প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব

উদাসী রাজকুমার – ১.৩

রাজা মহাচূড়ামণি হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে মন্ত্রী জীবকের চুলের মুঠি চেপে ধরে বললেন, “আগুন যে ছাই খায় না, আগুন যে ছাইয়ের ওপর দিয়ে যায় না, এই সামান্য কথাটা তুমি জানতে না কেন? এটা তোমারই তো জানার কথা। পাষণ্ড, তুমি শুধু-শুধু মন্ত্রী সেজে আছ? যাও, আজ’ থেকে আর তুমি মন্ত্রী রইলে না। তোমাকে আমি নির্বাসনে পাঠাব।” 

রানিও হাসতে হাসতে বললেন, “মহারাজ, মন্ত্রীকে ছেড়ে দিন। ওঁর একার কোনও দোষ নেই। আগুনের স্বভাব মেয়েরাই ভাল জানে!”

ছোট টিলাটি থেকে রাজা এবং রানি সদলবলে নেমে এলেন নীচে। সৈন্যরা রানি তলতাদেবীর নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগল। ভাস্কর জয়পাল ও আর-কয়েকজন গ্রামবাসী লাফাতে লাগল আনন্দে। 

ভুরুঙ্গা গ্রামের আগুনও প্রায় নিভে এসেছে। 

রানি তলতাদেবী রাজা মহাচূড়ামণির দিকে ফিরে বললেন, “হে মহারাজ, অতি সাবধানতার জন্যই আমি ভুরুঙ্গা গ্রামেও আগুন ধরিয়েছি। মাঝখানের যবের খেতটা পুড়তে যদি দেরি হত, তা হলে দাবানল এই পর্যন্ত ধেয়ে আসত। তার আগেই এই দিকটা ছাই করে দেবার দরকার ছিল।” 

রাজা মহাচূড়ামণি বললেন, “বেশ করেছ! বেশ করেছ! দু-একটা গ্রাম পুড়লে কী আর আসে যায়! তোমার বুদ্ধিতে রাজধানী রক্ষা পেয়েছে। সারা রাজ্য ছারখার হয়নি। আগেরবারের দাবানলে প্রজারা একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছিল।” 

রানি বললেন, “অট্টাগ্রাম আর ভুরুঙ্গা গ্রামের সব ঘর-বাড়ি নষ্ট হয়েছে। এই দুই গ্রামের প্রজারা এখন নিরাশ্রয়। রাজকোষের টাকা দিয়ে এদের ঘর-বাড়ি তৈরি করে দেওয়া উচিত।” 

রাজা তৎক্ষণাৎ বললেন, “অবশ্যই! অবশ্যই! মন্ত্রী, ঘোষণা করে দাও, অট্টা আর ভুরুঙ্গার প্রজারা ঘর-বাড়ি তৈরি করার জন্য রাজকোষ থেকে অর্থ পাবে। মহারানি তাদের ওপর দয়া করেছেন।” 

হঠাৎ দূরে তুমুল গোলমাল শোনা গেল। 

ভুরুঙ্গা গ্রামের পরে একটি ফলের বাগান, তারপর আবার যবের খেত। আর চারপাশে ছোট-ছোট টিলা, সেগুলি জঙ্গলে ভরা। দাবানল ছুটে এলে এর কিছুই রক্ষা পেত না। এখন আগুনের তাণ্ডব থেমে গেছে। ওদিকের আর-একটা টিলার ওপর আশ্রয় নিয়েছিল এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ। রাজপুরোহিত ছম্ভী সেইসব প্রজাদের মধ্যে ইন্দ্রের পূজা পরিচালনা করছিলেন। 

এখন সেইসব প্রজারা উল্লাসের সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে নেমে আসছে! তারা জয়ধ্বনি দিচ্ছে, “জয় মহারাজ বীর চূড়ামণি! জয় গুরুদেব ছম্ভী! জয় ইন্দ্রদেবতা!”

রানি তলতাদেবীর নাম তারা উচ্চারণও করছে না! 

প্রজারা যে-কোনও সময়েই রাজার নামে জয়ধ্বনি দেবে, এ তো স্বাভাবিক। কিন্তু রানি তলতাদেবী যে দাবানলকে জয় করলেন, প্রজাদের এত বড় বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন, তা কি ওই লোকগুলো বোঝেনি? রানির নামেও জয়ধ্বনি না দিয়ে তারা গুরুদেব ছম্ভীকে অত গুরুত্ব দিচ্ছে কেন? 

রাজা মহাচূড়ামণি ভুরু কুঁচকে চাইলেন রানির দিকে। রানি মৃদু হাসলেন। তারপর তাকালেন আকাশের দিকে। 

মন্ত্রী জীবক মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “মহারাজ, বৃষ্টি!” 

আকাশে কুণ্ডলি পাকিয়েছে কালো মেঘ। তার সঙ্গে মিশেছে আগুনের ধোঁয়া। টপটপ করে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল। 

রাজা তাঁর বিশাল শরীরেও সেই বৃষ্টি অনুভব করলেন। আরও অবাক হয়ে বললেন, “বৃষ্টি? বৃষ্টি নেমেছে?” 

রাজপুরোহিত ছম্ভী সেই সময় ছুটতে ছুটতে এসে উপস্থিত হয়ে বললেন, “মহারাজ, দেখুন মন্ত্রের জোর! দেখুন, ব্রাহ্মণের তেজ! আমার আহ্বানে ইন্দ্রদেবতা সাড়া না দিয়ে পারেননি! ইন্দ্রের কাছে অগ্নি হেরে গেছেন। দাবানল আর এগিয়ে আসবে না!” 

মহাচূড়ামণি বললেন, “দাবানল তো মহারানির বুদ্ধিতে আগেই থেমে গেছে। গুরুদেব, আপনি কি আগে জানতেন যে, আগুন কখনও ছাই খায় না?” 

ছম্ভী বললেন, “সে কথা কে না জানে! কিন্তু এই মহা দাবানল বৃষ্টি দেখে ভয় পেয়েছে!” 

মহাচূড়ামণি বললেন, “কিন্তু বৃষ্টি নামবার আগেই তো দাবানল…”

রানি তলতাদেবী বললেন, “মহারাজ, রাজপুরোহিত ঠিকই বলছেন! আকাশে বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখেই দাবানল নিভে গেল। গুরুদেব ছম্ভীকে আমার প্রণাম জানাই!” 

প্রজারা আবার রাজপুরোহিত ছম্ভীর নামে জয়ধ্বনি দিল। 

বৃষ্টি কিন্তু মাত্র এক পশলা হয়েই থেমে গেল। তাতে ভাল করে মাটিও ভিজল না। 

মহাচূড়ামণি খুঁতখুঁত করতে লাগলেন। এইটুকু বৃষ্টিতে সামান্য আগুনও নিভে যাওয়ার কথা নয়। দাবানল তো লম্বা-লম্বা জিভ দিয়ে এই বৃষ্টি চেটে খেয়ে ফেলতে পারে। এই বৃষ্টি যেন রোগা রোগা দশ-বারোটি সৈন্য, আর দাবানলের সহস্র শিখায় যেন সহস্র দুঃসাহসী যোদ্ধা। এমন বৃষ্টি ও আগুনে লড়াই হলে তো আগুনেরই জয়ী হওয়ার কথা। 

মহাচূড়ামণি তাঁর রানির বুদ্ধির জোর দেখে গর্বিত বোধ করছিলেন। আগুনে ছাই খায় না, এ কথাটা তো তিনি আগে জানতেন না। সত্যিই তো, যেখানে আগুন লাগে, সেখানে আর সব কিছু ঘাস হয়ে গেলেও অনেক ছাই পড়ে থাকে। মাঝখানে অনেক ছাই পড়ে থাকলে আগুন সেই ছাই ডিঙিয়ে আসতেও পারে না। অট্টাগ্রামের দাবানল তাই যবের খেতের ছাই দেখে থমকে গিয়েছিল। 

কিন্তু রানি তলতাদেবী রাজপুরোহিত ছম্ভীর কথায় কোনও প্রতিবাদ করলেন না। প্রজারা ছম্ভীর নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে, রানি তলতাদেবী মৃদু মৃদু হাসছেন। মহাচূড়ামণি মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, “যবের খেত যদি পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া না হত, তা হলেও এইটুকু বৃষ্টিতে কি দাবানল থামত?” 

মন্ত্রীর বদলে ছম্ভীই উত্তর দিলেন, “মহারাজ, দেবরাজ ইন্দ্র শুধু একটি তীর ছুঁড়েই অগ্নিকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। তাই আর যুদ্ধ করার দরকার হয়নি!” 

এই উত্তর শুনেও রাজা খুব সন্তুষ্ট হলেন না। তবে তিনি চুপ করে রইলেন। রানি কেন নিজের কৃতিত্ব দাবি করছেন না, সেটাই বুঝতে পারলেন না তিনি। 

সকলে মিলে সেই রাত্রেই ফিরে এলেন রাজধানীতে। দাবানলের হাত থেকে রাজধানী রক্ষা পেয়েছে বলে প্রজারা আনন্দ উৎসব করতে লাগল সারারাত ধরে। 

রাজা মহাচূড়ামণি আবার নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোতে গেলেন। 

তিনি জাগলেন পরদিন প্রায় সন্ধের সময়। একমাত্র খিদে পেলেই তাঁর ঘুম ভাঙে। তাঁর ঘুম ভাঙারও একটা বিশেষ ধরন আছে। 

তিনি প্রহরের পর প্রহর চিত হয়ে ঘুমোন, মেঘ গর্জনের মতো তাঁর নাক ডাকে। কয়েক জন কাজের লোক পালা করে বসে থাকে দরজার কাছে, তারা খুব মনোযোগ দিয়ে সেই নাক-ডাকা শোনে। কোনও এক সময় হঠাৎ নাসিকা গর্জন বন্ধ হয়ে যায়, তখন রাজা পাশ ফেরেন। সেই সময়ই কাজের লোকেরা বুঝতে পারে, এইবার রাজার জেগে ওঠার সময় হয়েছে। 

পাশ ফেরা মাত্রই অবশ্য রাজা জাগেন না। তিনি কিছুক্ষণ ছটফট করতে থাকেন। একবার এপাশ আর একবার ওপাশ ফেরেন, নিজের গায়ে চাপড় মারেন। এইরকম কিছুক্ষণ চলার পর তিনি চোখ বুজেই বলে ওঠেন, “বুক শুকিয়ে গেল! জল, জল!” 

তখনই একজন দাসী রুপোর থালার ওপর রাখা সোনার একটি ঘটি ভর্তি সুগন্ধ জল নিয়ে রাজার খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। চোখ না খুলেই রাজা হাত বাড়িয়ে সেই ঘটিটি নিয়ে ঢকঢক করে সবটুকু জল নিঃশেষ করে ফেলেন। 

ততক্ষণে রাজার খাবারদাবার সব তৈরি করা শুরু হয়ে গেছে। ঘুম ভাঙলেই রাজার সাঙ্ঘাতিক খিদে পায়, অর্থাৎ খিদের জন্যই তাঁর ঘুম ভাঙে। তখন আর তাঁর স্নান করারও তর সয় না। পেট ভরে খাবার পর রাজা স্নান করতে যান। 

রাজা মহাচূড়ামণি একঘটি জল পান করার পর প্রথম চোখ মেলে তাকালেন। গবাক্ষ দিয়ে বাইরে সন্ধের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। আকাশের আলো মিলিয়ে গেছে, পশ্চিম দিগন্তে শুধু লেগে আছে সূর্যাস্তের খানিকটা লাল আভা। বাগানের বড়-বড় গাছগুলিতে পাখিরা ফিরে এসেছে নীড়ে, রাত নেমে আসার আগে তারা প্রত্যেকেই একবার গলা খুলে ডেকে নেয়। 

রাজা একজন দাসীকে জিজ্ঞেস করলেন, “এখনও ভোর হতে কত বাকি আছে?” 

দাসী মাথা নিচু করে বলল, “মহারাজ, এখন সন্ধ্যা!” 

রাজা এবার উঠে বসলেন। এখন সন্ধ্যা শুনেই তাঁর খিদে যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। 

সুসীম নামে একজন কাজের লোক সঙ্গে-সঙ্গে ছুটে এল রাজাকে পাদুকা পরাতে। রাজা নাগরা পায়ে দিয়ে খাট থেকে নেমে দাঁড়াতেই তাঁর একটা কথা মনে পড়ল। 

তিনি সুসীমের দিকে তাকিয়ে বললেন, “অ্যাই, তুই কেন জুতো পরাতে এলি? আমার ভূতপূর্ব সেনাপতি চম্পক কোথায়? তাকেই তো আমি পাদুকা পরাবার কাজে নিযুক্ত করেছি।” 

সুসীম বলল, “মহারাজ, আমি কি এ-কাজের অনুপযুক্ত? আপনার পাদুকায় 

সামান্য ধুলো পড়লে আমি জিভ দিয়ে চেটে তা পরিষ্কার করি!” 

রাজা বললেন, “তাই নাকি? তোর এত সাহস, তুই আমার জুতোয় জিভ ছোঁয়াস? কে তোকে সেই অনুমতি দিয়েছে? আজই তোর ওই জিভ কেটে ফেলতে হবে।” 

সুসীম একটুও ভয় না পেয়ে বলল, “আমার জিভ কাটা গেলে মহারাজ যদি খুশি হন, তবে সে তো আমার পক্ষে খুবই সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমি এই মুহূর্তেই জিভ বিসর্জন দিতে রাজি আছি! তবে, তবে, তবে…”

রাজা ধমক দিয়ে বললেন, “আবার তবে-তবে কী?” 

সুন্সীম বলল, “মহারাজ, আমার গল্প শুনে রাজকুমারেরা খুব খুশি হয়। মহারানিও আদেশ দিয়েছেন, প্রতিদিন রাজকুমারদের দুটি করে গল্প শোনাবে। জিভ কাটা গেলে তো সেটা আর হবে না!” 

রাজা এক মুহূর্ত চিন্তা করে বললেন, “জিভ কাটা গেলে রাজকুমারদের গল্প শোনাতে পারবি না, তাই না? তবে তোর জিভ রইল। তুই এখন থেকে রাজকুমারদেরই গল্প শোনাবি আর জুতো পরাবি। কিন্তু খবরদার, রাজকুমারদের জুতোয় জিভ ঠেকাবি না কক্ষনো!” 

সুসীম বলল, “যথা আজ্ঞা, প্রভু!” 

রাজা জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু চম্পক কোথায় গেল? কাল থেকে সে-ই আমার পাদুকা সেবা করবে।” 

সুসীম বলল, “মহারাজ, কাল রাত্রি থেকে সেনাপতিকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কেউ বলছে, তিনি মনের দুঃখে বুঝি আত্মহত্যাই করে বসেছেন!” 

রাজা চূড়ামণি হুঙ্কার দিয়ে বললেন, “কী, তার এত বড় সাহস! ওরে কে আছিস! এক্ষনি চম্পককে ধরে নিয়ে আয়। যেখান থেকে পারিস তাকে ধরে আন। জীবিত অথবা মৃত!”

এরপর রাজা গেলেন খাওয়ার ঘরে। 

মেঝেতে গালিচা পাতা। তার সামনে একটা মস্ত বড় কাঠের পরাতের ওপর একটা আস্ত হরিণের ঠ্যাং ঝলসানো। এ ছাড়া দশ-বারোটি পাথরের বাটি ভর্তি দই আর চাটনি। রাজা মহাচূড়ামণি ভাত কিংবা রুটি খান না। দই ও চাটনির সঙ্গে নানারকম মাংসই তাঁর প্রিয় খাদ্য। হরিণের ঠ্যাংটি শেষ করার পর তিনি খেলেন চারখানা বন্য কুক্কুট ভাজা। 

খাওয়া শেষ করার পর তিনি পিছনের গোল অলিন্দে এসে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলেন, আজ স্নান করবেন কি করবেন না! একটু পরেই তিনি স্থির করলেন, নাঃ, আজ আর দরকার নেই। মেয়েরা প্রত্যেকদিন স্নান করে বটে, কিন্তু পুরুষদের আট-দশদিন অন্তর স্নান করলেও চলে! 

ঠিক এখনই ঘুম আসছে না। তা হলে কী করে সময় কাটানো যায়? 

রাজা মহাচূড়ামণি গান-বাজনা শুনতে ভালবাসেন না, কিছু বোঝেনও না। তাঁর সভায় একজন রাজকবি আছেন বটে, কিন্তু রাজা নিজে সভাতে প্রায়ই যান না, তাই কবিতাও শোনা হয় না। পাত্র-মিত্রদের সঙ্গে বসলে সবাই মিলে তাঁর এমন প্রশংসা ও তোষামোদ করে যে রাজার কান ঝালাপালা হয়ে যায়। রাজার একমাত্র ভাল লাগে যুদ্ধ-বিগ্রহে ব্যস্ত থাকতে। কিন্তু তিনি সদ্য একটা যুদ্ধ শেষ করে এসেছেন। এখন আর শত্রুর আক্রমণের সম্ভাবনা নেই। 

লোকে ভাবে রাজারা বুঝি সব সময়ই খুব ব্যস্ত থাকে। আসলে রাজাদেরও এক-একদিন কিছুতেই সময় কাটতে চায় না। 

রাজা মহাচূড়ামণি অলিন্দে দাঁড়িয়ে উদ্যানের শোভা দেখতে লাগলেন একা-একা। 

একটু পরে একজন দৌবারিক এসে জানাল যে, মন্ত্রী জীবক একবার রাজার সঙ্গে দেখা করতে চান। রাজা সম্মতি জানালেন। 

মন্ত্রী এসে অভিবাদন করে দাঁড়াতেই রাজা জিজ্ঞেস করলেন, “কী হে মন্ত্ৰী, রাজ্যের সব কুশল তো? আবার কোনও দুঃসংবাদ আনোনি তো?” 

মন্ত্রী বললেন, “না, মহারাজ, দুঃসংবাদ কিছু নেই।” 

রাজা বললেন, “বাঃ! তা হলে তুমি এমনিই দেখা করতে এসেছ আমার সঙ্গে?” 

মন্ত্রী বললেন, “আপনার ঠিক মতন নিদ্রা হয়েছে কি না, সেটাই জানতে এসেছিলাম। আর-একটা প্রশ্নও ছিল। গত যুদ্ধে আমাদের প্রায় চারশোটি ঘোড়া নিহত হয়েছে / সৈন্যবাহিনীর জন্য আবার ঘোড়া কেনা দরকার। শিগগিরই প্রয়াগের মেলায় অশ্বের হাট বসবে। সেখান থেকে অশ্ব কিনলে কিছু কম দামে পাওয়া যাবে।” 

রাজা বললেন, “তা হলে প্রয়াগের মেলা থেকেই কিনে ফেলো চারশো ঘোড়া।” 

মন্ত্রী একটু ছোট কাসি দিয়ে বললেন, “মহারাজ, বলছিলাম কি, এখন রাজকোষে অর্থ বেশি নেই। এখন সৈন্যবাহিনীর জন্য ঘোড়া কেনাটা খুবই জরুরি। আবার কাল রাত্রে মহারানি আদেশ দিলেন, সীমান্তের দুটো গ্রামের পুড়ে যাওয়া বাড়ি-ঘর সব রাজকোষের টাকা দিয়ে তৈরি করে দিতে হবে। একসঙ্গে এত টাকা পাওয়া যাবে কোথায়?” 

রাজা সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, “আগে ঘোড়া কিনে নাও! আমাদের সৈন্যবাহিনীতে ঘোড়া কম আছে জানতে পারলে শত্রুরা হঠাৎ এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে!” 

মন্ত্রী মাথা চুলকিয়ে বললেন, “কিন্তু মহারাজ, কালই মহারানি প্রজাদের কথা দিয়ে এসেছেন। ওই দুটি গ্রামের মানুষের মাথা গোঁজার জায়গা নেই, তারা আজ-কালের মধ্যেই দাবি জানাতে আসবে যে!” 

রাজা এবার চুপ করে গেলেন। তাঁর মতে, ঘোড়া কেনা আগে দরকার। আবার রানি কথা দিয়েছেন প্রজাদের। এই অবস্থায় কী করা উচিত, তা তাঁর বুদ্ধিতে কুলোল না। 

তিনি বিরক্ত ভাবে বলে উঠলেন, “রাজকোষে টাকা কম থাকে কেন? আমি কষ্ট করে শত্রুদের জয় করি, আর তোমরা রাজকোষ ভর্তি রাখতে পারো না? যত সব অপদার্থ! যাও, এই ব্যাপারে রানির সঙ্গে পরামর্শ করো গিয়ে! তিনি যা বলবেন, সেটাই হবে!” 

মন্ত্রী বললেন, “ঠিক বলেছেন মহারাজ! এ-ব্যাপারে মহারানির সঙ্গেই পরামর্শ করা দরকার।” 

মন্ত্রী চলে যেতে উদ্যত হয়েছিলেন, রাজা তাঁকে আবার ডেকে বললেন, “শোনো! কাল মাঝরাত্তিরে আমি রাজধানীতে এসে ঘুমিয়েছি। জেগেছি আজ সন্ধেবেলা। এর মধ্যে বৃষ্টি হয়েছিল?” 

মন্ত্রী বললেন, “আজ্ঞে না, মহারাজ। আকাশে মেঘ রয়েছে খুব! কিন্তু বৃষ্টি এখনও নামছে না। কাল ভুরুঙ্গা গ্রামে যা ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হয়েছিল, সেইটুকুই শেষ!” 

রাজা মহাচূড়ামণির মুখে রাগের ছায়া পড়ল। 

তিনি মন্ত্রীর দিকে রক্তচক্ষে তাকিয়ে বললেন, “ওইটুকু বৃষ্টিতে দাবানল আটকাত না! দাবানল থেমেছে মহারানির বুদ্ধিতে, তাই না? তবু লোকে পুরোহিত ছম্ভীর নামে জয়ধ্বনি দিল। তুমিও তাতে গলা মিলিয়েছিলে কেন?” 

মন্ত্রী এবার রাজার খুব কাছে এগিয়ে এলেন। 

গোপন কথা বলার মতন ফিসফিস করে বললেন, “মহারাজ, পুরোহিত ছম্ভীর প্রার্থনায় যে বৃষ্টি নেমেছে এবং সেইজন্যই অগ্নির দৌড় থেমে গেছে, লোকের মনে এই কথাটা বিশ্বাস করানোই ভাল। পুরোহিত ছম্ভী ঠিক কাজই করেছেন!” 

রাজা কর্কশ গলায় বললেন, “কী করে এটা ঠিক কাজ হল? দাবানল দেখে পুরোহিতও প্রথমে ভয় পাননি? তিনি আমাকে রাজধানী ছেড়ে পালাবার পরামর্শ দেননি? তখন কেন ইন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করার কথা ওঁর মনে আসেনি? ভুরুঙ্গা গ্রামে গিয়ে যেই দেখলেন যে, আকাশে মেঘ আছে, অমনি তিনি অং বং চং মন্ত্র পড়তে শুরু করলেন। ওইটুকু বৃষ্টি হওয়াও যা, না হওয়াও তা! দাবানল থেকে এ-রাজ্যকে রক্ষা করেছেন আমার রানি!” 

মন্ত্রী বললেন, “তবু কী ভাগ্য যে ওইটুকু বৃষ্টি নেমেছিল। তাই পুরোহিতের মান রক্ষা হল। মহারাজ, আপনার চেয়ে যদি রানির খ্যাতি বেশি বেড়ে যায়, সেটা রাজ্যের পক্ষে ভাল না।” 

রাজা খানিকটা হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, “রানির বেশি খ্যাতি ভাল নয়? কেন, ভাল নয়?” 

মন্ত্রী বললেন, “প্রজারা যদি টের পেয়ে যায়, রাজার চেয়ে রানির বুদ্ধি বেশি, তা হলে কি তারা আপনাকে আর সম্মান করবে?” 

রাজা বললেন, “আমার চেয়ে রানির বুদ্ধি বেশি? তা তো বটেই! তোমার চেয়েও রানির বুদ্ধি বেশি! দাবানল কী করে থামাতে হয়, তা তুমিও জানতে না! ওই পুরোহিত ছম্ভীও জানতেন না। রানির বুদ্ধি বেশি, সেটা তো সত্যি কথা! প্রজারা তা জানলে দোষ কী?” 

মন্ত্রী বললেন, “মহারাজ, তা হলে প্রজারা মনে করবে, রানিই এই রাজ্য চালাচ্ছেন! আপনি কেউ না!” 

রাজা এবার হেসে উঠে বললেন, “যত সব তোমাদের অদ্ভুত কথা! আমি বাহুবলে শত্রু জয় করি! আমি না থাকলে আমার সৈন্যরা অনাথ! তা সকলেই জানে। রাজ্যের রাজকর্ম চালাবার ব্যাপারে রানি অনেক সময় বুদ্ধি দেন। সেটা তো ভালই!” 

মন্ত্রী বললেন, “মহারাজ, শুধু এইটুকুতেই শেষ নয়! আজ সবাই জেনে গেছে যে, আপনি যাদের শাস্তি দেন, রানি তাদের ক্ষমা করে দেন। এর পর আপনার কথা আর কেউ মানতেই চাইবে না!” 

রাজা হেসে বললেন, “কাল রাত্রে রানির অনুরোধে আমি তোমাকেও ক্ষমা করে দিয়েছি!” 

মন্ত্রী যেন একথাটা শুনতেই পাননি এমন ভান করে বললেন, “আসল কথাটা ভেবে দেখুন মহারাজ! মহারানি তলতাদেবী যখন ছোট ছিলেন, তখন উনি নিজের পিতার রাজ্যের সিংহাসনে বসতে চেয়েছিলেন। সিংহাসনের ওপর ওঁর লোভ আছে। একদিন হয়তো উনি আপনাকেও সরিয়ে দিয়ে এই রাজ্যের সিংহাসনে বসবেন!”

এবার রাজা মহাচূড়ামণির চোখ দুটি গোল-গোল হয়ে গেল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *