১৬
ঘোড়া ছুটিয়ে একেবারে উঁচু বেদীটার কাছে চলে এল চম্পর্ক। তার মুখ খুশিতে ঝলমল করছে। প্রজাদের চিৎকারকে সে মনে করছে তার নামে জয়ধ্বনি! ঘোড়া থেকে নেমে দু’ হাত জোড় করে সে বলল, “প্রণাম, গুরুদেব!”
ছম্ভী পেছন ফিরে সেনাবাহিনীর দিকে একটা হাত তুলে ইঙ্গিত করলেন। সঙ্গে-সঙ্গে এই রাজ্যের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ অশ্বারোহী বাহিনী ছুটে গিয়ে দাঁড়াল চম্পকের পাহাড়ি সৈন্যদের মুখোমুখি। তাদের প্রত্যেকের হাতে উদ্যত বর্শা।
আর চারজন বিশালদেহী প্রহরী ঘিরে ধরল চম্পককে।
ছম্ভী চম্পককে অগ্রাহ্য করে তাকিয়ে রইলেন দূরের দিকে। মহারানি তলতাদেবীর ঘোড়াটা তীরের মতন ছুটে যাচ্ছে, আর দু’জন ঘোড়সওয়ার অনুসরণ করছে তাঁকে।
ছম্ভী চেঁচিয়ে বললেন, “ধরো ওকে! কিছুতেই যেন পালাতে না পারে।”
এতক্ষণে রাজকুমার তীক্ষ্ণর ঠোঁট কেঁপে উঠল। সে ব্যাকুল ভাবে ডেকে উঠল, “মা, মা!”
ছম্ভী কোমল গলায় বললেন, “দ্যাখো কুমার, তোমার মা পালিয়ে যাচ্ছেন!”
তীক্ষ্ণ ছলছল চোখ তুলে বলল, “কেন? মা চলে যাচ্ছেন কেন?”
“ছম্ভী বললেন, “ভয় পেয়েছেন। তোমার বাবাকে তোমার মা মেরে ফেলেছেন তো! আমরা যে সব জেনে গেছি তা বুঝতে পেরে পালিয়ে যাচ্ছেন।”
ছম্ভী বললেন, “লোভ, লোভ, বুঝলে কুমার, লোভের জন্য মানুষ কত না অন্যায় করে!”
বেদীতল থেকে চম্পক অধৈর্যভাবে বলে উঠল, “এ কী, গুরুদেব! এই প্রহরীগুলো আমাকে ওপরে উঠতে দিচ্ছে না কেন?”
এবার ছম্ভী চম্পকের দিকে তাকিয়ে বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “বিশ্বাসঘাতক! দেশদ্রোহী! ঘৃণ্য কুকুর! তুই সিংহাসনের লোভে আমাদের প্রিয় রাজাকে হত্যা করেছিস!”
চম্পক চোখ কপালে তুলে বলল, “এ কী বলছেন, গুরুদেব? আপনার সঙ্গে আমার যে কথা…”
ছম্ভী ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রহরীদের বললেন, “ওকে কোনও কথা বলতে দিও না। ওর মুখ বাঁধো। হাত বাঁধো!”
প্রায় নিমেষের মধ্যেই চম্পকের মুখ আর হাত বেঁধে দেওয়া হল। তবু সে কিছু বলার চেষ্টায় গোঁ গোঁ শব্দ করতে লাগল প্রাণপণে।
ছম্ভী আবার বললেন, “তোর মতন বিশ্বাসঘাতককে যদি রাজধানীর নাগরিকদের হাতে তুলে দিই, তা হলে তারা তোকে এই মুহূর্তে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে!”
প্রজারা চেঁচিয়ে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওকে আমাদের হাতে ছেড়ে দিন!”
কয়েকজন প্রহরীদের ঠেলে চম্পকের চুলের মুঠি চেপে ধরবার চেষ্টা করল।
ছম্ভী তাদের নিষেধ করে বললেন, “তোমরা ছেড়ে দাও! এখানে আমি রক্তপাত চাই না। প্রহরীরা ওকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাও! এই দণ্ডেই ওকে শূলে চড়াও। সাবধান, ওর মুখের বাঁধন যেন খুলে না যায়। ওর আর একটা কথাও শোনা পাপ! এ-রাজ্যের ইতিহাস থেকে ওর নাম মুছে দেওয়া হবে!”
প্রহরীরা টানতে টানতে নিয়ে গেল চম্পককে। সে তখনও গোঁ গোঁ শব্দ করে অনেক কিছু বলবার চেষ্টা করছে, কিন্তু তার কোনও কথাই বোঝা গেল না।
ছম্ভী আবার প্রজাদের গোলমাল থামাবার ইঙ্গিত করে বললেন, “আর একজন ষড়যন্ত্রকারী তলতাদেবীও পালাতে পারবে না বেশিদূর, ধরা সে পড়বেই। তার শাস্তিও মৃত্যুদণ্ড!”
প্রজারা সবাই হতবাক হয়ে রইল। মহারানিকে তারা সবাই ভালবাসত, শ্রদ্ধা করত। সেই মহারানি বিশ্বাসঘাতকতা করে মহারাজকে হত্যা করেছে, এ-কথা এখনও যেন তারা বিশ্বাস করতে পারছে না। তবু ছম্ভীর কথায় কেউ প্রতিবাদ করল না। কারণ, মহারাজ নিহত হয়েছেন একথা ঠিক। এবং বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি তো মৃত্যুদণ্ড বটেই।
ছম্ভী বললেন, “মহারানির মৃত্যুদণ্ডই যোগ্য শাস্তি, কিন্তু সে শাস্তি তাকে দেওয়া হবে না। নারী অবধ্য। নারীর প্রাণদণ্ড দিলে রাজ্যের অকল্যাণ হয়। সেইজন্য প্রাণদণ্ডের বদলে তলতাদেবীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হল। ধরা পড়ার পর থেকে ওই বিশ্বাসঘাতিনী তলতাদেবীকে সারাজীবন কালাঘরে বন্দিনী থাকতে হবে!”
তলতাদেবীর এই শাস্তিতে প্রজারা যেন সকলেই খুশি হয়ে উঠল। বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে যে মহারানির মুণ্ডু কেটে ফেলা হবে না, এটাই যথেষ্ট। কালাঘরে থাকলেও তিনি বেঁচেই তো থাকবেন।
ছম্ভীর সুবিচারে প্রজারা চেঁচিয়ে বলে উঠল, “জয় গুরুদেব ছম্ভীর জয়!”
ছম্ভী বললেন, “শোনো, শোনো, এখন উচ্ছ্বাসের সময় নয়। এখন বিপদের সময়। এই মুহূর্তে এ রাজ্যে কোনও রাজা নেই। রাজা ছাড়া কোনও রাজ্য টিকতে পারে না। যে-কোনও মুহূর্তে শত্রু এসে আক্রমণ করতে পারে। এক্ষুনি রাজা নিয়োগ করা দরকার। রাজসিংহাসনে কে বসবে? কে? কে?”
সবাই একসঙ্গে জানাল, “আপনি! আপনি! আপনি!”
ছম্ভী দু’ হাত নাড়তে লাগলেন। প্রজারা আবার চুপ করলে তিনি বললেন, “না, আমি রাজা হব না! আমি পুরোহিত। আমি সন্ন্যাসী! আমি কোনওদিনও রাজা হতে চাই না। সিংহাসনের ওপর আমার কোনও লোভ নেই। এই গৌরবময় রাজ্যের সিংহাসনের প্রকৃত অধিকারী মহান রাজা মহাচূড়ামণির পুত্রেরা। সেইজন্যই আমি রাজকুমার তীক্ষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। সে বয়েসে অতি বালক হলেও নিজের চোখে সবকিছু দেখল। সে জানল যে, চম্পকের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তার মা হত্যা করেছেন মহারাজকে। এই পাপীয়সী মাকে সে কি আর কোনওদিন শ্রদ্ধা করতে পারবে?”
ছম্ভী এবার নিচু হয়ে তুলে নিলেন মহাচূড়ামণির রাজমুকুট এবং বিখ্যাত তলোয়ার। সে দুটি প্রজাদের দেখিয়ে বললেন, “এই দ্যাখো, মহারাজ এগুলো বিশ্বাস করে আমার কাছে রেখে গিয়েছিলেন। ষড়যন্ত্রকারীরা যখন মহারাজ মহাচূড়ামণিকে ভুলিয়ে রাজধানীর বাইরে নিয়ে যায়, সেই সময় তিনি নিশ্চয়ই কিছু সন্দেহ করেছিলেন। তিনি আমায় বলেছিলেন, গুরুদেব, দৈবাৎ যদি আমার কোনও বিপদ ঘটে, আপনার ওপর ভার দিয়ে গেলাম, আপনি রাজ্য রক্ষা করবেন। আমার সন্তানদের আপনি দেখবেন, তাদের যেন কোনও বিপদ না ঘটে! এই গুরুদায়িত্ব আমি স্কন্ধে নিয়েছি। এই দায়িত্ব আমি আজীবন পালন করে যাব। এই রাজমুকুট আমি পরিয়ে দিচ্ছি কুমার তীক্ষ্ণ’র মাথায়। এই হিরণ্যক তলোয়ার আমি তুলে দিচ্ছি তার হাতে। আজ থেকে তীক্ষ্ণই রাজা।”
প্রজারা প্রবল উল্লাসে জয়ধ্বনি দিতে লাগল। রাজপুরোহিতের বদলে যে রাজকুমারই রাজা হলেন, এটাই যেন বেশি ভাল হল। সবাই খুশি। শুধু কয়েকজনের মনে প্রশ্ন জাগল, দুই রাজকুমারের মধ্যে দৃঢ়ই তো বয়েসে বড়, সুতরাং তারই তো রাজা হওয়া উচিত ছিল! কিন্তু দৃঢ় কোথায়? ছম্ভী বড় রাজকুমার দৃঢ়র কথা একবারও বললেন না কেন?
এই প্রশ্ন কয়েকজনের মনে জাগলেও তারা এখন উচ্চারণ করতে সাহস করল না। ছম্ভী কত বড় আত্মত্যাগী, তিনি ইচ্ছে করলেই সিংহাসনে বসতে পারতেন, তবু তা ছেড়ে দিলেন। তিনি যে ছোটকুমার তীক্ষ্ণকে রাজা করলেন, তা নিশ্চয়ই বিশেষ কোনও কারণে ভেবেচিন্তেই করেছেন!
বালক তীক্ষ্ণর মাথায় একটা মস্ত বড় রাজমুকুট। তার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে, ঠোঁট দুটি কাঁপছে। সে যেন কোনও কথাই শুনছে না, সে শুধু ভাবছে তার মায়ের কথা।
ছম্ভী তীক্ষ্ণর মাথার কাছে হাত এনে আশীবাদ করলেন। তারপর প্রজাদের বললেন, “এই খুদে রাজা যতদিন সাবালক হয়ে না ওঠে, ততদিন এর হয়ে আমিই রাজ্যের সব কাজ দেখাশুনো করব। আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি, আমি নিজে এই তীক্ষ্ণকে সবরকম শাস্ত্র ও অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দেব। সবদিক থেকেই এই কুমার হবে অপরাজেয়। ষোলো বছর বয়েস হলেই তীক্ষ্ণ মহারাজের বেশে সিংহাসনে বসবে!”
এর পর প্রজাদের আনন্দের মাতামাতি চলল বেশ অনেকক্ষণ ধরে।
এক সময় ছম্ভী তীক্ষ্ণর হাত ধরে নেমে এলেন বেদী থেকে। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “খিদে পেয়েছে, তাই না? সকাল থেকে কিছুই তো খাওয়া হয়নি!”
তীক্ষ্ণ দু’ দিকে প্রবলভাবে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল যে তার খিয়ে পায়নি!
ছম্ভী বললেন, “তৃষ্ণায় আমার গলা শুকিয়ে গেছে। বহুক্ষণ চিৎকার করেছি। চলো, এখন প্রাসাদে যাই!”
কাছেই অপেক্ষা করছে একটি সোনার ঝালর দেওয়া পালকি। মহারানি তলতাদেবী মন্দিরে যাবার সময় এই পালকি ব্যবহার করতেন কখনও কখনও। ছম্ভী সেই পালকিতে তীক্ষ্ণকে নিয়ে উঠে বাহকদের বললেন, “শীঘ্র রাজপ্রাসাদে চলো!”
রাজপ্রাসাদের রক্ষীরা এর মধ্যেই জেনে গেছে যে, তীক্ষ্ণ’র নাম রাজা বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং ছম্ভীই রাজ্যের সব কিছু চালাবেন, তাঁর হাতেই সমস্ত ক্ষমতা।
রক্ষীরা ছম্ভীর সামনে হাত জোড় করে দাঁড়াল।
ছম্ভী বললেন, “সেনানায়ক ভামহকে খবর পাঠাও, সে যেন এখানে আমার জন্য অপেক্ষা করে এক দণ্ড পরে। আমি ওপর থেকে আসছি!”
তীক্ষ্ণকে নিয়ে প্রাসাদের দ্বিতলে উঠে এলেন ছম্ভী। এর মধ্যেই সেখানকার অনেক বদল ঘটে গেছে। সব ঘর খালি। লম্বা অলিন্দের মাঝখানে উঠেছে একটা নতুন দেওয়াল, সেখানে একটা সুবিশাল লৌহদ্বার।
সেই দ্বার দিয়ে ঢোকার আগে তীক্ষ্ণ একটু দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, “আমার মা কোথায়?”
ছম্ভী বললেন, “এখনও ধরা পড়েননি, তবে ধরা পড়বেন নিশ্চয়ই। কুমার তীক্ষ্ণ, তুমি সারাজীবনে আর তোমার মাকে দেখতে পাবে না।”
তীক্ষ্ণ আবার জিজ্ঞেস করল, “আমার দাদা কোথায়?”
ছম্ভী বললেন, “তোমার দাদা দৃঢ়কেও তুমি কখনও দেখতে পাবে না। প্রাসাদের এই অংশে শুধু তুমি আর আমি থাকব। মনে করো, তোমার মা, দাদা, এরা আর কেউ নেই। তোমার জন্য শুধু আমি আছি। এখন থেকে তুমি আমাকেই বাবা বলে ডাকবে।”