উলের কাঁটা – ৯

নয়

জেল-হাজত সংলগ্ন একটি বিশেষ কক্ষে বসেছিলেন বাসু-সাহেব। এ ঘরেই অভিযুক্ত আসামীরা তাদের উকিল বা আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করে। ওঁকে একটি চেয়ারে বসিয়ে রেখে মেয়ে-কয়েদীদের ‘মেট্রন’ ভিতরে গিয়েছে অভিযুক্তাকে নিয়ে আসতে। শর্মাজী পূর্বাহ্নেই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বাসু-সাহেব ঘরটিকে লক্ষ করে দেখছিলেন। দেওয়ালে একটাও ছবি নেই। ব্লিচিং পাউডারের একটা উগ্র গন্ধ। এই সূর্যোকরোজ্জ্বল দিনের প্রথম প্রহরেও ঘরের ভিতরটা আলো-আঁধারি—একটা বুকচাপা দীর্ঘশ্বাস যেন আটকে আছে।

একটু পরেই মেট্রন নিয়ে এল রমা দাসগুপ্তাকে। ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাসু-সাহেবকে বললে, ম্যয় বাহার রহুঙ্গী।

দরজাটা টেনে দিয়ে সে চলে যায়।

রমা ওঁকে দেখে ম্লান হাসল। দরজার কাছেই সে দাঁড়িয়ে ছিল। বললে, আবার কেন এসেছেন? আপনার পরামর্শ অগ্রাহ্য করে এই বিপদ ডেকে এনেছি। তবু আপনার উৎসাহে ভাঁটা পড়েনি?

বাসু শুধু বললেন, বস ঐ চেয়ারটায়। কথা আছে।

রমা বসল। সপ্রতিভভাবে বললে, কথা সব ফুরিয়ে গেছে বাসু-সাহেব। এখন শত চেষ্টা করলেও আপনি আর আমাকে বাঁচাতে পারবেন না।

বাসু বলেন, আমি কিন্তু অতটা নিরাশ নই। হ্যাঁ, তোমার বিরুদ্ধে ওরা অনেকগুলি ‘এভিডেন্স’ দাখিল করবে বটে—কিন্তু তোমার স্বপক্ষেও যুক্তি কম নয়।

রমা এ-কথায় আশ্বস্ত হল না একটুও। ম্লান হেসে বললে, এটা আপনাদের একটা বাঁধা বুলি, না ব্যারিস্টার সাহেব? অভিযুক্তের মনোবল ফিরিয়ে আনতে?

বাসু বলেন, তুমি এবার আমাকে সব কথা খুলে বলবে?

—সেটা নিতান্তই পণ্ডশ্রম। আমি বেশ বুঝতে পারছি, এ দুনিয়ায় আমার দু-কড়ি-সাতের খেলা শেষ হয়ে গেছে! পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেছে আমার! যে মানুষটাকে ভালবাসলাম—এত…এতদিন পরে, সে মাত্র সাত দিনের মধ্যেই আমাকে ছেড়ে চলে গেল! আর ভাগ্যের কী প্রহসন দেখুন, ওরা বলছে আমি নাকি নিজে হাতে সেই মানুষটাকে খুন করেছি! আমি…আমি…

হঠাৎ গলাটা ধরে এল ওর। অসীম মনোবলে উদগত অশ্রুকে সম্বরণ করে বললে, না। যা ভাবছেন তা নয়। আমি কান্নায় ভেঙে পড়ব না। কারণ সত্যিই বাঁচতে আর ইচ্ছা নেই আমার! আচ্ছা, একটা কথা—ওরা ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন দেবে না তো?

বাসু বলেন, রমা, তুমি তো বুদ্ধিমতী! এ রকম পাগলামি করছ কেন? আমি তোমাকে অহেতুক মিথ্যা বলে উৎসাহ যোগাচ্ছি না। আমি অন্তর থেকে বিশ্বাস করেছি—তুমি খুন করনি। বললে তুমি বিশ্বাস করবে রমা কী যুক্তিতে আমি ঐ সিদ্ধান্তে এসেছি? একটি মাত্র যুক্তি—কে খুন করেছেন, কেন খুন করেছে তা আমি জানি। কিন্তু যে ধরনের প্রমাণের সাহায্যে তাকে অপরাধী বলে চূড়ান্তভাবে চিহ্নিত করা যায় সে ধরনের প্রমাণ আমার হাতে নেই। তুমি আমার সঙ্গে সহযোগিতা না করলে, সব তথ্য আমার হাতে তুলে না দিলে আমি কেমন করে লড়ব?

ধীরে ধীরে অবসন্নতার একটা মেঘ যেন সরে গেল মেয়েটির মুখের উপর থেকে। বললে, আপনি জানেন, কে ওঁকে খুন করেছে? কেন করেছে?

বাসু নীরবে শিরশ্চালনে সম্মতিসূচক প্রত্যুত্তর করলেন।

—কে সে? আমাকে বলতে কী বাধা?

—না। তোমাকেও এখনও বলা চলবে না। তবে তুমি তো আমার পদ্ধতি জান। সওয়াল জবাবের মাধ্যমে আদালতেই অপরাধীকে আমি চূড়ান্তভাবে চিহ্নিত করি—আমি শুধু চাইছি, তুমি আমাকে সে ব্যাপারে সাহায্য করে যাও শুধু।

সোজা হয়ে বসল রমা। বললে, বেশ। বলুন কী জানতে চাইছেন?

—প্রথমে বল, কেন তুমি আমার অবাধ্য হলে? কেন সুজাতার চোখকে ফাঁকি দিয়ে পহেলগাঁওয়ে গিয়েছিলে?

ওঁর চিঠিগুলি পুড়িয়ে ফেলতে। আপনি বলেছিলেন, পুলিসে সেগুলি নিয়ে যাবে, পড়বে, আদালতে দাখিল করবে। আমি সেটা চাইনি। তাই।

—কী এমন মারাত্মক কথা ছিল সেসব চিঠিতে!

এতক্ষণে হাসল মেয়েটি। বললে, মারাত্মক কথা কিছুই ছিল না। কিন্তু চিঠিগুলো এমনই ব্যক্তিগত যে, – কী বলব, আদালতে সেগুলো পড়া হচ্ছে মনে করলেই আমার আপাদমস্তক জ্বালা করতে থাকে। কেমন করে বোঝাব আপনাকে বুঝতে পারছি না। এ শুধুই একটা সেন্টিমেন্টাল অনুভূতি।

বাসু বললেন, ঠিক আছে। বুঝিয়ে বলতে হবে না। আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তাহলে তুমি ‘মুন্না’কে মেরে ফেললে কেন?

—ঐ কথাটা পুলিসেও জিজ্ঞাসা করেছিল। কী আশ্চর্য—আপনারা সত্যিই বিশ্বাস করছেন—ওকে আমি মেরেছি?

—তুমি মারোনি?

—নিশ্চয়ই না। আমি তাকে কেন মারতে যাব?

—হয়তো তুমি ওর একটা অদ্ভুত বোল শুনেছিলে….

—জানি, কিন্তু সেটা তো সে সেই প্রথম দিন থেকেই বলছে—সেই দোসরা সেপ্টেম্বর থেকে। তখন তো উনি বেঁচে। উনিই তো নিজের হাতে ওটাকে আমার কাছে দিয়ে গেলেন। মুন্না তো আদৌ কোনোদিন ঐ লগ্‌-কেবিনে যায়নি!

—তাহলে? কে ওকে মারল? তুমি কখন সেটা জানতে পারলে?

—শ্রীনগর থেকে আমি ভোর ছ’টা পনেরোর বাসে রওনা হয়েছিলাম। নটা নাগাদ বাড়িতে এসে পৌঁছাই। পাশের বাড়ি থেকে চাবি নিয়ে ঘর খুলে চিঠিগুলো পোড়াতে শুরু করি। তার মিনিট দশেকের মধ্যেই সদর দরজায় কে কড়া নাড়ল। খুলে দেখি একজন পাঞ্জাবী পুলিস অফিসার এবং আর একজন লোক। তাঁরা তখনই বললেন, “য়ু আর আন্ডার অ্যারেস্ট’। তাঁরা আমার সামনেই ঘরটা সার্চ করলেন। তাঁরাই আবিষ্কার করলেন—মুন্না মরে পড়ে আছে খাঁচায়। য়ুনিফর্ম যিনি পরেননি তিনি বাঙালি। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন—’পাখিটাকে এভাবে মেরেছেন কেন?’ আমি বললাম, ‘আমি মারিনি’। তখনই ঐ পাঞ্জাবী অফিসারটি ইংরাজীতে বললেন, মিস দাসগুপ্তা আপনি আমাদের প্রশ্নের জবাবে যা বলছেন বা বলবেন, তা প্রয়োজনবোধে আমরা আপনার বিরুদ্ধে আদালতে ব্যবহার করতে পারি। তখনই আমার সন্দেহ হল—ওরা আমাকে, আমাকে…একটা জঘন্য অপরাধে ফাঁসাতে চায়। আমি আপনার অনেকগুলো কাহিনী পড়েছি। তাই আমার মনে পড়ল—এ-ক্ষেত্রে সংবিধানগত অধিকারে আমি প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করতে পারি। তাই আমি আর কোনও কথা বলিনি। আমি কি ভুল করেছি?

—না। তুমি ঠিকই করেছ। এবার বল, মন-বাহাদুর তোমার কাছে যে পিস্তলটা গচ্ছিত রেখে গিয়েছিল সেটা কেমন করে লগ্‌-কেবিনে পাওয়া গেল? তুমি কি সেটা নিজেই লগ্‌-কেবিনে নিয়ে গিয়েছিলে?

—না। আমি বলছি বিস্তারিত। শুক্রবার দোসরা সেপ্টেম্বর ভোর ছ’টার বাসে উনি পহেলগাঁও থেকে শ্রীনগরে যান। ফিরে আসেন ঐ দিনই সন্ধ্যার সময়। ওঁর সঙ্গে ছিল ‘মুন্না’। সেটা আমাকে, উনি উপহার দেন। শনি আর রবি উনি পহেলগাঁওয়ে ছিলেন। রবিবার বিকালের দিকে উনি বললেন, দিন দশ-বারোর জন্য বাইরে যাচ্ছেন। আমি জানতে চাইলাম, কোথায়? বললেন, ভবঘুরেকে বিয়ে করেছ রমা, সব কথার জবাব পাবে না। তবে দিন দশ-বারো পরে ফিরে আসব। তারপর কী ভেবে নিজে থেকেই বলেন, এখন সংসারী হয়েছি, এবার থেকে আত্মরক্ষার একটা অস্ত্র সঙ্গে রাখতে হবে। শুনে আমার কেমন যেন খটকা লাগলো। প্রশ্ন করলাম, তুমি কি কিছু বিপদের আশঙ্কা করছ? উনি ম্লান হেসে বললেন, ঠিকই ধরেছ তুমি। আজকালের মধ্যেই একজনের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করতে হবে। ভাবছি একটা ছোরা কিনে ফেলি। তোমার কাছে গোটা কুড়িক টাকা হবে? আমি বললাম, টাকা দিচ্ছি কিন্তু ঐ সঙ্গে আরও একটা জিনিস তোমাকে দিতে পারি—একটা লোডেড রিভলভার। উনি খুব অবাক হয়ে গেলেন। তখন বুঝিয়ে বললাম, বাহাদুর সেটা আমার কাছে রেখে গেছে। ফিরে এসে নেবে। উনি তখন বললেন, তাহলে টাকা চাইনে। তুমি ঐ রিভলভারটাই দাও। দিন সাতেক পরে ফেরত পাবে। ভয় নেই, ওটা আমি ব্যবহার করব না। কিন্তু ওটা কাছে থাকা ভালো। আমি তখন ওঁকে রিভলভারটা দিলাম। উনি সেইদিনই বিকালে চলে গেলেন। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে উনি ঐ লগ্-কেবিনেই যাচ্ছেন। তারপর আর তাঁকে কোনওদিন দেখিনি।

বাসু মিনিটখানেক কী ভাবলেন। তারপর বললেন, আমার কাছে কিছু গোপন করোনি তো?

মেয়েটিও এতক্ষণ নতমুখে কী ভাবছিল। বললে, হ্যাঁ একটা কথা এখনও আপনাকে বলিনি। সেটাই বোধহয় আমার বিরুদ্ধে সবচেয়ে খারাপ এভিডেন্স!

বাসু সোজা হয়ে বলেন, কী?

—আমি মঙ্গলবার খুব ভোরে উঠে ঐ লগ্-কেবিনের দিকে গিয়েছিলাম। মঙ্গলবার, ছয় তারিখ বেলা দশটা নাগাদ আমি ঐখানেই ছিলাম!

কেন? তুমি তো জানতে না উনি ওখানেই গেছেন?

—না। তা জানতাম না। এটাও নিতান্তই সেন্টিমেন্ট। ঐ কেবিনটার কাছে যাওয়ার একটা দুরন্ত কামনা হল। ঐ পাইনবনের মৃদু গন্ধ, কাঠবিড়ালী আর পাখিগুলোর…কী বলব, আমি একটু পাগলাটে ধরনের। যখন যা খেয়াল চাপে…

—ঠিক আছে। কৈফিয়ত দিতে হবে না। তুমি কী করেছিলে শুধু তাই বল। কেমন করে গেলে ওখানে?

—ভোরবেলা রওনা হয়েছিলাম। কিছুটা বাসে, কিছুটা হেঁটে। ওখানে গিয়ে পৌঁছাই দশটা নাগাদ। তারপর সাড়ে দশটা নাগাদ ওখান থেকে ফিরে আসি। অফিসে যাইনি। ক্যাসুয়াল লীভ নিয়েছিলাম।

তোমাকে লগ্‌-কেবিনের কাছাকাছি কেউ দেখেছিল?

—হ্যাঁ। ওখানকার দারোয়ান।

—তুমি কি দেখলে লগ্-কেবিনটা বন্ধ?

—হ্যাঁ, এখন বুঝতে পারছি, উনি তখন কাছেই কোথাও বসে মাছ ধরছিলেন।

—জানলা দিয়ে ভিতরে উঁকি দাওনি?

—না। আমি তো শুধু বেড়াত্বেই গিয়েছিলাম।

আবার দুজনেই কিছুটা চুপচাপ

হঠাৎ মেয়েটির চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরে পড়ল। বলল, আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, উনি নেই! কেন—কেন এমন করে ওঁকে মারল বলুন তো? এমন একজন সরল, শান্ত, প্রকৃতিপ্রেমিক….

বাসু ওর খোঁপাটা নেড়ে দিয়ে বললেন, মনকে শক্ত কর রমা। দু-চার দিনের মধ্যেই তোমার কেস উঠবে আদালতে। প্রাথমিক শুনানী। তোমার বিরুদ্ধে যে রকম কেস, আমার আশঙ্কা হয় দায়রা-সোপর্দ হবেই। যদি না আমি তার আগে কোনও সন্দেহাতীত প্রমাণ সংগ্রহ করে…

মেয়েটি ওঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে, আমি ওদের কী বলব? ওরা যদি সব কথা জানতে চায়? কতটা বলব? আমি কি বলব যে, কোনও কথার জবাব আমি দেব না?

বাসু উঠে দাঁড়ান। বলেন, না! ঠিক উল্টোটা। তুমি আদ্যন্ত সত্য কথা বলবে। কোনও কিছু গোপন করবে না। মনে থাকবে?

—ছয় তারিখ সকালে যে আমি, আমি ওখানে গিয়েছিলাম…

—বললাম তো, দ্য হোল ট্রুথ অ্যান্ড নাথিং বাট দ্য ট্রুথ!

মেয়েটি কুঞ্চিত ভ্রূভঙ্গে বললে, কিন্তু কাল বিকালে তো আপনি আমাকে পুলিসের কাছ থেকে লুকিয়েই রাখতে চেয়েছিলেন?

বাসু হাসলেন। বললেন, না, রমা, পুলিসের কাছ থেকে নয়। আমি লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম সেই লোকটার কাছ থেকে যে মুন্নাকে মারতে আসছে।

—সে কে?

—বুঝলে না? আমি জানতাম, লোকটা মুন্নাকে খুন করতে আসবে। তুমি যদি তাকে দেখে ফেলতে পাখিটাকে মারতে বা প্রতিবাদ করতে যেতে তাহলে লোকটা তোমাকে মেরে ফেলত! লোকটা একটা খুন আগেই করেছে— মহাদেও প্রসাদকে; -প্রয়োজন হলে সে আর একটা খুনও করে বসত!

—কিন্তু, কিন্তু আপনি কী করে জানলেন লোকটা মুন্নাকে মারতে আসবে?

—‘পিওর ডিডাকশান’ রমা! পরে তোমাকে বুঝিয়ে বলব। এখন বল, আদ্যন্ত সত্যি কথা বলতে পারবে তো?

আবার ম্লান হাসল মেয়েটি। বললে, আদ্যন্ত সত্যি কথা বলা কি এতই কঠিন? দেখবেন, আমি পারব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *