প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব

উদাসী রাজকুমার – ২.১৩

১৩

মল্লপাল এবং তার সঙ্গীরা এসে রাজকুমার তীক্ষ্ণকে ধরে ফেলল রুকমি নদী তীরে এসে। রাজকুমার প্রচণ্ড জোরে ঘোড়া চালিয়ে এলেও থমকে গেছে নদীর ধারে। এর মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। বৃষ্টির সময় খেয়া নৌকোর মাঝিরা থাকে না। নদীটা এখানে খুব চওড়া, ঘোড়া সমেত এই নদী পার হওয়া সম্ভব নয়। 

একটা পিপুল গাছের তলায় ঘোড়া থামিয়ে নদীর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজকুমার তীক্ষ্ণ। 

মল্লপাল তার পাশে এসে দাঁড়াতেই তীক্ষ্ণ তাকে জিজ্ঞেস করল, “এই বৃষ্টি কতক্ষণে থামবে?” 

মল্লপাল বলল, “সমস্ত আকাশে মেঘ একেবারে জমাট বেঁধে আছে। এই বৃষ্টি বেশ কিছুক্ষণ চলবে মনে হয়।” 

রাজকুমার তীক্ষ্ণ অস্থিরভাবে বলল, “আমি দেরি সহ্য করতে পারছি না! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অহিচ্ছত্রপুরে পৌঁছতে চাই!” 

মল্লপাল হেসে বলল, “রাজকুমার, আপনি আমাদের ছেড়ে একা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে এলেন। কিন্তু আপনি একা-একা যাবেন কী করে? আমাদের রাজধানীতে তো এক রাত্তিরে পৌঁছনো যাবে না। সে যে অনেক দূরের পথ।” 

রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “যত দূরেই হোক, আমি একা যেতে পারব না কেন? আমি প্রতিশোধ নিতে চলেছি। আমি তোমাদের সাহায্য চাই না।” 

মল্লপাল বলল, “কুমার, অহিচ্ছত্রপুরে যেতে গেলে অনেকগুলি রাজ্য পার হতে হবে। তার প্রত্যেকটি রাজ্যেই আপনি দ্বন্দ্বযুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। কোনও রাজকুমার কিংবা সেনাপতিকে হারিয়ে দিয়েছেন। ওদের রাগ আছে আপনার ওপর।” 

রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “কিন্তু আমি তো আর দিগ্বিজয়ী হতে চাই না! আর তো অন্য কারুর সঙ্গে লড়াই করব না আমি!”

মল্লপাল বলল, “তবু আপনার ওপর তাদের রাগ থেকেই যাবে। সুযোগ পেলেই তারা আপনাকে হত্যার চেষ্টা করবে। কুমার, আমার মনে হয়, দিনের বেলা কোথাও লুকিয়ে থেকে রাত্তিরের দিকেই আপনার পথ চলা ভাল। আমরা সঙ্গে থাকলে সবরকম খোঁজখবর নিতে পারব!” 

রাজকুমার তীক্ষ্ণ তবু ছটফটিয়ে বলল, “তোমরা সঙ্গে থাকলে আমার অনাবশ্যক দেরি হয়ে যাবে! মল্লপাল, আমার শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরায় আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। বিশ্বাসঘাতক ছম্ভীকে চরম শাস্তি দেবার আগে আমি ঘুমোতেও পারব না!” 

এই সময় দেখা গেল, এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও একটা ঘোড়া ছুটে আসছে বৈশালীর দিক থেকে। কাছে আসতে দেখা গেল, সেই অশ্বের পিঠে দু’জন আরোহী। একজন বাহুক, অন্যজন শিল্পী জয়পাল। 

ঘোড়া থেকে নেমে একগাল হেসে বাহুক বলল, “আমাদের ফেলেই চলে এলেন, রাজকুমার? আমাদের ঘোড়া ছিল না। পায়ে হেঁটে তো আপনাকে ধরতে পারব না। তাই অতিকষ্টে একটা ঘোড়া জোগাড় করলাম। দেখুন, ঠিক এসে আপনাদের ধরেছি!” 

রাজকুমার তীক্ষ্ণ বিরক্তভাবে বলল, “এত লোককে আমি সঙ্গে নিতে চাই না। আপনাদের আসার কোনও প্রয়োজন ছিল না।” 

বাহুক বলল, “হ্যাঁ, প্রয়োজন আছে, রাজকুমার। আপনার পিতার যে হত্যাকারী, সে আমার পিতাকে হত্যা করেছে। আপনি প্রতিশোধ নিতে চান, আর আমি প্রতিশোধ নেব না? আপনার মতন আমি বীর নই, একা-একা শক্তিমান ছম্ভীকে শাস্তি দেবার ক্ষমতা আমার নেই, তবু আপনাকে যদি সামান্য সাহায্য করতে পারি। তাতেই আমার তৃপ্তি হবে।” 

শিল্পী জয়পাল বলল, “রাজকুমার, আপনার মাকে আমি উদ্ধারের চেষ্টা করেও পারিনি। একবার যদি তাঁকে কারাগারের বাইরে দেখতে পাই, তা হলে আমার জীবন ধন্য হবে। আমাকেও আপনার সঙ্গে নিন। শ্রমণ হবার পর আমি বহু দেশ ভ্রমণ করেছি। অনেক সংক্ষিপ্ত পথ আমি জানি। আপনাকে আমি অনেক দ্রুত অহিচ্ছত্রপুরে পৌঁছে দিতে পারব।”

রাজকুমারের মুখ থেকে অপ্রসন্নতার ছাপ খানিকটা মুছে গেল।

শিল্পী জয়পালের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখান থেকে কোন সংক্ষিপ্ত পথে আমাদের রাজধানীতে যাওয়া যায়, আমাকে বলুন।” 

শিল্পী জয়পাল বললেন, “স্থলপথের চেয়ে জলপথ অনেক সুবিধাজনক। এই রুকমি নদীর বুকে নৌকো নিয়ে যদি পশ্চিমে যাওয়া যায়, তা হলে দু-তিনটি দেশের মধ্যে আর প্রবেশ করতেই হবে না। পথ অর্ধেক হয়ে যাবে।” 

মল্লপাল জিজ্ঞেস করল, “নৌকো চালাবে কে? আমাদের দেশে নদ-নদী আর জলাশয় খুব কম। আমরা কেউ নৌকো বাইতে জানি না, সাঁতারও জানি না।” 

শিল্পী জয়পাল বললেন, “শ্রমণদের সব কিছু জানতে হয়। আমি নৌকো চালাতে জানি।” 

বাহুক বলল, “আমিও এক সময় খেয়া নৌকোর মাঝির কাজ করেছি। আমরা দু’জনে মিলে চালালে নৌকো ছুটবে শনশনিয়ে।” 

রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “আমিও সাঁতার জানি না। যদি নৌকো উলটে যায়!” 

বাহুক আর শিল্পী জয়পাল পরস্পরের দিকে তাকাল। তারপর হাসল। বাহুক বলল, “কুমার, আমাদের প্রাণ থাকতে কি আপনাকে জলে ডুবতে দেব? আমাদের প্রাণের চেয়েও আপনার প্রাণের দাম অনেক বেশি।” 

শিল্পী জয়পাল অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভয় নেই। আমি হাল ধরে থাকলে সে নৌকো কখনও উলটে যাবে না!” 

মল্লপাল তখন বলল, “তা হলে তো এক্ষুনি একটা নৌকো কিনে নিলেই হয়।” 

বৃষ্টি একটু থামতেই কয়েকজন ছুটে গেল কাছাকাছি গ্রামে। 

বিকেলের মধ্যেই একটা নৌকো কেনা হল, সেটাকে সুন্দর করা হল সাজিয়ে গুজিয়ে। চাল-ডাল কিনে রান্নার ব্যবস্থাও রাখা হল সেখানে। তারপর সন্ধের সময় যাত্রীদের নিয়ে জলে ভাসল সেই নৌকো। ঘোড়াগুলো ওরা বিক্রি করে দিল গ্রামবাসীদের কাছে। 

তিন দিন নদীপথে সমানে এগিয়ে গেল ওরা। কোথাও কোনও বাধার সৃষ্টি হল না। তারপর একদিন এক ঘাটে রাত্তিরবেলা নৌকো বেঁধে শিল্পী জয়পাল বললেন, “এবার আমাদের স্থলের ওপর দিয়ে যেতে হবে। নদী বেঁকে গেছে অন্যদিকে।” 

রাজকুমার তীক্ষ্ণ জিজ্ঞেস করল, “বাকি সবটা পথই স্থলের ওপর দিয়ে যেতে হবে?” 

শিল্পী জয়পাল বললেন, “হ্যাঁ, আর দু’দিন লাগবে!” 

রাজকুমার তীক্ষ্ণ রেগে গিয়ে বলল, “স্থলপথে আমরা পায়ে হেঁটে যাব নাকি? তোমাদের বুদ্ধিতে আমাদের ঘোড়াগুলো রেখে আসতে হল।” 

বাহুক বলল, “রাজকুমার, দিনের পর দিন একটানা ঘোড়া ছোটালে সেই ঘোড়া বাঁচত না। আমরাও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়তাম। এই তিন দিনে আমাদের বিশ্রাম হয়েছে। ঘোড়া বিক্রির টাকাগুলো রয়েছে আমার কাছে, এখানেও নিশ্চয়ই ঘোড়া কিনতে পাওয়া যাবে।” 

বাহুক সত্যিই করিৎকর্মা ব্যক্তি। অন্য সকলকে নদীতীরে বসিয়ে রেখে সে মল্লপালকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল লোকালয় খুঁজতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে কয়েকটা ঘোড়া নিয়ে ফিরে এল। এবারে শিল্পী জয়পালের জন্যও আলাদা একটা ঘোড়া জুটল। 

সেই রাত্রেই অশ্বারোহীরা ছুটে চলল অহিচ্ছত্রপুরের দিকে। 

সারারাত ঘোড়া ছুটিয়ে সকালবেলা ওরা বিশ্রাম নিল একটা জঙ্গলের মধ্যে। খাওয়াদাওয়া করে ঘুমোল। সন্ধের অন্ধকার নামতেই আবার শুরু হল যাত্রা। 

পরদিন সকালবেলা একটা পাহাড়ের কাছাকাছি পৌঁছে বাহুক বলল, “রাজকুমার, এই পাহাড়েই একটা খাদে আপনার পিতা মহাচূড়ামণিকে ছল করে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন পুরোহিত ছম্ভী। ওই পাহাড় থেকেই আমাদের রাজ্যের সীমান্ত।” 

রাজকুমার তীক্ষ্ণ ঘোড়া থামিয়ে স্থিরভাবে চেয়ে রইল সামনের দিকে। চকচক করছে তার চোখ। যেন দু’ চোখ ঠেলে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে, অতিকষ্টে আটকে রেখেছে সে। 

আস্তে-আস্তে সে বলল, “আমার বাবার কথা ভাল মনে নেই। শুধু মনে আছে, মাঝে-মাঝে তিনি আমাকে কোলে তুলে আদর করতেন। একদিন তিনি ঘোড়া সেজেছিলেন, আমি তাঁর পিঠে চেপেছিলাম।” 

শিল্পী জয়পাল পাশ থেকে বললেন, “তিনি তেজী পুরুষ ছিলেন। রাগী ছিলেন। কিন্তু তাঁর রাগ বেশিক্ষণ থাকত না। রাগ করে তিনি কারুকে শাস্তি দিলে পরের দিন ক্ষমাও করে দিতেন। তিনি খুব বিশ্বাস করতেন রাজপুরোহিত ছম্ভীকে।” 

বাহুক বলল, “এত শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস করার পরও যে লোক বিশ্বাসঘাতকতা করে, তার নরকেও স্থান নেই!” 

রাজকুমার তীক্ষ্ণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আবার কঠিন হয়ে গেল তার মুখ সে বলল, “চলুন!” 

বাহুক বলল, “দাঁড়ান, রাজকুমার। হঠাৎ এইভাবে রাজধানীর মধ্যে ঢুকে পড়া বোধ হয় ঠিক হবে না। আগে আমাদের কোনও গুপ্তচর গিয়ে দেখে আসুক, সেখানকার কী অবস্থা!” 

রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “কোনও দরকার নেই। এখনি ছম্ভীর কাছে যেতে চাই!” 

বাহুক বলল, “ভুলে যাবেন না কুমার, ছম্ভী আপনাকে ইচ্ছে করেই রাজধানীর বাইরে রাখতে চেয়েছিলেন। তিনি আপনাকে দিগ্বিজয় করতে পাঠিয়েছিলেন, এতে আপনি মরে যেতেও পারতেন। এতদিনে তিনি তো আপনার কোনও খোঁজ করেননি!” 

রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “ওসব কথা থাক। এবার ছম্ভীর সঙ্গে আমার চরম বোঝাপড়া হবে।” 

আর কোনও কথা না বলে রাজকুমার তীক্ষ্ণ ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে গেল।

পাহাড়ের পাশ দিয়ে প্রাচীনকালের পথ। সে পথ সোজা চলে গেছে রাজধানীর দিকে। কোথাও কোনও সৈন্য-সামন্তের চিহ্ন দেখা গেল না।

সাধারণ গ্রামের লোকেরা কৌতূহলের চোখে দেখল এই ছোট দলটিকে। সব মিলিয়ে এগারোজন অশ্বারোহী। রাজকুমার তীক্ষ্ণ অনেকদিন দেশছাড়া, তাই তাকে কেউ চিনতে পারল না। 

রাজধানীর কাছে গিয়ে সবাই বেশ অবাক হয়ে গেল। এই ক’ বছরের মধ্যেই সমগ্র রাজধানীটি পাথরের দেওয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। সেই দেওয়ালের এক এক জায়গায় প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড দরজা। দেওয়ালের মাথায় বর্শা হাতে নিয়ে চলাফেরা করছে প্রহরীরা। 

দরজাগুলি সব বন্ধ। বাইরের লোক ইচ্ছে করলেই রাজধানীর মধ্যে প্রবেশ করতে পারবে না। 

রাজকুমার তীক্ষ্ণর দলটি এসে থমকে দাঁড়াল প্রধান সিংহদ্বারের সামনে। ওপর থেকে একজন প্রহরী হুঙ্কার দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কে তোমরা? দূরে হঠে যাও! যদি কোনও পরিচয়পত্র থাকে, আগে সেটা দেখাও!” 

শিল্পী জয়পাল বললেন, “সর্বনাশ! রাজধানীতে প্রবেশ করার তো কোনও উপায় নেই দেখা যাচ্ছে! একটা মাছিও গলতে পারবে না। রাত্তিরবেলা অন্ধকারের মধ্যে চেষ্টা করা যেতে পারে।” 

বাহুক বলল, “আমাদের গোপনেই ঢুকতে হবে। একটা মই বা সিঁড়ি বানিয়ে রাত্তিরবেলা উঠব।” 

মল্লপাল বলল, “তা কেন? আমাদের রাজকুমার নিজের রাজ্যের রাজধানীতে চোরের মতন লুকিয়ে ঢুকবেন কেন? সেভাবে ঢুকলেও এত সৈন্যদের চোখ এড়াতে পারব না। তাদের সঙ্গে আমরা এই কয়েকজন মাত্র লড়াই করতেও পারব না। আমার মনে হয়, রাজকুমারের প্রকাশ্যেই প্রবেশ করা উচিত। রাজকুমারকে চিনতে পারলে প্রহরীরা বাধা দেবে না মনে হয়। রাজকুমারকে দিনের আলোয়, সবার সামনে হত্যা করার হুকুমও দিতে পারবেন না ছম্ভী।” 

রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “আমি প্রকাশ্যেই যেতে চাই।” 

মল্লপাল বলল, “তা হলে আপনাকে একটু সাজিয়ে দিতে চাই, কুমার। এই পোশাকে আপনাকে কেউ চিনবে না।” 

কয়েকদিনের পথশ্রমে রাজকুমারের মুখখানা ক্লান্ত, সর্বাঙ্গ ধূলিধূসর। মাথার চুলে জট পাকিয়ে গেছে। গালে একটু-একটু দাড়ি। 

মন্ত্রপালের অনুরোধে ময়লা পোশাক ছেড়ে পরিষ্কার পোশাক পরে নিল রাজকুমার তীক্ষ্ণ। মল্লপাল তার মাথায় পরিয়ে দিল মুকুট। বাহুতে স্বর্ণকঙ্কণ। তারপর সে নিজে ডঙ্কা বাজাতে-বাজাতে এগিয়ে গেল দ্বারের দিকে। চিৎকার করে বলল, “শোনো, প্রহরীরা, শোনো। আমি মল্লপাল, রাজধানীর কোটাল। আমি কাকে এনেছি, তোমরা ভাল করে দ্যাখো! এসেছেন আমাদের যুবরাজ! মহারাজ মহাচূড়ামণির পুত্র রাজকুমার তীক্ষ্ণ। তিনি দিগ্বিজয়ে গিয়েছিলেন। তিনি পঞ্চাশটির বেশি রাজ্য ঘুরে এসেছেন। তাঁর তুল্য বীর আর কেউ নেই। দ্বার খুলে দাও! আজ আমাদের আনন্দের দিন। জয়ধ্বনি দাও!” 

প্রহরীরা নীরব হয়ে রইল। দ্বার খুলল না। 

বাহুক আর শিল্পী জয়পাল একটু দূরে দাঁড়িয়ে অধীরভাবে অপেক্ষা করছে। তারা ভাবছে, সৈন্যরা যদি ওপর থেকে অস্ত্র ছুঁড়তে শুরু করে, তা হলে রাজকুমার বাঁচবে কী করে? 

মল্লপাল আবার চিৎকার করে বলল, “প্রহরীরা, শুনতে পাচ্ছ না? রাজকুমার তীক্ষ্ণ দিগ্বিজয় করে ফিরে এসেছেন। রাজপুরোহিত ছম্ভীকে এই শুভ সংবাদ জানাও! রাজপুরোহিত এই রাজকুমারকে আমাদের রাজ্যের যুবরাজ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন, তোমাদের মনে নেই?” 

এবার প্রহরীরা তুমুলভাবে হর্ষধ্বনি করে উঠল। খুলে গেল দ্বার। 

কোষ থেকে তলোয়ারটা মুক্ত করে উঁচু করে ধরে রাজকুমার তীক্ষ্ণ বাহুক ও শিল্পী জয়পালের দিকে চেয়ে বলল, “আপনারাও আসুন আমার সঙ্গে।” 

প্রহরী ও সৈন্য-সামন্তরা রাজকুমার তীক্ষ্ণকে ঘিরে ধরে জয়ধ্বনি দিতে লাগল। 

মল্লপাল তাদের বলল, “শোনো, শোনো, রাজকুমার অনেক দূরের পথ পার হয়ে এসেছেন, তিনি খুব ক্লান্ত, আজ তিনি রাজপুরীতে বিশ্রাম নেবেন। তোমরা পথ ছেড়ে দাও!” 

ভিড়ের মধ্য দিয়ে এই ছোট দলটি এগিয়ে চলল রাজপ্রাসাদের দিকে। এখন অপরাহ্ণ। এই সময় রাজপুরোহিত ছম্ভী প্রতিদিন রাজসভায় বসে রাজকার্য চালান। রাজসভার কাছে এসে রাজকুমার তীক্ষ্ণ অশ্ব থেকে নামল। রাজকুমার উঁকি মেরে দেখল, সেখানে ছম্ভী নেই, মন্ত্রী, সভাসদরা কেউ নেই। একেবারে শুনশান! 

এবার ওরা এসে পৌঁছল রাজপ্রাসাদের সামনের উদ্যানে। 

বাহুক বলল, “ব্যাপারটা তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। রাজকুমার যে পৌঁছে গেছেন, সে সংবাদ নিশ্চয়ই ছম্ভীর কাছে পৌঁছেছে। কিন্তু রাজকুমারকে সংবর্ধনা জানাবার জন্য তিনি কোনও দূত পাঠালেন না। নিজেও এলেন না। রাজকুমারকে বন্দী করারও তো কোনও চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না।” 

শিল্পী জয়পাল বললেন, “এই উদ্যানে বসে আমি মূর্তি বানাতাম। মহারানি তলতাদেবী রোজ দেখতে আসতেন। আমার সেসব মূর্তির কোনও চিহ্ন নেই। সব ভেঙে ফেলেছে! 

বাগানের একজন মালিকে দেখতে পেয়ে তাকে ডেকে শিল্পী জয়পাল জিজ্ঞেস করলেন, “ওহে বৎস, এখানে কোনও দ্বারী প্রহরীকে দেখছি না। রাজ পুরোহিত ছম্ভী কোথায় বলতে পারো। তিনি কি রাজধানীতে নেই?” 

লোকটি মুখে কোনও উত্তর দিল না। শুধু হাত তুলে রাজপ্রাসাদের দোতলার একটা কোণ দেখিয়ে দিল। 

রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “রাজপ্রাসাদের ওই কোণে আমি পুরোহিত ছম্ভীর সঙ্গে বছরের পর বছর কাটিয়েছি। এবার ওঁর সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎকার! মল্লপাল, তুমি তোমার লোকজনদের নিয়ে চলে যেতে পার। আমি তোমাদের বিপদে ফেলতে চাই না। কুটকৌশলী ছম্ভী সহজে ধরা দেবেন না। শেষ যুদ্ধে কে জয়ী হবে, তার ঠিক নেই। তোমরা ফিরে যাও।” 

মল্লপাল বলল, “কুমার, বছরের পর বছর আমরা আপনার সঙ্গে থেকেছি। আপনাকেই আমরা যুবরাজ বলে জানি। শেষ মুহূর্তে আপনাকে কিছুতেই পরিত্যাগ করতে পারব না। অন্যদের কথা জানি না, আমি ফিরে যাব না।” 

অন্যরাও একসঙ্গে বলে উঠল, “আমরা কেউ ফিরে যাব না!” 

সবাই একসঙ্গে ঢুকল রাজপ্রাসাদে। একতলাটা একেবারে জনশূন্য। এরকম তো হয় না। রাজবাড়িতে কত মানুষজন থাকে, সব সময় একেবারে গমগম করে। এখন কেউ নেই। কোনও বিপদের আশঙ্কায় দাস-দাসীরা পালিয়ে গেছে। 

সিঁড়ি দিয়ে সবাই উঠে এল দোতলায়। শ্বেতপাথরের অলিন্দ দিয়ে কিছুটা এগোতেই দু’ পাশের কক্ষগুলি থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল একদল প্রহরী। অস্ত্র নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল এই দলটির ওপর। 

সঙ্গে-সঙ্গে ঝলসে উঠল রাজকুমার তীক্ষ্ণর তলোয়ার। মল্লপাল, বাহুক ও অন্যান্যরাও লড়াইতে লেগে গেল। শিল্পী জয়পালও একজন প্রহরীকে ধরে আছাড় মেরে তার হাতের বশাটা কেড়ে নিলেন। তারপর তিনিও মেতে গেলেন যুদ্ধে। 

বোঝা গেল, দেশের সৈন্যবাহিনী রাজকুমান, তীক্ষ্ণকে বাধা না দিলেও কিছু অতিবিশ্বাসী প্রহরীকে ছম্ভী এখানে গোপনে রেখে দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, তারা অতর্কিতে তীক্ষ্ণকে হত্যা করবে। 

কিন্তু রাজকুমার তীক্ষ্ণ যে এর মধ্যে যুদ্ধে কতখানি দক্ষ হয়েছে, সেটা তিনি ধারণা করতে পারেননি। সাধারণ প্রহরীরা তাঁর সামনে দাঁড়াতেই পারছে না। রাজকুমার তীক্ষ্ণ যেন উড়ন্ত যোদ্ধা, সে এমন লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে যে, কেউ তার শরীরে অস্ত্রই ছোঁয়াতে পারে না। মল্লপাল, বাহুক এবং অন্যান্যরাও লড়ছে প্রাণপণে, শিল্পী জয়পালের দারুণ পরাক্রম। তাঁর শরীরে সন্ন্যাসীর পোশাক, অথচ তিনি এমনভাবে লড়ছেন, এই দেখে বিপক্ষের সৈন্যরা বিস্ময় সামলাতে সামলাতেই হেরে যাচ্ছে। 

অল্পক্ষণের মধ্যেই ছম্ভীর বিশ্বাসী প্রহরীরা কয়েকজন ধরাশায়ী হল, আর বাকি কয়েকজন প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেল। 

এবার রাজকুমার তীক্ষ্ণ এগিয়ে গেল ছম্ভীর শয়নঘরের দিকে। এক সময় সেটা ছিল তার নিজেরও শয়নঘর। 

লোহার দ্বারের বাইরে যমদূতের মতন দাঁড়িয়ে আছে শুভ আর নিশুম্ভ। এই রাজ্যের সৈন্যদের মধ্যে সবচেয়ে বড় বীর। 

শুম্ভ গম্ভীরভাবে বলল, “সাবধান। এদিকে কেউ এগোবে না!” 

মল্লপাল এগিয়ে এসে বলল, “শুম্ভ নিশুম্ভ, তোমরা কী করছ? আমাকে চিনতে পারছ না? আমাদের যুবরাজ তীক্ষ্ণ এসেছেন, পথ ছেড়ে দাও!”

নিশু বলল, “আমরা গুরুদেব ছম্ভীর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাঁর আদেশ ছাড়া অন্য কারুর আদেশ মানব না। এখানে কেউ আসতে পারবে না!” 

শিল্পী জয়পাল বর্শা হাতে নিয়ে এগিয়ে এসে বললেন, “কুমার, এই দু’জনের জন্য আপনার দাদাকে আর আমাকে নদীতে ঝাঁপ দিতে হয়েছিল। তখন কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলাম। আজ আমার হাতে ছেড়ে দিন, আমিই ওদের পরাজিত করব!” 

রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “না, আমরা থাকতে আপনি একজন ভ্রমণ হয়েও কেন লড়াই করবেন। আপনারা একটু দূরে থাকুন।” 

তারপর সে আদেশের সুরে শুম্ভ-নিশুম্ভকে বলল, “যদি বাঁচতে চাও, তোমরা অস্ত্র ফেলে দাও!” 

শুম্ভ আর নিশুপ্ত অহঙ্কারের ভঙ্গিতে তলোয়ার উঁচিয়ে ধরল। 

রাজকুমার তীক্ষ্ণ সঙ্গে-সঙ্গে একটা লাফ দিল। প্রতিপক্ষ কিছু বোঝার আগেই সে যেন শূন্য দিয়ে উড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিশুম্ভর ওপর। নিশুম্ভ লড়াই করার প্রায় কোনও সুযোগই পেল না। রাজকুমারের তলোয়ারের আঘাতে আহত হয়ে ঢলে পড়ে গেল। 

শুম্ভকে অবশ্য এত সহজে হারানো গেল না। সে ধেয়ে এল রাজকুমারের দিকে। চলতে লাগল দু’জনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। অন্যরা দূর থেকে দেখতে লাগল। শুম্ভ অসাধারণ যোদ্ধা। রাজকুমারের সঙ্গে তার তলোয়ারের ঠোকাঠুকিতে আগুন জ্বলে যাচ্ছে! 

এক সময় রাজকুমার তীক্ষ্ণ একটু সরে গিয়ে চুপ করে দাঁড়াল, মল্লপালরা আতঙ্কিত হয়ে ভাবল, রাজকুমার ক্লান্ত হয়ে গেছে, আর যুদ্ধ করতে পারছে না।

রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “শুম্ভ, এই শেষবার আমি তোমাকে সাবধান করছি। যদি বাঁচতে চাও তো অস্ত্র সমর্পণ কর!” 

শুম্ভ বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, “কুমার, আজ তোমার মৃত্যু আমার হাতে!”

রাজকুমার তীক্ষ্ণ আবার শূন্যে লাফিয়ে উঠল। শুম্ভকে সে প্রাণে মারল না। তলোয়ারের এক কোপে সে শুম্ভর ডান হাতের অর্ধেকটা কেটে ফেলল। শুম্ভ ছটফট করতে লাগল মাটিতে পড়ে। 

এবার রাজকুমার তীক্ষ্ণ, বাহুক আর শিল্পী জয়পাল এসে দাঁড়াল ছম্ভীর শয়নকক্ষের দ্বারের সামনে। বাহুক ঠেলা দিয়ে দেখল, দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। 

শিল্পী জয়পাল বললেন, “পুরোহিত ছম্ভী, দ্বার খোল, আর কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।” 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *