উলের কাঁটা – ১৩

তেরো

আরও ঘণ্টাদুয়েক পরের কথা।

হাউসবোটের ড্রইংরুমে সমবেত হয়েছেন সবাই। বাসু-সাহেব রানী দেবীকে সর্বশেষ ঘটনার চুম্বকসার শোনাচ্ছিলেন। সুজাতা কফি পটে কফিটা তৈরি হয়েছে কিনা দেখছে। কৌশিক এবং সূরয ঘরের অপর প্রান্তে নিম্নস্বরে কথোপকথনে ব্যস্ত। দ্বারের কাছে ধ্বনিত হল : আসতে পারি?

সবাই চোখ তুলে তাকায়—যশোদা কাপুর এবং রমা দাসগুপ্তা।

বাসু-সাহেব এগিয়ে এসে আগন্তুকের করগ্রহণ করে বলেন, আইয়ে আইয়ে খান্নাজী।

সূরয উঠে দাঁড়ায়। পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে। নত হয়ে প্রণাম করতে যায়। তার আগেই প্রীতম প্রসাদ খান্না ওকে সবলে বুকে টেনে নেন।

রমা এগিয়ে এসে রানী দেবীকে প্রণাম করে। বলে, কী যে বলব আমি ভেবে পাচ্ছি না। আমি…আমি…

রানীও ওকে বুকে টেনে নিয়ে বলেন, কিছুই বলতে হবে না রমা। তোমার বুকের মধ্যে এখন কী হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি।

সবাই স্থির হয়ে বসার পর বাসু সূরযকে প্রশ্ন করেন, তোমার কাকাকে দেখতে কি ঠিক বাবার মতো?

সূরয বললে, না। বাবা বেশ বুড়িয়ে গেছিলেন। তবে বছর সাত-আট আগে তাঁকে দেখতে ঠিক এই রকমই ছিল। খবরের কাগজ থেকে যখন ছবি চেয়ে পাঠায়, আমি বাবার একটা পুরানো ফটোগ্রাফই দিয়েছিলাম। তাতেই চাচিজীর ভুল হয়েছে।

প্রীতম প্রসাদজী বলেন, আমি খবরের কাগজ পড়া বহুদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছি। তাই এত বড় খবরটা জানি না। অবশ্যই আমি মাত্র কালকেই শ্রীনগরে ফিরে এসেছি। তার আগের দিন দশেক এমন পাহাড়ী অঞ্চলে ছিলাম যেখানে খবরের কাগজ যায় না।

বাসু বলেন, যদি কিছু না মনে করেন, আপনি ছদ্মনাম নিয়েছিলেন কেন?

প্রীতমজী হেসে বলেন, দেখুন, আমি একজন পাগলাটে মানুষ। ভবঘুরে। পাহাড়ে পর্বতে ঘুরে বেড়াই। হয়তো ময়লা বা ছেঁড়া জুতো-জামা পরি। অথচ মুশকিল হচ্ছে এই যে, আমার চেহারার সঙ্গে দাদার চেহারার খুবই সাদৃশ্য। দাদা একজন খান্দানী নামী ব্যক্তি। নিজের উপাধি খান্না বললেই লোকে প্রশ্ন করত, ‘মহাদেওপ্রসাদ খান্নাজী আপনার কেউ হন?’ জবাবে সত্য কথা বললেই নানান প্রশ্ন উঠে পড়ে। দাদা কেন তাঁর মায়ের পেটের ভাইকে দেখেন না, লক্ষপতির ভাই কেন ভবঘুরে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই নিজের নামটাকেই বদলে নিয়েছিলাম।

বাসু বলেন, আমার আরো দুয়েকটি প্রশ্ন আছে। জিজ্ঞাসা করব?

—নিশ্চয়ই করবেন। রমার কাছে শুনেছি, আপনি ওকে ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচিয়েছেন। আমি…আমি কী দিতে পারি আপনাকে? বড় জোর আপনার একখানা পোট্রেট…কিন্তু…

—সে সব কথা পরে হবে। আপনি বলুন, দাদার সঙ্গে কি সম্প্রতি দেখা হয়েছে?

—হ্যাঁ, হয়েছে। দাদা এবছর অমরনাথ তীর্থে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে পহেলগাঁওয়ে তাঁর দেখা পাই। পহেলগাঁও পোস্ট-অফিসে। অনেক পুরানো দিনের গল্প হল। তারিখটা আমার মনে আছে—ঠিক আমার বিয়ের পরদিন। আটাশে অগস্ট। আমি দাদাকে বললাম—বিয়ে করেছি। দাদা শুনে খুব খুশী। বলেন, রেজিস্ট্রি বিয়ে করেছিস্ ভালো কথা। শ্রীনগরে হিন্দুমতে আবার আমি তোদের বিয়ে দেব। আমি ওঁকে রমার বাসায় নিয়ে যেতে চাইলাম। উনি রাজি হলেন না, বললেন, ভাইয়ের বৌ কি কেউ খালি হাতে দেখে? তবে তখনই একটা কাগজে রমার নাম-ঠিকানা নিয়ে পকেটে রাখলেন। আমরা দুই ভাই একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে কিছু খেলাম। দাদা বললেন, প্রীতম, এবার আমিও বোধহয় মুক্তি পাচ্ছি। আমি জিজ্ঞাসা করাতে বললেন…

একটু ইতস্তত করে বললেন, নাঃ! সব কথাই বল্ব। আপনারা জানেন কি না জানি না, দাদার এবারকার বিবাহ সুখের হয়নি। উনি আমাকে বললেন, এতদিনে উনি ডাইভোর্স পাচ্ছেন। কথাপ্রসঙ্গে আরও বললেন, ট্রাউট-প্যারাডাইসের সেই লগ্‌-কেবিনটা তোর মনে আছে? ওটা এবারও আমি ভাড়া নিয়েছি। ওখানে পাঁচই তারিখে আমি আসব। আমি তখন ওঁর কাছ থেকে লগ্-কেবিনের চাবিটা চেয়ে নিলাম। বললাম, তুমি তো পাঁচ তারিখে আসবে, তার আগে ওখানে আমি দুদিন থাকতে চাই। সস্ত্রীক। উনি খুশী হয়ে চাবিটা আমাকে দিয়ে দিলেন। দিন দুয়েক আমি আর রমা সেখানে ছিলাম। পয়লা সেপ্টেম্বর আমরা পহেলগাঁওয়ে ফিরে এলাম। পরদিন ভোরের বাসে আমি আর দাদা শ্রীনগরে আসি। দাদা বলেছিলেন, ব্যাঙ্কে ওঁর কী একটা কাজ আছে, সেটা সেরে দেড়টার বাসে পহেলগাঁও ফিরবেন। আমি তাঁকে বললাম—আমিও ঐ বাসেই ফিরব। শ্রীনগরে পৌঁছে উনি সূরযের ওখানে গেলেন, আমি আমার ডেরায় চলে এলাম। ঐ ঘরটা মাসিক দশ টাকা ভাড়ায় আমি রেখেছি আজ বছরদশেক। বেলা একটা নাগাদ বাস-স্ট্যান্ডে গিয়ে আবার দাদার দেখা পেলাম। ওঁর সঙ্গে একটা পাহাড়ী ময়না ছিল। সেটা আমিই ওঁকে দিয়েছিলাম। দাদা বলেন, এটাকে চিনতে পারিস? চিনতে আমার অসুবিধা হল না। তার ডান পায়ের একটা আঙুল কাটা ছিল। দাদা তখন বলেন, প্রীতম, একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে। ও একটা নোতুন বোল পড়ছে! ভারি অদ্ভুত! একটু পরেই পাখিটা ‘বোলটা’ পড়ল। শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম। বললাম, দাদা, এ বোল ও কেমন করে শিখল? এর মানে কী?

আমার দাদা ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান। রাজনীতি করে চুল পাকিয়েছেন। বললেন, ওঁর বিশ্বাস কেউ ওঁকে হত্যা করতে চায় এবং হত্যাপরাধটা ভাবিজীর ঘাড়ে চাপাতে চায়। আমি অবাক হয়ে বলি—এমনভাবে কে ওঁকে হত্যা করতে পারে? উনি জবাবে বললেন, উনি এককালে সক্রিয় রাজনীতি করেছেন। তখন অনেক লোকের কাছে অপ্রিয় হয়েছে। অত্যন্ত প্রভাবশালী কোনও কোনও লোকের বিরুদ্ধে কমিশন বসিয়েছেন। তাদেরই মধ্যে কেউ হয়তো এতদিন পর প্রতিশোধ নিতে চায়।

এই পর্যন্ত বলে প্রীতমজী থামলেন। নিজের মনেই ম্লান হাসলেন। তারপর বলেন, এই বোধ হয় দুনিয়াদারীর মজা। অত বড় বিচক্ষণ মানুষ হয়েও উনি আসল ব্যাপারটা ধরতে পারেননি। এর পর আমাকে কী বললেন, জানেন?

—কী?

—বললেন গঙ্গারামকে জিজ্ঞাসা করে জানতে হবে ঐ পাখিটা এতদিন কার কাছে ছিল,–সেই ঐ বোলটা ওকে শিখিয়েছে!

বাসু-সাহেব বলেন, আশ্চর্য! এত বিশ্বাস?

—জী হাঁ! এতটাই বিশ্বাস করতেন উনি গঙ্গারামকে! অথচ কী ক্ষুরধার বুদ্ধি দেখুন। পরমুহূর্তে বলেন, প্রীতম, তুই তো পাখির বিষয়ে অনেক কিছু খোঁজ রাখিস্! বলতে পারিস, এ-রকম একটা পাহাড়ী ময়না কোথায় কিনতে পাওয়া যায়? আমি ওঁকে জানালাম শ্রীনগরে সেন্ট্রাল মার্কেটে ইয়াকুব মিঞার দোকানে। উনি বললেন, তাহলে তুই মুন্নাকে নিয়ে পহেলগাঁও ফিরে যা। ওটা তোর বউয়ের কাছে রাখ। আমি আর একটা ময়না কিনে আড়াইটার বাসে ফিরে যাব। লোকটা কে তা জানি না, সুরমার প্রতি আমার কোনও দরদ নেই—তাই বলে, বিনা অপরাধে তাকে ফাঁসির দড়িতেও আমি ঝুলতে দেব না।

পহেলগাঁওয়ের কোন হোটেলে দাদা ছিলেন তা আমি জানতাম। কথা হল, চৌঠা আমি তাঁর সাথে দেখা করব, এবং এ বিষয়ে কী সাবধানতা নেওয়া যায় সে কথা আলোচনা করব। আমি পহেলগাঁওয়ে ফিরে ময়নাটা রমাকেই রাখতে দিলাম। দাদার কথা কিছু বলিনি। আমার সত্যিকারের পরিচয়ও দিইনি। কেন, সে কথা আপনাদের আমি বলব না। শুধু রমাকেই বলব। কারণ ও বুঝবে। ওর সব কথা ও আমাকে বলেছে—কেন ও এত বয়সেও অবিবাহিতা। আমার জীবনেও অনুরূপ একটা ঘটনা ঘটেছিল। তাই আমি দেখতে চেয়েছিলাম, আমি নিঃস্ব বেকার একথা জানার পরেও…

হঠাৎ মাঝপথে থেমে বলেন, যাক সে-সব অবান্তর কথা। যে কথা বলছিলাম। চার তারিখে যখন দাদার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, তখন মনে হল একটা ছোরা কিনে দাদাকে উপহার দিলে কেমন হয়? রমার কাছে গোটাকুড়ি টাকা ধার চাইলাম।

বাসু বলেন, বাকিটা আমরা জানি—

সূরয বললে, চাচাজী, পিতাজী তাঁর উইলে বলেছেন আপনার যা ন্যায্য…

তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন প্রীতমজী : না! তা হয় না!

বাসু বলেন, আমি একটা কথা বলব প্রীতমজী?

—জী হাঁ, বলুন।

—আপনি এখনই বলছিলেন আপনার স্ত্রীকে আমি ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচিয়েছি, তাই আমার একটা ফি পাওনা আছে। তাই না?

—জী হাঁ! কিন্তু আপনি তো জানেন আমার কতটুকু সামর্থ্য?

—আর আমি যদি এমন কিছু দাবী করি যা আপনার সামর্থ্যের ভিতর?

—হুকুম ফরমাইয়ে সাব!

—আপনি আপনার দাদার দানটা অস্বীকার করবেন না, এই প্রতিশ্রুতি আমি চাই। প্রীতমজী, আমি জানি-আপনি যদি তাঁর স্নেহের দান গ্রহণ করেন, সংসারী হন, সে টাকায় একটা স্টুডিও খুলে বসে মনের আনন্দে ছবি আঁকতে বসে যান, তবে স্বর্গ থেকে তিনি আপনাকে আশীর্বাদ করবেন। তাছাড়া ঐ মেয়েটাকেই বা কেন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আনন্দঘন বিবাহিত জীবন থেকে বঞ্চিত করবেন আপনি? ও তো টাকার লোভে আপনাকে বিয়ে করেনি?

হাসলেন প্রীতমপ্রসাদ খান্না। স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন, তুমি কি বল?

রমা সাড়া দিল না। সে তখন রানী দেবীর কোলে মুখ লুকিয়ে অঝোরে কাঁদছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *