উলের কাঁটা – ৩

তিন

পরদিন সকালে হাউসবোটের ডাইনিং রুমে সবাই সমবেত হবার পর কৌশিক বলল, কাল আপনাদের ফিরতে এত দেরী হল কেন? আমি ইয়াকুবের দোকানে চুপচাপ বসে বসে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। ও ঝাঁপ বন্ধ করার পর হাউসবোটে ফিরে এলাম।

বাসু বললেন, ফেরার পরে পহেলগাঁও থানাতে যেতে হল যে।

পকেট থেকে এক টুকরো উলের নমুনা বার করে সুজাতার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলেন, এটাকে কী রঙ বলবে সুজাতা?

সুজাতা সেটা হাতে নিয়ে পরখ করে দেখে বলল, ‘পেল লাইলাক’।

রানী দেবীর দিকে সে নমুনাটা বাড়িয়ে ধরে। তিনি বললেন, না শুধু লাইলাক নয়, একটু নীলের ছোঁয়াচ আছে—যাতে রঙটা ভায়োলেট ঘেঁষা লাইলাক বলা যায়।

বাসু বললেন, রঙটা কি ‘কমন’? সহজেই উলের দোকানে পাব?

সুজাতা এবং রানী দেবী দুজনেই স্বীকার করলে, না।

বাসু বললেন, তাহলে সুবিধাই হল আমাদের। কৌশিক, আজ তোমার ডিউটি হল এই নমুনা নিয়ে শ্রীনগরের সব কয়টা উলের দোকানে যাচাই করে দেখা—কোনও দোকানদার মনে করতে পারে কিনা এই রঙের উল সে সম্প্রতি কাউকে বিক্রি করেছে কিনা। করে থাকলে ক্রেতার কথা তার মনে আছে কিনা—সে পুরুষ, না স্ত্রীলোক, কত বয়স, কী রকম দেখতে।

কৌশিক বলে, এভাবে সন্ধান পাওয়ার আশা খুবই কম।

বাসু বলেন, কেন? তুমি তো একবেলার মধ্যেই ইয়াকুবের কাছে ময়নাক্রেতার সংবাদটা পেয়েছ। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে উলের খদ্দেরকেও হয়তো আমরা খুঁজে পাব। মোট কথা, চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী?

সুজাতা প্রশ্ন করে, আমি আর রানীমাসী সারাদিন কী করব?

—একটা শিকারা ভাড়া করে ডাল লেকে চক্কর দিতে পার। চমশাহী, মোঘল-গার্ডেন, নিশাতবাগ দেখে আসতে পার।

রানী দেবী টিপটের লিকারটা পরীক্ষা করতে করতে বলেন, আর তুমি সারাদিন কী করবে?

—আমি আর কৌশিক প্রথমে যাব ইয়াকুবের দোকানে। ময়না-ক্রেতার খোঁজে। তারপর খুঁজতে বের হব সেই ময়না-ক্রেতাকে। হয়তো একবার পহেলগাঁও যাব। ঠিক বলতে পারছি না।

এই সময়ে ছোকরা চাকরটা প্রাতরাশের টেবিলে এনে দিল সেদিনের সংবাদপত্র। কৌশিক সেটা তুলে নিয়ে বলল, আজকের কাগজে মহাদেও প্রসাদের একটা ছবি বেরিয়েছে দেখছি। কাগজে লিখেছিল ওঁর বয়স ছেচল্লিশ, কিন্তু ফটো দেখে আরও কম মনে হয়। চল্লিশের কাছাকাছি। নয়?

সুজাতা ছবিটা দেখে বলে, হাঁ, তাই মনে হয় বটে। হয়তো বয়সের তুলনায় তিনি অতটা বুড়িয়ে যাননি।

বাসু পকেট থেকে একটা চাবির রিঙ বার করেন। তাতে আটকানো পেন্সিল-কাটা ছুরি দিয়ে নিখুঁতভাবে ছবিটা কাটতে কাটতে বলেন, অথবা ছবিটা বছর পাঁচ-সাত আগে তোলা। যখন তাঁর প্রথমপক্ষের স্ত্রী জীবিতা।

রানী বলেন, তুমি সাততাড়াতাড়ি খবরের কাগজটা কাটছ কেন? কেউই তো পড়েনি ওটা।

—ওর উল্টো দিকে একটা বিজ্ঞাপন। ওটা কেউ পড়বে না।

ছবিটা উনি বুকপকেটে ভরে নিলেন।

রানী বলেন, পনের দিনের মেয়াদ আমাদের। তোমার কি মনে হয়, এর মধ্যেই ব্যাপারটা মিটবে?

—মনে হয় না। কেসটা ঘোরালো মার্ডারারের সম্বন্ধে কোনও ক্লুই তো এখনও পাইনি আমরা।

সুজাতা বলে, কেন? অনেক কিছুই তো জানা গেছে—বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, 175 থেকে 180 সেন্টিমিটার লম্বা, গোঁফ-দাড়ি কামানো, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা!

বাসু বলেন, তাহলে অবশ্য মার্ডারার সুচিহ্নিত—গঙ্গারাম যাদব! লোকটার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, দৈর্ঘ্যও ঐ রকম, গোঁফ-দাড়ি কামানো, এবং যদিও তার চা রোল্ডগোল্ড ফ্রেমের তবু কালোফ্রেমের চশমা পরাটা খুব কিছু কঠিন নয়। দুর্ভাগ্যবশত লোকটার মোক্ষম অ্যালেবাই আছে। ছয়ই সেপ্টেম্বর সকাল ছয়টার ফ্লাইটে সে দিল্লি চলে যায়, এবং খুন হয়েছে ঐদিন বেলা এগারোটায় পহেলগাঁওয়ের কাছাকাছি। কিন্তু হত্যাকারীর ঐ সব স্ট্যাটিসটিক্স তুমি কোথায় পেলে সুজাতা?

—কেন? ও তো বলল, ইয়াকুবের দোকান থেকে যে লোকটা ময়না পাখিটা কিনেছে তার…

—কিন্তু তুমি কেমন করে জানলে যে লোকটা ময়না কিনেছে, সেই খুন করেছে মহাদেও প্রসাদকে?

—সেটাই কি আপনাদের হাইপথেসিস্ নয়?

—‘আমাদের’ কিনা জানি না, অন্তত ‘আমার’ নয়।

কৌশিক কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ স্বরে বললে, তাহলে আমাকে ওভাবে নাকে দড়ি দিয়ে কাল ঘোরালেন কেন?

—আমি একথা বলিনি, যে ঐ লোকটা হত্যাকারী নয়। আমি শুধু বলেছি—এমন কোনও সূত্র আমরা পাইনি যাতে ময়না-ক্রেতাকে হত্যাকারী বলে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করা যায়। আর আগেই তো বলেছি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস আসল ‘ব্লু টা আমরা খুঁজে পাব ঐ ‘মুন্না’র মাধ্যমেই—কে-কেন-কখন তাকে বদলিয়ে দিল। আর সবচেয়ে বড় কথা আসল ‘মুন্না’ কোথায় আছে?

ঘণ্টাখানেক পরে অ্যাম্বাসাডার গাড়িটা এসে দাঁড়ালো কাশ্মীরের সেন্ট্রাল মার্কেটের সামনে। সূরযপ্রসাদ এ গাড়িটা ওঁকে সর্বক্ষণের জন্য ব্যবহার করতে দিয়েছে।

ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলে ওঁরা দুজনে মার্কেটে ঢুকলেন। এটা একটা নতুন বাজার। পাশাপাশি টুরিস্ট-নিধন দোকান। কাশ্মীরি শাল, কাঠের কাজ, নানান রকম কিউরিওর দোকান প্রচুর। এত সকালে দোকানে ভিড় নেই। প্রথম চত্বরটা পার হয়ে কৌশিক বাজারের পিছনদিকে ওঁকে নিয়ে এল ইয়াকুব মিঞার দোকানে। ইয়াকুব ওঁদের আপ্যায়ন করে বসালো। আদাব জানালো। কৌশিক বললে, মিঞা-সাহেব এঁর কথা আপনাকে বলেছিলাম, কলকাতার ব্যারিস্টার সাহেব।

ইয়াকুব পুনরায় আদাব জানিয়ে শুধু বলল, বহুৎ খুব!

বাসু প্রশ্ন করেন, এ দোকান কতদিন হল হয়েছে মিঞাসাহেব?

ইয়াকুব বললে, এ দোকান মাত্র পাঁচ বছরের, কারণ এ বাজারটারই বয়স তাই। তবে আমি এ কারবারে আছি অন্তত ‘বিশ-তিশ্-সাল’।

বাসু-সাহেব দোকানটার চারিদিক একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। কিচির-মিচির শব্দে কান ঝালাপালা। নানান জাতের টিয়া, ময়না, কবুতর, লাভ-বার্ড, থ্রাশ, বদরিকা মায় দাঁড়ে বসা একটা ধনেশও। আছে খাঁচাবন্দী খরগোশ, গিনিপিগ, সাদা ইঁদুর ইত্যাদিও।

বাসু-সাহেব বলেন, কাল আমার ভাইয়ের কাছে আপনি বলেছেন যে, কিছু দিন আগে একটি পাহাড়ী ময়না একজনকে বিক্রি করেছেন, তাই নয়?

ইয়াকুব বিশুদ্ধ উর্দুতে বললে, হুজুর, আমি সব কথা আপনাকে খোলাখুলি বলব, কিন্তু তার আগে আপনি আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন—

—বলুন?

—আপনি কি আমাকে আদালতে সাক্ষী হতে বলবেন? তাহলে হুজুর আমি কিছুই মনে করতে পারছি না। আদালতকে আমি ভীষণ ডরাই।

বাসু হেসে বলেন, ঠিক আছে ইয়াকুবমিঞা। আপনাকে আমি সাক্ষী হিসাবে সমন ধরাবো না। এবার বলুন!

—জী হাঁ। সাচ্চা বাৎ। আমি কিছুদিন আগে—না, তাই বা বলি কেন, ঐ বাবুজী চলে যাবার পরে আমি আমার হিসাবের খাতা ঘেঁটে দেখেছি, তাই আজ বলতে পারছি দোসরা সেপ্টেম্বর, জুম্মাবারে আমি মাঝারি সাইজের একটা পাহাড়ী-ময়না এক সাহেবকে বিক্রি করেছি।

—সাহেবের চেহারা আপনার মনে আছে?

—জী সাব। উমর হবে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ। আপনারই মতন লম্বা। গোঁফ-দাড়ি কামানো। ওঁর পরনে ছিল পাৎলুন আর ওভারকোট। ওঁর চোখে ছিল কালো-ফ্রেমের চশমা।

কৌশিক বাধা দিয়ে বলে, কালো ফ্রেম? ঠিক মনে আছে আপনার? রোল্ডগোল্ড নয়?

—জী না। অন্তত তখন তাঁর চোখে ছিল কালো ফ্রেমের চশমা

—লোকটাকে দেখলে আপনি চিনতে পারবেন?

—খুব সম্ভবত পারব। চেহারাটা আমার বেশ মনে আছে।

বাসু বলেন, ঠিক কী কী কথা হয়েছিল, আপনার যতদূর মনে আছে বলে যান দিকি? —সেদিন ছিল জুম্মাবার। দুপুরে আমি নমাজ করতে গিয়েছিলাম, সামনের ঐ মসজিদে। পাশের দোকানের ছবীরলালকে বলেছিলাম দোকানটা দেখতে। ছবীরলাল সজ্জন ব্যক্তি। ওর দোকান তো দেখতেই পাচ্ছেন হুজুর, কাশ্মীরি শালের। কোনও প্রয়োজন হলে ও যদি দোকান ছেড়ে যায়, আমি দেখভাল করি; আবার আমি বাইরে গেলে ও আমার দোকানটা দেখে। সেদিন নামাজ সেরে ফিরে এসে দেখি ঐ বাবুটি দোকানের সামনে বসে আছেন। আমি তাঁকে আদাব জানিয়ে বললাম, ক্যা চাহিয়ে বাবুজী? উনি বললেন, একটা পাহাড়ী ময়না। আমার দোকানে তখন চারটে ময়না ছিল। টেবিলের উপর তাদের সাজিয়ে দিলাম। উনি তার ভিতর একটিকে পসন্দ করে বললেন, ‘ঐটা নেব। কত দাম দিতে হবে?’ আমি ওঁকে বললাম, ‘হুজুর এটার যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, বেশিদিন বাঁচবে না। তখন আপনি আমাকে দুষবেন। তার চেয়ে এই ছোটটাকে কিনুন, এটা অনেক ‘বোল’ শিখেছে। ঐ ধাড়ি ময়নাটা কিছুই বোল’ শেখেনি।’ উনি আমার কথার জবাবে বললেন, ‘না আমি ঐ ধাড়িটাকেই নেব। কত দাম দেব?’ আমি আবার বললাম, ‘ঐটার দাম দুশ টাকা; কিন্তু ঐ ছোট ময়নাটাকে আমি দেড়শ টাকায় দেব। আপনি এটাকেই নিন।’ বলেই আমি পাখিটাকে দিয়ে শিষ্ দেওয়ালাম, ‘বোল’ শোনালাম, নানাভাবে ছোট ময়নাটাকে গছাবার চেষ্টা করলাম—কিন্তু উনি কিছুতে শুনলেন না। ঐ ধাড়ি ময়নাকে বিনা দরদামে দুশ’ টাকা দিয়ে কিনে নিলেন।

বাসু বলেন, কিন্তু ধাড়ি ময়নাটাকে বেচতে আপনার অত আপত্তিই বা ছিল কেন? —তার কারণ ঐটা খুব পয়মন্ত ময়না। ওটাকে দোকানে নিয়ে আসার পর থেকেই আমার দোকানে লাভ বেড়ে যায়। আমার কেমন যেন মায়া পড়ে গিয়েছিল ঐ ময়নাটার উপর। ওর এতটা বয়স হয়েছে, এবং যেহেতু ও একটাও ‘বোল’ শেখেনি তাই ওর বাজারদর টাকা পঞ্চাশ হয় কি না হয়। উনি নগদ দুশ’ টাকা দেওয়ায় আমি আর লোভ সামলাতে পারিনি। উনি কেন যে দেড়শ টাকা দিয়ে বোল-পড়া কমবয়সী ময়নাকে নিলেন না তা আমি আজও বুঝতে পারিনি। আর সেজন্যই ঐ ক্রেতার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে।

বাসু-সাহেব বলেন, স্পষ্ট মনে আছে? বেশ, দেখুন তো এই লোকটা কিনা?

বুক পকেট থেকে ভাঁজ-করা একখণ্ড কাগজ বার করে দেখান।

ইয়াকুব দর্শনমাত্র চিনে ফেল্ল, জী হাঁ হুজুর। এই তো সেই লোক!

তারপর এদিক ওদিক দেখে নিয়ে প্রশ্ন করে, লোকটা কি ফেরারী আসামী? কাগজে ওর ছবি ছাপা হয়েছে কেন?

বাসু বলেন, ইয়াকুব-মিঞা, আমি যে দোকানে এসে আপনাকে এই ছবি দেখিয়েছি, এতসব প্রশ্ন করেছি, তা স্রেফ ভুলে যান। তৃতীয় ব্যক্তি জানতে পারলে থানা-পুলিসের হাঙ্গামায় পড়ে যাবেন।

ইয়াকুব ছা-পোষা মানুষ। দু-হাত কানে ঠেকিয়ে বললে, আমি কাউকে কিছু বলব না হুজুর।

দোকান থেকে বেরিয়ে এসে কৌশিক বলল, আপনি কেমন করে আন্দাজ করলেন মহাদেও প্রসাদ ওটা নিজেই কিনেছেন?

—দেখলে না, সূরযের স্টেটমেন্ট অনুযায়ী দোসরা শুক্রবার দুপুরে মহাদেও শ্রীনগরে ছিলেন। আর ক্রেতার যে বর্ণনা লোকটা দিল তার সঙ্গে মহাদেওর যথেষ্ট সাদৃশ্য।

কৌশিক আবার বলে—আমার যে বিশ্বাসই হচ্ছে না। মহাদেও প্রসাদ নিজেই ঐ ময়নাটা কিনেছেন? তাহলে আসল ‘মুন্না’ কোথায় গেল? আর কেনই বা তিনি নিজে ময়নাটা বদলে দিলেন?

বাসু বললেন, দ্যাটস্ দ্য মিলিয়ান-ডলার কোশ্চেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *