর্ক, তা-ই না?’ জানতে চাইল রানা। ‘অবশ্যই!’

‘তা হলে বলো তো, কী করে এই অচিন উপত্যকায় হাজির হলো অ্যাসল্ট টিম?’

‘আমিও অবাক হয়েছি। মাথায় কিছুই আসছে না!’

‘পরে ভেবে বের করতে হবে,’ বিড়বিড় করল রানা।

কুকুরের রোম ভরা পুরনো কয়েকটা কাপড় দিয়ে তৈরি গদির ভেতর শুয়ে পড়েছে টোমা। ট্রেইলারের দু’পাশের বেঞ্চির মাঝে নিকোলভকে সরাল রানা ও বেযুখফ। নড়তে শুরু করেছে এক্স এজেন্ট। কয়েক সেকেণ্ড পর পিটপিট করে চোখ মেলল সে। আবার বুজে ফেলল চোখের পাতা। কার্পেটে ছড়িয়ে পড়ছে রক্ত। বসে পড়ে নিকোলভের ফুটো হওয়া প্যান্টের পায়া ছিঁড়ল রানা। গভীর মনোযোগে দেখল ক্ষত। হাড়ে না লেগে মাংস ভেদ করে বেরিয়ে গেছে বুলেট। তবে জখমটা শুকাতে হলে সেলাই চাই। তা আপাতত সম্ভব নয়।

‘তোমার কাছে ফার্স্ট-এইড কিট আছে?’ বেযুখফের কাছে জানতে চাইল রানা।

‘অবশ্যই!’ পুরনো একগাদা পত্রিকা সরিয়ে প্লাস্টিকের একটা বাক্স বের করল সে।

ওটা খোলার পর রানা বুঝল, দরকারি সবই আছে কিটের ভেতর। জ্যাকেটের পকেট থেকে ফ্লাস্ক নিয়ে নিকোলভের ক্ষতে উইস্কি ঢালল ও। ভীষণ জ্বলে উঠতেই গোঙাল বেচারা। ফার্স্ট-এইড কিটে আছে লোকাল অ্যানেসথেটিক স্প্রে ও অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম। পায়ের দুই গর্তে একগাদা স্প্রে ও ক্রিম খরচ করল রানা। হাঁটু থেকে শুরু করে গোড়ালি পর্যন্ত ব্যাণ্ডেজ করে দিল। এখন ফিল্ড ড্রেসিঙেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। নিকোলভের ব্যথা কমে যেতেই ইউনাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা পেয়ে বসল তাকে।

‘ফিরে গিয়ে ওকে খুঁজে বের করব, নিকোলভ, ‘ জোর দিয়ে বলল রানা। ‘চিন্তা কোরো না।’

‘আমিও যেতে চাই,’ গুঙিয়ে উঠল নিকোলভ।

‘উপায় নেই।’ বেযুখফের দিকে তাকাল রানা। ‘আমি ত্রিশ মিনিটের ভেতর না ফিরলে বুঝবে এখান থেকে সরে যেতে হবে। তোমার অন্য কোনও আস্তানা আছে?’

‘বাদ দাও,’ বলল বেযুখফ। ‘মরে গেলেও কোথাও যাব না। আমার রেডিয়ো স্টেশন এখানে।’

‘পরে এ নিয়ে কথা হবে,’ বলল রানা। ‘মনে রেখো, বিপদে না পড়লে ফিরব আধঘণ্টার ভেতর।’

ট্রেইলার থেকে নেমে পড়ল রানা। অন্ধকার জঙ্গলে ফিরতি পথে চলেছে। কিছুক্ষণ পর পৌঁছুল গাছের শেষ সারির কাছে। শুনতে পেল হেলিকপ্টারের রোটরের ছন্দবদ্ধ আওয়াজ। উত্তরদিক থেকে আসছে অন্তত দুটো যান্ত্ৰিক ফড়িং। এখনও দূরে থাকলেও গতি দ্রুত।

তারের বেড়ার কাছে পৌঁছুল রানা। খোঁয়াড়ের ভেতর উত্তেজিত হয়ে তারস্বরে ডাকছে ছাগলের পাল। তারের বেড়া টপকে খামারের জমিতে পা রাখল রানা। ঘাপটি মেরে বসে চারপাশ দেখল। কোথাও নেই তানিয়া বা ইউনা। লেলিহান আগুনে পুড়ছে বেযুখফের বাড়ি। বাতাসে ঘন ধোঁয়া। আগুনের কমলা পটভূমিতে দেখা যাচ্ছে অ্যাসল্ট টিমের জীবিত ছয়-সাতজনকে। ব্যস্ত হয়ে ইকুইপমেন্ট ও লাশ সরিয়ে নিচ্ছে তারা। আগুনে পুড়ে যাওয়া মৃতদেহ নিয়ে তাদেরকে চিন্তিত মনে হলো না রানার। তাদের একজন কার সঙ্গে যেন আলাপ করছে রেডিয়োতে। এ ছাড়া, দু’তিনজন শুশ্রূষা করছে নিজ নিজ জখমের।

বসে থাকা লোকও গুলি করে খুন করতে পারে নিরস্ত্র যে- কাউকে। রানা বুঝে গেল, এখন এগোতে পারবে না।

যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে নিচে আলো ফেলল তিনটে হেলিকপ্টার। আগুন থেকে দূরে সরে, ভি-এর মত আকৃতি ধরে নামতে লাগল খামারের উঠানে। প্রচণ্ড হাওয়া রোটরগুলোর। পাগলা নাচুনি পেয়ে বসল কমলা আগুনের শিখাগুলোকে। নানাদিকে ছিটকে যাচ্ছে ধোঁয়া। উঠানের চারপাশে উজ্জ্বল সাদা আলো ফেলেছে সার্চলাইট। ছাগলের খোঁয়াড়ের কাছে লুকিয়ে আছে রানা। মুহূর্তের জন্যে দিনের মত আলোকিত হলো ওর চারপাশ। পরক্ষণে সরে গেল আলো। আবারও স্বাভাবিক হলো রানার হৃৎস্পন্দন।

হেলিকপ্টার নেমে আসতেই ওগুলোকে চিনতে পারল। ও-ক্যামোভ। ব্যবহার করে রাশান মিলিটারি। এই তিনটে কুচকুচে কালো। কোথাও কোনও মার্কিং নেই।

এসব উড়ন্ত যন্ত্রদানব স্পেশাল ফোর্সের, না অন্য কোনও সংগঠনের? ভাবল রানা। এরা যারাই হোক, শক্তি প্রয়োগে দ্বিধা করছে না। নিকোলভ আর ইউনাকে চাই তাদের। এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, বিশাল কোনও বিষয়ে জড়িত এরা। সন্ধ্যার পর বেযুখফ ও নিকোলভের কথা শুনে হেসেছিল রানা। এখন আর হাসতে পারছে না।

অ্যাসল্ট টিমের আরও লোক পৌঁছে দিচ্ছে তিন হেলিকপ্টার?

গলা শুকিয়ে গেল রানার।

সেক্ষেত্রে চারপাশে সার্চ করতে শুরু করবে এরা।

চুপ করে বসে হেলিকপ্টার দেখছে রানা। একটু পর স্বস্তির শ্বাস ফেলল। অ্যাসল্ট টিমকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্যে হাজির হয়েছে যান্ত্রিক ফড়িং। এক এক করে ওগুলোতে উঠে পড়ল আহত সৈনিকরা। চালের বস্তার মত জড় করে হেলিকপ্টারের মেঝেতে লাশ তুলল সুস্থরা।

রানা বুঝতে পারছে, এখানেই এর শেষ নয়। খেপে গেছে অ্যাসল্ট টিমের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। কীভাবে বিশজনের সৈনিক দল লড়াইয়ে হেরে গেল, তা মানতে চাইবে না। শাস্তি পাবে কেউ না কেউ। এরপর সৈনিকদের পাঠানো হবে পালে পালে।

কথাগুলো মাত্র ভেবেছে রানা, এমন সময় একটা দৃশ্য দেখে দুটো হৃৎস্পন্দন মিস করল ও। একটা হেলিকপ্টারে তুলে দেয়া হচ্ছে ছোট আকারের কাউকে। ছটফট করছে মানুষটা। রোটর ও টারবাইনের আওয়াজের ওপর দিয়ে এল চিলচিৎকার। ওই গলা ভাল করেই চেনে রানা।

ইউনা!

খামারে ওকে খুঁজে পাবার সব আশা দপ্ করে নিভে গেল রানার। বাচ্চা মেয়েটাকে পেয়ে গেছে সৈনিকরা। এখন বেচারি বন্দি, বা বলা চলে জিম্মি।

আড়ষ্ট হয়ে গেছে রানার হাত-পায়ের পেশি। ওর কাছে অস্ত্র থাকলেও কিছু করতে পারত না। দুর্ঘটনাবশত যে- কোনও সময়ে গুলি লাগতে পারে ইউনার গায়ে। রানার মনে হলো, দৌড়ে গিয়ে সৈনিকদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবে মেয়েটাকে। কিন্তু বাস্তবে যা ইচ্ছে করা যায় না। আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও লড়তে গিয়ে হয়তো মরত ও। চুপ করে হেলিকপ্টারের দিকে চেয়ে রইল রানা। ভাবছে, কীভাবে এ দুঃসংবাদ দেবে নিকোলভকে? বা ফ্রান্সে ফিরে কীভাবে মুখ দেখাবে তামারা বা তার চাচাকে?

হেলিকপ্টারে উঠেছে সবাই। ইঞ্জিনের রেভ বাড়িয়ে দিল তিন পাইলট। তীক্ষ্ণ হুঙ্কার ছাড়ছে টারবাইন। ঝাপসা হলো রোটর। যান্ত্রিক ফড়িঙের নাকে জ্বলে উঠল আলো। কয়েক সেকেণ্ড পর টেইল-এ। চকচকে ফিউজেলাজে খামারবাড়ির আগুনের প্রতিচ্ছবি।

অসহায় দৃষ্টিতে রানা দেখল, ভি ফর্মেশন ধরে রেখে ধোঁয়াময় আকাশে উঠছে তিন হেলিকপ্টার। কিছুক্ষণের ভেতর দূর থেকে দূরে হারিয়ে গেল যান্ত্রিক ফড়িং!

৩৩

ভারী হৃদয়ে বেযুখফের খামার ছাড়বে রানা, এমন সময় থমকে গেল ছাগলের খোঁয়াড়ের পাশে। ভীষণ ভয় পেয়ে তারের বেড়া ভেদ করে বেরোতে চাইছে ছাগলের পাল। সেইসঙ্গে করুণ ম্যা-ম্যা আর্তনাদ। শেষ এই খামার। জন্তুগুলো খোঁয়াড়ের ভেতর রয়ে গেলে পানি ও খাবারের অভাবে কষ্ট পেয়ে মরবে। গেটের ল্যাচ খুলে দিল রানা। কবাট সরিয়ে দিতেই হুড়মুড় করে বেরোতে লাগল অবলা প্রাণীগুলো। তিক্ত মনে ভাবল রানা, আজ রাতে অন্তত কাউকে রক্ষা করেছে ও।

ঘুরে তারের বেড়ার দিকে যেতে গিয়ে শুনল নিচু গোঙানি। ওটা ছাগলের কণ্ঠ চিরে বেরোতে পারে না।

ওই লোক অ্যাসল্ট টিমের। এরই মুখে সাবমেশিন গানের বাঁট দিয়ে গুঁতো দিয়েছিল রানা। অচেতন হওয়ার আগে তারের দেয়ালের কাছে সরেছে সে। জায়গাটা ছায়াময়। ঠিক সময়ে জ্ঞান ফেরেনি। তাকে খুঁজেও পায়নি তার কমরেডরা। উপুড় হয়ে পড়ে আছে সে। দৈর্ঘ্যে অন্তত ছয় ফুট পাঁচ ইঞ্চি। ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে সচেতন, সেই সঙ্গে বাড়ছে মুখের তীব্র যন্ত্রণা।

বুট ব্যবহার করে তাকে চিত করল রানা। ঠোঁট ও নাক ফেটে যাওয়ায় রক্তে ভেসে গেছে সৈনিকের মুখ। একটু দূরে ধুলোর ভেতর তার টেযার গান। রানা ভাবল, ইউনাকে নিয়ে গেছে এর সঙ্গীরা। এখন এর ওপর টেযার ব্যবহার করলে তার কেমন লাগবে?

এইমাত্র চোখ মেলেছে সৈনিক। কয়েক মুহূর্ত পর টের পেল, পাশেই এক লোক। হঠাৎ করেই সম্পূর্ণ সচেতন হলো সৈনিক। ঝট্ করে হাত বাড়াল ইউটিলিটি বেল্টের দিকে। ওখানে আছে তার পিস্তল। বুট দিয়ে সৈনিকের কবজি চেপে ধরল রানা। ঝুঁকে হোলস্টার থেকে নিল পিস্তল। না দেখেও স্পর্শ থেকে বুঝে গেল, অস্ত্রটা গ্লক সতেরো। ওজন বলে দিচ্ছে ফুল লোডেড। সৈনিকের মুখের দিকে পিস্তল তাক করল রানা। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল লোকটা। কাজটা অযৌক্তিক। ট্রেইণ্ড সৈনিক হয়েও ভাবছে তার হাতের তালু ভেদ করবে না নাইন এমএম বুলেট। তাকে খুন করার পরিকল্পনা নেই রানার। অন্তত এখন নয়। ঠিক করেছে, জরুরি কাজ করিয়ে নেবে তাকে দিয়ে।

তোমার বন্ধুরা ধরে নিয়েছে তুমি মারা গেছ,’ বলল রানা। ‘অথচ আজ রাতে কপাল ভাল ছিল তোমার।’

অস্ত্র তাক করে বাম হাতে লোকটার কবজি ধরল রানা। একটানে দাঁড় করিয়ে হাতটা মুচড়ে নিল পিঠের দিকে। ঘাড়ে ঠেকাল পিস্তলের মাযল। তারের বেড়ার দিকে নিয়ে চলল সৈনিককে। ‘একটু চালাকি করতে গেলেই খুন হবে,’ সতর্ক করল রানা।

আবছা আলোকিত তারের বেড়ার কাছে পৌঁছে গেল ওরা।

‘বেড়া টপকে পাঁচ ফুট দূরে থামবে,’ নির্দেশ দিল রানা।

লোকটা বেড়া পেরোবার পর নিজেও ওদিকে নামল রানা। টের পেল, হামলা করবে সৈনিক। তবে সে নড়ে ওঠার আগেই ঝট করে সামনে বেড়ে তার পেটে প্রচণ্ড এক লাথি লাগাল রানা। ঘোঁৎ করে উঠল সৈনিক। দু’হাতে চেপে ধরেছে পেট।

‘পরেরবার তেড়িবেড়ি দেখলে মাথায় ঢুকবে গুলি,’ বলল রানা।

‘ভাবছ মুখ খোলাতে পারবে?’ ফাটা ঠোঁট থেকে বেরোল জড়ানো স্বর। ‘সময় নষ্ট করছ। আমি কিছুই জানি না।

‘মুখ খোলাতে চাই, তা না-ও হতে পারে,’ বলল রানা, ‘হয়তো এক এক করে ভাঙব হাত-পা। সেটা তোমার ভাল লাগবে?’

‘আমি শুধু নির্দেশ পালন করেছি।’

‘ওই কথা সবাই বলে, অ্যান্থন।’

‘আমার নাম অ্যান্থন নয়।

‘তোমার নাম নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই,’ বলল রানা। ‘দরকারে ডাকব তাতিয়ানা বলে। এবার জঙ্গলে ঢোকো।’

সৈনিকের পিঠে পিস্তলের নল ঠেকাল রানা। মুচড়ে হাত তুলে দিয়েছে পিঠের ওপরের দিকে। ব্যথা পেয়ে কাতরে উঠল সৈনিক। কোনও উপায় না দেখে ধীর পায়ে ঢুকল জঙ্গলে। এখনও দাউ-দাউ করে জ্বলছে খামারবাড়ির আগুন। কিছুক্ষণ গাছের সারির মাঝ দিয়ে যাওয়ার পর ট্রেইলারের কাছে পৌঁছুল রানা ও সৈনিক। পায়ের নিচে মট্ করে ভাঙল শুকনো একটা ডাল। ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছে সৈনিক, কিন্তু রানা মুচড়ে ধরা হাতের চাপ বাড়িয়ে দেয়ায় গুঙিয়ে উঠল সে। যে- কোনও সময়ে ভাঙবে কাঁধের হাড়। ‘চাইলে চিৎকার করে কাঁদতে পারো,’ বলল রানা। ‘তবে বহু দূরে চলে গেছে তোমার বন্ধুরা। শুনবে না কেউ।’

কাছেই খচ-মচ শব্দ শুনেছে ও। পলকের জন্যে ভাবল, আশপাশেই আছে কুকুরটা? ট্রেইলার থেকে ওটাকে নামিয়ে দিয়েছে বেযুখফ?

তবে এবার চারপেয়ে নয়, জঙ্গলে ঢুকেছে দু’পেয়ে কেউ। দুটো পাইন গাছের মাঝ দিয়ে ছায়ামূর্তি আসতেই তার ওপর পড়ল চাঁদের রুপালি আলো।

‘তানিয়া!’ বিস্মিত হলো রানা। মেয়েটার নিচের ঠোঁটের বাম কোণে রক্ত। এ ছাড়া তাকে সুস্থ বলেই মনে হলো রানার। ‘কোথায় গেলে বুঝতে পারিনি। দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।’

‘চারদিকে গুলির আওয়াজ,’ বলল তানিয়া, ‘খুব ভয় পেয়েছি। কিন্তু সেসময়ে ধরে ফেলল একজন। তাকে ল্যাং মেরে দৌড়ে পালিয়ে যাই।’

মেয়েটার কণ্ঠ যেন ভেসে আসছে বহু দূর থেকে। রানার মনে হলো পুরো সচেতন নয় তানিয়া। মৃদু হাঁফাচ্ছে। চাঁদের আলোয় চকচক করছে ভেজা দু’চোখ। দৃষ্টি কেমন ফাঁকা। ভীষণ শক, ভাবল রানা। পিস্তল দিয়ে সামনের দিক দেখাল। ‘ওদিকে বেযুখফের ট্রেইলার। ওখানে পৌঁছে তোমার ফাটা ঠোঁটের ব্যবস্থা করব। এসো।’

‘এ… কে?’ বেসুরো কণ্ঠে জানতে চাইল তানিয়া।

রানার মনে হলো প্রথমবারের মত সৈনিককে দেখতে পেয়েছে মেয়েটা। ‘ও আমাদের নতুন সঙ্গী,’ বলল রানা।

নীরব থাকল তানিয়া।

কয়েক মিনিট পর ট্রেইলারের ভেতর জড় হলো ওরা পাঁচজন। সামনের বাঙ্ক এরিয়ায় নিকোলভকে বিছানায় বসিয়ে দিয়েছে বেযুখফ। রক্তশূন্য দেখাচ্ছে আহত এক্স এজেন্টকে। দু’হাতে ধরে আছে ব্যাণ্ডেজ করা পা।

‘তানিয়া হঠাৎ কোথা থেকে?’ জানতে চাইল বেযুখফ। ‘আর ওই ধেড়ে লোকটাই বা কে?’

ঠেলা দিয়ে সৈনিককে মেঝেতে বসাল রানা। ‘এ রাশান বডিবিল্ডিং ফেডারেশনের প্রাক্তন চ্যাম্পিয়ন। প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে হারিয়ে গেছে জঙ্গলে।’

মৃদু আলোয় ফাঁকা চোখে এদিক ওদিক দেখছে তানিয়া। একটা বেঞ্চে ওকে বসিয়ে দিল রানা। পরখ করল পাপড়ির রিফ্লেক্স ও পাস্। সব স্বাভাবিক বলেই মনে হলো ওর। ঠোঁটের ক্ষতটা দেখে বলল, ‘যা ভেবেছি, তার চেয়ে বেশি ফেটেছে। তবে সেলাই লাগবে না।’ কথাটা নরম সুরে বললেও মনে অনেক প্রশ্ন রানার।

হামলার সময় কোথায় ছিল তানিয়া?

কী করে পালিয়ে এল এত দূরে?

তবে এসব প্রশ্ন তোলার সময় এখন নয়।

ব্যথা-ভরা চোখে রানাকে দেখল নিকোলভ। ‘আমার মেয়ে? ও কোথায়? তুমি বলেছ লুকিয়ে আছে, ওকে নিয়ে আসবে। আরও বলেছ…’

চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। নিচু গলায় বলল, ‘খামারেই ছিল। তবে ওকে ধরে নিয়ে গেছে সৈনিকরা। কিছুই করতে পারিনি। সেজন্যে আমি দুঃখিত।’

দু’হাতে মুখ ঢাকল নিকোলভ। ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।

‘তুমি বুঝতে পেরেছ ইউনাকে নিয়ে কী করবে তারা?’ রাগী গলায় বলল বেযুখফ।

‘ওর ক্ষতি করবে না,’ বলল রানা, ‘ওদের কাছে ইউনা স্পেডের টেক্কা। ওর বাবাকে চায় তারা। তবে নিকোলভকে হাতে পাবে না।’

‘ভাব দেখে মনে হচ্ছে দারুণ কোনও পরিকল্পনা এঁটেছ,’ টিটকারির সুরে বলল বেযুখফ। ‘র‍্যাম্বোর মত ঝড়ের বেগে হাজির হবে তাদের আস্তানায়, তারপর সবাইকে মেরে-কেটে উদ্ধার করে আনবে মেয়েটাকে?

‘কী করব এখনও ঠিক করিনি,’ বলল রানা। ‘তবে ধরে নাও, ভাল থাকবে ইউনা। এবার এখান থেকে সরে যেতে হবে আমাদের।’

‘এখানেই ভাল আছি,’ এপাশ ওপাশ মাথা দোলাল বেযুখফ, ‘কেউ খুঁজে পাবে না এই ট্রেইলার।’

‘ভুল, বেযুখফ,’ বলল রানা, ‘খামারে কপালের জোরে বেঁচে গেছি। কিন্তু এরপর ওরা আসবে অনেক সতর্ক হয়ে। সংখ্যায় হবে আরও বেশি। সময় নেবে না হাজির হতে।’

‘কপাল ভাল কোথায় দেখলে?’ ক্লান্ত, ভাঙা কণ্ঠে বলল নিকোলভ। ‘আমার মেয়েটাকে নিয়ে গেল। এটাকে বিজয় মনে হচ্ছে তোমার?’

‘সব তো এখনও শেষ হয়নি, নিকোলভ।’

‘আমি এখান থেকে এক পা-ও নড়ব না,’ দু’হাতে চারপাশ দেখাল বেযুখফ। ‘এই ট্রেইলার আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়।’

‘সেক্ষেত্রে মরবেও এখানে,’ বলল রানা, ‘পাগলামি না করে অবস্থা বোঝার চেষ্টা করো। ওরা জানে তুমি কোথায় আছ। কখনও ফিরতে পারবে না ফার্মে। হয়তো পালিয়ে বেড়াতে হবে বাকি জীবন।’

বেল্ট থেকে পিস্তল নিয়ে ম্যাগাযিন বের করে বুলেট গুনল রানা। ম্যাগাযিনে সতেরোটা গুলি। চেম্বারে একটা। প্রতিটা তামার জ্যাকেট পরা হলোপয়েন্ট নাইন এমএম কার্ট্রিজ। একবার শরীরে ঢুকলে ছড়িয়ে পড়বে মাশরুমের মত। সর্বনাশ হবে দেহের ওই অংশের। মাত্র আঠারোটা বুলেট দিয়ে বড় কোনও সৈন্যের দলকে ঠেকাতে পারবে না ও।

‘কিন্তু ওরা জানল কীভাবে আমরা এখানে?’ বিড়বিড় করল বেযুখফ। ‘কী করে!’

‘জানা নেই,’ বলল রানা। ‘তবে মনে হচ্ছে এ প্রশ্নের জবাব জানে রাশান বডিবিল্ডিং ফেডারেশনের প্রাক্তন চ্যাম্পিয়ান।’ পিস্তলের নল দিয়ে মেঝেতে বসে থাকা সৈনিককে দেখাল ও।

‘আগেই বলেছি, কিছুই জানি না,’ তিক্ত কণ্ঠে বলল লোকটা। ভাঙা নাকের ব্যথায় ট্রেইলারের ছাত ফুঁড়ে বেরোতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।

তাকে বাপ-মা তুলে গালি দিতে লাগল বেযুখফ। ‘কুত্তার বাচ্চা, সবই জানিস! আমার হাতে পড়লে পাঁচ মিনিটে বাপ- বাপ করে সবই বলবে হারামজাদার বাচ্চা!’

কথাটা বিশ্বাসযোগ্য লাগল না রানার কাছে। নাক ভেঙে গেছে, কয়েকটা দাঁতও নেই দানবের, তবে একবার আনফিট বেযুখফকে হাতের নাগালে পেলে পিটিয়ে আলুভর্তা বানাতে তার লাগবে বড়জোর পাঁচ সেকেণ্ড।

‘তুমি বরং ভেবে বের করো, এবার এখান থেকে কোথায় যাব,’ বলল রানা, ‘নিশ্চয়ই আশপাশে কোনও গ্রাম বা ট্রেডিং পোস্ট আছে? যেখান থেকে রসদ সংগ্রহ করো তুমি। গাড়িও থাকবে ওখানে। তবে তার আগে দরকার নিরাপদ আশ্রয়।’

‘গাড়িতে করে গেলে সবচেয়ে কাছের গ্রাম এখান থেকে পুরো একঘণ্টার পথ,’ বলল বেযুখফ, ‘আমরা আছি জনশূন্য পাহাড়ি, জঙ্গুলে এলাকায়। এজন্যেই এই জায়গা বেছে নিয়েছিলাম।’

‘এটা তো আর সাইবেরিয়া নয়,’ বলল রানা, ‘একেবারে জনশূন্য হয় কী করে?’

কী যেন ভাবতে লাগল বেযুখফ। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘হ্যাঁ, যাওয়া যেতে পারে পিতরের খামারে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে হবে ছয় বা সাত মাইল।’

‘মাঝরাতে আমাদেরকে দেখে বিরক্ত হবে না?’ জানতে চাইল রানা।

‘আপত্তি তুলবে না,’ বলল বেযুখফ। ‘মরেছে গত মার্চ মাসে। তার বউটা ফেঁসেছে ষোলো বছর আগে। বুড়োর আর কেউ ছিল না। প্রায় এক শ’ বছর বেঁচেছে। এখন খালি পড়ে আছে তার খামার।’

‘কোনও ভুল করছ না তো?’

‘মনে তো হয় না। শুনিনি যে কেউ ওই খামার কিনেছে।’

‘তা হলে ওখানেই যাব,’ বলল রানা, ‘শুশ্রূষা করতে হবে নিকোলভের। ওখানে দরকারি কিছু জিনিসপত্রও হয়তো পেয়ে যাব। হয়তো আছে গাড়ি। সেক্ষেত্রে ওটাতে করে দূরে কোথাও চলে যেতে পারব। তবে আগে চাই নিরাপদ ঠাঁই। এরপর যাব ইউনাকে কেড়ে আনার জন্যে।’

মেয়েকে হারিয়ে কথা বলার সাধ্য নেই নিকোলভের। বোকার মত থম মেরে বসে আছে তানিয়া। যেন খেয়াল নেই কোনওদিকে। রানার পরিকল্পনা শুনে বিমর্ষ হয়ে গেছে বেখফ। আপত্তির সুরে বলল, ‘জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পিতরের খামারে যেতে অনেক কষ্ট হবে। দেখতেই তো পাচ্ছ, রানা, ঘোরের ভেতর চলে গেছে সুন্দরী মেয়েটা। এক বোতল ভোদকা খেলেও এমন হয় না। তার ওপর নিকোলভ আহত। ও তো হাঁটতেই পারবে না। এদিকে ছেড়ে যেতে পারবে না হারামজাদা দৈত্যটাকে। যাওয়ার পথে যে-কোনও সময়ে আমাদের ওপর হামলা করবে সে। সব বিবেচনা করে মনে হচ্ছে, অর্ধেক পথও পাড়ি দিতে পারব না আমরা।’

তানিয়া সম্পর্কে কিছু বলল না রানা। মেয়েটা যেন তলিয়ে গেছে অদ্ভুত নীরব কোনও স্বপ্নের ভেতর। অন্য দু’জনের জন্যে আলাদা পরিকল্পনা আছে রানার। সেটাই বলল এবার, ‘রাশান সৈনিক বড়সড় দানব। ও হবে মালবাহী খচ্চর। দৈত্যের কাঁধে চেপে আরাম করে পাশের খামারে পৌঁছুবে নিকোলভ।’

৩৪

রাতের ঘুটঘুটে আঁধারে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে যেতে যেতে মনে হচ্ছে যেন এটাই ওদের শেষযাত্রা। বিরক্তি নিয়ে আগে আগে হাঁটছে বেযুখফ। হাতে জ্বলন্ত লণ্ঠন। চারপাশের গাছে তৈরি হচ্ছে বিকট সব ভীতিকর ছায়া। সবসময় পথ চিনে এগোতে পারছে বেযুখফ, তাও নয়। বারবার থেমে বুঝে নিচ্ছে কোন দিকে চলেছে। প্রথম কিলোমিটার পেরোতেই আগের চেয়েও দুর্ভেদ্য হয়েছে গভীর অরণ্য।

প্রথমে অন্যের ঘাড়ে চেপে যেতে রাজি হয়নি নিকোলভ। আর আহত লোককে ঘাড়ে নিয়ে এতদূর হাঁটতে হবে শুনে নিকোলভের চেয়েও বেশি আপত্তি তুলেছে দৈত্যাকৃতি সৈনিক’। তবে গুলি ভরা পিস্তলের মাহাত্ম্যই আলাদা। ওটার জন্যে ভারী বোঝা বইতে রাজি হয়েছে শেষে। তানিয়ার পেছনে হাঁটছে রানা। ভাবছে, হঠাৎ কী হলো মেয়েটার?

পিছু নিয়েছে টোমা, মাঝে মাঝে থেমে চাপা ঘড়-ঘড় আওয়াজ ছাড়ছে। এমন কিছু টের পাচ্ছে, যেটা অন্যদের নাক-চোখ এড়িয়ে গেছে। কয়েক দিন আগে পত্রিকায় দেখেছে রানা, পুব ইউরোপে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে নেকড়ের সংখ্যা। তবে এই গভীর জঙ্গলে ওগুলোকে দেখা যায়নি। পনেরো মিনিট পর বিশ্রামের সুযোগ দেয়া হলো রাশান সৈনিককে। যাত্রা বিরতির সময় গাছের কাণ্ডে পিঠ ঠেকিয়ে টোমাকে আদর করতে লাগল নিকোলভ। মনের গভীরে তলিয়ে গেছে নিশ্চুপ তানিয়া।

ট্রেইলার ত্যাগের প্রায় দু’ঘণ্টা পর আকাশ থেকে মুছে যেতে লাগল রাশি রাশি নক্ষত্র। ধূসর হচ্ছে চারপাশ। তারও কিছুক্ষণ পর গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল পুবের আকাশ হয়ে উঠছে রক্তবর্ণ। একটু পর ওরা পৌঁছে গেল পিতরের পরিত্যক্ত খামারে। ধীরে ধীরে ওটাকে ঘিরছে হরিৎ জঙ্গল। গোরস্তানের মত খাঁ-খাঁ করছে চারপাশ। খামারবাড়ি বলতে ছাড়াছাড়াভাবে তৈরি কয়েকটা কুঁড়ে ঘর। উঠান ভরা ঝোপঝাড় ও ঘাসের ভেতর দিয়ে সবচেয়ে বড় ঘরের দিকে চলল বেযুখফ। তার খামারবাড়ির চার ভাগের এক ভাগ হবে এই বাড়ি। দশ শতাব্দীর কোনও তপস্বী এটা তৈরি করেছে বলে মনে হলো রানার। শিকার ধরে চলত তার জীবন। খুঁজে নিত ফলপাকুড়। শীতের হাওয়া ঠেকাবার জন্যে ব্যবহার করত কুঁড়ে ঘরের দেয়ালে শুকনো গোবরের চাপড়া। ছন দিয়ে তৈরি ছাত।

‘সাবধান,’ পর্ণকুটিরের কাছে পৌঁছে সতর্ক করল বেযুখফ। ‘বারান্দার অনেকগুলো তক্তা নষ্ট।’

কমই বলেছে রাশান। এমন কী টোমার ওজনও নেবে না পচা কাঠ। বড় ঘরের চারপাশে হাজারো আবর্জনা। বহু বছর এখানে বাস করেছে পিতর এবং তার স্ত্রী, কখনও বিদ্যুতের সংযোগ নেয়নি। একই ঘরে শোবার ও খাবারের ব্যবস্থা। এখানেই হয়তো মারা গেছে পিতর। ঘরের প্রতিটি কোণে মোমবাতি। লাইটার দিয়ে ওগুলো জ্বেলে দিল রানা। এখন ওর প্রথম কাজ হচ্ছে বন্দিকে বেঁধে রাখা। হলদে আলোয় নোংরা এক নাইলনের ফিতা পেয়ে, ওটা দু’টুকরো করে রাশান সৈনিকের হাত-পা বাঁধল রানা। ঘরের কোণে বসে বিড়বিড় করে গালি দিতে থাকল লোকটা। সরে আসার সময় তাকে বলল রানা, ‘আমার কাজ এখনও শেষ হয়নি।

বেশ কিছুক্ষণ কসরত করে প্রাচীন লোহার চুলো জ্বালল ও। শীতকালে চুলো ব্যবহার করেই গরম করা হতো ঘর। আগুন জ্বলছে বলে ঘর থেকে বিদায় হবে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। তবে জ্বালানী কাঠ ভেজা। তৈরি করছে প্রচুর ধোঁয়া। সবার দম আটকে আসছে বলে জানালা খুলে দিল রানা। এবার দেখতে হবে নিকোলভকে কিছুটা হলেও আরাম দেয়া যায় কি না। ভীষণ ব্যথার ভেতর আছে সে। কপাল ভাল, আসার সময় বেযুখফের ফার্স্ট এইড বক্সটা এনেছে ওরা। নিকোলভের কাফ মাসলে গুলি ঢোকার ও বেরোবার গর্তে আবার লোকাল অ্যানেসথেটিক স্প্রে করল রানা। বেচারাকে দিল দুটো পেইনকিলার। ব্যথা একটু কমলে সাবধানে শুরু করল ক্ষতের সেলাই। কাজ শেষ করে নিকোলভকে বলল, ‘সুন্দর পায়ের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে বাদ পড়লেও ডাক্তারের কাছে নেয়া পর্যন্ত ভালই থাকবে।’

‘পা খসে গেলেও কিছু না,’ বলল নিকোলভ। ‘আমি যার জন্যে বেঁচে ছিলাম, সেই ইউনাকেই তো হারিয়ে ফেলেছি।’

‘হাল ছেড়ো না, বন্ধু,’ বলল গম্ভীর রানা। ‘ঠিকই ওকে খুঁজে বের করব। কেড়েও আনব ওদের কাছ থেকে। শপথ করলাম, নিকোলভ, কোনও ক্ষতি হতে দেব না ইউনার।’

‘বন্ধু, এমন শপথ কোরো না, যেটা রাখতে পারবে না,’ বলল নিকোলভ।

তার কথা ছুরির মত কতটা গভীরে বিঁধেছে রানার মনে, সেটা সে জানেও না। আস্তে করে নিকোলভের কাঁধ স্পর্শ করল রানা। ‘একটু বিশ্রাম নাও।

নিকোলভকে রেখে তানিয়ার সামনে থামল রানা। আগের চেয়েও নীরব হয়েছে মেয়েটা। চুপ করে বসে আছে বুড়ো পিতরের প্রাচীন আর্মচেয়ারে। আসবাবপত্র হিসেবে ঘরে রয়েছে মাত্র দু’চারটে জিনিস। একদৃষ্টিতে জানালা দিয়ে চেয়ে আছে তানিয়া। পাপড়ি পড়ছে না চোখে। জঙ্গলে গাছের মাথায় উঠেছে ঘোলাটে, ম্লান সূর্য। রানার মনে হলো, ঠিকভাবে শ্বাসও নিচ্ছে না মেয়েটা। পাশে থেমে মন দিয়ে তাকে দেখল ও। বিপরীত দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছে বেযুখফ। মুগ্ধ চোখে দেখছে সুন্দরী তানিয়াকে।

ফিসফিস করে মেয়েটার কানের কাছে বলল রানা, ‘তুমি ঠিক আছ তো?’

‘ঠিক আছি,’ অস্পষ্ট স্বরে বলল তানিয়া।

‘ঘরে কফি বা চা পেলে তৈরি করে দেব?’

‘না।’ জানালা দিয়ে চেয়ে রইল মেয়েটা। ‘আমাকে একা থাকতে দাও।’

রানা সোজা হতেই ওর চোখে চোখ পড়ল বেযুখফের। দ্বিধা নিয়ে মাথা নাড়ল রাশান। জবাবে কাঁধ ঝাঁকাল রানা।

কখন যেন দলনেতা হিসেবে ওকে মেনে নিয়েছে সবাই। কয়েকটা মেয়াদোত্তীর্ণ টিনজাত খাবার পেল রানা। চুলার ওপর চাপিয়ে নিল একটা গামলা। টিনের খাবার ঢালল ওটার ভেতর। কিছুক্ষণ আগুনে সেদ্ধ করার পর তৈরি হলো মাংসের স্টু। নানা ডিযাইনের পাঁচটা তোবড়ানো পাত্রে খাবার ঢালল রানা। প্রত্যেকের হাতে তুলে দিল বাসন ভরা থকথকে জিনিসটা। ঠিক করেছে চোখা কিছুই দেবে না রাশান সৈনিককে। সে ছাড়া অন্য সবাই পেল কাঁটা চামচ।

‘ওই হারামজাদাকে খাবার দিলে কেন?’ বিরক্ত হয়ে বলল বেযুখফ।

তাকে পাত্তা না দিয়ে সৈনিকের কবজির বাঁধন খুলল রানা। ‘দিলাম, কারণ আমাদের দেশের আর্মিতে বন্দিদেরকে না খাইয়ে রাখে না। তা ছাড়া, ওর আলাদা কাজ আছে।’

‘আমি হলে তো গুলি করে মেরে ফেলতাম।’

‘তা হলে গুলি করো।’

‘আমি তো মানুষ খুন করি না। ওই কাজ তোমার।’

‘কীভাবে গুলি করতে হয়, ভুলে গেছি,’ বলল রানা। ‘যা করার তুমি করো। তোমার তো ধারণা আমাদের ভেতর সবচেয়ে বুদ্ধিমান তুমি।’

কিছুই খেল না নিকোলভ। তার বাসনের খাবার চেটেপুটে সাবড়ে দিল টোমা। নিজের বাসনের দিকে চেয়েও দেখল না তানিয়া। নেকড়ের মত গপ-গপ করে স্টু শেষ করল বেযুখফ ও রাশান সৈনিক। খাবার শেষে আবারও বন্দির হাত বাঁধল রানা। নিজেও বসে পড়ল পাশে। ‘তুমি চাইলে সহজ হবে আমার কাজ। সেক্ষেত্রে আমিও সহজ আচরণ করব।’

ঘাড় কাত করে রানাকে দেখল রাশান সৈনিক। ‘তারপর? ছেড়ে দেবে আমাকে?’

‘হয়তো প্রাণে বাঁচবে। তবে মুখ না খুললে তোমার ওপর নামবে ভয়ঙ্কর নির্যাতন।’

‘আমি কিন্তু তোমাকে ভয় পাই না,’ বলল সৈনিক।

বন্দিকে নিয়ে কী করবে, ভাবছে রানা। এ সাধারণ সৈনিক। অফিসার কোনও বিষয়ে ব্যাখ্যা দেবে না তাকে। নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে। প্রশ্ন তোলার অধিকার নেই। শক্ত নাটবল্টুর মত এক লোক। তবে সম্ভাবনা খুব বেশি, প্রায় কিছুই জানে না সে। সেক্ষেত্রে নির্যাতন করেও লাভ হবে না। মাঝখান থেকে পঙ্কিল হবে নিজের মন। দ্বিধার পাঁকে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে রানা।

‘চাইলে গুলি করো, ওর বেল্টে গোঁজা পিস্তল দেখাল সৈনিক। ‘মরতে ভয় পাই না।’

‘বুলেটের চেয়েও খারাপ কিছু আছে, সেটা বোঝো? এক সময়ে তো ছিলে রেগুলার আর্মিতে।’

‘স্পেনায জিআরইউ। ফোর্টি-ফিফ্থ্ গার্ডস্ স্পেশাল পারপাস ব্রিগেড। আবখাযিয়ায় লড়াই করেছি।’

‘আমিও আর্মিতে ছিলাম,’ বলল রানা। ‘তবে পরে জোর করে অবসর দিয়ে দিল। …জানতে চাও কারণটা?’

কৌতূহলী চোখে ওকে দেখল সৈনিক। চুপ করে আছে।

‘সিরিয়ান আর্মির হয়ে যখন যুদ্ধ করছি, সে সময় ধরা পড়ল আইএস-এর কয়েকজন। তাদের বড় একটা দল ছিল পাহাড়ে। তাদের ব্যাপারে জরুরি তথ্য চাইছিলাম। কিন্তু মুখ খুলল না ওরা। তখন রাতে গোপনে গিয়ে ঢুকলাম ওদের দু’জনের সেল-এ। এরপর থেকেই আমার ডাক নাম চালু হলো। ওটা কী, সেটা জানতে চাও?’

ঢোক গিলে মাথা নাড়ল রাশান সৈনিক।

‘নামটা হয়ে গেল কাবাবওয়ালা। ওদের দু’জনের নাড়িভুঁড়ি বের করে নিলাম। সব পড়ে ছিল মেঝেতে। এরপর চালু করলাম আমার জেটবয়েল স্টোভ। তার ওপর চাপিয়ে দিলাম কয়েক পাউণ্ড ভুঁড়ি। শুয়োরের বাচ্চারা তখনও বেঁচে। নাড়িভুঁড়ি ভাজছি আপন মনে, একটু পরেই ফুটতে লাগল ফট-ফট আওয়াজে। ভাবতেও পারবে না সে কী দুর্গন্ধ! ভেবে দেখো, এরপর কী করেছি!’

অন্যদিকে তাকাল প্রাক্তন সৈনিক।

ঘরের আরেকদিক থেকে রানার দিকে চেয়ে আছে বেযুখফ। বেসুরো কণ্ঠে বলল, ‘কাবাবওয়ালা?’

‘একবার ভাবো দৃশ্যটা,’ নির্বিকার কণ্ঠে বলল গম্ভীর রানা। চাপাবাজির নিদর্শন তৈরি করছে। দেখছে, মৃদু হাঁ করে ওর কথা গিলছে লোকটা। মনের চোখে দেখছে, একটু পর কী ঘটবে তার জীবনে। চোয়ালে চোয়াল চিপে রানাকে দেখছে। টপটপ করে কপাল ও ভুরু থেকে পড়ছে ঘামের ফোঁটা।

‘কথা তুমি ঠিকই বলবে,’ ধীর গতিতে বলল রানা। ‘তাতে ভুল নেই।

চোখ বুজল রাশান। ঘন ঘন ঢোক গিলল ক’বার, তারপর আবারও চোখ মেলল। চোখে স্পষ্ট ভয়। বিড়বিড় করে রানাকে বলল, ‘আমি সরকারের হয়ে কাজ করি।’

‘এই তো মুখে বোল ফুটেছে,’ বলল রানা, ‘ব্রাঞ্চের নাম বলো। কোন্ এজেন্সি?’

মাথা নাড়ল প্রাক্তন সৈনিক। কুলকুল করে ঘামছে। চোখে আতঙ্ক। মুখ খুলেছে বলে তার দলের লোক কতটা নির্যাতন করবে, সেটা ভুলে গেছে কাবাবওয়ালার বর্ণনা শুনে। অথবা, আসলে তেমন কিছুই জানে না সে। সাধারণত আর্মি থেকে অবসর নেয়া সৈনিক কাজ করে নগদ টাকার বিনিময়ে। বেশিরভাগ সময় দেখা যায় অচেনা কোনও ভ্যান তুলে নিচ্ছে তাদেরকে। কাজ শেষে আবারও ডাক পড়ার অপেক্ষা। এরা বেশি কিছু জানতে চায় না। তাতে কমে খুন হওয়ার ঝুঁকি।

‘তুমি কাজ করো ভ্যানকিন কাপরিস্কির হয়ে?’ জানতে চাইল রানা।

‘হয়তো। জানি না। যা বলেছে, করেছি।’ জানালার দিকে তাকাল প্রাক্তন সৈনিক। ‘আমাদেরকে বলেছিল ওই বাড়িতে আছে একদল টেরোরিস্ট। আর কিছুই জানি না, ‘কসম!’

‘টেরোরিস্ট?’ নিষ্ঠুর হাসল রানা। ‘ওখানে ছিল বারো বছরের অসহায় এক মেয়ে আর তার বাবা। ভয়ে আগেই অর্ধেক মরে গেছে ওরা।’ বেযুখকে দেখাল রানা। ‘আর এর ব্যাপারে কী বলেছে? ওকে দেখে টেরোরিস্ট মনে হচ্ছে তোমার? ওই লোক তো খোঁড়া একটা ইঁদুরকেও ভয় দেখাতে পারবে না।’

কথাটা শুনে ভুরু কুঁচকে গেল বেযুখফের। দ্বিধা নিয়ে বলল, ‘আরে, এসব কী! বাজে কথা বলবে না!’

ওরা বলেছিল, ওখানে আছে ভয়ঙ্কর এক লোক,’ বলল প্রাক্তন সৈনিক। ‘তার চেয়ে খারাপ কেউ হতে পারে না। মার্সেনারি। ভয়ঙ্কর খুনি। সে নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর লোক। খুন করেছে শত শত মানুষকে। আরও বলেছে, একটু ভুল হলেই খুন হব। সেজন্যেই জড় করেছিল এতজনকে।’

চোখ সরু করল রানা। ‘কারও নাম বলেনি ওরা?’

জানালার দিক থেকে চোখ সরিয়ে রানার চোখে তাকাল প্রাক্তন সৈনিক। ‘হ্যাঁ, বলেছে। তার নাম মাসুদ রানা। আর আমার মনে হচ্ছে তুমিই সেই লোক।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *