উলের কাঁটা – ১০

দশ

সেশনস্ চলছে। জাস্টিস্ লাল দশটার সময় আদালতে যাবেন। আদালত অবশ্য ঠিক পাশের ঘরখানাই। এখানা ওঁর চেম্বার। ঠিক সাড়ে নটার সময় বাসু-সাহেবকে নিয়ে শর্মাজী ওঁর ঘরে এলেন। জাস্টিস লাল বাসুরই সমবয়সী, দু-এক বছরের ছোট-বড় হতে পারেন। একমাথা ধবধবে চুল, গোঁফদাড়ি কামানো। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েননি। চোখে একটা মোটা ফ্রেমের চশমা। বাসু-সাহেবের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ডিলাইটেড টু মীট য়ু মিস্টার বাসু। আপনার সব কীর্তি-কাহিনীই আমার জানা, চাক্ষুষ কখনও দেখিনি এই যা।

বাসু আন্তরিকতার সঙ্গে করমর্দন করে বলেন, স্যার, আপনার বিরুদ্ধে আমি ডাকাতির অভিযোগ আব…

—মানে?

—এখানে এসে প্রথমেই আপনাকে যে-কথাগুলো বল্‌ ভেবে এসেছিলাম, তা আপনি ছিনিয়ে নিয়ে বলে ফেললেন।

হো-হো করে হেসে উঠলেন লাল।

বাসু যোগ করেন, আইন এবং আদালত বিষয়ে আপনার মৌলিক চিন্তা আমাদের মুগ্ধ করেছে; বিশেষ করে শেষ বইখানা : অ্যান অ্যানালিসিস অব্ জুডিশিয়ারি।

—যাক, ওটা পড়া আছে আপনার। তাহলে অল্প কথায় সারা যাবে। দশটায় আমার একটা কেস আছে। তাই সংক্ষেপে সারতে চাই। আপনাকে ডেকেছি; একটা অ্যাকাডেমিক ডিসকাশানে; মানে আইন-আদালত সম্বন্ধে নৈর্ব্যক্তিক আলোচনায়। বস্তুত আমি একটা প্রস্তাব রাখব আপনার সামনে। আপনি গ্রহণ করতেও পারেন, বর্জন করতেও পারেন।

—বাসু বলেন, বলুন?

লাল বলেন, সময় কম। সরাসরি বিষয়বস্তুতে আসা যাক। আপনি আমার বইটা পড়েছেন। আপনি জানেন, আমি তাতে ভারতীয় জুডিশিয়ারির সমস্যাগুলি এবং তার সমাধানের বিষয় আলোচনা করেছি। যে কোনও আদালতে যান, দেখবেন মামলা পাঁচ-সাত-দশ বছর ধরে ঝুলে আছে! শুধু হিয়ারিঙ ডেট আর হিয়ারিঙ ডেট! অথচ বছরের 365 দিনের মধ্যে আদালতই সবচেয়ে বেশি দিন বন্ধ থাকে। কল-কারখানার কথা ছেড়ে দিন—স্কুল-কলেজ-সরকারী-বেসরকারী অফিসের তুলনায় কোর্টের ছুটি অনেক-অনেক বেশি। যদি প্রশ্ন করেন—কেন? জবাবে শুনবেন জজ সাহেবের বেশি বিশ্রামের দরকার। তাঁদের ল-পয়েন্টের পড়াশুনা করার সময় চাই। যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের তা চাই না। দ্বিতীয় কথা, এই গোটা কাঠামোটাকেই আমি আমার গ্রন্থে আক্রমণ করেছি। আপনার মনে আছে নিশ্চয়, শেষদিকে আমি বলেছি ‘পিপল্স্-কোর্ট বা গণ-আদালতের কথা। আমি বলেছিলাম, চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে বিচার-ব্যবস্থা ধীরে ধীরে দেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর আংশিক ভাবে ন্যস্ত করে ঐ পর্বতপ্রমাণ এরিয়ার কেসগুলো শেষ করা যায় কিনা। দেশে ‘পঞ্চায়েত-রাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—সেখানে আছেন দেশ-দশের আস্থাভাজন প্রতিনিধিরা। আমি প্রস্তাব রেখেছিলাম, সেইসব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে জুরির মাধ্যমে আমরা কিছুটা সুবিধা করতে পারি কিনা। আমার প্রস্তাবটা ছিল এই রকম :

বর্তমানে একশ্রেণীর ক্রিমিনাল কেসগুলোর প্রাথমিক বিচার হয় ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে। সেখানে ‘প্রাইমা-ফেসি’ কেস প্রতিষ্ঠিত হলে সেগুলি দায়রার সোপর্দ করা হয়। অর্থাৎ সেশনসে আসে। শুধুমাত্র কলকাতা আর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে হোমিসাইড কেসগুলোর বিচার হয় তিন ধাপে—প্রথমে করোনারের আদালত, তারপর ম্যাজিস্ট্রেটের এবং সবশেষে সেশন্‌সে। তারপর আপীল হলে তো হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট আছেই। কলকাতা বা মাদ্রাজ ছাড়া বোম্বাই বা দিল্লির মতো শহরেও করোনারের ব্যবস্থা নেই। যদি জানতে চাই, কেন? তাহলে জবাব শুনতে হবে ব্যবস্থাটা করা হয়েছিল 1861 সালে, যখন বোম্বাই জমজমাট হয়নি, দিল্লি রাজধানী ছিল না। আমি প্রস্তাব করেছিলাম, ভারতবর্ষের প্রতিটি রাজধানীতে করোনারের আদালত থাকবে এবং করোনার হবেন পঞ্চায়েতের নির্বাচিত কোনও ‘সভাধিপতি’। এটাই আমার প্রথম পর্যায়ের পিপল্স্-কোর্ট বা গণ-আদালত। সভাধিপতি-করোনার হোমিসাইড কেসগুলার প্রাথমিক শুনানী নিলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে কাজ অনেক সংক্ষেপ হয়ে যাবে। এ পরীক্ষা ফলপ্রসূ হলে আমরা দেখব ঐ ‘সভাধিপতি-করোনার’কে প্রাথমিক আইনের শর্ট-কোর্স দিয়ে তাঁদের ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া যায় কিনা। সেক্ষেত্রে ঐ করোনার আদালত থেকে কেস সরাসরি দায়রায় আসবে!

এ নিয়ে আমি সুপ্রীম কোর্টের কয়েকজন জাজের সঙ্গে এবং অ্যাডভোকেট জেনারেলের সঙ্গে কথা বলি। ওঁরা পরীক্ষামূলকভাবে একটি কেস করতে সম্মত হয়েছেন। বিশেষ আদেশনামা জারী করে আমাকেই সেই পরীক্ষাটি করতে বলেছেন। ঐ বিচারের প্রসিডিংস্ আদ্যন্ত টেপ করা হবে, যেটা শুনে সুপ্রীম কোর্ট বিধান দেবেন এজাতীয় বিচারের সম্ভাবনা কতখানি। মুশকিল হচ্ছে এই যে, সুপ্রীম কোর্টের বিশেষ অনুমতি পেলেও আমি সেটা কার্যকরী করতে পারছিলাম না নানান কারণে। সে যাই হোক, এখন দেখছি একটি অপূর্ব সুযোগ এসেছে। লেট মহাদেও প্রসাদ খান্নার খুনের মামলাটা। মহাদেও প্রসাদ এক্স-এম. পি.। স্বনামধন্য ব্যক্তি, সুতরাং এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কেস। এদিকে দেখা যাচ্ছে, ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এই কেসটার জন্য সি. বি. আই. থেকে একজন বিশেষজ্ঞকে এনেছেন। ফলে এই কেসটা একটা সর্বভারতীয় রূপ নিতে চলেছে। তারপর যখন শুনলাম ডিফেন্স কাউন্সেল হচ্ছেন ‘পেরী মেসন অফ দ্য ইস্ট’ তখনই আমি মনস্থির করেছি। এখন আপনি বলুন, আপনি কি এ বিষয়ে আমার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন?

বাসু বলেন, আমি এখনও ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। ঐ সভাধিপতিকে কি ফার্স্টক্লাস ম্যাজিস্ট্রেটের পদাধিকার-বলে-প্রাপ্ত অধিকার দেওয়া হবে? জুরি থাকবে কি? ক্রস এক্সামিনেশন, রি-ডাইরেক্ট, ইত্যাদি থাকবে? বিচারক যেহেতু আইন জানেন না, তাই বে-আইনি কিছু হলে তা কে দেখবে?

—না। দেড় দু’শ বছর আগে যেভাবে বিচার হত সেভাবেই হবে। বাদী ও প্রতিবাদী তাঁদের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে ইচ্ছামত সাক্ষীদের সমন ধরাবেন। করোনার আদালতে যেভাবে বিচার হয় সেভাবেই হবে। আর একটা কথা—আমি নিজে উপস্থিত থাকব। বিচারক অনভিজ্ঞতার জন্য বে-আইনি কিছু করলে আমি সম্পূর্ণ বিচারটাকেই বিধিবহির্ভূত বলে পুনর্বিচারের আয়োজন করব। সে অধিকারও আমাকে দেওয়া হয়েছে।

বাসু বললেন, সে-ক্ষেত্রে আমি সম্মত।

—থ্যাঙ্কু মিস্টার বাসু।

বাসু বলেন, আমি ভেবেছিলাম লেট মহাদেও প্রসাদের কেসটার বিষয়েই বুঝি আপনি কিছু আলোচনা করতে চান।

লাল হেসে বলেন, তাই কি পারি? ওটা যে সাবজুডিস!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *