দুই
পাহাড়ী পাকদণ্ডী পথ দিয়ে অ্যাম্বাসাডার গাড়িটা বিসর্পিল পথে ক্রমশ উপরে উঠছে। পিছনের সীটে বসেছেন রানু আর সুজাতা, ড্রাইভারের পাশে বাসু-সাহেব। খোদাবক্স দুটি বড় টিফিন-ক্যারিয়ারে বৈকালিক জলযোগ এবং বড় ফ্লাক্সে কফি দিয়েছে। কোকরনাগ থেকে আচ্চাবলের দিকে যে পাকা রাজপথটা গিয়েছে সেই পথেই কোকরনাগ থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে একটা কাঁচা সড়ক। পীচ নেই বটে, তবে সব রকম গাড়িই চলে। এ পথটা ঘুরে গিয়ে মিশেছে পহেলগাঁও। ঐ পথের ধারে ‘লীডার’ নদীর কিনারে ট্রাউট-প্যারাডাইস’। কোকরনাগ এবং পহেলগাঁওয়ের মাঝামাঝি দূরত্বে। ড্রাইভার কিলোমিটারের হিসাব এড়িয়ে জানালো পঁচিশ মিনিট ড্রাইভিং দূরত্বে। এ-পথে দিনে একখানি বাস যায়, একখানি ফেরে। তবে ট্রাউট সিজনে—সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। প্রাইভেট গাড়ি এবং ট্যাক্সিও।
কোকরনাগ ছাড়াবার পরেই সমস্ত লীডার উপত্যকাটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। রানী দেবী বললেন, তোমার যদি তাড়া না থাকত, তাহলে আমরা এখানে একটু বসতাম। কিন্তু তুমি তো—
কথাটা শেষ হল না। বাসু-সাহেব ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন গাড়িটা থামাতে। রানী দেবীর দিকে ফিরে বললেন, কলা বেচতে এসেছি রথ দেখব না কেন? দু-দশ মিনিট দেরী হলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। নাম সুজাতা।
গাড়িটা পথের পাশে দাঁড় করিয়ে সুজাতা আর বাসু-সাহেব নামলেন। রানী দেবীর নামার উপায় নেই। হুইল চেয়ারটা আনা হয়নি। উনি গাড়ির কাচটা নামিয়ে দিয়ে কলস্রোতা ‘লীডার’:নদীর উপলবন্ধুর নৃত্যচ্ছন্দ দুচোখ ভরে দেখতে থাকেন। বাসু-সাহেব হঠাৎ বললেন, দেখি সুজাতা বাইনোকুলারটা দাও তো। ওই নিচে যে গাড়িটা আসছে, মনে হচ্ছে ওটা পুলিস-ভ্যান। নয়?
সুজাতা যন্ত্রটা ওঁর হাতে দেয়। দেখে নিয়ে বাসু-সাহেব বললেন, হ্যাঁ, যা ভেবেছি ঠিক তাই। যোগীন্দর সিং সেই সি. বি. আই.য়ের অফিসারটিকে নিয়ে আসছে।
অনতিবিলম্বে বিসর্পিল পথে পাক খেতে খেতে গাড়িটা এসে উপনীত হল। ওঁদের অতিক্রম করে এগিয়ে গেল না কিন্তু। একটু দূরে গিয়েই থামল। গাড়ি থেকে নেমে এলেন তিনজন। পুলিসের পোশাকে থানা অফিসার যোগীন্দর সিংকে চিনতে অসুবিধা হল না—আকালি শিখ তিনি—গোঁফ-দাড়ি-পাগড়ি- কড়ায় তিনি চিহ্নিত। অপর দুজনেই স্যুট পরেছেন। একজনকে হঠাৎ চিনতে পারলেন বাসু-সাহেব। সতীশ বর্মন! অনেকবার অনেক কেস-এ দুজনের মোলাকাৎ হয়েছে। সতীশ হাড়ে হাড়ে চেনে বাসু-সাহেবকে।
সতীশ করমর্দনের জন্য হাতটাও বাড়িয়ে দিল না, নমস্কারও করল না। বিস্ময় বিস্ফারিত চক্ষে শুধু বলল, আপনি? এখানে? কী ব্যাপার?
বাসু হেসে বললেন, আশ্চর্য কাকতালীয় ঘটনা। ঠিক ঐ প্রশ্নটাই যে আমি পেশ করতে চাই : আপনি? এখানে? কী ব্যাপার?
সতীশ বলল, আমি এখন ডেপুটেশানে সি. বি. আই.-তে আছি। একটা তদন্তের ব্যাপারে এসেছি। কিন্তু আপনি? ছুটিতে?
বাসু তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অপর দুজনের উদ্দেশে বললেন, আমার নাম পি কে. বাসু, আপনাকে অবশ্য আমি আন্দাজে চিনতে পারছি যোগীন্দর সিংজী; কিন্তু বর্মন তৎক্ষণাৎ নিজের ত্রুটি সংশোধন করে বলে, আয়াম সরি, আমারই ইন্ট্রোডিউস করে দেবার কথা। হ্যাঁ, উনি মিস্টার যোগীন্দর সিং, ও. সি. পহেলগাঁও; ইনি মিঃ জে. কে. শৰ্মা এখানকার সিভিল এস. ডি. ও.। আর ইনি মিস্টার পি. কে. বাসু. বার-অ্যাট-ল।
বাসু-সাহেব ওঁদের সঙ্গে করমর্দন করলেন। বর্মনের সঙ্গেও।
শর্মা বললেন, মিস্টার পি. কে. বাসু? ব্যারিস্টার? আপনিই কি…
বাসু-সাহেব ওঁকে মাঝপথে থামিয়ে বললেন, আর এ হচ্ছে সুজাতা, মিসেস সুজাতা মিত্র।
সুজাতা হাত তুলে সমবেত ভাবে সকলকে নমস্কার করল।
শর্মা তার অসমাপ্ত প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার পেশ করার পূর্বেই সতীশ বর্মন পুনরায় বলে, আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নটার জবাব দেননি। ছুটিতে?
এবারও বাসু-সাহেব সে প্রশ্নের জবাব দিলেন না। পকেট থেকে একটি খাম বার করে তার থেকে একখণ্ড কাগজ এগিয়ে দেন শর্মাজীর দিকে, যেন তাঁর অসমাপ্ত প্রশ্নের জবাব হিসাবেই।
শর্মা একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলেন, ঠিকই ধরেছি তাহলে।
—কী ওটা? দেখি দেখি—বর্মন কাগজখানা নিয়ে দেখে। বলে, সূরযপ্রসাদ আপনাকে নিয়োগ করছে?
—চিঠিটা কি তাই বলছে না?
—হুম্। কেন? কী চায় সে আপনার কাছে? কী বলেছে?
—চায়—দোষীর শাস্তি হ’ক। বলেছে—পুলিসের সঙ্গে যেন আমি সহযোগিতা করি।
কোথাও কিছু নেই অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে সতীশ বর্মন। কোনওরকমে হাসির দমক সামলে বলে, বাসু-সাহেব, আপনার এই ‘জোক’টা এ বছরের শ্রেষ্ঠ জোক। পি. কে. বাসু—বার-অ্যাট-ল—’দ্য প্যেরী ম্যাসন অব দ্য ঈস্ট’ পুলিসের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন। ভাবতেই আমার হাসি আসছে! এ যেন বামপন্থীরা দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে সহযোগিতা করছে! ওফ্।
আবার হাসির দমকে ভেঙে পড়ে বর্মন।
বাসু-সাহেব এস. ডি. ও. শর্মা সাহেবের দিকে ফিরে বলেন, যেহেতু কোন ক্রিমিনাল ল’ইয়ার নির্দোষ অভিযুক্তের হয়ে সওয়াল করে তাই সে আরক্ষাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করতে পারবে না?
বর্মন হাসি থামিয়ে বলে, মায়ের কাছে আর মাসির গপ্পো শোনাবেন না ব্যারিস্টার-সাহেব। আপনি আজীবন পুলিসের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন! যাননি?
বাসু বললেন, বরং উল্টোটাই। পুলিসের কাজ প্রকৃত অপরাধীকে ধরা। সে কাজে আমি আজীবন পুলিসের সঙ্গে সহযোগিতা করে গেছি। করিনি?
—সেটাকে সহযোগিতা বলে না। আপনি শুধু আপনার ‘ক্লায়েন্টদের নির্দোষ প্রমাণ করে গেছেন। অস্বীকার করতে পারেন?
বাসু হেসে বলেন, কী আশ্চর্য! তার জন্য কি আমি দায়ী? আপনারা যে ক্রমাগত নিরপরাধীদের ধরে ধরে এনে কাঠগড়ায় তুলেছেন!
সতীশ বর্মন জবাবে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল; কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে শর্মা বলে ওঠেন, এনাফ্ অব ইট। শুনুন আপনারা। এ নিয়ে ঝগড়া করার কোনও মানে হয় না। আমি এই সাবডিভিশনের এস. ডি. ও.। কালেকটারের নির্দেশে আমি যাবতীয় ব্যবস্থা করছি। হ্যাঁ, স্বীকার করছি—ব্যাপারটা এমনই রহস্যময় যে, এখানকার স্থানীয় পুলিস প্রকৃত ‘এক্সপার্ট’দের সাহায্য চায়। কালেকটার-সাহেব সি. বি. আই.-এর কাছে আবেদন করেছিলেন—বর্মনসাহেব স্বয়ং এসেছেন, তাতে আমরা আশ্বস্ত বোধ করছি। দেখা যাচ্ছে—অ্যাগ্রিভড পার্টি, আই মীন, নিহত মহাদেও প্রসাদের পুত্র এঁকে নিয়োগ করেছেন এ রহস্যজাল ভেদ করতে। মিস্টার পি. কে. বাসুকে যদিও আজ আমি প্রথম চাক্ষুষ দেখলাম, কিন্তু ওঁর অনেক কীর্তি-কাহিনী আমার জানা। এ-ক্ষেত্রে কালেক্টারের তরফে আমি বলব, আমরা তাঁকে সম্পূর্ণ সুযোগ দিতে চাই—তাঁর নিজস্ব কায়দায় সমাধানে পৌঁছাতে। আমি তো বুঝি—যদি কোনও আইনজীবী নিরপরাধীকে নির্দোষ প্রমাণ করে প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বার করেন, তবে তিনি সমাজের উপকারই করেন। মিস্টার বাসু, আপনাকে সর্বতোভাবে আমরা সাহায্য করব।
সতীশ বর্মন গুম খেয়ে গেল। তিক্ত হাসির সঙ্গে ব্যঙ্গ মিশিয়ে বলে, ঠিক আছে মিস্টার শর্মা। এটা আপনারই কেত্তনের আসর—আপনিই মূল-গায়েন। যদি খ্যামটার সুরে আসর জমাতে চান, সেই সুরেই কেত্তন গাইব!
শর্মার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। কথাটা চাপা দিতে বাসু-সাহেব শর্মাকে বলেন, আপনার গাড়ির পিছন পিছনই আসছি আমি। আপনি কি লগ্-কেবিনটা চেনেন?
জবাব দিলেন যোগীন্দর সিং। বলেন, আসুন আপনি। আমি ভাল রকমই চিনি। কাল প্রায় সারাটা দিনই ওখানে ছিলাম আমি।
বাসু প্রশ্ন করেন, মৃতদেহ আবিষ্কারের পরে ঘরে কি বেশি কিছু নাড়াচাড়া করা হয়েছে? —কিছুমাত্র না। আমরা শুধু মৃতদেহটা সরিয়ে নিয়ে গিয়েছি, আর পিস্তলটা। না ভুল বললাম—ময়না পাখিটাকেও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, আর মাছের পলোটা। পচে দুর্গন্ধ উঠছিল তা থেকে। যাই হোক, চলুন। আলো থাকতে থাকতে সব কিছু সারতে পারলেই ভালো।
আগু-পিছু দুখানি গাড়ি রওনা দিল।
মিনিট পনেরো পাহাড়ী পথে ড্রাইভ করার পর সামনের গাড়ির ডান দিকের ব্যাক-লাইটটা রক্তাভ এক-চোখে পিটপিট করে জানান দিল এবার ডাইনে মোড় নিতে হবে। পীচের সড়ক ছেড়ে পাথর-বাঁধানো কাঁচা রাস্তায়। দু-ধারে ঘন পাইনের গাছ কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে বনপথের উপর ঝুঁকে পড়েছে। ফলে বনপথ পাইন ফলে আকীর্ণ। মাঝে মাঝে দু-একটা কাঠের বাড়ি। লীডার নদীকে গাড়িতে বসে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তার শব্দ শোনা যাচ্ছে। একটা সাইন-বোর্ড : ‘ট্রাউট প্যারাডাইস’–তার তলায় ছোট হরফে কী যেন লেখা, বোধ হয় বিনা অনুমতিতে মাছ ধরা যে বে-আইনী তারই বিজ্ঞপ্তি। দ্রুতগতিতে গাড়িটা অতিক্রম করায় বিজ্ঞপ্তিটা পড়া গেল না। একটু পরেই সামনের গাড়িটা থামল। আগু-পিছু দুখানি গাড়ি পার্ক করা হল। সামনের গাড়ির আরোহীরা নামলেন। বাসু-সাহেবও।
যোগীন্দর সিং এগিয়ে এসে বললেন, বাকি পথটুকু হেঁটে যেতে হবে। বেশিদূর নয়, তিন-চার শ’ গজ, ঐ দেখা যাচ্ছে গাছের ফাঁক দিয়ে।
রানী দেবী বাইনোকুলারটা তুলে নিয়ে দেখলেন। পাইনকাঠের লগ্-কেবিনটা প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে গেছে। মনে হয় না ওটা মানুষের তৈরি। যেন পাইন গাছগুলোর মতই ওর শিকড় গাড়া আছে উপলবন্ধুর মাটির গভীরে। একটা অদ্ভুত বুনো গন্ধ।
যোগীন্দর সিং বললেন, ওঁরা বরং এখানেই অপেক্ষা করুন আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন।
চারজনে পাইনফলের কার্পেট-বিছানো পথে অল্প কিছুক্ষণ হাঁটার পরে উপনীত হলেন লগ্-কেবিনটার দ্বারদেশে। একজন কনস্টেব্ল বসেছিল ঐ কুটিরের বারান্দায়। উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম করল।
যোগীন্দর বললেন, সব্ ঠিক হ্যায় না বাহাদুর?
লোকটা বলে, জী সাব!—পকেট থেকে চাবি বার করে দরজা খুলে দিল।
শর্মাজী বলেন, আসুন আপনারা।
সতীশ বর্মন ছিল ঠিক পিছনেই। দরজাটা আগলে বলে, দেখুন শর্মাজী, প্রয়োজনের বেশি আমরা ঘরটার ভিতরে থাকব না। হয়তো অনেক কিছু ‘ব্লু’ এখনও ছড়ানো আছে ঘরটার ভিতর। আনাড়ি হাতে আপনারা সব তছনছ করে দেবেন না। সবার আগে বলুন—ফিঙ্গারপ্রিন্ট কিছু পাওয়া গেছে?
যোগীন্দর বলেন, হ্যাঁ অনেকগুলি। অধিকাংশই মহাদেও প্রসাদের। মৃতদেহ অপসারণের আগে অনেকগুলি ফটোও নেওয়া হয়েছে। শর্মাজী যা বললেন—অর্থাৎ মৃতদেহ, পিস্তল, ময়না ও পচা মাছ ছাড়া এ ঘর থেকে আর কিছুই অপসারিত হয়নি। যেখানে যা ছিল তাই আছে।
সতীশ বর্মন গম্ভীর হয়ে বলেন, দ্যাটস্ গুড। আমি বলি কি শর্মাজী—প্রথমে মিস্টার বাসুকে ঘরটা পরীক্ষা করতে দিন। কোনও কিছু না ছুঁয়ে উনি সব কিছু দেখে নিন। আমরা এই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকব। ওঁর দেখা হয়ে গেলে উনি চলে যাবেন। আমরা তারপর তদন্ত শুরু করব।
শর্মাজী বলেন, কেন?
—কারণ উনি যতক্ষণ উপস্থিত আছেন, আমরা ততক্ষণ তদন্ত করতে পারব না। শর্মাজীর ভ্রূকুঞ্চন আরও পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। বলেন, তার কারণটাই তো আমি জানতে চাইছি। কেন?
সতীশ বর্মনও একটু রুক্ষস্বরে বলে, সেটাই তো আমি প্রথম থেকে আপনাকে বোঝাবার চেষ্টা করছি। মিস্টার বাসু হচ্ছেন ক্রিমিনাল ল’ইয়ার। ওঁর উদ্দেশ্য একটাই—আমরা আততায়ীকে চিহ্নিত করা মাত্র উনি তার পক্ষ অবলম্বন করবেন। উঠে পড়ে লেগে যাবেন তাকে খালাশ করাতে। আমরা তদন্ত করে যেসব সূত্র আবিষ্কার করব সেগুলি আগেভাগে জানা থাকলে উনি আদালতে ততই সুবিধা পাবেন। ক্রস-এগ্জামিনেশানে আমাদের সাক্ষীদের উনি নয়-ছয় করে ছাড়বেন। আপনি ওঁকে চেনেন না শর্মাজী, আমি ওঁকে হাড়ে হাড়ে চিনি।
শর্মাজী ঘুরে দাঁড়ালেন। স্পষ্টভাবে বললেন, মিস্টার বর্মন, আমি খোলা কথার মানুষ, এবং সোজা পথে চলতে ভালবাসি। প্রথম কথা, এখানে আপনি, আমি এবং মিস্টার বাসু তিনজনেই বাহুল্য…
—বাহুল্য? মানে? রুখে ওঠে বর্মন।
—ভেবে দেখুন। এটা নিতান্তই একটা খুনের কেস। যত রহস্যজনকই হোক সেটা একটা ‘মার্ডার কেস’ ছাড়া কিছু নয়। এখানে স্বাভাবিকভাবে শুধু যোগীন্দর সিংজীরই তদন্ত করার কথা। কিন্তু যেহেতু মৃত খান্নাজীর একটা রাজনৈতিক পটভূমি আছে তাই সিভিল এস. ডি. ও.-কে এখানে আসতে হয়েছে, দিল্লি থেকে আপনি এসেছেন এবং মৃত ব্যক্তির পুত্রের তরফে একজন প্রখ্যাত আইনজীবী উপস্থিত হয়েছেন। এই হত্যারহস্য সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কোনও দায়রা আদালতে নেওয়া হলেও এ নিয়ে লোকসভায় ‘স্টার্ড কোশ্চেন’ উঠতে পারে। আমি চাই না, সেখানে মিস্টার বাসু এ-কথা বলবার সুযোগ পান যে, অথরিটি ওঁর সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেনি। আর দ্বিতীয় কথা, আপনি বললেন যে, আমরা যাকে অভিযুক্ত করব উনি ক্রস-এগজামিনেশনে প্রমাণ করবেন সে নিরপরাধী। এই বিষয়ে আমার একটিই বক্তব্য—আপনি এক্সপার্ট, আপনি দয়া করে এমন লোককেই অভিযুক্ত করুন যে-লোকটা সত্যিকারের অপরাধী।
সতীশ বর্মনের মুখটা লাল হয়ে উঠল।
বাসু তৎক্ষণাৎ বললেন, মেঝেতে ঐ যে চকের দাগ দেওয়া আছে এটাই বোধ হয় মৃতদেহের অবস্থানসূচক?
যোগীন্দর সিং বলে, জী হাঁ। মৃতদেহ অপসারণের আগে আমি মুর্দার আউটলাইনটা চক দিয়ে দাগিয়ে ছিলাম। আপনাদের সুবিধা হবে বলে আমি এই বাড়ির একটা নক্সাও তৈরি করেছি—চার-পাঁচ কপি অ্যামোনিয়া প্রিন্টও নিয়ে এসেছি। তাতে ক, খ, গ, ঘ ইত্যাদি লিখে বুঝিয়ে দিয়েছি হত্যামুহূর্তে কোন জিনিসটা কোথায় ছিল।
প্রত্যেককে সে এক কপি করে প্ল্যান দিয়ে দিল।
বাসু বলেন, হত্যামুহূর্তে নয়। বরং বলতে পারেন মৃতদেহ আবিষ্কার মুহূর্তে।
যোগীন্দর তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংশোধন করে, আজ্ঞে হ্যাঁ, তাই। এবং এ কথাও অনুমান করা যেতে পারে যে, হত্যামুহূর্তে না হলেও আততায়ী যখন ঘটনাস্থল ত্যাগ করে যায় তখন এই অবস্থা ছিল।
বাসু যোগীন্দরকে প্রশ্ন করেন, এটা কি আত্মহত্যার কেস হতে পারে?
—আমি তো মনে করি সেটা নিতান্ত অসম্ভব। প্রথম কথা, আত্মহত্যা করলে পিস্তলটা অত দূরে চলে যেতে পারে না। দ্বিতীয় কথা, পিস্তলে কোনও ফিঙ্গার-প্রিন্ট পাইনি আমরা। অথচ খান্নাজীর হাতে দস্তানা পরা ছিল না। আত্মহত্যা হলে খান্নাজীর আঙুলের ছাপ অনিবার্যভাবে পাওয়ার কথা।
বাসু বলেন, তাহলে ঐ সঙ্গে আরও একটি অনুসিদ্ধান্তে আসা যায় : হত্যাকারী এটাকে ‘আত্মহত্যার কেস’ বলে প্রতিষ্ঠা করতে চায়নি। সে যেন সোচ্চার ভঙ্গিতে বলে গেছে : ‘তোমরা শোন, এটা হত্যা!’
—কেন? এ কথা বলছেন কেন?—শর্মাজী জানতে চান।
—হত্যাকারী যদি পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে এটাকে আত্মহত্যার কেস বলে চালাতে চাইত তাহলে পিস্তলটা থেকে নিজের ফিঙ্গার-প্রিন্ট মুছে দিয়ে রুমাল-জড়ানো হাতে সেটা মৃত খান্নাজীর মুঠোয় ধরিয়ে দিত। নয় কি?
—ঠিক কথা। এদিক দিয়ে আমরা ভাবিনি। ধন্যবাদ মিস্টার বাসু।
—এবং হত্যাকারী চেয়েছিল পুলিস ঐ ‘মার্ডার—ওয়েপনটা’ খুঁজে পাক
সতীশ বর্মনের আর সহ্য হল না। সে হেসে ওঠে। বলে, হত্যাকারী শুধু চেয়েছে হত্যার সময়ে পিস্তলটা যে তার নিজের হাতে ছিল না এটাই প্রতিষ্ঠা করতে। সব চালাক-চতুর হত্যাকারীই তাই করে। রুমাল দিয়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট মুছে নিয়ে অকুস্থলেই পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলে যায়। ওটা তার পকেটে নিয়ে ঘোরা বিপদজনক। ক্রিমিনোলজি তাই বলে।
বাসু গম্ভীরভাবে বলেন, হবেও বা। হয়তো অপরাধ বিজ্ঞান তাই বলে।
যোগীন্দর নূতন প্রসঙ্গে আসে, ময়নার খাঁচাটা প্ল্যানে গ-চিহ্নিত অবস্থানে মেঝেতে রাখা ছিল। খাঁচার দরজাটা খোলা ছিল, যাতে পাখিটা ইচ্ছামত ঢুকতে বেরুতে পারে। যেহেতু জানলাগুলোয় মশক-নিবারণ জালতি দেওয়া ও দরজাগুলো বন্ধ তাই ময়নাটা পালাতে পারেনি। ওর খাঁচার ভিতর যথেষ্ট খাবার তখনও অভুক্ত ছিল, এবং বাথরুমের মগটা এঘরে এনে আধমগ জলও রাখা ছিল।
বাসু জানতে চান—কী খাবার ছিল খাঁচার ভিতর?
—খান ছয়েক মিইয়ে যাওয়া থিন-অ্যারারুট বিস্কুট এবং তারই ভাঙা টুকরো। বাসু পুনরায় প্রশ্ন করেন, খবরের কাগজে লিখেছে দেখলাম মৃত্যুর সময় ছয়ই সেপ্টেম্বর বেলা এগারোটা। এই সময়টা কীভাবে চিহ্নিত হল? অবশ্য এটা যদি পুলিসের ‘গোপন তথ্য’ হয়…
বাধা দিয়ে শর্মাজী বললেন, বিলক্ষণ। না, আপনি যখন সহযোগিতা করছেন তখন পুলিসের কোনও তথ্যই আপনার কাছে গোপন নয়—
সতীশ বর্মনকে দেখলে মনে হয় উনি বুঝি এইমাত্র একগ্লাস। চিরতার-জল খেয়েছেন। শর্মাজীর সেদিকে নজর নেই। তিনি বলে চলেন, মৎস্য এবং বন্যপ্রাণী মন্ত্রকের নির্দেশে এ বছর এই সাব্ডিভিশনে সিক্সথ্ সেপ্টেম্বর থেকে মাছ ধরার মরশুম শুরু হয়। মহাদেও খান্না—আপনি নিশ্চয় শুনেছেন, গত দুবছর ধরে প্রায় আধা-ভবঘুরের মত হিমালয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তাঁর এই চারিত্রিক পরিবর্তনের আগে থেকেই—আমার বিশ্বাস গত দশ-বারো বছর ধরেই তিনি এইখানে বাৎসরিক মৎস্যশিকারের উৎসবে যোগদান করে আসছেন। আগেভাগেই একটি কেবিন তিনি ‘বুক’ করেন, নির্জনে মাছ ধরেন, রেডিও শোনেন, ছবি আঁকেন, পাখি দেখেন এবং তারপর সভ্যজগতে ফিরে যান। অবশ্য গত দু-বছর ধরে তিনি সাধারণ মানুষের বেশে, আত্মাগোপন করে—
বাসু-সাহেব বাধা দিয়ে বলেন, সেসব আমি সূরযপ্রসাদের কাছে শুনেছি। কাগজেও পড়েছি। আপনি শুধু এ বছরের কথাই বলুন।
—এ বছর এখানে আসার আগে উনি গিয়েছিলেন অমরনাথে। সেই তীর্থে যাবার আগেই উনি ওঁর সেক্রেটারী গঙ্গারামজীকে একটি চিঠি লিখে জানান যে, উনি সোমবার, পাঁচই শ্রীনগরে আসবেন এবং কিছু জিনিসপত্র নিয়ে এখানকার লগ্-কেবিনে চলে আসবেন। যে কোনও কারণেই হোক প্রত্যাশিত সোমবারের বদলে, দিন-তিনেক আগে, শুক্রবার, দোসরা সেপ্টেম্বর সকালে তিনি শ্রীনগরে এসে পৌঁছান। গঙ্গারামজীকে তিনি বলেন, পহেলগাঁওয়ে তাঁর কী কাজ আছে। দু-একদিন সেখানে থেকে উনি মৎস্যশিকার মরশুমের উদ্বোধনের আগেই এই লগ্-কেবিনে চলে আসবেন। মোট কথা, উনি কিছু জামা-কাপড় ও ময়নাটাকে নিয়ে ঐ দোসরা তারিখেই শ্রীনগর থেকে রওনা হন। ইতিমধ্যে আরও একটা ব্যাপার হয়েছে। মহাদেও প্রসাদজী কী একটা জরুরী কাজে তাঁর সেক্রেটারীকে দিল্লিতে পাঠিয়ে দেন। লগ্-কেবিন থেকে তিনি ঐ মর্মে নির্দেশ দেন, এবং গঙ্গারামজী দিল্লি চলে যান।
—লগ্-কেবিন থেকে উনি কখন নির্দেশটা দিয়েছিলেন?
—গঙ্গারামজী সোমবার রাত আটটা নাগাদ টেলিফোন পান এবং পরদিন ছয় তারিখ সকালের প্লেন ধরে দিল্লি চলে যান।
—তার মানে মহাদেও খান্নাজী এই কেবিন থেকে সোমবার রাত আটটার সময় একটা টেলিফোন করেছিলেন?
—না, এই কেবিন থেকে নয়। খান্নাজী তাঁর সেক্রেটারীকে বলেন যে, কেবিনের টেলিফোনটা ‘ডেড’ হয়ে গেছে। তিনি অন্য জায়গা থেকে ফোন করছেন। কোথা থেকে তা তিনি বলেননি, গঙ্গারামও জিজ্ঞাসা করেনি। সেটা তখন নিতান্ত অবান্তর প্রশ্ন ছিল।
—আপনি এ বিষয়ে গঙ্গারামজীর সঙ্গে কথা বলেছেন?
হ্যাঁ। ট্রাঙ্ক-লাইনে। গঙ্গারামজী এখনও দিল্লিতেই আছেন। আজ তাঁর শ্রীনগরে আসার কথা। এলেই তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
—কী জাতের জরুরী কাজ নিয়ে গঙ্গারাম দিল্লি চলে যান তা বলেননি?
—না। টেলিফোনে শুধু বলেছিলেন ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরী, ব্যক্তিগত এবং গোপনীয়।
–গঙ্গারাম কি নিঃসন্দেহ যে, সোমবার পাঁচই সেপ্টেম্বর রাত আটটায় মহাদেওপ্রসাদই ফোন করেছিলেন? কেউ তাঁর কণ্ঠস্বর নকল করে …
বাসুকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে শর্মাজী বলেন, গঙ্গারামজী নিঃসন্দেহ। তিনি গত দশ বছর ধরে ঐ সেক্রেটারীর কাজ করছেন। অন্য কেউ খান্নাজীর কণ্ঠস্বর নকল করে ওঁকে ঠকাতে পারবে না। তাছাড়া যে বিষয়ে ওঁদের কথাবার্তা হয় সেটা নাকি অত্যন্ত গোপনীয়–তৃতীয় ব্যক্তির তা জানার কথা নয়।
বাসু বললেন, তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো খতিয়ে দেখা যাক। সোমবার পাঁচই সেপ্টেম্বর রাত আটটা পর্যন্ত খান্নাজী যে জীবিত ছিলেন তার প্রমাণ আছে। ভাল কথা, তারপর, অর্থাৎ সোমবার রাত্রি আটটার পর কি কেউ তাঁকে জীবিত অবস্থায় দেখেছে?
—না। ঐ সোমবার পাঁচই সেপ্টেম্বর রাত্রি আটটার পর থেকে বাকিটা অনুমাননির্ভর টেবিলের উপর একটা ঘড়ি ছিল। সেটা দুটো সাত মিনিটে দমের অভাবে থেমে গেছে। দেখা যাচ্ছে অ্যালার্ম-কাঁটাটা আছে সাড়ে পাঁচটায়। সেটারও দম ফুরিয়ে থেমেছে।
ঠিক ঐ সময়েই লগ্-কেবিনের টেলিফোনটা ঝঝন্ করে উঠল। যোগীন্দ্ৰ সিং ছিল টেবিলের কাছে। তুলে নিয়ে শুনল। টেলিফোনের কথা-মুখে চাপা দিয়ে বলল, মিস্টার বাসু—ইয়ে হ্যায় আপ্কে লিয়ে।
বাসু-সাহেব টেলিফোনটা নিয়ে সাড়া দিতেই ও-প্রান্ত থেকে ভেসে এল, আমি কৌশিক বলছি। লগ্-কেবিন থেকে আপনি কি এখন আমার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে পারবেন!
—না। অসুবিধা আছে।—বললেন বাসু।
—তাহলে এক-তরফা শুনে যান। সম্ভবত আমি হত্যাকারীকে খুঁজে পেয়েছি। শ্রীনগরে সেন্ট্রাল মার্কেটে একটা দোকান আছে, যেখানে পুষবার জন্য পাখি কিনতে পাওয়া যায়। দোকানের মালিক স্বীকার করেছে কিছুদিন আগে সে একজনকে পাহাড়ী ময়না বেচেছে। ক্রেতার চেহারাও ওর পরিষ্কার মনে আছে।
—ঠিক আছে। আর দ্বিতীয় কাজটা?
—উলের দোকান? অসংখ্য আছে। নাম ঠিকানার লিস্ট তৈরি করেছি।
—দ্যাটস্ ফাইন। পরে কথা হবে।
টেলিফোনটা স্বস্থানে বসিয়েই বাসু-সাহেবের নজর হল সতীশ বৰ্মন প্রতিটা কথা উদ্গ্রীব হয়ে শুনছিল। শর্মাজী কিন্তু ভ্রূক্ষেপই করলেন না, যেন তাঁর কোনও কৌতূহলই নেই। তিনি তৎক্ষণাৎ শুরু করেন, পুলিসে খবর পাওয়া মাত্র যোগীন্দর আমার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে-খান্নাজীর একটা পোলিটিক্যাল ইমেজ আছে, হয়তো সে জন্যই যোগীন্দর আমাকে জানায়। আমরা দুজনেই চলে আসি। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে দেখি…
বাসু-সাহেব বাধা দিয়ে বলেন, কবে? কখন?
—এগারো তারিখ, বেলা দশটায়। ঘরে ঢুকতেই একটা দুর্গন্ধ পেলাম। না, মৃতদেহ থেকে নয়, পচা মাছগুলো থেকে। সেগুলো বাক্সবন্দী করে থানায় পাঠিয়ে দিলাম। অনুসন্ধান করে পরে জানা গেছে ট্রাউট মাছগুলোর সমবেত ওজন দেড় কে. জি. অর্থাৎ দৈনিক যতটা মাছ ধরার অনুমতি আছে তার সমান। মাছগুলো কিন্তু কাদামাখা ছিল অর্থাৎ খান্নাজী সেগুলি ধুয়ে সাফা করার সময় পাননি। রান্নাঘরের সিংক-এ একটা প্লেটে প্রাতরাশের কিছু অভুক্ত অংশ ছিল—পাঁউরুটির টুকরো, ডিমের চিহ্ন। ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেটে দুটো ডিমের খোলাও ছিল। মৃতদেহের পরনে ছিল পায়জামা, ঊর্ধ্বাঙ্গে একটা পুরোহাতা শার্ট ও একটা হাফ-হাতা সোয়েটার। কোটটা টাঙানো ছিল ঐ চেয়ারের গায়ে। তার পকেটে হাত-দস্তানা ছিল একজোড়া। এ ছাড়া ছিল মানিব্যাগ, শ-তিনেক টাকা সমেত, রুমাল এবং সিগ্রেট-দেশলাই। দরজার পাশে একজোড়া গামবুট, কাদামাখা। ওপাশে দাঁড় করানো হুইল-ছিপ। খাটের নিচে ছিল স্যুটকেস। তালা খোলা। তাতে জামা-কাপড়, মুখ ধোওয়ার সরঞ্জাম, শেভিং সেট ছাড়াও ছিল নগদ সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা—একশ টাকার নোটে। একটা গোদরেজের নম্বরী চাবি।
বাসু বলেন, কিন্তু হত্যার সময়টা আপনারা কীভাবে নির্ধারণ করছেন?
শর্মাজী বলতে থাকেন, যোগীন্দরের ধারণা—এবং আমিও তাঁর সঙ্গে একমত—খান্নাজী হত হয়েছেন ছয়ই সেপ্টেম্বর বেলা এগারোটা নাগাদ। আমাদের যুক্তিটা এই রকম :
খান্নাজী পাঁচ তারিখ রাত্রি আটটা পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তার প্রমাণ আছে। দেখা যাচ্ছে ঘড়িতে অ্যালার্ম বেজেছে সকাল সাড়ে পাঁচটায়। তাহলে ধরে নিতে পারি, উনি খুব ভোরে উঠে পড়েন। তাড়াতাড়ি মুখহাত ধুয়ে নেন এবং একজোড়া পোচ তৈরি করে, রুটি টোস্ট করে এবং কফি বানিয়ে প্রাতরাশ সেরে নেন। ঘণ্টা-দেড়েক তাতেই কেটে যায়। সুতরাং সকাল প্রায় সাতটা নাগাদ উনি ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে বেরিয়ে যান। লক্ষণীয়, উনি এঁটো বাসন ধুয়ে যাননি—অর্থাৎ তাড়াতাড়িই বের হতে চেয়েছিলেন। তখনও মেছুড়েদের ভিড় হয়নি। ফলে বেলা দশটার মধ্যেই তিনি নির্দিষ্ট সীমারেখায় পৌঁছে যান এবং মাছ ধরায় ক্ষান্তি দেন। ঘরে ফিরে আসেন। লক্ষণীয়, মাছগুলি তিনি ধুয়ে রাখার সময় পান না। উনি বুট-জোড়া খুলে ফেলেন, কোটটাও খুলে চেয়ারে টাঙিয়ে দেন। প্যান্ট বদলে পাজামা পরেন। ঠিক এই সময়েই হঠাৎ হত্যাকারীর আবির্ভাব ঘটে এবং অনতিবিলম্বেই তিনি হত হন। তখন বেলা এগারোটা।
—কেন এগারোটা কেন? এমনও তো হতে পারে প্রাতরাশ তিনি করেছিলেন ক্রিম-ক্র্যাকার বিস্কুট—যার খোলা টিনটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে—এবং কফি দিয়ে। ফিরে এসেই ডিমের পোচ ও রুটি টোস্ট করে খান। দুপুরে বনের মধ্যে বসে কাড়বিড়ালীদের ছবি আঁকেন এবং বিকালে হত হন।
শর্মা বলেন, না দুপুর পার হয়নি। তার কারণটা এই—এই লগ্-কেবিনটা সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত অত্যন্ত ঠাণ্ডা থাকে। এগারোটা থেকে বিকাল তিনটা পর্যন্ত এ কেবিনের ছাদে সরাসরি রোদ পড়ে। করোগেট টিনের ছাদ। সেটা উত্তপ্ত হয়ে উঠলে ঘরটা বেশ গরম হয়ে যায়। বিকাল চারটে নাগাদ আবার বেশ ঠাণ্ডা হতে থাকে। রাত্রে তো খুবই ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এ জন্য ঘরে একটি ফায়ার-প্লেস আছে। ঐ দেখুন, তাতে কাঠ সাজানো রয়েছে। সুতরাং আমাদের সিদ্ধান্ত : ঘটনাটা বেলা সাড়ে দশটার পর ঘটে, যখন ঘরটা বেশ গরম। তাই কোট ও গরম প্যান্টটা খুলে রাখা হয়েছে। এবং ঘটনা তিনটার পরেও নয়। তাহলে কোটটা ওঁর গায়ে থাকত। আবার বেলা বারোটা থেকে দুটোর মধ্যে হলে হয়তো উনি সোয়েটারটাও খুলে ফেলতেন। সুতরাং মৃত্যুর সময়–হয় এগারোটা থেকে বারোটা অথবা বেলা তিনটে থেকে বিকাল চারটা। শেষোক্ত সম্ভাবনাটা এইজন্য বাদ দিচ্ছি যে, বিছানাটা দেখুন পরিপাটি করে পাতা আছে। সকালবেলা শয্যাত্যাগ করে তিনি যেমন পরিপাটি করে পেতে গিয়েছিলেন ঠিক তেমনই আছে। মধ্যাহ্ন আহার করলে তিনি নিশ্চয়ই বিছানাটায় একটু শুতেন। তাছাড়া ট্রাউট মাছগুলোও রান্না করে খেতেন।
বাসু বললেন, সুন্দর যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত। আচ্ছা ঐ ঘড়িটা দম দেবার পর কতক্ষণ চলে সেটা আপনারা পরীক্ষা করে দেখেছেন?
যোগীন্দর বলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, বত্রিশ ঘণ্টা। যেহেতু ওটা বন্ধ হয়েছে দুটো সাত মিনিটে তাই ধরে নেওয়া যায় যে শেষবার যখন দম দেওয়া হয়েছে তখন ঘড়িতে বেজেছিল ছয়টা-কুড়ি। সকালই হোক বা রাতই হোক।
বাসু বলেন, ধন্যবাদ, এবার আমি ঘরটা এক নজর দেখে নিয়েই বিদায় নেব।
ঘর, রান্নাঘর এবং বাথরুমটা দেখে ফিরে এসে উনি বললেন, রান্নাঘরে ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুটের একটা টিন, কফি, চিনি, কন্ডেন্সড্ মিল্ক, একটা জ্যামের শিশি আর কিছু টিল্ড খাবার ছাড়া যা আছে তা আনাজপাতি। এখান থেকে আর কোনও খাদ্যদ্রব্য কি অপসারিত হয়েছে? যেমন মাখন, চায়ের কৌটা, কোনও টিল্ড খাবার অথবা বিস্কুটের টিন?
যোগীন্দর সিং দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে বলে, না!
শর্মাজী বলেন, কেন বলুন তো?
—কারণ এ-থেকে বোঝা যাচ্ছে হত্যাকারী জানত এখানে একটি পাখি আছে, তাকে সে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। থিন্ অ্যারারুট বিস্কুট ছয়খানা সে পকেটে করেই নিয়ে আসে। যেহেতু খান্নাজীর ভাঁড়ারে ছিল শুধুমাত্র ক্রিম-ক্র্যাকার বিস্কুট।
শর্মাজী কিছু বলার আগেই সতীশ বর্মন বলে ওঠেন, আপনার সিদ্ধান্তগুলি আপনার নিজের মনেই রাখুন বাসু-সাহেব। আমরা তাতে উৎসাহী নই। আমি তো মনে করি—খান্নাজীর টেবিলে দশ-পনেরো খানা—মাইন্ড য়ু ছয়খানা নয়—থিন্ অ্যারারুট বিস্কুট ছিল, এবং আততায়ী গোটা ঠোঙাটাই তুলে নিয়ে পাখিটার খাঁচার কাছে নামিয়ে দিয়ে যায়। তার খানকতক পাখিটা খেয়েছে এবং মাত্র ছয়খানা অভুক্ত পড়ে আছে! এনি ওয়ে, আপনার তদন্ত শেষ হয়েছে কি?
বাসু বলেন, হয়েছে। শুধু আর একটি প্রশ্ন আছে। মিস্টার শর্মা, আপনাকেই জিজ্ঞাসা করছি—আমার ক্লায়েন্ট বলেছিলেন, এ ঘরে মেয়েদের একটি ব্র্যাসিয়ের, একজোড়া উলের কাঁটা, একটা আধবোনা সোয়েটার ও কিছু উল পাওয়া গিয়েছিল। সে কথা সত্য?
বর্মন কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই শর্মাজী বলে ওঠেন, হ্যাঁ সত্য। সূরযপ্রসাদ সে তথ্যটা গোপন রাখতে চায় বলে এতক্ষণ বলিনি। সেগুলি থানায় জমা দেওয়া আছে। আপনি দেখতে চান?
সতীশ বর্মন দুম দুম করে পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বাসু বলেন, হ্যাঁ চাই। আপনাদের আপত্তি নেই তো?
—নিশ্চয় নয়। এ কথা তো আমি বারে বারেই বলেছি।
—ধন্যবাদ। তাহলে ফেরার পথে আমি থানাতে যাব। জিনিসগুলি দেখব, আবার একই কথা বলি, আপনার আপত্তি না থাকলে ঐ উলের কিছু নমুনা আমি নিয়ে যাব।
—ঠিক আছে, পাবেন।
বাসু-সাহেব বের হয়ে আসছিলেন, হঠাৎ নজর হল দরজার বাইরে শুধু সতীশ বর্মনই নয়, আরও একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে। প্রৌঢ়, স্যুট পরা, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। শর্মাজীও বেরিয়ে এসেছিলেন। নবাগতকে দেখে বলে ওঠেন, গঙ্গারামজী?
—ইয়েস স্যার। আমি আজই শ্রীনগরে পৌঁছেছি। এসেই শুনলাম আপনারা সবাই এখানে এসেছেন। আপনি টেলিফোনে বলেছিলেন, শ্রীনগরে ফিরেই যাতে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাই তৎক্ষণাৎ এখানে চলে এসেছি।
—-কিসে এলেন আপনি?
—মোটর বাইকে।
শর্মা বললেন, আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। যোগীন্দরকে তো আপনি চেনেনই। ইনি হলেন সি. বি. আই.য়ের অফিসার মিস্টার সতীশ বর্মন। আর উনি —
বাধা দিয়ে গঙ্গারাম বললেন, ওঁকে আমি চিনি স্যার। সূরযপ্রসাদ আমাকে বলেছে এখানে হয়তো ব্যারিস্টার সাহেবের দেখাও পেয়ে যাব আমি।
গঙ্গারাম বাসু-সাহেবকে করজোড়ে নমস্কার করে শর্মাজীর দিকে ফেরেন। বলেন, আপনি টেলিফোনে যা যা বলেছিলেন তা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। প্রথমত-
—জাস্ট এ মিনিট! বাধা দিয়ে সতীশ বর্মন বলে ওঠে, আপনার জবানবন্দি আমরা একটু পরে নেব। মিস্টার বাসুর তাড়া আছে। উনি চলে যাচ্ছেন—
গঙ্গারাম বিহ্বলভাবে বলেন, কিন্তু আমার যা বলার আছে—
আমার বাধা দিয়ে বর্মন বলে, তা শুধু পুলিসকে জানাবেন। তৃতীয় ব্যক্তিকে নয়। বুঝেছেন?
গঙ্গারাম কী বলবেন ভেবে পান না।
বাসু-সাহেব বলে ওঠেন, কী হল? বুঝতে পারলেন না? আপনার যা বলার আছে তা আপনার এপ্লয়ারকে এবং তাঁর নিয়োজিত উকিলকে বলবেন না। এটা তো সোজা কথা!
গঙ্গারামের সব কিছু একেবারেই গুলিয়ে গেল।
বাসু যোগীন্দরকে বললেন—আমরা একটু ঘুরে বেড়াবো। ঘণ্টা দুই পরে থানায় গেলে আপনার দেখা পাব কি?
—নিশ্চয়ই। আমি অপেক্ষা করব।
বাসু তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে শর্মাজীর দিকে ফিরে বললেন, আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। আমি আমার সাধ্যমত আপনাকে সাহায্য করব প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বার করতে—যাতে পুলিস কোনও নিরপরাধীকে ডকে তুলে আমার বদনাম আরও বৃদ্ধি করতে না পারে। নমস্কার।
সতীশ বর্মনকে তিনি কোনও সম্বোধন না করেই পথে নামলেন।