এক্স এজেন্ট – ৫০

৫০

পুরনো হাসপাতালের চতুর্থতলায় শুরু হয়েছে গোলাগুলি। রানার দুই গুলিতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে স্টেপুরিন ও অরলভ। পরক্ষণে নিকোলভের পাশে গ্লাভ্স্ পরা বালতি হাতে হাতিটা মরল দু’চোখের মাঝে বুলেট খেয়ে। যেভাবে রক্ষা করবে বলেছিল, সেভাবেই ইউনার সামনে পৌঁছে ওকে আড়াল করল রানা। কথামত ওর পিঠের কাছে বানরের বাচ্চার মত সেঁটে থাকল ইউনা। ওকে খুন করতে হলে গুলি করতে হবে রানাকে। এই মুহূর্তে নিকোলভের গায়ে লক্ষ্যহীন বুলেট লাগবে বলে ভাবছে না বিসিআই এজেন্ট। সে আছে ক্রসফায়ারের আওতার বাইরে।

প্রথম দুই গুলির পর হুঁশ ফিরতে কয়েক সেকেণ্ড নিয়েছে কাপরিস্কির লোক। হুঁশ ফিরে পেয়ে ঝট্ করে হাত বাড়াল যে যার অস্ত্রের দিকে। দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা ব্যারেল কাটা শটগান ও সাবমেশিন গান হাতে তুলে নিচ্ছে ক’জন। দু’জন ছোঁ দিল চেয়ারের পেছনে অস্ত্রের দিকে। ঘরের সবাই অস্ত্র হাতে নেয়ার আগেই রানার গুলিতে মরল তাদের দুই গুণ্ডা। একটু দেরিতে ব্যস্ত হয়ে পিস্তল বের করল দরজা আটকে রাখা ভ্যানের চার প্রহরী। রানার দুটো মগজ; চারটে চোখ ও আট হাতে পিস্তল থাকলেও এতজনকে সামলাতে পারত না। তবে রানিং টার্গেট লক্ষ্যভেদে বিশেষ ট্রেনিং নেয়া আছে ওর। দু’হাত চালাচ্ছে ও, এক সেকেণ্ড পর পর গর্জে উঠছে দুই পিস্তল। ওগুলো একনাগাড়ে কাজ করছে সাবমেশিন গানের মত।

চোখে অবিশ্বাস নিয়ে চারপাশের কাণ্ড দেখছে এফএসবির স্টেশন চিফ কাপরিস্কি। কয়েক মুহূর্তের জন্যে জমে গেছে বরফের মূর্তির মত। চটকা ভাঙতেই গোলাগুলি থেকে সরতে ব্যাক গিয়ার দেয়া ট্রাকের মত পিছিয়ে গেল সে। তাড়াহুড়ো করে জ্যাকেট সরিয়ে হোলস্টার থেকে নিল নিকেল-প্লেটেড পিস্তল। সিনিয়র হওয়ার বিপদ হচ্ছে কাজের চাপে সময় হয় না রেঞ্জে গিয়ে কমব্যাট স্কিল ঝালিয়ে নেয়ার। তা ছাড়া, বয়সও হয়েছে মোটা ভ্যানকিন কাপরিস্কির। উচিত ছিল না এসবে জড়িয়ে যাওয়া। তার দিকে ঘুরল রানার ডানহাতের পিস্তলের মাযল। বামহাতের পিস্তলের নল তাক হলো কাপরিস্কির পাশের এক লোকের কপালে। ওই লোক এইমাত্র হাতে নিয়েছে পাম্প-অ্যাকশন বারো গেজের শটগান। কিন্তু একইসময়ে দুই পিস্তলের ট্রিগার চাপল রানা। হঠাৎ করেই হারিয়ে গেল লোকটার ডান চোখ। সেখানে এখন শুধু একটা রক্তাক্ত গর্ত। ধুপ করে পড়ল লাশ।

রানার গুলি লেগেছে কাপরিস্কির চোয়ালের পাশে। বিকট এক আর্তনাদ ছেড়ে পিস্তল ফেলে ক্ষতটা চেপে ধরল সে। তাকে আবারও গুলি করবে রানা, এমন সময় ওর বুকে লাগল প্রচণ্ড ধাক্কা। ওটা যেন মদ্দা ঘোড়ার জোড়া-পা লাথি। টলমল করে পিছিয়ে গেল রানা। ওদিকে একটা ক্রেট উল্টে ওটাকে কাভার হিসেবে ব্যবহার করছে কাপরিস্কির এক স্যাঙাৎ। তার হাতে আবারও গর্জে উঠল কালো রঙের বিরাট পিস্তল। .৪৫ ক্যালিবারের বুলেট বুকে লাগতে রানার মনে হলো ওকে ঘুষি মেরেছে পৃথিবীর বর্তমান হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন মুষ্টিযোদ্ধা ডিয়ন্টে ওয়াইল্ডার।

প্রচণ্ড ব্যথায় শ্বাস আটকে গেল ওর। ফাটল ধরেছে পাঁজরের দুটো হাড়ে। অবশ্য তাও খুন হওয়ার চেয়ে ঢের ভাল! দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নিল রানা। টের পেল, ভীষণ ভয় পেয়ে ওর পিঠের কাছে আঠার মত সেঁটে থরথর করে কাঁপছে ইউনা। ক্রেটের পেছনের লোকটাকে গুলি করতে চাইল রানা। কিন্তু লুকিয়ে পড়েছে সে ক্রেটের ওদিকে। পয়েন্ট অভ এইম বারো ইঞ্চি নামিয়ে পলকা কাঠের বাক্সের দিকে পর পর তিনটে গুলি পাঠাল রানা।

বুম! বুম! বুম!.

ক্রেটের ভেতরে শক্ত কিছু আছে। বাধা পেল দুটো বুলেট। কিন্তু কাঠ ফাটিয়ে লক্ষ্যভেদ করল তৃতীয় গুলি। করুণ আর্তনাদ ছেড়ে হাত-পা ছড়িয়ে মেঝেতে পড়ল লোকটা। পরক্ষণে উঠে বসে দু’হাতে চেপে ধরল ডান ঊরু। ফেমোরা আর্টারি ছিঁড়ে যাওয়ায় পিচকারির মত বেরোচ্ছে রক্ত। বাজে জখম, তবে রানার পরের গুলিতে ফুটো হলো লোকটার কপাল।

ঘরের নানাদিক থেকে রানাকে লক্ষ্য করে এল গুলি। নাকের সামনে দিয়ে তপ্ত হাওয়া তুলে পেছনের দেয়ালে লাগল একটা বুলেট। কাতরে উঠল ইউনা। রানা বুঝে গেল, সিমেন্ট ও ইঁটের টুকরো লাগলেও আহত হয়নি মেয়েটা। হৃৎপিণ্ডের কাছে রানার পেকটোরাল মাসলের ওপরে কেভলার ভেস্টে বিধল আরেকটা গুলি। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে তীব্র ব্যথা সহ্য করল ও। জেদ চেপেছে মাথায়। পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে পিস্তল ঘুরিয়ে গুলি করছে একের পর এক টার্গেটে। হারিয়ে গেছে সচেতন মন। গুলি খেয়ে মেঝেতে পড়ল কাপরিস্কির এক লোক। তারপর আরেকজন। কয়েক সেকেণ্ড পর ঘরে সুস্থ মানুষ বলতে দাঁড়িয়ে রইল শুধু রানা ও ইউনা। এখন আর গুলি করছে না কেউ।

ধোঁয়া ওঠা তপ্ত পিস্তলের নল নিচু করল রানা। বামহাতের অস্ত্র খালি হওয়ায় লক হয়েছে। পিস্তলটা মেঝেতে ফেলল ও। বড়জোর তিনটে বুলেট আছে ডানহাতের পিস্তলে। পরিত্যক্ত, ছাতাপড়া ঘরে হঠাৎ করেই নেমেছে অদ্ভুত নীরবতা। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কিছু রক্তাক্ত লাশ। হতবাক হয়ে বিহ্বল চোখে রানাকে দেখছে নিকোলভ। শক্ত করে রানার কোমর জড়িয়ে ধরেছে ইউনা। নাক গুঁজে দিয়েছে পিঠে। কোমর থেকে ওর হাত সরাল রানা। আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল মেয়েটার গালে। নরম সুরে বলল, ‘খুব সাহসের কাজ করেছ, ইউনা। দারুণ মেয়ে তুমি!’

‘সব শেষ তো?’ আস্তে করে জিজ্ঞেস করল ইউনা।

রানা জানে, সব শেষ হওয়ার নয়। সিঁড়ি বেয়ে ঝড়ের বেগে ধুপ-ধাপ আওয়াজ তুলে উঠছে কয়েকজন। কাত হয়ে পড়া একটা চেয়ার নিয়ে দরজায় ঠেকা দিল রানা। ব্যারিকেড হিসেবে জিনিসটা বেশি হালকা। লাশ এড়িয়ে নির্যাতন করার ক্রেটের পাশে থামল ও। ভেতর থেকে নিল বোল্ট ক্রপার। ওটা দিয়ে কাটা হয় মানুষের আঙুল। এবার সত্যিকারের কাজে লাগবে। ধাতব চেয়ারের সামনে পৌঁছে কট-কট শব্দে নিকোলভকে আটকে রাখা শেকল কাটল রানা। রাশান এক্স এজেন্টের মনে জেগেছে অনেক প্রশ্ন। বিড়বিড় করে বলল, ‘নিজ চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছি না! অদ্ভুত কাণ্ড, রানা!’

‘ভেবেছিলে প্রাক্তন বসের হাতে তোমাকে রেখে যাব?’

হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে পড়ল নিকোলভ। গায়ের জোরে জড়িয়ে ধরল মেয়েকে। দু’চোখ থেকে দরদর করে নামল অশ্রু। তবে পারিবারিক মহামিলনের সময় নয় এখন। ধুপ-ধাপ আওয়াজে চতুর্থতলায় উঠেছে কয়েকজন লোক। তারা যে সশস্ত্র, তাতে সন্দেহ নেই। ধুম-ধাম আওয়াজে ঘুষি পড়ল দরজার ওপর। কয়েক সেকেণ্ড পর কাঠ ভেদ করে এদিকে এল একরাশ গুলি। তালার লক বা বোল্ট ভেঙে কবাট খুলতে চাইছে কাপরিস্কির লোক। একটা লাশের পাশ থেকে পাম্প অ্যাকশন শটগান নিল রানা। দরজার দিকে তাক করে ট্রিগার টিপতেই ঘর ভরে গেল কানফাটা আওয়াজে। দরজার তক্তা ফুটো করে ওদিকে থাকা লোকটার গায়ে বিঁধল সোয়া এক আউন্স বাকশট।

প্রাণের ভয়ে সতর্ক হয়ে উঠবে অন্যরা।

এতে সামান্য বাড়তি সময় পাবে রানারা।

নিকোলভের আহত পায়ের দিকে আঙুল তাক করল রানা, ‘হাঁটতে পারবে?’

‘মনে হয় না, বন্ধু, খুব বেশি ব্যথা। তবে চেষ্টা করব।’

কালো জ্যাকেট খুলে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট দেখল রানা।

কয়েকটা গুলি লেগেছে ওটার ওপর। জায়গায় জায়গায় ছড়ে গেছে ওর ত্বক। কষ্ট হচ্ছে শ্বাস নিতে। ফাটল ধরেছে পাঁজরের দুটো হাড়ে। তবে আপাতত এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। একটানে মেঝেতে শোয়া এক লাশের ইউনিফর্ম ছিঁড়ল রানা।

নিকোলভ বলল, ‘কী করছ, রানা?’

‘তোমার জন্যে ভেস্ট দরকার,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল রানা। ‘এটা পরে নাও, নিকোলভ।’

‘আমার তো আগেই আছে,’ বলল ইউনা। জ্যাকেটের চেইন খুলে বাবাকে ভেস্ট দেখাল।

তবে একটা বিষয় খেয়াল করেনি রানা।

বেঁচে আছে স্টেশন চিফ ভ্যানকিন কাপরিস্কি!

জ্ঞান ফিরতেই গুঙিয়ে উঠে লাশগুলোর মাঝে হাঁটু গেড়ে বসল সে। আবছা আলোয় গোটা মুখ ও ঘাড়ে চিকচিক করছে রক্ত। ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশ দেখল সে, চোখে অবিশ্বাস। পরক্ষণে ডান কনুইয়ের ওপর ভর করে পড়ে গেল মেঝেতে। চাপা স্বরে গোঙাতে শুরু করেছে। বিশাল মাকড়সার মত রক্তে মাখা পাঞ্জাটা স্মিথ অ্যাণ্ড ওয়েসন পিস্তলের এক ইঞ্চি দূরে।

গাল কুঁচকে গেল নিকোলভের। কাপরিস্কি’ সাগরকলার মত মোটা আঙুলে অস্ত্রটা ধরার আগেই ওটা তুলে নিল এক্স এজেন্ট। সরাসরি মাযল তাক করল প্রাক্তন বসের মাথায়। ক্রোধে ও ঘৃণায় বেরিয়ে এল দু’পাটি দাঁত। চাপা স্বরে বলল নিকোলভ, ‘আমার মেয়ের ক্ষতি করতে চেয়েছিস, কুকুরের বাচ্চা! এবার ফিরে যা নরকে!’

নিকোলভ ট্রিগার টিপে দেয়ার আগেই ওর হাত থেকে মুচড়ে পিস্তলটা নিয়ে মেঝেতে ফেলল রানা। রাগ ও ক্ষোভ নিয়ে ওকে দেখল নিকোলভ। চোখ বলে দিল, বন্ধু হয়েও এত বড় বেইমানি করলে, রানা? ব্যথার ঢেউ শুরু হতেই কুঁচকে গেল তার কপাল ও গাল। টলমল করছে উঠতে গিয়ে। শক্ত হাতে তার বাহু ধরল রানা। নরম সুরে বলল, ‘কুকুর মেরে বাকি জীবন দোষী হয়ে লাভ কী, নিকোলভ?’

‘যা করেছে, সেজন্যে প্রতিশোধ নিতে চাই,’ বলল নিকোলভ।

‘এমনিতেই শোধ হচ্ছে,’ বলল রানা। ‘বেশিক্ষণ বাঁচবে না।’

ওর চোখে তাকাল নিকোলভ। কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেল। এইমাত্র খুব কাছে গর্জে উঠেছে পিস্তল। কানে তালা লাগল রানা ও নিকোলভের।

শেষবারের মত ‘হুঁক্!’ শব্দ করে মেঝেতে স্থির হয়ে গেল কাপরিস্কি।

এক পা পিছিয়ে এল ইউনা। ছোট্ট দু’হাতে বিশাল দেখাচ্ছে নিকেল করা অটোমেটিক পিস্তল। ওটা মেঝেতে ফেলল মেয়েটা। চোখ ভরে গেল অশ্রুতে। ওই জল দুঃখের নয়, গর্ব ও প্রতিশোধের। কচি কণ্ঠে বলল, ‘কারও অধিকার নেই যে আমার বাবাকে কষ্ট দেবে!’

অবাক চোখে ইউনাকে দেখল রানা ও নিকোলভ। বোবা হয়ে গেছে ওরা।

আর তখনই বাজতে লাগল কাপরিস্কির মোবাইল ফোন।

৫১

কাপরিস্কির মোবাইল ফোনের রিংটোন সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতীয় সঙ্গীত রেড আর্মির কোরাস। এ থেকে সহজেই রানা বুঝে গেল, কাদের প্রতি আনুগত্য ছিল তার। লাশের পকেট থেকে ফোন নিল রানা। একবার ভাবছে ফোন ধরবে, পরক্ষণে মন বলছে: ধরিস না। কল রিসিভ করলে হয়তো পাবে জরুরি তথ্য, যেটা কাজে আসবে ওদের। এক সেকেণ্ড পর স্পিকার চালু করে রিপ্লাই বাটন টিপল রানা। এবার সব শুনতে পাবে নিকোলভ ও ইউনা।

সতর্ক করার সুরে কথা বলতে লাগল প্রাক্তন কর্নেল উইলিয়াম শোফেল্ড। তার কণ্ঠ চিনতে দেরি হলো না রামার।

‘কাপরিস্কি, সাবধান! ফ্যাসিলিটি থেকে বেরিয়ে গেছে মাসুদ রানা! ঝামেলার জন্যে তৈরি থাকো!’

‘কে এই লোক?’ ফিসফিস করে জানতে চাইল নিকোলভ।

জবাব না দিয়ে মোবাইল ফোন মেঝেতে ফেলে বুট দিয়ে চুরমার করল রানা। শোফেল্ড বুঝে নেবে, দেরিতে সতর্ক করেছে সে। এবার লোক জোগাড় করে ছুটে আসবে পুরনো হাসপাতালে। পরিত্যক্ত মিলিটারি ফ্যাসিলিটি এই জায়গা থেকে বেশি দূরে নয়।

‘হাতে সময় নেই, বেরিয়ে যেতে হবে,’ তাড়া দিল রানা।

‘এবার বাড়ি ফিরতে পারব?’ জানতে চাইল ইউনা।

‘বাধ্য না হলে কোথাও থামব না,’ বলল রানা। কুড়িয়ে নিয়ে কাপরিস্কির .৪৫ ক্যালিবারের অস্ত্রটা বেল্টে গুঁজল। প্রায় ভরা এক শটগান তুলে ঝুলিয়ে নিল কাঁধে। সত্যিই ওদেরকে খুন করতে এলে প্রাক্তন কর্নেলকে তৈরি থাকতে হবে পাল্টা গুলির জন্যে।

‘এখান থেকে বেরোব কী করে?’ জানতে চাইল নিকোলভ।

‘পঙ্খিরাজে,’ বলল রানা। কয়েকটা লাশ সরিয়ে পেল ভ্যানের ড্রাইভারকে। তার পকেট থেকে নিল ইগনিশন কি। শোফেল্ডের লোক আসার আগেই মিনিভ্যানে চেপে বেরিয়ে গেলে হয়তো নিরাপদে পৌঁছুতে পারবে এয়ারপোর্টে।

‘কীসের পঙ্খিরাজ?’ জানতে চাইল ইউনা।

‘গেলেই দেখবে,’ বলল রানা।

একহাতে রানার ঘাড় পেঁচিয়ে ধরে দরজার দিকে চলল নিকোলভ। পেছনে হাঁটছে ইউনা। সাবধানে দরজা খুলতেই ওরা দেখল বারান্দার মেঝেতে পড়ে আছে একটা লাশ। শটগানের গুলিতে ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে বুক। মেঝেতে একটাকার কয়েনের সমান রক্তের ফোঁটা ফেলে ছায়াময় সিঁড়ির দিকে গেছে কেউ। দরজার কাছেই গুলি খেয়েছে কাপরিস্কির ওই লোক। কতটা জখম বোঝার উপায় নেই। যে-কোনও সময়ে আড়াল থেকে হামলা করতে পারে সে।

কে যেন নিভিয়ে দিয়েছে নিচতলার সব বাতি। অন্ধকারে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল রানা, নিকোলভ ও ইউনা। থমথম করছে চারপাশ। যে-কোনও মুহূর্তে আঁধার থেকে গর্জে উঠবে আগ্নেয়াস্ত্র। একা থাকলে অসংখ্য করিডোরের গোলকধাঁধা ঘুরে অন্য কোনও উপায়ে নিচতলায় নামতে পারত রানা, তবে আহত নিকোলভ আর বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে নানাদিকে না গিয়ে সরাসরি সিঁড়ি বেয়েই নামছে। হাতে রেখেছে কাপরিস্কির শখের পিস্তল। ট্রিগারে তর্জনী। আশপাশে সামান্য আওয়াজ হলে বা নড়াচড়া দেখলে গুলি পাঠাবে ওদিকে। এক ধাপ এক ধাপ করে নেমে চলেছে ওরা, সতর্ক। গুঙিয়ে উঠছে পুরনো তক্তার ধাপ। তৃতীয়তলায় নেমে এল ওরা। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নাইট ভিশন গগল্স্ পেলে ভাল হতো, ভাবল রানা। আশা করছে, গোলাগুলি হলে ওর নিজের রিফ্লেক্স হবে কাপরিস্কির লোকদের চেয়ে ভাল। চারপাশে নীরবতা। কেন যেন ওর মনে হলো, বিপদ বুঝে পালিয়েছে গুণ্ডাগুলো।

পা টিপে টিপে একতলায় নেমে বেরোবার দরজার কাছে পৌছে গেল ওরা। বাধা দেয়ার মত কেউ নেই। অন্ধকার থেকে এল না গুলি। ফয়েতে চকচক করছে রক্তের ফোঁটা। চতুর্থতলায় গুলি খেয়ে এখন নিচতলার দরজার সামনে এসে মরেছে একলোক।

আশপাশে নেই তার দলের কেউ।

‘কাপুরুষ,’ বিরক্ত হয়ে বলল নিকোলভ। ‘নেতা মরতেই লেজ তুলে পালিয়ে গেছে ইঁদুরের পাল!’

গাড়ি-বারান্দায় আছে কালো মিনিভ্যান। কাউকে দেখা গেল না চারপাশে। মনে মনে খুশি হয়ে উঠল রানা। ব্লিপার ব্যবহার করে খুলল গাড়ির দরজা। নিকোলভকে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে সরসর আওয়াজে খুলল স্লাইডিং ডোর। চট্ করে দেখে নিল ভেতরে। লুকিয়ে নেই কেউ। ভাল করেই রানা জানে, কেটে যায়নি বিপদের সম্ভাবনা। আগে নিরাপদে রাখতে হবে ইউনাকে। ওটা ওর প্রথম দায়িত্ব। আজকাল সাধারণ মানুষের জন্যে যেসব গাড়ি তৈরি করে নির্মাতারা, সেগুলোর বডি প্রায় কোকের ক্যানের মতই মোলায়েম। গুলির তো কথাই নেই, গিলটি মিয়ার গুলতি মেরেও ট্যাপ ফেলে দেয়া যায় বড়িতে। এই ভ্যানও সেই একই জিনিস নিরাপত্তা দেবে না কাউকে। রানা খেয়াল করল, বল্টু মেরে মেঝে থেকে ওপরে তোলা হয়েছে পেছনের সিট। বাল্‌কহেডটা পোক্ত বলেই মনে হলো ওর। পেছনে স্টিলের পাত। ‘আঙুলের কড়া দিয়ে টোকা মেরে দেখল রানা। চট্‌ করে ভাঙবে না পাতটা। আপাতত এর বেশি নিরাপত্তা দেয়ার উপায় নেই। সহজ সুরে বলল রানা, ‘ইউনা, পেছনের সিটের সামনে শোবে। মাথা নিচু করে রাখবে। একদম নড়বে না। …ঠিক আছে?’

অতিবাধ্য মেয়ের মত মাথা দোলাল ইউনা। ‘হ্যাঁ, রানা।’

‘আজ আর কাউকে গুলি করার দরকার নেই,’ বলল রানা। ‘বাচ্চা মেয়েদের এসব করতে হয় না।’

‘আমি বাচ্চা মেয়ে নই,’ জোর দিয়ে বলল ইউনা। কড়া চোখে রানাকে দেখে নিয়ে উঠে পড়ল গাড়িতে।

নিকোলভকে সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে উঠতে সাহায্য করল রানা। পাশের সিটের পেছনে রাখল শটগান। নিজে উঠল ড্রাইভিং সিটে। ইঞ্জিন চালু করে জ্বেলে নিল হেডলাইট। জিপিএস-এ দিল গন্তব্য: ভিআনুকোভা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। এখান থেকে ওটা মাত্র ষোলো কিলোমিটার। খুব কাছে, আবার বহু দূরে। কপাল ভাল হলে ওরা যাওয়ার আগেই এয়ারপোর্টে পৌছুবে লুকা ব্রেযনেভের জেট বিমান।

‘সবাই তৈরি তো বাড়ি ফেরার জন্যে?’ জানতে চাইল রানা।

‘আমিও খুশি হতাম বাড়ি থাকলে,’ মন খারাপ করে বলল নিকোলভ।

‘নতুন একটা খুঁজে নেবে,’ বলল রানা। ক্লাচ চেপে প্রথম গিয়ার ফেলল। চেপে ধরেছে অ্যাক্সেলারেটর। গর্জে উঠে রাস্তা সংলগ্ন গেটের দিকে ছুটল মিনিভ্যান। মাথায় লোহার বর্শাওয়ালা গেটে ঝুলছে তালা ও চেইন। এসব খুলতে সময় লাগবে, তাই বাঁদরের মত টপকে গেছে কাপরিস্কির লোক।

‘আটকা পড়ে গেলাম!’ গুঙিয়ে উঠল নিকোলভ।

‘মোটেও না,’ জানাল রানা, ‘সিটবেল্ট বাঁধো, অ্যান্টোনিন। শক্ত হয়ে শুয়ে থাকো, ইউনা।’

অ্যাক্সেলারেটর দাবিয়ে ইঞ্জিনের কাছ থেকে আরও গতি চাইল রানা। গাড়ির নাক তাক করেছে গেটের দুই কবাটের মাঝখানে। ওটাই সবচেয়ে দুর্বল অংশ। খট্ শব্দে সিটবেল্ট লাগিয়ে দু’হাতে মুখ ঢাকল নিকোলভ। ভাবছে, এবার করুণভাবে মরবে সে।

গেটে প্রচণ্ড গুঁতো মেরে ভীষণ ঝাঁকুনি খেল গাড়ি। রানাদের মনে হলো চুরচুর হলো সর্বাঙ্গের হাড়। একপাশের পাল্লা ভেঙে মাটিতে ফেলে ওটার ওপর দিয়ে স্কিড করে গাড়ি বেরিয়ে এল রাস্তায়। পেছনে ছিটকে উঠেছে কমলা ফুলকি। অ্যাক্সেলারেটর মেঝেতে দাবিয়ে দিল রানা। কানা হয়েছে একটা হেডলাইট। কয়েক টুকরো হয়ে ঝুলছে বাম্পার। বিশ্রী শব্দে ঘষা লাগছে পিচ-ঢালা পথে। এ অবস্থাতেই যেতে হবে বেশ কয়েক মাইল দূরের এয়ারপোর্টে। প্রয়োজনে চাকা ছাড়াই ন্যাড়া রিমে ভর করে ড্রাইভ করব; ভাবল রানা।

‘আমরা বেঁচে গেছি!’ খুশিতে হেসে উঠল নিকোলভ।

তবে উচিত হয়নি এত জলদি খুশি হওয়া। কড়াৎ করে একটা আওয়াজ পেল ওরা। পেছনের জানালা ভেঙেছে একটা বুলেট। ওটা বিঁধল প্লাস্টিকের ড্যাশবোর্ডে। চট্ করে রিয়ারভিউ মিররে দেখল রানা। পেছন থেকে দ্রুত ছুটে আসছে উজ্জ্বল সাদা আলো।

পৌঁছে গেছে কর্নেল উইলিয়াম শোফেল্ডের লোক!

৫২

‘কারা এরা?’ চোখ কুঁচকে আয়না দেখল নিকোলভ।

‘জানলে অখুশি হবে।’ মেঝের সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটর মিশিয়ে দিল রানা। চাপের মুখে হুঁই-হুঁই আওয়াজ ছাড়ছে কমজোরি ডিযেল মোটর। পেছনে ঝলমলে সাদা আলো। মিনিভ্যানের দুর্বল খ্যাস-খ্যাস কাঁদুনি ছাপিয়ে শক্তিশালী ইঞ্জিনের চাপা গর্জন শুনল রানা। গ্যায সোবল ভ্যানের চেয়ে অনেক পুরুষালী শোফেল্ডের লোকদের বাহন। আরও খারাপ দিক, হাই-পারফর্মিং সেলুন গাড়ির চেয়ে ঢের বিপজ্জনক খেলনা তাদের হাতে। সামনের গাড়ির জানালা দিয়ে অর্ধেক বেরিয়ে এসেছে এক লোক। পরনে কালো পোশাক। দু’হাতে কী যেন। পরক্ষণে রানা দেখল, কড়াৎ কড়াৎ আওয়াজে অস্ত্রটার মাযল থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে হলদে-সাদা রশ্মির হলকা। গুলির আঘাতে ভেঙে পড়ল পেছনের জানালার পুরো কাঁচ। রানা শুনতে পেল, ভয়ে ফুঁপিয়ে উঠেছে ইউনা। বেচারি আছে পেছন সিটের সামনের মেঝেতে। গলা ছাড়ল রানা, ‘চুপচাপ শুয়ে থাকো, ইউনা!’ নতুন করে মেঝেতে অ্যাক্সেলারেটর দাবিয়ে দিল। লাফিয়ে বাড়ল রেভ কাউন্টারের কাঁটা। ভ্যানের ভেতর নানা আওয়াজ, তবে সে তুলনায় বাড়ছে না ওদের গতি।

ওদিকে ঝড়ের বেগে আসছে শোফেল্ডের সশস্ত্র লোকদের দামি গাড়ি। পাশাপাশি ছুটে ভ্যানের কাছে পৌঁছুল কালো দুই মার্সিডিয। এতই কাছে, রেডিয়েটর গ্রিলের ওপর মার্সিডিয বেন্য ব্যাজ দেখল রানা। হঠাৎ করেই জেট বিমানের মত সরে গিয়ে ভ্যানের দু’দিকে হাজির হলো ওগুলো। এবার চেপে আসবে। তবে প্রাণপণে লড়াই না করে হার মানতে রাজি নয় বেপরোয়া রানা।

পথরুদ্ধ করতে চাইল দুই গাড়ির ড্রাইভার। তিনটে গাড়ি হয়ে গেল ইংরেজি ভি-র মত। অ্যাক্সেলারেটর থেকে পা সরাল না রানা। স্পর্শ করল না ব্রেক প্যাডেল। সামনের গাড়ির পেছনে গুঁতো দেবে বুঝে আঁৎকে উঠল নিকোলভ।

ধাতব কর্কশ আওয়াজ তুলে সামনের দুই গাড়ির মাঝে নাক গুঁজল মিনিভ্যান। চারদিকে ছিটকে গেল ধাতু ও প্লাস্টিকের টুকরো। ফটাস্ করে ভাঙল একটা কাঁচ। বাধ্য হয়ে সরে গেল দুই মার্সিডিয বেনয্। জেদি ভঙ্গিতে মেঝের সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটর দাবিয়ে রেখেছে রানা। গতির জন্যে তাগাদা দিচ্ছে বলে গুঙিয়ে উঠছে দুর্বল ইঞ্জিন। একমাত্র হেডলাইট এখন ট্যাড়া হয়ে দেখছে কালো আকাশ। খস্ খস্ আওয়াজে কী যেন কেটে দিচ্ছে চাকার রাবার। গুঁতো মেরে গতি কমেছে ভ্যানের। রানা বুঝে গেল, গতি না বাড়লে একটু পর ওদেরকে বাগে পাবে লোকগুলো।

রিয়ারভিউ মিররে চোখ রেখে দেখল, নতুন করে তেড়ে আসছে দুই মার্সিডিয বেনয্। আগে ছিল চারটে হেডলাইট, এখন জ্বলছে তিনটে। ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে ওগুলো।

ভীষণ অস্বস্তি জেগে উঠল রানার মনে।

রাতের আঁধারে গর্জে উঠল অটোমেটিক আগ্নেয়াস্ত্র। ঠকাস্ ঠকাস্ শব্দে পাতলা দেহ ভেদ করে ভ্যানের নানানদিকে লাগল বুলেট। রানা বুঝল, এই ফাঁদ থেকে বেরোতে না পারলে ওদের মৃত্যু হবে এই কফিনেই। কাপরিস্কির মত নিকোলভকে বাঁচিয়ে রাখবে না শোফেল্ডের লোক। এয়ারপোর্টে যাওয়ার চেষ্টা আপাতত বাদ দিল রানা। আগে পেছন থেকে খসাতে হবে দুই গাড়ি।

বহু পেছনে পড়েছে গাছে ভরা পুরনো হাসপাতালের আঙিনা! সামনে একের পর এক সরু অ্যাভিন্যু, দু’পাশে সাদা পাথরের বাড়ি। সর্বোচ্চ গতি তুলছে রানা। যাতে গুলি না লাগে, এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে গুলি করছে শোফেল্ডের লোক। বুলেট বিঁধছে আশপাশের পার্ক করা গাড়িগুলোর গায়ে, নানান দালানে ও রাস্তায়। গুলিতে ঝাঁঝরা হচ্ছে পাতলা টিন দিয়ে তৈরি ভ্যান। চট করে নিকোলভের দিকে তাকাল রানা। সোবলে লাগা গুলির আওয়াজের ওপর দিয়ে কী যেন বলছে এক্স এজেন্ট। হঠাৎ নেতিয়ে পড়ল সিটে। রানা ভাবল, গুলি খেয়েছে। তবে পেঁচার মত ড্যাবডেবে চোখে ওকে দেখল নিকোলভ। ‘ঠিক আছি, গুলিটাকে ঠেকিয়ে দিয়েছে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট!’

চিরকাল ভাগ্যের সহায়তা পাবে না ওরা। বাঁচতে চাইলে পাল্টাতে হবে এই পরিস্থিতি। কিন্তু সেটা কীভাবে, ভেবে পেল না রানা। মেঝেতে চেপে রেখেছে অ্যাক্সেলারেটর। শক্ত হাতে ধরেছে স্টিয়ারিং হুইল। বারবার রাস্তায় পিছলে যাচ্ছে চার চাকা। ঠিকভাবে কাজ করছে না ব্রেক। চিৎকার করে জানতে চাইল রানা, ‘তুমি ঠিক আছ তো, ইউনা?’

‘আমার ভীষণ ভয় লাগছে,’ পেছন থেকে ধরা কণ্ঠে বলল ইউনা।

‘একটু ধৈর্য ধরো, সোনাপাখি,’ সিটে ঘুরে বসে বলল নিকোলভ। দুলতে দুলতে তুমুল বেগে চলেছে ভ্যান।

পেছনের সিটের সামনে সরু মেঝেতে শুয়ে আছে ইউনা। ভাবছে রানা, আশা করি গুলি লাগলেও ভাঙবে না স্টিলের বাল্কহেড।

আবারও ভ্যানের পেছনে লাগল একরাশ গুলি। হোঁচট খেল চেসিস। হুইলবেস থেকে ফস্কে গেল বামদিকের চাকা, ফটাস্ ফটাস্ আওয়াজে রাবার বাড়ি মারছে হুইল আর্চের ভেতর। স্কিড ঠেকাতে গিয়ে শক্ত করে স্টিয়ারিং হুইল ধরেছে রানা। কিন্তু ফিযিক্সের নিয়ম মেনে চরকির মত এক পাক ঘুরল ভ্যান। উইণ্ডস্ক্রিনে ঝিকিয়ে উঠল রঙিন আলোর ক্যালাইডোস্কোপ। ঠাস্ করে ড্রাইভারের জানালার ওপর পড়ল রানার কাঁধ ও মাথা। পার্ক করা কয়েকটা গাড়ির একদিক ছেঁচে কাত হয়ে সামনের মোড়ের ফুটপাথে উঠল ভ্যান। প্রচণ্ড আওয়াজে রানার মনে হলো খসে গেছে গাড়ির তলি। দ্রুত এগিয়ে আসছে একসারি বাড়ি। স্টিয়ারিং হুইল নিয়ে ধস্তাধস্তি শুরু করল রানা। নাকের সামনে থেকে সাঁই করে সরে গেল একটা বাড়ির সদর দরজা।

তারপর হঠাৎ করেই থামল ভ্যান। ভীষণ দুলছে সাসপেনশনে ভর করে। একটা চাকার ভেতর বাতাস নেই, তাই একপাশে কাত। ওরা কোথায় আছে বুঝতে এক সেকেণ্ড লাগল রানার। পুরো তিন শ’ ষাট ডিগ্রি ঘুরে একইদিকে নাক তাক করেছে ভ্যান। আয়না থেকে প্রতিফলিত হয়ে উজ্জ্বল আলো পড়ল ওর চোখে। আসছে শোফেল্ডের খুনিরা। নতুন উদ্যমে মেঝেতে অ্যাক্সেলারেটর চেপে ধরল রানা। পার্ক করা এক মোটর সাইকেল পিষে তুবড়ে যাওয়া এক ল্যাডা গাড়িতে গুঁতো মেরে আবারও রাস্তায় নেমে পড়ল ভ্যান।

সামনে সরু রাস্তা। কঠিন হলো স্টিয়ারিং হুইল নিয়ন্ত্রণ করা। বামে পার্ক করা গাড়িগুলোর রঙ ও বডি আঁচড়ে নাচতে নাচতে ছুটে চলেছে ওরা। আগের মতই অ্যাক্সেলারেটর দাবিয়ে রেখেছে রানা। একবার পেছনে তাকাল। তুবড়ে যাওয়া গাড়ি এড়িয়ে এগিয়ে আসছে দুই কালো মার্সিডিয।

সামনের দৃশ্য দেখে রাশান ভাষায় ঝড়ের বেগে কপালকে গালি দিতে লাগল নিকোলভ। একটু দূরেই টি-জাঙ্কশন। এই সরু রাস্তা গিয়ে পড়েছে রাতের ব্যস্ত প্রধান সড়কে। হেডলাইট জ্বেলে সাঁই-সাঁই ছুটছে গাড়ি, মোটর সাইকেল ও ভারী সব ট্রাক- কেউ মানছে না স্পিড লিমিট। দ্রুতগামী আলোর মিছিলে ভ্যান নাক গুঁজলে ভয়ানক দুর্ঘটনা হবে। ফলাফল ওদের মৃত্যু। অথচ, ওদিকে না গিয়ে উপায়ও নেই। তেড়ে আসছে শৌফেল্ডের লোক। একবার বাগে পেলে খুন করবে ওদেরকে।

প্রধান সড়কের পঞ্চাশ গজ আগে হঠাৎ ডানে সরু একটা গলি দেখল রানা। শেষসময়ে ব্রেক কষে ঢুকে পড়ল ওটার ভেতর। আরেকটু হলে ওরা আছড়ে পড়ত পাশের বাড়ির দেয়ালে। গাড়ি সোজা করে রানা দেখল ছোট সাইনবোর্ড:

এ রাস্তা শুধুমাত্র পথচারীদের জন্য।

কয়েক সেকেণ্ড পর রানা বুঝল নিজের ভুল। মাত্র ত্রিশ ফুট দূরেই সমতল রাস্তা থেমেছে গভীর খাদে। আপাতত কাজ বন্ধ নগর পৌরসভার ইঞ্জিনিয়ারদের। ভ্যান খাদ পড়বে দেখে আঁৎকে উঠল নিকোলভ। রানা বুঝল কেন এ পথে চলে না গাড়ি। উঁচু পাথুরে সিঁড়ির ধাপ নেমেছে পাহাড়ি পুরনো লাল ইঁটের সব বাড়ির দিকে। ‘সাবধান!’ রানা বলতে না বলতেই খাড়া সব ধাপ বেয়ে লাফিয়ে, দুলতে দুলতে নামতে লাগল ভ্যান। ধুম-ধুম শব্দে গাড়ির তলিতে লাগছে পাথুরে সিঁড়ি। ডানে বা বামে কোনওদিকেই সরতে পারল না রানা। ব্রেক কোনও কাজ করছে না। স্টিয়ারিং হুইল ধরে বসে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই। যে-কোনও সময়ে ডিগবাজি দেবে ভ্যান, বা কাত হয়ে পড়বে নিচে। তাতেও করুণ মৃত্যু ঘটবে ওদের।

শোফেল্ডের লোক নিশ্চয়ই পাগল নয়, ভাবল রানা। চট্ করে রিয়ারভিউ মিরর দেখে চমকে গেল। পিছু নিয়ে আসছে প্রথম মার্সিডিয। গর্জন ছাড়তে ছাড়তে পড়ল খাড়া সিঁড়ির ধাপে। ভুম্ শব্দে জোর একটা আওয়াজ হলো। গাড়ির সামনের চাকা নেমে যেতেই রাস্তার শেষ কিনারায় বাড়ি মেরেছে সাসপেনশন। পাথুরে ধাপ গাড়ির আণ্ডারক্যারিজে গুঁতো দিতেই ছিটকে উঠল রঙিন ফুলকি। ধুম-ধাম আওয়াজে বারবার কাত হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলেছে দুই গাড়ি। মার্সিডিযের সামনের সিট থেকে অর্ধেক শরীর বের করল এক লোক। হাতে ছোট মেশিন পিস্তল। ভ্যানের দিকে পাঠাল একরাশ গুলি। তবে করে ফেলেছে মস্তবড় ভুল। কাত হয়ে একটা বাড়ির দেয়ালের কাছে চলে গেল তার গাড়ি। কিছু বোঝার আগেই দেয়াল ও গাড়ির মাঝে পিষে গেল লোকটার কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত। ভ্যান নামার ধুম-ধাম আওয়াজের ওপর দিয়েও সংক্ষিপ্ত আর্তনাদ শুনেছে রানা। রিয়ারভিউ মিররে দেখল ইঁটের দেয়াল থেকে সরে গেল মার্সিডিয। খুলে গেছে প্যাসেঞ্জার দরজা। গাড়ি থেকে ধুপ করে পড়ল ভাঙা শরীরের মৃতদেহ। ওটাকে ভেজা গমের মত করে পিষে দিল দ্বিতীয় গাড়িটা।

দুই মার্সিডিযের চেয়ে পনেরো গজ আগে রানার ভ্যান। ফুরিয়ে এল ধাপ, তারপর সামনের রাস্তায় নামার আগে পেভমেন্ট। ওখানে দাঁড়িয়ে হাতে হাত রেখে আলাপ করছে দুই কপোত-কপোতী। ওপর থেকে আস্ত এক ভ্যান ঘাড়ের ওপর নেমে আসছে দেখে তিন লাফে সরে গেল তারা। ‘ভুম’ আওয়াজে রাস্তায় পড়ল ভ্যান। চারপাশে ছিটকে উঠল একরাশ ফুলকি। ঝাঁকি খেয়ে ভ্যানের ছাতে গিয়ে পড়ল ভাঙা বাম্পার। বামে বা ডানে যেতে পারবে ওরা। বামেই রওনা হলো রানা। তীক্ষ্ণ হুঁই-হুঁই আওয়াজে এগোল ভ্যান। তবে গতি বাড়ছে খুব ধীরে।

আরেকটা ভুল করে ফেলেছে রানা।

‘রানা, এটা ওয়ানওয়ে রোড!’ চেঁচিয়ে উঠল নিকোলভ।

‘আমি জানব কী করে?’ মনে মনে বলল রানা। সামনে থেকে ওদের দিকে ছুটে আসছে একের পর এক গাড়ি। হর্নের আওয়াজে ভরে গেল চারপাশ। বারবার টিপ করছে হেডলাইট। গলা ছাড়ল রানা, ‘ইউনা, ঠিক আছ তো?’

‘পারলে থামুন, রানা!’ পেছন সিটের কাছ থেকে এল ওর কাঁপা গলা।

‘সে চেষ্টাই করছি,’ বলল রানা। প্রথম মোড় পেয়েই বাঁক নিল ডানে। রাস্তা থেকে উঠে গেল বামদিকের দুই চাকা। কাত হয়ে ছুটছে ভ্যান। কয়েক সেকেণ্ড পর সিধে হলো চার চাকায় ভর করে। নানান ধাতব আওয়াজ মার খাওয়া গাড়ির ভেতর। ছুটে চলেছে ভ্যান রাতের আঁধারে। ভাঙা জানালা দিয়ে ঢুকছে হু-হু হাওয়া। আততায়ীদেরকে এড়াতে ড্রাইভিঙে পুরো মনোযোগ দিয়েছে রানা। দেখার সময় নেই স্যাটেলাইট ন্যাভিগেশন। জানা নেই কোথায় আছে ওরা। চারপাশে গত শতাব্দীর বিশাল সব বাড়ি। পেছনে পড়ছে একের পর এক রাস্তার সাইনবোর্ড। একটা বুলেভার্ডে ঢুকতেই দেখল, দু’দিক দিয়েই চলছে গাড়িঘোড়া। পিছিয়ে গেলেও দূরত্ব বজায় রেখে আসছে দুই মার্সিডিয। কারণটা জানা নেই, তবে খেয়াল করল রানা, আগের চেয়ে গতি কম তাদের। রানা ভাবল, সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে হয়তো ক্ষতি হয়েছে ওই দুই গাড়ির।

‘পেছনে পড়ছে,’ হাঁফ ছাড়ল নিকোলভ। ‘হয়তো নিরাপদে পৌঁছে যাব এয়ারপোর্টে।

সত্যিই কি কপাল খুলবে?-ভাবল রানা।

৫৩

বহু পেছনে শোফেল্ডের দুই গাড়ি। বেশ এগিয়ে আছে রানার ভ্যান। ওরা সুযোগ পেয়েছে পালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু ঠিক তখনই জাঙ্কশনে হাজির হলো তুবড়ে যাওয়া হলদে এক ট্যাক্সিক্যাব। সরাসরি ওটা চলে এল সামনে। অনেক দেরিতে ভ্যানটাকে দেখেছে ড্রাইভার। ব্রেক প্যাডেলে দাঁড়িয়ে গেল সে। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মাঝ রাস্তায় থামল তার ট্যাক্সিক্যাব।

হঠাৎ করে থামতে পারবে না রানা। অতিরিক্ত জোরে চলছে ভ্যান। মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়াতে গিয়ে বনবন করে স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাল রানা। ঠিকভাবে কাজ করছে না ওটা। তার ওপর ফেটে গেল পেছনের একটা চাকা। ফলে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারাল রানা। মুহূর্তের জন্যে শুনল নিকোলভের আর্তনাদ। পরক্ষণে ভয়ঙ্করভাবে শুরু হলো স্কিড। সামনের এক গাড়ির পাশে গুঁতো মেরে পৌছে গেল রাস্তার পাশে। একই জায়গায় লাটিমের মত একপাক ঘুরেই ভ্যান গিয়ে ভাঙল একটা সাইন বোর্ড। ওখানে না থেমে ঢু দিতে গেল একটা বাসের নাকে। তবে একেবারে শেষ সময়ে যন্ত্রদানবের পাশ দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পড়ল ব্যস্ত মাল্টি- ওয়ে ইণ্টারসেকশন-এ। চারদিক থেকে আলো এসে চোখ ধাঁধিয়ে দিল রানার। প্যাঁ-পোঁ-ভ্যাঁপ-ভোঁ আওয়াজে বাজছে অসংখ্য গাড়ির হর্ন। রানা নিজেও জানে না কীভাবে নিয়ন্ত্রণে নিল, তবে চরকির মত না ঘুরে ভ্যান ঢুকে পড়ল দ্রুতগামী গাড়ির সারির ভেতর। সামনেই জ্বলজ্বলে আলোকিত এক আণ্ডারপাসের দিকে চলেছে সবাই।

বারবার হর্ন দিয়ে বিপজ্জনকভাবে সারি সারি গাড়ির মাঝ দিয়ে ভ্যানের কাছে পৌঁছে গেছে দুই মার্সিডিয। রিয়ারভিউ মিরর দেখছে রানা। গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত ভ্যানের পেছনে ঢুশ দিতে এল সামনের গাড়িটা। সুযোগ পেলেই ওভারটেক করবে। বিপদটা বুঝে ব্রেক কষে বা বাঁক নিয়ে সরছে আশপাশের গাড়ির ড্রাইভাররা। যে-কোনও সময়ে সচেতন নাগরিকরা ফোন দেবে পোলিতসিয়া স্টেশনে। ফলে শুরু হবে নতুন আরেক গাড়ি প্রতিযোগিতা।

ফটাস্ ফটাস্ আওয়াজে পেছনের হুইল আর্চে লাগছে ফাটা চাকা। অতিরিক্ত দ্রুত ছুটছে রানা। যে-কোনও সময়ে প্যাসেঞ্জার কমপার্টমেন্ট ফাটিয়ে ভেতরে ঢুকবে পুরু রাবার। নানাদিকে ঘুরতে চাইছে স্টিয়ারিং হুইল। ওটা ধরে রাখতে গিয়ে ব্যথা শুরু হয়েছে রানার হাতে। নষ্ট হচ্ছে ড্রাইভ করার মনোযোগ। তবে হুইল রিম থেকে শেষ ফাটা রাবার খসে যেতেই রানা দেখল পেছনের এক গাড়ির উইণ্ডশিল্ডে গিয়ে পড়ল ওটা। খুব কঠিন ছিল সোজা পথে ভ্যান রাখা, তবে চাকা নেই বলে আগের চেয়ে ভালভাবে সাড়া দিল ইঞ্জিন। আবারও দ্রুত ওপরে উঠছে স্পিডোমিটার।

তখনই রানা দেখল, বাম থেকে ওভারটেক করতে শুরু করেছে কালো একটা মার্সিডিয। কিছু করার আগেই ওর পাশে পৌঁছে গেল গাড়িটার নাক। খুলে গেছে পেছনের জানালার কাঁচ। রানার চোখে পড়ল তিক্ত চেহারার এক লোক ও কুচকুচে কালো অস্ত্রের ব্যারেল। ভ্যানের পাতলা বডি ঠেকাবে না বুলেট!

হুইল ঘুরিয়ে পাশ থেকে মার্সিডিয়ের ওপর চড়াও হলো রানা। ধুম্ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দু’দিকে সরল দুই গাড়ি। আবারও নিয়ন্ত্রণ হারাবে সে-ভয় ছিল, কিন্তু সামলে নিল ভ্যানটা। পিছিয়ে গেছে মার্সিডিয়। ওটা দ্বিতীয়বার সুযোগ নেয়ার আগেই ডানে-বামে সরে পথরুদ্ধ করল রানা।

আণ্ডারপাসের মুখে নিচে গেছে রাস্তা। তুমুল বেগে চলেছে তিন গাড়ির কনভয়। সামনে দু’দিকে যাওয়ার দুই লেনের রাস্তা। মাঝে ব্যারিয়ার ও পুরু কংক্রিটের পিলার পেছনের গাড়ি ভ্যানের এতই কাছে, রানা পরিষ্কার দেখল সামনের সিটের লোকটাকে। ভাল করেই বুঝল, গতি তুলে পেছনে ফেলতে পারবে না মার্সিডিযকে। ওর চাই অন্য কোনও কৌশল। হাত পেছনে নিয়ে একটু হাতড়াতেই পেয়ে গেল শীতল স্টিলের পাম্প-অ্যাকশন শটগানের ব্যারেল। খাটো অস্ত্রটা নিকোলভের কোলে ফেলল রানা। ‘গুলি করো ওদেরকে!’

‘জীবনেও গুলি করিনি!’ আপত্তির সুরে বলল নিকোলভ।

‘কোড ব্রেক করার চেয়ে গুলি করা অনেক সহজ, অ্যান্টোনিন। পাম্প করবে, নল ঠিক দিকে তাক করবে, টিপে দেবে ট্রিগার।’

আলতো করে বন্দুক স্পর্শ করল নিকোলভ। ভাব দেখে রানার মনে হলো, মানুষটা ভাবছে তার হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে টাইম বোমা। তবে কয়েক সেকেণ্ড পর সেফটি বেল্ট আনক্লিপ করে সিটে ঘুরে বসল নিকোলভ। জখমের ব্যথায় কুঁচকে গেছে মুখ। ভাঙা জানালা দিয়ে দেখল পেছনে। নাকের কাছে উজ্জ্বল সাদা আলো নিয়ে ধেয়ে আসছে একটা মার্সিডিয। সামনের দুই সিটের মাঝ দিয়ে নল তাক করল নিকোলভ। অনভ্যস্ত হাতে পাম্প করল বন্দুক, তারপর ভীত কণ্ঠে গাড়ির আওয়াজের ওপর দিয়ে চিৎকার করল, ‘পারব না! ইউনার গায়ে গুলি লাগবে!’

‘তা হলে জানালা দিয়ে শরীর বের করে গুলি করো, ‘ কঠোর সুরে বলল রানা।

গুঁতো খেয়ে আর গুলি লেগে ফেটে গেছে প্যাসেঞ্জার জানালা। বন্দুকের নল দিয়ে বাড়ি মেরে ওটার কাঁচ ঝরাল নিকোলভ। কাত হয়ে বুক বের করল বাইরে। সাঁই-সাঁই করে বইছে দমকা হাওয়া। বন্দুক ধরে চোখ বুজল কোড ব্রেকার। পরক্ষণে টিপে দিল ট্রিগার।

বুম!

প্রবল হাওয়া ও ইঞ্জিনের

ও ইঞ্জিনের গর্জনে হারিয়ে গেল আওয়াজটা। যে ঝাঁকি দিল বন্দুক, আরেকটু হলে নিকোলভের হাত থেকে রাস্তায় পড়ত।

ঠিকভাবে বন্দুক তাক না করলেও কাজ হলো ভালভাবেই। কড়া ব্রেক কষে দ্রুত পেছাল মার্সিডিয়। বাকশটের আঘাতে ফুটো হয়েছে বনেট। উইণ্ডশিল্ডের নিচের অংশে এখন হাজারখানেক মাকড়সার জাল। ডানে-বামে সরছে গাড়ি। হঠাৎ সামনের চাকা নেমে গেল রাস্তা থেকে। আড়াআড়ি হয়েই পরক্ষণে চরকির মত ঘুরল গাড়ি। ভারসাম্য হারিয়ে চিত হয়ে শুরু করল ডিগবাজি। মাঝের পুরু এক পিলারে গিয়ে লাগল মার্সিডিয। নানাদিকে ছিটকে গেল অসংখ্য ভাঙা ধাতব টুকরো। পিলার বেয়ে উঠতে গিয়েও বিস্ফোরিত হলো মার্সিডিয। চারদিকে ছড়াল আগুনের বিশাল কমলা-হলুদ গোলা। আরেকটু হলে চেটে দিত ভ্যানের পেছনদিক।

দূর থেকেও ঘাড়ের রোমে গরম হলকা টের পেল রানা।

জানালা দিয়ে অর্ধেক দেহ বের করেছে নিকোলভ। ভয় ও জয় মিশ্রিত চিৎকার ছাড়ল। গাড়ির ভেতরে ফিরে চোখ রাখল রানার চোখে। অবাক কণ্ঠে বলল, ‘আমি করেছি ওটা?’

রানা জবাব দেয়ার আগেই ভ্যানের কাছে পৌঁছুল আগুনের লকলকে জিভ। অ্যানাকোণ্ডা সাপের মত গড়িয়ে আসছে জ্বলন্ত মার্সিডিয! দুই টনি গাড়ির নিচে চাপা পড়লে চ্যাপ্টা হবে ওরা!

ছুটন্ত ভ্যানের পেছনে গুঁতো দিল বিধ্বস্ত মার্সিডিযের একটা অংশ। রানার গাড়ির পিছনদিক লাফিয়ে উঠল আকাশে। আরেকটু হলে সামনের পিলারে গুঁতো মেরে মরত ওরা। মার্সিডিযের গুঁতোটা এতই জোরাল, জানালা গলে রাস্তায় পড়তে গেল নিকোলভ। কিন্তু ঝট্ করে হাত বাড়িয়ে তার প্যান্টের বেল্ট আঁকড়ে ধরল রানা। একইসময়ে দুম শব্দে রাস্তায় নামল ভ্যানের পেছনের চাকা। টলমল করে আরেক দিকে চলল গাড়ি। কর্কশ আওয়াজে পিচঢালা পথ কামড়ে ধরতে চাইছে তিন চাকা। গাড়ি সোজা করতে চাইছে রানা। নিজেও জানে না কীভাবে যেন পেছনে পড়ল আণ্ডারপাস। বেরিয়ে এসেছে ওরা রাতের আকাশের নিচে। সিটে আধশোয়া হয়ে হাঁফাতে লাগল নিকোলভ। বিড়বিড় করল, ‘রানা, অস্ত্রটা হারিয়ে ফেলেছি!’

‘আফসোস করে লাভ কী,’ জানাল রানা। ওর মনে হলো না আবারও অস্ত্র লাগবে। রিয়ারভিউ মিররে দেখছে আণ্ডারপাস থেকে ভলকে বেরোচ্ছে কমলা আগুন ও কালো ধোঁয়া। পাতাল রাস্তায় দুর্ঘটনা হওয়ার আগেই থেমেছে একসারিতে অনেকগুলো গাড়ি। প্রথম মার্সিডিযের মাত্র কয়েক ফুট পেছনেই ছিল দ্বিতীয় মার্সিডিয। আগুনে পুড়ে যাওয়ার কথা ওটার।

বোধহয় আর কোনও বিপদ হবে না, ভাবল রানা। কিন্তু তখনই দেখল আগুন থেকে ছিটকে বেরোল দ্বিতীয় মার্সিডিয। পুড়ে গেছে রঙ। তুবড়ে গেছে বডি। কিন্তু আসছে ঝড়ের বেগে!

‘হায় রে, ঈশ্বর!’ নিচু গলায় বলল নিকোলভ।

উল্টোদিক থেকে আসছে বেশ কিছু গাড়ি। কিন্তু রানার ভ্যানের পেছনে রয়েছে মাত্র একটা- শোফেল্ডের লোকের তুবড়ে যাওয়া কালো মার্সিডিয়।

ওটাকে পেছনে ফেলার সাধ্য এই ভ্যানের নেই।

ওপরে উঠছে পাহাড়ি রাস্তা। দু’পাশে নতুন হাই-রাইয অ্যাপার্টমেন্ট ভবন, হাউসিংগুলোর জমি ও বাড়ি। নতুন করে গড়ে তোলা হচ্ছে এদিকের এলাকা। বাড়িঘরের মাঝ দিয়ে দেখা গেল বহু দূরে নানাদিকে ছড়িয়ে পড়েছে আলোকিত মস্কো। রানা বুঝে গেল, এটা শহরতলী। তবে জানা নেই জায়গাটা কোথায়। এটাও রানা জানে না, আর কতক্ষণ চলবে মার খাওয়া মিনিভ্যান। পোড়া গন্ধ আসছে অতি তপ্ত ইঞ্জিন থেকে। তাপমাত্রার গেজের কাঁটা পৌঁছে গেছে গাঢ় লাল অংশে। বারবার সতর্ক করছে ড্যাশবোর্ডের ছোট্ট আলো। তবে ওটাকে পাত্তা দেয়ার উপায় রানার নেই।

এগোতে থাক্, বাপ, বিড়বিড় করল রানা। কিন্তু ওর কথা শুনেই বোধহয় গতি কমাল ভ্যান। বাজে কিছু হয়েছে ইঞ্জিনের। বোধহয় গুলি লেগেছে মেকানিকাল কোনও অংশে। আবারও আসছে

আসছে মার্সিডিয। ভেতরে বেশ কয়েকজন। সুযোগ পেলে খুন করবে রানা, নিকোলভ ও ইউনাকে। কয়েকটা গুলি পাঠাবার পর থেমে গেল তারা। কাছে না এসে নষ্ট করবে না বুলেট।

‘একটু পর এগিয়ে এসে ঘাড়ে শ্বাস ফেলবে,’ একবার পেছনে দেখে নিয়ে বলল নিকোলভ। ‘আমরা এবার কী করব, রানা?’

‘মুখোমুখি হব,’ বলল রানা। ‘গোলাগুলিতে যা হওয়ার হবে। এটা তো জানি, আর কিছু করার ছিল না। মানুষ বড়জোর পারে চেষ্টা করতে। তাই না?’

বিস্ফারিত চোখে কয়েক মুহূর্ত দার্শনিক রানাকে দেখল নিকোলভ। আবেগে কাঁপছে রাশান মানুষটার দু’গাল। হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে খুলতে লাগল বুলেটপ্রুফ ভেস্ট। আগে ওটা রক্ষা করেছে তাকে। সিট টপকে ইউনার কাছে পৌঁছে গেল নিকোলভ। ভাল করে ঢেকে দিল মেয়ের দেহ। রানা শুনতে পেল ফুঁপিয়ে কাঁদছে ইউনা। ডাচ ভাষায় ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছে নিকোলভ।

হাউসিং এলাকা পেরোতেই সামনে পড়ল মস্কোর বাইরের দিকের ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা। চারপাশে পুরনো ফ্যাক্টরি ও ওয়্যারহাউস। নানাদিকে আকাশছোঁয়া ক্রেন ও ডেরিক। অনেক দূরে উজ্জ্বল সাদা বাতি। ওটা সেতু। আলো বিলিয়ে চলেছে মস্কোর ওপর। দূরে হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনল রানা। দেরিতে হলেও মাঠে নেমেছে রাশান পোলিতসিয়া। তিক্ত হাসল ও। যাদেরকে এড়াতে চেয়েছে, এখন তারাই একমাত্র দল, যাদের সাহায্য পেলে প্রাণে বাঁচবে ওরা। অবশ্য শেষ লড়াইয়ের আগে পৌঁছুতে পারবে না পুলিশবাহিনী। সুতরাং যা করার করতে হবে রানাকেই।

৫৪

আবারও ভ্যানের পেছনে পৌঁছে গেছে প্রাক্তন কর্নেল শোফেল্ডের কালো মার্সিডিয। নামিয়ে নেয়া হয়েছে জানালার কাঁচ। দু’দিক থেকে মাথা ও কাঁধ বের করেছে দুই লোক। রাগে সরু হয়েছে চার চোখ। মাথার চুল ও পোশাকে খামচি দিচ্ছে দমকা হাওয়া। কঠিন হাতে ধরেছে অটোমেটিক মেশিন পিস্তল। কয়েক মুহূর্ত পর নতুন করে ভ্যানের ওপর গুলিবর্ষণ করল তারা। থরথর করে কাঁপছে গাড়ির বডি। দ্বিতীয় সারির সিটের পেছনে মেয়েকে নিজের শরীর দিয়ে ঢেকে রেখেছে নিকোলভ। তৃতীয় সিটের লোহার বাল্‌কহেডে ঠকাঠক্ লাগছে বুলেট। একটা বুলেট ছিলে নিল রানার কাঁধের মাংস। ব্যথাটা যেন পেয়েও পেল না রানা। আরেকটা বুলেট বিঁধল ডান কানের পেছনে হেডরেস্টে। স্টিয়ারিং হুইলে রাখা বাম বুড়ো আঙুলের এক ইঞ্চি দূরে লাগল আরেকটা, পিছলে গিয়ে চুরচুর করল উইণ্ডশিল্ডটাকে। সামনের দিক হলো মাকড়সার জালের মত। বেল্ট থেকে কাপরিস্কির পিস্তল নিয়ে নলের বাড়িতে ফাটল ভরা উইণ্ডশিল্ড ভাঙল রানা। হু-হু করে ভেতরে ঢুকল শীতল একরাশ হাওয়া। মুহূর্তে শুকিয়ে গেল ওর ঠোঁট। চোখে টলমল করছে পানি। বুঝে গেল, ভ্যানের সাধ্য নেই যে আর বেশিদূর চলবে। বনেটের তলা থেকে বেরোচ্ছে কালচে ধোঁয়া। যে-কোনও সময়ে বন্ধ হবে ইঞ্জিন। ভ্যানের গতি আর একটু কমতেই পাশে পৌছে গেল মার্সিডিয। কয়েকটা গুলিতে চুরমার হলো ড্রাইভিং জানালার কাঁচ। আগেই ফুটওয়েলে বসে পড়েছে রানা। জানালা দিয়ে বের করল পিস্তল সহ ডানহাত, পরক্ষণে এক এক করে ছয়টা গুলি করল মার্সিডিয লক্ষ্য করে। কড়া ব্রেক কষে ক্র্যাচ-ক্র্যাচ আওয়াজ তুলল মার্সিডিয। মুহূর্তে কয়েক গজ পেছনে সরে গেল ওটা। কারও গায়ে গুলি লেগেছে কি না জানে না রানা। তবে ওদের কাছে যে অস্ত্র আছে, তা বুঝিয়ে দেয়া গেছে।

বেশ কয়েক মুহূর্ত অন্ধের মত ড্রাইভিং করেছে ও। সিটে বসে দেখল, ওরা ছুটে চলেছে সরু এক সেতু লক্ষ্য করে। ওদিকে জঞ্জালে ভরা অনুর্বর জমিতে পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরি ও ওয়্যারহাউস। সেতুটা পুরু লোহার তৈরি। একসময়ে শ্রমিক আসা যাওয়ার জন্যে এবং মালামাল আনা নেয়ার কাজে লাগত। সেতুর এবড়োখেবড়ো অ্যাসফল্টের দু’পাশে রেলিঙের বদলে রয়েছে পাতলা লোহার জাল। চল্লিশ ফুট গভীর খাদে কংক্রিটের চাপড়া থেকে ওপরে উঠেছে লালচে জঙে ভরা গার্ডার। খাদের তলে পড়ে আছে সোভিয়েত আমলের পুরনো ড্রাম ও ভাঙাচোরা গাড়ি।

লোহার সেতুর প্রথম আর্চওয়ে পেরোল ভ্যান। মার্সিডিযের এগিয়ে আসা ঠেকাতে বারবার এদিক ওদিক সরছে রানা। যদিও বুঝল, এসবে কাজ হবে না। ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে ভ্যানের গতি। বনেটের তলা থেকে ভক-ভক করে বেরোচ্ছে কালো ধোঁয়া। যে-কোনও সময়ে সিয করবে ইঞ্জিন। তাপমাত্রার গজ পেরোতে চাইছে শেষ লাল এলাকা।

ভ্যানের কাছে পৌঁছে গেছে দ্রুতগামী মার্সিডিয। ভেতরের লোকগুলো এখন বোধহয় খুশি। একটু পরেই শেষ হবে খেলা।

অবশ্য সব শেষ না-ও হতে পারে। চিরকাল রানা দেখেছে, যখন ফুরিয়ে যায় এগোবার পথ, তখনই সামনে হাজির হয় অন্য কোনও উপায় বা পথ। কাঁধের ওপর দিয়ে হাঁক ছাড়ল রানা, ‘শক্ত হয়ে বসো!’ ভ্যানের উদ্দেশে বিড়বিড় করল, ‘শেষবারের মত দেখিয়ে দে কী পারিস! আর কষ্ট দেব না, এই শেষবার!’ মেঝের সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটর দাবিয়ে দিল ও। ভীষণ কেশে উঠল ইঞ্জিন। হোঁচট খেল ভ্যান, তারপর হঠাৎই বাড়তে লাগল গতি। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে কয়েক ফুট পেছনে পড়ল মার্সিডিয।

এ-ই চেয়েছে রানা। নীরবে ধন্যবাদ দিল ভ্যানটাকে। অ্যাক্সেলারেটর থেকে পা তুলেই গায়ের জোরে চাপ দিল ব্রেক প্যাডেলে। ওর শরীর ছিটকে এগোতে চাইলেও সিটবেল্ট আঁকড়ে ধরল ওর কাঁধ। বুলেটের জখমের ব্যথাটা হয়ে উঠল অসহ্য। বুট দিয়ে বারবার প্যাডেল চাপ দেয়ায় কড়া ব্রেক কষল অ্যান্টি-লক ব্রেকিং সিস্টেম। সেতুর অ্যাসফল্টের ওপর ক্রিচ-ক্রিচ আওয়াজ তুলল তিন চাকা। ভুস ভুস শব্দে বেরোল পোড়া রাবারের ধোঁয়া।

আঘাতের জন্যে তৈরি রানা।

তখনই, গতি কমাতে না পেরে ভ্যানের পেছনে প্রচণ্ড জোরে গুঁতো দিল মার্সিডিয। মুচড়ে গেল দুই গাড়ির ধাতব দেহ। নানাদিকে ছিটকাল প্লাস্টিকের টুকরো। চরকির মত ঘুরতে শুরু করেছে দুই গাড়ি। ভ্যানের চেয়ে ভারী এবং পোক্তভাবে তৈরি মার্সিডিয। সোবলের পেছনের বাকি চাকা, সাসপেনশন ও চেসিস ক্রস মেম্বারের অংশ ছিঁড়ল ওটা। প্রচণ্ড ধাক্কা লেগেছে বলে কামানের গোলার মত একদিকে সরল গাড়িটা। নিচু চাকাগুলো কামড়ে ধরল রাস্তা। একই কারণে কমে গেল পিছলে যাওয়ার গতি। কিন্তু এত ওজন ও গতি কোথাও না কোথাও ব্যয় করতে হবে। রানার মনে হলো, ও দেখছে স্লো মোশন সিনেমা। দুই চাকায় ভর করে কাত হলো ভারী মার্সিডিয। স্বাভাবিকভাবেই কাজ করল নিউটনের ল অভ ডাইনামিক্স। দুই গড়ান দিয়ে মার্সিডিযটা গিয়ে পড়ল সেতুর প্যারাপেটে। পরক্ষণে পেনাল্টি কিক খাওয়া ফুটবলের মত জড়িয়ে গেল জঙ-ধরা লোহার জালে। খটাং আওয়াজে ছিঁড়ল পলকা জাল। ওটাকে নিয়ে ডিগবাজি দিয়ে খাদের দিকে রওনা হলো মার্সিডিয। মাত্র তিন সেকেণ্ড পর নিচ থেকে এল পতনের কর্কশ, জোরালো আওয়াজ।

এতক্ষণ নানান আওয়াজের পর হঠাৎ করেই চারপাশে নামল ভুতুড়ে নীরবতা।

কয়েক মুহূর্ত পর চোখ মেলতেই রানা জেনে গেল, ও শুয়ে আছে ড্রাইভারের দরজার ওপর। গাল বেয়ে দরদর করে পড়ছে রক্ত। দুই গাড়ির ধাক্কা লাগতেই জানালায় আছড়ে পড়ে কেটে গেছে মাথার তালুর চামড়া। কাত হয়ে পড়ে আছে ভ্যান। ইঞ্জিন বন্ধ। সেতুর গার্ডারের মাঝ দিয়ে মৃদু হিসহিস আওয়াজে বইছে হাওয়া। ভ্যানের পেছনে কাশির আওয়াজ পেল রানা। জোরে শ্বাস নিল কেউ। কনুইয়ে ভর করে উঠে বসতে চাইল রানা। কথা বলতে চাইলেও ওর গলা দিয়ে বেরোল কোলা ব্যাঙের ডাকের মত বিশ্রী আওয়াজ।

‘ইউনা? নিকোলভ?’

‘আমরা ঠিক আছি,’ পেছন থেকে এল নিকোলভের দুর্বল কণ্ঠ। ‘মরিনি। মনে হয়!’

‘এবার বাড়ি ফিরতে পারব, রানা?’ জানতে চাইল ইউনা।

মেয়েটার কণ্ঠ শুনে স্বস্তির ঢেউ বয়ে গেল রানার বুকে। নরম স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ, এবার পারব। তবে সেজন্যে আরেকটা গাড়ি লাগবে।’

সিটবেল্ট খুলে হামাগুড়ি দিয়ে বাপ-বেটির পাশে পৌঁছুল রানা। সোবলের তুবড়ে যাওয়া স্লাইডিং ডোর খুলতে গিয়ে গায়ের সমস্ত জোর খাটাতে হলো রানা ও’ নিকোলভকে। প্রথমে গাড়ি থেকে বেরোল রানা, তারপর দু’হাতে ভেতর থেকে তুলে নিল ইউনাকে। শেষে কাত হয়ে পড়ে থাকা গাড়ি থেকে বেরোল নিকোলভ। হতভম্ভ চেহারা হয়েছে তার, ভাবছে এইমাত্র জেগে উঠেছে দুঃস্বপ্ন থেকে।

রানারও মনে হচ্ছে ওটা ছিল বাজে এক স্বপ্ন। তবে রয়ে গেছে সামান্য কাজ। সেটা শেষ করতে হবে। প্যারাপেট থেকে খাদের ভেতর বিধ্বস্ত মার্সিডিযটা দেখল রানা। নাকের ওপর ভর দিয়ে পড়েছে গাড়ি। তারপর স্থির হয়েছে ছাতে ভর দিয়ে। একটা দরজা খোলা। গাড়ি বা খাদের ভেতর নড়ছে না কেউ।

রানা প্যারাপেট থেকে খাদে নামছে দেখে জানতে চাইল নিকোলভ, ‘কই যাও?’

জবাব না দিয়ে ঢালু জমি বেয়ে নেমে চলেছে রানা। চারপাশে আবর্জনা ও জঞ্জাল। খাদের ভেতর কাঁচা মাটির গন্ধ পেল। পতনের সময় মাটি থেকে ঘাস ও ঝোপঝাড় উপড়ে নিয়েছে ভারী গাড়ি। আঁধার খাদে পাথরের খণ্ড ভরা মেঝেতে নামতে পুরো একমিনিট লাগল ওর। ওকে সাহায্য করল ডাক্তার অ্যাঞ্জেল নেবেসার ফোনের টর্চ। বেল্ট থেকে নিয়ে ডানহাতে পিস্তল রেখেছে রানা। তবে ওর মনে হচ্ছে, দরকার পড়বে না ওটার।

বিধ্বস্ত গাড়ির একটা চাকা এখনও ঘুরছে ধীরে। ডেবে গেছে মার্সিডিযের ছাত। ভ্যানে গুঁতো মেরে মুচড়ে গেছে সামনের উইং ও গ্রিল। চল্লিশ ফুট ওপর থেকে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছে ড্রাইভার। ফাটা উইণ্ডস্ক্রিন ভেদ করেছে রক্তাক্ত ঊর্ধ্বাঙ্গ। দরজাটা খুলে যাওয়ার সময় দূরে গিয়ে পড়েছে একলোক। পাথরে গুঁতো খেয়ে চুরমার হয়েছে মাথা।

গাড়ির ভেতর টর্চের আলো ফেলল রানা।

ভেঙে গেছে জানালা-দরজা। ফেটে যাওয়া ফিউয়েল ট্যাঙ্ক থেকে আসছে অকটেনের কড়া গন্ধ। গাড়ির ভেতরে রয়েছে তিনজন লোক। তাদের মধ্যে এখনও বেঁচে আছে শুধু একজন— উইলিয়াম শোফেল্ড।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *