এক্স এজেন্ট – ৪০

৪০

‘আধুনিক টেকনোলজি বলব না,’ বলল শোফেল্ড। ‘প্রতিটি স্মার্ট ফোনেই আছে এই চিপ। যে-কোনও ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি চাইলেই ওটার মাধ্যমে যে-কাউকে ট্র্যাক করতে পারে। তবে ঠিকই বলেছেন, ভিআনুকোভা এয়ারপোর্টে এজেন্ট বেলিনভ যাওয়ার পর থেকেই জানতাম, কোথায় আছেন আপনি। যখন মস্কো থেকে পালিয়ে গ্রামাঞ্চলে গেলেন, তখনও চাইলে যে-কোনও সময়ে বাধা দিতে পারতাম। সর্বক্ষণ শুনেছি আপনার প্রতিটি কথা। এক পর্যায়ে মনে হলো, পরস্পরকে পছন্দ করছেন আপনারা। তবে প্রেমের সুযোগটা আর দিতে পারলাম না।’

‘আধুনিক টেকনোলজির খারাপ দিক,’ বলল রানা। ‘তবে ওই খামারে আমরা পৌঁছুলে যখন প্রমাণ হিসেবে ডিভাইসটা দেখাল নিকোলভ, তখন আপনাদের এজেণ্ট ওটা কেড়ে নিতে চাইল না কেন? তা হলে কি ধরে নেব তাকে প্রোগ্রামিং করা হয়নি? সেক্ষেত্রে আপনার কথাই ঠিক, এজেণ্ট বেলিনভ ছিল আপনার হাতের সামান্য পুতুল। ঠিক সময়ে মেশিনের মত অফ করে দেয়া হয়েছে তাকে। আমি কি ভুল বলেছি?’

‘প্রায় ঠিকই বলেছেন,’ মৃদু হাসল শোফেল্ড। ‘তার মিশন ছিল নিকোলভ আর এস. এম. ৬১৪৩ ডিভাইস খুঁজে বের করা। একইসঙ্গে তার মাধ্যমে আমরা জানলাম আপনি কী করছেন, কী শুনছেন বা কী বলছেন। বহু দূরে চলে গেছে নিকোলভ। তাকে খুঁজতে গেলেন। ফলে আপনাদেরকে ধরার জন্যে দরকারি সৈনিক জোগাড় করতে সময় লেগেছে। পরে অবশ্য খারাপ লেগেছে এতজনকে হারিয়ে। আগে সুযোগ ছিল না যে এজেণ্ট বেলিনভকে ব্যবহার করে কেড়ে নেব নিকোলভের কাছ থেকে এস. এম. ৬১৪৩ ডিভাইস।’

‘ব্যাপারটা অনেকটা মেশিনের সুইচ অন-অফের মত, তা-ই না?’ গম্ভীর হয়ে গেছে রানা। ভাবছে, সুযোগ পেলে ছিঁড়ে নেব হারামি বদমাশটার কলজে।

‘কমাণ্ড প্যারামিটার্স রিসেট করতে হয়। সেটা করতে হবে আমার কন্ট্রোল রুম থেকে। ভাবতেও পারবেন না মগজ নিয়ন্ত্রণে কতটা এগিয়ে গেছে আধুনিক টেকনোলজি। এস. এম. ৬১৪৩ ডিভাইস বহু আগেই পুরনো হয়ে গেছে। ওটা রাখা উচিত জাদুঘরে। কয়েক দশক ধরে এসেছে কমপিউটার নিয়ন্ত্রিত খেলনা। যদিও সাধারণ মানুষকে এসব জানাব না আমরা।’

কৌতূহলী চোখে রানাকে দেখল শোফেল্ড। ‘ওটা দেখেছে এমন মাত্র ক’জনের ভেতর আপনি একজন। আমি নিজেও দেখিনি ওটা। তাই মনে হচ্ছে, ওটা কোথায় আছে তা আপনি জানিয়ে দিলে নিজের চোখ সার্থক করতাম। আরও খুশি হব ওটার সঙ্গে মাইক্রোফিল্মটা ফেরত পেলে।’

‘যদি জানতাম কোথায় আছে, তা-ও জানাতাম না,’ স্পষ্ট বলল রানা।

‘আপনি যে এ কথা বলবেন, তা ভেবেছি,’ বলল শোফেল্ড, ‘তবে যে-কারও পেট থেকে তথ্য জোগাড় করতে আমরা এক্সপার্ট। আমাদের কাজে বাধা দিলে সামনে সময়টা ভাল কাটবে না আপনার।’

‘তা হয়তো ঠিক। এ-ও বুঝতে পারছি, এই মুহূর্তে নিকোলভের মুখ খোলাবার জন্যে নির্যাতন চালাচ্ছে আপনাদের একদল নিষ্ঠুর লোক। তবে সফল হচ্ছে না তারা। নইলে এ কথা আমাকে বলতেন না আপনি।’

গাল ভাঁজ করে জটিল হাসি হাসল উইলিয়াম শোফেল্ড। ‘ধরে নিন আপনার রাশান বন্ধু সহযোগিতা করবে আমাদেরকে। চিফ কাপরিস্কির লোক যে-কারও পেট থেকে কথা বের করার কাজে দক্ষ। শুনেছি জেদাজেদি করছে নিকোলভ, তবে বেশিক্ষণ মুখ বন্ধ রাখতে পারবে না। চাপের মুখে পড়লে একসময় হার মানতেই হয়।’

আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে কথা বলছে সে, তবে ভেতরে ভেতরে যে চিন্তিত, তা বুঝে গেল রানা। ‘এস. এম. ৬১৪৩ ডিভাইস হাতে না পেয়ে ঝামেলায় আছেন আপনারা, তাই না? একবার এই ষড়যন্ত্র প্রকাশ পেলে সর্বনাশ হবে আপনাদের মত কেঁচোর দলের।’

‘কীভাবে ক্ষতি কমানো যায়, তা দেখছি আমরা,’ বলল শোফেল্ড, ‘নকল তথ্য বা গুজব ছড়িয়ে কাদাপানি আরও ঘোলা করছি। প্রমাণ করে দিচ্ছি, আসলে মগজ ধোলাইয়ের মেশিন ভাঁওতাবাজি। নানাভাবে প্রমাণ করে দেয়া হবে এস. এম. ৬১৪৩ ডিভাইস তৈরি করা হয়েছিল, মৃগীরোগ, সাইকোসিস আর মেমোরি প্রবলেম সারাবার জন্যে। আমাদের কাজ যখন শেষ হবে, নানান দেশের সাধারণ মানুষ ভাবতেও পারবে না, ওই ডিভাইসের সঙ্গে মাইণ্ড কন্ট্রোলের সম্পর্ক থাকতে পারে।’

মৃদু মাথা দোলাল শোফেল্ড। ‘আসলে বর্তমানের ডিভাইসের সঙ্গে এস. এম. ৬১৪৩ ডিভাইসের এতই পার্থক্য, ওটা হাতে পেলেও বর্তমান পদ্ধতি সম্পর্কে কিছুই জানবে না কেউ। তফাৎ এতই বেশি, যেন অষ্টাদশ শতকের ফ্লিন্টলক মাস্কেটের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে বর্তমানের লেযার গাইডেড মিসাইলের।’

‘আপনারা চারপাশে ধোঁয়াশা তৈরি করলেও সবাইকে বোকা বানাতে পারবেন না,’ বলল রানা। ‘অনেকেই প্রশ্ন তুলবে। আর প্রমাণ হিসেবে যদি দেখানো যায় এস. এম. ৬১৪৩ ডিভাইস, কর্তৃপক্ষের কাছে হাজারটা প্রশ্ন তুলবে সাধারণ মানুষ। ফলে আপনাদের মাথার ওপরে জমবে গাঢ় বিদ্যুৎঝড়ের কালো মেঘ।’

‘তা ঠিক। আর সেজন্যেই চাই না এস. এম. ৬১৪৩ ডিভাইসের খোঁজ জেনে যাক ফেসবুক বা ইউটিউবের মত মিডিয়া।’ কাঁধ ঝাঁকাল শোফেল্ড। ‘কাজেই বন্ধ করতে হবে কারও কারও মুখ। নইলে শুরু হবে হৈ-চৈ। আর এটা জানি বলেই খুঁজে বের করা হয়েছে অ্যান্টোনিন নিকোলভকে।’

কথাগুলো শুনে রানার মনে হচ্ছে, ভুল শুনছে কানে। কয়েক মুহূর্ত পর জানতে চাইল, ‘আমাকে এসব বলছেন কেন?’

স্মিত হাসল প্রাক্তন কর্নেল। ‘অবাক হচ্ছেন? হবেন না! জরুরি নির্দেশ আছে বলেই এত কিছু খুলে বলছি।’

চুপ করে থাকল রানা।

‘আপনি অস্বাভাবিক কিছু গুণের অধিকারী, রানা,’ আবারও শুরু করল শোফেল্ড। ‘আর সেজন্যেই আড়াল করছি না কিছুই।’

‘এটা বুঝেছি, মতলব হাসিল হলেও আমাকে ছেড়ে দেবেন না,’ বলল রানা।

‘তার উল্টোও তো হতে পারে?’ রানার চোখে তাকাল প্রাক্তন কর্নেল। ‘আপনাকে খুন করতে চাইলে অনেক আগেই সেটা করতে পারতাম।

অস্বস্তির ভেতর পড়েছে রানা। আঁচ করতে চাইছে, কী ধরনের প্রস্তাব দেবে লোকটা। শোফেল্ড চুপ করে চেয়ে আছে দেখে জানতে চাইল, ‘আগে বলুন কোথায় রেখেছেন ইউনা আর নিকোলভকে। সেক্ষেত্রে বুঝব, আপনার উদ্দেশ্য সৎ।’

‘খুশি মনে বলছি,’ বলল শোফেল্ড। ‘অ্যান্টোনিন নিকোলভ আছে দূরের এক ফ্যাসিলিটিতে। তার মুখ খোলাবার চেষ্টা চলছে। আর ছোট্ট মেয়েটা আছে এই দালানেই। এই করিডোর ধরে গেলে তাকে পেয়ে যাবেন।’ চাপা শ্বাস ফেলল সে। ‘আপনি তো খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন এজেণ্ট গালিনা বেলিনভের বিষয়ে। দেখা যাক তাকে দেখার পর আপনার মনে কী অনুভূতি জন্মায়।’ দরজার দিকে হাত তুলে হাঁক ছাড়ল সে: ‘অ্যাই, নিয়ে এসো!’

৪১

দরজার দিকে তাকাল রানা, চমকে গেছে।

খুলে গেল কবাট। করিডোরে সেই ন্যাড়া-মাথা দুই ষণ্ডাকে দেখল রানা। স্পষ্ট বুঝল, সর্বক্ষণ তৈরি আছে তারা। এখন তাদের সঙ্গে আছে মেজর গালিনা বেলিনভ। তবে একেবারে বদলে গেছে তার হাবভাব।

মেয়েটা ঘরে ঢোকার পর ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কবাটের দু’দিকে দাঁড়াল দুই ন্যাড়া। দু’হাত ভাঁজ করে রেখেছে বুকের ওপর। তাদের ভেতর অলস ভঙ্গি লক্ষ করে রানা বুঝে গেল, বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিলে মুহূর্তে এরা হবে আগ্রাসী।

ঘরে ঢুকে কয়েক পা হেঁটে থেমেছে মেজর বেলিনভ। রানার মনে হলো না হুঁশ আছে তার। মেয়েটার পরনে কালো জাম্পসুটের মত পোশাক। শ্যাম্পু করেছে বলে দাঁড়িয়ে আছে মাথার খাটো চুল। পরিষ্কার করা হয়েছে ঠোঁটের ক্ষত। কয়েক দিনে সেরে যাবে। তবে একদিকের গাল লালচে। ওখানে চড় দিয়েছিল রানা।

প্রথমে স্বাভাবিক লাগলেও মেয়েটার চোখ দেখে চমকে গেছে ও। ফাঁকা দৃষ্টি যেন বহু দূরে। বেযুখফের খামারে যেমন ছিল, তার চেয়েও গভীর কূপে তলিয়ে আছে। চোখের দুই পাপড়ি যেন মরা প্রজাপতির শুকনো ডানা। মুখের পেশি ঢিলে। মানসিক রোগীকে কড়া ড্রাগ দিলে তার এ অবস্থাই হয়। চকের মত সাদা অন্য গাল।

মেয়েটাকে স্বাগত জানাল না উইলিয়াম শোফেল্ড। সোফা ছেড়ে উঠেও দাঁড়াল না। হাতে উইস্কির গ্লাস। কড়া চোখে লোকটাকে দেখল রানা। ‘কী করেছেন এই মেয়ের?’

‘ফাঁকা করা হয়েছে ওর মগজ,’ স্বাভাবিক সুরে বলল প্রাক্তন কর্নেল। কাজটা যেন কিছুই নয়। ‘আগেই বলেছি, গত দু’এক দিনের স্মৃতি নেই ওর। আগেই সরিয়ে নেয়া হয়েছে সব।’

‘সরিয়ে নেয়া হয়েছে, মানেটা কী?’ চমকে গিয়ে জানতে চাইল রানা।

মৃদু হাত নেড়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল শোফেল্ড, ‘ব্যাপারটা কমপিউটার থেকে ফাইল সরিয়ে নেয়ার মত। আপনিও তো ফাইল ফেলে দেন রিসাইকেল বিনে। কাজটা তেমনই। তবে সত্যি মুছে যায়নি। দরকারে যে-কোনও সময়ে আবার ফিরিয়ে আনা যাবে স্মৃতি। সত্যিকার অর্থে ক্ষতি হয়নি ওর। ইলেকট্রোম্যাগনেটিকালি বেড়া দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে জরুরি স্মৃতির অংশ। এই পর্যায়ে মেজর বেলিনভ জানে না আসলে সে কে। কোনও ইতিহাস নেই তার মগজে। বলতে পারেন পরিষ্কার স্লেটের মত। বাবা বা মা’র নামও বলতে পারবে না। তার মনে সচেতন কোনও চিন্তাই নেই।’

রানা টের পেল, শিরশির করছে ওর মেরুদণ্ড। এই মেয়ে ওর শত্রুদলের। মরণফাঁদ পেতে বেইমানি করেছে। নির্দেশ দেয়া হলে মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ত ওর ওপর। এবং চেষ্টা করলে সফলও হতো, কারণ লড়াইয়ের জন্যে তৈরি ছিল না রানা। এসব বুঝতে পেরেও দ্বিধায় পড়ল ও। এমন এক শত্রুর ওপর রাগ করবে কীভাবে, যে বেচারি নিজেই চালিত অন্যের হুকুমে? গোটা ব্যাপারটার নিষ্ঠুরতার মাত্রা বুঝে চমকে গেছে রানা। শুকনো গলায় বলল, ‘আপনারা ওকে রোবটের মত ব্যবহার করছেন।’

‘ছিহ্, এসব বলে না,’ বাচ্চা সামলে নেয়ার সুরে বলল শোফেল্ড। ‘আমরা এত নিষ্ঠুর হতে পারি? আপনি ভুল ভারছেন। ওর মগজের একটা সেল-ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কাজটাকে নিষ্ঠুরতা ভাববেন না। ধরে নিন আমরা ওকে মডিফাই করেছি। বাড়িয়ে দিয়েছি ক্ষমতা। মেজর বেলিনভের কপাল ভাল, অত্যাধুনিক সায়েন্টিফিক বায়োটেকনোলজির সহায়তা পেয়েছে। ওর তো খুশি হওয়া উচিত।’

কড়া চোখে লোকটাকে দেখল রানা। ‘আমি তাকে খুশি হতে দেখছি না।’ চোখের কোণে দেখল দরজার দু’পাশে সতর্ক হয়ে উঠেছে দুই ষণ্ডা। সামান্য খুলেছে জ্যাকেটের চেইন। দরকারে ঝট করে বের করবে মেশিন পিস্তল। ডানের লোকটার চেহারায় কোনও অনুভূতির ছাপ নেই। অন্যজন মৃদু বিস্ময় নিয়ে উপভোগ করছে পরিবেশ। প্রাক্তন কর্নেল নিজের নিরাপত্তার জন্যে লোক দু’জনকে ঘরে রেখে ভাল করেছে, নইলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার মেরুদণ্ড ভেঙে দিত রানা।

‘কী নাম আপনাদের এই গ্যাজেটের?’ জানতে চাইল ও। ‘অবজেক্ট থাউয্যাণ্ড-ওয়ান-থ্রি-নাইন? নাকি থাউয্যাণ্ড-ওয়ান- ওয়ান-ওয়ান?’

‘সত্যিকারের নাম ক্লাসিফায়েড,’ হাসল শোফেল্ড, ‘ওটা সেরিব্রাল ইমপ্ল্যান্টের ভেতর সত্যিকারের রোস্-রয়েস। ডেলগাডোর সেই আমল নেই। রিমোট কন্ট্রোল ব্যবহার করে থামাতে হবে না ষাঁড়। আপনি যদি বেযুখফকে বাধা না দিতেন, এজেন্ট বেলিনভের মাথায় অপারেশন করত সে। তাতে হয়তো কিছুই পেত না। এস. এম. ৬১৪৩ ডিভাইস ছিল সাত এমএম দৈর্ঘ্যের, চওড়ায় চার এমএম। ওটা ঠিকভাবে রাখার জন্যে কেটে নেয়া হতো কপালের ভেতর গর্ত। তবে উন্নয়নের ধারায় ক্রমেই ছোট হয়েছে ওই জিনিস। তিরিশ বছর আগে ডিভাইস ছিল চালের একটা দানার সমান। এরপর এল সিলিকন বা গ্যালিয়াম আর্সেনাইড ক্রিস্টালাইন সেমিকণ্ডাক্টর। ধাতুর জিনিস হারিয়ে গেল। এখন যে জেনারেশনের ডিভাইস তৈরি হচ্ছে, তাতে হাইপোডারমিক নিডল দিয়েই ওটা পাঠিয়ে দেয়া যায় মগজে। আজকাল যা ব্যবহার হচ্ছে, ওগুলো এস. এম. ৬১৪৩ ডিভাইসের চেয়ে কোটি গুণ জটিল ও সমপরিমাণ শক্তিশালী।’

‘জেনে সুখী হলাম, আপনারা করদাতাদের কষ্টের টাকা নিয়ে কী কাজে ব্যয় করছেন,’ টিটকারির সুরে বলল রানা।

‘যতই টিটকারি দিন, স্বীকার করতেই হবে, দুর্দান্ত উন্নতি করেছে মগজ নিয়ন্ত্রণ সেক্টর। ম্যাগনেটিক ফিল্ড দিয়ে বদলে দেয়া যাচ্ছে যে-কারও যে-কোনও নিউরন। নির্দেশ দিলে নিজেকে গুলি করতেও দ্বিধা করছে না কেউ। এই বিজয় এসেছে মাইক্রো-বায়োইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে।’

সোফা ছেড়ে উঠে টেবিলে গ্লাস রাখল উইলিয়াম শোফেল্ড। পায়চারি শুরু করল সে। তার ভাব দেখে রানার মনে হলো, লোকটা নামকরা কোনও ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। মনের ভেতর গুছিয়ে নিচ্ছে লেকচার। এরপর জ্ঞান দেবে আগ্রহী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে।

‘রানা, হয়তো জানেন মানুষ বিদ্যুৎ দিয়ে চালিত। বৈদ্যুতিক প্রবাহের মাধ্যমে চলে দেহ। আর মগজ হচ্ছে জীবিত কমপিউটারের মত। আমরা কিছু দেখলে, শুনলে, বললে বা কিছু করলে মগজের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডে তৈরি হয় সামান্য কম্পন। সবার মগজে আছে আলাদা বায়োইলেকট্রিকাল ফ্রিকোয়েন্সির অনুরণন। যেমন আমাদের প্রত্যেকের আঙুলের ছাপ বা চোখের মণি আলাদা। বর্তমান কমপিউটার অনায়াসেই অ্যানালাইয করে এসব প্যাটার্ন। ফলে আমরা জানতে পারি মগজের সামান্যতম কম্পন। তাই এটাও বুঝতে পারি, মানুষটা কী ভাবছে বা কী করবে। গত কয়েক বছর আগে ইউনিভার্সিটি অভ বার্কলের রিসার্চে বেরিয়ে এসেছে বহু কিছু। ঘুমন্ত কারও সঙ্গে মনিটরিং ডিভাইস জুড়ে দিয়ে জানা গেছে, স্বপ্নে আসলে কী দেখছে সে। ওই স্বপ্ন আবার তুলে নেয়া যায় ভিডিয়ো ইমেজের মত। চাইলে বারবার দেখতে পাবেন। বেশি দিন নেই, নাস্তার টেবিলে গতরাতের স্বপ্ন নতুন করে দেখে নেবে সাধারণ মানুষ।’

‘আমি এখন কী স্বপ্ন দেখছি, সেটা জানেন, শোফেল্ড?’ বলল রানা। ‘ভাবতেও পারবেন না।’

মৃদু হাসল প্রাক্তন কর্নেল। ‘একই কাজ বারবার করানো যায় মগজকে দিয়ে। কমপিউটার থেকে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক কম্পন মগজে পাঠালে, মানুষটার মনে হয় আগেও ওই অনুভূতি জেগেছে তার মনে। যে-কারও স্বপ্নও নিয়ন্ত্রণ করতে পারি আমরা। তাকে দেখাতে পারি স্বর্গ বা নরক। বা যে- কাউকে দেখানো যাবে এমন দৃশ্য, যা বাস্তবে নেই বা হয়নি। কানে শুনবে গায়েবি নির্দেশ। যা খুশি করিয়ে নেয়া যাবে তাকে দিয়ে। আমরা চাইলে আগের চেয়ে জোরে দৌড়াবে সে, বা দেখাবে অন্য প্রতিক্রিয়া। কারণ মগজটা আমাদের দখলে। তার রক্তে ছড়াতে পারব অ্যাড্রেনালিন বা এণ্ডোরফিন। বন্ধ করতে পারব ভয়ের অনুভূতি। বা মগজকে নির্দেশ দিলেই মানুষটা টের পাবে না কোনও ব্যথা। এসপিয়োনাজের ক্ষেত্রে বন্দি এজেন্টের কাছ থেকে কিছুই জানবে না শত্রুরা। নির্যাতন করা অর্থহীন। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আমরা যা খুশি তাই করাতে পারব যে কাউকে দিয়ে।’

‘খুব ভাল। কাজের কাজ করেছেন আপনারা,’ তিক্ত সুরে বলল রানা।

‘ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ইমপাস্ যাবে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। বা মানুষটার স্মার্ট ফোনটাকে ব্যবহার করা হবে। অথবা কয়েক শ’ গজ দূর থেকে টিভির ইলেকট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গের ‘ মাধ্যমেও চিন্তা বা নির্দেশ পাঠিয়ে দেয়া যায় মানুষটার মগজে। দরকারি এসব যন্ত্র কাজে লাগবে রিলে করার জন্যে।’

চুপ হয়ে গিয়ে কোটের পকেট থেকে সরু একটা কালো ডিভাইস বের করল উইলিয়াম শোফেল্ড। ওটা দেখতে সাধারণ টিভির রিমোট কন্ট্রোলের মত হলেও দৈর্ঘ্যে তার অর্ধেক। ওপরে মাত্র কয়েকটা বাটন। ডিভাইসটা উঁচু করে রানাকে দেখাল সে। মেনে নিচ্ছে ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দলের প্রতিটি কথা। …রানা, জানতে ইচ্ছে করে না, কেন এমন হচ্ছে? …তো শুনুন, প্রতিটি সমাজে কিছু মানুষ ঝামেলা করে, তবে তাদের মগজে চিপ বসিয়ে দিলে তার সঙ্গে সঙ্গে নীরব হয় আপামর জনতা। ভেড়ার মতই পাল ধরে চলে মানুষ। উঁচু মহল থেকে বড় নেতাকে সঠিক পথে পরিচালিত করা হলে টু শব্দ করে না পাবলিক। নেতা যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেবে, মানুষের ভালর জন্যেই কাজ করছে সে।’

‘অর্থাৎ, আপনারা বুদ্ধিমানদের মগজে চিপ বসাবেন, যাতে যোম্বি হয়ে যায় তারা?’ জানতে চাইল রানা।

‘আপনি শব্দ প্রয়োগে বড়ই অদক্ষ,’ বিরক্ত হলো প্রাক্তন কর্নেল, ‘যোম্বি, মগজ ধোলাই বা মাইণ্ড কন্ট্রোল শব্দগুলো আপত্তিকর। ভবিষ্যতে ওগুলোর বদলে মানুষ ব্যবহার করবে অন্য উপযুক্ত শব্দ। সঠিক সময়ে নেতাদের মগজে উপযুক্ত চিন্তা ঢুকিয়ে দেব আমরা। ভবিষ্যতে বিশাল স্কেলে নিয়ন্ত্রিত হবে সাধারণ মানুষ। এই প্ল্যান বাস্তবায়নে সময় লাগবে, তবে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছি আমরা। লাখে লাখে মানুষের মগজে বসিয়ে দেয়া হবে চিপ। তারা চলবে প্রি-প্রোগ্রাম্‌ভ্ ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভের নির্দেশনায়। বিশেষ নেতা- নেত্রীদের জন্যে থাকবে আলাদা প্রোগ্রাম। তারাই তো চালাবে নানান দেশ।’

‘অর্থাৎ তাদের মগজেও চিপ বসিয়ে দেবেন,’ বলল রানা।

মাথা দোলাল উইলিয়াম শোফেল্ড। ‘ঠিকই ধরেছেন। আর সে কাজে আমাদের পাশে থাকবেন আপনি।’

৪২

‘আমি?’ ভুরু কুঁচকে লোকটাকে দেখল রানা।

‘আমরা আচরণ বিধি তৈরি করেছি,’ বলল উইলিয়াম শোফেল্ড। ‘সেগুলো সঠিক সময়ে প্রয়োগ করব নেতা- নেত্রীদের মগজে। রানা, ভাবতেও পারবেন না, এরই ভেতর কোন্ কোন্ দেশের সরকারের ওপরমহলে রয়েছে আমাদের চিপ বসিয়ে দেয়া নেতা ও নেত্রীরা।’

লোকটার কথা শুনে আরও শুকিয়ে গেল রানার গলা।

‘যাক সেসব, ওই ডিপার্টমেন্ট আমার নয়,’ বলল শোফেল্ড, ‘আমার দায়িত্ব দলে উপযুক্ত মানুষ জোগাড় করা। সেজন্যে ব্যয় করছি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। টাকা জোগাড় করা সহজ। কিন্তু যোগ্য মানুষ পাওয়া কঠিন। নিজেকে মনে করি, মানব হৃদয়ের সত্যিকার একজন বিচারক হিসেবে। নানান দেশ থেকে উপযুক্ত লোক দলে নিচ্ছি। আর কী কপাল, কমরেড নিকোলভ পালিয়ে যাওয়ার কয়েক দিনের ভেতর আমার রেইডারে ধরা পড়লেন আপনি। তখনই আপনার ডোশিয়ে দেখে বুঝে গেলাম, কে হতে পারে আমার যোগ্য অ্যাসিস্ট্যান্ট। আর সেজন্যেই এই প্রস্তাব।’

‘আপনার প্রস্তাবে আমি রাজি নই,’ এককথায় বলল রানা।,

‘এখনও তো বলিইনি কী ধরনের কাজ করতে হবে আপনাকে।’

‘না বললেও চলবে। আমি রাজি নই।‘

‘আগে তো শুনুন, পরে সিদ্ধান্ত নেবেন।’

দুই গার্ডের পিস্তল দেখে নিল রানা। ‘ঠিক আছে, শুনিয়ে ছাড়বেন যখন… বলুন।’

‘আমরা দু’জনই একসময়ে যোদ্ধা ছিলাম,’ বলল শোফেল্ড, ‘এমন সব ঘটনার ভেতর দিয়ে গেছি, যেটা কল্পনা করবে না সাধারণ মানুষ। ফলে অন্যরকম হয়েছি আমরা। আমাদেরকে বুঝতে হয়েছে, অশুভ শক্তিকে বাগে আনতে গিয়ে কখনও কখনও বাধ্য হয়ে ছোট কিছু মন্দ কাজ করতে হয়। বিশাল ক্ষতি এড়াতে মেনে নিতে হয় সামান্য অন্যায়। আমার ডিপার্টমেন্টের কাজটাই এমন। যেমন ধরুন, আমাদের ছোট একটা কাজ হচ্ছে পৃথিবীর সব মানুষের কাছ থেকে অস্ত্র সরিয়ে নেয়া। আমেরিকায় শত শত নিরীহ মানুষ খুন হচ্ছে এসব অস্ত্রের কারণে। এটা বন্ধ হওয়া উচিত না?’

‘তার মানে সবার হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নেবেন, বলল রানা। ‘নিজেদেরকে আর রক্ষা করতে পারবে না তারা। ভাল পরিকল্পনাই করেছেন।’

‘আমরা দেব সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা, কাজেই তাদের প্রয়োজন পড়বে না অস্ত্রের,’ বলল শোফেল্ড। ‘আসলে ভেদ করতে হবে অস্ত্রের এই দুষ্টচক্র। সেজন্যে আড়াল থেকে তৈরি করা হবে এমন পরিবেশ, সবাই যাতে চায় নিরস্ত্র হতে।’

কড়া চোখে শোফেল্ডকে দেখল রানা। ‘তার মানে, দুঃসহ পরিবেশ তৈরি করবেন আপনারা?’

‘প্রয়োজনে বহু কিছুই করতে হয়, সেটা আপনি জানেন, ‘ বলল শোফেল্ড। ‘যেমন আমেরিকা। ওই দেশ দুনিगान অন্যসব দেশের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরালেও ওখানেই। বছর সশস্ত্র লোকের হাতে খুন হচ্ছে শত শত নিরীহ মানুষ। চমৎকার পরিবেশ বলতে পারেন। ওখান থেকেই আমরা শুরু করছি আমাদের আন্দোলন। ওটা জোরালো হলে নিজেরাই নিরস্ত্র হবে তারা।’

চুপ করে লোকটার দিকে চেয়ে রইল রানা।

‘টাকা বিষয় নয়,’ বলল শোফেল্ড। ‘মিডিয়াকে লেলিয়ে দেব। ভেবে দেখুন, প্রতি বছর আমেরিকায় হাজার হাজার মানুষ মরছে গাড়ি-দুর্ঘটনায়। সেজন্যে গাড়ি বাদ দিচ্ছে না কেউ। কিন্তু মাত্র কয়েকজন সশস্ত্র লোক দশ-বিশজন নিরীহ মানুষকে খুন করলেই হাউমাউ করে উঠবে সবাই। লবিস্টরা হোয়াইট হাউসে বা কংগ্রেসে গলা ফাটিয়ে আপত্তি তুলবে। আর তা তো করবেই, সহ্য করা যায় এত অন্যায়!’

‘মানুষ খুন হবে ভাবতে গিয়ে বুকটা ভেঙে যাচ্ছে আপনার,’ বলল রানা, ‘আগে এত পরহিতৈষী আর কাউকে দেখিনি!’

টিটকারিকে পাত্তা দিল না উইলিয়াম শোফেল্ড। ছোট চুমুক দিল সোনালি তরলে। ‘সমস্যাটা জানেন, রানা, আসলে সবকিছু ঘটছে খুব ধীরে। অস্ত্র ত্যাগ করতে মানুষের লাগবে অন্তত এক শ’ বছর। অথচ, মাত্র কয়েকজন রাইফেল হাতে রাস্তায় নেমে হাজার খানেক মানুষকে মেরে ফেললেই চুকে যাবে ওই সমস্যা। আইন পাশ করবে কংগ্রেস। তাতে লাভ হবে কাদের? আসলে আমেরিকার সমাজ হবে নিরাপদ। আমরা সেটাই চাইছি। বুঝতে পারছেন তো আমার দৃষ্টিকোণ?’

‘না-বোঝার কী আছে,’ বলল রানা। ‘মগজে চিপ আছে এমন অনেকে নেমে পড়বে রাস্তায়। গুলি করে মারবে নিরীহ মানুষকে। তা হলেই হয়ে গেল কেল্লা ফতে।’

‘ঠিকই ধরেছেন। তবে, আমরা আছি সমস্যায়। থুতনি চুলকে নিল প্রাক্তন কর্নেল। ‘জঙ্গী দলের সমস্যা হচ্ছে না লোক জোগাড় করতে। হাসতে হাসতে বুকে বোমা বেঁধে নিয়ে শিশু-নারী-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাইকে মেরে সাফ করছে একদল উন্মাদ। কিন্তু শিক্ষিত, সুস্থ মানসিকতার কারও গায়ে-মাথায়- পায়ে হাত বুলিয়েও আত্মহত্যা করতে রাজি করাতে পারবে না কেউ। আর এখানেই আমরা অসহায়। ধর্মগুলোর দোহাই দিয়ে যা খুশি করাতে পারব না আমরা কাউকে দিয়ে।’

‘বিরাট সমস্যা,’ বলল রানা।

‘কাজেই প্রবাদ বাক্যের মত বলতে হচ্ছে: পাহাড় মুসার কাছে না এলে, মুসাই যাবে পাহাড়ের কাছে। সুতরাং সঠিক লোক খুঁজতে হবে। তাদেরকে দিয়ে করিয়ে নিতে হবে দরকারি কাজ।’

‘তো আপনি চান আমি যেন মাথায় চিপ নিয়ে শতখানেক মানুষকে খুন করে আত্মহত্যা করি,’ বলল রানা।

মাথা নাড়ল উইলিয়াম শোফেল্ড। ‘তা নয়। আপনি বুদ্ধিমান এবং আর্মি থেকে প্রশিক্ষিত। চট্ করে জেনে নেবেন কাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়া যাবে, আর কাকে দিয়ে যাবে না। সবসময় মনে রাখবেন, মানব সভ্যতার জন্যে সামান্য অন্যায় করছেন বলে দুঃখিত হওয়ার কিছুই নেই। আর একটা কথা: জানবেন, এ প্রস্তাব মেনে না নিয়ে কোনও উপায় নেই আপনার।’

‘তা-ই তো দেখছি।’

‘অবসর নেবেন বিসিআই থেকে। সোজা যাবেন আমেরিকায়। সৈকতের কাছে কিনে নেবেন ভাল কোনও বাংলো। পাবেন বিলাসবহুল জীবন। তবে আপনার কাজ আমেরিকান মিলিটারি থেকে অবসর নেয়া লোক বেছে নেয়া। কাউকে পছন্দ হলে দেরি না করে সেটা জানাবেন। পরের কাজ আমাদের। গোপন কোথাও নেয়া হবে ওই লোককে। তারপর মগজে বসিয়ে দেয়া হবে চিপ। তাতে লাগে মাত্র এক মিনিটের মত। কীভাবে কী হলো, কিছুই মনে পড়বে না তার। তারপর অস্ত্র পেলেই কাজে নামবে সে।’ মেঝে দেখাল প্রাক্তন কর্নেল। ওখানে থকথক করছে গালিনা বেলিনভের রক্ত। ‘আপনি তো এরই ভেতর বুঝেছেন, কীভাবে কাজ করে চিপ।’ কাঁধ ঝাঁকাল শোফেল্ড। ‘প্রয়োজনে আত্মহত্যা করবে আমাদের রিক্রুট। ধরা পড়লে অফ করে দেয়া হবে তাকে। সুযোগ নেই যে জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনে যাবে পুলিশ বা আর কেউ। পিটিয়ে মারলেও টু শব্দ করবে না রিক্রুট। জানবেই না কী ঘটছে।’

‘সবই ভেবে রেখেছেন, তা-ই না?’

‘চুপ করে বসে খেলা দেখব আমরা,’ বলল শোফেল্ড। ‘হৈ-চৈ করবে মিডিয়া। আততায়ীর প্রতিবেশীরা বলবে: আমরা জানতাম সে খুবই ভাল মানুষ। চমকে যাবে বন্ধু ও আত্মীয়রা। বরাবরের মতই ইন্টারনেটে ঝড় তৈরি করবে ষড়যন্ত্রের থিয়োরি প্রচারকরা। তবে তাতে কিছু যাবে-আসবে না। খেপে যাবে পাবলিক। কংগ্রেসের সদস্যরা থাকবে চাপের ভেতর। আর শেষপর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়ে যাবে অস্ত্রবহন, বন্ধ হয়ে যাবে আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রির দোকান ও তৈরির কারখানা। ভেবে দেখুন, রানা, বিশাল এক বাঁধ ভাঙতে কতদিন লাগে? দু’বছর, তিন বছর, পাঁচ বছর? এদিকে মর্গে জমছে নারী, শিশু ও পুরুষের লাশ। যত বড় বড় কথাই বলুক না কেন, একসময় বাধ্য হয়ে ব্যবস্থা নিতেই হবে মার্কিন আইন প্রণেতাদেরকে।’

‘একটা কথা, শোফেল্ড, এরই ভেতর চালু করেছেন ওই প্রোগ্রাম?’ জানতে চাইল রানা। ‘মগজে চিপ নিয়ে নিরীহ মানুষ খুন করছে আপনাদের লোক?’

মিষ্টি হাসল উইলিয়াম শোফেল্ড। ‘সব কথা ভেঙে চুরে না-ই-বা শুনলেন!’ চকচক করছে কর্নেলের দুই চোখ।

জবাব পেয়ে গেছে রানা। আস্তে করে মাথা নাড়ল ও। ‘আমার ধারণা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে নীচমনা পশু দেখে ফেলেছি। তবে আপনি আমার চোখ খুলে দিলেন।’

‘বোকামি না করে যারা জিতবে, সেই দলেই থাকুন,’ বলল শোফেল্ড। ‘আখেরে লাভ হবে। এখনও বলিনি আপনার বেতনের অঙ্ক। অনেকগুলো শূন্য থাকবে একের পেছনে। চাইলে কিনে নিতে পারবেন কোনও দ্বীপ বা বিশাল ন্যাশনাল-পার্ক।’

‘আমার নিজের কাজটাই বেশি ভাল লাগে,’ বলল রানা, ‘তাই, আপনার প্রস্তাবে আমি রাজি হতে পারছি না।’

‘আপনার কাজে কয়টা পয়সা পান, বলুন তো?’

‘আমার কাছে আমার সন্তুষ্টিই আসল কথা। ‘

‘আরেকবার ভেবে দেখুন, বাস করতে পারবেন রাজার হালে।’

‘অন্যের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে রাজা হতে চাই না।’

‘অথচ, ওই স্বাধীনতার জন্যে বিগড়ে গেছে গোটা পৃথিবী।

‘মানলাম, মানুষের হাজার দোষ আছে,’ বলল রানা, ‘হয়তো অসুখী বা অখুশি। জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত থাকে অনিশ্চয়তা। এভাবেই পেরোয় জীবন। তবে প্রতিটি পদক্ষেপে আর কারও নির্দেশে চলতে হলে সেই মানুষের জীবনের কোনও অর্থই থাকে না।’

‘লেকচার দেবেন না, আমি আপনার ক্যাপটিভ অডিয়েন্স নই,’ বলল শোফেল্ড। ‘দুঃখের কথা, আমার এই প্রস্তাব না মেনে নিলে খুব কষ্ট পেয়ে মরবেন। আমি হলে সুযোগটা ছাড়তাম না।’

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘আমার আর কিছু বলার নেই। ইচ্ছে হলে খুন করতে পারেন। নিজে খুন করার সাহস না পেলে নির্দেশ দিন ন্যাড়া-মাথা জানোয়ারগুলোকে।

‘আর্মি থেকে অবসর নেয়ার সময় সিনিয়র অফিসাররা কী বলেছিল আপনাকে, রানা?’

‘ভাল করে ভেবে দেখার জন্যে এক সপ্তাহ সময় দেন তাঁরা। অবশ্য সময়টা নষ্ট না করলেও পারতেন। আমার জানা আছে। কী করব আর কী করব না।’

‘সে সময় তো প্রাণ যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। এবার কিন্তু ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্যরকম।’

‘যতক্ষণ বাঁচব, ভোগ করব মানসিক স্বাধীনতা। তা কম নয়।’

কড়া চোখে ওকে দেখল শোফেল্ড। কী যেন ভাবছে। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘ঠিক আছে, আপনাকে পুরো একঘণ্টা সময় দিলাম। আশা করি মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভাববেন। জরুরি কাজে যাচ্ছি। ষাট মিনিট পর ফিরব। তখনও রাজি না হলে একষট্টি মিনিটে খুন হবেন আপনি। ‘

৪৩

লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে গেল প্রাক্তন কর্নেল উইলিয়াম শোফেল্ড। একটু থেমে নিচু স্বরে কিছু একটা বলল দুই গার্ডকে। একঘণ্টা পর খুন করতে পারবে, সেজন্যেই বোধহয় * লোক দু’জনকে খুব খুশি মনে হলো রানার।

আপাতত বন্দিকে বাঁচিয়ে রাখার নির্দেশ পেয়েছে তারা। আগের মতই দূর থেকে রানার মাথার দিকে গ্র্যাচ অটোমেটিক তাক করল দুই গার্ডের একজন। অন্যজন এসে ওর কবজিতে আটকে দিল হ্যাণ্ডকাফ। কাজটা শেষ হতেই কোট থেকে বের করল তার পিস্তল।

ইশারা পেয়ে করিডোরে বেরোল রানা। গোলকধাঁধার মত করিডোর পেরিয়ে চলেছে নিজের সেলের দিকে! সামনে হাঁটছে এক গার্ড। কয়েক ফুট পেছনে রানার পিঠে পিস্তল তাক করে রেখেছে দ্বিতীয়জন। খুব হুঁশিয়ার। চাইলেও চট্‌ করে তার ওপর হামলা করতে পারবে না বন্দি।

কোলের কাছে দু’হাত রেখে ধীর পায়ে হাঁটছে রানা। বুঝে নিল কতটা সামনে প্রথম গার্ড। করিডোর সরু। সিলিঙে জ্বলছে শীতল সাদা নিয়ন বাতি। মেঝেতে ধুলোবালি ভরা মসৃণ টাইল্স্। দেয়াল সাদা চুনকাম করা। হ্যাণ্ডকাফ যে ঠিকভাবেই কবজিতে আটকে দেয়া হয়েছে, সেটা বুঝতে টানাটানি করতে হয়নি রানাকে। হালকা ওজনের জিনিস। দুই কড়ার মাঝে টাইটেনিয়াম বা এয়ারক্রাফট গ্রেডের অ্যালুমিনিয়ামের চারটে লিঙ্ক। যন্ত্রপাতি না পেলে ছেঁড়া অসম্ভব। এমন কী বুলেট লাগলেও হয়তো ভাঙবে না জিনিসটা। তা ছাড়া, গুলি পিছলে ওর নিজের গায়েই বিঁধতে পারে।

রানাকে নিয়ে সেলের করিডোরে পৌঁছল দুই গার্ড। হাঁটার গতি সামান্য কমাল রানা। চোখের কোণে দেখল পেছনের গার্ডকে। আশা করেছিল অধৈর্য হয়ে এগোবে সে, বা গতি কমিয়ে দেবে সামনের লোকটা। কোনওটাই হলো না। বিশেষ করে পেছনের গার্ড অতিসতর্ক। গতি কমিয়ে চাপা গলায় নির্দেশ দিল, ‘ঠিকভাবে হাঁটো!’

সেলের দিকে চলল রানা। নির্দিষ্ট দরজার কাছে পৌঁছুতেই পেছন থেকে ঘেউ করে উঠল গার্ড, ‘থামো!’

নির্দেশ পালন করল রানা।

শোল্ডার হোলস্টারে পিস্তল ঢোকাল সামনের গার্ড। বেল্টের লুপ থেকে নিল চাবির রিং। কয়েক সেকেণ্ড ব্যয় করল সঠিক চাবি খুঁজতে, তারপর ঝুঁকে তালায় ভরল ওটা। তাতে খুলল না তালা। বিড়বিড় করে কাকে যেন গালি দিল সে। রানার পেছনের গার্ড জানতে চাইল, ‘কী হলো?’

মাথা নেড়ে নিচু গলায় বলল প্রথম গার্ড, ‘শালার কপাল!’ আবারও সঠিক চাবি খোঁজায় মন দিল সে।

কাছ থেকে তাকে দেখছে রানা। বুঝে গেছে, এখন অসতর্ক পেছনের লোকটাও। তবে সেটা মাত্র কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে। রানার চাই বড়জোর এক সেকেণ্ড। আস্তে করে এক ইঞ্চি এগোল। খেয়াল করল, টের পায়নি ওরা।

তালা খুলল দ্বিতীয় চাবিটা। সরু করিডোরের বাইরের দিকে খোলে দরজা। জেলখানায় তাই থাকে। কবাট সরাতে গিয়ে এক পা পেছাল সামনের গার্ড। ওটা ছিল মস্তবড় ভুল। রানার আওতায় চলে এসেছে সে। মনে নেই জেলের প্রোটোকল।

বোঝার আগেই চোখের কাছে লোকটা দেখল রানার দুই কবজির মাঝের শেকল। পরক্ষণে গলায় চেপে বসল মরণ ফাঁস। পেছন থেকে হ্যাঁচকা টানে গার্ডকে ওপরে তুলল রানা! শ্বাস আটকে গেছে বলে দু’হাতে শেকল খামচে ধরল গার্ড। গলায় এঁটে বসেছে শেকল। পিছিয়ে ঊরু ও কোমরে ভর করে তাকে ঘুরিয়ে নিল রানা। সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়েছে দ্বিতীয় গার্ড। তার উচিত ছিল সময় থাকতে গুলি করা।

প্রথম গার্ডকে নিয়ে বিদ্যুদ্বেগে দ্বিতীয় গার্ডের ওপর চড়াও হলো রানা। হঠাৎ ঠেলা খেয়ে পাশের দেয়ালে পিঠ দিয়ে পড়ল দ্বিতীয় গার্ড। কোমরের পেছনে চাপা পড়েছে কবজি সমেত পিস্তল। ওটা বের করে রানার বুকে তাক করতে চাইল সে। গলা থেকে শেকল না সরিয়ে দুই কনুইয়ের জোরে গার্ডকে সামনে ঠেলল রানা। লোকটার মাথার এক পাশ ঠাস করে লাগল দ্বিতীয় গার্ডের কপালে। খাঁজকাটা বুটের সোল দিয়ে দ্বিতীয় গার্ডের কবজি দেয়ালে চেপে ধরল রানা। ব্যথা পেয়ে অস্ফুট শব্দ করল লোকটা। হাত থেকে পড়ে গেছে পিস্তল। রানার লাথি খেয়ে ধুলোভরা মেঝেতে পিছলে সরে গেল ওটা। দেরি না করে গায়ের জোরে দুই গার্ডের মাথা ঠুকল রানা। হাড়ের সঙ্গে হাড়ের থ্যাটাস্ শব্দটা অস্বস্তিকর। প্রথম গার্ডের গলা থেকে শেকল সরাতেই পিছলে চিত হয়ে মেঝেতে পড়ল সে। আগেই তার জ্যাকেটের শোল্ডার হোলস্টার থেকে নাইন এমএম গ্র্যাচ বের করে নিয়েছে রানা। ঝট্ করে কয়েক ফুট পেছাল। দম আটকে যাওয়ায় প্রায়- ভাঙা কণ্ঠনালী দু’হাতে চেপে ধরে আছে প্রথম গার্ড। তবে হামলা করতে পারে দ্বিতীয় গার্ড। দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে আছে সে। ভাঙা নাক থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে। তাকেই আগে গুরুত্ব দিল রানা।

ইঁটের দেয়ালের বদ্ধ করিডোরে সাইলেন্সড্ পিস্তল যে শব্দ করবে, তাতে হয়তো ছুটে আসবে আর কেউ। দ্বিতীয় গার্ডের মাথায় এক কেজি ওজনের কার্বন স্টিল ও পলিমারের পিস্তল নামাল রানা। অচেতন হওয়ার আগে এক সেকেণ্ড স্থির থাকল লোকটা, তারপর ধুপ্ করে পড়ল মেঝেতে। ওদিকে প্রথম গার্ডের মাথার ওপর পড়ল পিস্তলের দ্বিতীয় ঘা। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল সে-ও। কয়েক সেকেণ্ড কান পেতে করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকল রানা।

কোথাও ছুটে আসার আওয়াজ নেই। থমথম করছে চারপাশ। শুধু ধুপ-ধাপ করছে রানার হৃৎপিণ্ড। দ্বিতীয় গ্র্যাচ সংগ্রহ করল ও। পরীক্ষা করল দুই পিস্তল, তারপর পুরনো আমলের জলদস্যুর স্টাইলে গুঁজল কোমরের বেল্টে। এক এক করে গোড়ালি ধরে টেনে দুই অচেতন গার্ডকে নিল সেলের ভেতর। মুখোমুখি করে রাখল দু’জনের দেহ। একজনের একপাটি জুতো নিয়ে গুঁজে দিল দরজা ও চৌকাঠের মাঝে। এবার বন্ধ হবে না কবাট। দুই অজ্ঞান গার্ডের পাশে দাঁড়িয়ে এরপর কী করবে ভেবে নিল রানা। লোকদুটোর করোটির জখম থেকে টপটপ করে পড়ছে রক্ত। জ্ঞান ফিরলে যে পরিমাণ ব্যথা পাবে, মনে হবে ছাত ফুঁড়ে নরকে পৌঁছে গেলে বাঁচত। বিচারে শাস্তিও হবে চরম। তাদের দোষেই পালিয়ে গেছে বন্দি। হয়তো মেরেই ফেলা হবে এই দুই বদমাশকে।

সেলের দরজার তালা থেকে চাবির গোছা নিয়ে হ্যাণ্ড- কাফের তালা খুলল রানা। কয়েক সেকেণ্ডে মুক্ত হলো হাত। দু’গার্ডের দুই কবজি আটকে দিল হ্যাণ্ডকাফে। ডানেরজনের জ্যাকেট ছিঁড়ে কয়েক ফালি করল। ওগুলো দিয়ে দুই গার্ডের অন্য দুটো হাত বাঁধল আচ্ছামত। গোল করে মুখে গুঁজে দিল ফোম। দুই গার্ডের জ্যাকেটের নিচে হালকা কেভলার ভেস্ট। রাইফেলের গুলি ঠেকাতে না পারলেও পিস্তলের বুলেট বা ছোরার হাত থেকে বাঁচাবে। এরা যে পেশায় আছে, ওটা না থাকলে চলে না। কারও কাছে আইডি বা ওয়ালেট পেল না রানা। লম্বা লোকটার বুলেটপ্রুফ ভেস্ট খুলে নিজের জ্যাকেটের নিচে পরল এবার। সেল থেকে বেরিয়ে ভাবল, প্রথম সুযোগে খুন করবে উইলিয়াম শোফেল্ডকে। কবাটের জুতোর গোঁজ সরিয়ে বন্ধ করল দরজা। তালা লাগিয়ে পকেটে রাখল চাবির গোছাটা। বেল্ট থেকে গ্র্যাচ হাতে নিয়ে ছুট দিল ফিরতি পথে। সামনে হয়তো থাকবে আরও গার্ড।

কিন্তু না, ফাঁকা করিডোর।

লাউঞ্জ রুমেও কাউকে পেল না রানা। মেঝে ও দেয়ালে গালিনা বেলিনভের রক্ত। এরই ভেতর শক্ত হচ্ছে বলে তামাটে রঙ ধরেছে। শোফেল্ডের ওপর আবারও প্রচণ্ড রাগ হলো। একবার তাকে সামনে পেলে দ্বিধা না করে তার কপাল ফুটো করবে ও।

এখন প্রথম কাজ ইউনাকে খুঁজে বের করা।

কাছেই কোথাও রেখেছে মেয়েটাকে।

আস্তে করে দরজা বন্ধ করে করিডোরে বেরোল রানা। হালকা পায়ে ছুটে চলল করিডোর ধরে। কেউ নেই কোথাও। কোনও আওয়াজ নেই পরিত্যক্ত এই দালানে।

কয়েকটা দরজা পেরোবার পর হঠাৎ থামল রানা। কান পাতল। হাতে পিস্তল তৈরি। শুনতে পেল না কোনও আওয়াজ। আস্তে করে মোচড় দিল দরজার হ্যাণ্ডেলে। সামান্য ফাঁক হলো কবাট। পরক্ষণে দরজা খুলে ফাঁকা ঘরে ঢুকল রানা। ভেতরে বাজে তামাকের বাসি দুর্গন্ধ। ঘর ছায়াময়। নীরব। শীতল। বহুক্ষণ আগে এখানে ছিল কেউ।

আবারও করিডোর ধরে এগোল রানা। পরের দরজা খুলে উঁকি দিল। ভেতরে কেউ নেই।

ক্রমেই অধৈর্য হয়ে উঠছে রানা।

সত্যিই যদি এই ফ্যাসিলিটিতে ইউনা না থাকে?

যদি সরিয়ে নেয়া হয় তাকে?

সেক্ষেত্রে মেয়েটাকে খুঁজে পাবে না ও।

কিন্তু পরের ঘরের দরজায় থেমে রানা বুঝল, পৌঁছে গেছে ঠিক জায়গায়। কিছুই শুনতে পায়নি। বরাবরের মতই নীরব চারপাশ। তবুও ওর মন বলল, দরজার ওদিকে আছে কেউ।

বেইমানি করছে না ওর নাক।

শক্ত হাতে পিস্তল ধরল রানা, তারপর বামহাতে হ্যাণ্ডেল মুচড়ে মনে মনে তিন গুনে আস্তে করে খুলল কবাট।

৪৪

প্রকাণ্ড বাড়িটাতে বর্তমানে যারা আসে-যায়, প্রত্যেকেই ওটাকে চেনে পুরনো হাসপাতাল হিসেবে। আগে তা-ই ছিল এই বাড়ি। উনিশ ও বিংশ শতকে মানসিক রোগী বাচ্চা ছেলেমেয়েদেরকে আটকে রাখা হতো বিশাল এই ক্লিনিকে। তবে সব অত্যাচারের শেষ আছে। নৃশংস আচরণের কারণে উনিশ শ’ ছিয়াত্তর সালে বন্ধ করে দেয়া হলো হাসপাতাল। এরপর পেরিয়ে গেছে চল্লিশ বছরেরও বেশি সময়। সামনের রাস্তা থেকে দেখা যায় না ক্লিনিক। সামনে ও পেছনে লোহার গেট। চারদিকের উঠানে ঝোপঝাড়। কিছু দিন আগে ধসে গেছে বাড়ির ছাতের একটা দিক, মেরামত করেনি কেউ। নির্যাতিত নিষ্পাপ বাচ্চাদের দীর্ঘশ্বাস যেন নীরবে ঘুরে বেড়ায় চারপাশে।

পৃথিবী জুড়ে চলছে নানান নির্যাতনের ধারা। কয়েক বছর হলো পরিত্যক্ত মানসিক হাসপাতালটাকে ব্যবহার করছে এফএসবির স্টেশন চিফ ভ্যানকিন কাপরিস্কি। জায়গাটা শহরে তার হেডকোয়ার্টার থেকে দূরে নয়, অথচ একদম নির্জন এলাকায়। বাড়ির ভেতর গুমরে ওঠে অনেকের আর্তচিৎকার, তবে আশপাশে কেউ নেই যে শুনবে। পুরো দুই একর জমি নিয়ে মানসিক হাসপাতাল। পেছনে ঝোপঝাড়ে ভরা জায়গায় বাড়ছে কবরের সংখ্যা।

হাসপাতাল ভবনের চার তলায় রয়েছে সরু হলওয়ে। দু’পাশে প্লাস্টার করা স্যাঁতসেঁতে, ছাতাপড়া কালচে দেয়ালের একটু সামনেই একটা দরজা। ওদিকের ঘরের সব জানালা বন্ধ বোর্ড দিয়ে। একসময় ওই ঘরে থাকত সবচেয়ে খ্যাপাটে বাচ্চারা। অনেকেই হাসপাতালে আসার আগে ছিল প্রায় সুস্থ। পরে ভয়ানক নির্যাতনে হয়েছে চরম অসুস্থ। ঘরে আজ আর লোহার খাটিয়া না থাকলেও রয়েছে মেঝে ও দেয়ালে গেঁথে রাখা হাতকড়া ও পায়ের বেড়ি। ওখানে হাত-পা আটকে দিনের পর দিন শায়েস্তা করা হতো বাচ্চাদেরকে। এখন ওগুলো ছাড়া ঘরে রয়েছে আধুনিক কিছু যন্ত্রপাতি।

এই মুহূর্তে কাঠের একটা টুলে বসে সিগার টানছে ভ্যানকিন কাপরিস্কি। দু’পাশে বিশ্বস্ত দুই সহচর স্টেপুরিন ও অরলভ। বছরের পর বছর কাপরিস্কির হয়ে টর্চারের কাজ করছে তারা। চেচেনদের বিপ্লবের সময় বন্দিদের এনে টেবিলে জিভ গেঁথে দিত। বাধ্য করা হতো দাঁত দিয়ে কাঠের পাটাতন চিবুতে। শেষে দাঁতের গোড়া ছাড়া কিছুই থাকত না। এ ছাড়া ছিল তথ্য সংগ্রহের জন্যে ভয়ানক সব পদ্ধতি। একসময়ে চেচেন যোদ্ধারা বারবার অনুরোধ করত, যেন মেরে ফেলা হয় তাদেরকে।

এখনও সে পর্যায়ে পৌঁছায়নি অ্যান্টোনিন নিকোলভ। অবশ্য রাত ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই স্রেফ নরক থেকে ঘুরে আসবে সে। ধাতব চেয়ারে বসিয়ে হাতকড়া দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে দুই কবজি, পায়ার সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা হয়েছে ওর দুই পায়ের গোড়ালি। চেয়ারের টিউবের মত ফ্রেমে যুক্ত করা হয়েছে কিছু বৈদ্যুতিক তারের কানেক্টর। ওগুলোর তার গেছে গাড়ির বারো ভোল্টের ব্যাটারিতে। একপাশে ভোল্টেজ কন্ট্রোল বক্স। ওটা থেকে যে হাই পাওয়ারের বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হচ্ছে নিকোলভের দেহে, তাতে প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছে সে। ভিজে গেলে শক বাড়বে বলে পুরু রাবারের গ্লাভ্স্ ও বুট পরে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে পানিভরা বালতি হাতে এক লোক। কয়েক মিনিট পর পর ভিজিয়ে দিচ্ছে অ্যান্টোনিনকে।

‘আবার চালু করো,’ সিগার ফুঁকতে ফুঁকতে শান্ত স্বরে বলল কাপরিস্কি।

শুয়োরের মত কুঁতকুঁতে চোখে কন্ট্রোল বক্সের লাল রোটারি ডায়াল দেখল স্টেপুরিন। সামান্য বাড়িয়ে দিল বিদ্যুৎ প্রবাহ। জোরে গুঙিয়ে উঠল নিকোলভ। ছটফট করছে চেয়ারে। ভেজা ধাতব অংশের জন্যে যন্ত্রণা বাড়ছে বহু গুণ। পুরো পাঁচ সেকেণ্ড অসহ্য কষ্ট দেয়ার পর স্টেপুরিনের দিকে তাকাল কাপরিস্কি। তার ইশারায় ডায়াল ঘুরিয়ে কমিয়ে দেয়া হলো বৈদ্যুতিক প্রবাহ। চেয়ারে কুঁজো হয়ে বসে আছে নিকোলভ। হাঁফিয়ে চলেছে বিশ মাইল দৌড়ে আসা ম্যারাথন দৌড়বিদের মত। টকটকে লাল দুই চোখ। মুখ ভূতের মত ফ্যাকাসে।

‘ভাল লাগছে না, তাই না, অ্যান্টোনিন?’ মৃদু হেসে বলল কাপরিস্কি, ‘সহ্য করবে আরও? তুমি চাইলে দিতে আমার আপত্তি নেই। তবে স্বস্তি চাইলে প্রশ্নের জবাবটা দিয়ে দাও।’

তীব্র ঘৃণা নিয়ে কাপরিস্কিকে দেখল নিকোলভ। ‘এরই ভেতর বহুবার বলেছি, ওটা আমার কাছে নেই।’ শেষ কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা ভেঙে গেল তার।

‘তা হলে বলো কোথায় রেখেছ,’ ক্লান্ত সুরে বলল ভ্যানকিন। ‘নইলে… স্টেপুরিনের দিকে তাকাল সে। ‘আবার চালু করো।’

হাসিমুখে নির্দেশ পালন করল নিষ্ঠুর লোকটা। ডায়াল ঘুরিয়ে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বিদ্যুতের প্রবাহ।

নিকোলভের করুণ আর্তনাদে ভরে গেল ঘর।

‘চাইলেই কষ্ট থেকে বাঁচতে পারো,’ এবারের বিদ্যুৎ কমিয়ে দেয়ার পর বলল কাপরিস্কি। ‘মাত্র দু’চার কথায় রক্ষা পাবে।’

‘ওটা আছে জঙ্গলে,’ হার মেনে নিল নিকোলভ। ‘কোন্ জঙ্গল?’

‘তাতভ বেযুখফের খামারের কাছে। আপনি চাইলে ওখানে নিয়ে যাব।’

‘আবারও সময় নষ্ট করছ, নিকোলভ? ভেবে দেখো, এতে কোনও লাভ হচ্ছে?’ সিগার দিয়ে একদিকের দেয়ালের কাছে রাখা বড় প্যাকিং কেস দেখাল ভ্যানকিন। ‘দেখছ ওই ক্রেট? ওটার ভেতর আছে স্টেপুরিন আর অরলভের খেলার সরঞ্জাম। ওগুলো মুখ খুলিয়ে ছাড়বে তোমার। দরকার হলে হাত আর পায়ের আঙুল কাটতেও দ্বিধা করব না। আরও খারাপ কিছুও করতে পারি। তবে চাই না অত কষ্ট দিতে। ভুল কোরো না, নিকোলভ। নিজের প্রতি একটু মায়া দেখাও। যা চাইছি, সেটা না দেয়া পর্যন্ত এখান থেকে কোথাও যেতে পারবে না। দরকার হলে দিনের পর দিন চলবে আমার এই জিজ্ঞাসাবাদ।’

ডাহা মিথ্যা বলছে সে। বাইরে ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যার আঁধার। একটু পর যেতে হবে থিয়েটার বলশোইতে। সেখানে এখন চলছে প্রোকোফিয়েভ-এর অবরেচেনিয়া ভি মোনাস্তি রে। ভ্যানকিনের কমবয়সী, সুন্দরী মিসেস অপেরার গুণমুগ্ধ ভক্ত। ঠিকসময়ে তাকে অপেরাতে না নিলে খবর আছে। ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে। দেরি করে বাড়ি ফিরলে এক কথায় তালাক দেবে তাকে।

চট্ করে স্টেপুরিন আর অরলভের দিকে তাকাল ভ্যানকিন। জবাবে কাঁধ ঝাঁকাল তারা। বহুক্ষণ ধরেই বৈদ্যুতিক নির্যাতন চলছে, আগেই ভেঙে পড়ার কথা নিকোলভের, অথচ তার পেট থেকে দরকারি কিছুই বের করা যায়নি। এখন বাকি রয়েছে দৈহিক নির্যাতন। তবে সেটাতে রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকি। তাতভ বেযুখফ তো এক গুলিতে শেষ। নিকোলভকে রক্তারক্তি করার এক পর্যায়ে তার হার্ট অ্যাটাক হলে সর্বনাশ হবে কাপরিস্কির। ওপরমহল থেকে বলে দেয়া হয়েছে, যেভাবে হোক আদায় করো এস. এম. ৬১৪৩ ডিভাইস। এ মুহূর্তে ওটা পাওয়ার জন্যে অন্য উপায় খুঁজছে কাপরিস্কি।

‘আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দিন,’ কাতর সুরে বলল নিকোলভ, ‘পৌঁছে দিন ফ্রান্সে। কথা দিচ্ছি, জানিয়ে দেব কোথায় আছে এস. এম. ৬১৪৩ ডিভাইস। তারপর আপনারা চাইলে আমাকে খুন করবেন। আমার আর বাঁচার ইচ্ছে নেই।’

সিগার মেঝেতে ফেলে বুট দিয়ে পিষল ভ্যানকিন। পকেট থেকে নিল মোবাইল ফোন। নিকোলভের কথা থেকে ভাল একটা আইডিয়া এসেছে মনে।

‘কাকে ফোন করছেন, চিফ?’ জানতে চাইল অরলভ। হতাশ। ভেবেছিল দৈহিক নির্যাতনের সুযোগ পাবে।

‘কথা বলব ডক্টর নেবেসার সঙ্গে। মেয়েটাকে আনতে হবে এখানে। মনে হচ্ছে, ক’জন মিলে তার কাপড় খুললে ভড়-ভড় করে সব বলবে নিকোলভ। … তুমি কি বলো, নিকোলভ? পাখির মত কিচিরমিচির করবে, তাই না?’

রেগে গিয়ে চেয়ার ছাড়তে চাইল এক্স এজেন্ট। চিৎকার করে গালি দিল ভ্যানকিন কাপরিস্কিকে। কিন্তু তখনই নতুন করে বিদ্যুতের সংযোগ দিল ওর প্রাক্তন বস।

ভীষণ গুঙিয়ে উঠছে নিকোলভ। ঠিকভাবে নির্দেশ দিতে এবং ওদিকের কথা শুনতে টুল ছেড়ে ঘরের অন্যদিকে চলল কাপরিস্কি। দরজা খুলে বেরিয়ে এল সরু বারান্দায়। মোবাইল ফোনে ডায়াল করে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করল। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওদিক থেকে রিসিভ করা হলো কল।

চুপ করে আছে ডক্টর নেবেসা।

‘কাপরিস্কি বলছি,’ বিরক্ত সুরে বলল স্টেশন চিফ। ‘কথা শুনতে পাচ্ছ, অ্যাঞ্জেল নেবেসা?’

নীরবে পেরোল কয়েক মুহূর্ত, তারপর জবাব দিল অতিরিক্ত ধূমপানে ভারী, কর্কশ এক কণ্ঠ: ‘হ্যাঁ, বলুন। আমি শুনছি।’

‘হারামজাদিটাকে এখানে দরকার,’ বলল ভ্যানকিন। ‘লোক পাঠাচ্ছি।’

2 Comments
Collapse Comments
নাঈমুল July 5, 2023 at 11:35 am

ধন্যবাদ

নাঈমুল July 5, 2023 at 11:36 am

অসংখ্য ধন্যবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *