প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব

উদাসী রাজকুমার – ২.২

বন্দিনী তলতাদেবী কারাগারের মধ্যে ঘুমিয়ে ছিলেন, হঠাৎ একটা শব্দ পেয়ে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে তাকিয়েও তিনি প্রথমে বুঝতে পারলেন না, কিসের শব্দ কিংবা শব্দটা কোথা থেকে আসছে। 

দিনে ও রাতে সব সময়েই এই ঘর অন্ধকার থাকে। শুধু মাঝে-মাঝে একজন প্রহরী মশাল জ্বেলে খাবার দিতে আসে। তিনি দেখলেন, একটু দূরে একটা মশাল পড়ে আছে, কোনও লোককে দেখা যাচ্ছে না। 

আবার একটা হেঁচকির মতন শব্দ হল। 

তলতাদেবী উঠে বসে জিজ্ঞেস করলেন, “কে?”

এবার শব্দটা থেমে গেল। 

তলতাদেবী বুঝতে পারলেন, ঘরের মধ্যে কোনও লোক আছে। প্রহরীরা এসে খাবার দিয়ে চলে যায়, কোনওদিন তো মাটিতে মশাল ফেলে রাখে না। 

তলতাদেবী আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কে?” 

এবার একজন কেউ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “মহারানি! মহারানি!”

এবারে তলতাদেবী আরও অবাক হলেন। এই ঘরে যে দু’জন প্রহরী পালা করে আসে, তারা দু’জনেই বোবা-কালা। তারা মহারানির কোনও কথা শুনতে পায় না, তারা মহারানির সঙ্গে কোনও কথাও বলতে পারে না। ছম্ভীর ইচ্ছেতেই এ রকম ব্যবস্থা হয়েছে। আজ তবে ঘরের মধ্যে কে কথা বলছে? 

এতকাল ধরে বন্দিনী থাকলেও তলতাদেবীর মেজাজ রানিরই মতন রয়েছে, তিনি ভয় পান না, তাঁর কণ্ঠস্বরে আদেশের সুর ফুটে ওঠে। 

তিনি কড়া গলায় বললেন, “কে ওখানে? লুকিয়ে রয়েছ কেন?”

এবারে অন্ধকারের লোকটি বলল, “মহারানি, আমি জয়পাল!” 

এই নাম শুনেও তলতাদেবী চিনতে পারলেন না। কে জয়পাল? এই নিশ্ছিদ্র কারাগারের মধ্যে লোকটি এল কী করে? 

তলতাদেবী নিজেই এগিয়ে এসে মশালটি তুলে নিলেন। সেই আলোতে তিনি দেখতে পেলেন ঘরের এক কোণে হাঁটুতে মুখ গুঁজে একজন লোক বসে আছে, তার পোশাক প্রহরীদের মতন, তার কোমরে আঁটা আছে তলোয়ার। 

লোকটি মুখ তুলল। তার দু’চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। তার সারা মুখে পড়ি, সেই দাড়ি ভিজে গেছে চোখের জলে। 

একজন প্রহরী ঘরের এক কোণে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, এ আবার কী অদ্ভুত ব্যাপার? 

লোকটি বলল, “মহারানি, আমি শিল্পী জয়পাল। আমাকে চিনতে পারছেন না?” 

মহারানি বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, “শিল্পী?” 

লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বলল, “প্রণাম, মহারানি!” 

তলতাদেবীর বুক খালি করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। বহু বছর বাদে কেউ তাঁকে মহারানি বলে ডাকল, কেউ তাঁকে প্রণাম জানাল। তিনি তো আর এ রাজ্যের মহারানি নন, তিনি সামান্য একজন বন্দিনী। 

জয়পাল বলল, “মহারানি, আপনার মনে নেই? একবার আমাদের গ্রামে দাবানল এসে হানা দিয়েছিল। আমি নিজের বাড়িতে বসে আপনার মূর্তি গড়ছিলাম, সব কিছু পুড়ে যেত, তখন আপনি এসে আমাদের বাঁচালেন।” 

তলতাদেবী অস্ফুট স্বরে বললেন, “তুমি সেই শিল্পী জয়পাল? তুমি এখানে এলে কী করে?” 

জয়পাল বলল, “সে এক লম্বা কাহিনী, মহারানি! আপনি রাজবাড়ির উদ্যানে আমার স্থান করে দিয়েছিলেন। সেখানে আমি মনের আনন্দে মূর্তি গড়তাম। হঠাৎ সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেল। মহারাজের মৃত্যু হল। আপনিও কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আপনি বেঁচে আছেন না মারা গেছেন, তা-ও জানতে পারিনি প্রথমে। আমি আপনার একটা ছোট মূর্তি গড়েছিলাম, ছোট রাজকুমার তীক্ষ্ণ সেটা নিয়ে গিয়েছিল রাজবাড়ির মধ্যে। সেটা দেখে রাজপুরোহিত ছম্ভী দারুণ রেগে গেলেন, মূর্তিটা ভেঙে ফেললেন। আমাকেও হত্যা করার আদেশ দিলেন। ছম্ভী নিজেই তো রাজা হয়ে বসেছেন, তা জানেন কি? উনি সাঙ্ঘাতিক নিষ্ঠুর, কত লোককে যে মেরে ফেলার আদেশ দেন, তার ঠিক নেই।” 

তলতাদেবী জিজ্ঞেস করলেন, “ছম্ভী তোমাকে হত্যা করার হুকুম দিয়েছিলেন, তবু তুমি বাঁচলে কী করে?” 

জয়পাল বলল, “বাঁচা খুবই শক্ত ছিল। আমি পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলাম বেণুপালের বাড়িতে। বেণুপাল আমার স্ত্রীর ভাই, আমাকে খুব শ্রদ্ধা-ভক্তি করে। সে-বাড়ির গোয়ালঘরে লুকিয়ে রইলাম দিনের পর দিন। কিন্তু সেভাবে তো বেশিদিন থাকা যায় না। লোকে জেনে যাবেই। এক সময় বেণপাল একটা ভাল বুদ্ধি করল। আমার মাথায় তখন বড়-বড় চুল, মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফ, আমাকে সহজে চেনা যায় না। সেই অবস্থায় আমাকে নিয়ে গিয়ে বেণুপাল প্রহরীদের দলে ভর্তি করে দিল। তখন কিছু নতুন প্রহরী নেওয়া হচ্ছিল। আমি অন্য কোনও ছদ্মবেশ ধরে থাকলেও প্রহরীরা একদিন-না-একদিন ধরে ফেলতই আমাকে। কিন্তু প্রহরী সেজে থাকলে কে আমাকে সন্দেহ করবে? অনেক সময় আমিই অন্য প্রহরীদের সঙ্গে জয়পালকে খুঁজতে গেছি। এখন আমার নাম বজ্রপাণি।” 

তলতাদেবী বললেন, “ছিলে শিল্পী, হয়ে গেলে সৈনিক?” 

জয়পাল বলল, “হ্যাঁ, মহারানি! আমি প্রাণে বেঁচে গেলাম বটে কিন্তু আমার মনে সুখ নেই। বেণুপাল আমাকে সাবধান করে দিয়েছে, কিছুতেই আর আমার মূর্তি গড়া চলবে না। কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও আর জানতে না পারে যে, আমি এককালে শিল্পী ছিলাম! মহারানি, আপনিই বলুন, এককালে আমি এই হাত দিয়ে পাথর কেটে মূর্তি বানাতাম, এখন কি এই হাত দিয়ে তলোয়ার-বর্শা ধরতে ভাল লাগে?” 

তলতাদেবী জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি আমার মূর্তি গড়েছিলে বলে ছম্ভী তোমাকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবু তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে কোন সাহসে? বোবা-কালা প্রহরীদের বদলে তুমি এলেই বা কী করে?” 

জয়পাল বলল, “যে বোবা-কালা রক্ষীটি এখানে আসত, গতকাল থেকে তার ভেদ-বমি হচ্ছে, তার বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতা নেই। হঠাৎ অন্য একজন বোবা-কালা রক্ষী পাওয়া যাবে কোথায়? কারও জিভ কেটে বোবা করে দেওয়া যায় বটে, তবু তো সে কানে শুনতে পাবে। আমার শ্যালক বেণুপাল এখন এই কারাগারের অধ্যক্ষ। তাকে বলে কয়ে রাজি করিয়ে আমি এখানে এসেছি।” 

কথা বলতে-বলতে আবার জয়পালের চোখে জল এসে গেল। 

বাঁ হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে সে ধরা গলায় বলল, “নিয়তি! নিয়তি! এতকাল পর আপনাকে আবার দেখতে পেলাম। কিন্তু মহারানি, আপনাকে প্রথম দেখে আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। মশালের আলোয় দেখলাম, আপনি মেঝের ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে আছেন। এত বড় একটা দেশের মহারানি, সোনার পালঙ্কে দুধের মতন সাদা বিছানায় আপনার শুয়ে থাকার কথা। আপনাকে শুতে হচ্ছে এই অন্ধকার ঘরে পাথরের মেঝেতে!” 

তলতাদেবী বললেন, “অত বিচলিত হোয়ো না, জয়পাল। আমার আর কষ্ট হয় না, সহ্য হয়ে গেছে। তুমি সাবধানে থেকো। ছম্ভী অতি ধূর্ত। তিনি যদি কোনওক্রমে তোমার পরিচয় জানতে পারেন, তা হলে আর রক্ষে রাখবেন না।” 

জয়পাল বলল, “আমি সহ্য করতে পারছি না। আপনার এই অবস্থা কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না। আপনাকে আজই আমি এই কারাগারের বাইরে নিয়ে যাব। আপনাকে অনেক দূরের এক গ্রামে লুকিয়ে রাখব। দেশের মানুষকে আপনার কথা ধীরে-ধীরে জানাব। তারাই আপনাকে আবার সিংহাসনে বসাবে।” 

তলতাদেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ওসব কথা এখন বোলো না, জয়পাল। আমার পালাবার কোনও উপায় নেই। ছম্ভী বলে দিয়েছেন, আমি পালাবার চেষ্টা করলেই তিনি একে-একে আমার ছেলেদের বধ করবেন। আমার দুই ছেলে কোথায় আছে, আমি জানি না। তুমি তাদের খবর কিছু জানো?” 

জয়পাল বলল, “কিছু কিছু শুনেছি! রাজকুমারদের ওপর ছম্ভীর ব্যবহার বড় অদ্ভূত। ছোট রাজকুমার তীক্ষ্ণকে ওই ছম্ভী ভালবাসে, তাকে রেখেছে রাজপ্রাসাদে। আর বড় রাজকুমার দৃঢ়কে রেখেছে কারাগারে, তার সঙ্গে ছম্ভী একদিনও দেখা করেনি এ পর্যন্ত!” 

তলতাদেবী ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “দৃঢ় কোথায় আছে; কোন্ কারাগারে!” 

জয়পাল বলল, “মহারানি, আমি যতদূর শুনেছি, বড় রাজকুমারকে এই কালাঘর বন্দীশালাতেই কোনও একটা কক্ষে রাখা হয়েছে।” 

“সে কি জানে আমি বেঁচে আছি কি না?” 

“তা আমি জানি না। আমি তাকে দেখিনি!” 

“জয়পাল, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। তুমি যে-কোনও উপায়ে পারো আমার দুই ছেলের সঙ্গে দেখা করো। এমনও হতে পারে যে, ছম্ভী তাদের দু’জনকেই বুঝিয়েছে যে, তাদের বাবা আর মা কেউ বেঁচে নেই। তুমি তাদের জানিয়ে দাও যে আমি বেঁচে আছি। যে-কোনও উপায়েই হোক, আমাদের আবার দেখা হবে। মহারাজের হত্যার প্রতিশোধ আমরা একদিন ঠিকই নেব।” 

“আমি এই কারাগারে বড় রাজকুমারের সঙ্গে দেখা করতে পারি। সেটা খুব কঠিন হবে না। বড় রাজকুমারকে এখান থেকে পালাবার ব্যাপারে সাহায্যও করতে পারি। কিন্তু ছোট রাজকুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করব কী করে? রাজপ্রাসাদে তো আমি ঢুকতে পারব না। শুনেছি, ছোট রাজকুমারের সঙ্গে বাইরের কোনও লোক কথা বলতে পারে না। ছম্ভী সব সময় তার কাছে-কাছে থাকে।” 

“তুমি তা হলে বড় রাজকুমারের সঙ্গেই দেখা করো। সে কেমন আছে আমাকে জানাও!” 

“আমি আজই যাব তার কাছে।” 

আরও কিছুক্ষণ সুখ-দুঃখের কথা বলার পর জয়পাল বিদায় নিল। 

তলতাদেবী দেওয়ালে হেলান দিয়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন সামনের দিকে। তাঁর বুকের মধ্যে এক প্রবল আলোড়ন হচ্ছে। বছরের পর বছর একইরকম ভাবে কেটে যাচ্ছিল, এখান থেকে মুক্তি পাবার কোনও আশাই ছিল না। হঠাৎ যেন জয়পাল নিয়ে এল এক নতুন আশার আলো। 

এতদিন তিনি তাঁর দুই ছেলের কোনও খবর পাননি। এখন অন্তত জানলেন যে তারা দু’জনেই বেঁচে আছে। ছম্ভী রাজকুমারদের হত্যা করেননি। 

জয়পাল ফিরে এল সন্ধের সময়। 

রাজকুমার দৃঢ়র কাছে সে খুব একটা আশার কথা শোনেনি। মায়ের খবর শুনে সে খুব কেঁদেছে। সেও তার মা ও ছোট ভাইয়ের কোনও খবর জানত না। তার ধারণা ছিল, মা বেঁচে নেই। 

কিন্তু কারাগার থেকে মুক্ত হবার কোনও ইচ্ছেই নেই বড় রাজকুমারের। একবার সে পালাবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু দিনের আলো তার সহ্য হয় না। সে অন্ধ হয়ে গেছে। অন্ধকার ঘরেই তাকে থাকতে হবে সারাজীবন। 

তলতাদেবী হাহাকারের স্বরে বললেন, “তুমি কী বলছ, জয়পাল? সত্যিই কি দৃঢ় অন্ধ হয়ে গেছে?” 

জয়পাল বলল, “না, মহারানি। আমি মশালের আলোয় তাকে ভাল করে দেখেছি। চোখ ঠিকই আছে। কিন্তু, বহু বছর সূর্যের আলো দেখেনি বলে তার চোখে আলো সহ্য হবে না। বড় রাজকুমার বলল, রোদ তার চোখে কাঁটার মতন ফোটে।” 

তলতাদেবী বললেন, “সে তো হবেই। প্রথম কয়েকদিন তার চোখে রোদ সহ্য হবে না। তা বলে সারাজীবন অন্ধকার ঘরে থাকবে কেন? যত কষ্টই হোক, তবু মুক্তি আর স্বাধীনতা অনেক বেশি কাম্য। জয়পাল, তুমি আবার যাও! তাকে বুঝিয়ে বলো, তার ওপরেই এখন আমার সব আশা, ভরসা। সে এখন বড় হয়েছে। এই রাজ্যের সিংহাসনের ওপর তারই একমাত্র দাবি আছে। যে-কোনও প্রকারে বাইরে গিয়ে তাকে এখন সৈন্য-সামন্ত জোগাড় করতে হবে। দেশের মানুষ তার পরিচয় জানতে পারলে নিশ্চয়ই তার দলে যোগ দেবে। ছম্ভীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তারা ছম্ভীকে বিনাশ করবে। তুমি দৃঢ়কে গিয়ে বলো, সে একদিন এসে তার মাকে উদ্ধার করবে, তার মা সেই আশা করে আছে!” 

জয়পাল মাথা চুলকে বলল, “কিন্তু মহারানি, রাজকুমার দৃঢ় আলোতে বেরোতে খুবই ভয় পাচ্ছে। বাইরে যাবার কোনও ইচ্ছেই নেই!” 

তলতাদেবী দৃঢ়ভাবে বললেন, “তুমি গিয়ে তাকে বোঝাও! চোখে আলো সহ্য না হলে সে অন্ধকারের মধ্যে বেরোবে। রাত্তিরবেলায় যাতে কারাগার থেকে পালাতে পারে, তুমি সেই ব্যবস্থা করো। রাত্তিরবেলা সে অনেক দূরে চলে যাক। পরের দিন সকালে তাকে বলো চোখে একটা কাপড় বেঁধে রাখতে। দু-একদিন এরকম ভাবে থাকলেই আস্তে-আস্তে তার চোখে আবার আলো সহ্য হবে! যাও জয়পাল, তাকে গিয়ে বলো, সে কি তার মাকে বাঁচাতে চায় না? সে কি পিতৃরাজ্য উদ্ধার করতে চায় না? বীরের রক্ত কি নেই তার শরীরে?” 

জয়পাল আবার চলে গেল রাজকুমার দৃঢ়র কাছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *