উলের কাঁটা – ১১

এগারো

আদালতে অপ্রত্যাশিত জনসমাগম হয়েছে। একাধিক কারণে। এ কয়দিন সংবাদপত্রে নানান খবর ফলাও করে ছাপা হওয়াতে সাধারণ মানুষ স্বতই উৎসাহী। ওদিকে এই ‘করোনারের-আদালত’ নিয়ে জাস্টিস্ লাল যে পরীক্ষা করতে চলেছেন সে বিষয়েও আইনজ্ঞ মানুষদের কৌতূহল।

সভাধিপতি-করোনারের বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ। মাঝারি গড়ন, গম্ভীর এবং আত্মপ্রত্যয়ের একটা ভাবব্যঞ্জনায় মনে হয় তিনি দৃঢ়চেতা। সমবেত জনমণ্ডলীর উপর দৃষ্টি বুলিয়ে তিনি বললেন, বন্ধুগণ! আপনারা নিশ্চয়ই জানেন আজকের এই বিচার নানান কারণে আইন-বিভাগের একটা বিশিষ্ট দিকচিহ্ন। আমরা এখানে সমবেত হয়েছি স্বর্গত মহাদেওপ্রসাদ খান্নার রহস্যজনক মৃত্যুর বিষয়ে তদন্ত করতে—কেন তিনি মারা গেলেন। এবং যদি দেখা যায়, তিনি স্বাভাবিকভাবে মারা যাননি, কেউ তাঁর মৃত্যু ঘটিয়েছে তাহলে কে সেই লোক, সে কথাও আমরা ভেবে দেখব। আমরা এখানে কোনও অভিযুক্ত ব্যক্তি বা আসামীর বিচার করতে বসিনি। আমরা শুধু নির্ধারণ করতে বসেছি পহেলগাঁওয়ের অদূরে ট্রাউট-প্যারাডাইসের একটি নির্জন লগ্-কেবিনে কীভাবে মহাদেও প্রসাদ খান্না মৃত্যুবরণ করেন।

প্রথমেই বলে রাখি, আমি দেখতে পাচ্ছি, কিছু ক্যামেরাধারী সাংবাদিক উপস্থিত হয়েছেন। তাঁদের আমি জানাচ্ছি—বিচার চলাকালে তাঁরা যেন কোনও আলোকচিত্ৰ গ্ৰহণ না করেন। সাধারণ দর্শকদের আমি বলব, তাঁরা যেন কোনও গণ্ডগোল না করেন।

আমি করোনারের প্রচলিত পদ্ধতিতেই অগ্রসর হতে চাই। করোনার অধিকাংশ সময়েই বাদীপক্ষের প্রতিনিধিকে—এক্ষেত্রে পালিক প্রসিকিউটার শ্রীপ্রকাশ সাক্‌সেনাকে—প্রশ্নগুলি করে যাওয়ার সুযোগ দেন। তার মানে এই নয় যে পি. পি. ই এ বিচার পরিচালনা করবেন। তার মানে এই যে, পি. পি. আমাকে সাহায্য করবেন সত্যে উপনীত হতে। এবং এ-ক্ষেত্রে ঐ সঙ্গে তিনি সম্ভাব্য হত্যাকারীকে চিহ্নিত করবার প্রচেষ্টা করবেন। এস. ডি. ও. সদর শ্রীশর্মাও এখানে উপস্থিত—তিনিও ঐ কাজে আমাদের সাহায্য করবেন, যেহেতু তদন্তে তিনিও প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ডিস্ট্রিক্ট অ্যান্ড সেশান্‌স্‌ জাজ জাস্টিস্ লালও এখানে উপস্থিত। তিনি বস্তুত আমার বিচারক। যদিও তিনি এ বিচারে কোনও প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করবেন না। সে যাই হোক, আমাকে জানানো হয়েছে—একজন বিশেষজ্ঞকেও কেন্দ্রীয় সি. বি. আই.য়ের সংস্থা থেকে আনানো হয়েছে—যিনি এজাতীয় হত্যারহস্য উদ্ভাবনে পারদর্শী; তাঁর সাহচর্যও আমরা পাব। এছাড়া মৃত খান্নাজীর পুত্র শ্রীসূরযপ্রসাদ খান্নার তরফে উপস্থিত আছেন শ্রীপি. কে. বাসু, ব্যারিস্টার। প্রসঙ্গত তিনি শ্রীমতী রমা দাসগুপ্তার কৌসুলিও বটে।

আমি সকলকেই পরিষ্কারভাবে জানিয়ে রাখতে চাই যে, দীর্ঘ বক্তৃতা বা চুলচেরা আইনঘটিত ‘অবজেক্‌শান’ শুনবার জন্য আমরা সমবেত হইনি। নিছক ‘তথ্য’ ছাড়া আমাদের আর কোনও কিছুতে কৌতূহল নেই। সুতরাং সওয়াল-জবাবের প্যাচে সাক্ষীকে কায়দা করা, বা গরম-গরম বক্তৃতা দিয়ে জুরি ও বিচারককে অভিভূত করার চেষ্টাকে আমরা বরদাস্ত করব না।

সাধারণ বিচারসভায় বাদী তাঁর ইচ্ছামত সাক্ষীদের ক্রমান্বয়ে আহ্বান করেন, তাঁকে প্রশ্ন করেন এবং প্রতিবাদী তাঁকে জেরা করেন। বাদীর সাক্ষীর তালিকা শেষ হলে প্রতিবাদী তাঁর সাক্ষীদের একে একে আহ্বান করেন এবং সাক্ষ্যগ্রহণ করেন। সেবার বাদী সাক্ষীদের জেরা করেন। আমরা এই পদ্ধতিতে অগ্রসর হব না। কারণ ঐ পদ্ধতি অবলম্বন করার একমাত্র হেতু বাদী অভিযুক্তকে দোষী প্রমাণ করতে চান, প্রতিবাদী প্রমাণ করতে চান সে নির্দোষ। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত কেউ নেই। আরক্ষা বিভাগ যদি কাউকে এই কেস-এ আটক করে থাকে, তা তাদের ব্যাপার। আমার সামনে এমন কোনও তথ্য নেই যাতে কাউকে অভিযুক্ত বা আসামীরূপে চিহ্নিত করা যায়। যেহেতু আসামী বলে কিছু নেই, তাই বাদী ও প্রতিবাদীও কেউ নেই। সুতরাং সত্য উদ্ঘাটন মানসে আমিই সাক্ষীদের পর্যায়ক্রমে আহ্বান করব এবং ‘তথ্য’ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁদের প্রশ্ন করব। আমার প্রশ্ন শেষ হলে পি. পি. এবং শ্রীবাসু যাতে সাক্ষীকে প্রশ্ন করে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে আমাদের সাহায্য করতে পারেন সেটাও আমরা দেখব।

আশা করি আমি আমার উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতিটা বোঝাতে পেরেছি। এখানে ‘তথ্য’ সংগ্রহের মাধ্যমে ‘সত্য’ প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া আমাদের দ্বিতীয় কোনও উদ্দেশ্য নেই। জেরার মাধ্যমে সাক্ষীকে দিয়ে কিছু কবুল করানো, লম্বা বক্তৃতা বা ‘টেক্‌নিক্যাল অবজেক্‌শান’ আমরা কোনওমতেই বরদাস্ত করব না। অ্যাম আই ক্লিয়ার?

বাসু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ।

পি. পি. প্রকাশ সাক্সেনা এর পর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, হ্যাঁ, কিন্তু ‘টেকনিক্যাল অজেকশান’ বলতে ঠিক কী বোঝায় সে বিষয়ে করোনারের সঙ্গে আমার মতপার্থক্য হতে পারে। সে-ক্ষেত্রে…

ওঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকটি বলে ওঠেন, সে-ক্ষেত্রে আমি যেভাবে সেটাকে ‘ইনটারপ্রেট’ করব সেটাই গ্রাহ্য হবে। লুক হিয়ার সারস্! আমি বিজ্ঞানের অধ্যাপক, আইন কিছুমাত্র জানি না। আমার জুরিরাও সাধারণ মানুষ—ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার, বিজনেসম্যান ইত্যাদি। তাঁরাও আইন জানেন না। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে ঐ রহস্যজনক মৃত্যুর বিষয়ে যে সব ‘তথ্য’ এ পর্যন্ত উদ্ঘাটিত হয়েছে তাই সুসংবদ্ধভাবে সাজিয়ে দেওয়া, যাতে জুরিরা বুঝতে পারেন কী-ভাবে মহাদেওপ্রসাদ মৃত্যুবরণ করেন। জুরিরা জানেন, তারা এখানে কেন সমবেত হয়েছেন। অন্তত আমি জানি আমি এ চেয়ারে কেন বসেছি। সুতরাং ‘টেক্‌নিক্যালিটি’ বলতে কী বোঝায় তার ভাষ্য আমি চূড়ান্তভাবে দেব।

সর্বপ্রথমে আমি আহ্বান করতে চাই মহম্মদ খুরশেদকে, যিনি মৃতদেহ সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন। মিস্টার খুরশেদ, আপনি এগিয়ে আসুন এবং হলফনামা পাঠ করুন।

খুরশেদ হলফ নিলেন, নিজের নাম, ঠিকানা এবং অন্যান্য পরিচয় দিলেন। বিচারক প্রশ্ন করেন, মিস্টার খুরশেদ, আপনিই প্রথম মৃতদেহটি আবিষ্কার করেন, তাই না?

প্রকাশ সাক্‌সেনা তার পার্শ্ববর্তী ডেপুটিকে বলল, প্রথম প্রশ্নটাই লীডিং কোশ্চেন।

ডেপুটি জনান্তিকে বলল, চেপে যান স্যার! এখানে আইন মোতাবেক কিছুই হবে না!

খুরশেদ শুধু বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ।

—কোথায়?

—পহেলগাঁওয়ের উত্তরে ট্রাউট-প্যারাডাইসের একটি লগ্-কেবিনে।

—আপনাকে আমি একটি ফটো দেখাচ্ছি। দেখে বলুন এই কেবিনটিই কি?

সাক্ষী আলোকচিত্রটি দেখে স্বীকার করলেন, এই কেবিনই। বিচারক তখন ওঁকে আনুপূর্বিক সব কিছু একটা বিবৃতির আকারে বলতে বলেন। কবে, কখন, কী ভাবে উনি মৃতদেহটি আবিষ্কার করেন।

সাক্ষী যা বললেন তার সংক্ষিপ্তসার এই রকম : মৃতদেহটি উনি আবিষ্কার করেন রবিবার, এগারোই সেপ্টেম্বর। উনিই একটি লগ্‌-কেবিন ভাড়া নিয়েছিলেন। রবিবার এগারোই সেপ্টেম্বর সকাল আটটা নাগাদ যখন উনি ঐ লগ-কেবিনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন ঐ লগ্-কেবিনটার ভিতর থেকে একটা ময়নার ডাক শোনেন। ময়নাটা ক্রমাগত কর্কশ স্বরে ডাকছিল। উনি লক্ষ করে দেখেন, লগ-কেবিনের সদর দরজাটা বন্ধ। তখন ওঁর মনে পড়ে দিন দুয়েক আগেও উনি দেখেছিলেন ঘরটা তালাবন্ধ এবং তখনও একটা পাখির কর্কশ ডাক শোনেন। উনি ভাবেন, এই লগ্-কেবিনটি যিনি ভাড়া নিয়েছেন তিনি হয়তো শহরে গিয়ে কোনও কারণে আটকে পড়েছেন এবং অভুক্ত ময়নাটা তাই ক্ষুধার তাড়নায় ডাকছে। কৌতূহলী হয়ে উনি এগিয়ে আসেন। জানলা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিয়ে একজন মানুষকে রক্তাপ্লুত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। তখনই উনি নিজের লগ্-কেবিনে ফিরে যান এবং পুলিসকে টেলিফোনে খবর দেন। তারপর ও. সি. যোগীন্দর সিং এবং এস. ডি. ও শর্মাজী এসে পড়েন। দারোয়ানের কাছ থেকে ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে ঘরটা খোলেন।

করোনার বলেন, ঠিক আছে। এর পর কী হয়েছিল তা আমরা ও সি. যোগীন্দর সিংয়ের কাছে শুনব। মিস্টার পি. পি. অ্যান্ড মিস্টার বাসু আপনাদের কোনও প্রশ্ন আছে?

দুজনেই জানালেন তাঁদের কোনও জিজ্ঞাস্য নেই। অতঃপর বিচারকের আহ্বানে সাক্ষী দিতে উঠলেন যোগীন্দর সিং। করোনার বলেন, এবার আপনি বলুন ঘরে ঢুকে আপনারা কী দেখলেন?

যোগীন্দর প্রথমেই লগ্-কেবিনের একটি প্ল্যান দাখিল করে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলি কোন্‌টা কোথায় ছিল তা ঐ নক্সাতে দেখানো হয়েছে। তিনি জানালেন, মৃতদেহটি মেঝের উপর চিৎ হয়ে পড়েছিল। বাঁ-হাতটা বাড়ানো, ডান হাত বুকের উপর। পিস্তলটা ছিল মৃতদেহ থেকে অনেক দূরে। বললেন, প্রথমেই আমরা ঘরের জানলাগুলো খুলে দিলাম। না হলে পচামাছের গন্ধে ঘরের ভিতর দাঁড়ানো যাচ্ছিল না! মাছের পলোটা প্রথমেই ঘর থেকে বার করে বাইরে রাখা হল। ময়নাটাকে আমরা খাঁচায় পুরে ফেললাম। মৃতদেহের এবং পিস্তলের আউট-লাইনটা কাঠের মেঝেতে চক দিয়ে দাগিয়ে দিলাম। মৃতের পরনে ছিল পায়জামা। ঊর্ধ্বাঙ্গে পুরোহাতা শার্ট ও হাতকাটা সোয়েটার ছিল। হাতে দস্তানা পরা ছিল না। আমি থানাতেই বলে গিয়েছিলাম, তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স, ফটোগ্রাফার ও ফিঙ্গার-প্রিন্ট এক্সপার্ট এসে গেল। কয়েকটা ফটো নিয়ে মৃতদেহকে আমরা মর্গে পাঠিয়ে দিলাম। ঐসঙ্গে মাছের পলোটাও। ফিঙ্গার-প্রিন্ট এক্সপার্ট আঙুলের ছাপ নেন।

করোনার বলেন, জাস্ট এ মিনিট! ফটোগুলো কি আপনি সঙ্গে করে এনেছেন?

—ইয়েস স্যার!—খান-ছয়েক হাফ-সাইজ ফটো তিনি দাখিল করেন।

করোনার সেগুলি নিজেও দেখলেন এবং জুরিদের দেখতে দিলেন। তারপর প্রশ্ন করেন, আঙুলের ছাপ কিছু পাওয়া গিয়েছে কি?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। অনেকগুলি। মহাদেও প্রসাদের এবং দারোয়ানের। একটা কাচের গ্লাসে শ্রীরমা দাসগুপ্তার একটি এবং আরও তিন-চারটি অজানা লোকের, যাঁরা হয়তো আগে ঐ ঘরে বাস করে গেছেন।

—শ্রীরমা দাসগুপ্তার আঙুলের ছাপ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ আছে কি?

—আজ্ঞে না, নেই। উনি গ্রেপ্তার হওয়ার পরে ওঁর আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়েছে। একটি জলের গ্লাসে ঐ আঙুলের ছাপ নিঃসন্দেহে পাওয়া গেছে।

—ঠিক আছে। তারপর কী হল বলে যান

যোগীন্দর তাঁর জবাববন্দি দিয়ে বলেন, তারপর এস. ডি. ও শর্মাজী এবং আমি লগ্‌-কেবিনটাকে ভালোভাবে পরীক্ষা করি। প্রথমে রান্নাঘরের কথা বলি : সেখানে কিছু আনাজপাতি ছিল, কিছু টিনের খাবার। কফি, বিস্কুট, চিনি, কন্ডেন্সড মিল্ক ইত্যাদি ছিল। রান্নাঘরে ময়লাফেলা ঝুড়িতে দুটি ডিমের খোলা, পাঁউরুটি জড়ানো পাতলা কাগজ ছাড়া আর কিছু ছিল না। স্টোভের উপর সস্প্যানে কিছু ঘন হয়ে যাওয়া কফি ছিল। সিংক-এ একটা কাচকড়ার প্লেটে পাঁউরুটির টুকরা এবং ডিমের ভুক্তাবশেষ ছিল। মনে হল, খাবার পর ঐ প্লেটটা সিংক-এ নামিয়ে রাখা হয়েছে, কিন্তু ধোয়া হয়নি।

বাথরুমে একটা ব্যবহৃত তোয়ালে এবং ছাড়া আন্ডারওয়ার ছিল। সোপকেস স্ট্যান্ডে একটা সাবানও ছিল কিন্তু বাথরুমের মগটা ছিল না।

শয়নকক্ষে লক্ষণীয় বিষয়বস্তু হচ্ছে চেয়ারের পিঠে ঝোলানো একটা গরম কোট। তার পকেটে রুমাল, একটা ক্যাপস্টান সিগ্রেটের প্যাকেটে আটটি সিগ্রেট, একটি দেশলাই। কোটের ইনসাইড পকেটে মানিব্যাগ ছিল। তাতে ছিল শ-তিনেক টাকা নোটে ও খুচরায়, আর ছিল একখণ্ড কাগজ। তাতে শ্রীরমা দাসগুপ্তার নাম-ঠিকানা, যদিও নামটা লেখা ছিল রমা খান্না!

—এক মিনিট! কাগজটা আপনি এনেছেন?

যোগীন্দর সেটি দাখিল করেন। করোনার সেটা পরীক্ষা করেন। বাসুও এবং জুরিরাও। ইংরেজী হরফে লেখা ছিল : মিসেস্ রমা খান্না, মেথডিস্ট চার্চের পিছনে মাঝের কোয়ার্টার্স, পহেলগাঁও।

বাসু-সাহেব জনান্তিকে রমাকে প্রশ্ন করেন, এটার কথা তো কিছু বলনি?

—আমি এটার অস্তিত্বের কথা জানতামই না, কী বলব?

করোনার বলেন, য়ু মে প্রসীড-

যোগীন্দর বলেন, দেওয়ালে পেরেকে আটকানো হ্যাঙার থেকে ঝুলছিল একটা গরম প্যান্ট। টেবিলের উপর ছিল একটা অ্যালার্ম ঘড়ি। দুটো বেজে সাত মিনিটে দম ফুরিয়ে থেমে ছিল। অ্যালার্ম কাঁটাটা ছিল সাড়ে পাঁচটার ঘরে। অ্যালার্ম-দমও সম্পূর্ণ শেষ হয়েছিল, মানে দম বাজার পর ঘড়ির অ্যালার্ম দম ফুরিয়ে থেমে গিয়েছিল। এ ছাড়া ছিল টেলিফোন। খাটের নিচে সুটকেস—তাতে জামা-কাপড়, শেভিং-সেট, দশ প্যাকেট সিগ্রেট, টুথব্রাশ-পেস্ট, কিছু ঔষধপত্র ও খাম-পোস্টকার্ড এবং একশ টাকার চুয়ান্নখানা নোট। সুটকেস তালাবন্ধ ছিল না। ফায়ার প্লেসে কাঠগুলি সাজানো ছিল। বিছানাটি পরিপাটি করে পাতা, তাতে পাটভাঙা একটা চাদর।

শয়নকক্ষে একটা গা-আলমারি ছিল। তার নিচের তাকে একজোড়া ধুলোমাখা জুতো, মোজা, জুতা-ঝাড়া ব্রাশ ছিল। মাঝের তাকে আধডজনখানেক ধোপদস্ত বিছানার চাদর ও কিছু তোয়ালে। উপরের তাকটা এতই উঁচুতে যে, মেঝেতে দাঁড়িয়ে সহজে নজর চলে না। চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে আমরা দেখলাম—সেখানেও কিছু জিনিসপত্র আছে : একটা মেয়েদের অন্তর্বাস, মানে বক্ষবন্ধনী, মেডেনফর্ম, 32” মাপের। একঝোড়া উলের-কাঁটা, কিছু উল ও আধবোনা সোয়েটার এবং খান-দুয়েক ছবি। জলরঙে আঁকা। ঐ লগ্-কেবিনের কাছ থেকে দেখা নিসর্গ চিত্র। এছাড়া ঘরে ছিল হুইল-ছিপ।

পিস্তলটাতে দুটো চেম্বার। দুটি থেকেই ফায়ার করা হয়েছে, কিন্তু স্পেন্ট-আপ বুলেটগুলি ঐ পিস্তলেই আছে। সেটি স্যাক্সবি কোম্পানির। তার নম্বর পি-293750।

করোনার প্রশ্ন করেন, ঐ পিস্তলটার বিষয়ে শ্রীমতী রমা দাসগুপ্তা কি আপনার কাছে কোনও স্বীকারোক্তি করেছেন?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। সেটা কিন্তু অনেক পরে। মাত্র গত পরশুদিন। উনি বলেছিলেন, ঐ পিস্তলটা স্টেট-ব্যাঙ্কের দারোয়ান মন-বাহাদুরের। সে দেশে যাওয়ার সময় ওটা রমা দেবীর কাছে গচ্ছিত রেখে যায় এবং সেটি তিনি তাঁর স্বামী মহাদেও প্রসাদ খান্নাকে দিয়েছিলেন শুক্রবার দোসরা সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায়।

পাবলিক প্রসিকিউটার প্রকাশ সাকসেনা তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে উঠে বলেন, জাস্ট এ মোমেন্ট। রমা দেবী সেই স্বীকারোক্তি কি স্বেচ্ছায় করেছিলেন, না পুলিস তাঁকে ভয় দেখিয়ে, বা লোভ দেখিয়ে সে-কথা স্বীকার করতে বাধ্য করেছিল?

—না কোনওরকম ভয় বা লোভ তাঁকে দেখানো হয়নি। আপনিই আমার সম্মুখে রমা দেবীকে প্রশ্ন করেন এবং তিনি স্বেচ্ছায় ঐ স্বীকৃতি দেন।

করোনার বলেন, বর্তমান সাক্ষীকে আর কেউ কোনও প্রশ্ন করবেন?

বাসু উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, আমার দু-একটা প্রশ্ন আছে।

—জিজ্ঞাসা করুন।

বাসু বলেন, যোগীন্দর সিংজী, আপনি আপনার জবানবন্দিতে বলেছেন, শয়নকক্ষের• মাঝের তাকে আধ-ডজন-খানেক পাটভাঙা বিছানার চাদর ছিল। আধডজন খানেক বলতে পাঁচ থেকে সাতখানা যা কিছু হতে পারে। আমি জিজ্ঞাসা করছি, আপনি কি গুনে দেখেছিলেন কটা চাদর ছিল?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, ছয়টা।

—মিস্টার সিং, আপনি কি বলতে পারেন অতগুলো চাদর কেন ছিল?

—হ্যাঁ পারি। লগ্‌-কেবিনে সপ্তাহে একদিন মাত্র লন্ড্রির ব্যবস্থা আছে। অতগুলি চাদর থাকে যাতে সেল্ফ-হেল্পে বিছানা পরিষ্কার রাখা যায়

—ধন্যবাদ। আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, আপনি ঘরের যে নক্সাটা দিয়েছেন তাতে খাটের অবস্থান দেখানো হয়েছে। তার একদিকে দেখছি একটা ছোট্ট আয়তক্ষেত্র আছে; ওটায় কি মাথার বালিশের অবস্থান দেখানো হয়েছে?

—ইয়েস! দ্যাটস্ ইট।

—আমার তৃতীয় প্রশ্ন, টেবিলের উপর ঘড়িটা ছিল একথা আপনি জানিয়েছেন। সেটা টেবিলের কোনখানে ছিল? খাটের দিকে না বাথরুমের দিকে?

—খাটের দিকে।

—দ্যাটস্ অল।—বাসুর প্রশ্ন শেষ হল।

করোনার বললেন, এবার আমি শ্রীমতী রমা দাসগুপ্তাকে সাক্ষী দিতে ডাকব। তারপর জুরিদের দিকে ফিরে বললেন, আপনারা হয়তো জানেন, মহাদেওপ্রসাদের হত্যাপরাধে পুলিস শ্রীমতী দাসগুপ্তাকে গ্রেপ্তার করেছে। আর শ্রীযুক্ত পি. কে. বাসু তাঁর কৌসুলি। এ-সব ক্ষেত্রে অভিযুক্তের কাউন্সেলার তাঁর মক্কেলকে এই রকম করোনার-আদালতে কোনও কথা না বলাতে বলেন। সুতরাং শ্রীমতী দাসগুপ্তা সম্ভবত আমাদের কোনও প্রশ্নের জবাব দেবেন না। তবু আমি তাঁকে সাক্ষী দিতে ডাকছি, যাতে আপনারা তাঁকে স্বচক্ষে দেখতে পান, চিহ্নিত করেন, এবং কী ভাষায় তিনি উত্তরদানে অস্বীকৃত হচ্ছেন, তাও লক্ষ করেন।

রমা দাসগুপ্তা সাক্ষীর মঞ্চে উঠে দাঁড়ায় ও শপথবাক্য পাঠ করে।

বাসু বলেন, মহামান্য করোনার ও জুরিদের অবগতির জন্য আমি জানাচ্ছি—প্রচলিত রীতি লঙ্ঘন করে আমি আমার মক্কেলকে পরামর্শ দিয়েছি সব কিছু অকপটে বলতে। শ্রীমতী দাসগুপ্তাকে আমি অনুরোধ করছি, জিজ্ঞাসিত হলে তিনি যেন প্রশ্নগুলির যথাযথ জবাব দেন।

জাস্টিস লাল ঝুঁকে পড়ে বাসুকে ভালো করে দেখলেন।

রমাকে দেখে মনে হয় সে খুবই ক্লান্ত, দেহে ও মনে অবসাদগ্রস্ত। তবু তার ঋজু ভঙ্গিমায় কিছুটা প্রশান্তি এবং সম্ভবত দার্ঢ্যের ব্যঞ্জনা। দীর্ঘসময় ধরে সে তার অভিজ্ঞতার একটা আদ্যোপান্ত ইতিহাস শুনিয়ে গেল। গত বছর কী ভাবে সে পহেলগাঁওয়ের অদূরে চিত্রাঙ্কনরত খান্নাজীর সাক্ষাৎ পায়, কী ভাবে এক বছর ধরে তাঁর চিঠি পায়। তারপর এ বছরের ঘটনা। কীভাবে তাদের বিবাহ হয়, এই লগ্‌-কেবিনে মধুচন্দ্রিমা যাপন করে এবং গত দোসরা সেপ্টেম্বরে সে তার স্বামীর কাছ থেকে একটি ময়না উপহার পায়। তাঁকে একটি পিস্তল দেয়। সবশেষে জানালো, খবরের কাগজে মহাদেও প্রসাদের ছবি থেকে সে জানতে পারে তার স্বামীর পরিচয়। তাঁর মৃত্যুসংবাদে মর্মাহত হয়ে পড়ে।

প্রকাশ সাক্‌সেনা লাফ দিয়ে উঠে পড়ে ওর দীর্ঘ জবানবন্দি শেষ হওয়া মাত্ৰ। বলে, মিস্ দাসগুপ্তা, এ-কথা কি সত্য যে, আপনি সংবাদপত্রে ঐ ছবিটি দেখেই তৎক্ষণাৎ আপনার কর্মস্থল ত্যাগ করেন এবং আত্মগোপন করেন?

—হ্যাঁ, তৎক্ষণাৎ আমি কর্মস্থল ত্যাগ করে শ্রীনগরে আসি। কিন্তু আত্মগোপন করিনি। আমি নিজেকে বিপদগ্রস্তা ভেবেছিলাম; তাই শ্রীপি. কে. বাসুর শরণাপন্ন হই। তিনি আমাকে—

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রকাশ বলে, ছদ্মনামে একটা হোটেলে উঠতে পরামর্শ দেন?

বাসু উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ব্যস্! এ প্রশ্নের জবাব আমার মক্কেল দেবে না। সে বলেছে শ্রীনগরে পৌঁছেই সে আমাকে তার কাউন্সেলার হিসাবে নিযুক্ত করে। ফলে এর পর সে যা কিছু করেছে, তা আমার নির্দেশে করেছে। তার দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার। রমা তুমি এ প্রশ্নের উত্তর দিও না।

প্রকাশ বলে, আমার ধারণা, করোনার বলেছিলেন, এখানে টেকনিক্যাল অবজেকশান কিছু থাকবে না।

—আমি তো টেক্‌নিক্যাল অবজেকশান কিছু দিইনি। আমি আমার মক্কেলকে শুধু বলেছি, ও প্রশ্নের জবাবটা না দিতে।

—আই ডিমান্ড দ্যাট শী আনসার ইট!

করোনার বললেন, মিস্টার পি. পি., আপনি এ দাবি করতে পারেন না। বস্তুত শ্রীবাসুর নির্দেশে শ্রীমতী দাসগুপ্তা কোনও প্রশ্নের জবাবই না দিতে পারতেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে শ্রীবাসু স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই সাক্ষীকে প্রশ্নের জবাব দিতে বলেছেন। আপনি যে প্রশ্নটি বর্তমানে পেশ করেছেন, সে বিষয়ে শ্রীবাসু বলেছেন—তাঁর নির্দেশেই সাক্ষী যা কিছু করার তা করেছে। সুতরাং এ প্রশ্নের জবাব দিতে সাক্ষী বাধ্য নন। আপনি অন্য প্রশ্ন করুন।

প্রকাশ সাক্‌সেনা তখন সাক্ষীকে অন্যদিক থেকে আক্রমণ করে, এ-কথা কি সত্য যে, যেদিন আপনি গ্রেপ্তার হন সেদিন সকাল ছয়টার বাসে আপনি শ্রীনগর থেকে পহেলগাঁওয়ের বাসায় ফিরে আসেন?

—হ্যাঁ, সত্য।

—এবং বাড়িতে ফিরেই আপনি কিছু কাগজপত্র পোড়াতে শুরু করেন!

—হ্যাঁ, তাও সত্য।

—কারণ ঐ কাগজপত্রের মধ্যে এমন তথ্য ছিল যাতে আপনার হত্যাপরাধ প্রতিষ্ঠিত হয়?

—না, সেকথা ঠিক নয়। আমি যে কাগজপত্রগুলি পুড়িয়ে ফেলছিলাম তা শুধু চিঠি। আমার স্বামী গত এক বছর ধরে যেগুলি আমাকে লিখেছেন। আমি চাইনি তা পুলিসের হাতে পড়ুক—এবং প্রকাশ্য আদালতে তা পড়া হয়।

—কেন? তাতে আপনার আপত্তি কিসের? যদি তাতে আপনার হত্যাপরাধ প্রতিষ্ঠিত না হয়?

—চিঠিগুলি নিতান্তই ব্যক্তিগত। আমি চাইনি তা প্রকাশ্য আদালতে পড়া হোক।

—সে কথা আপনি আগেও বলেছেন। আমি জানতে চাইছি : কেন?

—এটা সেন্টিমেন্টের কথা। এর জবাব হয় না।

—বেশ! এ-কথা কি সত্য যে, যেদিন মহাদেওপ্রসাদ খুন হন, সেদিন সকালে আপনি বেলা দশটা নাগাদ ঐ লগ্‌-কেবিনে উপস্থিত ছিলেন?

তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে ওঠেন বাসু : অবজেকশান য়োর অনার। কোন্ তারিখে মহাদেওপ্রসাদ খুন হয়েছেন তা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সুতরাং প্রশ্নটি অবৈধ!

প্রকাশ রুখে ওঠে, আপনি বলতে চান মহাদেও প্রসাদ ছয়ই সেপ্টেম্বর সকাল এগারোটা নাগাদ খুন হননি?

বাসু বলেন, আমি বলতে চাই—সেটাও এই করোনার-একোয়ারির অন্তর্ভুক্ত! কে-কবে-কখন-কেন মহাদেওপ্রসাদকে হত্যা করেছে—যদি আদৌ তিনি খুন হয়ে থাকেন—তাই এখানে অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

প্রকাশ বলে, অলরাইট! আমি প্রশ্নটা সাক্ষীকে অন্যভাবে করছি, একথা কি সত্য যে, গত ছয়ই সেপ্টেম্বর সকাল দশটা নাগাদ আপনি ঐ লগ্-কেবিনে ছিলেন?

—না। আমি…

–প্রকাশ রুখে ওঠে, না? আপনি অস্বীকার করছেন? আমি যদি প্ৰমাণ দিই?

রমা বলে, আপনার আগেকার প্রশ্নের জবাব আমাকে দিতে দেননি। মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছেন। আপনি কী চান? আগেকার প্রথম প্রশ্নটার জবাবটা শেষ করব, না পরেকার প্রশ্নটার জবাব দেব?

—হোয়াট ডু য়ু মীন?

—আমি বলতে চাই—আপনার প্রথম প্রশ্নের জবাব, না, আমি ছয়ই সেপ্টেম্বর সকালে ঐ লগ্‌-কেবিনে উপস্থিত ছিলাম না। আমি ঐ লগ্‌-কেবিনের কাছাকাছি গিয়েছিলাম। সেটাকে বন্ধ দেখি। এবং ফিরে আসি।

—তাই বলুন। আপনি কেন গিয়েছিলেন ওখানে?

—বেড়াতে। যেখানে আমার বিবাহিত জীবনের প্রথম রাত্রিটা কেটেছিল সেটা দেখবার ইচ্ছা হয়েছিল, তাই।

—আপনি কী দেখলেন তাই বলুন।

রমা উত্তরে জানায় যে, লগ্-কেবিনটা বাইরে থেকে তালাবন্ধ ছিল। না, কোনও ময়নার ডাক সে শোনেনি। একমাত্র লগ্‌-কেবিনের দারোয়ান ছাড়া জনমানবের সাক্ষাৎ সে পায়নি। আধঘণ্টাখানেক ওখানে ঘোরাঘুরি করে সে পহেলগাঁওয়ে ফিরে আসে।

প্রকাশ বলেন, এ কথা সত্য নয়। আপনি ঐ লগ্-কেবিনের ভিতরে ঢুকেছিলেন। মহাদেওপ্রসাদের সঙ্গে আপনার কথা-কাটাকাটি হয়, কারণ তার পূর্বেই আপনি জানতে পেরেছিলেন যে মহাদেও বিবাহিত। সেই সময় আপনি পিস্তল দেখিয়ে তাঁকে ভয় দেখান। তারপর…

রমা তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে দৃঢ়স্বরে বলে, না! এসব কিছু হয়নি!

প্রকাশ বলে, আমার প্রশ্নটা শেষ হয়নি….

বাসু বাধা দিয়ে করোনারকে বলেন, য়োর অনার, আমি মনে করি, আমার মক্কেল ঐ ব্যাপারে যতটুকু জানেন, তা বলেছেন। এর পর যদি প্রশ্ন করা হয় তবে তা ক্রস-এক্জামিনেশান ছাড়া আর কিছু নয়। যদি অন্য কোনও প্রশ্ন করবার না থাকে তাহলে আমি আমার মক্কেলকে সাক্ষীর কাঠগড়া থেকে নেমে আসতে বলব।

প্রকাশ বললে, না আমার অন্য প্রশ্ন আছে। বলুন, রমা দেবী, যেদিন আপনি গ্রেপ্তার হন, সেদিন ময়নাটাকে কেন আপনি মেরে ফেললেন?

—আমি মারিনি। কে মেরেছে তা আমি জানি না।

—অথচ পাখিটা আপনার তালাবন্ধ বাড়িতে ছিল।

—না, বারান্দায় ছিল। পাঁচিল টপকিয়ে যে কেউ ওটাকে মেরে ফেলতে পারত।

—পারত কি পারত না, সে-কথা অবান্তর! আপনি নিজে হাতেই পাখিটাকে মেরে ফেলেছিলেন, কারণ সেটা একটা অদ্ভুত বোল পড়ত। তাই না?

—না, একথা সত্য নয়।

প্রকাশ বলল, বোধ হয় আপনার স্মৃতিকে ঝালিয়ে নিতে আমি একটু সাহায্য করতে পারি, দেখুন তো—

প্রকাশের ইঙ্গিতমাত্র তার একজন সহকারী কালো কাপড়ে ঢাকা একটা পাখির খাঁচা এনে রাখল সামনের টেবিলে। আর যাদুকর যেমন নাটকীয়ভাবে ঢাকা খুলে দেখায় টুপির ভিতর খরগোশ—ঠিক সেই ভঙ্গিতে কালো কাপড়টা তুলে দিয়ে খাঁচাটাকে অনাবৃত করে ফেলল, ঠেলে দিল রমার দিকে। দেখা গেল, খাঁচাটার ভিতরে একটা রক্তাক্ত ময়নার ধড়—তার মুণ্ডটা দেহ-বিযুক্ত হয়ে পড়ে আছে। বীভৎস দৃশ্য!

—এ কীর্তিটা আপনারই, তাই না রমা দেবী?

রমা দুই হাতে মুখ ঢেকে বলে ওঠে, ওটা…ওটা সরিয়ে নিন! আমার গা গুলাচ্ছে…প্লীজ…

প্রকাশ নাটকীয় ভঙ্গিতে জুরিদের সম্বোধন করে বলে, বিবেকের দংশন! অপরাধের প্রমাণে অপরাধীর আর্তি! পাপের স্বীকৃতি!

বাসু একলাফে এগিয়ে যান। প্রকাশের সহকর্মীর হাত থেকে কালো কাপড়টা কেড়ে নিয়ে খাঁচাটা ঢেকে দেন। জুরিদের দিকে ফিরে বলেন, মোটেই এটা পাপের স্বীকৃতি নয়, ভদ্রমহোদয়গণ! আপনারা বিবেচনা করে দেখুন, ঐ মেয়েটির প্রতি কী অমানুষিক মানসিক অত্যাচার করা হয়েছে! ও বেচারী মাত্র সাতদিনের বিবাহিত জীবনের মধ্যেই জানতে পারল ও বিধবা। তারপর পুলিস ওকে গ্রেপ্তার করে বলল—তুমিই হত্যাকারী। জেল হাজতে জেরায়-জেরায় তাকে পাগল করে তুলে এখানে তাকে টেনে আনা হয়েছে। এই কদিনে কেউ ঐ সদ্য বিধবাকে কোনও সহানুভূতির কথা শোনায়নি। তার উপরে পাবলিক প্রসিকিউটার একটা রক্তমাখা পাখি…

প্রকাশ বললে, সহযোগী কি একটা বক্তৃতা দিচ্ছেন?

—না, আমি আপনার বক্তৃতার উপসংহার টানছি!

করোনার সজোরে তাঁর হাতুড়িটা ঠুকে বললেন, অর্ডার, অর্ডার!

বাসু-সাহেব বললেন, আদালতে শৃঙ্খলা আনতে হলে আপনি পি. পি.-কে বলুন—এসব বিবেক-বাণীর নাটকীয়তা আমরা শুনতে রাজি নই! ঐ মেয়েটির স্নায়ুর উপর যথেষ্ট চাপ দেওয়া হয়েছে। তারপর একটা রক্তমাখা নিহত পাখি ওর কোলের উপর ছুঁড়ে ফেলতেও সহযোগীর দ্বিধা হল না। এবং তারও পরে মেয়েটির স্বাভাবিক বিবমিষাকে তিনি বলছেন, বিবেকের দংশন! বিচারালয়ে আপনি যদি ‘অর্ডার’ চান, তাহলে সহযোগীকে নাটক করতে বারণ করুন!

—আমি কিছুই নাটক করিনি; প্রকাশ সাকসেনা বলে।

করোনার বলেন, আমি দুপক্ষকেই বক্তৃতা দিতে বারণ করছি। করোনার মনে করেন, যেভাবে ঐ মৃত পাখিটাকে উপস্থিত করা হয়েছে তাতে ঐ মহিলার বিচলিত হয়ে পড়া খুবই স্বাভাবিক। বস্তুত আমারও গা গুলিয়ে উঠেছিল।

বাসু বলেন, য়োর অনার! আমাদের সকলেরই একই অনুভূতি হয়েছে। নাটকীয় ভাবে ওটা উপস্থাপনের একটি উদ্দেশ্য-দৃঢ়চেতা সাক্ষীর মনোবলে আঘাত করা।

—সেরকম কোনও উদ্দেশ্য আমার ছিল না—প্রকাশ বলে।

—তাহলে ওটা উপস্থাপিত করার উদ্দোশ্যটা কী ছিল? করোনার জানতে চান।

—আমি মৃত পাখিটাকে সনাক্ত করতে চেয়েছিলাম মাত্র।

বাসু বলেন, তা করবার প্রয়োজনে রক্তমাখা পাখিটা সাক্ষীর কোলের উপর টেনে এনে ফেলার প্রয়োজন ছিল না।

—ছিল, কি ছিল না, সেটা আমি বুঝব।

শর্মাজী উঠে দাঁড়ান। বলেন, জাস্ট এ মিনিট! করোনার এ বিষয়ে কোনও রুলিং দিলে আমি দেখতে পারি সেটা কার্যকরী করা হচ্ছে কি না।

পদার্থের অধ্যাপকটি বলেন, করোনার রুলিং দিচ্ছেন। করোনার রুলিং দিয়ে বলছেন—এ আদালতে ব্যক্তিগত বাদানুবাদ বরদাস্ত করা হবে না। করোনার আর বলছেন, দু-পক্ষই নাটকীয়তা বর্জন করে শুধুমাত্র তথ্য-সংগ্রহে মনোনিবেশ করুন।

প্রকাশ বলে, আমি শুধু পাখিটাকে সনাক্ত করতে চেয়েছিলাম।

করোনার বলেন, এ-কথা আপনি আগেও বলেছেন, আমি শুনেছি। সে বিষয়ে আমি যা রুলিং দেবার তাও দিয়েছি, আশা করি আপনি শুনেছেন। মিস্টার পি. পি. আপনার আর কোনও জিজ্ঞাসা আছে?

—নো স্যার।

—মিস্টার বাসু? আপনার?

—আছে য়োর অনার।

বাসু একটু আগিয়ে যান। রমার দিকে তাকিয়ে সহানুভূতির সঙ্গে বলেন, রমা! জানি, ঐ পাখিটার দিকে তাকিয়ে দেখতে তোমার কষ্ট হচ্ছে। তবু আমি বলব, তুমি ওটার দিকে তাকিয়ে দেখ একবার। আমি জানতে চাই—এই ময়নাটাকেই কি তোমার স্বামী তোমাকে উপহার দিয়েছিলেন?

রমা দাঁত দিয়ে নিচেকার ঠোঁটটা কামড়ায়। বাসু ইতিমধ্যে কালো কাপড়ের ঢাকাটা সরিয়ে নিয়েছেন। রমা সেদিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে। পারে না। বলে, আমি…আমি ওটার দিকে তাকাতে পারছি না। তবে আমার স্বামী যে পাখিটা আমাকে দিয়েছিলেন তার ডান পায়ের মাঝের আঙুলটা কাটা ছিল। উনি বলেছিলেন, ‘ইঁদুর-মারা কলে ওর ঐ একটি আঙুল কাটা গিয়েছিল।’

বাসু বলেন, কিন্তু এই মৃত ময়নাটার দু পায়ের সব কটা আঙুলই তো রয়েছে।

—তাহলে ঐ মরা পাখিটা ‘মুন্না’ নয়।

রমা একথা বলল অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে। বাসু কৌশিককে কী যেন ইঙ্গিত করলেন। সে কাপড়ে-ঢাকা আর একটা খাঁচা হাতে এগিয়ে এল। খাঁচাটা ওর হাত থেকে নিয়ে বাসু বলেন, রমা, এবার এটার দিকে তাকিয়ে দেখ। ভয় নেই, এটা মরা পাখি নয়। দেখ তো, এটাকে চিনতে পার কিনা।

রমা তখনও সাহস সঞ্চয় করতে পারছে না। ঠিক তখনই ওই পাখিটা ‘বোল’ পড়ল আইয়ে বৈঠিয়ে, চায়ে পিজিয়ে!

যেন সম্বিৎ পেয়ে রমা এদিকে ফিরল, বলল, এই তো! এই তো মুন্না! তবে যে পুলিসে বলল, মুন্নাকে কে যেন মেরে ফেলেছে!

পাখিটা আবার বোল পড়ল : রাম নাম সৎ হ্যায়!

রমা বলে, ঐ তো ওর মাঝের আঙুলটা কাটা।

ঠিক তখনই মুন্না বোল পড়ল : রমা…মৎ মারো…পিস্তল নামাও! দ্রুম্…হায় রাম!

পরিষ্কার মানুষের কণ্ঠস্বর। সমস্ত আদালতে একটা চাপা উত্তেজনা।

রমা বলল, ঐ তো সেই বোলটা বলেছে! ও নির্ঘাৎ মুন্না!

প্রকাশ সাক্‌সেনা এগিয়ে এসে করোনারকে বলে, য়োর অনার! আমি মুন্নার ঐ বোলটা টেপ্-রেকর্ডারে টেপ করতে চাই।

বাসু বলেন, সহযোগী কি মুন্নাকে সাক্ষী হিসাবে তুলতে চান?

—না! পাখিটা একটা বিচিত্র ‘বোল’ পড়েছে। আমি সেটা টেপরেকর্ড করতে চাই মাত্র।

—কিন্তু পাখিটার ঐ বক্তব্য তো হলফনামা নিয়ে নয়। মি লর্ড! সহযোগী যদি মুন্নাকে সাক্ষী হিসাবে তলব করতে চান, তাহলে আমার দাবী, প্রথমে তাকে দিয়ে হলফনামা পাঠ করাতে হবে!

প্রকাশ বিরক্ত হয়ে বলে, কী আশ্চর্য! পাখিটাকে সাক্ষী হিসাবে আমি আদৌ দেখছি না। তার একটা বোল এভিডেন্স হিসাবে রেকর্ড করতে চাইছি মাত্র। আমি করোনারের রুলিং চাইছি।

করোনার বললেন, না, পাখির সাক্ষ্য গ্রাহ্য হতে পারে না। কিন্তু পাখির কোনও ‘বোল’ একটা তথ্য হিসাবে গণ্য হতে পারে। পাখিটা কী বলেছে তা আমি শুনেছি, জুরিরাও শুনেছেন। পাখির ঐ উক্তি আইন-মোতাবেক গ্রাহ্য কিনা তা পরবর্তী আদালতে—যদি এ মামলা আদৌ দায়রায় সোপর্দ করা হয়—আইন-বিশারদেরা বিচার করবেন। আপাতত যেমন সাক্ষ্য চলছিল চলুক।

বাসু বলেন, রমা, তুমি কি মুন্নার মুখে ঐ ‘বোল’টা আগেও শুনেছ? –হ্যাঁ, প্রথম দিন থেকেই। অর্থাৎ সেই দোসরা সেপ্টেম্বর থেকেই।

বাসু বলেন, তাঁর আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই।

করোনার বলেন, অতঃপর শ্রীযুক্তা সুরমা খান্নাকে আমি সাক্ষী হিসাবে ডাকছি। প্রকাশ সাক্‌সেনা উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, শ্রীযুক্তা সুরমা খান্না, অথবা তাঁর পুত্র জগদীশ মাথুরকে সমন ধরানো যায়নি। তাঁরা কোথায় আছেন আমরা জানি না।

করোনার বলেন, আর মহাদেও প্রসাদের একান্ত সচিব? গঙ্গারাম যাদবকে? প্রকাশ বলেন, তিনি উপস্থিত। তাঁকে সমন দেওয়া হয়েছে। ঐ তো বসে আছেন। করোনার বলেন, ঠিক আছে। তাঁকে এর পর আমি সাক্ষী দিতে ডাকব। তিনি যেন প্রস্তুত থাকেন। এখন আমি শ্রীসতীশ বর্মনকে সাক্ষীর মঞ্চে উঠে বসতে অনুরোধ করছি। বর্মন সাক্ষীর মঞ্চে উঠে চেয়ারে বসলেন। করোনার বলেন, আপনি সি. বি. আই.য়ের একজন অফিসার, কাশ্মীর প্রাদেশিক সরকারের অনুরোধ পেয়ে সি. বি. আই. আপনাকে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে পাঠিয়েছে—এ কথা সত্য?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—আপনি বারোই সেপ্টেম্বর এস. ডি. ও. শর্মাজী এবং ও. সি. যোগীন্দর সিং এর সঙ্গে ঐ লগ্‌-কেবিনে গিয়ে তদন্ত করেছিলেন। এ কথা সত্য?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—সেখানে আপনি কী দেখেন বলে যান।

সতীশ বর্মন বিস্তারিতভাবে বর্ণনা দিতে থাকেন। পথে তাঁরা বাসুর সাক্ষাৎ পান সেকথাও বলেন। তারপর বাসু প্রস্থান করলে গঙ্গারামজী বলেন—

বাধা দিয়ে করোনার বলেন, তিনি কী বলেন, তা আমরা তাঁর মুখেই শুনব। আমরা বরং শুনতে চাই তদন্ত করে আপনি কী সিদ্ধান্তে এসেছেন।—তারপর বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বলেন, আপনি হয়তো বলবেন, সাক্ষীর সিদ্ধান্ত আমাদের শোনার কথা নয়; কিন্তু এ-ক্ষেত্রে সাক্ষী হচ্ছেন একজন বিশেষজ্ঞ। অপরাধ-বিজ্ঞান সম্পর্কে বিশেষ শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং বহুদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। এঁকে কেন্দ্রীয় অপরাধ-বিজ্ঞান সংস্থা এখানে পাঠিয়েছেন এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তদন্ত করতে। ফলে বিশেষজ্ঞ হিসাবে তাঁর সিদ্ধান্ত কী, তা আমরা জানতে ইচ্ছুক। আপনি এ বিষয়ে কী বলেন?

বাসু বলেন, আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। আমরা এখানে কারও বিচার করতে আসিনি। এসেছি সত্যানুসন্ধানে। কেন্দ্রীয় সংস্থার একজন বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে কী মনে করেন, কী তাঁর সিদ্ধান্ত তা শুনতে আমরাও আগ্রহী। উনি ওঁর মতামত ব্যক্ত করুন। আমিও প্রশ্নের মাধ্যমে আমার মনে যেটুকু সংশয় আছে তা পরিষ্কার করে নেব।

সতীশ বর্মনকে এখন বেশ ডগমগ মনে হচ্ছে। সে তার বক্তব্য শুরু করল শেষ সিদ্ধান্ত দিয়ে : আমার মতে মহাদেওপ্রসাদ খান্নাকে হত্যা করেছেন শ্রীমতী রমা দাসগুপ্তা। যেহেতু তাঁর বিবাহটা আইনানুসারে সিদ্ধ নয়, তাই আমি তাঁকে রমা খান্না বলতে চাই না। রমা দাসগুপ্তার বিরুদ্ধে যুক্তি পর্বতপ্রমাণ এবং অকাট্য। প্রথম কথা : মোটিভ বা উদ্দেশ্য। মহাদেও নিজেকে যশোদা কাপুরের পরিচয়ে অবিবাহিত বলেছিলেন; ভুল বুঝিয়ে রমা দেবীকে শয্যাসঙ্গিনী করেছিলেন। যে মুহূর্তে রমা দেবী জানতে পারলেন তাঁর স্বামী যশোদা কাপুর বিবাহিত; সেই মুহূর্তে–আই মীন ছয়ই সেপ্টেম্বর ভোরবেলা তিনি ঐ পিস্তলটি নিয়ে লগ্-কেবিনের দিকে যান। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি—স্বামীকে খুন করার বাসনা হয়তো তাঁর ছিল না। তবে পিস্তল দেখিয়ে ভয় দেখানোর ইচ্ছাটা ছিল। তাই তিনি করেছিলেন। সে সময় খান্নাজী এমন কোনও কথা বলেন যাতে উত্তেজিতা অবস্থায় রমা দেবী পিস্তলের দুটি ট্রিগারই টেনে দেন। ‘ডেলিবারেট মার্ডার’ হয়তো নয়, কিন্তু কালপেল্‌ হোমিসাইড। অর্থাৎ সুপরিকল্পিত হত্যা নয়; উত্তেজনার মুহূর্তে হঠাৎ হত্যা করে বসা।

উদ্দেশ্যের কথা বলেছি। দ্বিতীয় কথা : সুযোগ। বাহাদুর নিজে থেকেই ওঁর জিম্মায় পিস্তলটা রেখে যাওয়ায় এবং নিতান্ত নির্জনে খান্নাজী আছেন একথা জানা থাকায় রমা দেবীর সুযোগ পেতে কোনও অসুবিধা হয়নি। এটা আত্মহত্যার কেস কিছুতেই হতে পারে না। কারণ পিস্তলটা ছিল মৃতদেহের নাগালের বাইরে এবং তাতে কারও আঙুলের ছাপ ছিল না।

তৃতীয়ত; অ্যালেবাইয়ের অভাব। শুধু অভাব নয়, ঘটনার সময় রমা দেবী যে ঐ লগ্‌-কেবিনের ধারে-কাছেই ছিলেন তা তিনি নিজমুখেই স্বীকার করেছেন। না করে তাঁর কোনও উপায় ছিল না। ওখানকার দারোয়ান তাঁকে দেখতে পেয়েছিল, চিনতে পেরেছিল। তাই লগ্‌-কেবিনের কাছে যাওয়া পর্যন্ত তিনি স্বীকার করছেন, কিন্তু ভিতরে ঢোকার কথা অস্বীকার করছেন।

চতুর্থত : রমা দাসগুপ্তার গল্পটা যে আদ্যন্ত বানানো তার প্রমাণ তাঁর তথাকথিত স্বামীর বুক-পকেট থেকে উদ্ধারপ্রাপ্ত ঐ কাগজখানায়। তিনি স্ত্রীর ঠিকানায় লিখেছেন ‘মিসেস্ রমা খান্না’, ‘মিসেস্ রমা কাপুর’ নয়। সুতরাং মহাদেওপ্রসাদ যে যশোদা কাপুর নন, একথা রমা দেবীও জানতেন, খান্নাজীও জানতেন। আমরা মৃতের পকেটে প্রাপ্ত কাগজখানা হস্তরেখাবিদদের দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছি। তাঁরা সন্দেহাতীত ভাবে বলেছেন হাতের লেখা মহাদেও প্রসাদ খান্নার।

পঞ্চমত : পাখিটাকে হত্যা করা। পাখিটা ঘটনার সময় ঐ লগ্-কেবিনেই ছিল। রমা দেবীর বাসায় নয়। পাখিটার এমন ক্ষমতা আছে যে, একবার মাত্র শুনেই কোনও বোল তুলে নিতে পারে। সূরযপ্রসাদ এবং গঙ্গারামজীর সাক্ষ্য এখনও গ্রহণ করা হয়নি। এ তথ্যটা তাঁদের সাক্ষ্যে প্রমাণ হবে—ঐ যে ‘রাম নাম সৎ হায়’ বোল্‌ল্টা ও একটু আগে পড়ল, ওটা সে একবার মাত্র শুনেই শিখে ফেলেছিল। এ-ক্ষেত্রেও রমা দেবী যখন পিস্তল দেখিয়ে মহাদেওকে ভয় দেখাচ্ছেন তখন খান্নাজী বলে ওঠেন : ‘রমা, মৎ মারো… পিস্তল নামাও’! ঠিক সেই মুহূর্তেই রমা দেবী গুলি করেন। পাখিটা সেই শব্দটাও তুলেছে। এবং তারপরে মহাত্মাজীর উচ্চারিত দুটি অন্তিম শব্দ : হায় রাম! মহাদেও প্রসাদ খান্নার জীবনেও ঐ দুটি শব্দের সঙ্গেই শেষ নিঃশ্বাস পড়ে। এখন ঘটনা হচ্ছে এই যে, রমা দেবী জানতেন—খান্নাজী তাঁর স্ত্রীকে ‘রমা’ বলে ডাকেন। মুহূর্তমধ্যে ওঁর মনে হয় হত্যাপরাধটা সেই সুরমা দেবীর স্কন্ধে চাপানো যায় কি না। কারণ রমা দেবীকে কেউই চেনে না, স্বতই ঐ বোলটা ‘সুরমা’কে চিহ্নিত করবে। অথচ তিনি তখন জানতেন না, সুরমার কোনও অকাট্য অ্যালেবাই আছে কিনা। তাই তিনি দু-এক দিন পরে আর একটি ময়না এনে ঐঘরে টাঙিয়ে দিয়ে মুন্নাকে নিজের বাসায় নিয়ে যান। তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন সুরমার অ্যালেবাই বিষয়ে। প্রশ্ন হতে পারে, পরে এসে উনি কেমন করে ঐ বন্ধ ঘরে ঢোকেন। এর সহজ জবাব হচ্ছে, ঐ লগ্‌-কেবিনে তিনি খান্নাজীর সঙ্গে তথাকথিত মধুচন্দ্রিমা যাপন করে যান। ফলে তাঁর কাছে একটি ডুপ্লিকেট চাবি থাকা খুবই সম্ভব। তারপর যে মুহূর্তে তিনি শুনলেন যে, তাঁকে পুলিস খুঁজছে, তৎক্ষণাৎ তাঁর কাউন্সেলের আদেশ অগ্রাহ্য করে তিনি তাঁর বাসায় ফিরে যান ও মুন্নাকে হত্যা করেন।

সংক্ষেপে এইটাই আমার সিদ্ধান্ত। আমি মনে করি, রমা দেবীর বিরুদ্ধে এভিডেন্স এমন জোরালো যে, যে-কোনও আদালতেই বিচার হ’ক না কেন ‘গিটি’ ভার্ডিক্ট হবেই। যত বড় ব্যারিস্টারই হন, রমা দেবীকে বাঁচাতে পারবেন না।

করোনোর প্রশ্ন করেন, মৃত্যুর সময়টা কিভাবে আপনি চিহ্নিত করছেন? ঐ যে বললেন ছয়ই সেপ্টেম্বর সকল এগারোটা—

—সেটা হাইলি টেক্‌নিক্যাল ব্যাপার, স্যার। ওর পিছনে অপরাধবিজ্ঞানসম্মত নানান সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ডিডাক্‌শান আছে। সে সব কথা বুঝিয়ে বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে, তাছাড়া অনেক ‘টেকনিক্যাল ডিটেইল্স্’…ওয়েল, ওটা স্যার একজন বিশেষজ্ঞের সিদ্ধান্ত বলেই আপাতত ধরে নিন।

করোনার কী বলবেন ভেবে পান না।

বাসু বলেন, য়োর অনার! যতই ‘হাইলি টেকনিক্যাল’ হোক, ব্যাপারটা আমরা একটা আপ্তবাক্য বলে মেনে নিতে পারি না। আমি মনে করি, এ-কেসে মৃত্যুর সময়টাই হচ্ছে একটা ভাইটাল ব্লু। সুতরাং সাক্ষীর যুক্তি-নির্ভর সিদ্ধান্তটা আমরা শুনতে চাই।

করোনার বলেন, মৃত্যুর সময়টা যে ছয় তারিখ সকাল এগারোটা এটা প্রায় সকলেই মেনে নিয়েছেন। আমি সময় সংক্ষেপ করতে চাইছিলাম মাত্ৰ।

বাসু বলেন, ‘সবাই’ বলতে কে কে আমি জানি না। আমি মেনে নিইনি। অটোপ্সি সার্জেনকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম মৃত্যুর সময় সম্বন্ধে। তিনি বললেন, পাঁচ-সাত দিনের বাসি মড়া—এতদিনে সব পচে ঢোল হয়ে যাবার কথা। নিতান্ত ঠাণ্ডার মধ্যে ছিল বলে তা হয়নি। মৃত্যুর সময় সম্বন্ধে তিনি কিছুই আন্দাজ করতে পারেন না। অপর পক্ষে ছয়ই সেপ্টেম্বর সকালে, ঘটনাচক্রে আমার মক্কেল সেখানে উপস্থিত ছিল। এজন্য আমি জানতে চাই কী কী এভিডেন্সের মাধ্যমে ঐ বিশেষজ্ঞ ভদ্রলোক মৃত্যুর সময়টা চিহ্নিত করছেন।

করোনার কিছু বলার আগেই সতীশ বর্মন বলে ওঠে, স্যার। ওঁর মনে যখন সংশয় জেগেছে, তখন সেটা মিটিয়ে দেওয়াই ভালো। আমি এ প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চাইছিলাম এ জন্য যে, ব্যাপারটা ‘হাইলি টেক্‌নিক্যাল’! অপরাধবিজ্ঞান বিষয়ে যাঁর অভিজ্ঞতা নেই তাঁদের পক্ষে এই সব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সূত্রের ধারণ করা কঠিন। যা হোক আমি বলছি, শুনুন। বুঝবার চেষ্টা করুন। প্রথমত জানা তথ্যগুলি তৌল করে দেখুন। আমরা জানি যে, খান্নাজী উদ্বোধনের দিনে ওখানে উপস্থিত থাকতে চেয়েছিলেন। তিনি দোসরা শ্রীনগর থেকে রওনা হয়ে অন্য কোথাও দিন দু-তিন ছিলেন বটে তবে পাঁচই বিকাল নাগাদ তিনি নিশ্চয়ই লগ্‌-কেবিনে পৌঁছান। পহেলগাঁও থেকে ঐ পথে যে বাসটা যায় সেটা ঐ ট্রাউট-প্যারাডাইস্ `বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছায় বিকাল তিনটায়। ফলে তিনি পদব্রজে লগ্‌-কেবিনে সওয়া তিনটার মধ্যেই পৌঁছান। রাত আটটা পর্যন্ত যে তিনি জীবিত ছিলেন তার অকাট্য প্রমাণ আছে। কারণ ঐ সময়ে তিনি ঐ অঞ্চল থেকে টেলিফোনে তাঁর সেক্রেটারি গঙ্গারামজীর সঙ্গে কথা বলেন। গঙ্গারামজী ঐ সামনেই বসে আছেন, তাঁর সাক্ষ্য এখনও নেওয়া হয়নি। যখন নেওয়া হবে তখন সে তথ্যটা জানবেন। গঙ্গারামজী দীর্ঘ দশ বছর ধরে খান্নাজীর একান্ত সচিব; মনিবের কণ্ঠস্বর সম্বন্ধে তিনি ভুল করবেন না। তাছাড়া ওঁরা টেলিফোনে এমন একটা বিষয়ে আলোচনা করেন যা তৃতীয় ব্যক্তির পক্ষে জানা অসম্ভব। ফলে প্রমাণ হল, পাঁচই সেপ্টেম্বর সোমবার, রাত আটটা পর্যন্ত তিনি ঐ লগ্‌-কেবিনেই জীবিত ছিলেন। দেখা যাচ্ছে, তিনি ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়েছিলেন এবং সেটা সাড়ে পাঁচটায় বেজে দম খতম হয়ে থেমে গেছে। সুতরাং বোঝা যায় তিনি পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় গাত্রোত্থান করেছিলেন। দ্রুতগতি প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে উনি কফি বানান, ডিমের পোচ বানান এবং প্রাতরাশ সেরে নেন। উনি খুব সকাল সকাল মাছ ধরা শুরু করতে চেয়েছিলেন, কারণ রোদ বেশি উঠে গেলে মাছে টোপ খায় না। ফলে এঁটো বাসন ধোওয়ার সময়ও তাঁর ছিল না। আন্দাজ সাড়ে ছয়টা সাতটা নাগাদ তিনি মাছ ধরতে বেরিয়ে যান। উনি একজন দক্ষ মেছুড়ে। অন্যান্য মেছুড়ের ভিড় তখনও হয়নি। ফলে বেলা দশটার মধ্যেই তিনি দৈনিক ঊর্ধ্বসীমায় যতটা মাছ ধরা আইন-সম্মত সেই দেড় কে-জি মাছ ধরে লগ্‌-কেবিনে ফিরে আসেন। ফিরে এসে এক্ষেত্রে তাঁর প্রথম কাজই হওয়া উচিত ছিল মাছগুলো ধুয়ে কেটে পিত্তি ফেলে দেওয়া। তিনি সেসব কিছুই করেননি। মানে করার সময় পাননি। কোট ও প্যান্ট খুলে পায়জামা পরে তিনি হয়তো আবার এক কাপ কফি বানাতে যাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই রমা দেবী এসে পৌঁছান। তারপর কী হয়েছিল আমি তা আগেই বলেছি।

করোনার প্রশ্ন করেন, কিন্তু ঠিক এগারোটা কেন বলছেন?

—ঠিক এগারোটা বলিনি। বলেছি, সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে। ঐ সময়টা আমরা কীভাবে নির্ধারণ করছি শুনুন। বস্তুত এখানেই অভিজ্ঞতার দরকার—এগুলি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ‘ক্লু’ যা সাধারণ মানুষের নজরে পড়বে না, অপরাধবিজ্ঞানীরই শুধু নজর হবে। প্রথম কথা : মৃতদেহের পরনে ছিল পায়জামা এবং সোয়েটার, এবং চেয়ারের হাতলে গরম কোট, দেওয়ালে ঝোলানো ছিল গরম প্যান্ট। আমরা থার্মোমিটারের সাহায্যে ঐ লগ্‌-কেবিনের তাপমাত্রার একটি গ্রাফ তৈরি করেছি। দেখা যাচ্ছে, সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত ঐঘরের চালে সরাসরি সূর্যালোক পড়ে না, তাই ঘরটা বেশ ঠাণ্ডা থাকে। বেলা এগারোটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত সরাসরি রোদ পেয়ে ঘরটা বেশ গরম হয়ে ওঠে। এবং চারটের পর দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। রাত্রে রীতিমতো শীত করে। মৃতের পোশাক প্রমাণ করে মৃত্যু সময়টা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে। বেশি ঠাণ্ডা হলে উনি কোটটা পরে থাকতেন। বেশি গরম হলে উনি সোয়েটারটা খুলে ফেলতেন। ফলে মৃত্যুর সময়টা হয় সকাল সাড়ে দশটা এগারোটা অথবা বিকাল তিনটে চারটে। শেষোক্ত সময়টাকে বাদ দিচ্ছি এজন্য যে, তিনি মধ্যাহ্ন আহার করেননি। করলে নিশ্চয়ই তিনি ঐ মাছগুলি ধুয়ে কেটে রান্না করতেন। ফলে রমা দেবীর প্রবেশমুহূর্তটা হচ্ছে সাড়ে দশটা থেকে এগারোটা!

বাসু বললেন, আমি আপনাকে কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই। প্রথম কথা, আপনার থিওরি অনুসারে খান্নাজী ঐ লগ্-কেবিনে আসেন পাঁচই বিকালে এবং হত হন ছয় তারিখ বেলা সাড়ে দশ-এগারোটায়। আমরা জেনেছি, খান্নাজীর সুটকেসে দশ-প্যাকেট সিগারেট ছিল—যা থেকে মনে হয় তিনি বেশ হেভি স্মোকার। অথচ লগ্‌-কেবিনে ময়লা ফেলার ঝুড়িতে অথবা কাছেপিঠে কোনও খালি সিগারেটের প্যাকেট পাওয়া যায়নি। শুধু যোগীন্দর সিং বলেছেন—ওঁর পকেটে একটা প্যাকেট দেখেছিলেন যাতে আটটা সিগারেট ছিল। এ-ক্ষেত্রে কি আপনি মনে করেন খান্নাজীর মতো স্মোকার পাঁচ তারিখ বিকাল থেকে ছয়ই বেলা এগারোটার মধ্যে মাত্র দুটি সিগারেট খেয়েছিলেন?

সতীশ বর্মন হেসে বললেন, কিন্তু আপনি ভুলে যাচ্ছেন—ছয়ই সকালে তিনি নদীর ধারে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। ঠিক কোথায় বসে তিনি মাছ ধরেছিলেন তা আমরা জানি না। হয়তো সেখানে পড়ে আছে একটা খালি সিগারেটের প্যাকেট। শুধু তাই নয়—ওঁর লগ্‌-কেবিনের টেলিফোনটা বিকল হয়ে পড়ায় উনি পাঁচই রাত আটটা নাগাদ অন্য কোনও জায়গা থেকে ওঁর একান্ত সচিবকে টেলিফোন করেন। ফলে সেখানেও খালি প্যাকেটটা ফেলে আসতে পারেন!

বাসু বলেন, আই সী! আচ্ছা এবার অন্য একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা যাক। যোগীন্দর সিং বলেছেন—ফায়ার-প্লেসে কাঠগুলো সাজানো ছিল, আগুন জ্বালার অপেক্ষায়। তাই না?

—হ্যাঁ।

—আপনার থিওরি অনুসারে খান্নাজী সকালবেলা সাড়ে পাঁচটায় উঠে খুব তাড়াতাড়ি প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে দ্রুতহাতে প্রাতরাশ বানিয়ে খেয়ে নেন। তাই নয়?

—হ্যাঁ, তাই; কারণ সকাল-সকাল তিনি মাছ ধরতে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।

—প্রাতঃকৃত্যাদির মধ্যে দাঁতমাজা ও দাড়িকামানো নিশ্চয়ই পড়ে?

—সেটা উনি আগের দিন সন্ধ্যা বা রাত্রেও করে থাকতে পারেন। আমরা জানি না, উনি রাত্রে দাঁত মাজতেন না সকালে।

সে যাই হোক উনি লগ্‌-কেবিনে পৌঁছে অন্তত একবার দাঁত মাজেন ও দাড়ি কামান—কিন্তু দেখা যাচ্ছে তাঁর টুথব্রাশ, পেস্ট ও দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম সব কিছু ছিল তাঁর সুটকেসে। এটা আপনার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয় না কি? কোনও নতুন জায়গায় কেউ গেলে এবং সেখানে পাঁচ-সাতদিন থাকবেন জানা থাকলে দাঁতমাজা ও দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম কেউ বারে বারে সুটকেসে তোলে না। বাথরুমের তাকে রেখে দেয়। নয় কি?

বর্মন একটু অশান্তভাবে বলে, তা থেকে কিছুই প্রমাণ হয় না; হয়তো উনি স্নান করার সময় দাঁত মাজেন ও দাড়ি কামান। মাছ ধরে ফিরে এসে স্নানের আগেই তো তিনি মারা যান।

—রাত্রে দাঁত না মেজে এবং সকালেও না মেজে কেউ ব্রেকফাস্ট করে?

—এসব ছোটখাটো অসঙ্গতি সব কেস-এই থাকে। আমি বরাবর দেখেছি—তদন্ত করতে গেলে এমন দু-একটা ছোটখাটো অসঙ্গতি থেকেই যায়।

—তখন আপনি কী করেন?

—ঐ ছোটখাটো অসঙ্গতিগুলোকে অগ্রাহ্য করি।

—এমন কতগুলি অসঙ্গতি অগ্রাহ্য করে আপনি আপনার ঐ থিওরিটা খাড়া করেছেন?

—ঐ একটাই। মানে স্বাভাবিক হত যদি টুথব্রাশ, পেস্ট এবং দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম বাথরুমে থাকত।

—বুঝলাম। আপনার থিওরি অনুসারে খান্নাজী কখন ঐ ফায়ার-প্লেসের কাঠগুলো সাজিয়েছিলেন?

—সকালে নিশ্চয়ই নয়, তখন তাড়া ছিল। মাছ ধরে ফিরে এসেই নিশ্চয় তা করেছিলেন।

—কিন্তু মাছ ধরে ফিরে এসে তাঁর প্রথম কাজ হওয়া উচিত ছিল পলো থেকে মাছগুলো বার করে ধুয়ে ফেলা। মাছের পিত্তি গেলে ফেলা, কারণ কেবিনটা তখন গরম হচ্ছে। রান্নার যোগাড় করা। কারণ মধ্যাহ্ন আহারটা আগে করতে হবে; তারপর রাত্রের জন্য ফায়ার-প্লেস সাজানো, যেটা বিকালেও করা চলত। অথচ উনি মাছগুলো না ধুয়ে, রান্নার কোনও যোগাড় না করে ফায়ার-প্লেসটা সাজাতে বসলেন? এটাকে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না কি?

সতীশ বর্মন একটু বিরক্তভাবেই বলল, এমনও হতে পারে তিনি আগের দিন বিকালেই কাঠগুলো সাজিয়েছেন?

–সে কী? তারপর সারারাত শীতে হি হি করে কেঁপেছেন, আগুন জ্বালেননি?

সতীশ একটু অস্বস্তি বোধ করছে, তা স্পষ্টই বোঝা গেল। স্বীকার করতে বাধ্য হল—না, আগের দিন সন্ধ্যায় নয়। ছয় তারিখেই তিনি কাঠটা আবার সাজান।

—কিন্তু কখন? মাছ ধরতে যাবার আগে, না মাছ ধরে ফিরে এসে?

সতীশ বিরক্ত হয়ে বলে, তা আমি কেমন করে জানব?

—এক্সজ্যাক্টলি! আপনি তা জানেন না। অর্থাৎ যুক্তিনির্ভর কোনও অনুমানও করতে পারছেন না, কারণ এটাও একটা ছোটখাটো অসঙ্গতি যা অগ্রাহ্য করতে হবে। তৃতীয়ত : আপনি নিশ্চয় লক্ষ করেছেন লগ্-কেবিনের দেওয়ালে একটা নিয়মাবলী টাঙানো আছে এবং তাতে ঐ লগ্-কেবিনের যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তির উল্লেখ আছে—একটি টেবিল, একটি চেয়ার, বাসনপত্র কী কী আছে ইত্যাদি।

—হ্যাঁ, দেখেছি। তাতে কী হল?

—তাতে লেখা আছে, সাতদিন অন্তর লগ্-কেবিনে লন্ড্রীর ব্যবস্থা করা হয়। এজন্যই আলমারিতে ছয়টি ধোপ বিছানার চাদর এবং বিছানায় পাতা একটি পাটভাঙা চাদর আছে, তাই নয়?

—সম্ভবত তাই।

—এবং যোগীন্দর সিংএর জবানবন্দি অনুসারে দেখা যাচ্ছে বিছানাটি পরিপাটি টান-টান করে পাতা। নিশ্চয়ই ছয়ই তারিখে মাছ ধরতে যাওয়ার আগে খান্নাজী স্বহস্তে বিছানাটি পাতেন। অথবা ফিরে এসে? তাই নয়! যেহেতু পাত্রে ঐ বিছানায় তিনি শুয়েছিলেন?

—নিশ্চয়ই তাই।

—এক্ষেত্রে কি আমাদের আশা করা উচিত নয় যে, আলমারির তাকে পাঁচটি ধোপ চাদর থাকবে এবং নিচের তাকে একটা সয়েলড চাদর থাকবে?

সতীশ বর্মনের পুনরায় ভ্রূকুঞ্চন হল। বললে, এ-ক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে—খান্নাজী সয়েল্ড লিনেনটা পরিবর্তন করেননি।

—কেন? খান্নাজী তো ঐ ট্রাউট-প্যারাডাইস্-এ বছর-বছর যান। তিনি তো জানেন—সাত দিনের জন্য সাতটা চাদর আছে?

—এটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্স নয়।

—আপনি তাই মনে করেন? অর্থাৎ এটাও একটা ছোটোখাটো অসঙ্গতি যা অগ্রাহ্য করতে হবে, তাই নয়? বেশ, চতুর্থত : অ্যালার্ম ঘড়িটার দম শেষ হয়ে থেমে গিয়েছিল, নয়?

—হ্যাঁ।

—অথচ প্ল্যানে দেখছি বালিশটা যেখানে আছে সেদিকে মাথা করে শুলে শুয়ে শুয়েই অ্যালার্ম ঘড়িটার নাগাল পাওয়া যায়। এ-ক্ষেত্রে অ্যালাম বাজতে শুরু করলেই খান্নাজী হাত বাড়িয়ে সেটাকে থামিয়ে দেবেন, এটাই কি স্বাভাবিক নয়? আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?

—কারও কারও ঘুম ভাঙতে দেরি হয়।

—তা তো হয়ই। কিন্তু অ্যালার্ম ক্লকের শব্দে যার ঘুম ভাঙে, তার ন্যাচারাল রিফ্লেক্স অ্যাকশনই হয় হাত বাড়িয়ে ঘড়িটার শব্দ বন্ধ করা। তাই নয়?

—ওভাবে কিছুই প্রমাণ হয় না। অনেকে অ্যালার্ম ঘড়ি হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দেবার পরও ঘুমিয়ে পড়ে।

—তা পড়ুক। এখানে তো তা হয়নি। কারণ ঘড়িটার অ্যালার্ম দম সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। হাত বাড়িয়ে থামানো হয়নি।

—তাহলে ধরে নিতে হবে ‘অ্যালার্মের শব্দে তাঁর ঘুম ভাঙেনি। হয়তো আরও আধঘণ্টা পরে তাঁর ঘুম ভাঙে। ধরুন ছ’টায়। তাই হবে, সেজন্যই তিনি তাড়াতাড়ি করে—

ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বসু বলেন, ফায়ার-প্লেসে কাঠ সাজাতে বসে যান!

—আমি তা বলতে চাইনি।

—তবে কী বলতে চান? তাড়াতাড়ি করে সয়েল্ড চাদরটা কেচে ইস্ত্রি করতে লেগে যান?

সতীশ বর্মন বলে ওঠে, এ সবই অবান্তর কথা! সব অবাস্তব।

—কেন অবাস্তব? কেন এতগুলো সূত্রকে আপনি অগ্রাহ্য করছেন?

সতীশ বর্মন কোনও প্রত্যুত্তর করে না।

বাসু বলেন, মিস্টার বর্মন, আপনি কি বুঝতে পারছেন, আপনার থিয়োরিটা দাঁড়াচ্ছে না! অসংখ্য অসঙ্গতি থেকে যাচ্ছে।

বর্মন রুখে ওঠে, তার মানে আপনি কি বিকল্প কোনও থিয়োরি শোনাতে চান?

—এক্সজ্যাক্টলি। এবং এমন একটা থিয়োরি আমি শোনাতে চাই যাতে কোনও অসঙ্গতি নেই। যা জিগস্ ধাঁধার মত খাঁজে-খাঁজে মিলে যাবে। শুনবেন?

—কী আপনার থিয়োরি?

—মহাদেও প্রসাদ খান্না খুন হয়েছেন পাঁচই বিকাল সাড়ে চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে!

—পাঁচই? অসম্ভব! ছয় তারিখ সূর্যোদয়ের আগে ট্রাউট মাছ ধরা সম্পূর্ণ বে-আইনি ব্যাপার। লগ্‌-কেবিনের ঐ দেড় কে. জি. মাছের অস্তিত্বতেই প্রমাণিত হচ্ছে খান্নাজী পাঁচ তারিখে খুন হননি!

বাসু বলেন, মিস্টার বর্মন, এবার আপনাকে একটা অতি শক্ত প্রশ্ন করি— এক্সপার্ট হিসাবে বলুন, মানুষ খুন করা কি আইন-সঙ্গত কাজ?

সতীশ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। জুবাব দেওয়া বাহুল্য বোধে!

—সুতরাং মানুষ খুনের মতো বে-আইনি কাজ যে লোকটা করতে যাচ্ছে সে কি দেড় কে. জি. মাছ আগের দিন ধরতে পারে না? কিম্বা বাজার থেকে কিনতে? আর তা যদি পারে, তাহলে আপনি কি দয়া করে করোনার এবং জুরি মহোদয়ের কাছে জানাবেন যে, আপনার বিশেষজ্ঞের মতামতের দাম দেড় কে. জি. ট্রাউট মাছের সমান? আপনার সমস্ত যুক্তিটাই ঝুলছে ঐ দেড় কে. জি. মাছের পলোটার সুতোয়?

বর্মন নিষ্পলক নেত্রে শুধু তাকিয়ে থাকে। জবাব দিতে পারে না। কী যেন ভাবছে সে।

বাসু বলে চলেন, ধীরভাবে চিন্তা করে দেখুন মিস্টার বর্মন—আপনি প্রথমেই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, রমা দাসগুপ্তা ছয়ই সকাল এগারোটার সময় খান্নাজীকে খুন করেছে। তাই ঐ সিদ্ধান্তের পরিপূরক তথ্যগুলিই আপনি বেছে নিয়েছেন— ঐ তথ্যের পরিপন্থী সূত্রগুলিকে পরিহার করে। নৈর্ব্যক্তিক উদাসীনতায় বিচার করলে স্পষ্টই বুঝতে পারবেন খান্নাজী খুন হয়েছিলেন পাঁচ তারিখ বিকাল চারটায় এবং হত্যাকারী বুঝতে পেরেছিল ঐ নির্জন লগ্-কেবিনে মৃতদেহ আবিষ্কৃত হবে অন্তত চার-পাঁচদিন পরে। তাই ছয় তারিখ সকালের দিকে কোনও বজ্র-আঁটুনি অ্যালেবাই তৈরি করে সে দেড় কে. জি. মাছও ঐ কেবিনে রেখে যায়। সে জানত, পুলিস ধরে নেবে খুনটা হয়েছে ছয় তারিখ সকালে।

কেউ কোনও কথা বলছে না। আদালত কৰ্ণময়। সতীশ বর্মন মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টিতে কী ভাবছে। বাসু বলেই চলেন, এবং ভেবে দেখুন মিস্টার বর্মন, এই সিদ্ধান্তে আসতে হলে আপনাকে ছোটখাটো কোনও অসঙ্গতিই অগ্রাহ্য করতে হচ্ছে না। বিছানার চাদরের হিসাব মিলে যাচ্ছে, যেহেতু রাত্রে তিনি ঐ খাটে ঘুমাননি। অ্যালার্ম ঘড়িটা দম ফুরিয়ে থেমে যাওয়ার মধ্যে কোনও অসঙ্গতি নেই কারণ লগ্‌-কেবিনের একমাত্র বাসিন্দা পূর্বদিনই মরে পড়ে আছেন মাটিতে। সিগারেটের খালি প্যাকেট কেবিনের ধারেকাছে নেই, কারণ মাত্র এক ঘণ্টা পূর্বে তিনি এসেছেন ও দুটি মাত্র সিগারেট খেয়েছেন। ফায়ার-প্লেসের কাঠগুলো তিনি সাজাননি, ওটা সাজানোই ছিল। কোট ও গরম প্যান্ট না পরা এবং সোয়েটার গা থেকে না খোলা সঙ্গতিপূর্ণ, কারণ আপনিই বলেছেন বিকাল চারটে থেকে সাড়ে চারটের সময় ঘরটার অবস্থা না-গরম না-ঠাণ্ডা। সুটকেস থেকে দাঁত মাজা বা দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম বার করার কোনও প্রয়োজন হয়নি। আর হত্যাকারী ঐ পাখিটার প্রতি অতি-দরদী হয়ে উঠেছিল শুধু এজন্যেই যে মুন্না ঐ বোলটা পড়ে—যাতে হত্যাপরাধ রমা দেবীর উপর চাপিয়ে দেওয়া যায়। আমি একটি বিষয়ে আপনার সঙ্গে একমত, আমারও ধারণা খান্নাজী ঐ কেবিনে পৌঁছান পাঁচই বিকাল সাড়ে তিনটায়। কোট প্যান্ট খুলে পায়জামা পরে নেন। একটু কফি বানিয়ে এবং দুটি ডিম ও রুটি সহযোগে বৈকালিক টিফিন সারেন। চারটে সাড়ে চারটে নাগাদ দরজায় কেউ টোকা দেয়। খান্নাজী দরজা খুলে আগন্তুককে দেখেন—সে ওঁর পরিচিত ও বিশ্বাসভাজন। তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি—লোকটা এসেছে তাঁকে খুন করতে। এবং তার পকেটে একটা লোডেড রিভলভার। কিন্তু লোকটা হঠাৎ দেখতে পায় টেবিলের উপর বা খাটের উপর পড়ে আছে মন-বাহাদুরের রিভলভারটা, যেটা খান্নাজী আত্মরক্ষার্থে এনেছিলেন তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে। সম্ভবত পাখিটার ঐ অদ্ভুত বোলটা শুনেই খান্নাজী বুঝতে পারেন কেউ ওঁকে খুন করতে চায় এবং অপরাধটা রমা দেবীর কাঁধে চাপিয়ে দিতে চায়। কিন্তু ঐ আগন্তুকই যে সেই হত্যাকারী তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। আগন্তুক দ্রুতগতিতে মন-বাহাদুরের রিভলভারটা তুলে নেয় এবং দুটি ট্রিগারই একসঙ্গে টেনে দেয়। সে এটা আত্মহত্যার কেস বলে চালাতে চায়নি—সে হত্যাপরাধটা রমা দেবীর স্কন্ধেই চাপাতে চেয়েছিল! তাই ফিঙ্গার প্রিন্ট মুছে নিয়ে রিভলভারটা দূরে ছুঁড়ে দেয়। দেড় কে. জি. মাছ সে নিয়েই এসেছিল—সেটা রেখে দিয়ে, পাখিটার জন্যে এক মগ জল কিছু বিস্কুট ছড়িয়ে দিয়ে সে চলে যায়—যাবার সময় ইয়েল-লকওয়ালা দরজাটা টেনে দেয়। নাউ মিস্টার বর্মন, আপনি অপরাধবিজ্ঞানে বিশেষ শিক্ষাপ্রাপ্ত—সি. বি. আই-য়ের এক্সপার্ট। আপনি কি অনুগ্রহ করে আমাকে একটা বিরুদ্ধ যুক্তি—একটিমাত্র সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অসঙ্গতি দেখাতে পারেন যা আমার এই থিয়োরির সাথে মিলছে না?

সতীশ বর্মন এর জবাবে যা বললে তা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। বললে, না! আমি বিশ্বাস করি না জগদীশ মাথুর এ কাজটা করেছে–কারণ রমা দাসগুপ্তাকে সে আদৌ তখন চিনত না।

বাসু বলেন, এটা আমার প্রশ্নের জবাব নয় মিস্টার বর্মন! আমি জানতে চাই, আমার ঐ থিয়োরিটা কেন মানতে রাজী নন আপনি? কোথাও কোনও অসঙ্গতি দেখতে পাচ্ছেন?

—হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সতীশ। বলে, পাচ্ছি! প্রকাণ্ড বড় একটা অসঙ্গতি! পাঁচই বিকাল চারটের সময় খান্নাজী হত বলে তিনি কেমন করে ঐদিন রাত আটটার সময় ফোন করলেন?

—কাকে?

—ওঁর একান্ত…জাস্ট এ মিনিট—তার মানে-

—এই তো! ঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছেন আপনি! তার মানে মহাদেও প্রসাদ খান্না পাঁচই রাত আটটায় কোনও টেলিফোন করেননি!

—বাই জোভ! চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সতীশ বৰ্মন!

—একজাক্টলি। এতক্ষণে আপনি প্রকৃত অপরাধবিজ্ঞানীর মতো একটা কথা বলেছেন। খান্নাজীকে যে খুন করে সে লোকটার নাম…গঙ্গারাম যাদব!

শর্মাজীও উঠে দাঁড়িয়েছেন : মিস্টার যাদব! মিস্টার গঙ্গারাম যাদব!

দেখা গেল, যে চেয়ারখানাতে গঙ্গারাম যাদব এতক্ষণ বসেছিলেন সেটা শূন্যগর্ভ!

করোনার বললেন, আধঘণ্টার জন্য আদালতের কাজ স্থগিত রইল। মিস্টার যোগীন্দর সিং…কুইক!

কিন্তু কোথায় যোগীন্দর? সেও নিঃশব্দে বেরিয়ে গেছে সকলের অলক্ষ্যে গঙ্গারাম অন্তর্ধান করার সঙ্গে সঙ্গে।

বাসু এদিকে ফিরে বললেন, রমা, তোমার যন্ত্রণার শেষ হয়েছে। আর কেউ এরপর তোমাকে বিরক্ত করবে না। এখন তুমি প্রাণভরে কাঁদতে পার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *