উত্তম পুরুষ – ১২

বারো

একেবারে অন্ধকার হয়ে গেছে। বাড়ি থেকে বেরিয়েছি গতকাল বিকেলবেলা, আর ফিরছি আজ রাত্রে। গতরাত্রে বাইরেই থাকব, আম্মাকে অবশ্য সে নোটিশ দেয়া ছিল; কিন্তু সে নোটিশে আজ সারাদিনের গতিবিধির কোনো ব্যাখ্যা নেই।

বেশ দূর থেকে আমাদের বাড়িটা দেখা যায়। বাড়িটা চোখে পড়তেই বুকটা ধড়াস করে উঠল। যতক্ষণ চোখের আড়ালে ছিল, বিপদও যেন দূরে ছিল; কিন্তু এবার একেবারে বিপদের মুখোমুখি। আর তো এড়ানো যাবে না। আমাদের বাড়ির ঠিক সামনের ল্যাম্পপোস্টটিতে এরই মধ্যে আলো জ্বলেছে। বাইরের বারান্দাটাও এবার দেখা যাচ্ছে। বারান্দায় একটা ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার পা আর অগ্রসর হতে অস্বীকার করে। দূর থেকে আমাকে দেখে ছায়াটাও স্থির হয়ে গেল।

আমি তবু ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম।

বারান্দার রেলিং ধরে আম্মা দাঁড়িয়ে আছেন।

সিঁড়ি দিয়ে বারান্দার ওপর উঠে এলাম, তারপর বারান্দার এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। উদ্যোগী হয়ে কোনো কৈফিয়ত দেয়ার প্রয়োজন হবে না জানতাম : তাই নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

—কোথায় ছিলি দু’দিন?

আমি জবাব তৈরি রেখেছিলাম। সবিস্তারে প্রশ্নটির জবাব দেয়ার উদ্যোগ করছি, এমন সময় আম্মা দু’হাত দিয়ে ইশারা করে আমাকে থামিয়ে দিলেন।

—চুপ চুপ। গোল করিস না। যা শিগগির হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে তৈরি হয়ে নে। তোর আব্বা এসেছেন।

—আব্বা এসেছেন!

বিপদ আশঙ্কা করছিলাম আম্মার কাছ থেকে; কিন্তু এ-যে একেবারে অপ্রত্যাশিত আর এক দিক থেকে বিপদ উপস্থিত। মনে মনে যত ভয়ই থাক, এ কথাও ভালো করেই জানতাম, চোখে কোনোমতে একবার অশ্রু টেনে আনতে পারলেই, আম্মার রাগ যাবে নিভে; কিন্তু আব্বার কথাই আলাদা। একে তো তিনি কলকাতায় আসেন কম। রাগ করেন আরো কম; কিন্তু একবার যদি তিনি রাগ করেন তো আর রক্ষে নেই। তখন প্ৰায় কেয়ামত হয়ে যায়।

সারাদিন বাইরে কাটিয়ে বাড়ি ফিরছি, এদিকে কোথা থেকে আব্বা হাজির। আমার ধড়ে তখন প্রাণ নেই।

অথচ আম্মার কাছ থেকে যে বিপদ আশঙ্কা করছিলাম, তার কিছুই দেখলাম না। বরং মনে হলো, আমার ভয় দেখে আম্মা কিছুটা কৌতুকই বোধ করছেন। আম্মার মেজাজ আশ্চর্য রকম প্রসন্ন। তাঁর মুখের হাসি এক দুর্লভ বস্তু; অথচ আজ তাঁর সারা মুখচোখ হাসছে।

—হয়েছে, বীরপুরুষ হয়েছে। পড়তে বসগে যা। উনি একটু আগেই এসেছেন।

আব্বা এসেছেন বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছিল। হাওয়ায় জবাকুসুম তেলের গন্ধ; আম্মা রান্নাঘরে ব্যস্ত; মেজ ভাইয়ের সদাই মুখরিত কণ্ঠ আজ স্তব্ধ। সবগুলো লক্ষণই একটি কথাই ঘোষণা করছে, বাড়িতে কর্তা আছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *