উলের কাঁটা – ৭

সাত

সমস্ত দিনের ধকল তো বড় কম যায়নি। রাত প্রায় দশটার সময় ক্লান্ত শরীরে হাউসবোটে ফিরে এসে বাসু-সাহেব কিন্তু আবার একটি নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন। হাউসবোটের ড্রইংরুমে বসে আছেন এস. ডি. ও. শর্মা, সতীশ বর্মন, যোগীন্দর সিং আর একজন অফিসার। আর কৌশিক।

বাসু ওঁদের দেখে বললেন, গুড-ইভনিং জেন্টলমেন। আপনারা আমার প্রতীক্ষাতেই আছেন মনে হচ্ছে। কী ব্যাপার? জরুরী কিছু?

অপরিচিত ভদ্রলোকটি নিজে থেকেই আত্মপরিচয় দেন—আমার নাম প্রকাশ সাক্‌সেনা, আমি হচ্ছি এখানকার পাবলিক প্রসিকিউটার।

বাসু করমর্দনের জন্য হাতটা বাড়িয়ে বললেন, গ্ল্যাড টু নো য়ু।

—আপনার সঙ্গে আমাদের কিছু জরুরী কথা আছে।

–সেটা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। কী বিষয়ে?

—রমা দাসগুপ্তার বিষয়ে।

—তার বিষয়ে কী কথা?

—সে বর্তমানে কোথায় আছে?

—তা তো জানি না।

সতীশ বর্মন শর্মাজীর দিকে ফিরে বললে, হল? আমি বলিনি?

বাসু ধীরেসুস্থে সোফায় বসে বললেন, ব্যাপারটা কী?

প্রকাশ সাক্‌সেনা বললেন, আমি জানতে চাই রমা দাসগুপ্তাকে আপনি কোথায় নামিয়ে দিয়ে এলেন?

—আমি তাকে কোথাও নামিয়ে দিইনি।

—আমাদের খবর অন্য রকম।

—নাকি?

—আপনি অস্বীকার করতে পারেন যে, আজ সন্ধ্যা ছ’টার সময় আপনার সঙ্গে মেয়েটার দেখা হয়নি? শ্রীনগর বাস স্ট্যান্ডে?

—না। অস্বীকার করব কেন? দেখা হয়েছিল, কথাবার্তাও হয়েছিল। তারপর সে কোথায় গেছে জানি না।

সতীশ বর্মন একটি স্বগতোক্তি করে, সেই চিরাচরিত খেলা!

তারপর শর্মাজীর দিকে ফিরে বলে, গরিবের কথা বাসি না হলে তো চৈতন্য হয় না। এখন দেখছেন তো?

শর্মাজী এবার কথোপকথনে যোগ দেন। বলেন, মিস্টার বাসু, আপনি তো এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে সহযোগিতাই করছিলেন—

—এখনও করছি। বেশ, আপনাদের খোলাখুলিই জানাচ্ছি—শুধু সূরযপ্রসাদ নয়, রমাও আমার ক্লায়েন্ট। আমি মহাদেও প্রসাদ খান্নার মৃত্যু রহস্যটা সমাধান করতে পেরেছি। এবং সেটা আমার নিজের পদ্ধতিতে করব। আপনারা যেমন আপনাদের পদ্ধতিতে করছেন

প্রকাশ বললে, আমরা আপনার সেই ক্লায়েন্ট রমা দাসগুপ্তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

—খুব ভালো কথা। যান, তার সঙ্গে কথাবার্তা বলুন!

—সে কোথায়?

বাসু বলেন, এক কথা কতবার বলব মশাই? আমি জানি না সে কোথায়।

প্রকাশ সাক্‌সেনা উদ্ধত ভঙ্গিতে বললে, লুক হিয়ার মিস্টার বাসু! আপনি অস্বীকার করলে আমরা আপনাকে ‘অ্যাক্সেসারি’র চার্জে ফেলতে পারি, সেটা খেয়াল করে দেখেছেন?

বাসু বলেন, লুক হিয়ার মিস্টার পি. পি.! আপনি আমার বিরুদ্ধে কী চার্জ আনবেন তাতে আমার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। তবে আইনের প্রসঙ্গ যদি তোলেন তবে ঐ ধারাটা আবার আপনাকে দেখতে বলব। যতক্ষণ না আমার ক্লায়েন্টকে হত্যাকারীরূপে আপনি চিহ্নিত করছেন, ততক্ষণ আমার বিরুদ্ধে ও জাতীয় চার্জ উঠতেই পারে না। আপনারা কি বলতে চান রমা দাসগুপ্তাই খুনটা করেছে?

—প্রকাশ দৃপ্তস্বরে বলেন, হ্যাঁ তাই! এবার?

শর্মাজী বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, ওয়েট এ মিনিট সাক্‌সেনা।—তারপর বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বলেন, আমার ধারণা হয়েছিল, আপনি আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন; কিন্তু

বাধা দিয়ে বাসু বলেন, তাই তো করতে চাই মিস্টার শর্মা! একই লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে চাই—মহাদেও প্রসাদ খান্নার হত্যাকারীকে খুঁজে বার করা। কিন্তু পথটা বিভিন্ন হয়ে পড়ছে—আপনারা এক পথে চলেছেন, আমি ভিন্ন পথে।

শর্মা বলেন, তাতে আমার আপত্তি হত না, যদি আপনি আমাদের পথে বাধার সৃষ্টি না করতেন। আপনি তাই করছেন এখন

সতীশ বর্মন বলে ওঠে, উনি চিরটা কাল তাই করে এসেছেন।

বাসু সে কথায় কান না দিয়ে শর্মাজীকেই উদ্দেশ করে বলেন, তার কারণ চিরটা কাল দেখে আসছি পুলিস নিরপরাধীকে কাঠগড়ায় তুলে আসছে।

শর্মাজী বলে ওঠেন, আপনি জানেন মার্ডার-ওয়েপনটা কার তা আমরা খুঁজে বার করেছি?

—জানি, স্টেট ব্যাঙ্কের দারোয়ান মন-বাহাদুরের। দেশে যাবার সময় সে সেটা ঐ রমা দাসগুপ্তার কাছে গচ্ছিত রেখে যায়। শুধু তাই নয়, ঐ রমা দাসগুপ্তার বাড়িতেই আছে ‘মুন্না’, যাকে খুঁজছেন আপনারা।

শর্মাজী অবাক হয়ে বলেন, আপনি সে কথাও জানেন?

—এবং জানি ঐ ময়নাটা যে অদ্ভুত ‘বোল’টা পড়ে; ‘রমা! মৎ মারো… পিস্তল নামাও… দ্রুম… হায় রাম।’

প্রকাশ সাকসেনা গম্ভীর হয়ে বলেন, মিস্টার বাসু, এর পরেও যদি আপনি আমাদের না জানান সেই মেয়েটি কোথায় আছে, তাহলে আপনার বিরুদ্ধে আমি ‘অ্যাক্সেসারি’র চার্জ আনতে বাধ্য হব।

বাসু বললেন, এ-কথা আপনি আগেও বলেছেন একবার। আপনি যা খুশী করতে পারেন।

শর্মাও গম্ভীর হয়ে বললেন, আপনার স্ট্যান্ডটা কী? যেহেতু রমা দাসগুপ্তা আপনার ক্লায়েন্ট তাই আপনি তাকে লুকিয়ে রাখছেন, নাকি আপনি সত্যিই জানেন না সে কোথায় আছে?

—আমি সত্যিই জানি না সে কোথায় আছে।

সতীশ বর্মন বললে, আমার মনে হয় মিস্টার বাসুর বিরুদ্ধে আমরা চার্জ ফ্রেম করতে পারি।

শর্মাজী বললেন, না। আমি বিশ্বাস করি উনি সত্যি কথাই বলছেন—উনি জানেন না মেয়েটি বর্তমানে কোথায় আছে।

বাসু বলেন, থ্যাঙ্কু শর্মাজী। তাহলে আপনাকে আরও একটা সংবাদ জানাই। গঙ্গারামজী কী জন্য দিল্লি গিয়েছিলেন তা কি আপনাকে জানিয়েছেন?

—হ্যাঁ। কেন বলুন তো?

—একথা কি আপনি খেয়াল করে দেখেছেন যে, মিসেস খান্না ছয় তারিখে স্বয়ং আদালতে উপস্থিত ছিলেন না?

শর্মাজীর ভ্রু কুঞ্চন হল। বললেন, ঠিক কী বলতে চাইছেন বলুন তো?

—এবং মিসেস্ খান্না ছয় তারিখে মর্নিং ফ্লাইটে শ্রীনগরে এসে থাকতে পারেন?

সতীশ বর্মন বাধা দিয়ে বলে, আমরা সে খোঁজ নিয়েছি। প্যাসেঞ্জার লিস্টে মিসেস খান্নার নাম নেই—

বাসু বলেন, তাঁর নাম সাত বা আট তারিখের লিস্টেও নেই। সুতরাং আমরা জানি না ছয় তারিখের টিকিটখানা তিনি স্বনামে বুক করেছিলেন কিনা। এবং মৃত মহাদেওপ্রসাদ তাঁর স্ত্রীকে ‘সুরমা’ বলে ডাকতেন, না, শুধু ‘রমা’ বলে ডাকতেন।

সতীশ বর্মন বলে ওঠে, সেই এক প্যাচ! নিজের ক্লায়েন্টকে বাঁচাতে আর কোন শিখণ্ডীকে পুলিসের সামনে মেলে ধরা।

শর্মাজী গম্ভীর স্বরে বললেন, ধন্যবাদ। সবগুলো তথ্যই জানতাম। শেষেরটা ছাড়া। আচ্ছা চলি, গুড নাইট!

ওঁরা চলে যেতেই বাসু কৌশিককে বলেন, এখন সূরযপ্রসাদকে একটা ফোন কর। কাল ভোর চারটের সময় গাড়িটা আমার চাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *