উত্তম পুরুষ – ৮

আট

থার্ড বেঞ্চের এক পাশে বসি। একেবারে প্রথমেই থার্ড বেঞ্চে জায়গা পাওয়া খুব সহজ কথা নয়। পড়ুয়া ছেলেরা পরীক্ষার ফলাফল অনুসারে প্রথম তিনটি বেঞ্চ দখল করে বসে। এই বর্ণাশ্রম ধর্ম অনুসারে আমার স্থান হওয়া উচিত ছিল একেবারে শেষের বেঞ্চিতে। কিন্তু হেডমাস্টার আর হেড পণ্ডিতের সুপারিশেই আমি ক্লাসে অভিজাতদের মধ্যে জায়গা পেলাম। আমার পাশেই বসে মফিজ—সেই ছেলেটা, যাকে রোজ আমি যাতায়াত করতে দেখেছি।

সেদিন ক্লাসে নির্দিষ্ট স্থানে এসে বসতেই দেখি আমার নামে একটি খাম পড়ে আছে।

“অদ্য শনিবার। বৈকাল তিন ঘটিকায় ইন্টালী টকির সামনে সাঙুভেলী রেস্টুরেন্টের তিন নম্বর কেবিনে উপস্থিত থাকিবেক। ইতি ইস্কাপনের রাজা।”

ওরে বাবা, এ আবার কি!

আমি পাঁচকড়ি দে আর দীনেন রায়ের উপন্যাসের তৃষিত পাঠক। সুতরাং “লোহারথাবা”, “ইস্কাপনের রাজা” প্রভৃতি নামকে বড্ড ডরাই।

ভয়ে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। তার ওপর আব্বা-আম্মা বারবার করে মানা করে দিয়েছেন, “খবরদার। স্বদেশীঅলাদের সঙ্গে মিশবি না। তারা গলা টিপে মেরেই ফেলবে।” স্বদেশীঅলাদের সম্পর্কে এই রকম একটা ভয়ঙ্কর ছবি আমার মনে মনে আঁকা হয়ে গিয়েছিল।

শেষ পর্যন্ত সেই স্বদেশীঅলাদের খপ্পরেই পড়লাম না কি।

দুই চোখ ভরা আশা নিয়ে মফিজের দিকে তাকালাম—সে কোনো আলোকপাত করতে পারে কি না; কিন্তু মফিজ গৌতম বুদ্ধর মতো মুখভাব করে তখন পড়া শুনছে।

বড্ড দমে গেলাম।

টিফিনের সময় বট গাছটির গুঁড়িতে বসে চুপচাপ সাত-পাঁচ ভাবতে লাগলাম।

পণ্ডিত মশাইকেও বিপদের কথা খুলে বলা নিরাপদ নয়। শুনেছি স্বদেশীঅলারা দলের কথা ফাঁস করে দিলে জানেই মেরে ফেলে। এক ছিল মফিজ। কিন্তু তার ব্যবহারটাও এমন দুশমনের মতো। অপরপক্ষে কোথায় কোন্ দুই না তিন নম্বর কেবিন, সেখানে যাওয়াও সম্ভব নয়। এখন কি করি!

—চটপটি খাবি?

মফিজ কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে টেরও পাই নি।

ভাবলাম মফিজকে সব কথা খুলে বললে হয় না। সে তো অনেক দিন থেকে এই স্কুলে পড়ছে। সে হয়তো হাল-হকিকত জানে।

শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম।

—আমি ভাই বড় বিপদে পড়েছি। এই দ্যাখ।

খামসুদ্ধ চিঠিটা মফিজের হাতে দিলাম।

ফালি করে কাটা আলুর দম একটা সরু কাঠি দিয়ে তুলে মফিজ মুখে পুরল। তারপর শাল পাতার ঠোঙাটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। তারপর চিঠিটা হাতে করে সেও গাছের গুঁড়িতে বসে পড়ল।

গভীর মনোযোগ দিয়ে চিঠিটা পড়ে সে আবার ফেরত দিল!

—কি রে। চুপ করে আছিস কেন? কি বুঝলি!

—ভয়ের আছে, আবার নেইও।

–সে কি রকম?

–দলের কথা শুনলে ভয় নেই, আর না শুনলে-

মফিজ তার বাক্য অসমাপ্ত রাখলেও অর্থোদ্ধার করতে কিছুমাত্র অসুবিধা হলো না।

—আচ্ছা, এরা স্বদেশীঅলা নয় তো?

—স্বদেশীঅলা? না সে রকম কিছু নয়।

এই বলে মফিজ আর একটি আলুর দম মুখে পুরল।

আমি ভয়ে ভয়ে আবার জিগ্যেস করি :

—তুইও দলের সভ্য?

—হুঁ! তবে সভ্য নয়। আমরা বলি দলের অসভ্য।

বেলা তিনটার সময় পথ চিনে আমি তিন নম্বর কেবিনে উপস্থিত হলাম। পুরো খবর সংগ্রহ করবার জন্য আমাকে তিন আনা পয়সা খরচ করতে হয়েছে। বড় কষ্টের পয়সা। মফিজটা এক আচ্ছা জোঁক! তাকে তেলে ভাজা, ঘুগনি, আর বলতেই নেই, একটা ক্যাভেন্ডার সিগারেট খাইয়ে বাকি খবর জানতে হয়েছে। ইস্কাপন-চক্র আমাদের ক্লাসেরই একটি দল। দেশোদ্ধার তাদের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত না হলেও, তাদের কর্মপন্থা আমার পক্ষে কম ভয়াবহ নয়। দলপতির নির্দেশ যে-কেউ অমান্য করেছে, তাকেই নাকাল হতে হয়েছে। কথা না শুনলে এরা না কি গড়ের মাঠে মাঠসুদ্ধ লোকের চোখের সামনে প্যান্ট খুলে নেয়।

কেবিনের ভিতর কতগুলো পরিচিত কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পাই।

কালো পর্দাটা এক হাত দিয়ে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ি।

অমনি সব চুপ।

ইস্কাপনের রাজা আর কেউ নয়, আমাদের সলিল। সলিল ক্লাসের সবচাইতে লম্বা আর সবচাইতে বয়স্ক ছেলে। একেই বয়স বেশি, তার ওপর দু’বছর থেকে ক্লাস সিক্সেই পড়ছে। তাকে ডরাতো না, ক্লাসে এমন কোনো ছেলেই ছিল না। শোনা যেত, মাস্টাররা পর্যন্ত সলিলকে সহজে ঘাঁটাতেন না।

—হরিহর। ও হরিহর।

—আজ্ঞে বাবু, আসি।

—যা তো রে, একটা ভেজিটেবল চপ, আর এক পেয়ালা চা নিয়ে আয়।

-বাবু পয়সা?

—পয়সা!

সলিল এমনভাবে কথাটি বললো যেন পয়সা শব্দটি সে এই প্রথম শুনেছে।

—পয়সা দোব’খন। এখন যা বললাম তাই কর।

—বাবু, ম্যানেজার বাবু যে মানেন না। অনেক বাকি পড়েছে।

কথাটা শুনে সলিল আর বাক্যব্যয় না করে উঠে পড়ে। আমার মনে হলো এখুনি একটা খুনোখুনি হবে।

একটু পরই সলিল ফিরে এলো। তার পিছনে হরিহরের এক হাতে ভেজিটেবল চপ আর অন্য হাতে চা। হরিহরের পিছনে এক চশমা পরা ভদ্রলোক, নিশ্চয়ই তিনিই ম্যানেজার। সলিল দেনা চুকিয়ে এলো কি অন্য কোনো ব্যবস্থা করে এলো, সে আমি জানি না।

ম্যানেজার বিনীতভাবে বললেন :

—সলিল বাবু। দোকান আপনারই। কেবল যখন যা দরকার চাইবেন।

—না মশাই। আপনার বিরুদ্ধে কোনো নালিশ নেই। কিন্তু হোটেলের বাবুর্চি- বেয়ারাগুলোকে একটু আদব কায়দা শেখাবেন। কাকে কি বলতে হয় জানে না। মুখের ওপর চোপা করে।

সলিল এবার আমাকে বললো :

তারপর পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে নিপুণ হাতে সেটাতে অগ্নিসংযোগ করে অল্প হেসে আবার বললো :

—কি রে চলবে?

আমি ভয়ে ভয়ে জবাব দিলাম :

—থাক না ভাই। কখনো খাই নি।

সকলে সমস্বরে হেসে উঠল। সুকান্ত বললো :

–তোরা শুনেছিস! পণ্ডিত মশাই বলছিলেন, এ বছর শাকেরই গুড-কন্ডাক্টের জন্য প্রাইজ পাবে।

কথাটা শুনে আমার কান গরম হয়ে গেল। গুড-কন্ডাক্টের জন্য প্রাইজ পাওয়ার মতো লজ্জাকর ঘটনা যেন আর কিছুই হতে পারে না।

বেপরোয়া হয়ে আমিও একটা সিগারেট ধরালাম, গুড-কন্ডাক্টের জন্য যাতে প্রাইজ পেতে না হয় তারই আপ্রাণ চেষ্টা। মুখে যতই বিস্বাদ লাগুক, দম যতই বন্ধ হয়ে আসুক, তবু প্রাণপণে সিগারেট টানতে লাগলাম।

সেই আমার মুখে খড়ি।

সুকান্ত যখন দেখল আমি একটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি, তখন সে অন্য আর একদিক থেকে আক্রমণ করল।

সে বললো : তোর নাম শাকের কেন রে? তোদের নামগুলোই কেমন যেন বিদঘুটে। রোজ শাক খাই তাই তোর নামটা তবু কোনোমতে মনে আছে।

এমন উপাদেয় রসিকতা যেন কেউ কোনোদিন শোনে নি, এমনি হাসি শুরু হয়ে গেল। একটু পরই আর একজন ছেলে বলে উঠল :

—তা যা বলেছিস ভাই। মুসলমানদের নামগুলো মুখস্থ না করলে যদি কিছুতেই মনে থাকে! আরে বাবা, বসে বসে যদি কতগুলো নামই মুখস্থ করব তো হরিনাম দোষ করল কি।

এইভাবে আর কতক্ষণ চলত কে জানে। কিন্তু সলিল টেবিল চাপড়ে সকলকে থামতে বললো।

—এবার সভার কাজ শুরু করতে হয়।

সভার কাজ শুরু হলো।

বিশেষ কিছু নয়। পণ্ডিত মশাই আজকাল বড় কড়াকড়ি শুরু করেছেন। স্কুল আওয়ারের মধ্যে কোনো ছেলেই বাইরে যেতে পারবে না—এই জরুরি পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনার জন্যই এই সভা।

এমতাবস্থায় দারোয়ান দেওকীই আমাদের একমাত্র সহায়। তার সহায়তা ক্রয় করবার জন্য ক্লাসের প্রতিটি ছাত্রকেই মাসে তিন আনা চাঁদা দিতে হবে।

এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবার পর সভার কাজ শেষ হলো।

মৌলালির মোড়ে পৌঁছে দুটি বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। একটি সিনেমার বিজ্ঞাপন : ‘দেশের মাটি।’ শ্রেষ্ঠাংশে সায়গল আর উমাশশী। কেন যে এতদিন পরও বিজ্ঞাপনটির কথা মনে আছে, জানি না। আর একটি : ‘কমিট নো নুইসেন্স।’

হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরে এলাম। মাথার মধ্যে ইস্কাপন-চক্র, দেশের মাটি আর ‘কমিট নো নুইসেন্স’ তালগোল পাকাতে থাকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *