প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব

উদাসী রাজকুমার – ১.১

উত্তর পাঞ্চাল রাজ্যের রাজধানী অহিচ্ছত্রপুরে এক মধ্যরাত্রে এক দারুণ বিপদ এসে হানা দিল। বাইরের কোনও শত্রুর আক্রমণের চেয়েও এই বিপদ আরও সাঙ্ঘাতিক। রাজ্যের সাধারণ প্রজা থেকে শুরু করে সৈন্যসামন্তরাও ছুটোছুটি করতে লাগল প্রাণভয়ে। চতুর্দিকে মহাকোলাহল। 

এই রাজ্যের রাজা এক বিশালকায় পুরুষ। যেমন লম্বা, তেমন চওড়া। পাত্র-মিত্রদের মাঝখানে দাঁড়ালে তাঁর মাথা অনেকখানি উঁচু হয়ে থাকে, আর তিনি যখন হাঁটেন, তখন মনে হয় এক চলন্ত পর্বত। এই রাজার নাম মহাচূড়ামণি। 

তবে এই রাজার বাহুবল যতখানি, সেই তুলনায় বুদ্ধিবল বেশ কম। তিনি ভালবাসেন যুদ্ধ করতে এবং ঘুমোতে। এক পক্ষকাল আগেই তিনি কাম্পীল্য নামে অন্য একটি রাজ্যের রাজধানী আক্রমণ করে ঘোরতর সংগ্রামের পর বিজয়ী হয়ে ফিরেছেন। সত্যিই দারুণ বীরত্ব দেখিয়েছেন তিনি সেই যুদ্ধে। আর কোনও দেশের রাজা নিজে অস্ত্র হাতে নিয়ে সেনাবাহিনীর একেবারে সম্মুখে গিয়ে যুদ্ধ করেন না। রাজা মহাচূড়ামণির রুদ্র মূর্তি দেখলেই বিপক্ষের সৈন্যদের বুক কাঁপে, তারা অস্ত্র ফেলে দিয়ে পালায়। 

যুদ্ধজয় করে দর্পের সঙ্গে ফিরে এসেছেন মহাচূড়ামণি, এখন তাঁর ঘুমোবার সময়। টানা এক মাস তিনি ঘুমোবেন। দিনে একবার জাগেন শুধু খাওয়ার জন্য। গোটা একটা হরিণের মাংস তিনি একাই শেষ করে দিতে পারেন, তার সঙ্গে অন্যান্য অনেক খাদ্য তো আছেই। এক-একদিন খেতে-খেতেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। তাঁর ঘুম একেবারে কুম্ভকর্ণের মতন। 

আজ এই বিপদের রাতেও কিছুতেই রাজার ঘুম ভাঙানো যাচ্ছে না। এইরকম ঘুমের সময় রাজপ্রাসাদ ছেড়ে রাজা মহাচূড়ামণি উদ্যানের মধ্যে অন্য একটি বাড়িতে থাকেন। রাজপ্রাসাদে অনেক মানুষজন, অসংখ্য দাস-দাসী, তাদের চলাফেরা ও কথাবার্তায় রাজার ঘুমের ব্যাঘাত হয়, তাই তিনি এক মাস এখানে একা কাটাবেন বলে স্থির করেছেন। 

মন্ত্রী, সেনাপতি ও অমাত্যরা সকলে মিলে একসঙ্গে ডাকাডাকি করেও ঘুম ভাঙাতে পারছে না রাজার। রাজার স্বর্ণময় খাটটি প্রায় সারা ঘরজোড়া, তিনি হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর নাসিকা- গর্জন মেঘের ডাকের মতন, তাঁর বিশাল ভুঁড়িটি নিশ্বাসের সঙ্গে-সঙ্গে উঠছে আর নামছে। 

রাজার গায়ে ঠেলা দিয়ে জাগাবার চেষ্টা করার সাহস কারও নেই। রাজ-অঙ্গ যে-কেউ স্পর্শ করতে পারে না। তা ছাড়া রাজার শিয়রের কাছে রাখা আছে তাঁর খাপসুদ্ধু তরবারি। কাঁচা ঘুম ভাঙালে রাজা মহা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠবেন, চোখের সামনে যাকে প্রথম দেখবেন, তার কোনও কথা না শুনেই হয়তো তার মুণ্ডটা কেটে ফেলবেন ঘচাত করে। 

একমাত্র উপায় মহারানিকে ডেকে আনা। এ রাজ্যের সবাই জেনে গেছে, মহাশক্তিমান রাজা মহাচূড়ামণি এ-পৃথিবীতে শুধুমাত্র ভয় পান রানি তলতাদেবীকে। রানি তলতাদেবী তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী রমণী, তাঁর কাছে রাজা পদে পদে বুদ্ধিতে হেরে যান। রাজকার্য অধিকাংশই চলে রানির পরামর্শে। অনেক সময় বিচারসভায় রাজা কোনও লোককে ভুল করে শাস্তি দিতে গেলে রানি এসে বাধা দেন। রানির কাছে সুবিচার পেয়ে অনেকেই ধন্য-ধন্য করে তাঁর নামে। এ-দেশের সাধারণ মানুষ রাজাকে যমের মতো ভয় পায় বটে, কিন্তু তারা ভালবাসে রানি তলতাদেবীকে। 

রাজাকে জাগাবার জন্য এই উদ্যানভবনে রানিকে নিয়ে আসার জন্য দৌবারিকেরা ছুটে গেল। কিন্তু বিপদ ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসছে। যত দেরি হবে, ততই সর্বনাশ। মস্ত বড় রাজপ্রাসাদের কোন কক্ষে রানি আছেন, তা খুঁজে বার করে তাঁকে সংবাদ দিতে-দিতেই অনেক সময় পেরিয়ে যাবে। 

রানি এসে পৌঁছনো পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই রাজার শিয়রের কাছে এগিয়ে গেলেন রাজপুরোহিত ছম্ভী। 

রাজপুরোহিত ছম্ভীর ফরসা ছিপছিপে চেহারা, তাঁর মুখখানা চকচকে, কখনও দাড়ি-গোঁফ গজায়নি, মাথার চুলও পাতলা। তাঁর নাকটা বাজপাখির ঠোঁটের মতন, চোখ দুটি হীরের মতন উজ্জ্বল। মন্ত্রী-সেনাপতিরাও রাজপুরোহিতকে বিশেষ মান্য করে। 

এর আগে আর কখনও রাজাকে এমনভাবে ঘুম থেকে জাগাতে হয়নি। রাজার ভয়ঙ্কর মেজাজের কথা সবাই জানে। দরজার কাছে দাঁড়ানো রাজপুরুষেরা দারুণ উৎকণ্ঠার সঙ্গে তাকিয়ে রইলেন। 

রাজপুরোহিত ছম্ভী প্রথমে চক্ষু বুজে একটা মন্ত্র পাঠ করলেন। তারপর তাঁর ডান হাতখানি রাখলেন রাজার বুকের ওপর। 

সঙ্গে-সঙ্গে রাজা চোখ মেলে তাকালেন। এত ডাকাডাকিতেও তাঁর ঘুম ভাঙেনি, অন্যের সামান্য ছোঁয়াতেই জেগে উঠলেন তিনি। 

এত বড় শরীর নিয়েও রাজা মহাচূড়ামণি চোখের নিমেষে উঠে বসলেন, ডান হাতের থাবা দিয়ে ছম্ভীর টুটি চেপে ধরে বজ্রের মতন গর্জন করে উঠলেন, “কে? কে রে তুই?” 

দরজার কাছে রাজপুরুষেরা হাহাকার করে উঠলেন। মন্ত্রী দারুক বললেন, “মহারাজ, মহারাজ, ক্রোধ সংবরণ করুন! উনি রাজপুরোহিত! মহারাজ, শুনুন!” 

ততক্ষণে রাজা মহাচূড়ামণি ছম্ভীকে আছাড় মারার জন্য এক হাতেই শূন্যে তুলে ফেলেছেন। 

ছম্ভী কিন্তু ভয় পাননি। তিনি সেই অবস্থাতেই বললেন, “মহারাজ, আমি নিজের মৃত্যুর জন্য চিন্তা করি না, কিন্তু আমাকে মারলে আপনার ব্রাহ্মণ-হত্যার পাপ হবে! আমাকে নামিয়ে দিন, আমার কথা শুনুন!” 

রাজা মহাচূড়ামণির ঘুমের ঘোর এতক্ষণে কাটল। তিনি ছম্ভীকে মাটিতে নামিয়ে দিলেন। তারপর তাড়াতাড়ি তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে অস্ফুট গলায় বললেন, “রাজপুরোহিত? এত রাত্রে আপনি আমার কক্ষে এসেছেন কেন?” ছম্ভী কিছু বলার আগেই অন্যরা একসঙ্গে কথা বলে উঠল, কারও কথাই ঠিকমতন বোঝা গেল না। 

রাজা রক্তচক্ষে দরজার দিকে তাকাতেই সবাই চুপ হয়ে গেল।

ছম্ভী তখন বললেন, “মহারাজ! দারুণ বিপদ। আগুন!” 

রাজা মহাচূড়ামণি ভুরু কুঁচকে বললেন, “আগুন? তার জন্য আমাকে জাগাতে হবে কেন? জল ঢেলে দিন!”

ছম্ভী বললেন, “হে মহারাজ, এ যে-সে আগুন নয়, অতি সাঙ্ঘাতিক।” রাজা মহাচূড়ামণি বললেন, “বেশি আগুন তো বেশি করে জল ঢালার ব্যবস্থা করুন। প্রজাদের সেই কাজে লাগিয়ে দিতে পারেননি? এত সামান্য কারণে অসময়ে আমার ঘুম ভাঙানো উচিত হয়নি!” 

ছম্ভী বললেন, “হে মহারাজ, আমাদের সকলের অনুরোধ, আপনি একবার বাইরে আসুন। আপনি নিজের চক্ষে দেখলে বিপদের গুরুত্বটা ঠিক অনুধাবন করতে পারবেন।”

রাজা দেখলেন, অন্য সকলেও মিনতিপূর্ণ চোখে হাতজোড় করে আছে। 

রাজা একবার নিজের বিছানার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

তাঁর শরীর খুব ঘুম চাইছে, কিছুতেই বিছানা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। আগুনের কথাটা তাঁর মাথায় ঠিক ঢোকেনি, তাঁর ধারণা হল, আবার তাঁকে যুদ্ধে যেতে হবে! 

তিনি হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, “পাদুকা!” 

স্বর্ণময় খাটের নীচেই রাজার জুতো-জোড়া রাখা আছে। কিন্তু রাজা মহাচূড়ামণি নিজে তো আর খাটের নীচে মাথা ঝুঁকিয়ে সে জুতো টেনে আনবেন না, নিজে জুতো পায়েও দেবেন না, একজন ভৃত্য পরিয়ে দেবে। 

কে এখন জুতো পরাবে? দরজার কাছে এত বড়-বড় সব রাজকর্মচারীরা রয়েছেন যে, কোনও ভৃত্যই তাঁদের কাছাকাছি থাকতে সাহস পায় না। জুতো পরাবার দায়িত্ব রাজার নিজস্ব ভৃত্য সুসীমের, কিন্তু তাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। 

অন্য সকলেই বিপদের চিন্তায় অধীর, অকারণে দেরি হয়ে যাচ্ছে। সকলেই তাকিয়ে আছেন জুতো জোড়ার দিকে। রাজপুরোহিত ছম্ভী চামড়ার জুতোয় হাত দিতে পারেন না। মন্ত্রী দারুকও ব্রাহ্মণ। অনেকে মিলে সুসীমের নাম ধরে ডাকাডাকি করছেন, তবু তার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। 

তখন সেনাপতি চম্পক এগিয়ে এসে খাটের নীচে থেকে জুতো জোড়া টেনে এনে বললেন, “মহারাজ, পাদুকা পরিধান করুন!”

রাজা মহাচূড়ামণি সেই মণি-মাণিক্যখচিত নাগরা পরবার জন্য পা এগিয়ে দিলেন, সেনাপতি চম্পক দৈত্যের পায়ের মতন সেই পা দু’খানি নিজের বক্ষে ধারণ করে অতি সাবধানে জুতো পরিয়ে দিলেন। 

রাজা মহাচূড়ামণি অট্টহাস্য করে উঠে বললেন, “বাঃ সেনাপতি, তুমি বেশ যত্ন করে পাদুকা পরাতে পারো তো! কার কাছে শিখলে?” 

চম্পক বললেন, “কারও কাছেই শিখিনি মহারাজ। তবে বিপদের সময় মানুষকে সব কিছুই করতে হয়। প্রতিটি মুহূর্ত এখন মূল্যবান!”. 

রাজা মহাচূড়ামণি আবার হাসিমুখে বললেন, “বাঃ বেশ! আজ থেকে তুমি আর সেনাপতি রইলে না। যে-সেনাপতি বিপদের সময় অস্ত্র ধারণ না করে অন্যের পাদুকা ধারণ করে, সে সেনাপতির যুদ্ধ করা মানায় না!” 

তরুণ সেনাপতি চম্পক নিদারুণ বিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠলেন, “মহারাজ, এ বিপদ সেরকম নয়…” 

তাকে বাধা দিয়ে, মুখের হাসি মুছে ফেলে, রাজা ধমক দিয়ে বললেন, “চোপ! আর কোনও কথা নয়। আজ থেকে সুসীমের বদলে তুমি আমার পাদুকা পরাবার কাজে নিযুক্ত হলে!” 

রাজার এই অদ্ভুত আদেশের প্রতিবাদ করার সাহস পেল না কেউ। 

রাজপুরোহিত ছম্ভী বললেন, “মহারাজ, শীঘ্র একবার অলিন্দে চলুন!”

রাজা মহাচূড়ামণি খাটের ওপর থেকে তাঁর হিরণ্যক নামে বিশাল তলোয়ারটি তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বীরদর্পে। 

এই দ্বিতল গৃহটির সামনে এবং পেছনে দুটি বেশ বড় গোল অলিন্দ। সামনের অলিন্দটিতে দাঁড়িয়ে রাজা অনেক সময় প্রজাদের দর্শন দেন। বড়-বড় যুদ্ধ ছাড়া অন্যান্য রাজকার্যের ভার রাজা তাঁর মন্ত্রী এবং মহারানির ওপরেই দিয়ে রেখেছেন। তিনি রাজদরবারেও বিশেষ যান না। 

এখন রাজা মহাচূড়ামণি সামনের অলিন্দের দিকে এগিয়ে যেতেই ছম্ভী বললেন, “মহারাজ, ওইদিকে নয়, পিছনের দিকে চলুন।” 

রাজা আবার অবাক হলেন। পিছনের অলিন্দে দাঁড়ালে শুধু উদ্যানের শোভা দেখা যায়। রাজার বাগানে অনেকরকম ফুল ও ফলের গাছ। আর রয়েছে একটি চতুষ্কোণ দিঘি, তার জল স্ফটিকের মতন স্বচ্ছ। ওই দিঘিতে শুধু মহারাজ আর মহারানি তলতাদেবী এবং দুই রাজকুমার ছাড়া আর কারও স্নানের অধিকার নেই! দিঘিটি এতই সুন্দর যে, কেউ-কেউ বলে, এক-একদিন জ্যোৎস্না রাতে অপ্সরারা ওখানে স্নান করার জন্য আকাশ থেকে নেমে আসে। অপ্সরাদের ওপর তো রাজার কোনও হুকুম খাটে না! 

রাজা মহাচূড়ামণি জিজ্ঞেস করলেন, “কেন, পিছন দিকে কেন?” 

ছম্ভী বললেন, “মহারাজ, বিপদ আসছে ওই দিক থেকেই!” 

দিঘিটি ছাড়িয়েও রাজার উদ্যান অনেকখানি জায়গা জুড়ে। সম্পূর্ণ উদ্যানটাই প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। তারপর বিস্তীর্ণ যবের ক্ষেত। সেই খেতের মাঝে-মাঝে রয়েছে কয়েকটি গ্রাম। একেবারে শেষ গ্রামটির নাম অট্টা। তারপরেই গহন বন। সেই বন যে কতদূর ছড়ানো তার আর সীমানা পাওয়া যায় না। সেই অরণ্য মিশে গেছে হিমালয় পাহাড়ে। ওদিকে আর কোনও রাজ্য নেই। 

পিছন দিকের অলিন্দে এসে দূরের অরণ্যের দিকে আঙুল তুলে ছম্ভী বললেন, “মহারাজ, ওই দেখুন!”

এই মধ্যরাত্রির অন্ধকারেও পশ্চিমের আকাশ লাল হয়ে গেছে। অরণ্যের মাথার ওপর লকলকে আগুনের শিখা যেন জিভ দিয়ে চেটে নিচ্ছে আকাশের কালো রং। দূরের গ্রামগুলি থেকে অস্পষ্টভাবে ভেসে আসছে মানুষের আর্ত চিৎকার। গৃহপালিত এবং বন্য পশুরা প্রাণভয়ে ডাকতে ডাকতে ছোটাছুটি করছে। 

রাজা মহাচূড়ামণি বললেন, “জঙ্গলে আগুন লেগেছে!” 

ছম্ভী বললেন, “হ্যাঁ, মহারাজ, আগুন! ভয়ঙ্কর আগুন!” 

রাজা মহাচূড়ামণি বললেন, “এই আগুন নিভিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে পারেননি? গ্রামগুলি যে ধ্বংস হয়ে যাবে! প্রজারা না পারে, আমার সৈন্যদের তো বলতে পারতেন, পুকুর-নদী থেকে জল তুলে-তুলে ওই আগুনের সঙ্গে লড়াই করতে! এর জন্য আমাকে জাগাতে হবে কেন?” 

ছম্ভী বললেন, “মহারাজ, এখনও বুঝতে পারছেন না, এ যে-সে আগুন নয়। দাবানল! এই দাবানল নেভাবার সাধ্য কারও নেই!” 

এতক্ষণে মহারাজ মহাচূড়ামণি যেন বিপদের গুরুত্ব বুঝলেন। তাঁর মুখে ভয়ের ছায়া পড়ল। তিনি অস্ফুটভাবে বললেন, “দাবানল! দাবানল!” 

ছম্ভী এবার অশুভ ইঙ্গিতের সঙ্গে বললেন, “মহারাজ, আপনার বাল্যকালের কথা মনে নেই?” 

রাজা মহাচূড়ামণি সবেগে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “হ্যাঁ, মনে আছে। এখন কী হবে? আমার এত সাধের উদ্যান, রাজপ্রাসাদ ছারখার হয়ে যাবে!” 

মন্ত্রী দারুক এবার এগিয়ে এসে বললেন, “মহারাজ, রাজপ্রাসাদ তো যাবেই, রাজধানীও বাঁচবে না! এখন আপনার প্রাণ রক্ষা করাই আমাদের প্রধান কর্তব্য! সেইজন্যই অসময়ে আপনাকে জাগিয়েছি!” 

রাজা মহাচূড়ামণি একটুক্ষণের জন্য অভিভূতের মতন চুপ করে রইলেন। অনেকদিন আগে, মহাচূড়ামণির পিতার আমলে এইরকম দাবানল রাজধানী পর্যন্ত ধেয়ে এসেছিল। সেবারেও কিছুই প্রায় রক্ষা করা যায়নি। মহাচূড়ামণির পিতা কৌস্তুভমণি প্রজাদের আদেশ দিয়েছিলেন, জল দিয়ে সেই আগুনের সঙ্গে সংগ্রাম করতে। তাতে অনেক প্রজা পুড়ে মরে। আগুনের লেলিহান শিখা এই রাজধানী ধ্বংস করে শেষ পর্যন্ত থেমেছিল উত্তরের গঙ্গানদীর ধারে গিয়ে। কৌস্তুভমণি তাঁর রানি ও পুত্র-কন্যাদের নিয়ে রাজধানী ছেড়ে পলায়ন করেছিলেন, পথেই মহারানিকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। 

সেই ভয়াবহ স্মৃতি মনে পড়ে যেতেই রাজা মহাচূড়ামণি কেঁপে উঠলেন। তিনি বললেন, “তা হলে আর কোনও আশা নেই। এখনই রাজধানী ছেড়ে উত্তরের দিকে পলায়ন করতে হবে। মন্ত্রী, আমার রথ সাজাতে বলো! আমি মহারানির কাছে যাচ্ছি! প্রজাদেরও বলো, নগর ছেড়ে যেতে, সর্বত্র ঢোল দিয়ে দাও!” 

রাজার এই আদেশ শোনার আগেই দলে-দলে প্রজা ঘর-বাড়ি ছেড়ে ছুটে পালাতে শুরু করেছে। কেউ-কেউ জিনিসপত্রের মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে পারছে না, অন্যরা টানাটানি করছে তাদের হাত ধরে। কেউ-কেউ সোনাদানার সঙ্গে-সঙ্গে তাদের বাসনপত্র, জামাকাপড়, এমনকি বিছানা পর্যন্ত বেঁধে-ছেঁদে বিরাট পুঁটলি ঘাড়ে করে ছুটতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। 

এদিকে রাজপ্রাসাদেও হুলুস্থুলু বেধে গেছে। দাস-দাসীরাও টের পেয়ে গেছে দাবানলের কথা। সবাই জানে, এই দাবানল একবার ধেয়ে এলে আর কোনওমতেই রাজধানী বাঁচানো যাবে না। সবাই পালাবার জন্য ব্যস্ত। 

মহারানি তলতাদেবী তাঁর দুই পুত্রকে নিয়ে ঘুমিয়েছিলেন, এত গোলমালে তাঁরও ঘুম ভেঙে গেছে। তিনি বিশেষ চঞ্চল হলেন না। তিনি অন্য রাজ্যের রাজকুমারী, এখানে রানি হয়ে এসেছেন, তিনি আগেরবারের দাবানলের সাঙ্ঘাতিক বিধ্বংসী রূপ দেখেননি। তিনি যেন বুঝতেই পারছেন না, অত দূরের আগুনকে এত ভয় পাবার কী আছে! 

দাস-দাসীদের ভয়ার্ত আবেদন শুনে তিনি স্বয়ং প্রাসাদের ছাদে উঠে দেখলেন পশ্চিমের আকাশ। ভোরের সূর্য উদয়ের সময়েও যেন আকাশ এমন রক্তবর্ণ ধারণ করে না। আগুন এখনও বেশ দূরে আছে, তবু যেন শোনা যাচ্ছে সেই আগুনের করাল হুঙ্কার! 

বয়স্ক দাস-দাসীরা আগেরবারের দাবানলের ইতিহাস শোনালেও মহারানি তলতাদেবী খুব যেন বিচলিত হলেন না। তিনি নেমে এলেন ছাদ থেকে। নিজের শয়নঘরের দ্বারের সামনে একবার দাঁড়ালেন। দুই রাজকুমার দৃঢ় আর তীক্ষ্ণ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। তাদের একজনের বয়েস আট বছর, অন্যজনের তিন। মহারানি তলতাদেবী আদেশ দিলেন রাজকুমারদের যেন জাগানো না হয়! 

ততক্ষণে দৌবারিকেরা এসে অপেক্ষা করছে মহারানিকে মহারাজার কাছে নিয়ে যাবার জন্য। মহারানি নিজে থেকেই উদ্যান-প্রাসাদে যাবার জন্য উদ্যত হয়েছিলেন, দৌবারিকদের বার্তা শুনে তিনি বললেন, “আমি নিজেই যাচ্ছি, তোমাদের আমার সঙ্গে আসবার দরকার নেই। তোমরা রাজধানীর প্রজাদের মধ্যে প্রচার করো যে, এই দাবানলকে ভয় পাবার কিছু নেই!” 

মহারাজ মহাচূড়ামণি এবং তাঁর দলবলের সঙ্গে মহারানি তলতাদেবীর দেখা হয়ে গেল উদ্যানের মাঝখানে। 

মহাচূড়ামণি ব্যস্ত হয়ে বললেন, “মহারানি, শিগগির তৈরি হয়ে নাও! এখনই রাজধানী ত্যাগ করে আমাদের অনেক দূরে চলে যেতে হবে! রথ প্রস্তুত করতে বলেছি, তুমি রাজকুমারদের ডাকো!” 

মহারানি তলতাদেবী ছম্ভীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এই আগুন থামাবার কি কোনও উপায়ই নেই?” 

ছম্ভী বললেন, “না, মহারানি। আগুন আর দাবানল তো এক নয়। দাবানলের অগ্রগতি রোধ করার সাধ্য কারও নেই। বন্যা আর অগ্নি, এদের সঙ্গে কি মানুষ যুদ্ধ করতে পারে?” 

সাদা সিল্কের শাড়িপরা রানি তলতাদেবীর মুখের ওপর এসে পড়েছে জ্যোৎস্নার আলো। তিনি পশ্চিমের লাল আকাশের দিকে একবার তাকালেন, তারপর নিজের অধর দংশন করে কিছু চিন্তা করতে লাগলেন। 

তারপর তিনি আপনমনে বললেন, “এই সুন্দর উদ্যান, এই রাজপুরী, প্রজাদের ঘরবাড়ি, মন্দির, দেবালয় সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে? এগুলি বাঁচাবার কি কোনও উপায় সত্যিই নেই? নিশ্চয়ই আছে।” 

মহারাজ উতলাভাবে বললেন, “অগ্নিদেব ক্রুদ্ধ হয়েছেন। এখন আমাদের পলায়ন করা ছাড়া গতি নেই। তুমি জানো মহারানি, আমি কোনও যুদ্ধে ভীত হই না, কিন্তু ক্রুদ্ধ অগ্নির সঙ্গে সংগ্রাম করা যায় না। তুমি যখন মহারানি হয়ে এ রাজ্যে আসোনি, তখনও একবার এই দাবানল আমাদের সর্বস্বান্ত করেছিল। আর দেরি কোরো না, রাজকুমারদের তৈরি করে নাও।” 

মহারানি জিজ্ঞেস করলেন, “আগেরবারের ওই দাবানল অরণ্য থেকে রাজধানীতে পৌঁছুতে কতটা সময় লেগেছিল?” 

মহারাজ তাকালেন ছম্ভীর দিকে। 

ছম্ভী বললেন, “সেবারে অরণ্যে দাবানল শুরু হয়েছিল সন্ধ্যার সময়। আমার স্পষ্ট মনে আছে, কয়েক দণ্ডের মধ্যে আগুন হু-হু করে এগিয়ে আসে। মধ্যরাত্রির এইরকম সময়ে আগুন এসে রাজধানী অহিচ্ছত্রপুর গ্রাস করেছিল। কিছুই রক্ষা পায়নি।” 

মহারানি বললেন, “অর্থাৎ আজকের আগুন এখন যেখানে রয়েছে, সেখান থেকে এই প্রাসাদ পর্যন্ত পৌঁছতে আরও অন্তত দু’ঘণ্টা লাগবে?” 

রাজপুরোহিত মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললেন, “তা হতে পারে। বাতাসের বেগ তেমন প্রবল না। আরও অন্তত তিন ঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে মনে হয়। এর মধ্যেই নগর একেবারে জনশূন্য করে দিতে হবে। মহারানি, আমি মনে করি, মহারাজ আর আপনি রাজকুমারদের নিয়ে আগে-আগে চলে যান। গঙ্গা পার হয়ে কোনও নিরাপদ স্থানে অবস্থান করুন। আপনাদের জীবনই সবচেয়ে মূল্যবান।”

মন্ত্রীও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, মহারানি ডান হাত উঁচু করে তাঁকে থামিয়ে দিলেন। তারপর রাজা ও রাজপুরোহিতের দিকে চেয়ে বললেন, “আমাকে কিছুটা সময় দিন। এখনই প্রজাদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালাবার দরকার নেই। আমি আগে চেষ্টা করে দেখি, এ আগুন থামাতে পারি কি না!” 

মহারাজ মহা বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, “তুমি আগুন থামাবে?” মহারানি বিনা দ্বিধায় উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ।” 

অন্য কেউ এরকম কথা বললে তাকে মনে করা হত পাগল! অতি মূৰ্খ কিংবা উন্মাদ ছাড়া কি কেউ দাবানল থামাবার কথা ভাবতে পারে? 

কিন্তু ইনি মহারানি তলতাদেবী। এঁর বুদ্ধির কথা সবাই জানেন। এমন বিপদের মধ্যে ইনি কিছুতেই বাজে কথা বলবেন না। 

ছম্ভী তবু বললেন, “হে মহারানি, আপনি কী করে এই আগুনের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন? এখন প্রখর গ্রীষ্ম, অধিকাংশ নদী-নালা আর পুকুরই শুকিয়ে গেছে, কোথাও প্রায় জল নেই। জল থাকলেও বিশেষ সুবিধে হত না। এখন সব কিছুই শুকনো বলে আগুন আরও বেশি তেজে এগিয়ে আসছে।” 

মহারানি তলতাদেবী বললেন, “আপনারা এখানে অপেক্ষা করুন। প্রজাদের শান্ত থাকতে বলুন। আগে থেকেই হুড়োহুড়ি করে তারা অনেক জিনিসপত্র নষ্ট করবে কেন? আমার সঙ্গে মাত্র দশজন অশ্বারোহী দিন। আমি তাদের নিয়ে আগুনের দিকে এগিয়ে যাব। তাদের সঙ্গে থাকবে জ্বলন্ত মশাল।” 

মহারাজ মহাচূড়ামণির ভুরু দু’খানি কপাল ছাড়িয়ে যাবার উপক্রম। মুখখানা হাঁ হয়ে গেছে। কোনওক্রমে বললেন, “মশাল?” 

মহারানি বললেন, “হ্যাঁ, আমার সঙ্গের লোকদের হাতে শুধু মশাল থাকলেই চলবে। আর কোনও অস্ত্রশস্ত্র দরকার নেই।” 

মহারাজ বললেন, “তুমি আগুন নিয়ে আগুনের সঙ্গে সংগ্রাম করতে যাবে?”

মহারানি এবার সামান্য হেসে বললেন, “শুধু অস্ত্রবল কিংবা গায়ের জোরেই সব সংগ্রামে জয়ী হওয়া যায় না। অগ্নিদেবতার সঙ্গে যুদ্ধ করবে মানুষের বুদ্ধি!” 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *