ছয়
সুজাতা রমাকে নিয়ে রওনা হয়ে পড়ার পর কৌশিক বলে, এর পর? আজকের মতো কি খেল খতম্?
বাসু ব্যঙ্গের স্বরে বলেন, আজ্ঞে না! সার্কাসের শেষ খেলা হচ্ছে ‘বাঘিনী’র!
ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন—সূরযপ্রসাদের প্রাসাদে গাড়ি নিয়ে যেতে।
প্রকাণ্ড হাতাওয়ালা বাড়ি। গেটে বন্দুকধারী গুর্খা প্রহরী। গাড়ি নিয়ে পোর্চে থামতেই বেরিয়ে এলেন এক ভদ্রলোক। বাসু দেখলেন, গঙ্গারামজী। এগিয়ে এসে বললেন, আসুন স্যার, সূরয আপনাকে প্রতি পনের মিনিট পর পর হাউসবোটে ফোন করে চলেছে।
—নতুন কোনও ঝামেলা বেধেছে নাকি?
—বিশেষ কিছু নয়, গৃহকর্ত্রী এসে পৌঁছেছেন। ঐ শুনুন না—
ইতিমধ্যে ওরা সোপান অতিক্রম করে প্রকাণ্ড ড্রইংরুমে প্রবেশ করেছেন। ড্রইংরুমের পিছনেই দ্বিতলে ওঠার সিঁড়ি। উপর থেকে ভেসে আসছে একটি মহিলাকণ্ঠ—রীতিমতো রূঢ় ও কর্কশ।
গঙ্গারামজী বলেন, ওঁরা দুজন আর সূরয একা। পারবে কেন?
—কেন? আপনি তো সূরযকে মদৎ দিতে পারতেন?
—কী করে দেব স্যার? আমি তো এখনও নিশ্চিতভাবে জানি না–কে আমার মনিব। সদ্যোবিধবা, না সূরয?
—তাহলে আমি বরং সূরযের পাশে গিয়ে দাঁড়াই।
কৌশিক বলে, আমি আসব?
—না। তুমি হাউসবোটে ফিরে যাও। রানু একা পড়ে গেছে।
—সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে বাসু বলেন, ভদ্রমহিলার তরফে কোনও উকিল নিয়োজিত হয়েছেন কি?
—আজ্ঞে না। উনি বলছেন, ওঁর উকিল দরকার হবে না। অনেক উকিলের উনি নাক কাটতে পারেন!
বাসু-সাহেব রুমাল দিয়ে নিজের নাকটা মুছলেন।
দুজনে ঢুকতেই সূরযপ্রসাদ আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো। বললে, গুড ইভনিং স্যার। আপনাকেই খুঁজছিলাম আসুন।
মায়ের দিকে ফিরে বললে, মিসেস্ খান্না, ইনিই হচ্ছেন আমার সলিসিটার, মিস্টার পি. কে. বাসু। আর ও হচ্ছে জগদীশ মাথুর।
বাসু-সাহেবের লক্ষ্য হল—সূরয মহিলাকে মাতৃসম্বোধন করেনি। বাসু মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ধন্য হলাম মিসেস্ খান্না।
ভদ্রমহিলা শাণিত দৃষ্টিতে একবার বাসু-সাহেবকে দেখে নিয়ে অস্ফুটে একটি মাত্র শব্দে কী যেন স্বগতোক্তি করলেন। বঙ্গভাষে বোধ করি সেটা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় : আদিখ্যেতা!
জগদীশ কিন্তু সোৎসাহে এগিয়ে এল। বাসু-সাহেবের সঙ্গে করমর্দন করে বললে, আপনার সব কেসগুলো হিন্দি বা ইংরাজীতে অনুবাদ করাচ্ছেন না কেন? আমি মাত্র দুটি কাহিনী…
হঠাৎ মাঝখানে ওর মা ধমক দিয়ে ওঠেন : জগু! বস চুপ করে। এখন আমাদের খোশগল্প করার সময় নয়।
বাসু মহিলার দিকে ফিরে বললেন, তাহলে কিভাবে আমরা সময়টা কাটাবো?
—জরুরী ব্যাপারটা আশু ফয়সালা করে। সূরয আপনাকে টাকা দিয়ে নিযুক্ত করেছে খোশগল্প করার জন্য নয়। আমাকে আমার স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে। ক্ষমতা থাকে আপনি চেষ্টা করে দেখুন। বলুন, আপনার কী বলার আছে?
বাসু বলেন, সব চেয়ে ভালো হয়, আপনি যদি একজন এটর্নি নিযুক্ত করেন, যিনি আপনার স্বার্থ দেখবেন। আইনঘটিত ব্যাপার তো—
মহিলা খখনে গলায় বলেন, আমাকে আইন দেখাতে আসবেন না মশাই। দরকার হলে দশ-বিশটা উকিল আমি আমার ভ্যানিটি-ব্যাগে পুরে ফেলতে পারি। বুয়েছেন? বলুন, কী বলতে চান?
বাসু বলেন, বিষয়টা কী আগে শুনি। নিচে থেকেই আপনার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছিলাম। সে আলোচনাটাই শুরু হক না আবার?
—বেশ। শুনুন মশাই। সূরযকে বলেছি। আপনাকেও বলি। আমার বিয়ে হওয়া ইস্তক সূরয আমাকে বিষ-নজরে দেখে। নানাভাবে আমাকে বিপদে ফেলবার চেষ্টা করে এসেছে। সেসব কথা যদি আমি খোলাখুলি ওর বাপকে বলতাম তাহলে এতদিনে সে ওকে ত্যাজ্যপুত্র করে ছাড়ত। আমি বলিনি। কী দরকার ওসব নোংরামির মধ্যে যাবার? কিন্তু সূরযের অত্যাচারে এ সংসারে টিকতেও পারিনি। গত এক বছর ধরেই তীর্থে-তীর্থে ঘুরে বেরিয়েছি। আমি জানতাম ও সুবিধা পেলে আমাকে বিষ খাওয়াতো—তাই শ্রীনগরে এলেও আমি বরাবর হোটেলে উঠেছি। এ-বাড়ির ছায়া মাড়াইনি। কিন্তু সে খেলা শেষ হয়ে গেছে। এখন সব কিছু বর্তেছে আমাতে। সব কিছু আমাকে বুঝে নিতে হবে। দেখতে হবে, কোম্পানির কত লাখ টাকা ও ইতিমধ্যে হাতিয়েছে। ওকে বলেছি, খাতা-পত্র সব নিয়ে আসতে। ও শুধু ঢিলিমিশি করছে।
বাসু বলেন, ব্যবসায়ের খাতাপত্র দেখতে চাওয়ার আগে আপনিই যে মালকিন্ এটা প্রমাণ হওয়া চাই তো? সেটার কতদূর কী হয়েছে?
–বেশ। সে-কথাই বলি। আমি যদ্দুর জানি—মহাদেও আমাকে বলেও ছিল—সে একটা উইল করেছে। সব কিছু স্থাবর-অস্থাবর স্বত্ব আমাকেই দিয়ে গেছে। সূরয বোধ হয় একটা কী-যেন মাসোহারা পাবে।
বাধা দিয়ে বাসু বলেন, উইলটা আছে আপনার কাছে?
—আপনি কি আমাকে সেইরকম মেয়েছেলে ভেবেছেন? জ্যান্তস্বামীর উইল ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াবো? উইলটা এখানেই, এ বাড়িতেই ছিল এবং আছে। যদি না সূরয সেটা ইতিমধ্যে পুড়িয়ে ফেলে থাকে। ও যেমন ছেলে—ও সব পারে!
বাসু ধীরকণ্ঠে বলেন, ব্যক্তিগত চরিত্রাপহরণ না করেও কি আমরা আলোচনাটা করতে পারি না মিসেস্ খান্না?
এক কথায় ফয়সালা করে দিলেন উনি : না!
গঙ্গারামজী কী একটা কথা বলতে গেলেন—ঠিক সেই সময়ই জ্বলন্ত এক জোড়া চোখ তুলে মহিলা তাঁর দিকে তাকালেন। গঙ্গারামের সব কিছু গুলিয়ে গেল। ঢোক গিলে তিনি স্ট্যাচু মেরে যান।
বাসু বলেন, মিসেস্ খান্না, আমি একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে বাধ্য হচ্ছি। যে এক বছর ধরে তীর্থে-তীর্থে ঘুরছিলেন আর মহাদেও প্রসাদও যে ঐ এক বছর হিমালয়ের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তার কারণটা কি এই নয় যে, আপনাদের ‘সেপারেশন’ চলছিল?
—নিশ্চয়ই নয়! এসব ঐ সূরযের রটনা!
—আপনারা কি দুজনে এটাই স্থির করেননি যে, ঐ ‘সেপারেশন’ পিরিয়ড শেষ হলে বিবাহ-বিচ্ছেদ’টা কার্যকরী করা হবে?
—এক কথা কতবার আপনাকে বলব মশাই? তেমন কোনও কথাই ওঠেনি! সূরয খাই ভাবুক না কেন, আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনও রকম মনকষাকষি কোনওদিন হয়নি।
সূরয এই সময় বলে ওঠে, মিস্টার বাসু, আমি এখানে একটি তথ্য পেশ করতে চাই। আমি ব্যাঙ্কে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, গত দোসরা সেপ্টেম্বর পিতাজী এবং চাচাজী ব্যাঙ্কে গিয়েছিলেন এবং পিতাজী কিছু ফিক্সড-ডিপজিট জমা দিয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা লোন চেয়েছিলেন। চাচাজী আমার কাছে স্বীকার করেছেন, এই ব্রাঞ্চ থেকে লোন না পেয়ে পিতাজী তাঁকে দিল্লিতে পাঠিয়ে দেন। চাচাজী দশ তারিখে দিল্লি ব্রাঞ্চে সেই ফিক্সড-ডিপজিট দাখিল করে দুখানি ব্যাঙ্ক ড্রাফ্ট করিয়ে আনেন।
মহিলা বলেন, তাতে কী হল?
সে কথায় কান না দিয়ে সূরয বলে, চাচাজী আমার কাছে আরও স্বীকার করেছেন, পিতাজী ঐ টাকাটা একটা মানি সেটলমেন্ট কেসে খরচ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কে সেই পার্টি তিনি আমাকে বলছেন না।
মহিলা পুনরায় প্রতিবাদ করেন, এসব ‘খেজুরে গল্প’ কেন শোনানো হচ্ছে?
সূরয তাঁর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, বারে বারে আমাকে বাধা দেবেন না। আমার বক্তব্য শেষ হলে, আপনি কথা বলবেন।
মহিলা সোফায় এলিয়ে পড়ে বলেন, বেশ বল। শুধু ‘খেজুরে’ নয়, ‘আষাঢ়ে’ গল্প।
সূরয সূত্রটা তুলে নিয়ে বলে, আমার বিশ্বাস, আপনি যে প্রসঙ্গ তুলেছেন—ঐ সেপারেশনের কথা, তার সঙ্গে এই পঞ্চাশ হাজার টাকার যোগাযোগ আছে। চাচাজী এ বিষয়ে কী জানেন, তা জানা দরকার।
বাসু-সাহেব বলেন, ঠিক কথা। মহাদেওপ্রসাদ জীবিত থাকলে একমাত্র তাঁর কাছেই আপনার কৈফিয়ত দেবার কথা হত। তাঁর অবর্তমানে তাঁর স্ত্রী ও পুত্রের কাছে সব কথা আপনাকে খুলে বলতে হবে। বিশেষ এ একটা মার্ডার কেস।
গঙ্গারাম মিসেস্ খান্নার দিকে তাকাচ্ছেন না। বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন। ওঁদের সেপারেশনই চলছিল। মিসেস্ খান্না ডিভোর্সে রাজি হয়েছিলেন, নগদ —
ওঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে মহিলা চাপা গর্জন করে ওঠেন, গঙ্গারাম! আমি তোমাকে শেষবারের মতো সাবধান করে দিচ্ছি কিন্তু —
হঠাৎ গঙ্গারামজী সাহস ফিরে পান। সুরমার চোখে চোখ রেখে বলেন, আমাকে বৃথাই ভয় দেখাচ্ছেন, মিসেস খান্না। কী করবেন আপনি? সম্পত্তির অধিকার পেলে আমাকে বরখাস্ত করবেন, এই তো? তা আপনিই যদি এ কারবারের মালিক হয়ে বসেন, তাহলে আমি নিজে থেকেই পদত্যাগ করব! আর আমার ভয়টা কিসের?
মিসেস খান্না কালনাগিনীর মতো হিসহিসিয়ে ওঠেন, তুমি আমাকে চেন না!
চোখ দুটো জ্বলে উঠল গঙ্গারামের। বললে, চিনি, খুব চিনি। কিন্তু আমি তো আধা-সন্ন্যাসী মহাদেও প্রসাদ খান্না নই, আমাকে গুলি করে মারা অত সহজ নয়!
যেন জ্যাক-ইন-দ্য-বক্স পুতুল। তড়াং করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন মিসেস খান্না। চিৎকার করে ওঠেন, কী! কী বললে? আমি মানহানির মকদ্দমা করব।
বাসু তাঁকে থামিয়ে দেন : বসুন, বসুন। মানহানির মকদ্দমা যখন হবে তখন ওসব কথা উঠবে। আপাতত আমরা সম্পত্তির মালিক কে সেটারই ফয়সালা করছি। বলুন, গঙ্গারামজী। আপনি কী যেন বলছিলেন?
মিসেস্ খান্না গোঁজ হয়ে বসে থাকেন। গঙ্গারামজী বলে চলেন, মিসেস্ খান্না ডিভোর্সে রাজি হয়েছিলেন, নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার শর্তে। আমার মালিক সে শর্ত মেনে নেন। স্থির হয়েছিল, মিসেস খান্না দিল্লি আদালতে বিবাহ-বিচ্ছেদের আর্জি পেশ করবেন এবং খান্নাজী তা কনটেস্ট করবেন না। ঠিক এক বছর আগে মিসেস্ খান্না আর্জি পেশ করেন। আদালত এক কথায় সে আর্জি মেনে নেন না, ওঁদের এক বছর সেপারেশনে থাকবার নির্দেশ দেন। এ বছর পাঁচই সেপ্টেম্বর মিসেস্ খান্না দলিলটা পাবেন এমন কথা ছিল। আদালত থেকে তিনি নির্দেশ পান সোমবার পাঁচই সেপ্টেম্বর আদালত থেকে দলিলটা ডেলিভারি নিয়ে যেতে। মিসেস্ খান্না আমাকে টেলিফোন করে জানিয়েছিলেন। ছয়ই সকালের ফ্লাইটে তিনি শ্রীনগরে আসবেন এবং নগদে পঞ্চাশ হাজার টাকা পেলে বিবাহ-বিচ্ছেদের দলিলটা হস্তান্তরিত করবেন। সে-কথা আমি যখন আমার মালিককে জানালাম তখন উনি লিখলেন, সোমবার পাঁচই উনি এসে ব্যাঙ্ক থেকে টাকাটা তুলে আমাকে দিয়ে যাবেন। পরদিন আমি ঐ টাকা মিসেস্ খান্নাকে দেব এবং বিবাহ-বিচ্ছেদের দলিলটা নিয়ে সিন্দুকে রাখব। যে কোনও কারণেই হোক মালিক শুক্রবার দোসরা সকালে সাড়ে নটা নাগাদ এসে উপস্থিত হলেন। বাড়ির সিন্দুক থেকে এক বাণ্ডিল ফিক্সড-ডিপজিট সার্টিফিকেট নিয়ে আমাকে সঙ্গে করে ব্যাঙ্কে যান। সেখানে ব্যাঙ্ক-ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল যে, এ টাকা পেতে হলে হয় তাঁকে অথবা আমাকে দিল্লি যেতে হবে। উনি সার্টিফিকেটগুলি আমাকে দিয়ে বলেন সেগুলি বাড়িতে রাখতে। আরও বলেন, তিনি অন্য কোনও সূত্র থেকে টাকাটা যোগাড় করা যায় কিনা দেখবেন। নেহাৎ না পারলে উনি টেলিফোন করে আমাকে জানাবেন, যাতে আমি ঐগুলি জামানৎ দিয়ে দিল্লি থেকে ব্যাঙ্ক ড্রাফ্ট করিয়ে আনতে পারি। এর পর উনি আড়াইটার বাসে পহেলগাঁওয়ের দিকে চলে যান।
বাধা দিয়ে বাসু বলেন, বাসে? পাবলিক্ বাসে? গাড়িতে নয়?
—আজ্ঞে না। পাবলিক্ বাসে। যদিও তাঁর দুখানা অ্যাম্বাসাডার, একটা স্টেশন-ওয়াগন, একটা ল্যান্ডরোভার আর একত্রিশখানা ট্রাক আছে। যা হোক, যে-কথা বলছিলাম, পাঁচই রাত আটটা নাগাদ তিনি ঐ ট্রাউট-প্যারাডাইস থেকে আমাকে ফোন করে বললেন দিল্লি থেকে ব্যাঙ্ক ড্রাফ্ট করিয়ে আনতে।
বাসু বললেন, উনি কি ঐ লগ্-কেবিন থেকেই ফোন করেন?
—না। ঐ লগ্-কেবিন থেকে নয়। উনি বললেন, লগ-কেবিনের টেলিফোনটা ডেড হয়ে আছে। তিনি অন্য কোনও জায়গা থেকে ফোন করছেন। কোথা থেকে তা উনি বলেননি। আমিও জিজ্ঞাসা করিনি। সে যাই হোক, আমি তৎক্ষণাৎ এয়ার-অফিসে ফোন করি। সৌভাগ্যক্রমে পরদিন মর্নিং ফ্লাইটে একটা টিকিট পেয়ে যাই। ছয়ই ভোরের প্লেনে দিল্লি চলে যাই। কিন্তু সেখানে পৌঁছেই অসুস্থ হয়ে পড়ি। দু-তিন দিন আমি হোটেল ছেড়ে বেরুতে পারিনি। দশ তারিখে ব্যাঙ্কে গিয়ে ড্রাফ্টটা তৈরি করি। পরদিনই অর্থাৎ এগারোই সূরয আমাকে টেলিফোন করে দুঃসংবাদটা জানায়। আমি তৎক্ষণাৎ ফিরে আসি। ড্রাফ্ট দুটি এখনও আমার কাছে আছে।
সূরয ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, কী আশ্চর্য! এসব কথা তো আপনি আমাকে ঘুণাক্ষরেও জানাননি চাচাজী?
—না জানাইনি। কারণ মালিকের নির্দেশ ছিল সব কিছু গোপন রাখতে,—হ্যাঁ, এমনকি তোমার কাছ থেকেও। নির্দেশ ছিল, ঐ দলিলটি সংগ্রহ করে শুধু তাঁরই হাতে দেওয়ার। সে সৌভাগ্য আমার হল না, তার আগেই তিনি আমাকে ফাঁকি দিয়ে-
গলাটা ধরে এল প্রভুভক্ত একান্ত সচিবের। রুমাল দিয়ে চশমার কাচটা মুছে নিয়ে বললেন, আমি অপেক্ষা করছিলাম মিস্টার বাসুর জন্য। এখন আমার বুক থেকে একটা পাষাণভার নেমে গেল।
বাসু মিসেস্ খান্নার দিকে ফিরে বললেন, এ বিষয়ে আপনি কী বলেন?
মিসেস্ খান্না বলেন, নাটক মঞ্চস্থ করছেন আপনারা, আমি তো দর্শকমাত্র। আমি কী বলব? একটা কথাই বলতে পারি : এনকোর! এনকোর!
বাসু গম্ভীরভাবে বলেন, মিসেস্ খান্না, ব্যাপারটা আশু ফয়সালা হয়ে যাক এটা নিশ্চয় আপনিও চাইছেন। দিল্লি-আদালত আপনাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ মঞ্জুর করেছেন কি না এটা আমরা ঠিকই জানতে পারব। কিছুটা সময় লাগবে, এই যা। এ-ক্ষেত্রে আপনি কি জানাবেন, দিল্লি আদালত সেটা মঞ্জুর করেছেন কি না?
—হ্যাঁ করেছেন।
—সেটা নিয়েই আপনি এসেছেন শ্রীনগরে! সাত তারিখে?
—সে কৈফিয়ত আপনাকে দিতে যাব কেন?
সূরয বলে, বিবাহ-বিচ্ছেদ যদি হয়ে গিয়ে থাকে, তবে ক্ষতি-পূরণ স্বরূপ ঐ পঞ্চাশ হাজার টাকাই তাঁর প্রাপ্য, কেমন তো? এ-ক্ষেত্রে উনি আমার বিমাতা নন? তার মানে বাকি সম্পত্তির কিছুই উনি দাবী করতে পারেন, না?
কোথাও কিছু নেই অট্টহাস্যে ফেটে পড়েন মহিলা। হাসির দমক সামলে বলেন, তুমি বড় তাড়াহুড়া করে ফেলছ সূরয। একদিন পরে কাজটা হাসিল করলে সব কিছুই তোমাতে বর্তাতো!
—কোন কাজ?
—বাপ্কে খুন করা, আবার কী?
—শাট আপ!—গর্জে ওঠে সূরয।
জগদীশ এতক্ষণ নীরব ছিল। এবার বললে, মা, কী বলছ ভেবেচিন্তে বল!
—আমি জানি, জগু আমি কী বলছি। এই দেখুন ব্যারিস্টার-সাহেব সেই বিবাহ-বিচ্ছেদের দলিলটা।
সূরয বললে, মিস্টার বাসু, আমার প্রশ্নটার জবাব পাইনি। বিবাহ-বিচ্ছেদ যখন হয়ে গেছে তখন—মাঝপথেই সে থেমে যায়। দেখে, বাসু-সাহেব মন দিয়ে দলিলটা দেখছেন। মিসেস্ খান্নার কিন্তু তর সয় না। বলেন, কই ব্যারিস্টার-সাহেব? এবার নাটকে আপনার ডায়ালগ্ যে? আপনার ক্লায়েন্টকে শুনিয়ে দিন কেন ঐ বিবাহ-বিচ্ছেদ দলিলটা সিদ্ধ নয়?
বাসু বললেন, হ্যাঁ, বিবাহ-বিচ্ছেদের এ দলিলটা সিদ্ধ কিনা সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। আদালত বিবাহ-বিচ্ছেদের দলিলটা অনুমোদন করেছেন ছয়ই সেপ্টেম্বর। ঠিক কটার সময়—এমন কি ‘ফোরনুন’ না ‘আফ্টারনুন’ তারও উল্লেখ নেই। অপরপক্ষে মহাদেওপ্রসাদ খুন হয়েছেন ঐ ছয় তারিখেই সকাল এগারোটা নাগাদ। বিবাহ-বিচ্ছেদের দলিলটি সিদ্ধ হচ্ছে ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষরমুহূর্ত থেকে। যদি প্রমাণিত হয়, তিনি বেলা এগারোটার পর সই করেছেন, তাহলে এ ডিভোর্স-সার্টিফিকেট সিদ্ধ নয়। কারণ মৃতব্যক্তি বিবাহ-বিচ্ছেদ করতে পারে না, কাউকে ওকালতনামা দেওয়া থাকলেও।
মিসেস্ খান্না বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট বিকালবেলা সইটা করেন, এবং আমার তরফে অ্যাটর্নি সেটা ডেলিভারি নেন বিকাল চারটায়। প্রয়োজন হলে আমার অ্যাডভোকেট সেই মর্মে এফিডেবিট করবেন।
বাসু বলেন, তারপর? আপনারা দুজন সাত তারিখের ফ্লাইটে শ্রীনগরে চলে আসেন? —একই কথা বার বার জিজ্ঞেস করছেন কেন বলুন তো?
—কারণ এমনও হতে পারে যে আপনি ছয় তারিখ মর্নিং ফ্লাইটে দিল্লি থেকে এসেছেন, এবং আপনার পুত্র পরদিন ঐ বিবাহ-বিচ্ছেদ দলিলটা নিয়ে এসেছে?
—তাতে কী হল?
—হয়নি কিছুই। আমি জানতে চাইছি আপনি কবে শ্রীনগরে এসেছেন?
—আমি তো বারে বারেই বলছি, সে কথা ইরেলিভ্যান্ট অ্যান্ড ইম্মেটিরিয়াল। ছয় তারিখ সকালে আমি কোথায় ছিলাম, তার সঙ্গে সম্পত্তির মালিকানার কোনও সম্পর্ক নেই। আপনিই না একটু আগে বললেন, আমাদের বর্তমান মামলাটা শুধু সম্পত্তির অধিকার বিষয়ে?
—তার মানে ছয়ই সকালে আপনার কোনো ‘অ্যালিবাই’ নেই!
—লুক হিয়ার মিস্টার ব্যারিস্টার। এটা আদালত নয়। আপনার অবান্তর প্রশ্নের জবাব আমি দেব না। আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন—ঐ বিবাহ-বিচ্ছেদের কাগজখানা নিতান্ত মূল্যহীন।
বাধা দিয়ে সূরয বলে ওঠে, একটু আগে আপনি বলছিলেন, আমিই বাবাকে খুন করেছি। অথচ দেখা যাচ্ছে ছয়ই সকালে আপনি কোথায় ছিলেন তার সন্তোষজনক কৈফিয়ত দিতে পারছেন না। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আপনি হোটেলে চেক-ইন করেছেন সাত তারিখ সকালে। অথচ এয়ারলাইন্স বলছে, ছয়-সাত দু-দিনের প্যাসেঞ্জার লিস্টেই আপনার নাম নেই! তার মানে…
Sp
—ব্যস ব্যস! ঐ পর্যন্তই থাক। তোমার ব্লাড প্রেসার বেশি, ডাক্তার বলেছেন, উত্তেজিত না হতে, তাই না? আচ্ছা চলি ব্যারিস্টার-সাহেব-
পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে মহিলাটি কক্ষত্যাগ করবার জন্য উঠে দাঁড়ান। বাসু বলেন, বসুন, যাবেন না। আমার আরও একটা কথা বলার আছে-
—আবার কি?—মিসেস্ খান্না বসে পড়েন।
–খবরটা এখনও জানাজানি হয়নি, কিন্তু পুলিসে এটা শীঘ্রই জানতে পারবে। মহাদেও প্রসাদ সাতাশে অগস্ট তারিখে একটি মহিলাকে বিবাহ করেন।
সূরয চমকে ওঠে। গঙ্গারামও। কিন্তু মিসেস্ খান্নাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত হতে দেখা গেল না। বললেন, কী দুর্ভাগ্য, আমাদের নিমন্ত্রণ হল না! মহাদেও যে চরিত্রের লোক তাতে আমি অবাক হইনি। লোকটা মরে গেছে, তাই ‘বাইগামি’র মামলা আনা যাবে না। তা সে যাই হোক, আমার সঙ্গে যতদিন না বিবাহ-বিচ্ছেদ হচ্ছে ততদিন সেই মাগির কোনও দাবী আইনত দাঁড়ায় না। মেয়েটি কে তা জানবার আমার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। আয় জগু, আমরা যাই। অনেক কাজ এখনও বাকি।
মিসেস্ খান্না চলে যাবার পর বাসু দেখলেন, দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে সূরয। তারপর মুখ তুলে বললে, এ তথ্য কী করে পেলেন?
—ঐ উলের কাঁটা আর ব্র্যাসিয়ারের সূত্র ধরে। মেয়েটির দোষ নেই, সে জানত না উনি বিবাহিত।
সূরয বলে, ইতিমধ্যে আর কিছু জেনেছেন?
—জেনেছি। লগ-কেবিনে যে ময়নাটাকে পাওয়া গেছে সে মুন্না নয়। যে কোনো কারণেই হোক তোমার বাবা মুন্নাকে কোনও নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দিয়ে ঠিক ঐ রকম দেখতে আর একটি ময়নাকে ঐ লগ্-কেবিনে নিয়ে এসেছিলেন।
সূরয চমকে উঠে বলে, তিনি নিজেই? কেন?
—কেন তা এখনও বুঝতে পারিনি। তবে তিনি নিজেই ঐ দ্বিতীয় ময়নাটিকে খরিদ করেন দোসরা সেপ্টেম্বর শ্রীনগরের বাজারে।
তারপর উনি গঙ্গারামের দিকে ফিরে বলেন, দোসরা বেলা দেড়টার বাসে আপনি কি তাঁকে তুলে দিয়ে এসেছিলেন? তাঁর সঙ্গে কি আর একটা ময়না ছিল?
গঙ্গারাম বললেন, আজ্ঞে না। বাসে আমি নিজে তাঁকে তুলে দিতে যাইনি। তাঁর সঙ্গে আর একটা ময়না ছিল কিনা তা আমি জানি না। কিন্তু তিনি কেন আবার একটা ময়না কিনবেন? আর সেই দ্বিতীয় পাখিটাই বা কোথায়?
বাসু বললেন, দ্বিতীয় পাখি নয় গঙ্গারামজী, সেটাই প্রথম পাখি। তার নাম মুন্না। তার দেখা পেলেই বোঝা যাবে কী কারণে খান্নাজী তাকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দিয়েছিলেন। গঙ্গারাম বললেন, নিরাপদ দূরত্বে মানে? আততায়ী তো ময়নাটার কোনও ক্ষতি করেনি। মালিক কেন আশঙ্কা করলেন যে, মুন্নার কোনও বিপদ আছে?
বাসু বলেন, যতক্ষণ না ‘মুন্না’কে খুঁজে পাচ্ছি ততক্ষণ এ প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। কিন্তু এ-কথা নিশ্চিত যে, ঘটনার সময় ওঁর লগ্-কেবিনে মুন্না আদৌ ছিল না।
Ok