উত্তম পুরুষ – ৩০

তিরিশ

আম্মা ঠিকই বলেছিলেন। নিহার ভাবি দু’দিনেই একেবারে আপন করে নিলেন। আমার এমন এক আশ্চর্য সুন্দর লক্ষ্মী ভাবি আছেন এই কথা আমাকে আগে কেউ কখনো বলে নি মনে করে আমার ভারি অবাক লাগল।

কেবল স্বামী-স্ত্রীর সংসার। ছেলেপুলে হয় নি। বিয়ে হয়েছে বছর সাতেক। জমির ভাই কাঠের ব্যবসা করেন। অবস্থা রীতিমতো সচ্ছল। আমি ঘুম থেকে উঠবার আগেই তিনি বেরিয়ে পড়েন এবং রাত্রে আমি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়বার পর তিনি ফিরে আসেন। তাঁর সাথে দেখা-সাক্ষাৎই বড় একটা হয় না। ঘুম থেকে চোখ খুলতেই রোজ দেখি, নিহার ভাবি এক পেয়ালা গরম চা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকছেন। স্নান সারা, লম্বা ভেজা চুল পিঠের ওপর ছড়ানো, সারা মুখে প্রসন্ন হাসি, এবং হাতে গরম চা। সুতরাং অল্প দিনেই ভাবির সঙ্গে ভাব হয়ে গেল।

—আচ্ছা ভাবি, আপনি কি করে বুঝতে পারেন, আমি এই সময়টাই উঠব। রোজ তো আর একই সময় উঠি না। গরম চায়ের বাটি নিয়ে ঠিক সময় কি করে পৌঁছে যান?

—আমি যে হাত গুনতে জানি।

—না, ঠাট্টা নয়। সত্যি বলুন।

—পাগলা ছেলে! তুমি কি মনে কর আমি এইমাত্র এলাম। এর আগে কতবার এসে এসে ফিরে গেছি, প্রতিবারই দেখি খোকা ঘুমিয়ে আছে।

—প্রতিবারই চা নিয়ে এসেছেন?

—তা বই কি। আমি চা-বাগানের মালিক কি না!

—তাহলে?

—একবার এসে দেখি বাবু বেহুঁশ হয়ে নাক ডাকছেন। তখন জেনে যাই, তোমার রাত ভোর হতে অনেক বাকি আছে। তারপর এসে দেখি পাশ ফিরেছ। তখন বুঝে নি, মাঝে একবার নড়েছে। তারপর দেখি, অন্য পাশে মাথার ওপর হাত রেখে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছ, পায়ের কাছ থেকে চাদরটা সরে গেছে। তখন বুঝতে পারি, তোমার ঘুম পাতলা হয়ে এসেছে। তারপর দেখি, চোখ দুটি বোজাই আছে; কিন্তু পা-টা যেন একটু একটু নড়ছে। তখন বুঝতে পারি, খোকা, এইবার উঠবে। তখন আমি চা তৈরি করতে যাই।

—আপনি কি সারাক্ষণ এই করেন? আপনার অন্য কাজ নেই?

কিই-বা আর কাজ।

অজান্তেই ভাবি যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

আমিই আবার বলি : সত্যি আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন। মাঝে মাঝে মনে হয় চলে যাই, আপনাদের কষ্ট দিচ্ছি!

এমন ব্যগ্র হয়ে ভাবি আমার হাত দুটি চেপে ধরলেন যে আমি অবাক হয়ে তাকিয়েই থাকি।

—দোহাই তোমার। এই কথাটি মুখে এনো না।

তারপর চায়ের শূন্য পেয়ালাটা হাতে করে নিয়ে ভাবি ফিরে যান। একটু পরে আবার ফিরে আসেন। হাসতে হাসতে বলেন : আমার কেবলই ভয় হয় তুমি মামানির কাছে গিয়ে আমার বদনাম করবে, বলবে তোমার কোনো খেয়ালই করতে পারি নি। সত্যি, গরিবের বাড়িতে তোমার খু-উ-ব কষ্ট হচ্ছে।

—আপনি জানেন কথাটা কত মিথ্যা! আর গরিব বড়লোকের কথা বলছেন! আমাদের অবস্থার কথা তো ভালো করেই জানেন। নিহার ভাবি তেমনি হাসতে হাসতে বললেন : আমাদের যা কিছু আছে তোমাকে তার ভাগ দিয়ে যাব। না, ঠাট্টা নয়। আমাদের আর কে আছে বলো। আমার থাকবার মধ্যে আছে এক বোন। তার সঙ্গে তোমার বিয়ে হলে কিন্তু আমি বড় খুশি হই। তুমি মনে করছ, আমার বোন আমারই মতো জংলি? তা কিন্তু মোটেই নয়। সে দার্জিলিং-এর স্কুলে পড়ে। দেখতেও খুব সুন্দর। মেয়েটি এমনিতেও খুব ভালো। নিজের বোন বলে বলছি না। বিয়ে করবে তাকে?

—পাগল না কি? আমার চাল নেই চুলো নেই, বিয়ে করব কি?

–কিচ্ছু লাগবে না। আমাদের মেলা আছে। তোমাকে কিছুই করতে হবে না। তোমার মতো ছেলে পেলে আমরা এক্ষুণি বিয়ে দি।

—খুব তো দাতা সাজছেন। আজ না হয় আপনাদের টাকা ভোগ করবার কেউ নেই। হতে কতক্ষণ?

—থাক সে কথা।

ভাবি উঠে চলে গেলেন।

এইভাবেই দিনের পর দিন গড়িয়ে যেতে লাগল।

.

আর এক দিনের কথা।

সেদিন নিহার ভাবি বললেন : তুমি একটু বোসো। আমি কাজ সেরে এই আসছি।

মুখে একটা গান পুরে নিহার ভাবি উঠে চলে গেলেন।

পাশ থেকে বালিশটা টেনে নিয়ে বিছানার ওপর গা এলিয়ে দিলাম। পাশেই কোনো বাড়িতে রেডিওতে গান হচ্ছে। শরতের নীল আকাশ গরাদহীন গবাক্ষ জুড়ে ফ্রেমে আঁটা ছবির মতো ঝুলছে। বালিশটাকে আঁকড়ে ধরে বিছানার ওপর এইভাবে পড়ে থাকতে বেশ লাগছে। মাঝে মাঝে বাতাস শরীর স্পর্শ করে যায়; তখন কেন জানি সবকিছু ফাঁকা মনে হয়।

ওদিকে রান্নাঘরে খুন্তি নাড়ার শব্দ হয়। চচ্চড়ি বা সেই জাতীয় কিছু একটা রান্না হচ্ছে। তেল-হলুদের গন্ধ নাকের কাছাকাছি এসে ফিরে ফিরে যায়। হাতের চুড়ির আওয়াজ নুড়ির মতো বাজতে থাকে।

—ওমা! তুমি যে শুয়েই পড়লে। অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি, তাই না!

–কোথায় আর অনেকক্ষণ! এই তো গেলেন!

—নাও নাও খেয়ে নাও। কটা গরম মাছ ভেজে আনলাম। বেশ লাগবে।

—বেশ লাগছে। নুন একটু বেশি হয়েছে।

—ভালোই তো! নেমকহারামি করতে পারবে না।

নিহার ভাবিও বিছানার ওপর বসে পড়লেন। মাথার চুল খোলা। কপালে নাকে আর দুই গালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কাঁধের ওপর থেকে আঁচল টেনে এনে ঘাম মুছলেন। উদ্যত হাতের নিচেও ঘাম।

—এতও ঘামতে পারেন আপনি।

—আর বোলো না ভাই। যা মুটিয়ে যাচ্ছি। ঘামব না!

—যাঃ মোটা আর কোথায়!

—ওমা। মোটা নয়, তুমি বল কি!

এই বলে নিহার ভাবি তাঁর দুই হাত এগিয়ে দিলেন। পুষ্ট দুটি বাহুর ওপর থেকে আঁচল সরিয়ে দিলেন।

—তাও বলবে মোটা না। দেখ দিকি।

আমি সে কথার কোনো জবাব দিই না। দৃষ্টি নত করে নি। নিহার ভাবি অনেকটা আপন মনেই বলে গেলেন : মুটিয়ে যাব, তাতে আর আশ্চর্য কি! বয়স তো আর কম হলো না।

এই বলে নিহার ভাবি উঠে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। ঘাড়ে কপালে আর গলার ওপর ময়লা জমে আছে। ময়লার আর দোষ কি। উনুনের কাছে বসে সারাদিন কাজ করলে খাঁজে খাঁজে ময়লা তো জমবেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিহার ভাবি ঘষে ঘষে গায়ের ময়লা তুলতে লাগলেন।

—দেখো দিকি, কি ময়লাটাই না জমেছে।

এই বলে তিনি এগিয়ে এলেন। মাথাটা উঁচু করে সারসের মতো লম্বা গলাটা আরো লম্বা করলেন। ঘষে ঘষে গলাটিকে লাল করে ফেলেছেন।

—এবার চলি। বেলা হয়ে গেছে। অনেক কাজ পড়ে আছে।

কিন্তু ঠিক তক্ষুণি উঠে গেলেন না।

ইস্। এক্কেবারে যে ভিজে গেছ। এই ঝড়-বাদলের মধ্যে বেরুতে আছে। -বেরুতেই হলো। রেডিওতে স্ক্রিপ্ট দিয়ে এলাম।

—স্ক্রিপ্ট? কিসের স্ক্রিপ্ট?

—আজ রাত্রে রেডিওতে একটা গল্প পড়ব।

—ওমা, তুমি গল্প লেখ না কি। কৈ আমাকে তো কখনো বল নি!

—বলবার মতো কিছু নয়। ফ্যাসি-বিরোধী গল্প—জাপানি অত্যাচারের কাহিনী!

নিহার ভাবি ততক্ষণে একটা পরিষ্কার তোয়ালে নিয়ে এসেছেন। দুই হাত দিয়ে আমার মাথা মুছতে মুছতে বললেন : তোমার পেটে অনেক বিদ্যে আছে। আমাকে কিছুই জানতে দাও না। মূর্খ মানুষ! আমি বুঝিই-বা কি।

মাথার চুল যখন মরুভূমির মতো শুষ্ক করে ফেলেছেন, তখন ক্ষান্ত হয়ে তোয়ালেটা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে নিহার ভাবি বললেন : নাও নাও মাথাটা ভালো করে মুছে ফেল। এক্ষুণি সর্দি-কাশি শুরু হয়ে যাবে। আর এই লুঙ্গিটা পরে নাও।

—লুঙ্গি আমি পরি না।

—বাবুয়ানা পরে করো। এখন জান তো বাঁচাও। আমি ভুলে তোমার সব কটা পাজামা ধোপার বাড়ি দিয়ে দিয়েছি। বোসো। আমি এক্ষুণি গরম চা করে আনছি।

শুধু চা নয়। পাঁপর ভাজা আর গরম দালপুরিও এলো।

—এই অসময়ে এত সমারোহ করে দালপুরী খাওয়াচ্ছেন। ভাত খেতে দেবেন কবে? —আজ কপালে ভাত নেই। মুখপোড়া বাবুর্চি বাজার থেকে গরুর গোস্ত নিয়ে এসেছে, তাতে আবার পোকা ভরা। হতভাগা আমাকে জানতেও দেয় নি। দিব্যি চুলোয় চড়িয়ে দিয়েছিল।

—দালপুরিটা কিন্তু একদম গরম। এইমাত্র করলেন?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি জানতাম কি না, তুমি এক্ষুণি এসে পড়বে।

—যাঃ, তাও বুঝি কখনো হয়!

—হয় হয় খুব হয়। তুমি ছাই জান। ভালোবাসার পাত্র এলে মন বুঝতে পারে।

—কি যে বলেন! আমার লজ্জা করে।

—লজ্জা করে! সে কি গো!

নিহার ভাবি হেসেই আকুল।

হাসতে হাসতে যাকে বলে একেবারে খুন! এমন করে কেউ হাসে। মাথার কাপড় কোথায় খসে পড়ল ঠিক নেই, ব্লাউজের বোতাম খোলা সে সম্পর্কে কোনো হুঁশ নেই, কেবল ঢেউয়ের মতো ফুলে ফুলে হাসলেই হলো।

—অমন পাগলের মতো হাসছেন কেন?

হাসব না। তোমার কথা শুনলে যে মরামানুষও হেসে উঠবে।

এমন সময় বাইরে কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল।

—দাঁড়াও দিকি বাবু। লোক এসেছে। তোমার ভাইয়ের খাবার পাঠাতে হবে।

নিহার ভাবি খানিক বাদেই ফিরে এলেন। বললেন : যাও তো সোনা আমার। একটু সাজগোজ করে এসো।

—এই অসময়ে সাজতে যাব কোন দুঃখে?

—দুঃখে নয় রে পাগল, সুখে। আমি তোমার সঙ্গে পালাব।

—আমি খুব রাজি। কোথায় যেতে চান?

–নিউ মার্কেটে। কেনাকাটা করবার আছে।

—খাবেন না?

—আজ বাইরে কোনো হোটেলে চপ-কাটলেট খাব চলো। বেশ মজা হবে, তাই না!

—হ্যাঁ চলুন। আমি খুব রাজি।

—একটু অপেক্ষা করো, আমি ব্লাউজটা বদলে আসি। ঘামে কেমন ভিজে গেছে, একবার দেখেছ।

—দেখেছি।

পটপট করে ব্লাউজের বোতামগুলো খুলতে খুলতে নিহার ভাবি পাশের ঘরে কাপড় ছাড়তে চলে গেলেন। আমিও বাক্স থেকে প্যান্ট বের করবার জন্য অন্যদিকে চলে গেলাম।

মিনিট পাঁচেক পরই নিহার ভাবি আবার বেরিয়ে এলেন।

ঐ যাঃ দেখেছ। কি ভুলো মন! ফর্সা ব্লাউজ বের করতেই ভুলে গেছি।

নিহার ভাবি কোনোমতে গায়ের ওপর আঁচল জড়িয়ে বেরিয়ে এসেছেন।

—হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছ কি? এসো এসো বাক্সটা ধরে নাবাও।

দু’জনে ধরাধরি করে বাক্সটা নাবালাম। তাড়াতাড়িতে মাথা ঠোকাঠুকি হয়ে গেল।

—মাথা তো নয়, পাথর। এসো, আর একবার মাথা ঠুকে দাও। নইলে শিং বেরুবে। এই বলে একটু হেসে তিনি আবার পাশের ঘরে চলে গেলেন।

সাজগোজ করতে অবশ্য তাঁর সময় বেশি লাগে না। নিহার ভাবি অল্প পরই তৈরি হয়ে ফিরে এলেন। নিহার ভাবি সম্পর্কে সবচাইতে লক্ষ্য করবার বিষয় তাঁর সাজ-পোশাক। বাড়িতে থাকলে ব্লাউজ প্রায় পরতেনই না। এমনকি অনেক সময় পেটিকোটটা পর্যন্ত গায়ে রাখতেন না। আর সত্য কথা বলতে কি, লক্ষ্য করতামও। এ সম্বন্ধে কিছু বললে তিনি হেসে জবাব দিতেন : “আমরা বাপু গাঁয়ের মানুষ। বিয়ের পরই শহরে এসেছি। এখনো পুরোপুরি শহুরে হাত পারি নি। অত সব কাপড়-চোপড়ের বালাই হাঁফ ধরিয়ে দেয়। তাছাড়া বাড়িতে কেই-বা আছে!’ যদি বলতাম : “কেন, আমি!” দুটি বড় বড় চোখ তুলে ভাবি একবার আমার দিকে তাকাতেন। যেন আমার কথাটা ভালো করে কানেই যায় নি। অথবা গেলেও, আমার বক্তব্য যেন তাঁর বোধগম্যই হচ্ছে না। তারপর শুধু বলতেন “তুমি!” আবার সেই হাসি। দুর্নিবার অপ্রতিরোধ্য হাসি। বস্তুত ভাবি বিয়ের আগে পর্যন্ত গ্রামেই ছিলেন। তার কথাবার্তায় পাকা বুদ্ধির পরিচয় থাকত, এমনকি একটা শিক্ষিত মনের স্বাক্ষর থাকত। তিনি কতদূর লেখাপড়া করেছেন সে কথা কোনোদিনই জিজ্ঞাসা করি নি। অথচ তাঁর আচরণ মোটের ওপর শালীন, রুচিসম্মত, যদিচ মাঝে মাঝে দুটি একটি কথা বা আচরণে গ্রামের মেয়েটি হঠাৎ উঁকি দিয়ে যেত।

তৈরি হয়ে এসে নিহার ভাবি কৌতুকভরে প্রশ্ন করলেন : “বল দেখি আমার সাজ-সজ্জা কেমন হয়েছে?”

তাঁর পরনে বগল পর্যন্ত কাটা চোলি; পেটের উপরের এবং কণ্ঠির নিচের মেদ অনেকটাই দেখা যায়। তাই আমিও বললাম : আপনার সাজ শয্যারই উপযোগী

—চোপ ফাজিল কোথাকার। দিনে দিনে লায়েক হয়ে উঠেছ। কান মলে লাল করে দেব।

টালীগঞ্জের এক সুদূর প্রান্ত থেকে কলকাতা এলে আমরা বলতাম, শহরে যাচ্ছি। সেই শহর কলকাতায় এলাম। ট্রামে ভাবি অনর্গল কথা বলে চললেন। এমন বকবক করতে কাউকে শুনি নি। নিজের মনের আনন্দে কথা বলে চলেছেন। ঐ গাছটার নাম কি, ঐ ট্রামটা কোন দিকে যাবে, ঐ মেমটার পরনে ওটা কি, ইত্যাকার অবিরাম প্রশ্ন, এবং থেকে থেকে, “উঃ বড্ড খিদে পেয়েছে” এই কাতরোক্তি শুনে শুনে আমি অস্থির হয়ে গেলাম। এক সময় আমি প্রায় ধমকের সুরেই বললাম : আঃ থামুন তো! আপনি বড্ড বকবক করেন।

নিহার ভাবি মুখ ম্লান করে নীরব হলেন।

হোটেলে প্রবেশ করবার আগে আমরা ওয়াসেল মোল্লার দোকানে এলাম—ভাবিরই প্রয়োজনে।

—দেখতো, এই কামিজটা তোমার পছন্দ হয়?

—ভালোই তো! ভাইকে মানাবে ভালো।

—ভাইয়ের জন্য তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। তোমার পছন্দ কিনা, তা বলো!

—হ্যাঁ, পছন্দ!

ভাবি তৎক্ষণাৎ কামিজটা কিনে নিলেন।

—এই কামিজটা গায়ে দিয়ে রেডিও স্টেশনে যেও। ফর্সা মানুষ, বেশ মানাবে।

—বারে, আমি এটা নিতে যাব কেন?

—কেন, নিলে কি মানীর মান যাবে?

—যাবেই তো! আমি পুরুষ! বরঞ্চ আমিই আপনাকে দেব।

—দেখ, এই হাটসুদ্ধ লোকের মধ্যে তুমি আমাকে হাসিও না বাপু!

তারপর নিহার ভাবি আমাকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে সত্যিই হাসতে শুরু করে দিলেন।

—ওরে আমার পুরুষ রে! দেখে আর বাঁচিনে।

রিজেন্ট—রেস্টুরেন্টের একটা কেবিন বেছে নিয়ে আমরা আহার শুরু করে দিলাম। এক সময় ভাবি বললেন : বেয়ারাটাকে বলতো, এক বোতল টোমাটো সস নিয়ে আসবে।

—এক বোতল তো শেষ করলেন। আর কি দেবে!

—বাছা তুমি বলেই তো দেখ। দেবে না তো কি! পয়সাটা গুণে নেবে না?

পর্দার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ওয়েটার আমাদের তর্ক শুনছিল। সে কোনো কথা না বলে একটু হেসে চলে গেল। মিনিটখানেক বাদেই এক বোতল টোমাটো সস নিয়ে ফিরে এলো।

—দেখলে তো, দিলে কি না!

—আপনি কিন্তু বড্‌ড বেশি খাচ্ছেন।

—অমন নজর দিও না। তুমিও খাও না।

এই বলে তিনি চিকেন কাটলেটটা নিজের পাত থেকে তুলে আমার পাতে ঢেলে দিলেন।

আমি ব্যস্ত হয়ে দু’হাত দিয়ে তাঁর দুটি হাত চেপে ধরে বললাম :

—ও কি করছেন! দোহাই আপনার। ওটা পেটে গেলে আর বাঁচতেই হবে না!

—মরণ অত সহজে হয় না। চটপট খেয়ে নাও। আরো কাজ আছে।

—কিছুতেই পারব না।

—মাথা খাও ওটুকু খেয়ে নাও।

ওয়েটার বিল নিয়ে এলো। বকশিশ পেল। মিটিমিটি হাসতে লাগল।

—লোকটা ওভাবে হাসছে কেন? ব্যাটা ভাবল কি!

—কি জানি, জিগ্যেস করব?

—চোপ!

নিহার ভাবি হঠাৎ আবার গম্ভীর হয়ে গেলেন। যেন আপন মনেই বলে গেলেন : আমাদের দেশটা এমন কেন বলতো?

—কেমন কেন?

ছেলে আর মেয়েকে হেসে দুটি কথা বলতে দেখলেই যা তা মনে করে বসে। ওয়েটারটার কথাই ধরো না। তোমাকে আমাকে দেখে মুখ-পোড়া ওয়েটার কিভাবে হাসছিল। আমি বয়সে কত বড় তাও!

বহুক্ষণ নীরবেই পথ চললাম। নীরবতা ভঙ্গ হলো আমারই প্রশ্নে :

—আচ্ছা ভাবি আপনার বয়স কত?

—বয়স? বোকা ছেলে। মেয়েদের বয়স জিগ্যেস করতে নেই। এ তো তোমাদের শহরেরই শিক্ষা।

হঠাৎ সেলিনার কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল একদিন তাকেও এই প্রশ্ন করেছিলাম; আর আশ্চর্য, এই জবাবই পেয়েছিলাম।

অন্যমনস্কের মতোই বললাম : যে মেয়ের যৌবন গেছে সেই বয়স গোপন করে। আপনি তো আর বুড়ি নন।

—যে মেয়ের কি গেছে?

—যৌবন।

—তোমার মুখে যৌবন শব্দটি শুনে আমার যা হাসি পায়। সে যাই হোক, আমাকে কি মনে করো? ছুঁড়ি?

—অন্তত বুড়ি নয়!

—বয়স কত হলো জানো? তেত্রিশ!

—তেত্রিশ? আশ্চর্য!

—তুমি কি মনে করেছিলে?

—তেইশ কি চব্বিশ!

—সত্যি?

—সত্যি।

–তেইশ ছিলাম দশ বছর আগে। তোমার বয়সটা কত হলো শুনি?

—আমার? বিশ হবে।

–এবার পরীক্ষায় তোমাকে ফার্স্ট হতে হবে কিন্তু।

—ওরে বাবা, একেবারে ফার্স্ট! তা না হয় একটা কিছু হওয়া যাবে; কিন্তু হঠাৎ পরীক্ষার কথা এলো কোথা থেকে?

—মানুষের মন! কোথা থেকে কোথা যায়। ওর আর হঠাৎ বলে কিছু নেই। এমনিই মনে এলো। একবার বেরিয়েছি যখন তখন চলো একটা সিনেমা দেখে আসি। শহরে তো বড় একটা আসা হয় না।

—তা বেশ চলুন। আমার কাছে কিন্তু পয়সা নেই।

—থাক। তোমার আর পয়সা থেকে কাজ নেই।

ছবি শুরু হয়ে গেছে অল্পক্ষণ হলো। আঁধারে কোনোমতে দেখে দেখে সন্তর্পণে আসনের দিকে এগিয়ে গেলাম, অনেকগুলো লোকের আসন পার হয়ে স্বস্থানে আসতে হলো।

ভাবি গজরাতে লাগলেন।

—দেশের লোকগুলো এমন বাঁদর। দেখছে মেয়েমানুষ আঁধারে এগুচ্ছে। পা-টাও একটু সরাবে না। যেন কোল পেতে বসে আছে।

চেয়ারের একই হাতলের ওপর দু’জনের হাত। যাকে বলে লোমহর্ষক, ছবিটা সেই জাতের। উভয়েরই অত্যন্ত দ্রুত উত্তেজিত শ্বাস পড়ছিল। নিহার ভাবির তপ্ত নিশ্বাস আমার হাত স্পর্শ করে যাচ্ছিল। আমি অনেকটা কাঠ হয়ে বসেছিলাম। একটু আগেই নিহার ভাবি বলেছিলেন, মানুষের মন, কখন কোন দিকে যায় আগে থেকে বুঝবার উপায় নেই। দেখলাম সত্যিই তাই। এই সময় আমার মনের মতিগতি লক্ষ্য করে আমারও সেই কথাই মনে হলো। নিহার ভাবি আনমনে ছবি দেখছেন। বিস্ময় আর কৌতূহলভরা দুটি চোখ পর্দার ওপর। ছবির গল্প সত্যই ভয়াবহ। হলসুদ্ধ লোক অধীর উৎকণ্ঠায় চঞ্চল উদ্গ্রীব। দৈত্যটি যখন সকলের অলক্ষ্যে পাশের জানালা দিয়ে একাকী প্রসাধনরতা তরুণীর কক্ষে প্রবেশ করল, তখন দর্শকদের মধ্যে একটা চিৎকার পড়ে গেল। বহু আগে থেকেই নিহার ভাবির নিশ্বাসের উত্থান- পতন বড্ড দ্রুত হচ্ছিল। এবার তিনিও সভয়ে চিৎকার করে সবেগে আমার দুটি হাত তাঁর মুঠির মধ্যে পুরলেন, যেন, এই বিপদের মুহূর্তে তাঁর একটা অবলম্বন আবশ্যক। একেবারে তাঁর কোলের ওপর আমার হাত লতার মতো নেবে এলো। তখনো নিহার ভাবির বুক ধড়ফড় করছিল, তারই আন্দোলন ছাড়া আমার হাতে আর কোনো স্পন্দন ছিল না। একটু পরই ছবি শেষ হলো।

–ইস! একেবারে আঁধার হয়ে গেছে। এবার পালাই।

—আমাকে তো রেডিও স্টেশন যেতে হবে। আপনি একা যেতে পারবেন?

—তুমি হাসালে। আমি কি একা চলাফেরা করি না?

—তাহলে আমি আসি I

—আচ্ছা ভাই এসো। ভালো কথা, ফিরবার সময় তোমার ভাইয়ের জন্য এক জোড়া ‘সামার কুল’ গেঞ্জি নিয়ে এসো। ভুলে যেও না। তখন তাড়াতাড়িতে কিনতে ভুলে গেলাম। এই নাও টাকা।

—রেডিও থেকে ফিরতে রাত হবে। অত রাতে আবার গেঞ্জি কিনতে যাব?

—রাত হোক। এটুকু কষ্ট তোমাকে করতেই হবে ভাই।

নিহার ভাবি একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়লেন।

আমি গোপনে ট্যাক্সির নম্বর টুকে রাখলাম। কিছুই বলা যায় না। যা দিনকাল।

.

ফিরতে আমার রাত হয়ে গেল। এসে দেখি জমির ভাই ফিরেছেন। অন্যদিনের তুলনায় বেশ সকালই ফিরেছেন। নিহার ভাবি আমাকে দেখেও কিছু বললেন না। তাঁর মুখ ভার ভার। ভাত বাড়া ছিল। নীরবে খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে উঠে দেখি পাশের টেবিলে চা ঢাকা আছে, কিন্তু অন্য দিনের মতো নিহার ভাবি উপস্থিত নেই। আমি হাত-মুখ ধুয়ে শুধু এক পেয়ালা চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রেডিও থেকে চেক পেয়েছি, সেটাও ভাঙাতে হবে।

আবার যখন বাড়ি ফিরলাম তখন দুপুর হতে চলেছে।

—সকালে না বলে না কয়ে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়েছিলে? এদিকে আমি সারাটা সকাল না খেয়ে বসে আছি।

—কাজ ছিল।

—কি হাতি-ঘোড়া কাজ ছিল শুনি? একবার বলে গেলে কি ক্ষতিটা হতো!

নিহার ভাবি সত্যিই রেগে আছেন।

আমার দুটি হাত পিছনের দিকে লুকানো দেখে বললেন :

—তোমার হাতে কি?

—বলুন দেখি!

—তোমার ভাইয়ের গেঞ্জি।

–উঁহু! হলো না!

এবার নিহার ভাবি রীতিমতো অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন :

—গেঞ্জি আন নি। এত করে তোমাকে বলে দিলাম।

—এনেছি, কিন্তু আরো জিনিস আছে।

—তাই বলো।

আর কি জিনিস আছে সে সম্বন্ধে নিহার ভাবি কোনো কৌতূহল দেখালেন না। বস্তুত গত রাত থেকেই তাঁর ব্যবহারটা একটু ভিন্ন রকম। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই কোনো মনোমালিন্য হয়েছে। তাই অনুমান করে আমি আর সে সম্বন্ধ কোনো প্রশ্ন তুললাম না। বিস্ময়ে আর কৌতূহলে নিহার ভাবিকে একেবারে হতবাক করে দেব, মনে মনে এই রকম একটা পরিকল্পনা আর প্রত্যাশা ছিল; কিন্তু তার কোনো রকম লক্ষণই দেখতে না পেয়ে আমি বড়ই দমে গেলাম। একটু পর নিহার ভাবিই বললেন : আজ শরীরটা ভালো নেই। পেট খারাপ!

–পেটে আবার হলো কি?

—পেটে আবার হবে কি! কাল তুমি যেভাবে নজর লাগাচ্ছিলে। তারপর কোনো মানুষের পেট ভালো থাকতে পারে!

—যত দোষ আমার নজরের! আর আপনি যে বসে অতটা গিললেন, সে কিছু নয়?

—অতটা আর কোথায় গিললাম? ওতো রোজই খাই। আমি বাপু মেম সাহেব নই। সারাদিন গতর খাটাই, পেট পুরে না খেলে আমার চলে না। কাগজের মোড়কটায় কি আছে এবার খুলে দেখাও দিকি চটপট।

—আমার বয়ে গেছে। যার গরজ সেই খুলে দেখুক।

কাগজের মোড়কটা অবগুণ্ঠিত বিস্ময়ের প্রতীকের মতো সেইভাবেই বিছানার ওপর পড়ে থাকল।

শেষ পর্যন্ত নিহার ভাবিই হার মানলেন।

—ওমা! কি সুন্দর কাপড়! কার জন্য এনেছ গো?

—কার জন্য আবার। আপনার জন্য।

—সে কি। আমি নিতে যাব কেন?

—কেন? নিলে কি মানীর মান যাবে?

এবার দু’জনেই হেসে ফেললাম।

—কাপড় তো আনলে। টাকা পেলে কোথায়?

—কেন? কাল না রেডিওতে ‘টক’ ছিল। বিশটা টাকা পেলাম। আপনার জন্য ব্লাউজের ‘ছিট’ নিয়ে এলাম।

—খুব কাজ করেছ। এভাবে টাকা নষ্ট করতে আছে।

—আমি কত সাধ করে নিয়ে এলাম। আপনি এতটুকু খুশি হলেন না।

—খুশি হই নি? খুব খুশি হয়েছি।

তারপর একটু হেসে যোগ করলেন : মেয়েদের একটু নখরা করতে হয়। তা না হলে ভালো দেখায় না; কিন্তু আমি ভাবছি, এই টাকা দিয়ে তুমি কত কাজের জিনিস কিনতে পারতে।

—আবার নখরা। এও তো একটা কাজ।

নিহার ভাবি ব্লাউজের ছিটটা হাতে নিয়ে আয়নার সামনে এগিয়ে এলেন।

—কাপড়টা এনেছ খুব সুন্দর। কিন্তু বড্ড ছোট। এতে ব্লাউজ হবে কি না কে জানে!

—হবে না!

–কোনোমতে করতেই হবে। তুমি যখন এনেছ। আমি নিজেই ছাঁটব আর সেলাই করব। না হয় পেট আর বুক খালিই থাকবে। কেমন? পছন্দ তো?

আমি সে কথার কোনো জবাব দিলাম না। বললাম : দোকানদার যে বললো হবে।

–দোকানদার আমাকে দেখল কোথায়?

—বারে, যেখান থেকে শার্ট কিনেছিলাম, সেখান থেকেই তো কিনে আনলাম।

—ওঃ তাই বলো; কিন্তু দোকানদার ব্যাটা আর কতটা দেখতে পায় বলো!

—তা বটে!

—নিহার ভাবি মুচকে মুচকে হাসতে লাগলেন। আবার বললেন : বাহারের ব্লাউজ হবে। পেট আর বুক অর্ধেক খোলাই থাকবে।

—তা আর মন্দ হবে কি।

—দূর ফাজিল কোথাকার।

এবার বেশ কিছুটা সময় উভয়েই নীরব থাকলাম। নিহার ভাবি কিন্তু ঘুরে-ফিরে ব্লাউজ পিসটা নাড়তে লাগলেন। তারপর তিনিই বললেন : তোমার চোখ আছে। এই রঙটা আমাকে মানাবে বেশ, তাই না?

—তা মানাবে; কিন্তু ব্লাউজ জিনিসটাই আমার পছন্দ নয়।

—ওমা কেন?

—তা না হলে আরো মানাত।

—আবার!

এরপর তিনি উঠে গেলেন। একটা বাসনে ভাত-তরকারি এবং একটি গেলাসে পানি নিয়ে তিনি আবার উপস্থিত হলেন।

—নাও খাও!

—আপনি খাবেন না।

–না। আমি গা ধুয়ে তারপর যা হোক একটু কিছু মুখে দেব। হঠাৎ জানালা দিয়ে রাস্তার ওপর কি একটা দেখতে পেয়ে নিহার ভাবি চেঁচিয়ে ডাক দিলেন : জলদি এদিকে এসো। একটা মজা দেখতে পাবে।

তাড়াতাড়ি জানালার ধারে এসে দেখলাম পাশের বাড়ির ষোল সতের বছরের মেয়েটি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করছে।

—মেয়েটা ওভাবে ছুটছে কেন?

—ওর নিশ্চয়ই জোরে পায়খানা লেগেছে। বলেই নিহার ভাবি খিলখিল করে হেসে উঠলেন।

—আপনি মাঝে মাঝে এমন বদ-রসিকতা করেন।

নিহার ভাবির মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। তাঁর দু’গালে হঠাৎ কে যেন চড় মেরেছে।

মুখে ভাত পুরে যথাসম্ভব গম্ভীর হতে চেষ্টা করলাম; কিন্তু কিছুতেই পারলাম না। হঠাৎ উদ্দাম হাসির চোটে মুখের ভাত প্রায় ছিটকে পড়বার উপক্রম হলো।

—হঠাৎ তোমার আবার হলো কি!

—আমার হাসি আরো অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল। কোনোমতে বললাম : তা মেয়েটার রকমসকম দেখে মনে হয়, আপনি যা বললেন, তাহলেও হতে পারে।

এবার আর নিহার ভাবি কোনো শাসন মানলেন না। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লেন। এইভাবে একটি একটি করে দিনও গড়িয়ে যেতে লাগল।

.

চিঠি এসেছে, আম্মা-আব্বা সকলেই কলকাতা ফিরে আসবেন। আব্বা অসুস্থ। আমাকে ঢাকা যেতে হবে, তারপর তাঁদের সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে। ইতিমধ্যে আব্বা মাদারীপুর থেকে ঢাকা বদলি হয়েছেন। চার দিন পরই আমি ঢাকা যাচ্ছি।

নিহার ভাবির অনর্গল কথা আর অবিরাম হাসির উৎস যেন শুকিয়ে গেছে। শীতের অপরাহ্ণের মতো এক প্রকার বিধুরতা তাঁর চোখ-মুখ গতিবিধি কাজকর্ম সব কিছুতেই আচ্ছন্ন করে আছে।

সেদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ কালো চুলে তেল মাখাতে মাখাতে তিনি বললেন : তোমাকে পেয়ে আমি বেঁচে গিয়েছিলাম।

—কি রকম।

—এই নির্বান্ধব পাড়ায় নিঃসঙ্গ জীবন যে কিভাবে কাটত আমিই জানি।

—লোকজনের সঙ্গে আলাপ হয়েই যাবে।

—তা যাবে।

তিনি আর কিছু বললেন না। তাঁর চোখ দুটি সজল হয়ে এলো। আমারও। আমি বললাম : এখানকার এ ক’টি দিন আমি কোনোদিনই ভুলব না।

নিহার ভাবি এ কথার কোনো জবাব দিলেন না। বললেন : যাই এবার। গা ধুয়ে আসি।

কাঁধে তোয়ালে আর পাট করা ধোয়া শাড়ি ফেলে তিনি গোসলখানায় প্রবেশ করলেন।

আমার মনটাও ভারি খারাপ হয়ে গেল। নিহার ভাবি সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে আমার যত্ন করেছেন। অত বড় হৃদয়ও হয় না। সত্য কথা বলতে কি এতটা যত্ন কোনোদিনই পাই নি। বসবার ঘরে একটি চেয়ারে লম্বা হয়ে এইসবই ভাবছিলাম। এক সময় টেলিফোন করবার জন্য জানালার ধারে উঠে এলাম। সেখানেই একটা ছোট্ট টেবিলের ওপর টেলিফোন রাখা আছে।

এমন সময় দেখি নিহার ভাবিও গোসলখানা থেকে বেরিয়ে আসছেন। পরনে একটি মাত্র শাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই। বোধ করি কাপড় ধুচ্ছিলেন, শাড়ি স্থানে স্থানে ভেজা। চুল খোলা। দু’হাতে সাবানের ফেনা।

–আবার বেরিয়ে আসতে হলো। ময়লা তোয়ালেটা ধোব, নিতে ভুলে গেছি।

আমি যেখানে দাঁড়িয়ে টেলিফোনটা হাতে তুলে নিয়েছিলাম, তিনিও তার বিপরীত পার্শ্বে দুই হাত দিয়ে গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

—কাকে টেলিফোন করছ?

মুহূর্তকাল জবাবের জন্য অপেক্ষা করে তিনি আবার তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। কোথায় যে টেলিফোন করব মনে করেছিলাম, ভুলে গেলাম।

.

দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানার ওপর একটু গড়িয়ে না নিলে নিহার ভাবির শরীর ভালো থাকে না। সেদিনও তিনি বিছানায় গা এলিয়ে বিশ্রাম করছিলেন।

প্রকাণ্ড বিছানা। আমি পাশে এসে দাঁড়ালাম। শয্যাশায়িনীর বেশবাস অবিন্যস্ত।

—শোবে ভাই, শোও না। পাশে অনেক জায়গা আছে।

আমিও পাশের বালিশটায় মাথা রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ঘুম কি কিছুতেই আসতে চায়! পাশে নিহার ভাবি পাশ ফিরে শুয়ে আছেন। মাঝখানে বেশ ব্যবধান। এবার তিনি আবার আমার দিকে পাশ ফিরলেন। আমার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। দ্রুত নিশ্বাসের তালে তালে নিহার ভাবির বক্ষ ওঠানামা করছিল। নিহার ভাবি চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন, বোধ করি ঘুমিয়েই পড়েছেন।

আমি হঠাৎ বিছানার ওপর উঠে বসলাম। ততোধিক অকস্মাৎ শক্ত করে তাঁর হাত চেপে ধরলাম। নিহার ভাবি বিশ্বের বিস্ময়-ভরা দুটি তন্দ্রাজড়িত চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। যেন দুঃস্বপ্ন দেখছেন, এমনই ভীত চকিত সন্ত্রস্ত এবং সর্বোপরি বিস্ময়াহত চোখ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আমাকে যেন তিনি চেনেন না—এই প্রথম দেখছেন।

একটি নিমেষ মাত্র। ধড়ফড় করে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। যে দুটি হাত দিয়ে তাঁর হাত ধরেছিলাম, প্রবল বেগে সেটি দূরে সরিয়ে দিয়ে তিনি উঠে বসলেন। এক মুহূর্তের জন্য তিনি বিহ্বল হয়ে গেলেন। তারপর দুটি হাত দিয়ে দ্রুত সর্বাঙ্গ ভালো করে ঢেকে নিলেন, মাথায় ঘোমটা তুলে দিলেন, তারপর উঠে চলে গেলেন। যাবার আগে কেবল বললেন : তোমার মনে এই ছিল?

তাঁর কণ্ঠে যে কি ছিল আমি আজও বোঝাতে পারব না। বিস্ময় না বিরক্তি না বেদনা না তিরস্কার—না কি সব কিছুরই একটা মিশ্রিত ব্যঞ্জনা কে বলবে।

এরপর আরো তিনদিন সেখানে ছিলাম; কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও নিহার ভাবির দেখা পাই নি।

চতুর্থ দিন সকালে চলে যাব। বাইরে ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ভালো করে তখন ও ফর্সা হয় নি। গাড়িতে সামান্য মালপত্র যা ছিল, তোলা হয়ে গেছে। আমি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছি, যাবার আগে একটিবার কি নিহার ভাবি সামনে আসবেন না। একটিবার!

জমির ভাইও পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমরা উভয়েই বহুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলাম, নিহার ভাবির অপেক্ষায়; কিন্তু তবু তাঁর দেখা নেই।

—নিহার! একটিবার বাইরে এসো। শাকের যাচ্ছে যে।… আসলে কি জান শাকের। আসতে চায় না কেঁদে ফেলবে বলে। তুমি জান না; কিন্তু আমি জানি, তোমাকে মায়ের পেটের ভাইয়ের চাইতেও ভালোবাসে।

এতক্ষণে দরজার কাছে ছায়া পড়ল। দেখলাম, নিহার ভাবি।

পরনে মোটা শাড়ি, মাথার ঘোমটায় কপালের অর্ধেকটা ঢাকা, গায়েরর পুরাহাতা ব্লাউজের আস্তিন হাতের কব্জি পর্যন্ত লম্বা। একেবারে গলা পর্যন্ত বোতাম লাগানো।

আমি এখনো যা করি নি আজ তাই করলাম।

এগিয়ে গিয়ে নত হয়ে পা ছুঁয়ে কদমবুসি করলাম। আমার চোখের এক ফোঁটা অশ্রু তাঁর পায়ের পাতার ওপর গড়িয়ে পড়ল। মুখ ফুটে যা বলতে পারলাম না, এক ফোঁটা অশ্রু তাই বলে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *