প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব

উদাসী রাজকুমার – ১.৭

মাত্র চারজন দেহরক্ষী নিয়ে মহারানি তলতাদেবী বেরিয়ে পড়লেন রাজধানী থেকে। তাঁর সাদা ঘোড়ার পিঠে রাজছত্র বসানো। তলতাদেবীও পরে আছেন রেশমের পোশাক। তিনি সাদা রং পছন্দ করেন। 

নগর থেকে খানিকটা দূরে একটা উঁচু টিলার ওপর মহাকালের মন্দির। তলতাদেবী প্রথমে চললেন সেই দিকে। রাজধানীর প্রজারা মনে করবে যে, মহারানি মন্দিরে পূজা দিতে যাচ্ছেন। সেখানে তিনি প্রায়ই যান। 

প্রথমে তলতাদেবী মহাকালের মন্দিরে এসে সত্যিই ভক্তিভরে পূজা দিলেন। সেখানকার পুরোহিতের সঙ্গে কথা বললেন খানিকক্ষণ। এই মন্দিরের জন্য একটি অতিথিশালা বানানো দরকার। মহারানি প্রতিশ্রুতি দিলেন, শীঘ্র একটি অতিথিশালা বানিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবেন। 

তারপর মন্দির থেকে বেরিয়ে মহারানি গেলেন কাছাকাছি একটা ঝরনা দেখতে। তীর্থযাত্রীরা অনেকেই এই ঝরনায় এসে স্নান করে। রাজা-রানির জন্য আলাদা করে ঘেরা একটা জায়গা আছে। তলতাদেবী সেখানে গিয়েও স্নান করতে নামলেন না। তিনি আগেই স্নান করে এসেছেন। 

ঝরনাটা ছাড়িয়ে তিনি ঢুকে পড়লেন জঙ্গলের মধ্যে। 

একটু পরেই দেহরক্ষীরা পৌঁছে গেল তাঁর কাছে। সবাই মিলে যেতে লাগলেন গভীর জঙ্গলের দিকে, একজন গুপ্তচর পায়ে হেঁটে আগে আগে তাঁদের পথ দেখিয়ে যেতে লাগল। 

এদিকে আর কোনও গ্রাম নেই। শুধু পাহাড়ের পর পাহাড় আর জঙ্গল একটু সরু পায়ে-চলা পথ রয়েছে শুধু। তলতাদেবী এদিককার পথ চেনেন না। তবু তিনিএকটুও ভয় পেলেন না। তাঁর দেহরক্ষী চারজন অত্যন্ত বিশ্বাসী এবং নিপুণ যোদ্ধা। তারা মহারানির জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। এ-রাজ্যে চোর-দস্যুরও তেমন উৎপাত নেই। তা ছাড়া মহারানির পথ আটকে দাঁড়াবার মতন সাহস এ-রাজ্যের কোন মানুষের হবে না। 

মহারানি শুধু একটাই চিন্তা করতে লাগলেন, কাজ উদ্ধার করে তাঁকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসতে হবে। মহারাজ জেগে ওঠার আগেই! 

চম্পকের রাগ করার কারণ আছে। সে এই রাজ্যের সেনাপতি। তার বাবাও সেনাপতি ছিলেন। হঠাৎ মহারাজ মহাচূড়ামণি তাকে সেনাপতিত্ব থেকে সরিয়ে জুতো পরাবার কাজ দিলেন। মহারাজের মাথায় মাঝে মাঝে এরকম অদ্ভুত খেয়াল জাগে। 

অবশ্য যুদ্ধের সময় মহারাজ নিজেই সৈন্য পরিচালনা করেন। সেনাপতি চম্পকের বিশেষ কোনও কাজ থাকে না। চম্পকের সুন্দর চেহারা, সেইজন্য আড়ালে অনেকে তাকে ঠাট্টা করে বলত, পুতুল-সেনাপতি! 

কিছু পাহাড়ি উপজাতির সৈন্য জুটিয়ে নিয়ে চম্পক বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিজের মৃত্যু ডেকে এনেছে। এত সাহস তার হল কী করে? মহারাজ মহাচূড়ামণি নিজে অস্ত্র ধারণ করে, উত্তর পাঞ্চালের সৈন্যবাহিনী সঙ্গে নিয়ে এলে, চম্পক এই সামান্য দলবল নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই পারবে না। নির্ঘাত তার প্রাণ যাবে। বিদ্রোহীদের মহারাজ কিছুতেই ক্ষমা করবেন না। 

এখন চম্পকের বাঁচার একমাত্র উপায় কিছুদিনের জন্য কোথাও লুকিয়ে থাকা। এমনকী, সে যদি এ-রাজ্যের বাইরে চলে যায়, তা হলে আরও ভাল।

হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে প্যাঁ পোঁ প্যাঁ পোঁ করে খুব জোের ভেঁপু বেজে উঠল।

শব্দ যে কোথা থেকে এল তা বোঝাই গেল না প্রথমে। তারপর সেই শব্দটা ক্রমেই দূর থেকে আরও দূরে ছড়িয়ে পড়ল। 

দেহরক্ষী চারজন চতুর্দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দেখে এসে জানাল যে, এখানকার অনেকগুলো গাছে প্রহরীরা বসে আছে। তারা ভেঁপু বাজিয়ে সঙ্কেত দিচ্ছে। নিশ্চয়ই কাছেই কোথাও চম্পকের বাহিনীর শিবির। 

তলতাদেবী বললেন, “হুঁ, ব্যবস্থা ভালই করেছে দেখছি! এগিয়ে চলো!”

ক্রমশই ভেঁপুর আওয়াজ বাড়তে লাগল। আরও খানিকটা এগোবার পর দেখা গেল জঙ্গলের মধ্যে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে সারি সারি তাঁবু। 

তাঁবুগুলোর সামনে অন্তত পঞ্চাশজন পাহাড়ি যোদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের খালি গা, কোমরের নীচে পালকের পোশাক, মাথাতেও পালক গোঁজা। তারা তীর-ধনুক উঁচিয়ে আছে। ছিলা টান টান, যে-কোনও মুহূর্তে ছুটে আসবে ধারালো তীর। 

তলতাদেবী ঘোড়া থামিয়ে ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। 

প্রধান দেহরক্ষী সোমদত্ত জিজ্ঞেস করল, “মহারানি, আমরা কি আর এগোব?” 

তলতাদেবী বললেন “তুমি সাদা পতাকা এনেছ তো? সেই পতাকা উড়িয়ে দাও।” 

সোমদত্ত সাদা পতাকা তুলে মহারানিকে আড়াল করে দাঁড়াল। 

তলতাদেবী তখন গুপ্তচরটিকে বললেন, “তুমি আমাদের দূত হয়ে সামনে এগিয়ে যাও। সেনাপতি চম্পককে আমার এই বার্তা দেবে; উত্তর পাঞ্চাল রাজ্যের মহারানি এসেছেন সেনাপতি চম্পকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তিনি সঙ্গে সেনাবাহিনী আনেননি। সেনাপতি চম্পক তাঁর অনুচরদের অস্ত্র নামিয়ে ফেলতে আদেশ দিক।” 

গুপ্তচরটি সেই তীর-ধনুক ওঁচানো পাহাড়ি সৈন্যদের দিকে, আর-একবার মহারানির দিকে তাকিয়ে ভয়-পাওয়া কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “যাব? আমি একা যাব?” 

মহারানি আঙুল তুলে আদেশ দিলেন, “যাও!” 

সে দুরুদুরু বুকে এগিয়ে যেতে লাগল। পাহাড়ি যোদ্ধারা তখনও তীর-ধনুক উঁচিয়ে আছে। 

একটু পরেই মহারানির দূত ফিরে এল, সঙ্গে বিপক্ষের একজন দূত। সেই বিপক্ষের দূতটি রানিকে প্রণাম জানিয়ে বলল, “স্বাগতম মহারানি! আমাদের দলপতি আপনাকে তাঁর শিবিরে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তবে, আপনার চারজন দেহরক্ষীকে এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। তারা আর এগোতে পারবে না!” প্রধান দেহরক্ষী সোমদত্ত তৎক্ষণাৎ বলে উঠল, “না, আমরা মহারানিকে একলা যেতে দেব না!” 

তলতাদেবী হাত তুলে সোমদত্তকে চুপ করতে ইঙ্গিত করলেন। তারপর বললেন, “ঠিক আছে, আমি একাই যাব!” 

ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন সামনে, পাহাড়ি যোদ্ধাদের তিনি গ্রাহ্য করলেন না। সেই যোদ্ধারা সরে গিয়ে তাঁকে জায়গা করে দিল। 

একটি বড় শিবিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে চম্পক। তার সর্বাঙ্গে রাজপোশাক, মাথায় একটা সোনার মুকুট। সে এখন সেনাপতি নয়, রাজা! 

চম্পক এগিয়ে গিয়ে সহাস্যে বলল, “আসুন, আসুন, মহরানি, কী সৌভাগ্য আমার! আপনি নিজে এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। এই দুপুর রৌদ্রে আপনার সোনার বর্ণে আঁচ লেগেছে। আপনি আমার শিবিরে এসে আসন গ্রহণ করুন।” 

তলতাদেবী ঘোড়া থেকে নামলেন। তারপর রাগত স্বরে বললেন, “এ কীরকম ব্যবহার তোমার, চম্পক! আমি দিনের আলোয় এসেছি, আমার সঙ্গে চারজনের বেশি দেহরক্ষী নেই। গাছের ওপর বসে তোমার প্রহরীরা সব দেখেছে। তবু তোমার সৈন্যরা তীর-ধনুক উঁচিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করল? আমি কি শত্রু হিসেবে এসেছি তোমার কাছে?” 

চম্পক এবারও হেসে বলল, “আমার পাহাড়ি সৈন্যরা অস্ত্র তুলে আপনাকে সম্মান জানিয়েছে। তা ছাড়া, আমি যে একেবারে সহায়-সম্বলহীন নই, সে-কথাও আপনাকে জানানো হল।” 

তলতাদেবী বললেন, “হুঁ, তুমি এর মধ্যেই রাজা হয়ে গেছ দেখছি!”

চম্পক মহারানিকে নিয়ে এল শিবিরের মধ্যে। সেখানটা বেশ সুন্দরভাবে সাজানো প্রচুর টাটকা ফুল দিয়ে। 

ভেতরে এসে তলতাদেবী বেশ কয়েক মুহূর্ত অপলকভাবে তাকিয়ে রইলেন চম্পকের দিকে। 

চম্পক তাঁর চেয়ে প্রায় পাঁচ বছরের ছোট। মহারানি তাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতন স্নেহ করেন। এর আগে চম্পক প্রায়ই নানা ব্যাপারে তাঁর পরামর্শ নিতে যেত। মহারাজা মহাচূড়ামণি ঘুমিয়ে থাকলে মহারানির কাছ থেকেই সে নির্দেশ নিত। মহারানিকে খুব ভক্তি করত সে। সেই চম্পক হঠাৎ অনেক বদলে গেছে। 

চম্পক বলল, “কী খাবেন বলুন? রোদ্দুরের মধ্যে এসেছেন, আগে শরবত আনতে বলি? তারপর দুপুরের আহার্য এখানেই গ্রহণ করবেন।” 

তলতাদেবী বললেন, “আমি এখানে খেতে আসিনি!” 

চম্পক বলল, “আপনার সেবা করার কিছু সুযোগ দিন আমাদের!”

তলতাদেবী বললেন, “আমার সময় নেই। আমাকে খুব তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আমি ছুটে এসেছি তোমাকে সাবধান করতে। এ কী পাগলামি শুরু করেছ, চম্পক? তুমি কি মরতে চাও?” 

চম্পক হা-হা করে হেসে উঠল, “মৃত্যুর জন্য আমার মোটেই ব্যস্ততা নেই, মহারানি! আমি এখনও অনেক বছর বাঁচব। আপনি বসুন। আপনি এত অস্থির হচ্ছেন কেন? উত্তর পাঞ্চাল রাজ্যের বিপদের চিন্তায় আপনি খুবই বিচলিত হয়ে পড়ছেন দেখছি!” 

তলতাদেবী ধমক দিয়ে বললেন, “আমি উত্তর পাঞ্চাল রাজ্যের বিপদের কথা একবারও ভাবিনি। আমি ছুটে এসেছি তোমাকে বাঁচাতে। তোমাকে বলেছিলাম, মহারাজের রাগ কমে যাওয়ার অপেক্ষায় কোনও গ্রামে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে। তুমি আমার কথা শুনলে না।” 

চম্পক বলল, “আমি লুকিয়ে থাকব কেন? মহাচূড়ামণিকে আমি গ্রাহ্য করি না। ওই হোঁতকাটাকে আমি আর ভয়ও পাই না।” 

“তোমার এত সাহস এল কোথা থেকে? মহারাজ এখনও কিছুই জানেন না। আমি তোমাকে বলতে এসেছি, তুমি সন্ধের আগেই পালিয়ে যাও! কিছুদিনের জন্য অন্য রাজ্যে আশ্রয় নাও। প্রয়াগ কিংবা বারাণসী ঘুরে এসো!” 

“আমি অন্য রাজ্যে পালাব? আমি মহাচূড়ামণিকে এবার চরম শিক্ষা দেব। ওই মূর্খ রাজাটা এতদিন অন্যদের যা ইচ্ছে শাস্তি দিয়েছে। এবার আমি তাকে এমন শাস্তি দেব যে, সে কল্পনাও করতে পারবে না!” 

‘কী পাগলের মতন কথা বলছ, চম্পক? মহারাজ যখন শুনবেন যে, তুমি বিদ্রোহ করেছ, অমনি তিনি ক্রোধে জ্বলে উঠবেন। তিনি তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে ছুটে এলে তুমি তৃণখণ্ডের মতন উড়ে যাবে।” 

“আমি তো মহাচূড়ামণির জন্যই অপেক্ষা করছি। আসুক না সে।” 

“তুমি এই সামান্য কয়েকজন সৈন্য নিয়ে মহারাজের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে?”

“আমার সৈন্যরা মোটেই সামান্য নয়। শিগগিরই অন্য সাহায্য আসবে!”

“অন্য সাহায্য মানে? তুমি কী বলছ, চম্পক? তুমি কি বিদেশী শত্রুদের সাহায্য নিয়ে দেশের সর্বনাশ করতে চাও? তুমি এমন কুলাঙ্গার হয়েছ?” 

“বিদেশী সাহায্যেরও দরকার হবে না। সাহায্য আসবে দেশের মধ্যেই আসল জায়গা থেকে। তবে আপনি চিন্তা করবেন না, মহারানি। ওই ঘটোৎকচ মহাচূড়ামণিটাকে আমি কঠিন শাস্তি দিলেও আপনার কোনও ক্ষতি হবে না!” 

তলতাদেবী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ঠিক আছে, তোমার সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক এখানেই শেষ! এর পর তোমার যা হয় হোক, তা নিয়ে আর আমি ভাবব না!” 

চম্পক দু’ হাত ছড়িয়ে মহারানির পথ আটকে বলল, “বসুন, বসুন, এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আমার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক শেষ কী বলছেন? এই তো সবে শুরু। মহাচূড়ামণির যাই-ই হোক না কেন, আপনি যেমন উত্তর পাঞ্চালের মহারানি আছেন, তাই-ই থাকবেন।” 

তলতাদেবী বললেন, “তার মানে?” 

চম্পক মহারানির দু’ বাহু ছুঁয়ে বলল, “আমি বসব উত্তর পাঞ্চালের সিংহাসনে, আপনি হবেন মহারানি।” 

তলতাদেবী কয়েক মুহূর্ত মহাবিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন চম্পকের দিকে। তারপরেই ক্রোধে তাঁর মুখ রক্তিমবর্ণ হয়ে গেল। তিনি ঠাস করে এক চড় কষালেন চম্পকের গালে। 

দাঁতে দাঁত চেপে তিনি বললেন, “অকৃতজ্ঞ! অমানুষ!” 

চড় খেয়েও চম্পক হাসতে হাসতে বলল, “কেন আমার কথাটা পছন্দ হল না? আমি রাজা হলেও রানি হিসেবে আপনাকে মানাবে। প্রজারাও আপনাকে পছন্দ করবে!” 

তলতাদেবী বললেন, “আর-একবার ওই কথা উচ্চারণ করলে একটা একটা করে তোমার দাঁত খুলে নেওয়াব! আমি আর এক মুহূর্ত এখানে অপেক্ষা করব না। তুমি নরকে যাও!” 

মহারানি শিবিরের দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই প্রথমে ঢুকল দু’জন সৈন্য, তাদের হাতে খোলা তলোয়ার। তারপর আরও দশ-বারোজন সৈন্য ঢুকে এসে গোল হয়ে দাঁড়াল। 

চম্পক বলল, “শিকল দিয়ে বাঁধো এই নারীকে। সাবধান, দেখো, এই রমণী অতিশয় বুদ্ধিমতী। কোনওরকম দুর্বলতা দেখিয়ো না, শক্ত করে হাত বাঁধো!” 

একজন সৈনিক শিকল ঝনঝনিয়ে এগিয়ে এল মহারানির দিকে। 

তলতাদেবী সেই সৈনিকটির চোখে চোখ রেখে প্রবল ঘৃণার সঙ্গে বললেন, “ছিঃ! তুমি উত্তর পাঞ্চালের মানুষ না? তুমি এ-রাজ্যের মহারানির গায়ে হাত তুলছ? তোমার লজ্জা করে না? মহারাজ তোমাদের এজন্য কী শাস্তি দেবেন, সে ভয় নেই?” 

সৈনিকটা কোনও কিছু বলার আগেই চম্পক বলে উঠল, “এই সৈন্যদের উত্তেজিত করার চেষ্টা করলে কোনও লাভ হবে না, মহারানি। এরা ভালভাবেই জানে, মহাচূড়ামণি আর বেশিক্ষণ মহারাজ থাকবে না। মহাচূড়ামণির আয়ু শেষ হয়ে গেছে। পরবর্তী মহারাজ হব আমি!” 

তলতাদেবী বুঝতে পারলেন, এতগুলি সৈনিকের সামনে কোনওরকম বাধা দেবার চেষ্টা করে লাভ নেই। তিনি সঙ্গে কোনও অস্ত্র আনেননি। মহারাজের কাছে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, আর কখনও অস্ত্র ধারণ করবেন না। 

সেই সৈনিকটি মহারানির হাত দুটি শিকলে বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে গেল পিছন দিকে অন্য একটি তাঁরতে। বাইরে তিনি একটা কোলাহল শুনতে পেলেন। নিশ্চয়ই তাঁর দেহরক্ষীদের সঙ্গে এখানকার সৈন্যদের লড়াই বেঁধে গেছে। সেই চারজন রক্ষী এতজন সৈন্যের বিরুদ্ধে কী করে দাঁড়াবে! ওরা সাদা পতাকা উড়িয়েছিল, তবু এরা আক্রমণ করল? 

খানিক পরে চম্পক একটা ঝলসানো হরিণের ঠ্যাং কামড়াতে কামড়াতে ঢুকল এই তাঁবুতে। 

তলতাদেবী ঘৃণায় তার দিকে তাকালেন না। 

চম্পক বলল, “আপনার চারজন দেহরক্ষীই শেষ হয়ে গেছে। একজনও পালাতে পারেনি। গুপ্তচরটিকে গাছের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে!” 

মাটির দিকে চোখ রেখে তলতাদেবী বললেন, “মানুষ এত দ্রুত বদলে যেতে পারে? তোমাকে আমি স্নেহ করতাম, তুমি তার এই প্রতিদান দিলে? রাজ্যের লোভে তুমি উন্মাদ হয়ে গেছ! পিঁপড়ের পাখা গজালে কী হয়, তুমি জনো না?” 

চম্পক বলল, “আমি শুধু-শুধু রাজ্যের লোভ করিনি, তলতাদেবী। সবরকম আটঘাট বাঁধা হয়ে গেছে। মহাচূড়ামণির এবার নিস্তার নেই। যথাসময়ে সব জানতে পারবেন! আঃ, মহাচূড়ামণি যখন ঘুম ভেঙে জানতে পারবে যে, তার প্রিয়তমা মহারানি আমার হাতে বন্দিনী, তখন তার মুখের অবস্থা কীরকম হবে? সেই গণ্ডমূর্খটা নিশ্চয়ই হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করবে। আঃ, সেই দৃশ্যটা ভেবেই যা আনন্দ হচ্ছে আমার!” 

মহারানি আর কোনও কথা বললেন না। 

চম্পক জিজ্ঞেস করল, “এখন আপনি কিছু খাবেন তো? খিদে পায়নি?”

তলতাদেবী বললেন, “তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাও!” 

চম্পক বলল, “ঠিক আছে, একেবারে রাজধানীতে গিয়ে আমার পাশে বসে মহারানি হয়ে রাজভোগ খাবেন। ততক্ষণ উপবাসেই থাকুন!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *