এক্স এজেন্ট – ৫৫

৫৫

রানা টান দিয়ে ভাঙা দরজাটা খুলতেই দেখল লোকটার দেহ ভেসে যাচ্ছে তাজা রক্তে। ‘ফুর্তি করবে না, কর্নেল?’ শোফেল্ডের মুখে আলো ফেলল ও।

‘আমার পা,’ গুঙিয়ে উঠল লোকটা। ‘দুটো পা-ই ভেঙে গেছে।’

‘পা দিয়ে কী করবে?’ বলল রানা। ‘যেখানে, যাচ্ছ, ওখানে ওগুলো লাগবে না।’

কাঁপা হাত তুলে ককিয়ে উঠল শোফেল্ড, ‘সাহায্য করো।’

‘মানুষ তো মানুষেরই জন্যে- এ ধরনের কিছু বাণী শোনাতে চাও?’

আরও বাড়ছে অকটেনের গন্ধ। গাড়ির ভেতর পুড়ছে তারের প্লাস্টিক আবরণ। কিছুক্ষণ পর অকটেনের কাছে পৌঁছুবে আগুনের ফুলকি। দাউদাউ শিখার সময় লাগবে না গাড়িটা গিলে নিতে। এটা বুঝতে পেরেছে বলেই নরম হয়েছে শোফেল্ড।

‘আমাকে বের করো, প্লিয,’ বলল সে, ‘এটা যে-কোনও মানুষের কর্তব্য।’

‘কর্তব্য?’ তিক্ত হাসল রানা।

‘এটা এক যোদ্ধার কাছে আরেক যোদ্ধার দাবি,’ করুণ সুরে বলল শোফেল্ড। থরথর করে কাঁপছে হাতের পাঁচ আঙুল। চোখে আলো পড়ছে বলে চোখ বুজল। ‘আমি হলেও আগুনের হাত থেকে তোমাকে বাঁচাতাম।’

‘আগে কখনও বুঝিনি তুমি এত দয়ালু,’ বলল রানা।

তীব্র ব্যথায় ফুঁপিয়ে উঠল শোফেল্ড। কুঁচকে গেল চেহারা। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘ঈশ্বরের দোহাই, রানা! আমাকে যা বলা হয়েছে, শুধু তা-ই করেছি! আমার কিছু করার ছিল না!’

‘বুঝলাম,’ বলল রানা। ‘তবে এখানে নেমেছি তোমার প্রস্তাবের ব্যাপারে আমার জবাবটা জানাতে, তোমাকে সাহায্য করতে নয়।’

‘জানি, মানা করে দেবে তুমি,’ হাসতে চাইল শোফেল্ড। প্রচণ্ড ব্যথা সহ্য করতে গিয়ে হাসিটা হলো ভেঙচির মত।

‘মানুষের, জীবনে আসে নানান প্রস্তাব,’ বলল রানা, ‘আমারও একটা প্রস্তাব আছে। সেটা শুনতে চাও?’

মাথা দোলাল শোফেল্ড।

‘কথা বলতে চাই ফ্লেয়ার অপারেশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে।’

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল প্রাক্তন কর্নেল। ‘সে উপায় নেই।’

গাড়ির পাশে উঠে দাঁড়াল রানা। ‘ঠিক আছে, তা হলে বিদায়।’

‘একমিনিট!’

‘কিছু বলবে?’

হিসহিস করে বলল শোফেল্ড, ‘কী চাও?’ গাড়ির বনেট থেকে উল্টে যাওয়া কেবিনে ঢুকছে বিশ্রী গন্ধের ধোঁয়া।

‘তোমার মোবাইল ফোনটা দাও,’ বলল রানা। ‘যেটা দিয়ে বসের সঙ্গে কথা বলো। তারপর দেবে তার নাম্বার।’

‘তারপর কী করবে?’

‘তখন ভাবব তোমাকে সাহায্য করা যায় কি না।’

কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল লোকটা, তারপর পকেট থেকে বের করল মোবাইল ফোন। বুড়ো আঙুল দিয়ে অ্যাকটিভ করল স্ক্রিন। স্ক্রল করল নাম্বারের মেন্যু। সঠিক নাম্বার পাওয়ার পর রানার দিকে বাড়িয়ে দিল মোবাইল ফোন। ‘নাও! এবার আমাকে বের করো এখান থেকে!’

‘একটু পরেই তোমাকে বের করে ওপরে নিয়ে যাওয়া হবে, কর্নেল,’ শোফেল্ডের ফোনটা নিয়ে ডাক্তার নেবেসার ফোন পকেটে পুরল রানা। উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্ট থেকে ঝেড়ে নিল ধুলো।

অন্ধকারে মার্সিডিযের ভেতর ভীষণ ভয় লাগছে শোফেল্ডের। আতঙ্ক ভরা কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে ফেলে কোথায় যাচ্ছ, রানা?’

‘একটা কল করতে,’ বলল রানা।

ধোঁয়ায় ভরে উঠছে গাড়ির ভেতর। চোখ জ্বলছে। বুঝতে পেরেছে, মৃত্যু আর দূরে নেই। ব্যর্থতা ও তীব্র ব্যথায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল প্রাক্তন কর্নেল।

খাদের ঢালু অংশের দিকে চলেছে রানা। দূর থেকে এল ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ির সাইরেন। সাহসী মানুষগুলো চলেছে আণ্ডারপাসের দিকে। পুলিশ খুঁজছে অপরাধীদেরকে। বহু দূরে রাতের আকাশ চিরে দিচ্ছে কপ্টারের উজ্জ্বল আলো।

মার্সিডিয়ের ভেতর হাউমাউ করে উঠল শোফেল্ড, ‘রানা! ভাই আমার! আমাকে বের করো! বাঁচাও!’

বড়জোর তিন মিনিট, তারপর আগুনে পুড়বে গাড়ি। রানা আশা করছে, তার আগেই শেষ হবে চেয়ারম্যানের সঙ্গে ওর আলাপ। কল-রেকর্ডিং চালু করে বোতামে চাপ দিল ও। কয়েক মুহূর্ত পর ফোনে শুনল ভারী পুরুষ কণ্ঠ: ‘হ্যালো।’

‘আমি কি চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে পারি?’ জানতে চাইল রানা।

‘আপনি কে?’ জানতে চাইল লোকটা। কণ্ঠ গুরুগম্ভীর।

‘আমার নাম মাসুদ রানা,’ বলল বিসিআই এজেন্ট। ‘আপনি ভাল করেই জানেন আমি কে। আর আমিও জানি আপনি কে। সুতরাং সরাসরি আসছি কাজের কথায়।’

‘বলুন,’ বলল লোকটা।

‘আপনাদের এস. এম. ৬১৪৩ ডিভাইসের কারণে জানতে পেরেছি ফ্লেয়ার অপারেশন সম্পর্কে। আমি মুখ খুললে ভাল ধরনের ঝামেলায় পড়বেন আপনারা।’

‘বলুন, আমি শুনছি।’

এবার শুনুন আমার দুটো প্রস্তাব,’ বলল গম্ভীর রানা। ‘সহজ শর্ত। ভবিষ্যতে ফুলের টোকাও দেবেন না অ্যান্টোনিন নিকোলভ এবং তার মেয়ে ইউনার গায়ে। যদি তেমন কিছু করেন, ধরে নেবেন আপনি হাত ভরে দিয়েছেন চুলোর আগুনে। রক্ষা পাবে না দলের কেউ।’

‘বুঝলাম,’ বলল চেয়ারম্যান, ‘তার মানে এককথায়: ওদের দু’জনকে বিরক্ত করব না আমরা। সেক্ষেত্রে আমাদেরকেও বিরক্ত করবেন না আপনি।’ মৃদু হাসল বয়স্ক লোকটা। ‘কিন্তু কেন ভাবছেন আপনার কথা আমরা মেনে নেব? আপনি তো মাত্র একজন লোক।’

‘আপনিও একজনই। কাজ মাত্র শুরু করেছি আমি,’ বলল রানা। ‘এবার আমার দ্বিতীয় প্রস্তাব: এই মুহূর্তে বন্ধ করবেন এ সংক্রান্ত আপনাদের সমস্ত কর্মকাণ্ড। নইলে এক এক করে কাটা পড়বে আপনাদের সংগঠনের বড় বড় মাথাগুলো। শুরু হবে আপনাকে দিয়ে।’

‘হুমকি দিচ্ছেন?’

‘তা তো দেবই। আমাদের প্রতিটা কথা রেকর্ড হচ্ছে আমার মোবাইলে। প্রয়োজনে ব্যবহার করব আমি এটা। যদি সামান্য একটু এদিক ওদিক দেখি, আপনার লেজে আমি আগুন লাগিয়ে দেব। দুনিয়ার প্রতিটা পত্রিকায় বিস্তারিত ছাপা হবে সব।’

ওদিকে নীরবতা। পেরোল একমিনিট। রানা ভাবতে শুরু করল, ডেড হয়ে গেছে লাইন। কিন্তু তখনই শান্ত স্বরে বলল চেয়ারম্যান, ‘আপনি সরাসরি কথা বলতে অভ্যস্ত, রানা। আমিও পছন্দ করি এ ধরনের লোক।’

‘তা হলে সরাসরি জবাব দিন। হ্যাঁ কি না।

আবারও নীরব হলো চেয়ারম্যান। ভাবছে। একটু পর বলল, ‘আর তো কোনও উপায় দেখছি না, মেজর। ক্ষতি হয়েছে অনেক। আপনার প্রস্তাবে রাজি না হলে আরও বাড়বে ক্ষতি।’

‘তা হলে কি ধরে নেব আপনি রাজি?’

‘এই প্রস্তাবে কর্নেল শোফেল্ডের ভূমিকা কী?’

‘আর কোনও ভূমিকা নেই,’ বলল রানা। ‘একটু পরেই দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে সে।

রানা শুনল, নাইট ক্যাপের জন্যে ক্রিস্টাল গ্লাসে ড্রিঙ্ক ঢালছে লোকটা। এক ঢোক তরল গিলেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল চেয়ারম্যান। ‘ঠিক আছে। আমি রাজি। অপারেশন বন্ধ করে দিচ্ছি। নিকোলভ আর তার মেয়েকে বিরক্ত করব না আমরা। আপনিও আর আমাকে বিরক্ত করবেন না। আপনার সঙ্গে কথা বলে ভাল লাগল। আশা করি আর কখনও আমাকে ফোন দেবেন না। ‘

ডেড হয়ে গেল লাইন।

উইলিয়াম শোফেল্ডের মার্সিডিয়ের দিকে পা বাড়াল রানা। ভাবছে, প্রস্তাব দিয়েছি। নিজে রাজি হইনি কোনও শর্তে। পকেটে পুরে রাখল মোবাইল ফোন। থাকুক এটা আমার কাছে। ভবিষ্যতে অপারেশন ফ্লেয়ারের কর্মকাণ্ডের আভাস পাওয়া মাত্র যা বলেছি ঠিক তা-ই করব। তারপর রেকর্ডিং সহ মোবাইল ফোনটা পাঠিয়ে দেব ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স চিফ মিস্টার লংফেলোর কাছে।

নিশ্চয়ই ব্যথাতুর চেহারায় গাড়ির ভেতর পড়ে আছে উইলিয়াম শোফেল্ড। মুখে থাকবে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। গাড়ির দিকে পা বাড়িয়ে রানা ভাবল, ওকে দেখেই বলবে প্রাক্তন কর্নেল, ‘ভেবেছি ফেলে চলে গেছ! আগুন ধরে যাওয়ার আগেই এখান থেকে আমাকে বের করো!’ হাত বাড়িয়ে তাগাদা দেবে সে, ‘রানা, জলদি!’

শোফেল্ডের হাতটা ধরবে না রানা। কাপরিস্কির স্মিথ অ্যাণ্ড ওয়েসন পিস্তলটা বের করে অফ করবে সেফটি ক্যাচ। আলো পড়ে ঝিকিয়ে উঠবে নিকেল প্লেট। ওটার দিকে চেয়ে শিউরে উঠবে শোফেল্ড। কাঁদতে গিয়েও থেয়ে গিয়ে বলবে, ‘ক্-কী করছ?’

‘সঠিক কাজ,’ বলবে রানা।

করুণ সুরে বলবে লোকটা, ‘ত্… তুমি তো কথা দিয়েছ!’

‘সবসময় কথা রক্ষা করি,’ বলবে রানা।

‘রানা, তুমি কি পাগল হলে?’ কেঁপে উঠবে শোফেল্ডের কণ্ঠ।

হাঁটতে হাঁটতে পিস্তলটার ওজন মেপে নিল রানা। ভাবছে: গাড়ির খোলা দরজার পাশে থেমে বলবে, ‘আরো কিছু মগজে ভরে দেয়া যায়, তবে ওটার কথা তুমি একবারও বলোনি, শোফেল্ড। ওটা খুব হাইটেক নয়। দামও পড়ে মাত্র কয়েক পাউণ্ড। তবে কাজ করে সবসময়। ওই ডিভাইস তৈরি সীসা দিয়ে। পেছনে থাকে তামার জ্যাকেট। মগজে ঢোকে তীব্র বেগে। সেজন্যে ব্যবহার করতে হয় বিশেষ যন্ত্র। এই মুহূর্তে আমার হাতে অমনই একটা জিনিস।’ শোফেল্ডের মাথার দিকে পিস্তলের নল তাক করবে রানা। শীতল সুরে বলবে, ‘এই ডিভাইসটা পাচ্ছ গালিনা বেলিনভ ও তাতভ বেযুখফের তরফ থেকে।’

‘না-না!’ আর্তচিৎকার করে উঠবে শোফেল্ড। ‘মাফ করো, রানা। ভুল হয়ে গেছে! কসম! আর কখনও…’

কড়াৎ শব্দে গর্জে উঠবে রানার স্মিথ অ্যাণ্ড ওয়েসন। পিস্তলটা গাড়ির ভেতর ফেলে ফিরতি পথ ধরবে রানা। কাউকে খুন করলে ছোট হয়ে যায় মন। ভারী হবে ওর বুকটাও। করুণ মৃত্যু সবসময় ঘৃণ্য, সেটা ইঁদুরের হলেও।

মার্সিডিয থেকে বেশ দূরে সরে গিয়েছিল রানা। হঠাৎ করেই দেখল গাড়ির ভেতর উজ্জ্বল সাদা আলো। বৈদ্যুতিক ফুলকি খুঁজে পেয়েছে অকটেনের পুকুর। করুণ এক আর্তনাদ শুনল ও। ফাঁপা, জোরালো হুইম্‌প্ আওয়াজে আকাশে উঠেছে বিশাল নীলচে আগুন, গিলে ফেলেছে গোটা গাড়িটাকে। কয়েক সেকেণ্ড পর আকাশে উঠল কালো ধোঁয়ার মস্ত পিলার। রাতের হাওয়ায় ভর করে বিদঘুটে এক দৈত্যের মত ওটা ভাসতে ভাসতে চলল মস্কো শহরের দিকে।

গাড়ির ভীষণ নীল আগুনে খুন হয়েছে প্রাক্তন কর্নেল উইলিয়াম শোফেল্ড। নরহত্যা করতে হলো না বলে স্বস্তিই পেল রানা। একবার কাঁধ ঝাঁকাল। তারপর পিস্তলটা ফেলে দিল আগুনের মধ্যে।

কে জানে, হয়তো ধোঁয়ার ধূসর-কালো দানবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোথাও ভেসে চলেছে কর্নেলের পাপাত্মা!

ঘুরে সেতুর দিকে চলল রানা। ভ্যানের কাছে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে অ্যান্টোনিন নিকোলভ আর ছোট্ট ইউনা।

৫৬

ভিআনুকোভা এয়ারপোর্টে ব্রেয়নেভ কর্পোরেশনের গালফস্ট্রিম হ্যাঙারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাইলট রবার্ট স্টিফান ও কো-পাইলট এদোমণ্ড মার্কাস। অনেকক্ষণ হলো তৈরি তারা। মাসুদ রানা আর ইউনা পৌঁছে গেলেই আকাশে তুলবে বিমান। দু’জনই ভাবছে, অদ্ভুত মানুষ মাসুদ রানা। তাদের বসের কাছে ফোন দিয়ে বলেছে বিমান পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু এরপর এক এক করে পেরিয়ে গেছে দুইঘণ্টা, আসেনি কেউ। স্টিফান আর মার্কাস এখন ভাবছে ফোন দেবে মিস্টার ব্রেযনেভকে। বিলিয়নেয়ারের দুর্গে চিন্তিত সবাই। মাসুদ রানার সঙ্গে তৃতীয় মানুষটা কে, এ ব্যাপারে কিছুই জানে না কেউ। দুর্গে নিজের লিভিংরুমে পায়চারি করছেন উদ্বিগ্ন লুকা ব্রেযনেভ।

যতই সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, হতাশ হয়ে উঠছে পাইলট ও কো-পাইলট। আবারও বোধহয় ফিরতে হবে খালি বিমান নিয়ে। ফ্লাডলাইটে আলোকিত টারমাকে বিমান পর্যন্ত হেঁটে যাচ্ছে স্টিফান, তারপর আবারও ফিরছে হ্যাঙারের কাছে। দুই হাত ভরে দিয়েছে প্যান্টের পকেটে। ঝুঁকে গেছে দুই কাঁধ। হ্যাঙারের কোণে লুকিয়ে একটু পর পর সিগারেট ফুঁকছে কো-পাইলট এদোমণ্ড, অথচ প্রাইভেট জেট টার্মিনালের চারপাশে রয়েছে শতখানেক নো স্মোকিং সাইন।

‘তোমার কী মনে হয়?’ সপ্তমবারের মত জানতে চাইল পাইলট স্টিফান।

‘আসবে না,’ বিরস সুরে বলল এদোমণ্ড।

হঠাৎ করেই সোজা হয়ে কান পাতল স্টিফান। ‘একমিনিট! কীসের একটা আওয়াজ এগিয়ে আসছে!’

একইসময়ে শুনতে পেয়েছে এদোমণ্ড। চট্ করে হাত থেকে ফেলে দিল সিগারেট। সময় পেলে মোটর সাইকেল নিয়ে মেতে থাকে সে। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, ওই ইঞ্জিন টুইন-স্ট্রোক মোটর সাইকেলের। দামি লিমাযিন বা এসইউভি খুবই স্বাভাবিক প্রাইভেট জেট টার্মিনালে, কিন্তু সাধারণ এক মোটর সাইকেলে চেপে আসছে কে?

বিস্মিত চোখে পরস্পরকে দেখল পাইলট ও কো- পাইলট। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর সামনের দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেল তারা। টারমাক ধরে ছুটে আসছে অদ্ভুত এক বাহন।

এদোমণ্ড বলল না, ওটা রাশান ইউরাল। পাশেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওয়েইমাখট্ বিএমডাব্লিউ মিলিটারি সাইডকার। তার চেয়েও বিস্ময়কর তিন আরোহী। মোটর সাইকেল চালাচ্ছে মাসুদ রানা। রক্তাক্ত। ধুলোয় ভরা। যে-কেউ বলবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এসেছে সে। পেছন সিটে উস্কোখুস্কো চুল- দাড়ি ভরা অ্যান্টোনিন নিকোলভ। যেন এইমাত্র ছাড়া পেয়েছে লেবার ক্যাম্প থেকে। আর সাইডকারের ভেতর গোলাপি জ্যাকেট আর ছেঁড়া জিন্সের প্যান্ট পরে নোংরা চুলের ইউনা নিকোলভ। তবে ওর হাসি হাজার কোটি ওয়াটের বাতির চেয়েও ঝলমলে। বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে মোটর সাইকেলের দিকে দৌড় দিল দুই বৈমানিক। বিমানের পাশে থেমে গেছে অদ্ভুত বাহন। ইউনাকে জড়িয়ে ধরল স্টিফান। তবে ওকে ঠেলে সরিয়ে ইউনার হাত ধরে নাচতে শুরু করেছে এদোমণ্ড। পাইলট স্টিফান ভুলেই গেছে নিকোলভকে সামনে পেলে ঘুষিয়ে তার দাঁতগুলো ফেলে দেবে ভেবেছিল।

‘দেরির জন্যে দুঃখিত,’ বলল রানা, ‘আসার পথে ঝামেলা হয়েছে।’

‘কোত্থেকে… কী করে…’ একের পর এক প্রশ্ন করবে ভেবেছে স্টিফান।

কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল রানা, ‘পরে বলব।’ উজ্জ্বল আলোয় ঝিকমিক করছে আধুনিক বিমান। ওটা দেখাল রানা। ‘জলদি চলে যেতে হবে। নইলে ওদের সুন্দর শহরের বারোটা বাজিয়ে দেয়ায় আটকে দেবে রাশান কর্তৃপক্ষ।’

মাত্র পাঁচ মিনিটে আকাশে উঠল গালফস্ট্রিম জেট। বিমানে ওঠার আগে হ্যাঙারের পাশে মোটর সাইকেলটা রেখেছে রানা। হ্যাণ্ডেলে রাবার ব্যাণ্ড দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে একটা কাগজ। ওটাতে লেখা: সত্যিই দুঃখিত। আপনার মোটর সাইকেলটা না নিয়ে পারিনি। মাফ করবেন।

পরিত্যক্ত এলাকা ত্যাগ করে পায়ে হেঁটে শহরের দিকে ফিরেছে রানা, নিকোলভ ও ইউনা। রানা ভেবেছিল গাড়ি চুরি করবে। কিন্তু আশপাশে কোথাও পাওয়া গেল না ও জিনিস একটা পেট্রল পাম্পে পেল ইউরাল মোটর সাইকেল। ওটাই লোপাট করেছে ও। শেষ কয়েক মাইল মোটর সাইকেলে চেপে পৌঁছেছে এয়ারপোর্টে। দ্রুত কাজ করেছেন রাশান এভিয়েশন মিনিস্টার। গার্ডদের হাতে ছিল রানা ও ইউনার ছবি। নিকোলভ অচেনা হলেও বাধা দেয়নি তারা। এখন বিলাসবহুল বিমানের রাজকীয় সিটে বসে অদ্ভুত লাগছে একটু আগের স্মৃতি। রাশান এয়ারস্পেসে মিগ যুদ্ধবিমান ওদেরকে বাধা না দিলে ওরা পৌঁছে যাবে ফ্রান্সের এলাকায়। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজল রানা।

তিন ঘণ্টা পর লে ম্যান্স-অনাজ এয়ারপোর্টে নামল গালফস্ট্রিম জেট বিমান। টারমাকে নামতেই রানা দেখল, একটু দূরে থেমেছে ক্যাডিলাকের কনভয়। একটা গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে এল তামারা ব্রেনেভ। পাগলের মত জড়িয়ে ধরল মেয়েকে। চুমুর পর চুমু দিচ্ছে গালে, কপালে, থুতনিতে। গাড়ি থেকে নেমে নাচতে শুরু করেছেন চিরকালের গম্ভীর লুকা ব্রেযনেভ। ইউনা ছাড়া, আর কোনও দিকেই খেয়াল নেই তাঁর। তামারাকে ঠেলে সরিয়ে জড়িয়ে ধরলেন নাতনিকে। একটু দূরে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে নিকোলভ। খুব অসহায় বোধ করছে।

তার দিকে চেয়ে আছে তামারা ব্রেয়নেভ।

নিকোলভের কাঁধে হাত রাখল রানা। নিচু গলায় বলল, ‘কেন যেন মনে হচ্ছে, এবার ঠিক হয়ে যাবে সব।’

মন খারাপ, নীরব থাকল নিকোলভ।

রানা ভাবল, একবার স্নান শেষে নরম বিছানা পেলে আগামী তিন দিন ঘুম থেকে উঠবে না। তবে এত ভাল নয় ওর কপাল। এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলেন লুকা ব্রেনেভ। হাজারবার বলতে লাগলেন কতখানি কৃতজ্ঞ তিনি।

ইউনার হাত ধরে ওদের পাশে থামল তামারা। চট্ করে চুমু দিল রানার গালে। ‘থ্যাঙ্ক ইউ, মিস্টার রানা।’

‘ইউ আর ওয়েলকাম,’ মৃদু হাসল বিসিআই এজেন্ট।

‘তুমি সত্যিকারের হিরো!’ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা বলে চলেছেন ব্রেযনেভ। ‘তুমি সত্যিই মহৎ লোক, রানা! সত্যিকারের মহান নাইট…’

প্রতিবাদ করে লাভ হবে না বুঝে চুপ থাকল রানা।

বারবার ওকে দেখছে ইউনা। চোখে অদ্ভুত এক আলো। ক্ষণে ক্ষণে লালচে হচ্ছে দুই গাল।

নিকোলভ চুপ করে আছে বলে তার সামনে থামল তামারা ব্রেযনেভ। কথা বলছে না ওরা কেউ। ওদিকে চোখ পড়েছে লুকা ব্রেযনেভের। নিকোলভকে দেখে কঠোর হলো তাঁর চেহারা। কড়া সুরে বললেন, ‘তুমি এখানে কী করছ, নিকোলভ?’

‘আপনি ওকে ভুল বুঝেছেন, মিস্টার ব্রেনেভ, মাঝখান থেকে বলল রানা। ‘পরে সব খুলে বলব। দীর্ঘ কাহিনী। শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট, নিজের মেয়েকে কেউ এত ভালবাসতে পারে, নিকোলভকে না দেখলে জানতাম না। ইউনার জন্যে মরতেও দ্বিধা নেই ওর।’

কথাগুলো শুনে কেমন থমকে গেলেন ব্রেনেভ। কাঁধ ঝাঁকালেন। এগিয়ে গিয়ে বাবা ও মা’র হাত ধরল ইউনা। একবার ওকে দেখল নিকোলভ ও তামারা, তারপর তাকাল পরস্পরের চোখে। ওখানে খুব প্রিয় কাউকে হারিয়ে বসার দুঃখ, কষ্ট ও সত্যিকারের ভালবাসা। রানা আরেকবার বলল, ‘দুর্গে গিয়ে খুলে বলব সব। আশা করি তাতে ক্ষোভ দূর হবে সবার মন থেকে।’

একটু পর ব্রেযনেভ এস্টেটের দিকে ছুটল মোটরকেড। সামনের গাড়িতে লুকা ব্রেনেভ, তামারা ও ইউনা। পরের গাড়িতে রানা ও নিকোলভ। পেছনে কয়েকটা গাড়িতে গার্ডরা।

‘কাজ তো শেষ, আমরা খারাপ করিনি, কী বলো?’ বলল রানা।

মাথা নাড়ল নিকোলভ। না, বন্ধু, আমি কিছুই করিনি। যা করার করেছ তুমি একা। কষ্ট লাগছে যে আজ আর নেই তাতভ। আমি বেঁচে আছি জানলে খুব খুশি হতো।’

বন্ধু হারাবার কষ্ট কতটা, জানে বলেই চুপ করে থাকল রানা।

দুর্গে পৌঁছে ইউনাকে নিয়ে দোতলায় চলে গেল তামারা। লুকা ব্রেযনেভের সঙ্গে রানা ও নিকোলভ এল ড্রয়িংরুমে। সবাই বসার পর রানার দিকে চাইলেন বিলিয়নেয়ার। বেয়ারা এসে টেবিলে দিয়ে গেল লুই তেরো কনিয়াকের বোতল ও তিনটে ক্রিস্টালের গ্লাস। সবার জন্যে গ্লাসে ব্র্যাণ্ডি ঢাললেন ব্রেযনেভ।

প্রথম থেকে খুলে বলতে লাগল রানা।

বারবার নিকোলভকে দেখছেন ব্রেযনেভ, চোখে বিস্ময়। রানার কথা শেষ হওয়ার পর বললেন, ‘তার মানে ইউনাকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিতেও রাজি ছিল নিকোলভ। রানা তো চিরকালই হিরো, ওর কথা আলাদা। আর আমি, যে-লোক কখনও মানুষ চিনতে ভুল করি না, সে-ও একদম বোকা বনে গেছি নিকোলভের ব্যাপারে!’

ব্র্যাণ্ডির গ্লাস হাতে চুপ করে বসে আছে নিকোলভ।

‘একটা কথা,’ বললেন ব্রেনেভ, ‘কোথায় লুকিয়েছিলে ওই ডিভাইস, নিকোলভ?’

‘ট্রেইলার থেকে রওনা হওয়ার পর প্রথমবারের মত যখন থামলাম, তখন,’ বলল নিকোলভ, ‘অন্য কোথাও রাখতে ভয় হচ্ছিল।’

‘কোথায় সরালে?’ জানতে চাইল রানা।

‘তাতভ আর আমি নিয়মিত খাবার ঘুষ দিতাম ওর ঝগড়াটে কুকুরটাকে, যাতে কান ফাটিয়ে না দেয়। যে- কোনও কিছু দিলেই দু’বার চিবিয়ে গিলে ফেলত। খাবারের সঙ্গে ডিভাইস, মাইক্রোফিল্ম আর ফ্ল্যাশ ড্রাইভ গিলিয়ে দিয়েছিলাম ওকে,’ বলল নিকোলভ। ‘কে ভাববে ওটার পেটে ওসব থাকবে! এতক্ষণে জঙ্গলের কোথাও পড়ে আছে মলমূত্রের ভেতর।’

‘নিকোলভ বোধহয় আর কখনও রাশায় ফিরতে পারবে না,’ ব্রেনেভকে বলল রানা, ‘ওর বাড়ি নেই। চাকরিও নেই। তবে ওর রয়েছে ইউনার জন্যে একবুক ভালবাসা।’

মাথা দোলালেন ব্রেনেভ। ‘চাকরি, বাড়ি বা টাকা নিয়ে ভাবতে হবে না ওকে।’ চুপ হয়ে গেলেন তিনি। আনমনে কী যেন ভাবছেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘চিনি তামারাকে। আজও ভালবাসে নিকোলভকে। রাতে চুপচাপ কাঁদে ওর কথা ভেবে।’ এক্স এজেন্টের দিকে তাকালেন বিলিয়নেয়ার।

তাঁর কথা শুনে হতবাক হয়েছে নিকোলভ। জবান ফিরতেই বলল, ‘আমিও ভালবাসি ওকে। ভালবাসব বাকি জীবন।

‘সুযোগ থাকলে তুমি ওকে বিয়ে করে সংসার পাতবে?’ জানতে চাইলেন ব্রেযনেভ।

মাথা নিচু করে নিল অ্যান্টোনিন। ‘হ্যাঁ। কিন্তু জানি না তামারা আমাকে গ্রহণ করবে কি না।’

‘আজই ওর সঙ্গে কথা বলব,’ বললেন ব্রেনেভ। ‘আশা করি চুকেবুকে যাবে ঝামেলা।’ রানার দিকে তাকালেন তিনি। ‘এবার আর আটকে রাখব না তোমাদেরকে। রানা, নিকোলভ, তোমরা আহত এবং ক্লান্ত। এখন চাই ভাল চিকিৎসা। এ দুর্গ থেকে কয়েক মাইল দূরে ছোট্ট এক ক্লিনিক খুলেছি। আপাতত তোমরা ওখানে ভর্তি হও। নামকরা ক’জন ডাক্তার দেখবে তোমাদেরকে।’

‘আমার কিছুই হয়নি,’ আপত্তি তুলল রানা।

মাথা নাড়লেন বিলিয়নেয়ার। ‘দেখেই বুঝতে পারছি সুস্থ নও। এখন তোমাকে ছেড়ে দিলে সবই জানবে রাহাত। ভয়ানক খেপে যাবে আমার ওপর। তুমি নিশ্চয়ই চাও না সেটা?’

৫৭

বিলিয়নেয়ার ব্রেযনেভ বলেছিলেন, ছোট্ট ক্লিনিক খুলেছেন। অথচ ওটা উত্তর ফ্রান্সের সেরা আধুনিক প্রাইভেট হাসপাতাল। নিজে রানা ও নিকোলভকে ড্রাইভ করে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন তিনি। সর্বক্ষণ ওদের ওপর চোখ রাখছে চারজন ডাক্তার আর আটজন নার্স।

পরের দু’দিন গৃহবন্দির মত অলস সময় কাটিয়ে রীতিমত খেপে গেল রানা। ঠিক করল পালিয়ে যাবে বিলাসবহুল এই হাসপাতাল থেকে। তবে বুদ্ধিমান দু’জন ডাক্তার ওর মনের কথা বুঝতে পেরে ব্যবস্থা নিলেন: এখন থেকে বাগানে যেতে পারবে রানা। একা থাকতে চাইলে বিরক্ত করবে না কেউ।

তৃতীয় দিন বাগানে যেতে পেরে খুশি হলো রানা। একটু পর দেখল দুই ক্রাচে ভর দিয়ে আসছে অ্যান্টোনিন নিকোলভ।

দু’চার কথার পর আরামদায়ক একটা বেঞ্চে বসল ওরা। ক্রাচ দেখাল নিকোলভ। ‘প্রায় এক মাস লাগবে পা ঠিক হতে।’

‘তারপর যোগ দেবে মিস্টার ব্রেযনেভের অফিসে?’

‘না। ওঁর এক বন্ধুর অফিসে।’

আস্তে করে মাথা দোলাল নিকোলভ। ‘আমার ওপর রেগে নেই তিনি।’ দূরে তাকাল। ‘গত দু’দিনে তিনবার আমাকে দেখতে এসেছে তামারা। আগেই আমার উচিত ছিল ওকে সব খুলে বলা। এখন আর কিছুই গোপন নেই।’

‘সব ভালর দিকে যাচ্ছে জেনে ভাল লাগছে,’ বলল রানা।

‘আর সেজন্যে, বন্ধু, চিরকালের জন্যে তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ রয়ে গেলাম,’ জানাল নিকোলভ। ‘কোনও দিনই শোধ দিতে পারব না তোমার ঋণ।’

‘তুমি কোনও ঋণ নাওনি, কাজেই শোধ দেয়ার কথাও ওঠে না,’ বলল রানা।

‘প্রতিদিন চারবার দেখা করে ইউনা,’ হাসল নিকোলভ। ‘ওর ভেতর বেশ পরিবর্তন দেখছি।’

‘কী ধরনের?’ জানতে চাইল রানা।

হাসিটা চওড়া হলো নিকোলভের। ‘নিজেই জেনে নিয়ো। তবে আমার মনে হয়েছে, তোমাকে বিয়ে করতে চায় ইউনা। ওর বয়স বছর দশেক বেশি হলে আমি হয়তো হতাম তোমার শ্বশুর!’ পকেট থেকে খাম বের করল সে। বাড়িয়ে দিল রানার দিকে। ‘খুব লজ্জা পাচ্ছে বলে আমাকে বলেছে তোমাকে দেয়ার জন্যে।’

খামটা নিয়ে ভেতর থেকে গোলাপি কাগজ বের করল রানা। পড়তে লাগল ইউনার চিঠি।

রানা,

অনেক-অনেক-অনেক ধন্যবাদ। তুমি আমার বাবা আর আমার জন্যে যা করেছ, সেটা কখনও ভুলব না। আশা করি কয়েক দিনের ভেতর তোমার সঙ্গে দেখা হবে।

আমার বুক ভরা ভালবাসা নিয়ো, সবচেয়ে সেরা বন্ধু তুমি আমার!

ইউনা নিকোলভ’।

চিঠিটা ভাঁজ করে বুক পকেটে রাখল রানা। ওর হৃদয় স্পর্শ করেছে লক্ষ্মী মেয়েটার অকপট লেখা। মৃদু স্বরে বলল ও, ‘ইউনাকে বোলো, কখনও হারিয়ে ফেলব না ওর এই মিষ্টি চিঠি।’

মুচকি হাসল নিকোলভ। ‘প্রথম প্রেম বলে কথা!’

চুপ হয়ে গেল ওরা। চারপাশে সবুজ টিলা, রঙিন ফুলের বাগান, নীল জলের সুইমিংপুল। চমৎকার দৃশ্য। ভাবা যায় না গত ক’দিন কীসের ভেতর দিয়ে গেছে ওরা। আস্তে করে মাথা নাড়ল নিকোলভ। ‘খারাপ লাগছে কুকুরটার জন্যে। বেচারা হয়তো পেটে খিদে নিয়ে জঙ্গলে ঘুরছে।’

‘বেযুখফের খামারে বা অন্য খামারটায় ইঁদুরের অভাব নেই। নিজের ব্যবস্থা করে নেবে,’ বলল রানা, ‘তুমিই তো বলেছ, ভালমন্দ সবই গিলে ফেলে। হয়তো নিজের জন্যে খুঁজে নেবে নতুন মনিব।’

মাথা দোলাল নিকোলভ।

.

বিকেলে সুস্থ বোধ করছে জানিয়ে প্রায় জোর করেই হাসপাতাল থেকে রিলিয় নিল রানা। নরম্যাণ্ডিতে রানা এজেন্সিতে পড়ে আছে অনেক কাজ। তবে ওখানে যাওয়ার আগে ট্যাক্সিতে চেপে হাজির হলো ব্রেযনেভের দুর্গে। সরাসরি ওকে নেয়া হলো বিলিয়নেয়ারের লিভিংরুমে। সোফায় বসার পর আবারও ওকে ধন্যবাদ দিলেন বৃদ্ধ। তারপর তুললেন পারিশ্রমিকের বিষয়ে। এক মিলিয়ন ডলারের একটা চেক লিখে রেখেছেন।

মাথা নাড়ল রানা। হাসিমুখে জানতে চাইল ও, ‘গতবার কত দিয়েছিলেন?’

থমকে গেলেন ব্রেযনেভ।

‘তুমি তো কিছুই নাওনি। কিন্তু বারবার…’

‘কাজটা নিয়েছি আমার বস আর আপনার সম্মানে। কাজেই এবারও টাকা নেয়ার প্রশ্ন ওঠে না।’

ব্রেযনেভ বললেন, ‘অন্তত হেলিকপ্টারে করে তো তোমাকে পৌঁছে দিতে পারি রানা এজেন্সিতে? পরে আমার শোফার দিয়ে আসবে তোমার গাড়ি।’

মাথা নাড়ল রানা। ‘ড্রাইভ করতে ভাল লাগে। চারপাশ দেখতে দেখতে পৌঁছে যাব গন্তব্যে।’ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ও। দরজার দিকে রওনা হয়ে বলল, ‘পরে দেখা হবে।’

উঠে দাঁড়িয়েছেন ব্রেনেভও। নরম সুরে বললেন, ‘অজস্র ধন্যবাদ, রানা।’ অদ্ভুত চোখে দেখছেন নির্লোভ বাঙালি ছেলেটাকে। রানা দরজার কাছে যেতেই হঠাৎ পেছন থেকে ডাকলেন, ‘রানা?’

ঘুরে তাকাল বিসিআই এজেন্ট।

চকচক করছে গম্ভীর বিলিয়নেয়ারের দু’চোখ। ‘একটা কথা, তুমি কিন্তু আমার প্রায় নাত-জামাই হয়ে গেছ!’

‘কী করে?’ মৃদু হেসে ফেলল রানা।

‘কী জাদু করেছ সেটা তুমিই জানো, তবে ওর গোলাপি ঘরে মাসুদ রানা লিখে সবক’টা দেয়াল লাল, কালো, নীল, সবুজ করে ফেলেছে ইউনা! মুখে শুধু তোমার নাম!’

‘ঠিক আছে, নাত-জামাই হতে রাজি, তবে আগে ষোলো বছর বয়স তো হোক আমার,’ বলে লিভিংরুম থেকে বেরিয়ে এল রানা। একটু পর দুর্গ থেকে বেরিয়ে তুমুল বেগে নরম্যাণ্ডির দিকে ছুটল ওর গাড়ি। আনমনে ভাবছে বিসিআই এজেন্ট: সত্যিই, ষোলো বছর বয়সে ফিরে যেতে পারলে মন্দ হতো না!

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *